প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

আমাদের দেখা গঙ্গোত্রী ও গোমুখ (২) (আগে যা প্রকাশিত হয়েছে)

দুপুরের খাওয়া আমরা প্রায় ১১টায় শেষ করলাম। তার পরই বেরোলাম লোহার সেতু পার করে ভাগীরথীর বিপরীত পারে ঘোরার জন্যে। দেখতে পেলাম গঙ্গোত্রীর ডাকঘর। রাস্তা কিছুটা উপর দিকে উঠে গেছে। অল্প এগোতেই কেদারগঙ্গার ধারা (চিত্র-৮) আমাদের ডান পাশে দেখা গেল। মনে পড়ে গেল যে আগের বার আমি এদিকটায় একলা এসেছিলাম। এখানে দাঁড়িয়ে কেদারগঙ্গার ধারার ভিডিও ছবি তুলছিলাম। সেই দেখে এক অল্প বয়সী সন্ন্যাসী আমাকে বলেন, “য়াঁহা ক্যা ফোটো খিঁচতে হো। যাও আগে বহুত অচ্ছা ফোটো আয়গা।“ তাঁর কথানুযায়ী এগিয়ে গিয়ে গৌরিকুণ্ডের দর্শন পেয়েছিলাম। আজ তাই আমি সকলকে নিয়ে সেই দিকেই যাচ্ছি।

চিত্র-৮  কেদারগঙ্গা

কেদারগঙ্গার ধারা বরাবর অল্প দূর হাঁটার পর এই পথ নদীর ধারা পার হয়েছে কাঠের সেতুর উপর দিয়ে। সেতুর মুখে এক ফলকে লেখা যে এই সেতু ১৯৮৫ সালে নির্মিত আর দৈর্ঘ্যে ২৫মি.। এই সেতুর উপর দাঁড়িয়ে দেখা যায় যে কেদারগঙ্গার ধারা যেন হঠাৎ জন্ম নিয়েছে দুই পাহাড়ের মাঝে। আসলে দুই পাহাড়ের মিলন রেখা ডান দিকে বেঁকে গেছে বলে আর নদীর উজানের অংশ দেখা যাচ্ছে না। ধারার আশপাশে প্রচুর গাছ আর বড় বড় বোল্ডর জমা হয়ে আছে। কালিদাস চক্রবর্তী তাঁর ‘হিমালয় দর্শন’ দ্বিতীয় খণ্ডে (২০০৩, ট্রেকস্‌ এণ্ড ট্যুরস্‌, কলকাতা-৭০০ ০০৮, পৃ-১৩৮) লিখেছেন, “গঙ্গোত্রীর সে অভিনব রূপ গঙ্গোত্রীর কোলে দাঁড়িয়ে দেখা যায় না।” এই রূপ নাকি কেদারগঙ্গার ধার দিয়ে ওপরে উঠতে পারলে দেখা যায়। দুঃখের কথা যে এর ধার দিয়ে ওপরে ওঠার পথ আমি দেখতে পেলাম না। যাই হোক, আমরা কেদারগঙ্গা পার হয়ে কংক্রিটের প্রায় ৩মিটার প্রস্থ রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম, নদীকে ডান দিকে রেখেই। প্রথমেই এক সরকারি বাংলো দেখতে পেলাম আর তার পর ভাগীরথীর ধার দিয়ে পথ বেঁকে গেল। অবশ্য নদী রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছিল না, কারণ নদী ও রাস্তার মাঝে সন্ন্যাসীদের ফুল ফলের বাগান সহ আশ্রম রয়েছে পরস্পর। এই অঞ্চল দিয়ে হাঁটার সময় বিভিন্ন প্রকারের পাখির কল-কাকলী আর নদীর মৃদু কল্লোল ছাড়া নিস্তব্ধ ও শান্ত পরিবেশ আমাদের মোহিত করে রেখেছিল। প্রাচীন কালের তপোবন, মনে হয় এমনই ছিল। প্রায় ১৫০/২০০মিটার হাঁটার পর ভাগীরথীর ধারা দেখা গেল আশ্রমগুলো শেষ হতেই। অল্প পরেই একেবারে পথের ধারেই খাদ আর তার মধ্যে ভাগীরথীর সম্পূর্ণ ধারা দু ভাগে বিভাজিত হয়ে তীব্র গতি ও গুরু-গম্ভীর গর্জন সহ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নিচে জলের ধারা শতধা বিভক্ত হয়ে আবার লাফিয়ে উপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করে বিফল হয়ে প্রধান ধারার সঙ্গে মিশে যেতে বাধ্য হচ্ছে। সেই মিলিত ধারা দুই খাড়া দেয়ালের মাঝ দিয়ে দিগ্‌বিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথম যেখানে জলের ধারা খাদে নামছে, সেখানটা এক কুণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে, যার নাম ‘গৌরিকুণ্ড,’ অবশ্য সাধারণের ধারণা যে এর নাম ‘সূর্যকুণ্ড।’ এই কুণ্ড কিন্তু আর পাঁচটা কুণ্ডের মতো নয় (চিত্র-৯, ১০ ও ১১ )। এর পৌরাণিক কাহিনি বা বৈশিষ্ট্যতার কথা পরে হবে, আপাতত এর বর্ণনা আগে করি।

