বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা
ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫
হিমালয় ভ্রমণকথার প্রবাদপুরুষ : প্রবোধকুমার
সান্যাল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম শতবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি রূপে
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে (মে
২০০৩) লেখক মন্তব্য করেছিলেন
“উমাপ্রসাদই প্রথম হিমালয়ের অপরিচিত
অঞ্চলের ভ্রমণ বিবরণ বাঙালি পাঠকসমাজের সামনে উপস্থিত করেন”।
প্রবোধকুমার সান্যালের নাম প্রবন্ধকারের কেন মনে আসেনি জানি না।
উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম ভ্রমণ-রচনা ‘গঙ্গাবতরণ’ প্রকাশিত
হয় ১৯৫৫ তে আর প্রবোধ কুমার সান্যালের
‘দেবতাত্মা হিমালয়’এর রচনাকাল ১৯৫৪। এমন কি, উমাপ্রসাদের প্রথম
হিমালয় দর্শন, ঐ নিবন্ধের তথ্য অনুযায়ী ১৯২৮ এ, আর প্রবোধকুমার
হিমালয়কে প্রথ চেনেন ১৯২৩ এ। তারও অনেক আগে ১৯৩৭এ প্রবোধ কুমারে
অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ প্রকাশিত হয়। তবুও,
প্রবোধকুমার সান্যাল নন, হিমালয় ভ্রমণ-কথা প্রথম সাহিত্য রসসিক্ত
হয়ে বাঙালি পাঠকের সামনে আসে জলধর সেনের রচনায়। অতীতকালের প্রখ্যাত
প্রাবন্ধিক অক্ষয় কুমার দত্ত মন্তব্য করেছেন,
“এই ভ্রমণকাহিনী যখন ধারাবাহিকরূপে ‘ভারতী’তে
প্রকাশিত হইতে আরম্ভ করে, তখন বঙ্গসাহিত্যের এক নতুন দ্বার উন্মুক্ত
হইয়াছিল;- এখন সে পথে বহুলোকে সগর্ব্বে অগ্রসর হইলেও জলধরকেই প্রথম
পাণ্ডা বা পথপ্রদর্শক বলিয়া নির্দ্দেশ করিতে হইবে”।
‘দেবতাত্মা হিমালয়’এর অনেক আগে প্রবোধকুমার রচনা করেন তাঁর অন্যতম
শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘মহাপ্রস্থানের
পথে’। কৈলাশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা অসাধারণ ভ্রমণোপন্যাস।
‘মহাপ্রস্থানের পথে’ পাঠ করার পর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন
‘তোমার ভাষা পাঠকের মনকে রাস্তায় বের করে আনে’।
১৯৩২ এ কেদারবদ্রী ভ্রমণ ও তারপর হৃষিকেশ থেকে পার্বত্য শহর রাণীক্ষেত
পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে পরিক্রমণ করেছিলেন ৩৮ দিনে।
সেই অভিজ্ঞতার কাহিনী নিয়েই লিখেছিলেন ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। তারপর
১৯৩২ থেকে ১৯৩৬ দীর্ঘ পাঁচ বছর হিমালয় সন্নিহিত নানা স্থান ভ্রমণ
করেন, সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা, হিমালয়ের নানান প্রদেশের মানুষের জীবনপ্রণালী
আর নানান মানুষের সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলেন তাঁর অনন্য
সৃষ্টি ‘দেবতাত্মা হিমালয়’। এই শীর্ষকটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন কালিদাসের
কুমারসম্ভবের বিখ্যাত শ্লোক থেকে,
অস্ত্যুত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা হিমালয়ো নাম নগাধিরাজঃ |
