রাণিপৌয়া থেকে মন্দিরের
দিকে হাঁটা পথে আমি এগোতে এগোতে আপনাদের ইতিহাসের চিন্তা
করতে বলেছিলাম। এবার আমি আপনাদের আবর্ত সম্পূর্ন করিয়ে দিয়ে
সোমে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। হাঁটা আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গেই টিপ্
টিপ্ করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করলো। প্রথম দিকে কিছুটা মাটির
পথ, মোটামুটি সমতল। আশপাশে বেশ কিছু হোটেল আর তার সামনে
চৌকি বিছিয়ে শালগ্রাম শিলা, ছবি, মালা, পাথরের বিভিন্ন মূর্তি
সাজিয়ে বিক্রি করার জন্যে প্রধানত তিব্বতী মহিলারা বসে দাঁড়িয়ে
আছেন। শালগ্রাম শিলা দেখা ও কেনার খুব ইচ্ছে, তবে আগের কাজ
আগে এই ভেবে তাড়াতাড়ি হাঁটতে থাকলাম। এমন কি ছবি পর্যন্ত
তুলতে পারলাম না বৃষ্টির কারণে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পথের
ওপর মন্দিরের প্রথম তোরণ পার হলাম (চিত্র-৪৬, চিত্র-৪৬ক-এ
অনিরুদ্ধ বাবুর তোলা ছবি)।
চিত্র
৪৬ রানিপৌয়া-মুক্তিনাথ পথে প্রথম তোরণ। ছবি - লেখক
চিত্র ৪৬ রানিপৌয়া-মুক্তিনাথ
পথে প্রথম তোরণ। ছবি - শ্রী অনিরুদ্ধ হীরা
কিছু পর থেকে মাটির
বদলে পাথর ছড়ানো পথ আর তা বেশ উঁচুতে উঠতে আরম্ভ করলো। বৃষ্টির
কারণে দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না, শুনেছি এখান থেকে দক্ষিণে
অন্নপূর্ণা শ্রেণির কিছু শৃঙ্গ আর দক্ষিণ-পশ্চিমে ধৌলাগিরি
শৃঙ্গ দেখা যায়। গাছ-পালা একদম নেই। মিনিট দশেকের পর মন্দিরের
বিরাট তোরণ (চিত্র-৪৭, চিত্র-৪৭ক-এ আবার অনিরুদ্ধ বাবুর
তোলা ছবি) পার হলাম এবং তার পর পাথরের সিঁড়ি (চিত্র-৪৮,
চিত্র-৪৮ক, অনিরুদ্ধবাবুর তোলা ছবি)।
চিত্র
৪৭ মন্দিরের প্রধান তোরণ। ছবি - লেখক
চিত্র
৪৭ মন্দিরের প্রধান তোরণ। ছবি - শ্রী অনিরুদ্ধ হীরা
চিত্র
৪৮ প্রথম তোরণের পর সিঁড়ি। ছবি - লেখক
চিত্র ৪৮ প্রথম
তোরণের পর সিঁড়ি। ছবি - শ্রী অনিরুদ্ধ হীরা
মনে হলো প্রায় এক ’শ
সিঁড়ি, তবে ধাপের উচ্চতা বেশি নয়। এইখানে দু পাশে সার দিয়ে
বেশ বড় বড় গাছ, এই সময় পাতা প্রায় নেই। মনে হলো এগুলো ওক
গাছ আর নিশ্চয় লাগানো হয়েছে, প্রাকৃতিক নয়। এদিকে অবশ্য
পিপল, অর্থাৎ, এক ধরণের পপ্লারের (অশ্বত্থ নয়) আধিক্য আছে,
তবে এই গাছগুলোর কাণ্ডের আকৃতি দেখে পিপল কি না সন্দেহ হল।
চিত্র
৪৯ মন্দির চত্বরে ওঠার জন্যে রেলিং দেওয়া সিঁড়ি। ছবি - লেখক
সিঁড়ির ধাপ শেষ হতে
সামনে দেখি পাহাড়ের গা সমান করার জন্যে ক্যান্টিলিভার করে
সিমেন্টের ছাদ এবং সেখানে ওঠার জন্যে রেলিং দেওয়া সিঁড়ি
(চিত্র-৪৯)। তা হলে এতদিনের আশা পূর্ণ হতে চলেছে, এই ভেবে
সামনে দেখি সেই বহুদিন ধরে ছবিতে দেখা প্যাগোডা। হাঁ প্যাগোডা
কি কেবল মাত্র বৌদ্ধ, কনফুসিয়াস ইত্যাদি ধর্মেই হবে, হিন্দু
ধর্মে হতে পারে না? হঠাৎ মনে পড়ল, তাইতো, এই মন্দির তো বৌদ্ধ
মন্দিরও বটে? যাক্, এসব তত্ত্ব কথা ভাবার সময় এখন নয়, যাই
মন্দির চত্বরে। সেই রেলিং দেওয়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে প্রায় মন্দিরের