চিত্র-৯  গৌরীকুণ্ড ১

চিত্র-১০  গৌরীকুণ্ড ২

চিত্র-১১  গৌরীকুণ্ড দর্শন-রত অচিন্ত্য পাল। ছবির উপর দিকে গঙ্গোত্রীর কিছু বাড়ি-ঘর দেখা যাচ্ছে

কুণ্ডের গভীরতা প্রায় ২০/২২ মিটার আর প্রায় গোলাকার, ব্যাস ৩০/৩৫ মিটার। সামনের দিকের দেয়ালের গঠন অদ্ভুত, মনে হয় যেন দেয়ালের পাথর কেউ পেঁচিয়ে দিয়েছে, তবে খুবই মসৃণ আর খুব পুরানো হাতির দাঁতের রঙের মতো ফিকে গোলাপি আভাযুক্ত খয়েরি। আমাদের দিকের দেয়াল দেখা সম্ভব নয়। বিপরীত পারে যেতে পারলে দেখা যাবার কথা, তবে কুণ্ডের বিপরীত পারে যাবার কোনও সুবিধা মতো পথ আছে কি না সন্দেহ হয়। যদিও ওই পারেই গঙ্গোত্রী আসার রাস্তা আর রাস্তা ও এই কুণ্ডের মাঝে অনেক দোকান-ঘর আর হোটেল রয়েছে। চিত্র-১১-র উপরের দিকে সেই বাড়ি-ঘর বোঝা যায়। আগের বার ওইখানেরই এক লজে আমরা উঠেছিলাম। আমাদের পথের সমান্তরাল পশ্চিম দিকে ভাগীরথীর গতি পথ। সেই পথ বাঁধা আছে দুই সমান্তরাল দেয়ালে। দুই দেয়ালের মাঝে দূরত্ব ২০/২৫ মিটার, আর গভীরতাও মোটামুটি তাই তবে পশ্চিম দেকে যত এগোচ্ছে ক্রমশ তা বেড়ে যাচ্ছে। দেয়ালের গঠনও কুণ্ডের দেয়ালেরই মতো। আমি ছবি দেখেছি, শীতে এই কুণ্ডের জলের উপরের তল জমে বরফ হয়ে আছে।