পূর্বাপরৌ তোয়নিধী বিগাহ্য স্থিতঃ পৃথিব্যা ইব মানদণ্ডঃ ||
হিমালয় আমাদের কাছে চির দুর্জ্ঞেয় রহস্য, দুর্নিবার তার আকর্ষণ।
বুঝি বা সেই রহস্যের টানেই পর্যটকরা বারবার ছুটে যান। এই প্রসঙ্গে
আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিক
হবে না। ‘দেবতাত্মা হিমালয়’ গ্রন্থের মুখবন্ধে জওহরলাল মন্তব্য
করেছিলেন
‘হিমালয় যে শুধু ভারতের বিস্তীর্ণ ভূভাগের শীর্ষে নগাধিরাজ রূপেই
বিরাজমান তাই নয়, প্রত্যেক ভারতবাসীর অন্তরে তার একটি গভীর বাণীও
মন্দ্রিত। ইতিহাসের ঊষাকাল থেকে হিমালয় আমাদের জাতির জীবনের সঙ্গে
গ্রথিত; এবং শুধু যে আমাদের রাষ্ট্রনীতিকেই হিমালয় প্রভাবিত করে
এসেছে তাই নয়, আমাদের শিল্পকলা,আমাদের পুরাণ এবং ধর্মের সঙ্গেও
এই পর্বতমালা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে আছে। সুদূর অতীতকাল থেকে হাজার
হাজার বছর ধরে আমাদের জাতীয় জীবনের বিকাশে হিমালয় যে অংশগ্রহণ
করেছে, আমার মনে হয় পৃথিবীর অন্য কোথাও অপর কোন পাহাড়-পর্বত বা
গিরিশ্রেণী তা করতে সক্ষম হয়নি”।
কালিদাসের ‘নগাধিরাজ’ বিশেষণের যাথার্থ্য আমরা বুঝতেই পারি।
প্রবোধ কুমার সান্যাল
|
হিমালয়ের মূল মেরুদন্ড দক্ষিণ-পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিমে কাশ্মিরের
শেষপ্রান্তে হিন্দুকুশের সঙ্গে মিলেছে। হিমালয়ের সেই মেরুদন্ডের
দুই পার ছিল তাঁর ভ্রমণের পথ। সাতটি পার্বত্য ভূভাগে দুর্গম অঞ্চল
সহ বিস্তীর্ণ পথ পরিক্রমণের বৃত্তান্ত লিখেছেন উত্তর ‘হিমালয় চরিত’
গ্রন্থে। সেই ভ্রমণ-কথায় মিশে আছে সেইসব অঞ্চলের সামাজিক ইতিহাস,
পৌরানিক কথা, নানান জাতি ও সমাজের স্তরবিন্যাস, শ্রেণী, বর্ণ ও
ভাষার কথা, তাদের লোকাচার ও দৈনন্দিন যাপনের বিশ্বস্ত ছবি। হিমালয়
কেন বারবার তাঁকে টেনে এনেছিল, সেই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন ‘উত্তর
হিমালয় চরিত’ গ্রন্থের মুখবন্ধে। লিখেছেন –
“এই ভ্রমণের পিছনে ছিল জানা ও অজানা পার্বত্যলোকের প্রতি আমার
অন্ধ আসক্তির টান। আমার প্রকৃতিগত অস্থিরতা একমাত্র নিভৃত হিমালয়ের
মধ্যেই স্থৈর্য লাভ করে। আমার পঞ্জরাস্থিমালা হিমালয়ের সঙ্গে মেলানো”।
নিতান্ত শৈশবে মাত্র চার বছর বয়সে পিতৃহীন প্রবোধকুমার জননী বিশ্বেশ্বরী
দেবীর হরিদ্বার-হৃষিকেশ তীর্থভ্রমণে সঙ্গী হয়েছিলেন ১৯২৩ এর অক্টবরে,
প্রবোধকুমার তখন ১৮ বছরের কিশোর। জননীই তাঁকে প্রথম হিমালয় চিনিয়েছিলেন।
‘দেবতাত্মা হিমালয়’ গ্রন্থের ভুমিকায় প্রবোধকুমার লিখেছেন,
“সাধারণত যে জগতে ও যে সমাজে আমার চলাফেরা ছিল, হিমালয় তার
থেকে সম্পূর্ণ পৃথক সুতরাং, সেদিনকার সেই তরুণ বয়সের একটি বিশেষ
সন্ধিক্ষণে সমগ্র হিমালয় আমার চোখে এক বিচিত্র অভিনব আবিষ্কার
মনে হয়েছিল। নূতনের আকস্মিক আবির্ভাবে চমক লেগেছিল আমার জীবনে।
যিনি আমাকে প্রথম হিমালয় চিনিয়েছিলেন, সেই জননীর অজ্ঞাতসারেও
আমাকে বারকয়েক হিমালয়ের কয়েকটি অঞ্চলে যেতে হয়েছিল। কারণ তিনি
