৩ মে ভোর বেলা ঘুম
থেকে ওঠার কোনও তাড়া নেই ভেবে জেগেই বিছানায় শুয়ে আছি। ঠাণ্ডা
ভালই আছে আর, একটা লেপ হলেও ভালই আরাম লাগছে বলে বিছানা
ছাড়তে ইচ্ছেও করছে না। হঠাৎ শুনলাম কল্যাণ আমায় ডাকছে, “কী
সুন্দর বরফের পাহাড় কত কাছে দেখা যাচ্ছে, দেখেছ ছোড়দা?”
বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়েই দেখি নীল আকাশে শরৎ কালের
মতো পেঁজা তুলো মেঘ আর পশ্চিম দিকের আকাশ জুড়ে তুষার শৃঙ্গের
সারি। কিছুক্ষণ সেই দৃশ্য হাঁ করে দেখতে থাকলাম, তারপর ঘরে
ঢুকে হ্যান্ডিক্যাম আর স্টিল ক্যামেরা দুই নিয়ে হাজির হয়ে
তাদের সদ্ব্যবহার করলাম। ইতি মধ্যে, হোটেলের মালিক বাইরে
বেরিয়েছেন, তাঁর কাছে জানলাম যে এই শৃঙ্গের নাম নীলগিরি
হিমাল ।
চিত্র-২৪
জোমসোমের হোটেল থেকে নীলগিরি হিমাল ছবিঃ লেখক
গত কাল রাত হয়ে গিয়েছিলো,
তাই দেখতে পাইনি আমাদের হোটেলের পিছনেই জোমসোম এয়র স্ট্রিপ
(চিত্র-২৫)।
আমাদের নীলগিরি দেখার
মধ্যেই প্রায় ৫:৩০ থেকে পর পর বেশ কয়েকটা বিমান যাত্রী নিয়ে
যাতায়াত করলো। বিমান গুলো ছোট, শুনেছি আসন সংখ্যা কুড়ির
কাছাকাছি। নীলগিরির ছবি নেওয়ার সঙ্গে বিমানের ওঠা ও নামা,
দুয়েরই ভিডিও ছবি নেওয়া গেল ।
যেহেতু সকাল ৮টা নাগাদ
জিপ চলাচল আরম্ভ হয়, আমরা ৭:৩০-এর কাছাকাছি জিপ স্ট্যান্ডের
দিকে যাব সেই হিসাবে প্রাতঃকৃত্য ইত্যাদি সারতে লাগলাম।
ইতিমধ্যে শুনলাম মাওবাদীরা তাদের পূর্ব ঘোষণা মতো রাস্তায়
অবরোধ আরম্ভ করে দিয়েছে, মাইক-এর আওয়াজ ভালই শোনা যাচ্ছিল
হোটেল থেকে। হোটেলের বেশ কাছেই তাদের অবস্থান ধর্মঘট চলছে।
সকাল ৭টা নাগাদ ক্যামেরাগুলো নিয়ে হোটেলের বাইরে গেলাম।
স্ট্যান্ডে গোটা দুয়েক বাস দাঁড়িয়ে আছে, এদিক ওদিক কয়েকজন
স্থানীয় লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর দশ বারো জন মাওবাদী দলের
সদস্য পতাকা নিয়ে রাস্তার ওপর বসে বা দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাশেই
একটু উঁচুতে বেশ বড় একটা বেকারি। তার চত্ত্বরে আরও কিছু
মহিলা, পুরুষ ও শিশুরা উৎসবের মেজাজে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে
(চিত্র-২৬)।
চিত্র-২৬
জোমসোমে বন্ধ উপভোগ ছবিঃ অজয় মান্না
সেখানেই মাইক লাগানো
আর তাতে গান হচ্ছে, ভাষা বোঝা না গেলেও গানের সুর থেকে পরিষ্কার
যে বিরোধের কথাই তাতে আছে। অজয়দা সকাল বেলাই একবার হোটেলের
সামনেটা একবার ঘুরে গিয়েছিলেন, অবরোধ আরম্ভ হবার আগেই। তখন
এই অঞ্চলের কয়েকটা ছবি তুলেছিলেন (চিত্র-২৭, ২৮ ও ২৯)। ছবি
গুলো এই ছোট্ট শহরের এই অংশের ভালই বর্ণনা করে।
আমাদের মধ্যে ৩৫ বছরের
অচিন্ত্য, পৈতৃক ও নিজস্ব ব্যবসা আছে, বেশ শান্ত ভাবে সকলকার
সঙ্গে কথা বলে নিজের কাজ উদ্ধার করতে দারুণ পটু। লক্ষ্য
করলাম সে মাওবাদীদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা বলছে। কয়েক
মিনিটের মধ্যে আমার কাছে এসে ও যা বলল তার সারমর্ম হলো যে
আমি এখানকার মাওবাদী দলের নেতার সাক্ষাৎকার ভিডিও রেকর্ড
করব কি না। আমি তৎক্ষণাৎ রাজি। প্রায় মিনিট ১০ সাক্ষাৎকার
নিলাম, মুস্তাঙ মুক্তাঞ্চলের মাওবাদী দলের সম্পাদক, কৃষ্ণ
প্রসাদের (চিত্র-৩০)।
চিত্র
৩০ সাক্ষাৎকার ছবিঃ অজয় মান্না
মুস্তাঙ, নেপালের উত্তর
সিমান্তের একটি জেলা আপনাদের আগেই বলেছি, তবে ইনি কেন মুক্তাঞ্চল
বললেন, জানি না। লাগোয়া তিব্বতকে চীন স্বশাসিত অঞ্চল আখ্যা
দিয়েছে, তার প্রভাবে এই নাম কি না কে জানে। বন্ধের কারণ
থেকে আরম্ভ করে নেপালের মাওবাদীদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের
মাওবাদীদের যোগাযোগ, বন্ধের কারণ, অন্তর্রাষ্ট্রীয় সখ্যতা
এবং শেষে আমাদের অর্থাৎ তীর্থযাত্রী ও ট্রেকারদের এই বন্ধের
ফলে দুর্ভোগ সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করে তাঁর বক্তব্য রেকর্ড
করলাম। এই সমস্ত বিষয়ে নেপালের মাওবাদীদের মনোভাব আপনারা
খবরের কাগজে পড়েই থাকেন, তা সত্বেও তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম
আপনাদের সামনে উপস্থিত করেছি ভিডিওতে। আমাদের, অর্থাৎ, মুক্তিনাথ-যাত্রীদের
ব্যাপারে নাকি তাঁরা পরিষ্কার, যে এই যাত্রায় কোনও বাধা
সৃষ্টি হবে না। তখনকার মতো নিশ্চিন্ত হলাম, তবে তাঁর সেই
আশ্বাস-বানী আমার রেকর্ডে তোলা হয়নি ।