বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা
ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫
দিগন্তের শেষ স্টেশন
ঈশানী রায়চৌধুরী
অদ্ভুত নাম কিন্তু ট্রেনটার। দিগন্ত এক্সপ্রেস। শুধু দুটো স্টেশনের
মধ্যে যার চলাফেরা। নিশ্চিন্দিপুর আর দিকশূন্যপুর। এবার আমি গোঁ
ধরে বসেছিলাম এই ট্রেনে আমায় চড়তেই হবে। আর আমার কেই বা আছে ,
যে এসব উদ্ভট ভাবনার গোড়ায় ধোঁয়া দেবে , এক নীলুচন্দর ছাড়া? সে
ব্যাটার সব সময়েই একমুখ হাসি আর বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্টের আড়ালে
লুকোনো রোগাভোগা বুকে আমার জন্য জমিয়ে রাখা অগাধ প্রশ্রয়।
বলল , নিয়ে যাব তোকে , তবে আমাদের সঙ্গে আরও একজন যাবে
কিন্তু।
-- কে রে?
-- ট্রেনে উঠেই দেখতে পাবি। সারপ্রাইজ।
ট্রেনটা কেমন অন্য রকম। আমরা ছাড়া একটিও যাত্রী নেই। রওনা হবার
কথা নিশ্চিন্দিপুর থেকে। কলকাতা থেকে লজঝর মার্কা বাসে চাপিয়ে
নীলু নিয়ে এসেছে আমাকে। এ কেমন স্টেশন রে বাবা! আর হতচ্ছাড়ার আক্কেল
দ্যাখো! আমাকে নিঝুম কামরায় বসিয়ে "আসছি" বলে স্রেফ
হাওয়া হয়ে গেল।
ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। একটু একটু ভয় ভয় করছে এখন।
নীলু ব্যাটা বিনে টিকিটেই বেড়াতে যাচ্ছে নাকি কে জানে! শুধুই রেললাইন
বিছানো আছে , বাঁধানো প্ল্যাটফর্মের বালাই নেই। টিকিটঘর , চায়ে
গ্রাম , পানি পাঁড়ে কিস্যুই নেই। তাহলে কী আছে? জানলা দিয়ে মুখ
বাড়িয়ে দেখি ....দূরে ....
"মাঠের ঝোপঝাপগুলো উলুখড় ,বনকলমী , সোঁদাল
ও কুলগাছে ভরা। কলমীলতা সারা ঝোপগুলার মাথা বড় বড় সবুজ পাতা বিছাইয়া
ঢাকিয়া দিয়াছে -- ভিতরে স্নিগ্ধ ছায়া , ছোট গোয়ালে , নাটাকাঁটা ও
নীল বন-অপরাজিতা ফুল সূর্যের আলোর দিকে মুখ উঁচু করিয়া ফুটিয়া আছে
, পড়ন্ত বেলার ছায়ায় স্নিগ্ধ বনভূমির শ্যামলতা , পাখির ডাক , চারিধারে
প্রকৃতির মুক্ত হাতে ছড়ানো ঐশ্বর্য রাজার মতো ভাণ্ডার বিলাইয়া দেয়
, কোথাও এতটুকু দারিদ্র্যের আশ্রয় খুঁজিবার চেষ্টা নাই , মধ্যবিত্তের
কার্পণ্য নাই। বেলাশেষের ইন্দ্রজালে মাঠ , নদী , বন মায়াময়।"
ওই তো নীলু! একটা ফর্সা ডাগর চোখ ফিনফিনে নাক আর লালচে অভিমানী
ঠোঁটের বছর আষ্টেকের খোকার হাত ধরে। খোকার পরনে
একটা খাটো কাপড়, গায়ে পাতলা পিরান, বগলে ভাঁজ করা সস্তা চাদর একটা
আর ওই হাতেই একটা ছোট টিনের সুটকেস। মরেছে! এই দুধের ছেলেকে নিয়ে
ব্যাটা নিরুদ্দেশে যাবার মতলব ফেঁদেছে নাকি? নীলু নড়া ধরে বাচ্চাটাকে
ট্রেনে তুলল আর অমনি কু ঝিকঝিক শব্দ করে ট্রেনটা চলতে শুরু করল।
নীলু একগাল
হেসে আমাকে বলল,
-- চিনতে পারছিস?
আমি রাগ রাগ গলায় বললাম,
-- চেনার কথা ছিল নাকি?
