প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিষ্ণুধাম মুক্তিনাথ (সূচী)

-৯-

কিছুটা নামার পরেই অচিন্ত্য প্রস্তাব দিলো যে কাগবেণীতে মন্দির আর কালী গণ্ডকী ও কৃষ্ণা নদীর সঙ্গম দেখে যাবার জন্যে জিপ চালকদের বলা হোক। প্রস্তাব মেনে নিয়ে বাক্‌চাতুর্যে কার্যোদ্ধারে পটু অচিন্ত্যকেই এই পরিকল্প সমাধা করতে বললাম। ও সঙ্গে সঙ্গেই নেগোসিয়েসান আরম্ভ করে দিল এবং এই ধরণের কাজে পরাস্ত হয়েছে অচিন্ত্য আমরা কখনও পাইনি। মোট অতিরিক্ত মাত্র ১০০০ নেপালি টাকায় দুটো জিপের কাগবেণী ঘুরে জোমসোম যাওয়া ঠিক হয়ে গেল। আমাদের জিপ অনেক পিছনে রয়েছে, কাজেই, কি করে অপর জিপের চালক ব্যাপারটা জানতে পারবে? আমাদের জিপের চালক তার সেল-ফোনে সংযোগ করার চেষ্টা করল, কিন্তু যোগাযোগ হল না। কী হবে? তবে মুস্কিল-আসান অচিন্ত্য যেখানে সহায়, অসফলতা সেখানে হয় না। ওই আমাদের চালককে বলল, “শর্টকাট করে ওদের আগে চলুন না।“ আমরা চমকে গেলাম, এই রাস্তায় গাড়ির শর্টকাট? কী রকম অবস্থা রাস্তার সে তো আপনাদের উপরে যাবার সময়ই জানিয়েছি ও দেখিয়েছি, তা সত্ত্বেও অবিশ্বাস্য ভাবে চালক কেমন করে যে এদিক ওদিক দিয়ে জিপ চলিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আগের গাড়ির কাছে চলে গেল কে জানে। তা ছাড়া সাহসীকে ঈশ্বর সাহায্য করেন, তাই মনে হয় সামনের গাড়ির কিছু যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিল আর সেটা থেমে গেল অথবা ওই গাড়ির আরোহীদের অনুরোধে থামলো। ব্যাস, যোগাযোগের আর কোনও অসুবিধা রইল না। আর সেই জায়গা থেকেই বরফে ঢাকা, আমি প্রথমে ভাবলাম নিলগিরি, পরে শুনলাম ধৌলাধার শ্রেণী, দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কিছু সময় ব্যয় করলাম সেই তুষার শৃঙ্গ দেখতে আর ছবি তুলতে ।

চিত্র ৫৬ রানিপৌয়া থেকে কাগবেনির পথ থেকে ধৌলাগিরি ছবিঃ শ্রী অজয় মান্না

তবে পাঠক হয়ত ভাবছেন যে কাগবেণী যেতে বিশেষ ব্যবস্থার কেন প্রয়োজন, কাগবেণীর উপর দিয়েই তো গাড়ি ফিরবে। হ্যাঁ, কাগবেণীর উপর দিয়েই গাড়ি ফিরবে কিন্তু গ্রাম, জিপের রাস্তা থেকে অনেক নিচে আর বিশেষ করে এখানকার মন্দির, যা দুই নদীর সঙ্গমের ধারেই আছে, সেই জায়গা অনেকটা দূরে। তাই জিপের বেশি ভাড়া লাগবে। শুনেছি, কাগবেণী গ্রামে যাবার জন্যে জোমসোম থেকে ভাড়া জিপ প্রতি ১০০০ নেপালি টাকা।
কাগবেণী গ্রাম বেশ বড়, অনেক বাড়ি আর জনসংখ্যাও অনেক। চাষ-আবাদ ভালই হয়, দুই নদীর ধারে বলে। স্থানীয় মানুষরা প্রধানত তিব্বতী মার্ফা উপজাতির। ভারত-তিব্বত বানিজ্য পথ, বিখ্যাত ‘সিল্ক-রুট’-এর ধারে অবস্থানের জন্যে এখানকার মানুষের আর্থিক অবস্থা এক কালে ভালই ছিল। এখন সেই রাস্তার ব্যবহার প্রায় বন্ধ তাই সেই রমরমা আর নেই বললেই হয়। যাই হোক, আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছলাম (চিত্র-৫৭)। সন্ধ্যা নামছে। নদীর ধারে বিরাট বিরাট প্রাচীন গাছ। তাই আরো তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে আসছে।

