আমাদের
দেখা গঙ্গোত্রী ও গোমুখ (৫)
(আগে যা প্রকাশিত
হয়েছে)

৫।
চিরবাসায়
আমরা চিরবাসায় পৌঁছলাম
প্রায় ৩:১৫ মিনিটে। এখান থেকে প্রাথমিক লক্ষ্য ভুজবাসা, আরও
৫কিমি.। চিরবাসার উচ্চতা ৩৬০০মি. আর ভুজবাসার ৩৭৯২ মি.। মাত্র
১৯২ মিটার চড়াই ৫কিমি. পথে, পথ প্রায় সমতলই বলা যায়। অর্থাৎ
তিন ঘণ্টার কমই লাগার কথা। মিনিট দশ/পনেরোর মধ্যে আবার হাঁটা
শুরু করবো মনে করলাম। তখন অবশ্য জানতাম না যে আমাদের এখানেই
এই রাত কাটাতে হবে। পরে জেনেছিলাম যে সুজিত আর ৭২ বছর বয়সী
লক্ষ্মীদা (শ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ দাশ) আমাদের আসতে দেখে এখান
থেকে ঘোড়া নিয়ে ভুজবাসার দিকে চলে যান এই ভেবে যে আমরা তো
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই পথে এগিয়ে যাব।
আমি যে টেন্টের কথা বলছি,
আসলে সেটাকে বলা উচিত পলিথিনের এক লম্বা ঘর, ১০X৮ বর্গ মিটার
আর প্রায় ৩ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট। সামনের দিকটা খোলা, তবে
পর্দার মতো পলিথিন শিট গুটিয়ে রাখা দু পাশে। দোকানে বোতল-বন্দি
জল, ঠাণ্ডা পানিয়, ফ্রুটি ইত্যাদি রয়েছে। এক লিটার জলের বোতল
৩০টাকা দাম। এক প্যাকেট ম্যাগি, তৈরি করে প্লেটে দিচ্ছে, সেও
৩০টাকা। আমি আর কন্যা এক প্লেট ম্যাগি নিয়ে ভাগাভাগি করে খেলাম।
ইতিমধ্যে ভারতী বলল যে তার মাথা ঘোরার সঙ্গে বমি ভাবও হচ্ছে।
আমার বেশ ভয় হলো, কারণ এই অবস্থা উচ্চতা জনিত, বায়ুতে কম অক্সিজেন
থাকার কারণে হয়। সব থেকে সহজ এবং অনেক ক্ষেত্রেই একমাত্র চিকিৎসা
অক্সিজেন দেওয়া বা নিচে নিয়ে যাওয়া, যেখানে অক্সিজেনের অভাব
নেই বায়ুতে। তবে এই উচ্চতায় আমরা অনেক বার এসেছি, কখনও কিছু
অসুবিধে হয়নি, যদিও সেই অবস্থা তাহলে কখনও হবে না তা বলা যায়
না। আমার মনে হলো অনেকক্ষণ কিছু না খাবার জন্যেও হতে পারে।
আমি ঘোড়ার ব্যবস্থা করার কথা এই টেন্টের মালিক, আলম রাণাকে
আগেই বলেছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম ভারতী ঘোড়া করেও যেতে
পারবে না। এখানেই রাতের মতো আমাদের যাত্রা স্থগিত করতে হবে।
কয়েক বছর আগেও চিরবাসায়
রাত কাটাবার, এমন কি চায়েরও কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ভুজবাসায়
অনেক আগে কয়েকটা গুহায় যাত্রীরা রাতের সময় থাকতেন, তবে পরে
লালবাবা নামে এক সন্ন্যাসী যাত্রীদের শুধু থাকাই নয়, ভোজনের
ও শুশ্রূষার ব্যবস্থাও করতেন। ক্রমে তাঁর সেই পরিসেবা বেশ
বড় আকার ধারণ করে। বেশ কিছু সংখ্যক টিনের ছাওনি দেওয়া ঘরেরও
ব্যবস্থা তিনি যাত্রীদের দানে্র সাহায্যে সেখানে করেন। আমার
ছোট ভাই আর তার দুই বন্ধু মিলে ১৯৯০ সালের মে-জুন মাসে গোমুখ
যাবার পথে লালবাবার আশ্রয়ে এক রাত কাটিয়ে ছিল। লালবাবা পরবর্তী
চার বছর আমাদের বাড়িতে শীত কালে আসেন তাঁর গোমুখের ব্যবস্থাপনা
চালানোর জন্যে দানের আশায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে একবছর
সেই বিশ্রামের স্থান সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। এই ঘটনার
ব্যাখ্যা অবশ্য অনেকে অনেক রকম করে থাকেন। সে যাই হোক, কিছু
বছরের মধ্যেই আবার যাত্রীদের সহায়তায় লালবাবা তাঁর যাত্রী
সেবার ব্যবস্থা নতুন করে দাঁড় করাতে সমর্থ হন। এর পর বাবার