নীলু কেমন মজার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে খোকাকে বলল ,
-- এ: , তোকে চিনতে পারছে না! এই না হলে মেয়েদের বুদ্ধি!
ছেলেটা অমনি বাঁশির মতো রিনরিনে গলায় বলে উঠল ,
-- অপু। আমি অপু।
আমি ছটফটিয়ে উঠলাম। অপু মানে? কে অপু? কোন অপু?
নীলু বলল,
-- বড্ড মায়া রে আমার এই ছেলেটার ওপর। ও বুঝলি আমার ফেলে আসা, ভুলে
যাওয়া অবাক চোখের ছেলেবেলা। আজও আমি আয়নার সামনে দাঁড়ালে যে আমার
চেনা ছায়া আড়াল করে ছোট্ট শরীরটা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। ও হল সেই
মাঠের মাঝে একা দাঁড়িয়ে অবোধ অবুঝ মনের শিশু, যে ভাবে ....কী ভাবে?
"ওই মাঠের পর ওদিকে বুঝি মায়ের মুখের সেই রূপকথার রাজ্য?
শ্যাম -লকাঁর দেশে বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর গাছের নীচে , নির্বাসিত রাজপুত্র
যেখানে তলোয়ার পাশে রাখিয়া শুইয়া রাত কাটায়? ও-ধারে আর মানুষের
বাস নাই , জগতের শেষ সীমাটাই এই। ইহার পর হইতেই অসম্ভবের দেশ ,
অজানার দেশ শুরু হইয়াছে।"
নীলু উদাস গলায় বলল ,
-- জানিস , আমাদের বাড়ি থেকেও খানিক দূরে একটা ..অশ্বত্থ নয় ,
নিমগাছ ছিল। যতবার সেদিকে চোখ চলে যেত , এই অপুর মতোই অনেক অনেক
দূরের কোনো দেশের কথা মনে পড়ত আমার। আর ঠিক তক্ষুনি মায়ের জন্য
মনটা কেমন ছটফটিয়ে উঠত। দৌড়ে ভেতরে গিয়ে মায়ের আঁচলের গন্ধ খুঁজতাম।
সে যাক গে , কী রে অপু, রেলগাড়ি চেপে লাগছে কেমন?
অপু বড় বড় চোখে অনেকখানি আনন্দের সঙ্গে সামান্য লজ্জা মিশিয়ে বলল
,
-- ভালো নীলুদা , খুউউব ভালো। আমাদের পাড়ার রাজকেষ্ট জ্যেঠু কত
জায়গায় যায় রেলগাড়ি চেপে! নাভিগয়া , বিন্ধ্যাচল ..সে আরও কত কত
নাম! নীলুদা , তুমি কি জানো ..চিকামসজিদ কোথায়? আর সাবিত্রী পাহাড়?
আমিও অপুর চোখে চোখ রেখে ছবি দেখছিলাম।
নিশ্চিন্দিপুর। অপু। আমার চোখে সে এক অলীক ভুবন।
"সে গ্রামের ছায়া -ভরা মাটির পথে একটি মুগ্ধ গ্রাম্য বালকের
ছবি আছে। বইদপ্তর বগলে লইয়া সে তাহার দিদির পিছনে পিছনে সাজিমাটি
দিয়া কাচা , সেলাই করা কাপড় পরিয়া পাঠশালা হইতে ফিরিতেছে , তাহার
ছোট্ট মাথাটির অমন রেশমের মতো নরম চিক্বন সুখ -স্পর্শ চুলগুলি
তাহার মা যত্ন করিয়া আঁচড়াইয়া দিয়াছে -- তাহার ডাগর ডাগর সুন্দর
চোখ দুটিতে কেমন অবাক ধরনের চাহনি-- যেন তাহারা এ কোন অদ্ভুত জগতে
নতুন চোখ মেলিয়া চাহিয়া চাহিয়া দিশাহারা হইয়া উঠিয়াছে। গাছপালায়
ঘেরা এইটুকুই কেবল তাহার পরিচিত দেশ -- এখানেই মা রোজ হাতে করিয়া
খাওয়ায়, চুল আঁচড়াইয়া দেয় , দিদি কাপড় পরাইয়া দেয়। এই গণ্ডিটুকু
ছাড়াইলেই তাহার চারিধার ঘিরিয়া অপরিচয়ের অকুল জলধি! তাহার শিশুমন
থৈ পায় না !"