তলে এসে পড়লাম।
এই সময় লক্ষ্য করলাম
যে আমার কন্যা শুভ্রমালার ষ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে উচ্চতার
কারণে বায়ুতে অক্সিজেনের অভাব হয়েছে বলে। ও তাই মন্দির চত্বরে
খুব কম চলাফেরা করেছিল। মন্দির প্রায় ২৫মিটারের বর্গাকৃতি
তিন ধাপের চত্বর। সামনের ধাপে পাশাপাশি দুইটি কুণ্ড, এগুলোও
৪/৫মিটারের বর্গাকৃতি। পরের ধাপে মন্দির। মন্দির অবশ্য আবার
এক ১০/১২মিটার বর্গাকার ঘেরা চত্বরের মাঝে (চিত্র-৫০ ও ৫০ক)।
চিত্র
৫০ মুক্তিনাথ মন্দির। ছবি - লেখক
চিত্র
৫০ ক মুক্তিনাথ মন্দির। ছবি - শ্রী অনিরুদ্ধ হীরা
আগেই বলেছি, মন্দির
প্যাগোডা শৈলীতে নির্মিত ও তিন তলা। উপরের তলা ক্রমশঃ ছোট
আকারের। শীর্ষে পরস্পর ছোট হয়ে যাওয়া পিতলের কলশ এবং তারও
উপরে ত্রিকোণ পতাকা। ছাদগুলো কালচে-লাল রং করা টিনের, অবশ্য
রোদ-বৃষ্টির জন্যে লাল রংই ওই রূপ নিয়ে থাকতে পারে। ছাদগুলো
খুব একটা ঢালু নয়। বৃষ্টির কথা বলতে খেয়াল হলো যে উপস্থিত
বৃষ্টির বেগ ভালই। সঙ্গে হাড় হিম করা বাতাস দোসর রয়েছে।
শেষ ধাপের শেষ প্রান্ত সরল রৈখিক নয়, অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালে
ঘেরা। দেয়ালের মাথা থেকেই পাহাড় উঠে গেছে, যদিও বিশেষ উঁচু
নয়। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে সেই পাহাড়ে বেশ কিছু বড় গাছ
রয়েছে এবং এগুলোতেও এখন পাতা বেশি নেই। ওখান থেকে বোঝা যাচ্ছিল
যে মন্দির চত্বর পাহাড়ের ঢালেই গঠিত, এবং এই কারণে চত্বরের
সামনের দিকটা পিছনের সঙ্গে প্রায় একই সমতলে আনার জন্যে ক্যান্টিলিভারের
উপর বারান্দা করা আছে। যার বর্ণনা আগেই করেছি। পিছনের দেয়ালের
মাথা থেকে সম্পূর্ণ দৈর্ঘটাতেই প্রায় আধ মিটার অন্তর এক
মিটার দৈর্ঘের ১০৮টি নল লাগানো রয়েছে।
চিত্র
৫১ মকরাকৃতি ও গোমুখকৃতি নল। ছবি - লেখক
বাঁ দিকের প্রথমটা
ছাড়া প্রত্যেকটি নলের মুখ গরুর মুখের আকৃতির (চিত্র-৫১)।
প্রথমটা, আমার মনে হলো সম্ভবত মকরের, মুখাকৃতিতে ক্রোধ ভালই
প্রকাশ পাচ্ছে। উমাপ্রসাদবাবু লিখেছেন, “প্রাঙ্গনের প্রাচীরের
গায়ে সারি সারি নানাবিধ জীবজন্তুর- মকর, গরু, ঘোড়া, হাতি,
সিংহ, হরিণ প্রভৃতির মুখের আকারের গড়া পাথরের নল বসানো।”
ওই ১০৮টি নল থেকে বেশ ভাল পরিমাণেই জল পড়ছে, উষ্ণতা প্রায়
হিমাঙ্কের কাছাকাছি। পাহাড়ের উপরের এক খোলা থেকে জল নালা
করে নিয়ে এসে এই নলগুলোতে সংযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এই জল
নিচে কাগবেণীতে কালী গণ্ডকীতে গিয়ে মিশে যাচ্ছে কৃষ্ণা নাম
নিয়ে।
১০৮ সংখ্যাটির কিছু
ধার্মিক বৈশিষ্ট্য আছে। ১২টি রাশি ও ৯টি গ্রহ মিলে ১০৮ রকম
সংযোগ বা সমবায় হয়। আবার ২৭টি নক্ষত্র এবং ৪টি পদ মিলেও
সেই ১০৮ সমবায়ই হয়। সম্ভবত এই ১০৮টি জলের উৎসের কারণেই তিব্বতী
বৌদ্ধদের কাছে এর নাম চুমিগ গ্যাত্সা হয়েছে, কেননা তিব্বতী
এই শব্দে শত জলের ধারাকে বোঝানো হয়।
এতক্ষণ মন্দির এবং
চত্ত্বরের গঠন বোঝার চেষ্টায় আমার সহযাত্রীদের কথা মনেই
পড়েনি। এবার তাঁদের লক্ষ্য করতে আরম্ভ করলাম। চত্বরের বাঁদিকে