জেনেছিলেন এ নেশা আমাকে পেয়ে বসেছে”।
হিমালয়ের টানেই প্রবোধকুমার সেনা বিভাগে চাকরি নিয়ে দেড় বৎসরকাল
পীরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণির ‘কো-মারি’ অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন। এখন এই
অঞ্চলটি পাকিস্তানের অন্তর্গত।
জননীর তীর্থভ্রমণের সঙ্গী হয়ে প্রথম হিমালয় চেনা ও তার দূর্বার
আকর্ষণ বোধ করলেও তার বারংবার হিমালয় ভ্রমণ তীর্থ-ভ্রমণের টানে ছিল
না। ‘দেবতাত্মা হিমালয়’ ও ‘উত্তর হিমালয় চরিত’এ অসংখ্য দেবালয় ও
তীর্থস্থানের বিবরণ দিয়েছেন, সেগুলির প্রতিষ্ঠার পেছনে ইতিহাস ও
পৌরাণিক পৃষ্ঠভূমির বিশ্বাসযোগ্য বৃত্তান্ত শুনিয়েছেন। তবু প্রবোধকুমারের
‘হিমালয় ভ্রমণ-কথা’ কখনোই ‘তীর্থ-ভ্রমণ-কথা’ হয়ে ওঠেনি। তাঁর নিজের
কথায়,
“হিমালয় পর্যটক বলেই যে আমি তীর্থযাত্রী – একথা সত্য নয়। লক্ষ্যটা
আনন্দের উপলক্ষ্যটা তীর্থের। হিমালয়ের রঙ মেখেছি আমি সর্ব দেহে মনে,
রস পেয়েছি সর্বত্র। কেবলমাত্র তীর্থযাত্রা করাই যদি মূল উদ্দেশ্যই
হত তাহলে যেদিন বদ্রীনাথ মন্দিরে ঢুকে বিষ্ণুমূর্তি দর্শন করলুম,
সেদিনই আমার গাড়োয়াল দেখা শেষ হয়ে যেত। ... হিমালয়ের সকল তীর্থদেবতা
দর্শন মোটামুটি দশ বছরেই শেষ হয়, কিন্তু বত্রিশ বছরেও আমার কাছে
হিমালয় শেষ হয়নি”।
১৯২৩ এ জননীর সঙ্গে প্রথম হিমালয় চিনেছিলেন তারপর ১৯৫৫ পর্যন্ত
বারবার হিমালয় পর্যটন করেছেন। নিতান্ত শৈশবে পিতৃহারা প্রবোধকুমার
প্রতিপালিত হন কলকাতায় মাতুলালয়ে (জন্মও মাতুলালয়ে, ৭ই জুলাই ১৯০৫)।
স্কটশচার্চ কলেজিয়েট স্কুল ও সিটি কলেজে অধ্যয়ন করেন। ডাক বিভাগ
ও পরে হিমালয়ের টানে সামরিক বিভাগেও কয়েক বছর কর্মরত ছিলেন। ১৯৩৭
থেকে ১৯৪১ অধুনা লুপ্ত ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগের
সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩০ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ
করেছেন যারা তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বহু পাঠকবন্দিত উপন্যাস ও
গল্পের স্রষ্টা প্রবোধকুমার। তাঁর কাহিনী অবলম্বনে বহু সফল চলচ্চিত্র
নির্মিত হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে, কাঁচ কাটা হীরে, পুষ্পধনু, প্রিয়
বান্ধবী ইত্যাদি। মূলত কল্লোল যুগের সাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিত প্রবোধ
কুমার। তিনি একাধিক পুরস্কার লাভ করেন সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ।
বন্ধু রূপে পেয়েছিলেন সেকালের বহু নামী দামী সাহিত্যিককেও। সবিতেন্দ্রনাথ
রায় মহাশয়ের কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর (১ম পর্ব) – বইটিতে দেখা যায়,-
“কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে দিলখুসা কেবিন আর জ্ঞান বাবুর চায়ের দোকানের
আড্ডা যখন তুঙ্গে, তখনই দুই সাহিত্যিক গজেন্দ্র কুমার মিত্র ও সুমথনাথ