এ কী রে বাবা! এদের কি ট্রেনে উঠলে খিদেও পায় না? দুজনের কারো
মুখেই খিদে খিদে দু:খ নেই তো! আর ট্রেন তো থামেও না কোথাও! ভাগ্যিস
ব্যাগে আপেল , বিস্কুট আর চানাচুর ছিল! বের করতে নীলু নির্বিকারভাবে
আমার হাত থেকে নিয়ে কচরমচর করে আপেল চিবোচ্ছে। ভাবখানা এমন যেন
আমারই তো আনার কথা এ সব! ও মা , অপুর ছোট্ট লাল টুকটুকে হাঁ- মুখ
কী যে মিষ্টি!
নীলু বলল ,
-- জানিস অপু , আমার একটা নদী , একটা পাহাড় আর গোটা একটা আকাশ
আছে। সেই সতেরো বছর বয়স থেকে। তখন আমি এত ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতামই
না! যত বৃষ্টি পড়ত আকাশ ভেঙে ...সব বৃষ্টি আমার! যখন খুশি , যে
খুশি , যতবার খুশি স্নান করে নিতে পারে। সে নদীর নাম দিয়েছিলাম
ভালোবাসা , সে পাহাড়ের নাম ছিল অমরাবতী , আর সে আকাশের নাম ছিল....মেঘমহল।
অপু হাততালি দিয়ে উঠল।
-- মেঘমহল আমিও দেখেছি নীলুদা। মেঘের রাজবাড়ি| তাতে হাতির মুখ
, সিংহের মুখ। মেঘের পাহাড়, মেঘের দ্বীপ, মেঘের সমুদ্র, মেঘের
স্বপ্নপুরী।
নীললোহিত (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
|
নীলু
বিপুল উৎসাহে অপুর পিঠ চাপড়ে বলল ,
-- ঠিক বলেছিস। এটাই আসল কথা। ইচ্ছে করলে তামাম দুনিয়ার আমিই মালিক
হতে পারি। ভগবান আমাদের দু-জোড়া চোখ দিয়েছেন, বুঝলি! একজোড়া শরীরের
, অন্য জোড়া মনের। মনের চোখ খোলা রাখবি সারাক্ষণ। শরীর থাক না
যেখানে খুশি! একজোড়া ইচ্ছেডানা লাগিয়ে নে পিঠে , ব্যস!
নীলুটা
হয়েছে জন্মের গুলবাজ! এইটুকু দুধের খোকাকে যা খুশি তাই শেখাচ্ছে!
আমি বললাম,
-- তুমি আগে কখনও ট্রেনে চড়েছ অপু?
অপু উজ্জ্বল চোখদুটো তুলে বলল ,
--- দিদি আমায় প্রথম রেললাইন দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। আমি তো জন্ম
থেকে তেমন কোথাও যাইনি। ওই বকুলতলা , গোঁসাইবাগান, চালতেতলা ...খুব
জোর ওই নদীর ধার| নদীর ওপারে বাবলাগাছে হলুদ ফুল, গরু চরছে, শিমূলগাছের
গায়ে দুলছে গুলঞ্চলতা, অক্কুর মাঝি মাছ ধরার দোয়াড়ি পাততে যায়
, বাতাসে কেমন দুলত সোঁদালি ফুল...আর মস্তবড় উল্টানো বাটির মতো
নীল আকাশটা অনেক দূরে মিশে গেছে সবুজ মাঠে ... ঠিক যেন নীল শাড়িতে
সবজে পাড় ...
নীলু বলল,
-- ওই তো তোর 'অজানি দেশের না -জানি কী' রে অপু!
আমি জিজ্ঞেস করলাম ,
-- রেললাইন দেখেছিলে অপু?
অপু বলল ,
-- না: , সেবারে আর কই? আমাদের রাঙী গরুটার বাছুর খুঁজতে খুঁজতে
অনেক দূর চলে গেছিলাম তো! মাঠ বিল জলা ভেঙে
সে
যা ছুট লাগিয়েছিলাম আমরা! রোয়ার মাঠ , জলছত্তরতলা , ঠাকুর -ঝি
পুকুর .... উফফ ....
আমিও যেন দেখতে পাচ্ছিলাম ...
“জীবনে এই প্রথম বাধাহীন গণ্ডিহীন মুক্তির উল্লাসে তাহাদের তাজা
তরুণ রক্ত তখন মাতিয়া উঠিয়াছে। পরে কী হইবে, তাহা ভাবিবার অবসর
কোথায়?"
-- তারপর কী হল?