মৃত্যু হতে পরিসেবা কয়েক বছর ব্যাহত হয়। আমি যখন ওই পথে যাই,
আবার সেই পরিসেবা নতুন উদ্যমে লালবাবার কোনও সুযোগ্য শিষ্য
চালু করেছেন দেখতে পাই। ২০০৯ সাল থেকে ‘গঙ্গোত্রী জাতীয় উদ্যান’-এর
আওতায় চিরবাসার টেন্টের থাকার ব্যবস্থা ও চা-পানীয়র দোকান
ইত্যাদি সমস্তই পরিসমাপ্ত করে দেওয়া হয়েছে, দূষণ নিবারণের
উদ্দেশ্যে। এমন কি ভুজবাসার খাবার ঝুপড়িগুলোও বন্ধ করে দিয়েছে।
আমরা যে টেন্টে চিরবাসায় ছিলাম, তার মালিক আলম রাণার কছে জানতে
পেরেছিলাম যে সরকারি দপ্তর (কোন বিভাগের, তা অবশ্য জিজ্ঞাসা
করিনি) দরপত্রের আহ্বান করতো, এবং আলম বেশ ভাল দর দিয়েই (সেই
বছরে দিয়েছিল ত্রিশ হাজার টাকা) যাত্রা কালের প্রায় ছয় মাস
এই জায়গা ব্যবহার করার অধিকার পেত। জাতীয় উদ্যান ও ভুজবাসা
সম্পর্কে পরে আরও কিছু আলোচনা করা যাবে। প্রায় ৫০ বছর বা তার
আগে কিন্তু চিরবাসাতেই বন-বিভাগের একটি বাংলোই এই পথে রাত
কাটানোর একমাত্র ব্যবস্থা ছিল। এ কথা আমরা শঙ্কু মহারাজের
ভ্রমণোপন্যাস, ‘বিগলিত-করুণা জাহ্নবী যমুনা’-য় উল্লেখ পাই।
পরে আমি এখানে চির গাছের জঙ্গলের মধ্যে বন বিভাগের একটা বাড়ি
দেখতে পাই, যেটা সম্ভবত তাদের বাংলো। জানি না এখনো সেখানে
সাধারণ যাত্রীদের রাত্রিবাস করতে দেয় কি না।
কি আর করা যায়, ভারতী
টেন্টের মধ্যে শুয়ে রইল আর উঠতে চাইলো না, বিশেষ করে যখন শুনলও
যে এখানেই আমরা রাত কাটাতে পরছি। অবশ্য কারণ যে ওরই অবস্থা,
তা আমি ওকে তখন বলিনি। ভারতী একবারই বমি করেছিল, না উঠে টেন্টের
পলিথিন অল্প একটু তুলে ধরে। কোনও রকমে একবার উঠে সঙ্গে আনা
মুড়ি অল্প করে খেয়ে নিয়েছিল। শঙ্করবাবুও কিছু মুড়ি আর বাদাম
ভাজা ভারতীর কাছ থেকে নিয়ে খেয়েছিলেন। আমি আর শুভ্রমালা সেই
যে এক প্লেট ম্যাগি ভাগাভাগি করে খেয়েছিলাম, আর কিছু খেতে
ইচ্ছে করেনি। এও এক রোগ, উচ্চতার কারণে খাবার ইচ্ছা খুবই কমে
যায়, বা অরুচি হয়। এই ব্যাপারটা আগের বারে আর কয়েক বছর পরে
হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম যখন অমরনাথের পথে সুন্দর, সুস্বাদু ও
টাটকা খাবার ডেকে ডেকে খেতে বলছে বিভিন্ন ভাণ্ডারার কর্মীরা,
আর আমাদের প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও খেতে পারছি না মুখে
অরুচির জন্যে।
আমি আশপাশটা দেখতে টেন্টের
বাইরে বেরোলাম পিঠের ব্যাগ রেখে দিয়ে। বাইরে প্রচণ্ড হিমেল
হাওয়া বইছে, প্রায় ঝড় বলা যায়। কণকণে ঠাণ্ডা। সূর্য এখনও অস্ত
যায়নি, কিন্তু এই অঞ্চলে রোদ নেই, কেননা, পশ্চিম দিকে সূর্য
পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। আলমের ‘হোটেলের’ পিছনে প্রচুর ছোট
বড় চিরের জঙ্গল। গাছের নিচে ছোট গাছ বা আগাছা কিছুই নেই, তবে
নিচটা ছোট বড় ধপধপে সাদা বোল্ডারে ভরা। জঙ্গলের পিছনেই বেশ
উঁচু পাহাড়, যদিও শীর্ষ তুষারহীন। তবে সেই পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে
এক তুষার কিরীট দেখা যাচ্ছে। মানচিত্র থেকে বুঝলাম, এর নাম
ভৃগু পর্বত, ৬০৪১ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট। পাশেই বেশ কয়েকটা
তুলনায় ছোট, অবশ্য বেশি দূরে তুষার শীর্ষ রয়েছে, সম্ভবত সেগুলি
মেরু পর্বতের। টেন্টের ঠিক সামনে দিয়ে ভুজবাসা যাবার রাস্তা
