বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা
ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫
একটুও ধুলো পড়েনি ‘পালামৌ’র গায়ে
শেখর বসু
বঙ্গবাসীমাত্রেই সজ্জন। খারাপ কে? প্রতিবেশীরা. বাংলায় কেবলমাত্র
প্রতিবেশীরাই খারাপ। যা কিছু নিন্দে শোনা যায় তা ওই প্রতিবেশীর।
তারা পরশ্রীকাতর, দাম্ভিক, কলহপ্রিয়, লোভী, কৃপণ, বঞ্চক। তারা
নিজেদের সন্তানদের ভালো-ভালো জামা-কাপড়, জুতো পরায়। কেন পরায়?
একমাত্র কারণ আমাদের সন্তানকে কাঁদাবার জন্যে। প্রতিবেশীরা নিজেদের
পুত্রবধূকে ভালো-ভালো কাপড়, গয়নাগাটি দেয়। কেন দেয়? কেন আবার,
আমাদের পুত্রবধূর মুখ ভার করাবার জন্যে। প্রতিবেশীমাত্রই পাপিষ্ঠ।
যাদের প্রতিবেশী নেই তাদের রাগ নেই। তাদেরই নাম ঋষি। ঋষিদের কোনও
প্রতিবেশী থাকে না।
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
|
ঋষির আশ্রমের পাশে প্রতিবেশী বসাও। দেখবে তিনদিনের মধ্যে ঋষির
ঋষিত্ব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রথম দিনেই প্রতিবেশীর ছাগল গিয়ে ঋষির
ফুলগাছের ফুলপাতা খেয়ে শেষ করবে। দ্বিতীয় দিন প্রতিবেশীর গরু এসে
ঋষির কমন্ডুলু ভাঙবে। তৃতীয় দিন প্রতিবেশীর গিন্নি এসে ঋষিপত্নীকে
নিজের গয়না দেখাবে।
ব্যস, আশ্রমের ঋষিটির ধ্যান ও শান্তির দফা গয়া। নিজের,ঋষিপত্নী
ও আশ্রমের শান্তি বজায় রাখার জন্যে ঋষিকে তখন ওকালতির পরীক্ষা
দিতে হবে, কিংবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটির পদ পাওয়ার জন্যে দরখাস্ত
জমা দিতে হবে।
এই যে অতি সজ্জন বঙ্গবাসী—তার জীবনে যাবতীয় দুঃখকষ্ট, ঝক্কিঝামেলা
নিয়ে আসে পাপিষ্ঠ প্রতিবেশীরা। যেখানে প্রতিবেশী নেই সেখানে বঙ্গবাসীমাত্রেই সজ্জন।
আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমন একজন
সজ্জন বঙ্গবাসীর আতিথ্য নিয়েছিলেন হাজারিবাগে একদিনের জন্যে।
মানুষটি খুব বড়লোক ও অতিথিপরায়ণ। তাঁর বাড়িটি ছিল একজন ধনী ইংরেজের
বাড়ির মতো। সঞ্জীবচন্দ্র লিখেছেন, যে সময়ের কথা তিনি জানাচ্ছেন
তখন তিনি যুবা। লিখেছেন,
‘সে বয়সে বৃদ্ধকে সুন্দর দেখা ধর্মসঙ্গত নহে। কিন্তু সে দিবস এরূপ
ধর্মবিরুদ্ধ কার্য ঘটিয়াছিল। এক্ষণে আমি নিজে বৃদ্ধ, কাজেই প্রায়
বৃদ্ধকে সুন্দর দেখি। একজন মহানুভব বলিয়াছিলেন যে, বৃদ্ধ না হইলে
মনুষ্য সুন্দর হয় না। এক্ষণে আমি তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করি।’
সজ্জন বঙ্গবাসীটি ছিলেন অতিথিপরায়ণ। অতিথিসেবায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি
রাখেননি। সঞ্জীবচন্দ্র তাঁর আহারে অনেক কিছুর সঙ্গে পেয়েছিলেন
‘সঘৃত আতপান্ন আর দেবীদুর্লভ ছাগ-মাংস।’
অত্যন্ত সহজ, অনাড়ম্বর ভাবে সঞ্জীবচন্দ্র শুরু করেছিলেন তাঁর
পালামৌ ভ্রমণবৃত্তান্ত। বৃত্তান্তটি শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রকৃতপক্ষে
