তখন প্রায় ৩টে, ভারতী,
গীতা আর কন্যা শুভ্রমালাকে নিয়ে আমি মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ
করলাম। সেই ভিক্ষুণী আর আমরা ছাড়া সেখানে আর কোনও মানুষ
নেই তখন। যে হিন্দু পূজারির কথা আমি শুনেছিলাম তিনিও অনুপস্থিত।
আমার সামনেই স্মিত হাস্যমান পীত বর্ণের শান্ত, সমাহিত, পদ্মাসনে
অধিষ্ঠিত পিতলের মূর্তি (চিত্র-৫৩)।
চিত্র
৫৩ মুক্তিনাথ (মন্দির থেকে কেনা ছবি)
আমি আর তাঁর মাঝে আর
কেউ নেই। মুহূর্তের জন্যে আমি আর আমার মধ্যে রইলাম না, অদ্ভুত
এক শান্তি আমাকে যেন ঘিরে ধরল। আমি অপলক নয়নে তাঁর দিকে
তাকিয়ে আছি। উপরের দুই হাতে সঙ্খ ও চক্র, নিচের দুই হাত
শ্বেত বস্ত্রে ঢাকা। তাঁর সামনে পাশাপাশি বেশ বিরাট তিনটি
শালগ্রাম শিলা রাখা। দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীদেবী, বাঁ
দিকে, আর ডান দিকে ভূদেবী বা পৃথিবী। সামনে নিচে কুবের আর
গরূড়। তাঁর মাথায় মুকুট আর তার উপরে সাতটি ফনা বিস্তার করে
শেষনাগের অবস্থান। আমায় এখানে আসার পথে কিছু কষ্ট সহ্য করতে
হয়নি, তা সত্ত্বেও এমন অপার্থিব অনুভূতি, তা হলে আগে যাঁরা
প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করে এই মন্দিরে এসে প্রবেশ করতেন, তাঁদের
অনুভূতি কেমন হতো? আসলে অভিষ্ট লক্ষ্যে মানুষ যখন পৌঁছায়
তখন তার মন আনন্দে আপ্লুত হয়ে যায়, আর তা যদি হয় কষ্টসাধ্য,
মন তখন আনন্দের চরম উৎকর্ষ লাভ করে। তাছাড়া স্থান মাহাত্ম
তো আছেই। আর
আনন্দাশ্রু কাকে বলে, এমন করে বোধ হয় আর কখনো আমি প্রত্যক্ষ
করিনি। প্রথম বার অমরনাথ গুহায় যখন বিরাটাকার তুষারলিঙ্গ
দেখেছিলাম তখন আমার স্বতস্ফূর্ত আনন্দাশ্রু এসে গিয়েছিল
বিশেষ করে তুষার ও বৃষ্টির মধ্যে প্রচণ্ড কষ্টে লক্ষে পৌঁছাতে
সফল হয়েছিলাম বলে। এখানে কিন্তু বিগ্রহ দেখতে পাওয়ার জন্যে
এই আনন্দাশ্রু নয়। কারণ – অপলক নয়নে বিষ্ণু মূর্তি দর্শন
করতে করতে সম্বিৎ ফিরে পেলাম ভারতীর কণ্ঠে যখন শুনি,
প্রায় শোনাই গেল না,
সে কান্নায় সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ল বলে। আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে
কি স্থির থাকতে পারি? এর পর বিষ্ণুর শ্বেত শুভ্র বস্ত্র
সরিয়ে পদযুগল আমরা স্পর্শ করে নিজ নিজ মাথায় হাত রাখলাম।
সেই সুযোগে নিচের দুই হাত দেখতে পেলাম দুই হাঁটুর উপরে রাখা।
ডান হাতে প্রস্ফুটিত পদ্ম আর বাঁ হাতে গদা ধারণ করে আছেন,
অর্থাৎ সঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্মধারী বিষ্ণুর আদি ও অকৃত্রিম
রূপ। মনে পড়ে যে উমাপ্রসাদবাবু লিখেছেন, “মন্দিরের বিগ্রহ
প্রকৃতই নারায়ণ মূর্তি, অথবা, বোধিসত্ত্বের মূর্তি-এ বিষয়েও
মতভেদ আছে।” চার হাত বিশিষ্ট আর সেই হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী
বোধিসত্ত্বের মূর্তি দেখা যায় কি না, আমার জানা নেই। অবলোকিতেশ্বরের
মূর্তি কি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী?