অল্প উঁচুতে উঠে কয়েক মিটার এগিয়েই লম্ব ভাবে ডান দিকে মোড়
নিয়েছে। আর সেই রাস্তার বাঁ দিকে ছোট্ট মাঠের মতো এক সমতল
ও পরিষ্কার জায়গা। সেই ফাঁকা জায়গায় দু-চারটে ফাইবারের চেয়ার
পাতা। কেউ সেখানে নেই। চেয়ারগুলোর তলায় বড় কোকিলের আকারে এক
কালো পাখি মাটি ঠুকরে বেড়াচ্ছে। পাথিটির রং মিশমিশে কালো,
চোখ গাড় লাল, ঠোঁট আর পা দুটি উজ্জ্বল হলুদ রঙের। পরে বাড়ি
এসে বই ঘেঁটে জানতে পারি যে এই পাখির নাম ‘পাহাড়ি ময়না।’ ওই
জায়গার আবহাওয়া, গাছপালা, পরিবেশ, সমস্তই এই পাখি থাকার আদর্শ।
একটু পরেই দেখি একটি মাত্র খঞ্জনাও লেজ ঝাঁকিয়ে মাটি ঠুকরে
খাবারের খোঁজ করছে। শীত কালে আমাদের দক্ষিণ-বঙ্গে খঞ্জনা দেখা
যায়, সেগুলোর শরীরের সাদা অংশের থেকে এই পাখিটির গায়ের সাদা
অংশ অনেক বেশি আর উজ্জ্বলতর। পরবর্তী সময়ে প্রচুর পাহাড়ি ময়না
দেখেছি পথে এবং গোমুখের সামনেও, তবে খঞ্জনা আর একটাও দেখতে
পাইনি।
ক্রমশ অন্ধকার বাড়ছে।
আলম বলেছিল যে সূর্যাস্তের পর বাতাস আর প্রায় থাকবেই না। ঠিক
তাই, বাতাসের বেগও ক্রমশ কমছে। তবে শীত আরও চেপে ধরছে। শুভ্রমালা
সেই সময় টেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে ওকে চিরের জঙ্গলের দিকে নিয়ে
যেতে বলল, এবং আমাকে পাহারায় রেখে বোল্ডারগুলোর পিছন দিকে
চলে গিয়ে কিছু পরে ফিরে এলো। এখন সময় প্রায় ৬টা, প্রায় ৫টার
একটু আগে দুই যুবক আর এক মধ্য বয়সী মহিলা টেন্টের মধ্যে এসেই
বিছানা পাতা রয়েছে দেখে এমন ভাবে বসে পড়লেন যেন মনে হল হাতে
স্বর্গ পেলেন। কম বয়সী যুবক আলমকে ভাত পাওয়া যাবে কি না জিজ্ঞাসা
করল করুণ ভাবে। অল্প সময়ের মধ্যেই আলম ভাতের যোগান দিয়ে দিল।
ইতি মধ্যে জানতে পারলাম যে ওরা দুই ভাই ও তাদের পিসিমা। মা
বাবাও আসছেন তবে তাঁরা কত দূরে, তা তাদের জানা নেই।
এখানে পৌঁছবার পরই আমি
ঘোড়ার কথা বলেছিলাম তাই তিনটি ঘোড়া নিয়ে তিন জন সহিস এসে হাজির।
কিন্তু আমাদের চারটি ঘোড়ার প্রয়োজন, কারণ শঙ্করবাবু এখন আমাদের
সঙ্গেই আছেন। সহিসরা বলল যে আর একটি ঘোড়া আজ পাবার সম্ভাবনা
একেবারেই নেই। এই শুনে আমি পিসি-ভাইপোদের ঘোড়ার প্রয়োজন কিনা
জানতে চাইলেই তারা বিনা বাক্যব্যয়ে ঘোড়ায় চেপে ভুজবাসার দিকে
চলে গেল ৬টা নাগাদ। আমি সুজিত ও লক্ষ্মীদার উদ্দেশ্যে একটা
চিরকুটে আমাদের অবস্থানের কথা লিখে তাদের দিয়ে দিলাম, কেননা
লালবাবার আশ্রমেই নিশ্চয় সকলেই থাকবেন, কাজেই সুজিতদের খুঁজে
নিয়ে চিরকুট দিতে কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়। পরে জানতে পেরেছিলাম
যে সেই সংবাদ সুজিতদের কাছে যথারঈতি পৌঁছেছিলো। বেশ কিছু সময়
পরে এক বাঙ্গালি ভদ্রলোক এসেই পুত্র ও ভগিনীর খোঁজ করলেন।
ওরা এগিয়ে গেছে শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন। সঙ্গে ভদ্রমহিলাকে
না দেখতে পেয়ে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁর খোঁজ করলাম। কিন্তু ভদ্রলোক
বেশ শান্ত ভবে বললেন যে তিনি এসে যাবেন। আধ ঘণ্টা পরেও ভদ্রমহিলা
না আসাতে আমারই চিন্তা হতে লাগলো কিন্তু ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত
মনে বেড়ানোর গল্প করতে লাগলেন আমাদের সঙ্গে। ঘোর অন্ধকারে