-- ইস, একটু পরে হোগলা আর শোলা গাছে ভরা একটা মস্ত জলা, সামনে
শুধু ধানজমি, বেতঝোপ, আমরা পথ আর চিনতে পারি না! দিদির কাপড় ছিঁড়ে
একসা , আমার পায়ে কাঁটা ফুটে গেল ..উফ মা গো , বাড়ি ফিরে একঝুড়ি
মিছে কথা .... দিদি তো তারপর চলেই গেল। দিদির আর রেলগাড়ি চড়া হল
না!
অপুর ডাগর চোখ উপচে উঠল জলে।
-- তারপর বাবার সঙ্গে রেলগাড়ি চড়লাম। রাঙা রাঙা খোয়ার রাশি উঁচু
হয়ে কেমন ধারের দিকে সারি দেওয়া। সাদা সাদা খুঁটি, কেমন গোছ করে
তার বাঁধা, দুটো লোহার পাতের ওপর দিয়ে রেলগাড়ি যায় ... আমি দেখলাম
...কিন্তু দিদিটা ....
আমার বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠল| বড্ড অবোধ হাঁ-করা ছেলে অপু!
“তুমি চলিয়া যাইতেছ ... তুমি কিছুই জানো না, পথের ধারে তোমার চোখে
কী পড়িতে পারে, তোমার ডাগর নবীন চোখ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধায় চারিদিককে
গিলিতে গিলিতে চলিয়াছে ... নিজের আনন্দের এ হিসাবে তুমিও একজন
দেশ -আবিষ্কারক। অচেনার আনন্দকে পাইতে হইলে পৃথিবী ঘুরিয়া বেড়াইতে
হইবে, তাহার মানে নাই। আমি যেখানে আর কখনো যাই নাই, আজ নতুন পা
দিলাম, যে নদীর জলে নতুন স্নান করিলাম, যে গ্রামের হাওয়ায় শরীর
জুড়াইল, আমার আগে সেখানে কেহ আসিয়াছিল কিনা, তাহাতে আমার কী আসে
যায়? আমার অনুভূতিতে তাহা যে অনাবিষ্কৃত দেশ! আমি আজ সর্বপ্রথম
মন, বুদ্ধি, হৃদয় দিয়া উহার নবীনতাকে আস্বাদ করিলাম যে!"
নীলু অপুকে কাছে টেনে নিয়ে হাতের বেড়ে ওর ছোট্ট রোগা পিঠটা জড়িয়ে
নিল।
-- জানো নীলুদা , আমাদের বাড়ির ধারে যে বনজঙ্গল ..সে যেন আর ফুরোয়
না! এত সবুজ এত সবুজ...ঠিক যেন সমুদ্দুরের ঢেউ।
-- তুই কী করে জানলি? সমুদ্র দেখেছিস?
-- গল্প শুনেছি তো রাজকেষ্ট জ্যাঠার বাড়িতে। সব সময়ে বুঝি সব কিছু
গিয়েই দেখতে হয় নীলুদা? আমরা যে বড্ড গরীব! ছবিতে দেখি , গল্প
শুনে চিনি ....। তুমি দেখেছ কখনো বন -চালতা গাছের নীচে খঞ্জন পাখির
নাচ? তুমি দেখেছ বড় বড় গাছের আড়ালে ছোট গাছগুলো যখন রোদ্দুর না
পেয়ে মরে যায় ...ওদের সবুজ চোখে কেমন কান্না লেগে থাকে? তুমি চেনো
বন-কলমী, নাটা-কাঁটা, ময়না -ঝোপ? আমাকে যখন ফেরত দিতে আসবে, সব
দেখাব তোমাকে, সব!
