প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা

ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫

 

পথ-পূর্বাভাষ-উপেক্ষা-মহাপ্রস্থান

ভাস্কর বসু


নারায়ণ সান্যাল

নারায়ণ সান্যাল পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, নেশায় সাহিত্যিক। দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকেও সময় বার করে দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যকর্মে নিযুক্ত।

তাঁর সাহিত্য কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তিও বিচিত্র। তাঁর রচনাতে যেমন এসেছে তাঁর কর্মজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা (দণ্ডক-শর্বরী, বকুলতলা পি এল ক্যাম্প, --) তেমনি এসেছে বিজ্ঞানের কথা (বিশ্বাসঘাতক, হে হংসবলাকা, নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা), শিল্পের কথা (প্রবঞ্চক, আবার যদি ইচ্ছা কর, অজন্তা অপরূপা-), বিচিত্র মানুষের কথা (লিন্ডবার্গ, গজমুক্তা)!
ডিটেকটিভ পিকে বাসু, বার-এট-ল (নাগচম্পা, কাঁটা সিরিজ-) কে তো সকলেই চেনেন। আবার প্যারাবোলা স্যার, পাষণ্ড পণ্ডিত, নীলিমায় নীল বা সত্যকামের মত একেবারে সামাজিক উপন্যাসও তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। সর্বভারতীয় জনতার কাছেও তিনি পরিচিত হয়েছেন হৃষিকেশ মুখার্জীর বিখ্যাত ছবি ‘সত্যকাম’ এর কাহিনীকার রূপে।

সামান্য কটি ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় – “পথের মহাপ্রস্থান”। বইটি স্কুলের পরীক্ষায় স্থানাধিকার স্বরূপ পুরস্কার পেয়ে প্রথম পড়েছিলাম সাতের দশকের শেষাশেষি। অন্যান্য ভ্রমণকাহিনী ও পড়েছি বেশ কিছু। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী মন কেড়েছিল সুবোধ কুমার চক্রবর্তী প্রণীত ‘রম্যাণী বীক্ষ’ সিরিজ। এছাড়াও হিমালয়, বা বিদেশ ভ্রমণের ওপর বেশ কিছু বই পড়ারও সৌভাগ্য হয়েছে।
তবে এই বইটি আমার মনে একটি আলাদা স্থান করে নিয়েছে। মূলত এই লেখাতে আমি যেটাকে ধরতে চেয়েছি সেটা হল এটি একটি ব্যতিক্রমী ভ্রমণ-সাহিত্য। লেখক একজন পেশাদার প্রযুক্তিবিদ। তা সত্ত্বেও তিনি 'তথাকথিত' উন্নয়নের বিরুদ্ধে সতর্ক করছেন আর সেই সতর্কবাণীর সত্যতা অনেক বছর ফলে মিলে যাচ্ছে। তাঁর সেই পর্যবেক্ষণকে আমি অন্য ভ্রমণকারীর থেকে পৃথক করে দেখতে চেয়েছি।
সাধারণত ভ্রমণে আনন্দই বেশী থাকে, কিন্তু এখানে তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক 'মহা-শঙ্কা'!! যা পরে আমরা জেনেছি অমূলক ছিল না। এর থেকে ভবিষ্যৎ কি শিক্ষা নেবে?

প্রবোধকুমার সান্যালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ বইটি এবং সেই কাহিনীভিত্তিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রটি বাঙালীর মনে কেদার-বদ্রী ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়েছে। প্রাবন্ধিক ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে আমরা জানতে পারছি,-

‘মহাপ্রস্থানের পথে’ পাঠ করার পর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘তোমার ভাষা পাঠকের মনকে রাস্তায় বের করে আনে’। ১৯৩২ এ কেদারবদ্রী ভ্রমণ ও তারপর হৃষিকেশ থেকে পার্বত্য শহর রাণীক্ষেত পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে পরিক্রমণ করেছিলেন ৩৮ দিনে। সেই অভিজ্ঞতার কাহিনী নিয়েই লিখেছিলেন ‘মহাপ্রস্থানের পথে’।