রাত ৭:৩০ মিনিটের পর ভদ্রমহিলা এলেন। অবিশ্বাস্য লাগছিল ওনার
এই অন্ধকারে অক্ষত অবস্থায় আসা। মহানবমীর চাঁদ তখন পাহাড়ের
আড়ালে। লক্ষ করলাম যে ওনার কাছে টর্চ নেই। শুনলাম উনি ঘোড়ায়
চেপে এসেছেন। তা হলেও বোল্ডার ঢাকা পথ এবং ওই সাঁকো কি করে
পার হলেন ভাবতেই আমার শিহরণ লাগছিল।
ভদ্রলোক আসবার ঠিক পরেই
এক বিরাট দল এসে হাজির হলো, বুঝতে পারা গেল তারা স্কুলের ছাত্র
এবং সঙ্গে জনা তিনেক শিক্ষক। দেখে শুনে মনে হচ্ছিল যে ওরা
রাজস্থান বা গুজরাটের কোনও স্কুলের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর
প্রায় ৪০ জন ছাত্র। টেন্টের মধ্যে ঢুকেই যেখানে-সেখানে বসে
পড়ে হই হই করে গল্প করতে আরম্ভ করলো, আর তাদের শিক্ষকেরা খাবারের
বন্দোবস্ত করতে লাগলো। আমার চিন্তা হলো যে এত জনের শোবার জায়গা
এখানে কি করে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের কোনও অসুবিধা হয়নি
কেননা ভোজনের পর সেই দলের সকলকেই আলম অন্যান্য টেন্টে পাঠিয়ে
দিয়েছিল।
আমাদের জন্যে দুখানা করে বেশ মোটা লেপ আলম দিয়েছিল। সেই লেপ
চাপা দিয়ে ৯টা নাগাদ শুয়ে পড়লাম। ওই লেপ চাপিয়ে টেন্টের মধ্যে
ঠাণ্ডা লাগছিল না। টেন্টের সামনে পলিথিনের পর্দা লাগিয়ে দিয়েছিল
আলম। হ্যাজাকের আলোও নিভিয়ে দিল একটু পরেই। আর সঙ্গে সঙ্গেই
ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাত দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ
হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। পলিথিনের টেন্টের মধ্যে বাইরের
চাঁদের আলো এক আবছা মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে কিন্তু তার
সঙ্গে বুঝতে পারলাম বিড়ির ধোঁয়ার দুর্গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে আছে।
লক্ষ করলাম যে পর্দার কাছে বিছানায় বসে এক বৃদ্ধ বিড়িতে জোর
টান দিচ্ছে। আমি হিন্দিতে আমার বিরক্তি প্রকাশ করলাম, কিন্তু
তার মহা-স্থবিরতাতে সেই বিরক্তির কোনও ছাপ পড়ল না। আমার কিছুই
করার নেই, চুপ করে সহ্য করতে লাগলাম, কেননা আমি চাইছিলাম যে
ভারতীর ঘুমে যেন কোনও ব্যাঘাত না ঘটে। এবার দেখতে পেলাম যে
শুধু সেই বৃদ্ধই নয়, টেন্টের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক নতুন মহিলা-পুরুষ-শিশু
শুয়ে আছে। কথন আসলো কে জানে, আমি ঘুমের মধ্যে বুঝতেই পারিনি।
ঘুম ভাঙ্গলো একেবারে
ভোর ৫টায়। পাশের বিছানায় ভারতী উঠে বসে আছে। কন্যাকে জাগিয়ে
দুজনে মিলে বাইরে চলে গেল। আমিও ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বাইরে
বেরোলাম। এক ড্রাম জল রাখা রয়েছে আর সেখনে অনেকেই ব্রাশ করছে।
আমিও ব্রাশ করার পর মুখে জল দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভিতরটা
অবশ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে জল তোলার সময় তেমন বুঝতে পারিনি।
বরফ গলা জল, অমন তো হবেই। মুখ ধোওয়া হয়ে গেলে পাহাড়ের দিকে
তাকাতেই দেখি ভৃগু পর্বতের শীর্ষ যেন আর বরফের নয়, সোনার গয়ে
গেছে। তাড়াতাড়ি করে টেন্টের মধ্যে ঢুকে ব্যাগ থেকে আমার হ্যান্ডিক্যাম
বের করে নিয়ে আসতে আসতেই দেখি আমি অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যের চলচ্চিত্র