যাত্রা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে। আজকের হিসেবে পালামৌ তো ঘরের কাছেই--।
কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে এলাকাটি ছিল খুব দুর্গম এবং
বহু দূরের পথ।
সরকারি কাজে পালামৌ যেতে হয়েছিল সঞ্জীবচন্দ্রকে। সঠিক পথটি খুঁজে
বার করাই তখন কঠিন হয়ে পড়েছিল। ম্যাপ দেখে পথ ঠিক করতে হয়েছিল
তাঁকে। ইনল্যান্ড ট্রানজিট কোম্পানির ডাকগাড়ি ভাড়া করে রাত দেড়টায়
যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই ডাকগাড়ি সম্ভবত ঘোড়ায়-টানা গাড়ি। কেননা
এই গাড়ির সুবাদে এক জায়গায় গাড়োয়ানের কথা এসেছে।
অল্প জলের বরাকর নদী পেরিয়ে বেলা দুটোনাগাদ ডাকগাড়ি হাজারিবাগ
এসে হাজির হল। সেদিনটা ওখানে বিশ্রাম নেওয়ার পরে পরদিন রাত দেড়টার
সময় পাল্কিতে চেপে ছোটনাগপুরের উদ্দেশ যাত্রা করলেন লেখক। সেখান
থেকে পালামৌ পৌঁছেছিলেন ‘দুই-চারি দিনের মধ্যে।’ পথে পড়েছিল রাঁচি।
সেখান থেকে পালামৌ।
সঞ্জীবচন্দ্র লিখেছেন,
‘জানিতাম না যে, পালামৌ শহর নহে, একটি প্রকান্ড পরগনামাত্র। শহর
সে অঞ্চলে নাই, নগর দূরে থাকুক, তথায় একখানি গন্ডগ্রামও নাই, কেবল
পাহাড় ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ।’
পালামৌ জেলার এখনকার মানচিত্র
|
রাঁচি থেকে লেখক পালামৌ গিয়েছিলেন পালকি চেপে। বেশ কয়েক মাইল
যাওয়ার পরে দূর থেকে পালামৌ চোখে পড়েছিল। দেখে তাঁর মনে হয়েছিল,
‘যেন মর্ত্যে মেঘ করিয়াছে।’
আরও আট-দশ মাইল যাওয়ার পরে সেই মেঘ কেটে গিয়েছিল। মেঘের বদলে
পাহাড় দেখা গেল এবার। পাহাড়ের গায়ে,নীচে—সর্বত্র জঙ্গল। কিন্তু
পালামৌ পৌঁছে দেখলেন—নদী, গ্রাম সবই আছে সেখানে। আসলে পালামৌ পরগনায়
পাহাড় অসংখ্য। ‘পাহাড়ের পর পাহাড়, তাহার পর পাহাড়, যেন বিচলিত
নদীর সংখ্যাতীত তরঙ্গ।’
গাঁয়ে তাঁবু খাটানো হল এই বাঙালি সাহেবের। সাহেবের পরনে ট্রাউজার্স,
গায়ে কোট, মাথায় হ্যাট, পায়ে বুট। বগলে আবার বন্দুক।
লাতেহার গাঁয়ের পাশে একটি ‘অর্ধ পাহাড়’ আছে। সাহেব প্রতিদিন বিকেলে
কাজকর্ম ফেলে রেখে সেই পাহাড়ে গিয়ে বসতেন কিছুক্ষণ। পাহাড়ে, জঙ্গলে
দিনের শেষ আলো নিভে যাওয়ার অপরূপ দৃশ্য দেখতেন। সেই অঞ্চলে প্রধানত
কোলেদের বাস।
‘কোলেরা বন্য জাতি,খর্বাকৃতি, কৃষ্ণবর্ণ; দেখিতে কুৎসিত কি রূপবান,
তাহা আমি মীমাংসা করিতে পারি না। যে-সকল কোল কলিকাতা আইসে বা চা-বাগানে
যায়,তাহাদের মধ্যে কাহাকেও রূপবান দেখি নাই; বরং অতি কুৎসিত বোধ
করিয়াছি। কিন্তু স্বদেশে কোল মাত্রেই রূপবান, অন্তত আমার চক্ষে।
বন্যেরা বনে সুন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’
‘পালামৌ’ খুব ছোট আকারের একটি ভ্রমণবৃত্তান্ত। কিন্তু বইটিতে
প্রবাদ ও উদ্ধৃতিযোগ্য বাক্যের ছড়াছড়ি। পাঠক-পরম্পরায় কোনও বই
মর্মে গেঁথে না গেলে এমন ঘটনা ঘটে না।
বৃত্তান্ত শুরু হওয়ার পর থেকেই এমন অভিজ্ঞতা পাঠকদের হয়। ওই তো
