প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিষ্ণুধাম মুক্তিনাথ (সূচী)

-৭-

শেষ পর্যন্ত মুক্তিনাথ মন্দিরের নিচে এবং প্রায় ৫০০ মিটার আগে এক জায়গায় পৌঁছলাম, নাম রানিপৌয়া, কোনও এক রানি যাত্রীদের রাত্রিবাসের জন্যে ধর্মশালার নির্মান করেছিলেন এখানে, সেই কারণে এই নাম। সময় লাগলো প্রায় দু ঘন্টা, অর্থাৎ পৌঁছলাম ১:১০ মিনিটে। এখানে পৌঁছে আমার মনে হলো এই ১৯ কিমির কিছু বেশি এমন পথ আসতে দু ঘন্টা লাগা খুব একটা বিস্ময়ের কথা নয়। এই জায়গা পর্যন্তই জিপ এসে থাকে ।

আমাদের জিপ থামবার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ কয়েকজন যুবক মোটর-সাইকেল আরোহী আমাদের প্রায় ঘিরে ধরলো মালা পরিয়েই দেয় প্রায়। কী ব্যাপার? না, তারা মন্দিরের ঠিক নিচ পর্যন্ত নিয়ে যাবে, যাত্রী ইচ্ছা মতো সময় সেখানে কাটিয়ে আবার যে কোনও মোটর-সাইকেলে ফিরে আসতে পারে। মালা, মানে সুতোয় বাঁধা মেডালের মতো একটা চাকতি, যা যাত্রীর যাতায়াতের পুরো ভাড়া মিটিয়ে দেওয়া প্রমাণ করবে। যাতায়াতের ভাড়া একজনের ভারতীয় মুদ্রায় ৩০০ টাকা (নেপালি মূদ্রায় নেওয়া ওরা পছন্দ করে না)। এ পর্যন্ত যে কোনো স্তরের বাস বা জিপ ভাড়ার থেকে অনেক বেশি। ওরা নিয়ে যাবে যাতায়াতে মোট প্রায় ১কিমি পথ যা আবার এমন কিছু উচ্চ নয়। ওরা এমন করে, যে যাত্রীরা ভয় পেয়ে যায় আর ভাবে যে ভীষণ কষ্টকর পথ, তারা নিশ্চয় হাঁটতে পারবে না।

আমাদের ইচ্ছা ছিল মন্দিরের পাশে নাকি কিছু থাকবার জায়গা আছে সেখানে রাতে থাকবো। তাই সেই হিসাবে তৈরি হয়েই এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে জানতে পারলাম রাণিপৌয়াতেই জায়গা আছে আর মন্দিরের পাশে নেই। তাই ওখানে থাকার চিন্তা ত্যাগ করলাম, তবে সঙ্গের জিনিসগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার মানে হয় না, তাই একটা হোটেলের বারান্দায় রেখে দিলাম। হোটেলের কর্ত্রী বিনা পয়সাতেই সেগুলো রাখতে দিলেন। এই বার আবার জিপ স্ট্যান্ডে ফিরে এসে আমাদের মধ্যে কয়েকজন মোটর-সাইকেল করে চলে গেল আর আমরা বেশির ভাগ, হাঁটা আরম্ভ করলাম। জিনিস-পত্র গুলো রাখার ব্যবস্থা করার কারণে এই অংশের যাত্রা শুরু করতে আমাদের কিছু দেরি হয়ে গেল।

যাক, আমরা এখন হাঁটতে থাকি আর আপনারা এই মন্দির আর সেখানে প্রতিষ্ঠিত দেবতাদের ইতিহাস মনে করে নিন। স্থানের ভূগোল আগেই কিছু জেনেছেন। নেদারল্যান্ডের য়্যামস্টারডামে অবস্থিত মুক্তিনাথ ইন্টারন্যাসানাল ফাউন্ডেসন অনেক প্রামাণ্য বই-এর সাহায্য নিয়ে মুক্তিনাথের ইতিহাস লিখেছে। এখন সেই ইতিহাসের সারমর্ম আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত করছি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে যথাক্রমে উমাপ্রসাদবাবু তাঁর বই ‘মুক্তিনাথ’-এ, আর শ্রীঅশোক রায় ‘শালগ্রাম শিলার সন্ধানে’-তে মুক্তিনাথের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তবে আমার মনে হয়েছে যে এই ফাউন্ডেসনের লেখা ইতিহাসে অনেক বেশি প্রামাণ্যতার চিহ্ন ও ধার্মিক প্রভাব থেকে অনেকটা মুক্ত (Secular)।

