বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা
ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫
“আশ্চর্য ভ্রমণ”
অভীক দত্ত
সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের আকাশে নক্ষত্রের মত বিচরণ করে চলেছেন
যে তারকারা তাঁদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি আমাদের দিয়ে চলেছেন একের পর
এক ভিন্ন স্বাদের উপন্যাস।
পারাপার, ঘুণপোকা, দূরবীন, ফজল আলি আসছে, চোখ, পার্থিব, চক্র,
মানবজমিন, - কত নাম করব!
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
|
পাশাপাশি কিশোর উপন্যাসেও তিনি সেরকমই জনপ্রিয়,- মনোজদের অদ্ভুত
বাড়ি, গোঁসাইবাগানের ভূত, হীরের আংটি, নবীগঞ্জের দৈত্য, নবাবগঞ্জের
আগন্তুক, পাতালঘর ----। তিনি নাকি ভূতে বিশ্বাস করেন, ভূত দেখেছেনও
বেশ কয়েকবার। সম্ভবত: তাই তাঁর সৃষ্ট ভূতগুলি আমাদের এত জীবন্ত
মনে হয়।
আবার সম্প্রতি তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র শবরকে নিয়েও বেশ আলোচনা
হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের জগতে তিনি এমন এক সব্যসাচী লেখক পাঠককে
নিয়ে অনায়াস খেলাধুলো করার বিরল কৌশল যাঁর করায়ত্ত।
শীর্ষেন্দুর জীবনের বেশ কিছু সময় কেটেছে উত্তরবঙ্গে। তাঁর লেখাতে
মাঝে মাঝে উত্তরবঙ্গ হাজির হয় তার অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে। তাঁর চরিত্ররা
উত্তরবঙ্গে পাড়ি দিলেই কিরকম অন্যমানুষ হয়ে যান।
শীর্ষেন্দুর লেখাতে মাঝে মাঝে উত্তরবঙ্গ
হাজির হয় তার অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে...
|
শীর্ষেন্দু মানুষটি কিন্তু আদপেই ভ্রমণপিপাসু নন। বাংলার সাহিত্য
জগতের দিকপালেরা দেশ-দেশান্তর ঘুরে এসেছেন, লিখেছেন অনবদ্য ভ্রমণকাহিনী।
এমনকি তাঁদের সাহিত্যেও ভারতের বিভিন্ন জায়গা ও সারা পৃথিবীর বিভিন্ন
দেশের প্রভাব থেকে গেছে। তুলনাতে শীর্ষেন্দু একেবারে বিপরীত মেরুতে।
তাঁর চরিত্রদের মানসভ্রমণ নিজেদের ও পারিপার্শ্বতে। তারা নিজেদের
বা তাদের কাছের মানুষদের মনের গহীন অরণ্যেই ডুব মারতেই বেশী স্বচ্ছন্দ।
‘বাহির ছেড়ে ভিতরেতে
আপনি লহো আসন পেতে
তোমার বাঁশি বাজাও আসি
আমার প্রাণের অন্তঃপুরে’
- এই ধারাতেই গড়ে ওঠে তাঁর সাহিত্যসাধনা।
কাজেই তাঁর ভ্রমণ-কাহিনীতে যে এক ‘আশ্চর্য’ অন্তর্লীন স্বাদ থাকবে
তা আর বিচিত্র কি!
