প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা

ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫

 

কৈলাসভূমির নাগরিক

দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


“বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায় ১৯৪২ এ রাক্ষসতাল, বা লানগাক সো পরিক্রমার অনুমতি জোগাড় করে ১৩ থেকে ১৬ অক্টোবর তার সম্পূর্ণ পরিক্রমা করলাম। পথের দৈর্ঘ্য সাতাত্তর মাইল। সঙ্গে গাইড ছিল না। রাস্তাও ছিল না কোন হ্রদের ধারে। প্রায় সময়েই পাথর থেকে পাথরে লাফ দিয়ে এগোতে হয়েছিল আমায়। তীব্র ঝোড়ো বাতাসে রাতের তাপমাত্রাকে হিমাংকের ষোল ডিগ্রি নীচে নামিয়ে এনেছিল।তবু, সে পথের প্রতিটি বাঁকে প্রকৃতির অপূর্ব রূপ আর ক্রমাগত ভোলবদল দেখলে অবাক হতে হয়।। ভোরবেলা উত্তাল হ্রদের বুকে বিরাট বিরাট ঢেউয়ের গর্জন শুনতে শুনতে রওনা দিলাম হয়ত। কয়েক মিনিট পরেই দেখি যেখানটা এসে পৌঁছেছি সেখানে পান্নাসবুজ হ্রদের জল আয়নার মত স্থির। তার বুকে সাঁতার কাটা মাছগুলোকে অবধি চোখে পড়ে তখন। মাঝেমাঝে জলাজমির বুকে ব্রাহ্মণী হাঁসের ভিড়, কোথাও বা অতিকায় মান্ধাতা মৌনী হয়ে চেয়ে আছেন হ্রদের উন্মত্ত ঢেউয়ের দিকে, আবার তার খানিক দূরেই বরফজমাট খানিকটা এলাকা বিরাট এক আয়নার মত মহান কৈলাশের ছবি ধরে আছে নিজের বুকে—”

লেখক প্রণবানন্দ

১৯২৮ এ প্রথমবার কৈলাস মানসরোবর যাত্রা শুরুর পর সে ছিল তাঁর দেবভূমিতে অষ্টম যাত্রা। সে সময় প্রতি বছরেই দু থেকে ছ মাস করে তিনি বাস করছেন মানসের তীরে। ভুগোলবিদ অভিযাত্রীর দক্ষতা ও আগ্রহে তন্ন তন্ন করে ঘুরে দেখছেন সম্পূর্ণ এলাকাটাকে। শেষ হেমন্তের তুষারঝড়ের মধ্যে একলা একলা রাক্ষসতাল পরিক্রমা তাঁর সে অঞ্চলে অজস্র পরিব্রাজনের একটা সামান্য অংশমাত্র।

অথচ লাহোরে শিক্ষাদিক্ষা শেষ করে সবে চাকরিতে ঢোকা রেলের এই কেরানির এমন জীবন পাবার কথা ছিল না। ১৮৯৬তে পূর্ব গোদাবরি জেলায় জন্মানো কনকদন্ডী ভেঙ্কায়া সোমায়াজুলুর এহেন কেরানির জীবনটাকে আমূল বদলে দিয়েছিল দুটো ঘটনা। প্রথমটা অসহযোগ আন্দোলন। তার ধাক্কায় চাকরি ছেড়ে ১৯২০ সালে কংগ্রেসকর্মী হয়ে তিনি ফিরে গেলেন মাতৃভূমি অন্ধ্রদেশে। কিন্তু সে-ও তাঁর প্রকৃত পথ ছিল না। সে পথ দেখালেন ডঃ জ্ঞানানন্দ। ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্বসেরা গবেষণাকেন্দ্রে গবেষণা করে বেড়ানো এই সন্ন্যাসী পদার্থবিজ্ঞানবিৎ ১৯২৬ এ ভেংকায়াকে সন্নাসব্রতে দিক্ষা দিয়ে পথে বের করে আনলেন। পূর্বাশ্রমের নাম বর্জন করে ভেংকায়া হয়ে গেলেন স্বামী প্রণবানন্দ।