চিত্র ৫৭ কাগবেনির ধর্মীয়স্থানে প্রবেসগের তোরণ ছবিঃ শ্রী অজয় মান্না

সুন্দর ছবি তোলার সাবজেক্ট (চিত্র-৫৮, ৫৯)। সদ্‌ব্যবহার করতে ভুল হয়নি ।

চিত্র-৫৮ কাগবেনি – দুই নদীর সঙ্গমের স্থান ছবিঃ লেখক

চিত্র ৫৯ কাগবেনিতে গন্ডকী ও কৃষ্ণার সঙ্গম ছবিঃ লেখক

সঙ্গমের ধারে গেলাম। একটু পাশেই ঝোলা ব্রিজ কালী গণ্ডকীর উপর। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আধুনিক নাগরিক সভ্যতার প্রতীক এক জোড়া কপোত-কপোতী। ওপারে ঊষর অনতিউচ্চ পাহাড়। ছোট পাথর আর নুড়িতে ভর্তি। এপারে নদীর পাড়ে প্রচুর ছোট বড় ও নানা রঙ্গের পাথর পড়ে আছে। কিছুটা সময় ব্যয় করলাম আমি ও সুজিত, যদি শালগ্রাম শিলা আমাদের ভাগ্যে থাকে কাছেই দেখলাম শ্মশান।

শুনেছিলাম পার্সিদের মত এখানে নাকি কাক, শকুনি ইত্যাদিদের দ্বারা মৃতদেহ সৎকার করানো হয়। দেখলাম না সেই রকম কোনও সৎকার হতে। বরণ, দাহক্রিয়ার চিহ্ন কিছু দেখা গেল। দিনের পরিবর্তন? দাঁড়িয়ে দেখতে হয়, কিন্তু সময় নেই, জিপ চালকেরা তাড়া দিচ্ছে, অনেকটা যেতে হবে, অসুবিধে হবে। তা ছাড়া বেশি দেরি হলে তাদের অফিসে কৈফিয়ত দেবার প্রয়োজন হতে পারে।

চিত্র ৬০ কাগবেনিতে গন্ডকীর মন্দির ছবিঃ শ্রী অজয় মান্না

চিত্র ৬১ কাগবেনির গন্ডকীর মন্দিরে গন্ডকীর কোলে ও নিচে শালগ্রাম শিলা ছবিঃ শ্রী অচিন্ত্য পাল

তার মধ্যেই তাড়াতাড়ি এখানকার মন্দির এক ঝলক দেখে নিলাম (চিত্র-৬০, ৬১) এবং এক নতুন তথ্য জানতে পারলাম। কৃষ্ণা নদীর সঙ্গে সঙ্গমের পরই নাকি কালী গণ্ডকী নাম হয়েছে, তার আগে অর্থাৎ উত্তরে এই নদীর নাম গণ্ডকী। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখি, ধৌলাধার পড়ন্ত রোদে যেন সোনার পাহাড় ।

চিত্র ৬২ কাগবেনি থেকে সূর্যাস্তের সময় ধৌলাগিরি ছবিঃ লেখক

গাড়ি ফেরার পথ ধরল, তবে একই বা গতানুগতিক পথ নয়। একেবারে কালী গণ্ডকীর জল শূন্য গর্ভ দিয়ে। মনে পড়ে ঘাসা থেকে জোমসোম আসার সময়ের কথা। তখন বৃষ্টির আর উঁচু বাসে থাকার কারণে যেমন উপভোগ করেছিলাম সে তুলনায় নিচু ও খোলা জিপে বসে থাকা, এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। নদীর গর্ভে পথের কোনও নিশানা নেই, আমি ভাবছি দিক ঠিক করবে কেমন ভাবে। তা ছাড়া যদিও নদীর বিরাট চওড়া খাত কিন্তু দুই পাড়ই বেশ খাড়াই। কি করে নদী গর্ভ থেকে সাধারণ পথে উঠবে জিপ? মাঝে মাঝে খালের মত জলের স্রোত পার হতে হচ্ছে। দানায় বাস আটকে যাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। যদিও আকাশ এখন মেঘশূন্য, কিন্তু ক্রমে অন্ধকার বাড়ছে। এবার বেশ বোঝা যাচ্ছে যে আমরা পথ হারিয়েছি। কিছুক্ষণ আরও চেষ্টা করে আমাদের কথা মান্য করে পিছিয়ে আসতে আরম্ভ করল চালকেরা। হঠাৎ একজায়গায় আমাদের চালক কিছুদিন আগে ধসের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া পথ দেখতে পেল। সেই পথে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছ থেকে জানা গেল যে সেই মুহূর্তেই কাজ শেষ করে রাস্তা চালু করা হয়েছে। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম ও আমাদের জিপ সেই পথে জোমসোমের দিকে ফিরতে লাগল। অন্য জিপের চালক কিন্তু এই পথে এলো না, সে অনেকটা পেছিয়ে গিয়ে আমাদের আসবার সময়কার পথ ধরে কিছু সময় পরে ফিরল।

ড. শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।