কুণ্ডের কাছেই উত্তরাখণ্ড পর্যটন সংস্থার বিশ্রাম গৃহ। বিশ্রাম গৃহে আসতে গেলে বাস টার্মিনাসের কাছেই ভাগীরথীর উপর লোহার এক সেতু পার হতে হয়। আমরা এই বিশ্রাম গৃহের সামনে দিয়ে নদীর সমান্তরাল হাঁটা আরম্ভ করলাম। অল্প এগোতেই পথ আর কংক্রিট করা নেই, চিহ্ন ছাড়া মাটির পথ, কিছু পাথর তো আছেই। আমরা চলেছি প্রাচীন, প্রধানত পাইন গাছের সারির মধ্য দিয়ে। কিছু দেওদারও রয়েছে। তাদের ঝুলন্ত ডালপালা কাটিয়ে আমাদের এগোতে হচ্ছে। তবে গাছের তলে আগাছা কিছুই নেই বলতে গেলে (চিত্র-১২ ও ১৩), কারণ পাইন গাছের সূঁচের মতো এবং গন্ধযুক্ত পাতা আগাছা জন্মাতে দেয় না ।

চিত্র-১২  পাণ্ডব-গুহার পথে ১

চিত্র-১৩  পাণ্ডব-গুহার পথে ২

ভাগীরথীর গম্ভীর গর্জন আমাদের সাথী, তবে খাতের গভীরতার কারণে তার উচ্ছল তরঙ্গধারা দেখা সম্ভব হচ্ছে না। নদীর বিপরীত পার থেকে অনেকটা দূরে আর উঁচুতে গঙ্গোত্রী আসবার পথ রয়েছে বোঝা যাচ্ছে যখন কোনও গাড়ি চলছে সেই পথে (চিত্র-১৪)।

চিত্র-১৪  পাণ্ডব-গুহার পথে ৩, ছবির মাঝা-মাঝি বাস রাস্তায় কয়েকটা বাস দেখা যাচ্ছে

এক জায়গায় দেখা গেল প্রায় ৭০/৮০ মিটার উঁচু থেকে সেই পথের উপর দিয়ে সোজা নিচে রুপালী সুতার মতো ঝর্ণা ধারা নিচে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মনে পড়লো যে এই ঝর্ণা আমরা আগের দিন গঙ্গোত্রী আসবার সময় গাড়ি করে পার হয়েছি। তবে তখন বোঝা সম্ভব হয়নি যে কত উপর থেকে কত নিচে নেমে যাচ্ছে এই ঝর্ণা।

আমরা সময় সময় কোনও বড় পাথরের উপর বসে পাইন ও সিডারের জঙ্গলের মাঝের অপরূপ সৌন্দর্য ভোগ করতে করতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি, জানিনা কোথায়, কত দূর পর্যন্ত যাব। কিসের যেন মৃদু এক সুগন্ধ চারি দিক ভরে আছে। পরে জেনেছিলাম যে পাইন গাছের রস, যা থেকে রেজিন তৈরি হয়, এই সুগন্ধ তারই। ফেলে আসা গঙ্গোত্রীর দিকে ফিরে তাকাতেই আমাদের দৃষ্টি পড়ল দুপুরের সোনালি কিরীট শিবলিঙ্গের দিকে পাইন-দেওদারের মাঝ দিয়ে (চিত্র- ১৫ ও ১৯)।

চিত্র-১৫  পাণ্ডব-গুহার পথ থেকে শিবলিঙ্গ

চিত্র-১৯  পাণ্ডব-গুহা থেকে ফেরার পথে আবার শিবলিঙ্গ

আমাদের সেবা সদন আর গঙ্গোত্রী মন্দির পরিসর থেকে একই দৃশ্য দেখেছি, কিন্তু এখান থেকে দেখা দৃশ্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। আগে বুঝিনি, কিন্তু এখান থেকে দেখার পর মনে হচ্ছে আগের দেখা যেন শূন্যতার মধ্যে হঠাৎ জেগে ওঠা কৃত্রিম দৃশ্য, অথবা যেন পক্ক কেশ এক গম্ভীর মুখ বৃদ্ধ আর এ যেন প্রকৃতির পটে আঁকা সবুজ ও নীল ফ্রেমে বাঁধান ছবি, অথবা হাস্যমুখ এক শুভ্র বর্ণের শিশু।

 

ড. শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

(চলবে)

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।