ভারতীর অবস্থা দেখে
মনে হল ভিক্ষুণীও বিচলিত হয়েছেন। তিনি তিন মহিলাদের হাতে
বিষ্ণুর পায়ের কাছ থেকে বিশেষ কিছু নিয়ে দিলেন। সেগুলো যে
কী, আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করিনি। তিন মহিলাই বিষ্ণুর জন্যে
পীত বস্ত্র নিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা ভিক্ষুণীর হাতে সেগুলো
দিতে গেলে নিজেরাই দেবতাকে তা পরিয়ে দিতে বললেন তিনি। প্রত্যেকে
খুবই ভক্তিপূর্ণ মনে সুন্দর করে সেগুলো দেবতার অঙ্গে জড়িয়ে
দিলেন। পীত শরীরে পীত অঙ্গবস্ত্র যেন “সোনার হাতে সোনার
কাঁকন।“ আমার দুঃখ হল যে সেই অপরূপ দৃশ্যের ছবি নিতে পারলাম
না, কারণ সমস্ত মন্দিরের মত এখানেও মন্দির চত্বরে ছবি তোলা
বারণ। যা করার বারণ নেই, তা বোধহয় কোনও মন্দিরে পাওয়া যায়
না। নিজেরাই পূজা করা যায় আর যায় বিগ্রহ স্পর্শ করা, ইচ্ছা
করলে বিষ্ণুকে আলিঙ্গনও করা যায়। বাড়ি ফেরার অনেক পরে মন্দিরে
বিগ্রহের সামনে বিষ্ণু আরাধনার অভিনয় করিয়েছিলাম ভারতীকে
দিয়ে। তার সঙ্গে অবশ্য বিষ্ণু স্তবের পাঠও করিয়েছিলাম আমার
সহযাত্রী শ্রীঅমরনাথ অধিকারী ও আমার এক সহকর্মী শ্রীধনঞ্জয়
চক্রবর্তীকে দিয়ে। এর ভিডিওও তুলেছিলাম অভিনেতা ও অভিনেত্রী
বাদ দিয়ে। ভারতী তার সেই সময়কার আবেগ অবশ্য আনতে পারেনি।
সেই ভিডিও আপনাদের জন্যে এখানে উপস্থিত করলাম।
পূর্ণ তৃপ্ত মনে আমরা
মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলাম। তখন সময় প্রায় পৌনে চারটে।
বেরিয়ে দেখি আমাদের সাথীরা সকলেই নিচে নেমে গেছেন। আর কোনও
যাত্রী নেই, মন্দির পরিসর যাত্রীহীন। কেবল মাত্র দুই সন্ন্যাসী
দাঁড়িয়ে আছেন বাইরে। আগেই তাঁদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আলাপ
হয়েছিল, নাম, শঙ্করগিরি নাগাবাবা। তাঁর শরীর বাঙালির।
মন্দিরের প্রথম ধাপে
ওঠার সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচের দিকে রাস্তা রাণিপৌয়া যাবার
আর বাঁ দিকের রাস্তা জ্বালামায়ের মন্দিরের দিকে যাচ্ছে।
সময় বড়ই কম, আবার বৃষ্টি আরম্ভ হল, তা সত্ত্বেও বিশেষ করে
সন্ন্যাসী গিরির আন্তরিক অনুরোধে আমরা সেই মন্দিরে গেলাম।
খুবই কাছে। এই মন্দির আসলে এক বৌদ্ধ গোম্পা, ধোলা মেবার
গোম্ফা। কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে মন্দির বা গোম্পায় প্রবেশ করলাম।
ঘর অন্ধকার। প্রথমে কিছুই চোখে পড়ে না। পরে দেখি বেশ বিরাট