করতে অসফল হয়েছি। এইটুকু সময়ের মধ্যেই শীর্ষের সোনা প্রকৃতি
নিয়ে চলে গিয়ে আবার সাদা বরফে ঢেকে দিয়েছে। আমার নিজের উপর
রাগ হলো, কেন আমি আগে দাঁত মাজবার মতো দৈনিক কাজ করার দিকে
মন দিলাম। প্রথমেই কেন হ্যান্ডিক্যাম অথবা অন্তত স্টিল ক্যামেরা
নিয়ে বাইরে বেরোলাম না। যা হারিয়েছি তা আর ফিরে পাবার সুযোগ
হবে কি না কে জানে। গঙ্গোত্রীর দিকে এক নাম না জানা পর্বতের
নিচু শীর্ষে তখনও অল্প সোনালি আভা ছিল, সেই ছবিই নিলাম।
গত কাল রাতে যারা এসেছিল,
তারা সকলে বিছানা ছেড়ে আমাদের আগেই উঠে পড়েছে। দেখলাম বিরাট
এক পরিবার, মনে হলো আট, না, চার থেকে আশি পর্যন্ত বয়সের শিশু,
মহিলা, পুরুষ রয়েছে সেই দলে। বিশেষ করে মহিলাদের পায়ে হাওয়াই
আর মাথায় বোঁচকা আর কাঁখে শিশু। হাঁটতে আরম্ভ করে দিল ওরা।
মনে হলো পোশাক দেখে গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের গ্রামের মানুষ,
চলেছে তীর্থযাত্রায়। শুনলাম এদের লক্ষ্যে গোমুখ ছাড়িয়ে তপোবনও
আছে। স্কুলের ছেলেরাও হই হই করতে করতে বেরিয়ে গেল। ওদেরও লক্ষ্য
নাকি তপোবন। আমরা সঙ্গে আনা মুড়ি, বাদাম ভাজা দিয়ে প্রাতরাশ
সেরে নিলাম। ইতিমধ্যে চারটি ঘোড়া নিয়ে সহিসেরা এসে গেছে। কিছুক্ষণের
মধ্যে সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ অশ্বারূড় হয়ে যাত্রা শুরু করে দিলাম।
সেই ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলারা বিছানায় বসে ঘোড়ায় যাবেন কি যাবেননা,
এই বিষয়ে সমানে আলোচনা করে চলেছেন, যে আলোচনা ঘুম থেকে ওঠার
পর থেকেই আরম্ভ করেছিলেন।
৬। ভুজবাসা
(শুভ্র)মালা তার মায়ের
মতো না হলেও গত কাল কিছুটা শারীরিক অস্বস্তিতে ভুগছিল, তাই
সে শুনলেও ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি। আজ সকালে উঠে শরীর
ঠিক হয়েছে, তা ছাড়া হাঁটতে তার অনীহা, আজ ঘোড়ায় চেপেছে তাই
মন বেশ প্রফুল্ল। পথে কিছুটা এগোবার পর বলল যে গত কাল সন্ধ্যায়
সে আলমকে সেই সহিসদের রাগান্বিত ভাবে বলতে শুনেছে, “তুমহারে
সাথ দোস্তি খতম। কিঁউ তুম ঘোড়ে লে আয়ে?” আসলে আলম আমাদের ঘোড়া
পাওয়া যাবে বলেছে আর চেয়েছে যে ঘোড়া যেন না আসে। ঘোড়া না পেলে
যাত্রী বাধ্য হয়ে তার টেন্টে রাত কাটাবে আর সে যাত্রী ভাড়া
ও খাবারের দাম পাবে। আমরও মনে পড়ল যে সেই স্কুলের ছাত্রদের
সে অন্যান্য টেন্টে পাঠিয়ে দিয়েছিল বটে কিন্তু সেই সব টেন্টের
মালিকদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে শুনেছিলাম। তখন আমি এই ব্যাপার
অন্য কোনও কারণে করছে মনে করেছিলাম। এখন মালার কথা শুনে বুঝতে
পারলাম যে সে তার কমিশনের ব্যাপারেই সেই দর-দাম করছিল। কত
রকম ভাবেই যে রোজগার করা যায়, চোখ কান খোলা রাখলে তবেই বোঝা
যায়। আগে বলা হয়নি, রাতে থাকবার জন্যে আলম আমাদের কাছ থেকে
জন প্রতি ৫০ টাকা করে নিয়েছিল।
আগেই বলেছিলাম যে চিরবাসায়
আলমের টেন্টই সাঁকোর দিক থেকে প্রথম। পরে বেশ কয়েকটা টেন্ট
আর খাবারের ঝুপড়ি রয়েছে। সেগুলো পার করে আমরা এগোচ্ছি। কয়েক
মিনিট ঘোড় সওয়ারি করার পরই মনে হতে লাগলো কখন ঘোড়া থেকে নামবো।
সারা অঙ্গের মধ্যে পিছনের কষ্টই বেশি। এই আমাদের প্রথম ঘোড়ায়
চাপা। মালাকে মনে হলো বেশ উপভোগ করছে এই ঘোড়-সওয়ারি। তার মা