মুক্তিনাথ মন্দির দুইটি ভিন্ন ধর্মের সহাবস্থানের এক জাজ্বল্যমান প্রতীক। এক বৌদ্ধ ভিক্ষুণির তত্ত্বাবধানে এক হিন্দু ব্রাহ্মণ দ্বারা অত্যন্ত সরল ভাবে বিষ্ণুর পূজার্চনা করা হয়। হিন্দু মন্দিরের মত কিন্তু এখানে পাণ্ডার কোনও উপস্থিতি নেই। পূজারি বিগ্রহের পাশে দাঁড়িয়েই থাকেন কেবল। যাত্রী নিজেই তাঁর ইচ্ছা মত পূজা করতে পারেন। বৌদ্ধরা এই মন্দিরকে বৌদ্ধ মন্দির চুমিগ গ্যাত্‌সা বলে থাকেন। আগের ভিডিওতে আপনারা মন্দিরের প্রথম তোরণের উপর নেপালি ভাষায় এই নাম লেখা আছে, দেবনাগরী অক্ষরে। বৌদ্ধদের মতে চুমিগ গ্যাত্‌সা ডাকিনীদের মন্দির, অর্থাৎ এই স্থান চব্বিশটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক পিঠের একটি পিঠ। পদ্মসম্ভব এবং অনেক মহাসিদ্ধগণের আশীর্বাদধন্য এই পিঠ। বৌদ্ধদের বিশ্বাস যে গুরু রিম্পোচে, অর্থাৎ পদ্মসম্ভব এখানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। তাঁরা বলেন যে মন্দিরের বিগ্রহ অবলোকিতেশ্বরের। তিব্বতী মহান যোগি শবকর ১৮১৮ সালে এই মন্দিরে কিছুকাল বাস করে যান।

যাই হোক, বর্তমান মন্দির খুব একটা প্রাচীন নয়, মাত্র ১৮১৫ সালে গঠিত। তার অগে এখানে মন্দির আদৌ ছিলা কি না তার কোনও প্রামাণ্য নথি নেই। অবশ্য বলা হয় যে স্বামী রামানুজ নাকি এইখানে গত সহস্রাব্দের প্রথমে এসেছিলেন। উনি এসেছিলেন বলেই যে সেখানে কোনও মন্দির থাকতে হবে, এমন ভাবার কারণ নেই। এই স্থানই শালগ্রাম, এই বিচার করে নেপালের এক রানি, সুবর্ণপ্রভা বর্তমান এই মন্দির স্থাপন করেন। অনেকে বলেন এই মন্দির নাকি স্বয়ম্ভু, স্বয়ম্ভু শিব লিঙ্গের কথা আমরা শুনি, মন্দিরও স্বয়ম্ভু হতে পারে? এই রকম নাকি আরও সাতটি মন্দির আছে, যেগুলির নাম শ্রীরঙ্গম, শ্রীমুষনাম, তিরুপাতি, নৈমিসারণ্য, থোটাদ্রী, পুষ্কর ও বদরিনাথ। ১০৮ টি বৈষ্ণব ধামের মধ্যেও এই মন্দির গণ্য করা হয়।