১৯২৪ এ জ্ঞানানন্দ কৌপিনমাত্র সম্বল করে কৈলাসমানস অভিযান করেছিলেন। দীক্ষার দু বছর বাদে গুরুদেবের পদাংক অনুসরণ করেই প্রণবানন্দের প্রথম কৈলাসভূমিতে পা। শ্রীনগর থেকে রওনা হয়ে লাদাখ, গারটক জ্ঞানিমা মান্ডি হয়ে কৈলাস-মানস, তারপর অন্যপথে তাকলাকোট, খেচরনাথ হয়ে ফিরে আসা। লিখে গিয়েছেন খেচরনাথের মূর্তির সাতবার কথা বলবার রোমাঞ্চকর মিথ-এর অসামান্য একটা বিবরণও।

স্বোয়েন হেডিন

সেই শুরু। এরপর ১৯৩৫ সাল থেকে বারংবার নতুন নতুন পথে দেবভূমি কৈলাসে ফিরে ফিরে গিয়েছেন প্রণবানন্দ। পাঁচ ছটি রুটের পুংখানুপুংখ বিবরণ ধরে রেখেছেন নিজের ডায়েরিতে, এবং তা প্রকাশও করেছেন পরবর্তী যাত্রীদের সুবিধের জন্য।

তৃতীয় যাত্রায় ১৯৩৭ সনের এপ্রিলে জমাটবাঁধা রাক্ষসতালের বুক বেয়ে হেঁটে অভিযান চালালেন তার বুকের লাচাতো আর তপশেরমা নামে দুই দ্বীপে। কালিকলমের অসামান্য অবজার্ভেশনে জীবন্ত করে রাখলেন বরফজমাট রাক্ষসতালের ছবিটি। জমাটবাঁধা হ্রদের বুকে ইয়াকে চেপে চলেছেন এক ভূতত্ত্ববিদ সন্ন্যাসী। তার পুবপশ্চিম আর উত্তরদক্ষিণ –আড়েদিঘে দুবার তাকে পারাপার করে লিখে রেখে চলেছেন অঞ্চলটার নিখুঁত ভৌগলিক বর্ণনা। এর আগে একমাত্র স্বোয়েন হেডিনের লেখাই ছিল ও অঞ্চল সম্বন্ধে বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ। প্রণবানন্দের পরিব্রাজন সে বিবরণের ত্রুটিগুলোকে সংশোধন করে দেয়। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেয় রাক্ষসতালের বুকে দ্বীপ আছে দুটো, হেডিনের কথামত তিনটে নয়।

দরকারি তথ্যগুলো পরিবেশন করবার পাশাপাশি মানুষ আর পরিবেশের সুখদুঃখের গল্পগুলোও একইরকম গুরুত্বে ফুটে উঠেছে প্রণবানন্দের ভ্রমণসাহিত্যে। এক যাত্রায় তিনি জেনেছেন, কিছুদিন আগে জমাট রাক্ষসতালের বুকে এক গ্রামবাসী ইয়াকশুদ্ধ বরফ ফেটে তলিয়ে গেছে। খবর পেয়েছেন, রাজহাঁসের ডিম সংগ্রহ করবার জন্য রাক্ষসতালের দ্বীপে যাবার পর হ্রদের বরফ আবরণে ভাঙন ধরায় কেমন করে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে গিয়েছে কয়েকজন দুর্ভাগা তিব্বতী। মানসের বুকে গলিত সোনার মত রোদমাখা মহান কৈলাশ, অস্তগামী সূর্যালোকে লেলিহান অগ্নিশিখায় জ্বলে ওঠা মান্ধাতা, বা চাঁদের রুপোলী আলোয় ঝিকিমিকি জমাটবাঁধা মানস-এইসব অসামান্য ছবির পাশাপাশি তাঁর লেখায় ফুটেছে হ্রদের স্বচ্ছ বরফে সাঁতারের ভঙ্গীতে জমে মরে থাকা অজস্র মাছেদের ছবি, কিংবা বরফজমাট মৃত পরিযায়ী পাখির ঝাঁক।