ঘোষ ১৯৩৪-এর মার্চে গোড়াপত্তন করেন মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্সের; আড্ডার
আরও একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। আড্ডার প্রথম যুগের মানুষ কবি শেখর
কালিদাস রায়, ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, কবি কৃষ্ণদয়াল
বসু, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ কুমার সান্যাল যোগ দিলেন
আড্ডায়”।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, প্রবোধকুমারকে ঘাটশিলায় টেনে আনতে চেয়েছিলেন
পর্যটক মননের সাহিত্যিক অরণ্যপ্রেমি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বলেছিলেন,
"ঘাটশিলায় চলে এসো, ওই ঢাকুরিয়াতে থাকলে তোমার স্বাস্থ্য টিকবে না।
"
তবু নিশ্চিতভাবেই ‘পর্যটক প্রবোধকুমার’ বাংলা সাহিত্যের পাঠকমনে
এক অন্যতর উচ্চতায় আসীন। তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত কল্লোল
যুগের সাহিত্যিকরা সেইভাবে হয়তো
হিমালয় ভ্রমণ-পিপাসু ছিলেন না। কাজেই এই ব্যাপারে তাঁকে একেবারে
পথিকৃৎই বলা চলে। এই নতুন বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি
বাঙালীদের মনে প্রবল হিমালয় প্রেমের সূচনা করেন। তাঁর কাহিনী অবলম্বনে
নির্মিত ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ চলচ্চিত্রটি ও খুবই জনপ্রিয় ও উচ্চমানের।
বস্তুত, বাঙালীর জীবনে হিমালয়ের আকর্ষণের শুরু এই ভ্রমণ-কাহিনী
পাঠ ও এই চলচ্চিত্র দর্শন দিয়েই। হিন্দীতেও চলচ্চিত্র হয় ‘যাত্রিক’
নামে। এই লেখাটির তুমুল জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য এই দুটি ছবি। ভারত
ও নেপাল ছাড়াও এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়া নানান অঞ্চল ভ্রমণের
অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। কলকাতার হিমালয়ান অ্যাসোশিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা
ভ্রমণপিপাসু প্রবোধকুমার ১৯৭৮ এ নরওয়ের পথে উত্তরমেরু ভ্রমণ করেন,
তখন তাঁর বয়স তিয়াত্তর বছর। সেদিক দিয়ে প্রবোধকুমার সান্যালকে
বিশ্বপর্যটকও বলা যায়। তবুও, বাংলাসাহিত্য তাঁকে মনে রাখবে তিন
অনন্য হিমালয় ভ্রমণ-কথা ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘দেবতাত্মা হিমালয়’
ও ‘উত্তর হিমালয় চরিত’ গ্রন্থের জন্য।
সার্থক ভ্রমণকাহিনী শুধুমাত্র সেই অঞ্চলের ভৌগোলিক বিন্যাস বা
অন্য প্রান্ত থেকে সেখানে যাওয়ার পথনির্দেশ নয়। সেখানকার মানুষ,
তাদের জীবনযাপন, আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি সবই সেই ভ্রমণবৃত্তান্তের
অঙ্গীভূত হয়। আর থাকে পর্যটকের ইতিহাস চেতনা ও মানুষকে দেখার চোখ।
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তর শুরুতেই ভ্রমণকাহিনী লেখা সম্পর্কে যা
বলেছিলেন তা আজও প্রণিধানযোগ্য-
“কিন্তু বলিলেই ত বলা হয় না। ভ্রমণ করা এক, তাহা প্রকাশ করা