"এই বন শ্যামলতার নবীন স্পর্শটুকু তাহার আর তাহার দিদির
মনে বুলাইয়া দিয়াছিল। জন্মিয়া অবধি এই বন তাহাদের সুপরিচিত, প্রতি
পলের প্রতি মুহূর্তের নীরব আনন্দে তাহাদের পিপাসু হৃদয় কত বিচিত্র
, কত অপূর্ব রসে ভরিয়া তোলে। বর্ষাসতেজ , ঘন সবুজ ঝোপের মাথায়
নাটা - কাঁটার সুগন্ধ ফুলের হলুদ রঙের শীষ , আসন্ন সূর্যাস্তের
ছায়ায় মোটা ময়না -কাঁটা ডালের আগায় কাঠবিড়ালীর লঘুগতি আসাযাওয়া
, পত্রপুষ্পফলের সে প্রাচুর্য , সবাকার অপেক্ষা যখন ঘন বনের প্রান্তবর্তী
, ঝোপঝাপের সঙ্গীহীন বাঁকা ডালে বনের কোনো অজানা পাখি বসিয়া থাকে
, তখন তাহার মনের বিচিত্র অপূর্ব গভীর আনন্দরসের বর্ণনা সে মুখে
বলিয়া কাহাকেও বুঝাইতে পারে না। সে যেন স্বপ্ন , যেন মায়া ..।
চারিপাশে ঘিরিয়া পাখি গান গায়, ঝুরঝুর করিয়া ফুল ঝরিয়া পড়ে, সূর্যাস্তের
আলো আরও ঘন ছায়াময় হয়।"
-- জানো নীলুদা, দিদিটা আমার কক্ষনো তো
রেলগাড়ি দেখেনি। ছবি দেখেছিল একখানা বইতে। খুব লম্বা, অনেকগুলো
চাকা, সামনের দিকে কল, সেখানে আগুন দেওয়া আছে, ধোঁয়া ওড়ে। আমি
যখন আরও ছোট ছিলাম, শকুনের ডিমের জন্য গোটা দু-দুটো পয়সা খরচ করেছিলাম।
নাকি ওই ডিম পারা পুরে কদিন রোদ্দুরে রেখে মুখের
ভেতরে
রাখলে উড়তে পারা যায়! কী যে বোকা ছিলাম আমি! রাখাল নিশ্চয়ই আমাকে
কাগাবগার ডিম দিয়েছিল। ভেবেছিলাম উড়ে উড়ে অনেক নতুন জায়গায় যাব।
টিকিট লাগবে না। আচ্ছা নীলুদা , আমরা যেখানে যাচ্ছি ...নদী আছে?
-- কেন রে? তোর জল ভালো লাগে?
-- খুব! আমাদের কদমতলায় সাহেবের ঘাটে কত নৌকো আসে জানো? গোলপাতা,
ধান, ঝিনুক ...কত কী নিয়ে। আমার বড্ড ইচ্ছে করে নদীতে নদীতে সমুদ্দুরে
সমুদ্দুরে ঘুরে বেড়াই।
আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম...অপু নদীর পাশে বসে আছে ...
" নদীজলের ঠান্ডা আর্দ্র গন্ধ উঠিতেছে , কলমীশাকের দামে
জলপিপি বসিয়া আছে, চরের ধারে ধারে চাষীরা পটলখেত নিড়াইতেছে, কেহ
ঘাস কাটিয়া আঁটি বাঁধিতেছে, চালতেপোতার বাঁকে তীরবর্তী ঘন ঝোপে
গাঙশালিকের দল কলরব করিতেছে, পড়ন্ত বেলায় পূব আকাশের গায়ে নানারঙের
মেঘস্তূপ।"
আমি কখনো কোনোদিন নিশ্চিন্দিপুরের মাটিতে পা না রেখেও জানি যে
একটু পরেই ঠান্ডা বাতাস বইবে , পাখপাখালির ডাক শোনা যাবে, ভিজে
মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসবে নাকে| মাঠের ওপর ঘূর্ণি তুলে উড়ে আসবে
মুঠো মুঠো পাখাওয়ালা আকন্দের বীজ।
-- জানো নীলুদা , ঝড় উঠলে নদীর জল কেমন নেচে ওঠে, মেঘে ভর করে
বক উড়ে যায় , নদীর জলে ভেসে যায় ঝিনুক আর কচুরিপানা ....আমিও ওদের
সাথে সাথে চলি ...কত নতুন নতুন দেশ ...
" নিজেকে সে বঙ্গবাসী কাগজের সেই বিলাত -যাত্রী কল্পনা
করে! কলিকাতা হইতে তাহার জাহাজ ছাড়িয়াছে, বঙ্গোপসাগরের মোহনায়
সাগরদ্বীপ পিছনে ফেলিয়া সমুদ্রমাঝের কত অজানা ক্ষুদ্র দ্বীপ পার
হইয়া সিংহল উপকুলের শ্যামসুন্দর নারিকেলবনশ্রী দেখিতে দেখিতে কত
অপূর্ব দেশের নীল পাহাড় দূরচক্রবালে রাখিয়া সূর্যাস্তের রাঙা আলোয়
অভিষিক্ত হইয়া নতুন দেশের নব নব দৃশ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়া চলিয়াছে...চলিয়াছে
...চলিয়াছে..."
আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পাই ছোট্ট অপু বড় হয়ে গেছে। সে সমুদ্রের
জল ইছামতীর জলের মতোই গহীন কালো , অপু ভেসে চলেছে
জালি -বোটে। আমার চোখের সামনে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের বাঁশবনের
মাথায় ভেসে থাকা রাঙাভাঙা ওই আজন্মের চেনা চাঁদটা তুঁতে রঙের মেঘের
নৌকো বেয়ে অপুর আকাশে পৌঁছে যায়।
-- জানো, আমার কিছুতেই ঘরে মন বসে না।
আমি মনে মনে বললাম,
-- জানি তো! তোর খালি পায়ে বেলেমাটির তাত, তুই একমনে কুড়িয়ে নিচ্ছিস
ঝোপেঝাড়ে মুখ লুকিয়ে পড়ে থাকা রাশি রাশি বৈঁচিফল, তোর ফর্সা টুলটুলে
মুখখানা জষ্টিমাসের রোদ্দুরে কেমন রাঙা হয়ে উঠেছে ....প্রকৃতি
তোর কানে দিয়েছে অমৃতের দীক্ষামন্ত্র , গন্ধবিধুর দখিন হাওয়া আর
বনজ্যোৎস্নার আলো মেখে তুই এভাবেই একার মনে বড় হয়ে উঠিস রে অপু!
তোর জীবন হোক অনিশ্চিত পুলকের , প্রতিদিন তোর আকাশে যখন সূর্য
উঠবে , তুই সে ভোরের আকাশ দেখিস নতুন চোখে নতুন করে। আর দুর্গাকে
, তোর দিদিটাকে মনে মনে সঙ্গে রাখিস। তার যে বড় রেলগাড়ি দেখার
সাধ ছিল! তুই এই পথ চলা থামাস না রে অপু! নিশ্চিন্দিপুরের ঘেরাটোপ
পেরিয়ে চল আমাদের সঙ্গে। চল দিকশূন্যপুর।
“পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন- মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ
হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠ্যঙারে বীরু রায়ের বটতলায় কী
ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়! তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী
পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায়
পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে। দেশ ছেড়ে
বিদেশের
দিকে,
সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডি এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে।
দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম-মরণ পার হয়ে, মাস বর্ষ মন্বন্তর, মহাযুগ
পার হয়ে চলে যায়, তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শেওলা ছাতার দলে ভ'রে
আসে, পথ আমার তখনো ফুরোয় না। চলে, চলে, এগিয়েই চলে।"
অপু এবার আমার দিকে তাকাল।
-- তুমি গেছ কখনও নীলুদার সঙ্গে দিকশূন্যপুরে? কী আছে সেখানে?
নদী , গাছ , পাখি ...
কী করে বোঝাই তোকে অপু...
"সকালবেলার মেঘলা আকাশ, কচি কলাপাতা রঙের
আলো আর পলিমাটির মতো ঠান্ডা নিস্তব্ধতার মধ্যে বারান্দায় এসে
দাঁড়িয়ে প্রথমেই একটা পাখির পালক চোখে পড়লে মনে হয়, কোনো একটা
জায়গা থেকে ডাক এসেছে?"
অপু, দিকশূন্যপুর ওই অমনি এক দিনদুপুরে নিশির ডাক।
নীলু বলল ,
-- স্টেশন থেকে নেমে আমরা একটা টিলার ওপর উঠব। সে টিলায় আছে
মস্ত এক শিমূল গাছ। তার বুড়ো গুঁড়িতে আধফালি চাঁদ আঁকা। দেখবি
রাতের বেলা বাকি আধফালি আকাশে। দূরে ছোট ছোট বাড়ি। তোর চোখ জুড়োবে
, আবার বুকের মধ্যে কেমন আলুথালু ভাবও হবে। আর আছে নদী। আমি
জানি, আমি শুনেছি ওই নদীর নাম চন্দ্রহার। সে নদী
"কোনো
অপ্সরীর ভুল করে ফেলে যাওয়া অলঙ্কারের মতো।"
আচ্ছা .....