১৯৩৬-৩৭ সালের সেই যাত্রায় তাঁর প্রথম কৈলাশভূমিতে দীর্ঘ বর্ষবাস, মানসের পাশে থুগলো গোম্ফায়। আধ্যাত্মসাধনার পাশাপাশি তখন চলেছে সে অঞ্চলের ভূগোল, আবহাওয়া, মানুষজনকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান। কৈলাস পর্বতকে পরিক্রমা করেছেন তেইশবার, আর মানস পরিক্রমা পঁচিশবার। তার মধ্যে সাতটি ছিল ঘোর শীতকালে সম্পূর্ণ জমাটবাঁধা মানসের বুক বেয়ে।

ডিঙি নৌকায় মানস অভিযান

একদম শুরুর দিকে যা ছিল সন্ন্যাসী পরিব্রাজকের আধ্যাত্মসাধনা আর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা, পরের দিকে তা বদলে যায় গবেষকের নিবিড় জ্ঞানসাধনায়। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৯ সাল অবধি প্রতি বছর দু থেকে ষোল মাসের কৈলাসবাসকালীন সেইসব বৈজ্ঞানিক অভিযানে গবেষণা করেছেন কৈলাসপর্বতের পাথরের চরিত্র নিয়ে, সংগ্রহ করেছেন অজস্র জীবাশ্ম, আবিষ্কার করেছেন হ্রদের জলের তলায় সামুদ্রিক প্রাণীদের ফসিল বেড। নৌকায় চেপে ভেসেছেন মানসের জলেও। ১৯৪২ সালে নৌ-অভিযান চালালেন মানসের বুকে। উদ্দেশ্য হ্রদ আর তার মধ্যেকার দ্বীপগুলোর বিষয়ে ব্যাপকতর তথ্য সংগ্রহ। ১৯৪৬ সালের অভিযানে সমুদ্রতল থেকে ১৮৪০০ ফুট ওপরে গৌরীকুণ্ড হ্রদে নৌকা নিয়ে নেমে শব্দ দিয়ে তার গভীরতা মাপলেন। সেইসঙ্গে সে বছরই কৈলাশের পাদদেশ আরোহণ করে নির্ণয় করেছেন তার পাথরের চরিত্র। সে বছরের যাত্রায় তাঁর আরেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা পাংথা নামের এক পরিত্যক্ত গুহানগরীর আবিষ্কার।

পাংথা নামের এক পরিত্যক্ত গুহানগরী

ক্রমাগত বসবাস ও সান্নিধ্যে কৈলাশ মানস তাঁর সামনে নিজের রহস্যময় রূপটিকে যেভাবে খুলে ধরেছিল আর কাউকে বোধ হয় তা সে মুখটি দেখায়নি কখনো। প্রাণভরে তিনি তাকে দেখেছেন, তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তাকে বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন, আর যার ব্যাখ্যা করতে পারেননি, তাকেও সযত্নে বর্ণনা করে রেখে গিয়েছেন কোন উত্তরসূরী যদি কখনো আকৃষ্ট হয়ে তাকে খুঁজতে যায় সেই আশায়। এমন কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক-

