এর পর আর কি, সে রাতে
জোমসোমে কাটিয়ে পর দিন ৪ মে সকাল ৭:১০ মিনিটে ঘাসা যাবার
জন্যে বাসে উঠলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে মার্ফা পার হলাম। আসার
সময়ে দেখা সম্ভব হয়নি, এখন দেখলাম সরকারি ব্যবস্থাপনায় ‘শিতোষ্ণ
বাগওয়ানি সংস্থান’ রয়েছে মার্ফাতে। শুনেছিলাম মার্ফা নাকি
ফলের জন্যে বিখ্যাত। মনে পড়ল নৈনিতাল জেলার মুক্তেশ্বরে
শিতোষ্ণ অঞ্চলের ফুল-ফলের সম্পর্কে হোর্টিকালচারাল রিসার্চ
ইন্সটিটিউট আছে। কালোপানি পৌঁছবার আগে নদীর জলশূন্য গর্ভ
দিয়ে আসার সময় দেখতে পেলাম ধৌলাধার গিরিশ্রেণী তার রাজকীয়
সৌন্দর্য নিয়ে বিরাজ করছে সারা পশ্চিম আকাশ জুড়ে। ড্রাইভারকে
অনুরোধ করতে সে বেশ কিছুক্ষণ বাস সেখানে দাঁড় করায়। আমরা
মনের সুখে ছবি তুলি (চিত্র-৬৩-৬৬) সেই শৈলরাজির ।
চিত্র ৬৩, সামনে
ধৌলাধার আর নিচে কালী-গণ্ডকীর জল-শূন্য খাত, ছবি - লেখক
চিত্র ৬৪, আমাদের
ধৌলগিরি দর্শন, ছবি - লেখক
চিত্র ৬৫, ধৌলগিরি,
ছবি - লেখক
চিত্র ৬৬, ধৌলগিরির
কোলে গ্লেসিয়ার, ছবি - লেখক
আর বিশেষ ব্যাপার হল
ভারতীকে স্থানীয় এক যুবক নদীর খাত থেকেই একটা শালগ্রাম শিলা
তুলে দেয়।
ঘাসায় পৌঁছে যাই সকাল ১০টায়। সেখানে ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করে
হাঁপাতে হঁপাতে ৯কিমি পায়ে চলে (হ্যাঁ, নামার সময়েও আমরা
হাঁপিয়েছি) ২টার মধ্যেই দানায় পোঁছলাম। আনন্দে ছিলাম যে
আজই বেনি কেন, নিশ্চয় একেবারে পোখরা পৌঁছাবো। কিন্তু হায়,
দেখি মাওবাদীদের বন্ধ এখানে জাঁকিয়ে বসেছে। তাই আবার দানায়
পুরণ বাহাদুরের লজে আর পাশের জিৎ বাহাদুর পুনের রিভার সাইড
হোটেলে ১০ জন করে ঢুকে পড়লাম। হ্যাঁ, ফেরার পথে ‘রুপসে’-র
এক সুন্দর ভিডিও তুলেছিলো সুজিত। অবশ্য কেবল মাত্র রুপসের
ছবির কারণে নয়, ঝর্ণার জলে এক যুবকের স্নান করা দেখাবার
জন্যেও সেই ভিডিও আপনাদের দেখতে দিলাম ।
দানায় দিনের পর দিন
কাটে আর আমাদের উৎকণ্ঠা বাড়ে। সময় কাটাই আশপাশে ঘুরে ফিরে
,
স্থানীয় মানুষ-জনের
সঙ্গে কথা বলে আর তাদের কাজকর্ম দেখে
আর তাদের কাজকর্ম
দেখে,
নদীর পাড়ে পাথর কুড়িয়ে
আর জলে পাথর ছুঁড়ে।
অন্নপূর্ণা পরিক্রমারত
বিদেশি-বিদেশিনি ট্রেকারদের সঙ্গে গল্পও
আমাদের বেশ আনন্দ
দিয়েছে এবং তার সঙ্গে বিদেশিদের ভারতে (মনে রাখবেন কথা হচ্ছে
নেপালে) কোন ব্যাপার বা জিনিস ভাল লেগেছে জানতে পেরেছি সোগাসুজি।
আর একটা বড় কাজ যোগ হল দ্বিতীয় দিন থেকে, কাঠমাণ্ডুর ভারতীয়
দুতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
এই ব্যাপারে আমার ভগিনীপতি
কমলের ছোট জামাই শ্রীমান্ অর্ধেন্দু প্রধান ভুমিকা নেয়
কলকাতা থেকে। দুতাবাসের শ্রী এ. কে. রায় আমাদের অবস্থান
কোথায় তা জেনে নিয়ে আমাদের নিশ্চিন্ত করেন আর বলেন যে দানার
লজ থেকে আমরা যেন যত্র-তত্র ঘুরে না বেড়াই। নেহাতই ব্যক্তিগত
ব্যাপার হলেও আপনাদের জানাই যে বেড়াতে গিয়ে দু-এক বার সকলকেই
নিজেদের কাপড়-জামা সবান-কাচা করতে হয়। বিশেষ করে যদি বেড়ানো
অনেক দিন ধরে হয় এবং যদি Laundry service না পাওয়া যায়।
আমাদের বেড়ানো তো অনেক দিন ধরেই হচ্ছিল আর তা ছাড়া দানায়
প্রায় কর্মহীন অবস্থায় থাকছিলাম। তাই আমাদের মধ্যে অনেকেই
তাদের কাপড়-জামা সাবান-কাচা করে নিচ্ছে দেখে আমরা দুজনেও
লেগে গেলাম সেই কাজ করতে। বিশেষ করে আমাদের Wash-room-এর
বৈশিষ্ট্যতা ও অভূতপূর্ব পরিবেষের কারণে আমাদের কন্যা শুভ্রমালা