বেশ মুখ ভঙ্গিমা করে রয়েছে দেখে তার অবস্থা বুঝতেই পারলাম।
সহিসদের সঙ্গে ঠিক হয়েছে যে ওরা আমাদের এখান থেকে গোমুখ দেখিয়ে
একেবারে গঙ্গোত্রী পৌঁছে দেবে আজই, ঘোড়া প্রতি খরচ লাগবে ১০২৫
টাকা করে। যাই হোক, টেন্ট গুলো পার হতে না হতেই আবার চিরের
জঙ্গল। বিরাট সব মহিরূহ, বোঝা গেল অনেক কাল থেকেই এখানে তারা
ধীর-স্থির ভাবে কর্তৃত্ব করছে আর পরিবেশ উপভোগ করছে। তারা
তাদের মধ্যে অনেক ভূর্জ গাছকেও স্থান দিয়েছে। শান্ত পরিবেশ।
এখনোও ভোরের ফিকে হলুদ রোদ প্রায় আমাদের মুখে এসে পড়ছে, অবশ্য
যখন চির ও ভূর্জ গাছ সূর্য রশ্মিকে ভিতরে আসতে দিচ্ছে। বলা
বাহুল্য, আমরা পূর্ব দিকে এগোচ্ছি। ভাগীরথীর পথ থেকে আমাদের
পথ এখন বাঁ দিকে কিছুটা দূরে। পাখির কাকলি ছাড়া ঘোড়াদের পায়ের
শব্দ আর সময় সময় তাদের সহিসদের গলায় পথনির্দেশের শব্দ শোনা
যাচ্ছে, যা অবশ্য পরিবেশের সঙ্গে দারুণ ভাগে খাপ খেয়ে যাচ্ছে।।
চিরের জঙ্গলের মধ্যে গাছের ফাঁকে লাল-সবুজ রঙের বন-বিভাগের
বাংলো দেখতে পেলাম।
এইখানেই দেখা গেল মন্দা
পর্বত (৬৫১০মি.)। এই পর্বতের শীর্ষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, প্রায়
শিবলিঙ্গেরই মতো তবে শীর্ষের অংশটা অনেকটা শঙ্কুর আকারে। আমার
অনভিজ্ঞ চোখে দেখে মনে হয়েছে এই দুই শৃঙ্গ জয় করা বেশ কঠিন।
দুটি শীর্ষই সূচালো, নিচে থেকে দেখলে মনে হয় উপরে দাঁড়ানোর
জায়গাই হবে না। যাই হোক পাহাড়ে চড়ার আধুনিক ব্যবস্থাদির সাহায্যে
১৯৭৪ সালে হুক্ম সিং-এর নেতৃত্বে ইন্দো টিবেটান বর্ডার পুলিশের
একটি দল শিবলিঙ্গে প্রথম আরোহণ করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। এর
পর আরও কয়েক বার শিবলিঙ্গ শীর্ষে মানুষের বিজয় পতাকা প্রোথিত
হয়েছে। ১৯৮০ সালে একটি জাপানি দল, আর পরের বছরই Doug Scott-এর
নেতৃত্বে ভারত-ব্রিটিশ যুগ্ম দল শিখরটি জয় করেন। গোমুখের পথে
শিবলিঙ্গ শীর্ষের দক্ষিণ প্রান্ত দেখা যায় এবং এই দিকটা মনে
হয় যেন কেউ ছুরি দিয়ে চেঁচে দিয়েছে। এই দিক থেকে শীর্ষে আরোহণ
করার কথা কোথাও লেখা নেই। এই পথেই আমি যে মন্দা পর্বত শীর্ষ
দেখতে পেয়েছি সেটি মন্দা-১, এবং এইটিই একই নামে তিনটি শীর্ষের
মধ্যে সর্বনিম্ন উচ্চতার। ১৯৭৮ সালে পশ্চিম বঙ্গের একটি দল
সর্বপ্রথম মন্দা-জয়ী হন। ১৯৮০ সালে বম্বের একটি দল আর তারপর
১৯৮২তে একটি জাপানি দল এর শীর্ষে আরোহণ করেন। এর পরেও এই শীর্ষগুলোতে
বিভিন্ন অভিযাত্রী দল আরোহণ করেছেন, তবে আমাদের সেই খতিয়ান
জানার প্রয়োজন নেই।
যাক, আবার আমাদের যাত্রার
কথায় ফিরে আসি। আরও কিছুটা এগোবার পর সেই পায়ে হাঁটা গুজরাটি
দলটি আমরা অতিক্রম করলাম। লক্ষ করলাম দলের কয়েক জন বছর দশেকের
থেকেও ছোট শিশুদের হাঁটা। তাদের দেখে আমার মনে পড়ে গেল আমাদের
প্রথম বার কেদারনাথ যাবার কথা। তখন মালার বয়স ৫ বছর ৮ মাস
আর পুত্র শুদ্ধায়ণের ৭ বছর ৫ মাস। ওরাও আমাদের সঙ্গে হাঁটছিল।
আমায় পুত্রকে চোখে চোখে রাখবার জন্যে প্রায় ছুটতে হচ্ছিল।
অবশ্য মালাকে তার মা সময় সময় তাড়া দিচ্ছিল। ওদের দেখে অনেক
যাত্রী, বিশেষ করে বাঙ্গালি যাত্রীরা অন্তত ওদের জন্যে ঘোড়া
নেবার উপদেশ আমাদের দিচ্ছিলেন। অনেকে জনান্তিকে আমরা খরচ বাঁচাচ্ছি
এমনও কথা বলেছিলেন। অনেকে এটা ভাবতে পারে না যে ওই রকম বয়সে