“নদী কি তার গর্ভের নাম না জলের নাম? সুবর্ণরেখায় যখন একটুও
জল থাকে না, তখনও তো তার নাম সুবর্ণরেখা।"
আমি জানি নদীর পাশে কয়েকটা রুক্ষ পাথর পেরোলেই বিশাল ক্যানভাসে
জলরঙে আঁকা হলুদ নদীটি হয়ে শুয়ে আছে সর্ষে ক্ষেত।
নীলু অপুর পিঠ চাপড়ে বলল,
-- অদ্ভুত ব্যাপার, জানিস! এখানে এলেই কলকাতার সব কিছু ভুলে
যাই, কিন্তু মাকে প্রায় রোজই স্বপ্ন দেখি। বড় হয়ে গেছি, মাকে
তেমন দরকারেও লাগে না, মায়ের কথা এমনিতে মনেও আসে না সব সময়ে
...শুধু এখানে এলেই...সে যাক গে! তোকে কিন্তু বলেই রাখছি একটু
’মা মা' টান হবে। আর তখনই তুই মুখ তুলে আকাশ দেখবি। কেন বল তো?
কারণ পৃথিবীর প্রায় সব জীব মাথা নীচু করে চলে। তারা সবসময় মাটি
দেখে।| একমাত্র মানুষই যখন তখন আকাশ দেখতে পারে। জীবনটা বড় অল্পদিনের
রে অপু! যত পারিস, আকাশ চিনে নে। আর এই দিকশূন্যপুরে আমরা সবাই
রাজা, বুঝলি! এখানে কেউ কারো সঙ্গে পাল্লা দেয় না| রাতে এখানে
জোনাকির মতো চাঁদের আলো ঝরে পড়ে, শিলাবৃষ্টি যেন পারিজাত ফুল,
রোদ্দুর যেন ঠাকুমার হাতে সেলাই করা নকশিকাঁথা।
-- ইস, তোমার কী মজা গো নীলুদা! তুমি প্রায়ই আসো, না?
আমি ফুট কাটলাম,
-- তা আর নয়! বিশ্ববেকার বখাটে বাউন্ডুলে ছোঁড়া তো তোর নীলুদা!
নীলু মুচকি হাসল। আমি জানি, নীলু অন্যরকম ভাবে।
“সবাইকে চাকরি করতে হবে কেন? এই সমাজের কিছু লোক গান গাইবে,
বাঁশি বাজাবে, ফুটবল খেলবে, কবিতা লিখবে, ছবি আঁকবে, সাধু সন্ন্যাসী
হয়ে যাবে। এসব থেকে টাকা রোজগার না হলেও ক্ষতি নেই। আর কিছু
লোক এসব কিছুই করবে না, সারা দেশ ঘুরে ঘুরে বেড়াবে , কাছের মানুষদের
সেই সব ভ্রমণের অভিজ্ঞতার গল্প শোনাবে , তারও কি প্রয়োজন নেই?
সবাই চাকরি কিংবা ব্যাবসা করবে, এরকম একটা বিকট বীভৎস, যান্ত্রিক
সমাজ চাই না।"
নীলুর কথা শুনতে শুনতে আমারও কেমন সব কিছু বেভুল হয়ে যাচ্ছিল। আমি
ঘোর লাগা গলায় বলে উঠলাম,
-- দিকশূন্যপুর। আমার কাছেও যে কোনো অচেনা, অজানা, অনামা জায়গা
মানেই দিকশূন্যপুর।| সেখানে যখন ইচ্ছে চলে যাওয়া যায় মনে মনে
হাত ধরে! দু:খ নেই, অভিমান নেই, অভাব-অভিযোগ- অনুযোগ কিচ্ছুই
নেই.. শুধু অপার মুক্তি আছে।| চারিদিকেই শুধু খোলা আকাশ।। শেষ
দেখা যায় না যে স্থলভূমি, জলভূমি বা বনভূমির.. সেটাই দিকশূন্যপুর!
‘Vastness’ কথাটা পড়েই এসেছি, শুনেই এসেছি..বুঝিনি কখনো। দিকশূন্যপুর
না থাকলে বুঝতামওনা! মনের দরজা জানালা হাট করে খুলে দিলে..দিকশূন্যপুর!
মন খুব ভালো থাকলে দিকশূন্যপুর, আবার মন খুব খুব খারাপ থাকলেও!