“আশ্চর্য ভ্রমণ” একটি ছোট উপন্যাস। খুব বেশি বড় না। কিন্তু পাঠকের
মনের ওপর “আশ্চর্য ভ্রমণে”র প্রভাব চিরকালীন। যে একবার আশ্চর্য
ভ্রমণ পড়েছে, তাকে সারাজীবন আশ্চর্য ভ্রমণ তাড়া করে বেড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে কিংবা ভবিষ্যতের বাংলা উপন্যাসগুলির মধ্যে যে
ধীরে ধীরে ডকুমেন্টারি উপন্যাসের দিকে এগোনোর এক প্রবণতা দেখা
যাচ্ছে, সেই ট্রেন্ডের ঘোরতর বিপরীতে এই উপন্যাস দাঁড়িয়ে। “আমার
আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু বলার নেই”... “আশ্চর্য ভ্রমণ” এই ফর্মুলাকে
আঁকড়ে ধরেও আমাদের এক অদ্ভুত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে।
“আশ্চর্য ভ্রমণ” শুরু থেকেই পাঠককে একেবারে টেনে নিয়ে যায় একটা
অন্য পৃথিবীতে। ট্রেন জার্নি এবং তার সাথে জড়িত বিভিন্ন মানুষের
কাজকর্ম, বর্ণনা অত্যন্ত নিখুঁত এবং উপভোগ্য ভঙ্গিতে দিতে দিতে
নিজের জীবনকেও অদ্ভুতভাবে রিলেট করে দিচ্ছে ইন্দ্রজিৎ। এই ধরণ
অননুকরণীয় তা নিঃসন্দেহ হয়ে বলা যায়। এই যে অনুপম শৈলী, তাকে কি
বলব – ‘শীর্ষেন্দু ঘরানা’? এই লেখার মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব মজার
গল্প আছে, একটা উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না-
“একটা লোকের সাথে নাগাড়ে ঝগড়া করে বিমল তাকে রাগিয়ে এমন বেহেড
করে দেয় যে লোকটা তেড়ে এসে বলে- ফের কথা বললে দাঁত খুলে নেব। তাতে
বিমল বিচ্ছুর মত হেসে বলেছিল- দাদা বুঝি ডেন্টিস্ট?”
গল্প এগিয়ে চলে ট্রেনের বর্ণনার সাথে ইন্দ্রজিতের জীবনকে রিলেট
করতে করতে।
“আপনাদের কারও কাছে ব্যথা কমানোর বড়ি আছে কি ভাইসব? গত কিছুদিন
যাবত আমার একটা দাঁত বড় কষ্ট দিচ্ছে। ডানদিকের নীচের পাটির একদম
শেষের বড় দাঁতটার আমি নাম দিয়েছি বড়দা। আর ঠিক তার আগের দাঁতটার
নাম দিয়েছি মেজদা। এই মেজদাই হচ্ছে কালপ্রিট। কবে যেন সুপুরি খেতে
গিয়ে দাঁতের একটা দেয়াল খসে পড়ে। তারপর থেকেই মেজদা মাঝে মাঝে
ঝিলিক দেয়। গভীর রাতে ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেলে আমি উঠে বসে মেজদার
সাথে কথা বলি- জানো তো মেজদা, অধিকাংশ ডেন্টিস্টই, ভাঙা দাঁত সম্পর্কে
একটাই কথা বলে। তারা বলে, এ দাঁতের তো আর চিকিৎসা নেই, আসুন তুলে
দিই। তা মেজদা, তোমার কি উচ্ছেদ হওয়ারই ইচ্ছে! এ কেমনতর উল্টোবুদ্ধি
তোমার। যে ক’দিন পারো নিজের ভিত আঁকড়ে থাকাটাই তো বুদ্ধিমানের
কাজ। কোন বোকা চায় ভিত থেকে উচ্ছেদ হয়ে আস্তাকুড়ে যেতে? নিজের
ভবিষ্যৎ বুঝে কাজ কর মেজদা, আখের বলে একটা কথা আছে। কিন্তু বহু
বলা সত্ত্বেও মেজদা শোনে না। মাঝে মাঝে সেই অবিমৃষ্যকারী জলঘোলা
করবেই। যেমন এখন ঝিলিক মারছে। পুরো ডান দিকটা ধরে গেল ব্যথায়।
চোখে জল আসছে। মাথাটাও ব্যথা করছে দাঁতের ঝিলিকে। ভাইসব, কারও
কাছে বড়ি নেই?”