এই ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষার সুবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে একটি জাতির উন্নত মানসিকতার পরিচায়ক। কিন্তু শ্রমসাধ্য তীর্থযাত্রা (Pilgrimage) আর প্রমোদ-ভ্রমণ (Luxurious Tourism) – এই দুইয়ের ও বিস্তর ফারাক। পরিণত মানবগোষ্ঠীকে সেই পার্থক্য বুঝে তদনুচিত বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রাবন্ধিক বিকাশ বসুও ‘সাহিত্যের ট্যুরিস্ট’ প্রবন্ধে জানাচ্ছেন,-

কাঙ্ক্ষিত সব বস্তুই সুলভ করে দিতে নেই। আর সাহিত্যতীর্থযাত্রী ব্যাপারটা ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের মতোই। কেদার-বদ্রীর পথ রেডরোডতুল্য হলে তার মাহাত্ম্য অনেক কমে যায়। তীর্থপথের খবরাখবর নিয়েই তাঁরা বার হন তীর্থযাত্রায়। আর তীর্থের মাহাত্ম্যের মূল্য হিসেবেই তাঁদের যাবতীয় শ্রমস্বীকার।

এটাই খুব বড় সত্য। সব যাত্রা সবার জন্য নয়। তাই মাত্রালঙ্ঘন হলেই বিপদের সম্ভাবনা। হয়েছেও তাই। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তো আর “Made Easy” চলে না। তবে তা নিয়ে আমরা প্রথমেই আলোচনা করতে চাই না।

সপরিবারে সান্যাল মহাশয় এই পথযাত্রায় বেরিয়েছেন ১৯৬৪ সালে, - বন্ধুদের সতর্কবার্তা কে উপেক্ষা করে অল্পবয়সী পুত্র-কন্যাকেও সঙ্গে নিয়েছেন। তিনি শুনেছিলেন এই পথ নাকি অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উমাপ্রসাদ, প্রবোধকুমারের মত সাহিত্যিকদের ভ্রমণকাহিনী পাঠ করেই তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন হিমালয়ের পথে। আর সে পথে তিনি চলতে চেয়েছেন কষ্টসাধ্য, দুর্গম পথ ধরেই। যেমন তিনি পড়েছেন, প্রবোধকুমার সান্যালের “মহাপ্রস্থানের কথা” বইটিতে। এই যাত্রাপথের দুর্গমতাই যে এই পথের আকর্ষণ তা প্রবোধকুমার বারেবারেই দেখিয়েছেন। মুগ্ধ হয়েছেন প্রকৃতির অসাধারণ মাধুর্যে। যাত্রার শুরুতেই লেখক পরিষ্কার জানাচ্ছেন,-

সম্মুখে গগনস্পর্শী নীলকণ্ঠ পর্বত

“সম্মুখে গগনস্পর্শী নীলকণ্ঠ পর্বত, তারই নীচে দক্ষিণে স্বর্গাশ্রমের শ্বেত মন্দির, হাঁসের পালকের মত সাদা, পদতলে গঙ্গার নীল স্রোতপ্রবাহ। বিদায় স্বদেশ, বিদায় সভ্যতা, বিদায় জনসমাজ। আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত, মনে মনে সকলের নিকট বিদায় নিলাম। চোখে আমাদের সুদূরের পিপাসা, অন্তরে উদ্দীপনা ও উৎসাহ, বুকে দুঃসাহসিক পথযাত্রার দুর্জয় আনন্দ”।