একটু আগেই যে জায়গায় লেখক লিখেছেন—‘সেই প্রথম আমি বৃদ্ধকে সুন্দর
দেখি।’ হাজারিবাগের ওই মানুষটি সবে পঞ্চাশ পেরিয়েছে। সেই আমলে
কারও বয়েস পঞ্চাশ পেরুলেই ‘বৃদ্ধের তালিকায়’ তাঁর নাম উঠে যেত।
পালামৌ ভ্রমণের সময় লেখক যুবক ছিলেন, কিন্তু এই এলাকাটি নিয়ে
ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় তাঁর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছিল, তাই নিজেকেও
তিনি বৃদ্ধের তালিকায় ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন । সেই সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও
জানিয়েছিলেন, ‘মনুষ্য বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না।’ এটিও একটি
উদ্ধৃতিযোগ্য বাক্য।
এই ভ্রমণকাহিনিটির মস্ত বড় একটি গুণ হল এটির সরসতা। আমরা লেখাটি
পড়তে পড়তে যা বারবারই দেখতে পাই তা হল লেখকের প্রসন্ন মুখ। সঞ্জীবচন্দ্রের
জীবনকথায় জানা গিয়েছে, মানুষটি অত্যন্ত সুরসিক ছিলেন। জমিয়ে গল্প
করতে পারতেন। যুবাবয়সে দুর্গম পালামৌ ভ্রমণের কথা বন্ধুদের শুনিয়েছিলেন,
তখন তাঁরা তাঁকে এই কাহিনিটি লিখতে বলেছিলেন; কিন্তু তিনি আলসেমি
করে লেখেননি। লিখতে শুরু করেন পঞ্চাশ পেরুবার পরে। অর্থাৎ ‘বুড়ো
বয়সে’। তখন তাঁর আশঙ্কা হয়েছিল পাঠক নিয়ে। বলেছিলেন, বুড়ো মানুষরা
কথা বলতে ভালোবাসেন, কিন্তু তাঁদের কথা শোনার লোক কোথায়! কিন্তু
‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘পালামৌ’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহী ও
উৎসুক পাঠকের দেখা পেয়েছিলেন লেখক।
ভ্রমণকাহিনিটিতে বিষয়ের কিছু গুরুত্ব অবশ্যই ছিল, কিন্তু তার
চাইতে ঢের বেশি ছিল সর্বত্রই লেখকের সজীব উপস্থিতি। সালতারিখসহ
কোনও স্থানের ঐতিহাসিক বা ভৌগোলিক বিবরণ নয় রচনাটি। আদিম জাতির
একটি শাখার কথা জানা যায় এখানে, কিন্তু কোথাও কোনও নৃতাত্ত্বিক
কৌতূহল মেটাবার উৎসাহ দেখাননি লেখক। সামান্য কিছু তথ্য, অতীতচারণা
এবং বৈঠকী গল্পের পরিমণ্ডল থেকে উঠে এসেছে অনবদ্য একটি ভ্রমণকাহিনি।
এমনটি বাংলা সাহিত্যে আগে দেখা যায়নি, পরেও নয়। ওই যে বলা হয় না—কদাচিৎ
একটিমাত্র রচনা নিয়েই একটি শ্রেণি নির্দেশিত হয়—এই রচনাটি বোধহয়
তেমনই। সাহিত্যগুণে ভরপুর ‘পালামৌ’।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
|
বঙ্কিমচন্দ্র সে যুগের উজ্জ্বলতম পত্রিকা ‘বঙ্গদর্শন’ বছর-পাঁচেক
সম্পাদনা করার পরে পত্রিকার স্বত্ব ও অধিকার অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্রের
হাতে তুলে দিয়ে সরে আসেন। সরলেও তিনি পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ
করেননি। সঞ্জীবচন্দ্র ১৮৭৬ সালে বঙ্গদর্শন সম্পাদনার দায়িত্ব নিজের
কাঁধে তুলে নেওয়ার পরে এই পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের
উইল’, ‘রাজসিংহ’, ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরাণী’ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত
হয়। বঙ্গদর্শনের গৌরব অক্ষুণ্ণই রইল। সঞ্জীবচন্দ্র এখানে লিখলেন
‘জাল প্রতাপচাঁদ’, ‘পালামৌ’ ইত্যাদি। ‘পালামৌ’ লিখেছিলেন প্রমথনাথ
বসু ছদ্মনামে।
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর অগ্রজের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সঙ্গে
সঙ্গে এও জানতেন ওই মানুষটির ‘প্রতিভা ভস্মাচ্ছন্ন’। হঠাৎ-হঠাৎ
তিনি জ্বলে ওঠেন, কিন্তু ছাইচাপা থাকেন বেশির ভাগ সময় । বেশ কয়েকবার
‘শিক্ষাবিভ্রাট’ হয়েছিল সঞ্জীবচন্দ্রের, তার ফলে তাঁর স্কুল-কলেজের
পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি; কিন্তু স্বশিক্ষায় মানুষটি ছিলেন রীতিমত
সুশিক্ষিত।
প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বাংলার প্রজাদের সম্বন্ধে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ
করে ইংরেজিতে একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম ‘বেঙ্গল রায়ত’। অমূল্য
এই বইটি সেই সময় কলকাতা হাই কোর্টের ইংরেজ জজদের হাতে হাতে ঘুরত।
বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে লেফটেনান্ট গভর্নর সঞ্জীবচন্দ্রকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের
চাকরি দিয়েছিলেন। তাঁর কর্মস্থল হল কৃষ্ণনগর। এখানে ছিলেন তখনকার
সমাজের ও কাব্যজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র দীনবন্ধু মিত্র। সঞ্জীবচন্দ্রের
সঙ্গে তাঁর অকপট বন্ধুতা হয়েছিল। বছরদুয়েক এখানে থাকার পরে সরকার
বাহাদুর তাঁকে গুরুতর কাজের ভার দিয়ে পালামৌ পাঠান।
বঙ্কিমচন্দ্র সঞ্জীব-জীবনকথা ‘সঞ্জীবনী সুধা’য় লিখেছেন, ‘পালামৌ
তখন ‘বাঘ-ভাল্লুকের আবাসভূমি, বন্যপ্রদেশমাত্র।’ সঞ্জীবচন্দ্র
সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি। পরে আর একবার যেতে হয়েছিল। কিন্তু
যেদিন পৌঁছলেন, সেদিনই পালামৌর ওপর রাগ করে ফিরে এলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র জানিয়েছেন, এমন করলে সরকারি চাকরি থাকে না, কিন্তু
কপালজোরে সঞ্জীবচন্দ্রের চাকরি থেকে গিয়েছিল। তবে তিনি,-
‘আর পালামৌ গেলেন না। কিন্তু পালামৌয়ে যে অল্পকাল অবস্থিতি, তাহার
চিহ্ন বাংলা সাহিত্যে রহিয়া গেল।’
বঙ্কিমচন্দ্রের এই কথাটি যে ধ্রুব সত্য—-সে-কথা পাঠকরা তখন থেকে
আজ পর্যন্ত কেমন যেন পালা করে জেনে আসছেন । সেকালের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক
চন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন,
‘পালামৌ উৎকৃষ্ট উপন্যাসের ন্যায় মিষ্ট বোধ হয়। পালামৌর ন্যায়
ভ্রমণকাহিনি বাংলাসাহিত্যে আর নাই। আমি জানি, উহার সকল কথাই প্রকৃত,
কোন কথাই কল্পিত নয়, কিন্তু মিষ্টতা মনোহারিত্বে উহা সুরচিত উপন্যাসের
লক্ষণাক্রান্ত ও সমতুল্য।’
উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করার পরে এক জায়গায় লিখেছেন,