দোতলা এক বাড়ি রয়েছে, যাত্রীদের বিশ্রামের জন্যে (আগের ভিডিওতে
দেখানো আছে)। সেই বাড়ির সামনেই আমার স্ত্রী ভারতীকে দেখলাম
সে স্নান করার জন্যে তৈরি। মন্দিরে পূজা করার আগে বা তীর্থ
স্নান করা এক সাধারণ আচার। যদিও এখানে এখন ভীষণ ঠাণ্ডা এবং
তার সঙ্গে বৃষ্টিও পড়ছে, কিন্তু ভারতীকে স্নান না করতে দেওয়ার
চেষ্টা আমি স্বপ্নেও করতে পারি না। সে গোমুখেও স্নান করেছে।
তবে এখানে এর এক বিশেষত্ব আছে। ওই ১০৮টি নলের জলেই পরস্পর
স্নান করাই হলো এখানকার রীতি। শুধু এতেই শেষ নয়, প্রথমেই
যে দুটি কুণ্ডের কথা বলেছি, সেই দুটিতেও এর পর স্নান করতে
হবে। লক্ষ্য করলাম যে ওই জল আবার নলে করে কুণ্ড দুটিতে নিয়ে
আসা হয়েছে। শুনেছি অনেক দিন আগে নাকি নলের এই জল নিচে এক
ধর্মচক্র ঘোরাবার কাজে ব্যবহার হতো। এই জলধারা কৃষ্ণা নদী
নামে কাগবেণীতে কালী গণ্ডকী বা নারায়ণীতে মিশে যাচ্ছে আগেই
বলেছি।
আমার এই সমস্ত চিন্তার
মঝে ভারতী কুমিরের মুখ থেকে পড়া জল থেকে আরম্ভ করে পরস্পর
গরুর মুখের থেকে পড়া জলধারা বরাবর ছুটে চলেছে আর একটু পিছনেই
গীতা তার বৌদিকে অনুসরণ করে দৌড়চ্ছে। আমার সহকর্মী, সুজিত
রেজ সেই দৃশ্যের ভিডিও রেকর্ড করে চলেছে। কিছু পরেই কল্যাণ
, হীরামোহন, আমার প্রাক্তন সহকর্মী বলরাম, আমার ভগিনীপতি
কমল ও শেষে দেখি ৭২ বছরের অজয়দাও ১০৮ নল থেকে পড়া জল মাথায়
নিতে নিতে ছুটেছেন। তারপর আবার কুণ্ড দুটিতেই স্নান তো আছেই।
আমি তো ভারতী স্নানের জন্যে তৈরি দেখেই শীতে কাঁপছিলাম,
ওরা কি করে স্নান করতে পারলো ওরাই জানে।
চিত্র ৫২ গর্ভ
গৃহের সামনে ভক্তগণের ভীড়। ছবি - লেখক
আমি মন্দিরে পৌঁছেছিলাম
প্রায় ২টার সময় । সেই সময় জোমসোমে যে সমস্ত দক্ষিণ-ভারতীয়দের
দেখেছিলাম, তাঁরাই মন্দির চত্বর আর মন্দিরের গর্ভ গৃহের
সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিলেন (চিত্র-৫২)। তাই তখন বিগ্রহ
দর্শণ আমি করতে যাইনি। এইবার মন্দিরের দরজার সামনে এলাম।
বড় দরজা, সমস্তটাই রুপার পাতে মোড়া। সুন্দর কারুকার্জ, লতা
পাতা ও বিভিন্ন জ্যামিতিক নক্সা করা। তার সঙ্গে বিষ্ণু,
সরস্বতী ইত্যাদির মূর্তি দেখতে পেলাম। প্রত্যেকটি কাজই সূক্ষ্ম
।
ভারতী তার স্বভাব
অনুসারে “ষোড়শোপচারে” পুজা দেবার জন্যে সমস্ত “উপাচার” বাড়ি
থেকে বয়ে নিয়ে এসেছিল। স্নানের পর সেই উপাচার সাজাতে বেশ
সময়ই লাগছিল। ইতিমধ্যে তার দেবর কল্যাণ বলে গেল যে মন্দির
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি করে মন্দিরে গেলাম। সত্যই
তখন মন্দির বন্ধ, কিন্তু বাইরে লামার লাল পোষাক পরিহিতা
এক ভিক্ষুণী দাঁড়িয়ে আছেন। মনে পড়ল উমাপ্রসাদবাবুর লেখায়
পড়েছি বৃদ্ধা বৌদ্ধ ভিক্ষুণীর কথা, যাঁর তত্ত্বাবধানে মন্দিরে
বিষ্ণুর পূজা হয়ে থাকে। আমি বুঝতে পারলাম যে ইনিই তাহলে
বর্তমানে সেই কাজ করছেন। আমি তাঁকেই বললাম যে আমার স্ত্রী
পূজাপোকরণ নিয়ে আসছেন। উনি অভয় দিলেন যে মন্দিরের দরজা তিনি
খুলে দেবেন, আমি যেন তাড়াতাড়ি পূজারিনিকে নিয়ে আসি।