“দুঃসাহসিক পথযাত্রার দুর্জয় আনন্দ” – এই শব্দবন্ধগুলি ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণ প্রমোদভ্রমণের সঙ্গে এই যাত্রার যা পার্থক্য গড়ে দেয় তা এই কটি কথাতেই বলা আছে।
নারায়ণ সান্যালও সেই একই ভাবে ভেবেছেন। তাই বইটি শুরুতেই সেরকম আভাস পাচ্ছি। তবে আরো যা পাচ্ছি তা সে “দুর্জয় আনন্দ” কে বিলীন করে দেওয়ার পূর্বাভাষ, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক-

“মহাপ্রস্থানের পথ। যুগ যুগান্তর ধরে এসেছে যাত্রীদল। ঋষি মুনি সন্ন্যাসী অবধূতের মিছিল। --- তাই সুযোগ পেয়েই মহাপ্রস্থানের পথের দুর্নিবার আকর্ষণে ছুটে গিয়েছিলাম আমিও। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার। মহাপ্রস্থানের পথকে দেখতে গিয়ে দেখে এলাম পথের মহাপ্রস্থান। ----কেদার বদ্রীর পায়ে-চলা পথের নাভিশ্বাস উঠছে শুনে আর দেরী করিনি। -- যেসব চটি এতকাল ছিল আনন্দ-কলরব-মুখরিত, প্রতি সন্ধ্যায় যেখানে ক্লান্ত পরদেশী যাত্রী এসে চটিদারের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করত, সে সব চটি ক্রমশ জনশূন্য হয়ে পড়বে যাত্রীর অভাবে। ---- গ্রাম ছাড়বে ওরা - হরিদ্বারের এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখানোর কথাও ওরা জানেনা। হারিয়ে যাবে ওরা ধীরে ধীরে। চটিতে এসে আশ্রয় নেবে বন্য প্রাণী। মুছে যাবে একটা সমাজব্যবস্থা।”

এই যাত্রাতে পূর্বসূরিরা যে বিপদের সম্মুখীন হতেন তা আমরা জেনেছি। এ পথ তো ‘মহাপ্রস্থানের”। এই পথে দুর্দম সাহস নিয়ে মোকাবিলা করতে হবে বিপদের, হতাশা এলেও তাকে কাটিয়ে নব উদ্যোগে আবার শুরু করতে হবে পথচলা। পূর্বসূরির লেখাতে তিনি নিশ্চয় পড়েছেন,-

“না, না, সময় নেই, সবাই গেল এগিয়ে। ওরে শ্রান্ত, ওরে ভ্রান্ত, ওরে ভগ্ন, আর একবার উঠে দাঁড়া, কাঁধে তুলে নে ঝোলাঝুলি, ধর বাগিয়ে লাঠি ও ঘটি, অতীত শক্তি ফিরিয়ে আন, বিদীর্ণ কণ্ঠে চীৎকার করে ওঠ,-
ব্যাঘাত আসুক নব নব,
আঘাত খেয়ে অটল রব,
বক্ষে আমার দুঃখে তব
বাজবে জয়ডঙ্কা।
দেব সকল শক্তি, লব
অভয় তব শঙ্খ।”

আর সেই পথে সঙ্গে থাকবে বন্ধু ও পথপ্রদর্শক, কেদার-বদ্রীর পাণ্ডার দল। এই পথ আলাদা, আলাদা এই পথের পাণ্ডারাও।

“কেদার বদ্রীর পাণ্ডা ভূ-ভারতের আর সমস্ত পাণ্ডার থেকে পৃথক। গয়ায় যাও, পুরীতে যাও, কাশীতে যাও, বৃন্দাবনে যাও, - সেখানে পাণ্ডা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যা পারে শুষে নেবে তোমার কাছ থেকে ---কেদার বদ্রীর পাণ্ডা কিন্তু তা নয় – - সে তোমার অভিভাবক। ধমকাবেও তোমাকে – ফিন ব্যয়ঠ গয়া। উঠ, চল, বোল জয় কেদার! --- তার আলাদা মর্যাদা। সে সাতপুরুষের মর্যাদা কেড়ে নিতে নিচে থেকে উঠে আসছে একটা লোলজিহ্ব অজগর।”