আর। যাহার পা-দুটা আছে, সেই ভ্রমণ করিতে পারে; কিন্তু হাত-দুটা
থাকিলেই ত আর লেখা যায় না! সে যে ভারি শক্ত।
খোদ শরৎচন্দ্র যে কাজকে ‘ভারি শক্ত’ বলেছেন, সেই কাজ করাতে অগ্রণী
ভূমিকা নিয়েছিলেন যাঁরা, প্রবোধ সান্যালের নাম একেবারে প্রথম সারিতেই
আসবে।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি উক্তিও স্মরণ করি। বলেছিলেন
“ভ্রমণ থেকেই হয় ভ্রমণ কাহিনী, কিন্তু ভ্রমণকারীদের সকলের হাত
দিয়ে নয়”।
জীবন পর্যবেক্ষণ, প্রকৃতির অবলোকন আর সাহিত্যের স্বাদ ভ্রমণ-কথাকে
পাঠযোগ্য করে তোলে। প্রবোধকুমারের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ কিংবা ‘দেবতাত্মা
হিমালয়’ বাংলা সাহিত্যের সার্থক ভ্রমণ-সাহিত্য রূপে চির নন্দিত।
হিমালয় পর্বতমালা (চিত্রসূত্র - উইকিপেডিয়া )
প্রবোধকুমারের বত্রিশ বছরের বারংবার হিমালয় পরিক্রমণের সেরা ফসল
তার দুই খন্ডের গ্রন্থ ‘দেবতাত্মা হিমালয়’। হিন্দুকুশ উপত্যকা
থেকে পার্বত্য আসাম পর্যন্ত হিমালয়ের যে বিস্তৃত ভৌগোলিক উত্তর-প্রাচীর
তার প্রত্যেকটি ভূভাগই তাঁর ভ্রমণের মধ্যে এসেছে। চব্বিশটি পর্যায়
ভাগ করে তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত সন্নিবেশিত করেছেন ‘দেবতাত্মা হিমালয়’
গ্রন্থে। অভ্রভেদী সুবিস্তৃত হিমালয় – আর সেই পর্বতমালা থেকে হাজার
হাজার বছর ধরে সমতলে নেমে আসা স্রোতধারা সৃষ্ট খরতোয়া নদীর দুপাশে
গড়ে ওঠা উপত্যকার সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে পর্যবেক্ষণ করেছে শিল্পীর
জিজ্ঞাসু মন ও দৃষ্টিতে। আমাদের শুনিয়েছেন সেই বিবরণ। তার পরেও
শুনিয়েছেন এক সারসত্য,
“মানুষের এক জন্মে সমগ্র হিমালয় আনুপূর্বিকভাবে ভ্রমণ ও পর্যবেক্ষণ
করা সম্ভব নয়। এ কাজ আয়ুষ্কালের একশো বছরেও কুলায় না”।
এই গ্রন্থ রচনার বত্রিশ বছর আগে যখন জননীর সঙ্গী হয়ে তরুণ প্রবোধকুমার
হরিদ্বার, হৃষিকেশ, গঙ্গোত্রি ভ্রমণ করেছিলেন, তাঁর প্রথম তারুণ্য
চোখ মেলেছিল শিবলিঙ্গ পর্বতমালার নীচে গঙ্গাবতরণের প্রান্তে। যে
অঞ্চলটির প্রাচীন নাম ব্রহ্মপুরা, চারশো বছর পরে নাম হয় গাড়োয়াল।
প্রবাদপ্রতীম গ্রন্থটির প্রথম পরিচ্ছদটির শিরোনাম তাই ‘ব্রহ্মপুরা
গাড়োয়াল’। তারপর বত্রিশ বছরে বারবার গিয়েছেন এই ব্রহ্মপুরার প্রান্তসীমায়
জিজ্ঞাসু মন নিয়ে। কিসের অন্বেষণে? কোন জিজ্ঞাসা নিয়ে? আমাদের
যুগ-যুগান্তরের বিশ্বাস অভ্রভেদী হিমালয়ের প্রথম স্তর হলো ‘ব্রহ্মলোক’,
তার নিচে শিবলিঙ্গ পর্বতমালার দূরতিক্রম্য স্তরটি ‘দেবলোক’ আর
হিমালয়ের পাদমূলে যে স্তরে গঙ্গা প্রসারিত তা হ’ল মর্ত্যলোক। গঙ্গার
অবতরণ উত্তর ব্রহ্মপুরার গোমুখ থেকে। প্রবোধকুমারের হিমালয় ভ্রমণকথা
তীর্থভ্রমণের বৃত্তান্ত নয়, একথা উল্লেখ করেছি। আবার হ্যাঁ, তীর্থভ্রমণও
বটে। কারণ তাঁর কাছে “পথই তীর্থ, এবং সেটি হলো গঙ্গাবতরণের পথ”।
তাঁর সেই তীর্থ পরিক্রমণের অসমান্য বিবরণের কয়েকটি পংক্তি পুণরায়