দাঁতের ব্যথার এরকম সরস বর্ণনা পাঠককে বিস্ময়াবিষ্ট করে রাখে
বেশ খানিকক্ষণ। এইরকম সব মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে এই উপন্যাসের পাতায়
পাতায়।
ট্রেন জার্নি পেরিয়ে ইন্দ্রজিৎ পৌঁছয় দার্জিলিং তার অধ্যাপক বন্ধুর
কাছে, শীতের দার্জিলিং যেখানে প্রবল শীতে কেউ যেতে চায় না, সেখানেই
সে পৌঁছয়। ঝগড়াপ্রবণ অগোছালো সংসারে থাকতে থাকতেই ম্যালে গিয়ে
তার দেখা হয়ে যায় এককালের বান্ধবী মিতুনের সাথে, আর এখানেই সেই
উপলব্ধি আসে তার, পড়ে নিই,-
“বন্ধুগণ, মাঝে মধ্যে হঠাৎ পুরনো প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা
কি একটা ‘ক্লিশে’? অর্থাৎ পুরনো কায়দা? কিন্তু ভাইসব, আমার জীবনে
এরকম সব ঘটনাই ঘটে- যা শুনলে হঠাৎ খুব চটকদার মনে হয়, অথচ আসলে
কিছু নয়।
এই যেমন ঐ ফর্সা মোটা মহিলাকে কয়েকবারই আমার চেনা চেনা মনে হল।
মাথার ঘোমটাটি কাঁধের ওপর খসে পড়তেই আমার মনের ভিতর এক বিচক্ষণ
ইন্দ্রজিৎ বলে উঠল- ভাগ্যিস মিতুনের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়নি ইন্দ্রজিৎ।
ঠিকই আমি ভাগ্যবান। নইলে ঐ মোটা, বয়স্কা ও ভয়ঙ্কর রকমের বহির্মুখী
চেহারার মহিলাটি আজ আমার বউ হত। আজ এই ম্যালের ঠাণ্ডা বেঞ্চে শীত
কাতর ছত্রিশ বছর বয়সী যে ইন্দ্রজিৎ বসে আছে, সে তত বোকা নয়”।
আর পাঁচটা রোম্যান্টিক বাঙালির মত ইন্দ্রজিতেরও কলেজ লাইফ কেটেছে
মেয়েদের সাথে কিভাবে কথা শুরু করবে সেই ফ্যান্টাসি নিয়ে। কলেজ
হোস্টেলের ঘরে সে কল্পনা করে এসেছে কিভাবে মেয়েদের সাথে সে কথা
শুরু করবে। অথচ তার সমস্যা হল মেয়েদের সাথে কথা শুরু করতে গিয়েই
সে মেয়েদের খুঁত আবিষ্কার করে ফেলে যেটা সেই মেয়েটার ওপর থেকে
তাকে সমস্তরকম মোহমুক্ত করে ফেলে।
“খুব কাছ থেকে জয়ার দিকে তাকাতেই সে জয়ার কয়েকটা ভীষণ খুঁত দেখতে
পেল। যেমন, জয়ার ওপরের ঠোঁটের লোম কিছু বড়, নাকের দুধারে রেখা
গভীর, ভ্রুতে চুল প্রায় নেই, মুখের চামড়া খসখসে, কথা বলার সময়
জয়ার দাঁত দেখা যাচ্ছিল, ফোলা মাড়ি এবং দাঁতে হলদে রং”।
আবার ইন্দ্রজিৎ প্রেম ছাড়া থাকতেই পারত না। জয়ার পরেই সে ঐন্দ্রিলা
মুখার্জির প্রেমে পড়ে। তারপর মিতুনের। এভাবেই একে একে কোন প্রেমই
শেষ পর্যন্ত সে টিকিয়ে রাখতে পারে না এবং শেষ অবধি সব সম্পর্ক
থেকে পালিয়ে বয়স বাড়তে বাড়তে শেষতক ছত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিতই
থেকে যায়। ম্যালেই তার সাথে পরিচয় হয় মিতুনের মজাদার বর আর তার
ননদ সনাতনীর সাথে। এবং সে আবার যথারীতি সনাতনীর প্রেমে পড়ে যায়
এবং মিতুনের মাধ্যমে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের রক্ষণশীল মানসিকতা
অবশ্য এই উপন্যাসেও প্রকট হয়েছে এই প্রেমিক প্রেমিকার বয়সের পার্থক্যের
ক্ষেত্রে। ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং স্বামী স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য যত
বেশি হবে তত ভাল এই সব ব্যাপার স্যাপার শীর্ষেন্দুর সব উপন্যাসেই
প্রচ্ছন্নভাবে থাকে এবং আশ্চর্য ভ্রমণও এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম
নয়।
যাই হোক, একে একে এই উপন্যাসে এসেছে ইন্দ্রজিতের উত্তরবঙ্গে থাকাকালীন
শৈশব, কৈশোর সহ বিভিন্ন স্মৃতি, যে ভ্রমণের মাধ্যমেই সে বারবার
ফিরে ফিরে স্মৃতিচারণ করেছে তার ফেলে আসা সমস্তকিছুকে। নস্টালজিয়া
বার বার কুরে কুরে খেয়েছে ইন্দ্রজিতকে,-
“-আপনি কি খুব দুঃখী লোক নগেনবাবু?