আর ভারতীর ছবি নিলাম। দুজনকার কাজ একেসঙ্গে -এতে দেখুন।
আমাদের এই অজাচিত
ও বাধ্যতামূলক বিশ্রামের দিন গুলোতে পুরন বাহাদুর আর জিৎ
বাহাদুর পুন আমাদের সর্বদা সাহস ও আশা যুগিয়ে গেছে। এমন
কি চতুর্থ দিনের ঘর ভাড়া অর্ধেক নেন। জিৎ আমাদের ওখানে আটকে
থাকার ঘটনা নেপালের রেডিওতে খবর হিসাবে বলার ব্যবস্থা করে
দেন।
একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না, বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়
মাওবাদী দল কিন্তু লক্ষ্য করলাম সেই দিনগুলোতে প্লেন যাতায়াত
খুব বেড়ে গেল। তীর্থযাত্রীরা কি সকলেই প্লেনে যাতায়াত করবে,
বাসে নয়? এই বিষয়ে স্থানীয় মানুষদের এবং নেপালি জনসাধারণের
কটাক্ষের কথা আর নাই বা বললাম। যে কোনও বন্ধে সাধারণ মানুষের
যে কষ্ট হয় তা এখন রাজনৈতিক দলের লোকেরাও স্বীকার করে থাকেন।
বন্ধে আর একটা ব্যাপার দেখে এখানকার মানুষের কষ্ট সহিষ্ণুতার
এক উদাহরণ পেলাম। জিৎ-এর কন্যা, বাসন্তী, বেনির একটি স্কুলের
৯ম শ্রেণীর ছাত্রী। সে স্কুলের হস্টেলেই থাকে। বন্ধের জন্যে
স্কুলও বন্ধ। তাই সে দানায় তার বাড়ি ২৯কিমি হেঁটে চলে এলো।
শুধু তাই নয়, জিৎ তার মেয়েকে হস্টেল থেকে নিয়ে আসবে বলে
ভোর বেলা বেরিয়ে পড়েছিল আর তার সঙ্গে তার ছোট মেয়েও দিদিকে
আনতে যাবার বায়না ধরে বলে সঙ্গে গিয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবে
বাপ-বেটি এক দিনেই ৫৮কিমি হাঁটলো! এখানেই শেষ নয়। বাসন্তি
বাড়ি এসে দেখে যে তার মা বাসন মাজায় ব্যস্ত। সঙ্গে সঙ্গে
সেও মাকে সাহাহ্য করতে আরম্ভ করে দেয়! ওই পরিবারের Group
photo দেখুন চিত্র-৬৭-তে। ছবিটা জিৎ-এর হোটেলের উঠানে তোলা।
চিত্র ৬৭, জিৎ-এর
পরিবার, মাঝে অজয় মান্না, পাশে অচিন্ত্য পাল, ছবি - কল্যাণ
চক্রবর্তী
শেষে, ৭ মে রাত ১০টার
পর জানতে পারলাম পরের দিন থেকে বন্ধ বন্ধ হচ্ছে। বাস কাছেই
ছিল চালক সহ। রাতেই সে কথা বলে গেল। ৮ মে সকাল ৭:২০, আমরা
দানা থেকে বেনির উদ্দেশে যাত্রা আরম্ভ করলাম ।
এই ক’দিন ওখানে থেকে
আর সকলকার সুমিষ্ট ও আন্তরিক ব্যবহার পেয়ে দানা ছেড়ে যেতে
কেমন যেন মনঃকষ্টই হচ্ছিল।
বেনি সকাল ৯:৫০ মিনিটে পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে পোখরার জন্যে বাস
পেয়ে গেলাম আর ১০:২০তে বাস ছেড়ে বিকাল ৩:০০ টায় পৌঁছলাম।
সময় অনেকটাই লাগলো, কারণ এই বাস রুটের বাস, আমাদের রিজার্ভ
করা ছিল না। পোখরার কিছু আগে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে বাস দাঁড়িয়ে
থাকতে বাধ্য হয় বেশ কিছু সময়, আর বাসের মাথা থেকে সমানে
ভিতরে জল পড়তে থাকে। ছাদে মালপত্রের উপর কিন্তু পলিথিন ঢাকা
ছিল।
এই কাহিনির এখানেই সমাপ্তি হবার কথা, কিন্তু আমি মনে করি
মুক্তিনাথ সম্পর্কে কোনও কিছু লেখায় শালগ্রাম শিলা সম্পর্কে
কিছু কথা না থাকলে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তবে আমি কেবল
মাত্র এই বিষয়ে জানার জন্যে কিছু আকর গ্রন্থের কথা উল্লেখ
করে বিদায় নেব। লেখার আরম্ভে আমি উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের
লেখা ‘মুক্তিনাথ’-এর কথা বলেছি। আর বলেছি শ্রীঅশোক রায়ের
লেখা, ‘শালগ্রাম শিলার সন্ধানে’-র কথা। এই দুই বইই শালগ্রাম
শিলার আকর গ্রন্থ হিসাবে বিচার করা যায়। আরও বেশি জানার
ইচ্ছা হলে ওনারাই নিজেদের লেখায় বেশ কিছু বইএর কথা উল্লেখ
করেছেন, সেগুলো পড়তে পারলে আপনি শালগ্রাম শিলা সম্পর্কে
বিশেষজ্ঞ হয়ে যাবেন।