“ভোর আর সন্ধেগুলো এখানে বেজায় লম্বা হয়। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আগে পড়ে প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে আলোকিত হয়ে থাকে গোটা এলাকা। অত্যধিক উচ্চতা, হালকা, ধুলোহীন বাতাস এই সবকিছু মিলে দূরের জিনিসকে খুব কাছের করে দেখায় এখানে। কখনো কখনো দেখি মানসের তীরের কাছে জল ফুলেফেঁপে উঠছে বড়ো বড়ো ঢেউতে, অথচ খানিক গভীরতায় সেই একই সময়ে কাচের মত স্থির জলে কৈলাশের অথবা তারাভরা রাতের আকাশের ছবিটি ফুটে আছে। কখনো হাওয়াবাতাস ছাড়াই হ্রদের জল ফুলে ওঠে পাহাড়প্রমাণ ঢেউয়ে। কখনো তার উঁচু পাড় থেকে দেখি জলের মধ্যে জেগে উঠেছে যেন চওড়া চওড়া রাজপথ। হয়তো জলের তলায় থাকা উষ্ণপ্রস্রবণের জল জোয়ারভাটার মতন দোলনের তাড়নায় হ্রদের শীতল জলের সঙ্গে মিশে এই রাস্তাদের সৃষ্টি হয়, কিন্তু সে জোয়ারভাটা সমুদ্রের জোয়ারভাটা নয়।”

পর্যবেক্ষণের এই গভীরতা, হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান পীঠস্থানে বসে চোখের সামনে প্রায় অলৌকিক, অব্যাখ্যাত দৃশ্য দেখেও একজন সন্ন্যাসী পরিব্রাজক কীভাবে নিজের বৈজ্ঞানিক বোধকে জাগিয়ে রেখে তার বাস্তবসম্মত বিবরণ ধরে রাখছেন ও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করছেন সেইটেই শিক্ষণীয় এখানে। তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণীর সঙ্গেসঙ্গে পরিব্রাজকের এই নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণী দৃষ্টিকোণও সার্থক ভ্রমণসাহিত্য সৃজনের একটা আবশ্যিক পূর্বশর্ত।

এরই পাশাপাশি আবার রয়েছে হার না মানা অ্যাডভেঞ্চারিজমের সুবাসও—

“একদিন ভাবলাম পায়ে হেঁটে জমাটবাঁধা মানসের ওপর ঘুরে এলে কেমন হয়? ঠিক হল চিউ গুম্ফা থেকে চেরকিপ গুম্ফা অবধি মাইলখানেক পথ হ্রদের ওপর দিয়ে ট্রেক করব। এই সময়টা ময়ূরের (মানসের জলের নীচের উষ্ণ প্রস্রবণগুলোর গেইসারের মতন বরফচাদর ফাটিয়ে উৎক্ষিপ্ত হওয়ার স্থানীয় নাম) মৃত্যুফাঁদ আর ভয়াবহ সব বিস্ফোরণের শব্দ এই দুয়ের ভয়ে স্থানীয়রা কেউ সরোবরের ধারেকাছে যেতে সাহস পায় না। গোম্ফার লামারা মিলে অনেক সাবধানবাণী শোনালেন বটে কিন্তু আমি গোঁ ছাড়লাম না। জমাট বাঁধা বরফের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম।

বিপদ হল খানিক এগিয়ে। সামনে দেখি এক লম্বা ফাটল। তার ওপর পাঁচ ফুট উঁচু সব আলগা বরফের চাঙড় ছড়িয়ে আছে। সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদ। খুব সাবধানে, ভয়ে ভয়ে মহাকষ্টে সে জায়গাটা পার হওয়া গেল। চেরকিপে পৌঁছোবার আগে হ্রদের গভীরে একটা,আর পাড়ের কাছে আরো একটা এইরকম ফাটলের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তবে অভিযানটা সেদিন শেষ করেই ছেড়েছি। ‘বাগেত’ একবার একটা কথা বলেছিলেন, ‘যখন অন্যেরা বলে কাজটা তুমি পারবে না তখন সে কাজটা করে দেখাবার মত মজা আর কিছুতে নেই। কথাটার সত্যতা সেদিন খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম।’ ”