শিশুর মানসিক অবস্থাটাই তাদের হাঁটা নিয়ন্ত্রণ করে, শারীরিক
অবস্থা যদি অবশ্য ঠিক থাকে। সুস্থ শিশুর যদি মন ঠিক থাকে ওই
হাঁটা তাদের পক্ষে কিছু মাত্র কষ্টের নয়। ফিরে আসার সময় আমরা
গৌরিকুণ্ডে না থেমে আরও ৫কিমি. নেমে এসে সোনপ্রয়াগের মন্দির
কমিটির ধর্মশালায় রাত কাটাই। অবশ্য এই ৫ কিমি. বাসে করে এসেছিলাম।
ধর্মশালায় এক পাঞ্জাবী পরিবারও উঠেছিলেন। তাঁদেরও আমার পুত্র-কন্যাদের
সমবয়সী তিনটি শিশু ছিল। তারা পাঁচ জন ধর্মশালার লম্বা বারান্দায়
প্রচণ্ড দৌড়া-দৌড়ি করে খেলা করছিল। দেখলে কে বলবে যে তারা
কিছু ক্ষণ আগেই ১৪কিমি. হেঁটে এসেছে।
কিছু পরে আমরা ‘গিলা
পাহাড়’-এর শ্রেণী পার হলাম। গিলা পাহাড় মানে ভঙ্গুর পাহাড়।
এমনিতেই হিমালয় এখনও স্থির অবস্থায় নেই, তার উপর এখানে পরস্পর
তিন চারটি পাহাড় আছে যেন মনে হয়, ‘(এক) বিরাট শিশু আপন মনে
খেলিছে’ এক তাল কাদা আর কিছু পাথরের টুকরো নিয়ে। তার পর সেই
শিশু খেলা ছেড়ে কোথাও গেছে। ক্রমে সেই কাদা শুকিয়ে গিয়ে মাটির
তালে পরিণত হয়েছে। শিশু আর সেই খেলায় মাতেনি। এই গিলা পর্বত
একেবারে বন্ধ্যা, আশপাশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এর চেহারা।
বড় কেন, ছোট গাছই এই মাটিতে জন্মাতে পারে না। অবশ্য চিরবাসার
কিছু পর থেকেই বড় গাছের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে, তার বদলে ছোট
ঝোঁপের আকারের গাছের আধিক্য দেখা দিচ্ছে। সারা রাস্তাতেই বন
তুলসীর ঝোঁপ হয়ে আছে, তবে এখানে সেগুলির সংখ্যা বেড়ে গেছে।
বন তুলসীর মৃদু আর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সৌরভ চলার কালে বেশ পাওয়া
যায়। শুনেছি এই তুলসী পাতার ঘ্রাণ শরীরের উচ্চতা জনিত রোগ
নিরাময় করে। সাধু সন্ন্যাসীরা সেই জন্যে নিজেদের সঙ্গে বন
তুলসী পাতা রাখেন পাহাড়ে হাঁটার সময়। আবার গিলা পাহাড়ের কথায়
ফিরে আসি। এই পাহাড়ের একেবারে কোলের উপর দিয়েই পথ। এই অংশ
বেশ সাবধানে পার হতে হয় কেননা আলগা মাটি আর তার সঙ্গে পাথর
উপর থেকে নিচে গড়িয়ে সমানে পড়তে থাকে মানুষের বা ঘোড়ার চলাচলের
জন্যে মাটিতে যেটুকু কম্পন হয় তাতেই। আবার যদি বৃষ্টি পড়ে
তাহলে তো মারাত্মক ব্যাপার হয়ে যায়, কাদা মাটি আর তার সঙ্গে
পাথর সমানে জলের সঙ্গে নেমে আসে আর সেই কারণে পথ ভীষণ পেছলা
হয়ে যায়। আমাদের সৌভাগ্য যে আজও মেঘ শূন্য সুনীল আকাশ, রৌদ্র
ঝলমলে। আমরা এই গিলা পাহাড়ের অংশ ঘোড়ায় চেপে সহজেই পার হয়ে
গেলাম। ঘোড়ার পিঠে বসে লক্ষ করলাম যে এই পাহাড় শ্রেণীর নিচে
পথে ছোট ছোট গুলির আকারে মাটি পড়ে রয়েছে। মনে হলো পায়ে উপযুক্ত
জুতা না থাকলে হাঁটার সময় পা পিছলে যেতে পারে। পাহাড় এত কাছে
যে ঘোড়ার উপর থেকে এগুলির ছবি নিতে পারলাম না।

চিত্র-২৮:
ভুজবাসার উপর থেকে ভাগীরথী শিখরত্রয়
সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে
আমরা ভুজবাসা পৌঁছোলাম, অর্থাৎ ঘণ্টা দেড়েকে ৫কিমি. ঘোড়ায়
এসেছি (চিত্র-২৮)। এর মধ্যে আমরা উঠেছি ১৯২ মিটার। আমাদের
সামনে বড় এক সমতল উপত্যকা, তবে রাস্তা থেকে অনেকটা নিচে। সেই
উপত্যকা ঘিরে উঁচু দিয়েই প্রথমে লম্ব ভাবে বাঁ দিকে আর তারপর