আর সেই কঠিন পথে চলাই তো তীর্থদর্শনের মাহাত্ম্য। এই পথ নিজেকে ‘দেব’ ভাবে না, সে সত্যিই দেব। কারণ তা চলেছে “দেবতাত্মা হিমালয়ে”র গা বেয়ে। এই পথের পথযাত্রীকে ভুলতে হয় আপন পদমর্যাদা, শুধু মনে রাখতে হয় ‘পথমর্যাদা’। সেই যাত্রার মানুষগুলির একটিই পরিচয়, তারা সহযাত্রী। তাদের লক্ষ্য একটি, পথের মহিমা উপভোগ করতে করতে পথের প্রান্তে সেই তীর্থক্ষেত্রে উপনীত হওয়া। তারই প্রতিধ্বনি লেখকের ভাষায়,-

“সমস্ত ভারতবর্ষকে একটা পাহাড় বেয়ে উঠতে দেখেছ কখনও? পঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠা-দ্রাবিড়-উৎকল-বঙ্গ। চলছে সবাই। টলতে টলতে এঁকে বেঁকে। শিশু ভোলানাথের ভক্তশিশু সব। হাঁটি হাঁটি পা পা। সবার মুখে এক বোল – জয় কেদার, জয় কেদার!”

এই পথে চলতে গিয়ে এই বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন লেখক নিজেও। আর সেই বিপদ এসেছে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র-কন্যাকে ঘিরে। প্রথম ঘটনাটি ঘটে তাঁর পুত্র রাণাকে নিয়ে। যাত্রা শুরুর আগেই। লছমনঝুলাতে।

আগেকার দিনে এই লছমনঝুলাতেই নাকি হত তীর্থযাত্রীর মানসিক স্থৈর্যের প্রথম পরীক্ষা। অবশ্য তাঁরা যখন সেখানে গিয়েছিলেন সেই সেতু অপেক্ষাকৃত শক্তপোক্ত। এই লছমনঝুলার বাবার দেওয়া বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর পুত্র রাণা ঝাঁপ দিয়েছিল জলে, কেন না, প্লবতা (Buoyancy) তাকে জলে ভাসিয়ে রাখবে। বাবা তাকে তত্ত্ব বুঝিয়েছিলেন, কিন্তু তার একটা ছোট্ট ফাঁক বোঝাতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর মাথাতেও আসেনি যে পুত্র এরকম ভয়ঙ্কর জায়গাতে হাতে-কলমে সেই পরীক্ষা করে বসবে।

দ্বিতীয় ঘটনাটি তাঁর কন্যা সন্তানকে নিয়ে, রুদ্রপ্রয়াগে। রাতের অন্ধকারে সে পথ না দেখে প্রায় গড়গড় করে চলে যাচ্ছিল একেবারে অতলস্পর্শী খাদের দিকে। শেষমুহুর্তে বাবা তাকে ধরে ফেলেন। এই দুটি ঘটনা তাঁকে গভীরভাবে শঙ্কিত করেছিল। তাঁর মনে পড়েছিল কলকাতা থেকে আসার সময় বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সতর্কবাণীর কথা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি চলা থামাননি।

তার কারণ একটাই। তিনি জানতেন, এই পথের দিন ফুরিয়ে আসছে। তার মাহাত্ম্যকে কেড়ে নিতে বদ্ধ পরিকর আপাত-সভ্য মানুষজন। লেখক নিজে প্রযুক্তিবিদ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তাঁর প্রিয় বিষয়। কিন্তু কেদার-বদ্রীর এই পথকে সহজ সরল করার এই প্রক্রিয়াকে তাঁর মনে হয়েছে বিজ্ঞানের, প্রযুক্তির এক ভয়ঙ্কর অপপ্রয়োগ। “উঠে আসছে একটা লোলজিহ্ব অজগর।” – এই কথার মধ্যে তিনি মানুষের অদম্য লোভের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।