‘সঞ্জীববাবুর সৌন্দর্যতত্ত্ব ভালো করিয়া না বুঝিলে তাঁহার লেখাও
ভাল করিয়া বুঝা যায় না ।’
চন্দ্রনাথের এই কথায় রবীন্দ্রনাথের ঘোরতর আপত্তি। রবীন্দ্রনাথ
লিখেছেন,
‘সমালোচকের এই কথায় আমরা কিছুতেই সায় দিতে পারি না। কোনও একটি
বিশেষ সৌন্দর্যতত্ত্ব অবলম্বন না করিলে সঞ্জীবের রচনার সৌন্দর্য
বুঝা যায় না। এ কথা যদি সত্য হইত, তবে তাঁহার রচনা সাহিত্যে স্থান
পাইবার যোগ্য হইত না। নদ-নদীতেও সৌন্দর্য আছে, পুষ্পে নক্ষত্রেও
সৌন্দর্য আছে—এ কথা প্লেটো না পড়িয়াও আমরা জানিতাম...।’
লিখেছেন, একজন নিরক্ষর ব্যক্তি বিশেষ কোনও তত্ত্ব না জেনেও তার
প্রিয় মুখকে চাঁদমুখ বলতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আধুনিক সাহিত্য’ নিবন্ধে লিখেছেন,
‘সঞ্জীব বালকের ন্যায় সকল জিনিস সজীব কৌতূহলের সহিত দেখিতেন এবং
প্রবীণ চিত্রকরের ন্যায় তাহার প্রধান অংশগুলি নির্বাচন করিয়া লইয়া
তাহার চিত্তকে পরিস্ফুট করিয়া তুলিতেন এবং ভাবুকের ন্যায় সকলের
মধ্যেই তাহার নিজের একটি হৃদয়াংশ যোগ করিয়া দিতেন।’
পালামৌর মহান লেখককে দেখার এটাই বোধ হয় প্রধান রাস্তা। আরও একবার
পালামৌ পড়ে আরও একবার মুগ্ধ হলাম। মাদলের তালে তালে কোল যুবতীদের
শিহরিত দেহে ‘কোলাহল’ পড়ে যাওয়ার মাধুর্যে আজকের পাঠকরাও বিহ্বল
হন। সাহিত্যরসাশ্রিত এই ভ্রমণবৃত্তান্তটি এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
‘সঞ্জীবের ‘প্রতিভার ঐশ্বর্য ছিল, কিন্তু
গৃহিণীপনা ছিল না।’
গৃহিণীপনা থাকলে তাঁর প্রতিভার ঐশ্বর্য নিশ্চয়ই আরও বিকশিত হতে
পারত; কিন্তু এই অগোছালো গৃহিণী ‘পালামৌ’তে যা দিয়ে গিয়েছেন—তাও
তো তুলনাহীন!
সঞ্জীবচন্দ্র জীবদ্দশায় খুব একটা খ্যাতি পাননি। পরিচিতি, প্রতিষ্ঠা
যা পেয়েছিলেন তা তাঁর মতো বড় প্রতিভার পক্ষে যথেষ্ট নয়। লেখকের
মৃত্যুর পরে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনকথায় বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, লেখকের
‘এক অতি বলবান সহায় আছে। কাল আমাদের সহায়। কালক্রমে ইহা অবশ্য
ঘটিবে।’
মহাকালের সহায়তা পেয়েছেন সঞ্জীবচন্দ্র। কালক্রমে তাঁর প্রাপ্য
মর্যাদা ফিরে পেয়েছেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পরে দেড়শো বছর পেরিয়ে
গেছে, কিন্তু নিজস্ব গরিমায় আজও কালাতীত হয়ে আছে ‘পালামৌ’।
লেখক পরিচিতি - প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ছোটগল্পকার।
কর্মজীবনে আনন্দবাজার পত্রিকার গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু
বছর। এখন পুরো সময়টাই লেখালেখির কাজ করছেন। গত চল্লিশ বছরে উনি
বহু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গোয়েন্দাকাহিনী লিখেছেন। এযুগের
যুবক সম্প্রদায়ের অনেকেই বড় হয়েছেন ওঁর লেখা ছোটদের বই পড়ে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।