অনেকে মনে করেন যে কালী গণ্ডকী নদীর উৎস দামোদর কুণ্ড অথবা তার আশপাশে কোনও এক গুহায় শালগ্রাম বা বিষ্ণুর অবস্থান। এই বিশ্বাসের দুটো প্রধান কারণ উল্লেখ করা যায়। প্রায় সমস্ত হিন্দু তীর্থস্থানের মন্দির নদীর ধারেই হয়ে থাকে। কিন্তু মুক্তিনাথ মন্দির কালী গণ্ডকী নদী থেকে বেশ কিছু দূরে অবস্থিত। দ্বিতীয় প্রধান কারণ বলা যেতে পারে যে আর আর তীর্থস্থানের মতো মুক্তিনাথের উল্লেখ মহাভারত বা পূরাণে নেই। মনে আছে নিশ্চয় সেই বিখ্যাত উক্তী, “যাহা আছে ভারতে তাহা আছে ভারতে?” অবশ্য বরাহপূরাণে মুক্তিক্ষেত্র নামে এক স্থানের কথা আমরা প্রথম উল্লেখ পাই। অনেকেই মুক্তিনাথ মন্দিরের স্থানকেই মুক্তিক্ষেত্র বলে থাকেন। তবে এই পূরাণের ১৪৪ খণ্ডের ১২২ শ্লোকে বলা হয়েছে যে এই ক্ষেত্র পাহাড়ের কোনও স্থানে নয়, গণ্ডকী নদীর ধারে অবস্থিত। বর্তমান মন্দির কিন্তু, যেমন আগেই বলা হয়েছে যে গণ্ডকী বা কালী গণ্ডকী নদীর ধারে নয়।
এ ছাড়া মুক্তিক্ষেত্র বা শালগ্রাম ও মুক্তিনাথ বা চুমিগ গ্যাত্‌সা যে ভিন্ন, তা বরাহপূরাণের উপরোক্ত খণ্ডের ১৮২ শ্লোকে উল্লিখিত আছে। এই শ্লোকে লিখিত যে দুই স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব পঞ্চদশ যোজন (= প্রায় ১৯৫কিমি), অথচ বাস্তবে মুক্তিনাথ মন্দির থেকে কালী গণ্ডকী নদীর দূরত্ব অনেক কম দূরত্ত্বে, মাত্র কয়েক কিলোমিটার।

পূরাণে মুক্তিক্ষেত্রে শালগ্রাম সর্বাধিক পুণ্যস্থান বলা হয়েছে, এবং শালগ্রাম শিলার প্রধান বা প্রায় একমাত্র উৎস দামোদর কুণ্ড। কালী গণ্ডকী নদীতে পাওয়া শালগ্রাম শিলা নাকি এই কুণ্ড থেকেই নদীর স্রোতে নিচে নেমে আসে। এই কুণ্ড মুক্তিনাথ মন্দির থেকে সত্যই অনেক দূরে আর বিশেষ কষ্টকর পথও বটে। তাই মনে হয় দামোদর কুণ্ডই প্রকৃত মুক্তিক্ষেত্র। এই প্রসঙ্গে সঙ্গের মানচিত্রটি (চিত্র-১) দেখা যেতে পারে।

চিত্র-১, পোখরা-মুক্তিনাথ ও অন্নপূর্ণা পরিক্রমা পথের মানচিত্র

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ইতিহাস স্বীকার্য কি না, তা আমার জানা নেই তবে এর থেকে বেশি তথ্য যোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

জোমসোমের জিপ স্ট্যান্ডে অপেক্ষার সময় মুক্তিনাথগামী অনেক দক্ষিণ-ভারতীয় যাত্রীর কথা বলেছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে এর এক ঐতিহাসিক কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। আগেই উল্লেখ করেছি যে পরম বৈষ্ণব ও বিশিষ্টাদৈতবাদের প্রবক্তা স্বামী রামানুজ (খৃষ্টাব্দ ১০১৭-১১৩৭) শালগ্রাম বা মুক্তিনাথে নাকি এসেছিলেন। এ ছাড়া দক্ষিণ ভারতের অন্তত আরও দুই বিখ্যাত ধর্মগুরু বা আলওয়ার, নাম্মলওয়ার ও থিরুমঙ্গল তাঁদের রচিত বিষ্ণুস্তবে মুক্তিনাথের প্রশস্তি গেয়েছেন। প্রধানত এনাদের মুক্তিনাথ প্রশস্তির কারণেই আজও দক্ষিণ-ভারতীয়দের উত্তর-ভারতীয়দের থেকে এখানে তীর্থযাত্রার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

ড. শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।