তাঁর এই আশঙ্কার কথাই তিনি বারেবারে তুলে এনেছেন এই তীর্থযাত্রার সময়। জড়িয়ে পড়েছেন সহযাত্রীদের সঙ্গে তর্ক ও বিবাদে। গোঁসাইজী বলে এক সহযাত্রী এই পথযাত্রার কষ্ট লাঘব করার পক্ষে জোর সওয়াল করেছেন। ব্যথিত চিত্তে লেখক প্রতিবাদ করেছেন। গোঁসাইজীর প্রশ্ন ছিল-

- “কিন্তু কেন বলুন তো? হাজার হাজার যাত্রীর কষ্ট লাঘব হয়ে যাবে – যে পথ দশ-পনের দিনে যেতে হত সে পথ লোকে উইকেন্ডে ঘুরে আসবে, এতে আপত্তিটা কোথায়?”

লেখকের সুস্পষ্ট উত্তর –

“আমরা ধরে নিয়েছি পথশ্রমের কষ্টটা যেন-তেন-প্রকারেণ লাঘব করতে হবে। কিন্তু তা তো নাও হতে পারে। --- আর এটা তো স্বীকার করবেন এ পথটা ভারতবর্ষের আর লক্ষটা পথের থেকে স্বতন্ত্র? এ পথের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। ভারত সরকার চেষ্টা করলে সে বৈশিষ্ট্যটুকু বজায় রেখেও এ পথের উন্নতি করতে পারতেন। বসন্তের টিকা আর কলেরার ইঞ্জকশন দিন, স্যানিটারই পায়খানা বানান, আমি খুশী হব, কিন্তু পায়ে চলার পথকে পায়ে চলার পথই রাখতে হবে। এমনকি এ পথে বিজলী বাতি আর কংক্রিটের বাড়িতেও আমার আপত্তি। মাটির পান্থশালা মাটিরই থাকবে – সাঁওতাল কুটীরের মত তাকে রাখতে হবে ছিমছাম ঝকঝক, তাকেই আমি উন্নয়ন বলব।”

আমরা পুরোপুরি একমত তাঁর এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে, এই মনোভাবের সঙ্গে। যে কোন প্রগতিই হওয়া উচিত সুসমঞ্জস ভাবে, পরিবেশ ও সেখানকার অধিবাসী মানুষগুলির সঙ্গে যথাসম্ভব মানিয়ে রেখে। গোঁসাইজি অবশ্য তাঁর যুক্তি চালু রেখেছেন, শেষে প্রায় অভিযোগের ভঙ্গিতেই হেসে বলেছেন,

- এ আপনার সমস্তটাই সাহিত্যিকের দৃষ্টিভঙ্গি।

কিন্তু লেখক অটল ছিলেন তাঁর নিজের ভাবনাতে। পথে চলতে চলতে এই পথের মাহাত্ম্যের ক্ষয়ের কথা ভেবে তিনি শঙ্কিত হয়েছেন বারবার। নিজেকেই প্রশ্ন করেছেন যে তিনি কি প্রাচীনপন্থী যিনি পেশাতে প্রযুক্তিবিদ হয়েও মেনে নিতে পারছেন না। লাও সে, বার্ট্রান্ড রাসেল, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মেলাতে চেয়েছেন নিজের চিন্তাকে। শেষে উপনীত হচ্ছেন এই সিদ্ধান্তে,-