এক মূর্তি, পদ্মসম্ভবের (চিত্র-৫৪)। মনে হয় যেন জীবন্ত বসে
আছেন সামনে।
চিত্র - ৫৪ জ্বালামায়ের
মন্দিরে পদ্মসম্ভব, ছবিঃ লেখক
ঠিক তার নিচে দেয়ালে
বিরাট এক গর্ত যা লোহার জালে জানালার মত উল্লম্ব ভাবে ঢাকা।
পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে যেন ভিতরে জলের ধারা কল কল ধ্বনিতে
বইছে। আর তার মাঝে প্রদীপের ন্যায় এক নীলাভ শিখা, স্থির
ভাবে জ্বলছে (চিত্র-৫৫)।
চিত্র - ৫৫ জ্বালামা,
ছবিঃ লেখক
শুনেছি এখানে নাকি
তিনটি ভিন্ন গর্তে শিখা দেখা যায়, তবে আমি এখন একটিই দেখতে
পেলাম। বলা হয় এই আপাত বিপরীত ঘটনা, জলের মধ্যে অগ্নির উপস্থিতি
ব্রহ্মার কীর্তি। তিনি “জলের উপর অগ্নির আবাহন করে ঘোর তপশ্চর্যা
করেন...।” ব্রহ্মা এই তপস্যা এবং যজ্ঞানুষ্ঠান করে একিই
সঙ্গে জ্ঞানকাণ্ড, কর্মকাণ্ড ও উপাসনাকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা
দেখান। জগতের সকলকার মুক্তির জন্যে তাঁর এই ক্রিয়াযজ্ঞের
স্থান তাই মুক্তিক্ষেত্র নামে পরিচিত হয়। অবশ্য এই ক্ষেত্রই
মুক্তিক্ষেত্র কি না, বিতর্ক আছে আগেই উল্লেখ করেছি। স্থানের
মাহাত্ম্যের কথা বলতে গিয়ে নাগা বাবা বললেন যে এখানে শঙ্করের
উপস্থিতিও রয়েছে, ওই শিখার মধ্যে, অগ্নিরূপে। জল, বিষ্ণুর
প্রতীক আর হোতা, ব্রহ্মা নিজেই। তাই এই স্থান ত্রিমূর্তির
অবস্থানের স্থান। আবার অনেকে বলেন এইখানে পঞ্চভূতের, অর্থাৎ
ক্ষিতি, জল, পাবক, গগন ও সমীরের একসাথে অবস্থান রয়েছে। জল
ও পাবক রয়েছে সে তো আলোচনা করাই হয়েছে, অন্যান্য ভূতের উপস্থিতি
তো সমস্ত ক্ষেত্রে একসঙ্গেই হয়ে থাকে ।
কাছেই নাকি অন্তঃসলিলা
গঙ্গার ধারা আছে, দেখা যায় না, কেবল তার কলধ্বনি শোনা যায়,
পাপী না হলে। স্বর্গ থেকে নামার পর মন্দাকিনী নদী নাকি অন্তঃসলিলা
হয়ে এই পথে বয়ে গিয়ে কেদারনাথের উত্তরে কেদারতাল থেকে ভূপৃষ্ঠে
উত্থিত হন। স্কন্দপূরাণে বর্ণিত। আমরা সময়াভাবে নিজেদের
পরীক্ষা করতে পারলাম না।
বৃষ্টির মধ্যেই নিচে নেমে আসলাম। নামার পথে কয়েকটা শালগ্রাম
শিলা কিনলাম, দরাদরি করে। আমরা চার জনই সর্বশেষ মন্দির থেকে
নামলাম। দলের অন্যান্যরা বেশ কিছু আগেই রাণিপৌয়ায় নেমে এসেছে।
৫টার পর নাকি জিপ চলবে না। তাই আর একটু সময় এখানকার পথের
ধারে দোকানগুলোয় কাটানোর ইচ্ছা থাকলেও তাড়াতাড়ি করে জোমসোম
নামার টিকিট কেটে জিপে উঠে বসলাম।