এখানে ট্রেন দাঁড়ায় বটে, কিন্তু স্টেশন নেই, সিগনালও নেই। টিমটিমে
রাতবাতি জ্বলে। এখানে আসতে টিকিট লাগে না, টাকাপয়সা দরকার নেই,
বাড়তি জামাকাপড় চাই না..শুধু খুব দু:খী নীলচে সবুজ মন চাই। এ
হল মন ভালো করার হাসপাতাল। বন্দনাদি আছে..সব্বাইকে আগলে রাখার
জন্য।
আমি তো মাঝে মাঝেই ভাবি চলে আসব। এখানে সবজেটে সাদা জলে শালুক
ফুল, এখানে ফিঙে আর বুলবুলির মেলা, এখানে কাচপোকা টিপ, এখানে
গাছের পাতার জাফরিকাটা জানালা দিয়ে রোদ্দুর আর ছায়ার খেলা। আকাশে
গোলাপী মেঘ, হালকা রামধনু, বড় বড় ঝুপসি কৃষ্ণচূড়া, পলাশ.. আর
..ওই গাছের নিচে দাঁড়ালেই দমকা ধুলোর ঝড় ..আর মাথা, মুখ, বুক,
শরীর, মন.. ভরে যায় ঝুরো ফুলে। এখানকার ঋতুতে বারোমাসই বসন্ত,
এখানকার আকাশে বারোমাসই পুষ্পবৃষ্টি!
আমার যখন কিচ্ছু ভালো লাগে না, খালি খালি মরে যেতে ইচ্ছে করে,
তখন আমি দৌড়ে পালিয়ে আসার কথা ভাবি দিকশূন্যপুরে! আমার মনে যে
অস্থিরতার পাখিটা ঠোকরায়, ডানা ঝাপটানি দেয়, তাকে দানাপানি দিয়ে
শান্ত করতে দিকশূন্যপুর!
তাই ঠিক করেছি, আর ফিরে যাব না। চেনা গণ্ডির বাইরে চলে যাব। আমার
দমচাপা ঘরে আকাশ ধরা পড়ে না, আমার ভোরের আকাশ ভরা ম্লান ধূসর আলো,
সকালগুলোতে দু:খের রোদ্দুর, দুপুরভর বুকে পাথরচাপা নির্জনতা, বিকেলে
মন কেমনের মেঘ, সন্ধেরা আসে হার্মাদের মতো। আমার বুকভরা ভয় আর
ভয়। আর রাতের আকাশে এক বিন্দুও চাঁদের জল লেগে থাকে না। তাই দিকশূন্যপুর
যাচ্ছি। তাই দিকশূন্যপুর! অপু অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।
বোঝা না- বোঝার আলোছায়া দোলা নিয়ে। আর খুব অচেনা চোখে... নীলুও।
ট্রেনের গতি কমছে। দিগন্তের শেষ স্টেশন প্রায় এসে গেল।
"সামনের দিকের বনানীর সবুজ রেখা আস্তে আস্তে কালো হয়ে আসছে।
মাথার ওপরে ফুটেছে ধ্রুবতারা। এখন যেটা সন্ধ্যাতারা, ভোরবেলা
তো সেটাই শুকতারা হয়ে যাবে। আজ আকাশ এমনই পরিষ্কার যে মিল্কি
ওয়ে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। মিল্কি ওয়ের বাংলা ছায়াপথ, আমার ঠিক
পছন্দ নয়।"
আমি মনে মনে উচ্চারণ করলাম... আকাশগঙ্গা!
নীলু গমগমে গলায় নিস্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে বলে উঠল,
“হে প্রিয় নি:শ্বাস তুমি জাহাজের পতাকা ওড়াও
হে প্রিয় নি:শ্বাস তুমি পুষ্পবৃষ্টি আনো
আকাশ এসেছে কাছে , আরও কাছে এসো
জলের দর্পণ থেকে তুলে নাও নক্ষত্রের মালা
হিরণ্য গর্ভের দ্যুতি রাখো এই হাতে
আমি চলে যাবো , তাকে এই সমস্ত মহিমা
আমি দিয়ে যেতে চাই ....."
লেখক পরিচিতি - বিজ্ঞানের ছাত্রী । কিন্তু
প্রথম ভালোবাসা সাহিত্য । তিন দশক ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত ।
বেশ কিছু অনূদিত বই প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য অকাদেমি, ন্যাশনাল
বুক ট্রাস্ট ইত্যাদি বিখ্যাত সংস্থা থেকে । ভাষান্তরের পাশাপাশি
নিজস্ব লেখালেখির ঝোঁক । তবে খুব নিয়মিত নয় । ভালোবাসেন টুকরো
গদ্য, পদ্য লিখতে । নানা স্বাদের লেখা নিয়ে গত বছর প্রকাশিত হয়েছে
ওঁর আরেকটি বই 'ম্যাজিক লণ্ঠন। এ বছর প্রকাশিত হচ্ছে আরও তিনটি
বই।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।