“খোলা মনে এখনও আমি বলতে চাই- তীর্থযাত্রার এই সরলীকরণ আমি খুশী মনে মেনে নিতে পারছিনা। ---- বিশাল কোন একটা কিছুকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে হলে তার জন্য একটা প্রস্তুতি চাই, - সময়ের একটা ন্যূনতম পরিমাপ চাই। মহাকাব্যের পকেট এডিশন হয় না, বিটোফেনের সোনাটাকে ধরে রাখা যায়না আড়াই মিনিটের রেকর্ডে। চলন্ত বাসের জানলা দিয়ে তেমনি দেখা যাবে না কেদারবদ্রীর পথকে। ---- --- যখন অফিসের কাজে দিল্লী দৌড়ই, তখন পথটা উপলক্ষ্য। তখন লক্ষ্যস্থলে যেন-তেন-প্রকারেণ পৌঁছে কাজটা সারাই হলও আসল। এখানে তো তা নয়, - এখানে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে আমার মিলনের সাধনা, যোগের আরাধনা। তাই এখানে পথটাই লক্ষ্য, পথের প্রান্তটা নয়। তাই এখানে গতিটা গৌণ, মৌল হলও যতি।”

আমরা তাঁর লেখার মধ্যে এক সতর্কীকরণ উপলব্ধি করি। হয়তো তা খুব পরিষ্কার নয়, তা অনেকটাই আভাসে, ইঙ্গিতে। কিন্তু সমগ্র বইটি পাঠ করে পাঠকের মন কি এক অজানা আশঙ্কায় ভরে ওঠে।

এই যে আশঙ্কা তিনি করেছিলেন, তা কিন্তু একেবারেই যে অমূলক ছিল না, ২০১৩ সালের সেই বিধ্বংসী বন্যাই তার বড়ো প্রমাণ। নিঃসন্দেহে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছিল, ২০১৩র জুন মাসের প্রথম দু-তিন সপ্তাহে যা বৃষ্টি হয়েছিল তা স্বাভাবিকের প্রায় সাড়ে চারগুণ আর তাকে প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাও বলাই চলে।

কিন্তু তা সত্তেও প্রশ্ন এসে যায় অনেকগুলি। ভূতাত্ত্বিক বা পরিবেশবিদরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই সতর্ক করে আসছিলেন এই ব্যাপারে। কতকগুলি ঘটনা তুলে ধরা যাক,-

"A new (mountain) range like the Himalaya will remain steady if not tampered with much. But the huge expansion of roads and transport is bringing the mountains in Uttarakhand down," says Pandit. Road, he says, is a major destabilising factor for a mountain and it is a new phenomenon for the Himalaya. ---- It is an established fact that there is a straight co-relation between tourism increase and higher incidence of landslides.”১০

“straight co-relation between tourism increase and higher incidence of landslides”!! – কোনরকম লুকোছাপার আর জায়গাই রাখেননি “পণ্ডিত মশাই”!

পাহাড় থেকে নামা ধ্বস

আরো দেখা যাক! এই রকম বৃষ্টি কিন্তু আগেও হয়েছে। বস্তুত, ১৯৬৫ সালে ৯০০ মিমি বৃষ্টি হয়েছিল যা ২০১৩র প্রায় আড়াই গুণ। কিন্তু এইরকম ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। মনে রাখতে হবে, সান্যালমশাই যাত্রা করেছিলেন ১৯৬৪ সালে। কাজেই তখন তাঁর চোখে যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা পরবর্তী কালে ভয়ঙ্কর বাস্তবে পরিণতি লাভ করেছে। ১১

যতই পদাধিকারীরা ‘দৈব-দুর্বিপাক’ বলে উড়িয়ে দিন, বিশেষজ্ঞরা একদমই মানতে নারাজ।

“Padma Shri awardee KS Valdiya told TOI that while "heavy rain and cloudbursts were natural, the tragedy that followed was entirely man-made". Valdiya, an honorary professor at Bangalore's Jawaharlal Nehru Centre for Advanced Scientific Research, said the heavy loss of life and property in the deluge was a result of "criminal oversight" over the decades of the state's geological features and water channels by various authorities. "These features are well-mapped and documented. But engineers and builders choose to overlook them," said Valdiya, who comes from the state and has been studying the region for close to 50 years.” ১২