স্মরণ করার লোভ সম্বরণ করা গেলো না। লিখেছেন,
“ব্রহ্মলোকের গিরিসংকটে এবং গঙ্গাকে অনুসরণ করে যাবো যতদূর তার
গতি, - এরই নাম তীর্থ পরিক্রমা ...... দেবতাত্মা হিমালয়ের রহস্যলোকে
এই অলকাপুরীর দর্শনপিপাসায় ছোটে মর্ত্যবাসী তীর্থযাত্রীরা। দুস্তর
চড়াইপথে বুক ফেটে মরেছে কত মানুষ, নিঃশ্বাসের বায়ু খুঁজে না পেয়ে
মরেছে, অভ্রভেদী গিরিচূড়ার সংকীর্ণ শঙ্কটে পদস্খলন ঘটে মরেছে কত
শত, - ইতিহাসে তার হিসাব নেই কোথাও ... তবু কোনকালে মানুষকে স্থির
থাকতে দেয়নি ওই ব্রহ্মপুরার গঙ্গাপথ। গিরিসংকটের ভিতর দিয়ে যেমন
চলেছে উন্মাদিনী জলধারা, তেমনি চলেছে তার পাশে-পাশে দুর্বার গতিতে
তীর্থযাত্রী দলের অজেয় প্রাণধারা। সুখ দুঃখ স্নেহ মোহ বেদনা দয়া
প্রীতি, - ওরাও চলেছে ওদের সঙ্গে সঙ্গে ... ওদের ওই আনন্দ-বেদনার
তরঙ্গদোলায় আমিও নিজেকে বার বার মিলিয়ে দিয়েছি”।
নিরস ভ্রমণ-বৃত্তান্ত নয়, এ যেন ভ্রমণের কাব্যকথা। ভ্রমণ-কথা
কেমন হওয়া উচিৎ তারও নির্দেশ করে গেছেন প্রবোধকুমার। ‘উত্তর হিমালয়
চরিত’ গ্রন্থের ভুমিকায় লিখেছেন,
“ভ্রমণকাহিনী রচনার নির্দিষ্ট পদ্ধতি কিছু নেই। পায়ের সঙ্গে মন
হাঁটে, মনের খুশিমতো বিষয়বস্তুও হাঁটে। ভ্রমণের সকল বৃত্তান্তের
মধ্যে গতিশীলতার স্বাদ না থাকলে সে-বস্তু প্রাণসত্তাহীন”।
প্রবোধকুমারের জীবন-পর্যবেক্ষণের মূল সূত্রই এই গতিশীলতা। তাঁর
ভ্রমণ-সাহিত্যেরও প্রাণ-বিন্দু। প্রবোধকুমারের অমর সৃষ্টি ‘দেবতাত্মা
হিমালয়’ শেষ পংক্তি ক’টি বোধকরি সমস্ত হিমালয় ভ্রমণ-কথারই প্রাণ-বিন্দু,
“অতৃপ্তি আর অসন্তোষ থাক জীবনজোড়া, থাক নিবিড় নৈরাশ্য আর অসীম
কালের বিরহবেদনা, থাক অনন্তলাভের প্রবল ব্যাকুলতা, - এরা তীর্থযাত্রার
পাথেয়। কোথায় পৌঁছবো, সঠিক জানা নেই। কিন্তু আপন চিত্তের অশ্রান্ত
গতি কামনা করি। যে গতি গঙ্গার, যে গতি সৃষ্টিলোকের, সেই গতিই জীবনের।
একথাটি জেনেছি, গতিহীনতাই অপমৃত্যু”।
আমাদের অতএব সংশয় থাকে না, কেন তাঁর প্রথম হিমালয় ভ্রমণের প্রায়
একশো বছর পরেও প্রবোধকুমার সান্যাল রহস্যঘেরা হিমালয় ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ
কথাকারের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।
(উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে শব্দগুলির বানান অপরিবর্তিত)
লেখক পরিচিতি - প্রবীণ সাহিত্যকর্মী। বাংলা
গদ্যসাহিত্যে তাঁর অবাধ বিচরণ। মূলত প্রাবন্ধিক। ছোট গল্প ও নাটকও
লেখেন। বিভিন্ন অন্তর্জাল ও মুদ্রিত পত্রিকায় তাঁর বহু মননশীল
প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আঠেরো ও উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাস
ও বিবর্তন তাঁর বিশেষ আগ্রহের যায়গা। প্রায় চুয়াত্তর পেরনো বয়সে
দুটি অন্তর্জাল পত্রিকা – ‘অন্যনিষাদ’ ও ‘গল্পগুচ্ছ’ প্রকাশ করে
চলেছেন গত পাঁচ বছর ধরে । ‘অবসর’এ এটিই তাঁর প্রথম লেখা।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।