বিবরণের সরসতায় প্রকৃতির ভয়াল মুখটির মধ্যে থেকে তার রঙ্গরসিকতা আর আশ্চর্য সৃজনশীলতার ছবিগুলোকে উদ্ধার করে আনবার মত সাহস ও সাধ্য থাকাটা ভ্রমণসাহিত্যের আরো একটা জরুরি পূর্বশর্ত। বারংবার তার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন প্রণবানন্দ তাঁর ভ্রমণসাহিত্যে। সঙ্গের এই উদাহরণগুলো সেইটিকে পরিষ্কার করবার পক্ষে যথেষ্ট হবে-

“একবার জমাটবাঁধা মানসের বুকে ঘুরতে ঘুরতে একটা মজার জিনিস দেখেছিলাম। গিউমা শু থেকে শাম সো অবধি এলাকাটার বরফের ওপর যেন গোটা একটা পর্বতমালার মিনিয়েচার তৈরি হয়ে আছে নিজেনিজেই। তার মধ্যে গিরিচূড়া, উপত্যকা, গিরিপথ, মালভূমি সবই আছে। প্রায় দু ঘন্টা ধরে ইশকুলের ছাত্রের মতই অবাক বিস্ময়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম গোটা একটা পর্বতমালার স্কেল মডেলের সেই আশ্চর্য প্রাকৃতিক প্রদর্শনী। চেনা কোন পর্বতমালার সঙ্গে তার কোন মিল খুঁজে পাইনি অবশ্য।

এমন অনেক আজব দৃশ্যের খোঁজ পাওয়া যায় ও এলাকায়। প্রথম যেবার শীতকালে মানস পরিক্রমায় বের হলাম, সেবার শাম সো আর গুগতা-র মোহনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে পৌঁছে দেখি গোটা এলাকা জুড়ে অজস্র বুনো ঘোড়া আর চমরির খুড়ের দাগ। এই শীতে দল বেঁধে হ্রদের বুকে এত প্রাণী এল কোথা ত্থেকে? পরে অবশ্য বোঝা গেল, সেসব কিছু নয়, এ হল মানসের রসিকতা। বরফের ওপর ওসব দাগ আপনাআপনি তৈরি হয়েছে।

আবার একবার গিউমা আর তাগ-এর মোহনার মাঝামাঝি এলাকায় গোটা অঞ্চলটা জুড়ে তটবয়াবর হ্রদের বুকে একটা ছ থেকে দশ ফিট চওড়া মসৃণ ফুতপাথ পেয়েছিলাম। জায়গাটায় দিব্যি স্কেটিং প্র্যাকটিশ করা যায়। ওর ওপর দিয়ে বেশ ক’বার মহানন্দে স্লাইড করে গিয়েছিলাম সেবারে।”


******

পাহাড় বড়ো অহংকারি জায়গা। সহজে সে কাউকে তার অন্দরমহলে ঢুকতে দেয় না। সাধারণ অভিযাত্রীরা তার পাথর, বরফ, জঙ্গল, ঝর্ণা দেখেই সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যান। প্রণবানন্দের জন্য কৈলাস-মানস তার অন্দরমহলের দরজাটা হাট করে খুলে দিয়েছিল। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছেন তিনি সেই পর্বতজগতের অন্তঃপুরে। সেইসব তথ্যকে একত্র করে সৃষ্টি করেছেন ভ্রমণ গাইড “পিলগ্রিমস্ কমপ্যানিয়ন টু দি হোলি কৈলাস অ্যান্ড মানসরোবর” এবং দেড় হাজার পাতার এক রোজনামচার ওপর ভিত্তি করে হিন্দি ভাষায় (ও তারপর ইংরিজি ভাষায়) মহাকাব্যিক ভ্রমণকথা “কৈলাস-মানসরোবর।” সে বইয়ের ভূমিকায় নিজের পরিচয় রেখেছেন এই বলে—

“পবিত্র কৈলাস ও মানসরোবরের নাগরিক স্বামী প্রণবানন্দ, এফ আর জি এস।”