-খুব। আমি একবার একটা কোকিলের ডাক শুনেছিলাম। সেই রকম ডাকতে কোন
কোকিল আর পারল না।
উনি একটা শ্বাস ফেলে বললেন- কথাটা মিথ্যে নয়। ছেলেবেলায় মায়ের
হাতে ইলিশ মাছের ঝোল খেতাম, বেগুন আর সরষেবাটা দিয়ে রান্না। তেমন
আর খেলাম কই? আমার বউ হুবহু সেই রকম করেই রাঁধে, সেই সরষেবাটা
আর বেগুন দিয়েই কিন্তু সে স্বাদ আর হয় না। ছেলেবেলাটা বেশ ছিল”।
এই উপন্যাসে একটি চরিত্র বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে, সে হল খুন
করে ফেরার হওয়া চেলু। ইন্দ্রজিৎ তাকে চিনে ফেলায় সে বার বার ঘুরে
ঘুরে এসেছে, ইন্দ্রজিৎকে প্রলোভন দেখিয়েছে এবং তাদের সেই দেখা
হওয়াগুলি, কথোপকথনগুলি উপন্যাসে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে। চেলু
যখন বলে,-
“লায়লী একদফে ঐসন পিয়ার করো মেরি জান। দুনিয়াতে আর কেউ কভি ওইসব
পিয়ার করে নি”... কিংবা
“ লোকটা গম্ভীরভাবে বলে – দুনিয়ার সব পুরুষমানুষের সাথে লায়লীর
একবার করে দেখা হবে।
আমি চমকে উঠে বলি- সে কী?
চেলু মাথা নেড়ে বলে – জরুর হবে। লায়লী আমাকে বলেছিল, হাত ফেরতা
হয়ে হয়ে সে হর-মানুষের কাছে একবার করে যাবে। কিন্তু থাকবে না।
কেবল ঘুরবে আর ঘুরবে। ছাতুওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, ভুজাওয়ালা, পকেট মারওয়ালা...”
এ যেন এক অন্য দর্শনের কথা চেলু শোনায় আমাদের। যেন “তারে ধরি
ধরি মনে করি ধরতে গেলেম আর পেলেম না”...
আশ্চর্য ভ্রমণ আসলে কোথাও শুরু করে কোথাও শেষ করে না। আশ্চর্য
ভ্রমণ আসলে জীবন থেকেই কোন একটা সময়কে কেটে নিয়ে শুধু সেই সময়টাকে
অদ্ভুত সুন্দরভাবে বর্ণনা করে যায়। বস্তুত, ভ্রমণে মানুষ নতুন
নতুন দেশ যেমন দেখে, তেমনভাবে দেখে নিজেকেও। সাধারণ পরিবেশের বাইরে
গিয়ে সে নিজেকে বারে বারে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে থাকে, যেমন করেছে
ইন্দ্রজিৎ। পাঠক নিজের অজান্তেই সেই আবিষ্কারের শরিক।
এ ভ্রমণ সত্যিই আশ্চর্য এবং অবশ্যই অত্যন্ত সুখপাঠ্য।
লেখক পরিচিতি - পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার
আর ভালবাসা সাহিত্য। 'আদরের নৌকা' লিটল ম্যাগের সম্পাদক। মূলত
গদ্যকার। প্রকাশিত গ্রন্থ- এক কুড়ি গল্প, কেউ কোথাও যাবে না।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।