আবার লম্ব ভাবে ডান দিকে বেঁকে পথ পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে।
এই বাম-ডান করে পথ একেবারে ‘দ’-এর আকার নিয়েছে। উপত্যকায় গাড়োয়াল
মণ্ডল বিকাস নিগমের ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসের সবুজ রঙের আর লালবাবার
আশ্রমের লাল রঙের টিনের চালের বাড়ি বোঝা যায় (চিত্র-২৯)। একেবারে
ডান দিকে ভাগীরথীর ধারা। ওপারে পাহাড়ের সারি। বরফ নেই। অনেকগুলো
সাদা সমান্তরাল চওড়া রেখা পাহাড়ের উপর থেকে নিচে প্রায় ভাগীরথীর
ধারা পর্যন্ত এসে মিশেছে। বোঝা যায় যে সেগুলো বরফ গলা জলের
ঝর্ণার দাগ, এখন জল আর নেই সেগুলিতে। ওপারেই অনেক গাছ দেখতে
পাওয়া যাচ্ছিল যেগুলো মনে হলো শুকিয়ে গেছে। হ্যান্ডিক্যামের
বিশেষ জুম লেন্স লাগিয়ে বোঝা গেল যে সেগুলো ভূর্জ গাছ। ঠাণ্ডার
জন্যে পাতার রং খয়েরি হয়ে গেছে।

চিত্র-২৯:
ভুজবাসার উপর থেকে লালবাবার আশ্রয় ও ডান দিকে GMVNL-এর বাংলো
আকাশে অনেক উড়ন্ত পাহাড়ি
ময়নার ঝাঁক দেখা গেল। নিচে উপত্যকা, রাস্তার ডান দিকে। বাঁ
দিকে পরস্পর অনেকগুলো পলিথিনের ঝুপড়ি। সামনে খাবারের আর পিছনে
যাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা, যেমন চিরবাশাটে ছিল। আমরা একটা
ঝুপড়ির সামনে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। মালার ম্যাগি খেতে
খুব ভাল লাগে। এখানেও এর দর কিছুটা বেশি, এক প্লেট ৪৫ টাকা।
আমি ওর খাবারে এখন আর ভাগ বসালাম না। এখান থেকে ভাগীরথী চুড়া
গুলো আরও ভালো দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে আমার ঘোড়ার সহিস আমাকে
গোমুখ দেখাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু সকালের সূর্য একেবারে সামনে,
তাই সেই তীব্র আলোয় মধ্যে দিয়ে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না।
না বুঝেই হ্যান্ডিক্যামে ছবি তুলেছিলাম। তবে পরে সেই ছবিতে
আমি গোমুখ দেখতে পেয়েছিলাম কারণ আমার তখন চাক্ষুষ গোমুখ দর্শন
হয়ে গেছে।
ভুজবাসা থেকে গোমুখ মনে
হয় যেন নিচুতে রয়েছে, তা হলেও এর উচ্চতা ভুজবাসা থেকে আরও
১০০ মিটার বেশি, অর্থাৎ ৩৮৯২মি.। অনেক জায়গায় লেখে যে গোমুখের
উচ্চতা ৪১৯৭মি.। আমার মনে হয় এই উচ্চতা গোমুখের নয়, ভাগীরথী
পর্বতমালার পাদদেশের বা তপোবনের। এখান থেকে গোমুখের দূরত্ব
প্রায় ৫কিমি.। এখান থেকেই গঙ্গোত্রী হিমবাহের উপরের তল দেখা
যায়। এত দূর থেকে সেই জায়গা মনে হয় যেন এক সমতল উপত্যকা। গোমুখের
বাঁ দিক থেকে এই তথাকথিত উপত্যকা হয়ে তপোবনের পথ। সেই পথ দক্ষিণ
দিকে এগিয়ে গিয়ে পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে।
আবার যাত্রা শুরু হয়। উপত্যকার সীমানা ছেড়ে এগোতেই ডান দিকে
বেড়ায় ঘেরা ঢালু মাঠ, একেবারে ভাগীরথীর তীর পর্যন্ত। মাঠে
ছোট ছোট গাছ লাগানো হয়েছে, মনে হলো, বেশি দিন হলে গাছগুলোর
বয়স এক বছর। দেখা গেল এক টিনের বোর্ডে কিছু লেখা। প্রথম লাইন,
‘ভোজপত্র কনসার্ভেসন এরিয়া,’ পরের লাইন, ‘Sponsored by American
Rotary International।’ বাকি লেখা পড়া গেল না। আমাদের সামনের
ভাগীরথী শীর্ষগুলি আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে। আমরাও ওই দিকেই
এগোচ্ছি।
ড.
শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী
(চলবে)