গবেষণাজগতে, এ প্রবন্ধে এখন অবধি উল্লিখিত আবিষ্কারগুলো ছাড়াও সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, কার্নাল ও শতদ্রুর উৎস অভিযান করে স্বচক্ষে তাদের দেখে তার বিবরণ তৈরি করেছিলেন তিনি। স্বেন হেডিনের এই সম্পর্কিত হাতফেরতা তথ্যের গবেষণাকে নস্যাৎ করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিশ্বজোড়া স্বীকৃতিও পেয়েছেন তার জন্য। ফেলো অব দা রয়েল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রণবানন্দ। তাঁর “কৈলাস-মানসরোবর” বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে নেহরুজি লিখেছিলেন,

“জানিনা কোনদিন কৈলাস-মানসরোবর যেতে পারব কি না, আমার ভালোবাসার কৈলাস আর স্বপ্নের মানসকে নিয়ে অনেক কথাই বলেছে এই বইটি। আশা করব এ বই আরো অনেক মানুষকেই কৈলাস-মানসরোবর যেতে অনুপ্রাণিত করবে।”

তবে শুধু ভ্রমণার্থীই নয়, প্রকৃতির নিবিড় পর্যবেক্ষক, দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চারলোভী মানুষজন, বিজ্ঞানসাধক, প্রত্যেকের কাছেই তাঁর ভ্রমণসাহিত্য একটি উল্লেখযোগ্য দিগদর্শক হবার দাবি রাখে।

বাঙালি হিসেবে একটাই গর্বের কথা, প্রণবানন্দের ম্যাগনাম ওপাস এ বইটি কিন্তু ১৯৪৯ সালে কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। হয়ত সে সময়ে এ শহরের প্রকাশনা জগতে তারুণ্যের শক্তি ছিল, ছিল অ্যাডভেঞ্চারিজমের স্বপ্নও।

সে স্বপ্ন এখন ফুরিয়ে গেছে কি? নইলে এতগুলো বছর পরেও এ বইয়ের একটা বাংলা অনুবাদের কোন সন্ধান পাওয়া গেল না কেন?




লেখক পরিচিতি - জন্ম , বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা উত্তর চব্বিশ-পরগনার নৈহাটির কাছে দেউলপাড়া গ্রামে। রাজ্য ও তারপর কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল সার্ভিস কর্মসূত্রে দেশের নানান জায়গায় বাস ও প্রবাস। বর্তমানে সরকারী কাজ ছেড়ে ইন্টারনেটের কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও কর প্রশাসণের আইনকানুনের সরকারী মাস্টারগিরিতে যুক্ত। তারই মধ্যে চলে বেড়ানো আর ছোটদের জন্য দুটো ওয়েব পত্রিকা পরিচালনা। বাংলাভাষার ওয়েবম্যাগ, কাগুজে পত্রিকা আর চিরায়ত সাহিত্যকে ইন্টারনেটের সাহায্যে পাঠকের কাছে পৌঁছোবার জন্য পদক্ষেপ নামে একটা লিংক পোর্টাল পরিচালনা। অসমের বাংলা কাগজে লিখে লিখেই বাংলা লেখায় হাতেখড়ি। তারপর থেকে পরবাস, সৃষ্টি, শুকতারা, দেশ, আনন্দবাজার, সন্দেশ এইরকম নানান পত্রপত্রিকায় লেখা চলছে। বেশ কয়েকটা বই প্রকাশিত হয়েছে সুচেতনা, আনন্দ আর সৃষ্টিসুখ থেকে। ভারতীয় গুহাচিত্র আর উত্তরপূর্ব ভারতের অর্থনীতির ওপরে গুটিকয় গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে কমনওয়েলথ প্রকাশন ও “হেরিটেজ” নামের ভারতত্ত্বের গবেষণা পত্রিকায়।


(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।