পাঠকবৃন্দ, লক্ষ করলেন কি “পঞ্চাশ বছর” কথাটি? অর্থাৎ ১৯৬৩-৬৪ সাল থেকে ভালদিয়া মহাশয় দেখে আসছেন জায়গাটিকে! অর্থাৎ ঠিক সেই সময় যখন ‘পথের মহাপ্রস্থান’ শুরু।

"heavy rain and cloudbursts were natural, the tragedy that followed was entirely man-made"

শ্রীভালদিয়া অনেক দিন এগিয়ে এসে কি সেই কথাই বলছেন না যা নারায়ণবাবু সেই পঞ্চাশ বছর আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন! একথা ঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তির দ্বারা তিনি এই মতকে প্রতিষ্ঠা করেননি। কিন্তু তাঁর প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা কিন্তু তাঁকে বারংবার সতর্ক করাচ্ছিল যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না।

ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলে রাস্তাঘাট নির্মাণ কালে অসতর্কতার মাশুল।

ভ্রমণকারীদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই প্রকৃতি প্রেমিক সাহিত্যিককে। আমরা আরো দেখতে পাই তীর্থযাত্রায় মানসিক ভাবে উন্নত হয়ে ওঠা, সহযাত্রার আনন্দে উদ্বেল হওয়া ভ্রমণপিপাসু দার্শনিককে। কিন্তু এখানে আমরা বাড়তি পাওনা রূপে পেয়ে গেছি এক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা পরিবেশবিদকে। ১৯৬৪-৬৫ সালে পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে সেভাবে কিছু কথা ওঠেনি। সুন্দরলাল বহুগুণার “চিপকো” আন্দোলনের বার্তা ধ্বনিত হয় তার বেশ কিছু বছর পরে। এ এক অনবদ্য প্রাপ্তি!
মনে পড়ে সেই ধ্রুপদী উপন্যাসের কথা-
“তিনি অতি মৃদুস্বরে কহিলেন, “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?”
এই কণ্ঠস্বরের সঙ্গে নবকুমারের হৃদয়বীণা বাজিয়া উঠিল। বিচিত্র হৃদয়যন্ত্রের তন্ত্রীচয় সময়ে সময়ে এরূপ লয়হীন হইয়া থাকে যে, যত যত্ন করা যায়, কিছুতেই পরস্পর মিলিত হয় না।”

ভ্রমণকারী প্রযুক্তিবিদের মনে হয়ত সেই কথাই প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে বারেবারে। পার্থক্য একটাই – সেখানে ছিল পথিকের নিজের চলার পথ হারানোর কথা আর এখানে আমরা পাচ্ছি অন্য এক বেদনার আভাস, পথ নিজেই হারিয়ে যাচ্ছে, বরাবরের মত। কোন কপালকুণ্ডলাই আর তাকে নতুন ভাবে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

(বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার - কেদারনাথ বন্যা সংক্রান্ত তথ্যপঞ্জী দিয়ে এবং তৎ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের মতামত জানিয়ে সাহায্য করেছেন প্রেসিডেন্সীর ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক শ্রী শঙ্কর বসু। )

তথ্যসূচী

হিমালয় ভ্রমণকথার প্রবাদপুরুষ : প্রবোধকুমার সান্যাল - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়– অবসর– ভ্রমণ সংখ্যা -
সাহিত্যের ট্যুরিস্ট – বিকাশ বসু - গদ্যসংগ্রহ, প্রতিভাস - পৃঃ - ৪৯
মহাপ্রস্থানের পথে – প্রবোধ কুমার সান্যাল --মিত্র – ঘোষ, ত্রিশ মুদ্রণ, জ্যৈষ্ঠ – ১৪২২, পৃঃ – ১৫
পথের মহাপ্রস্থান – নারায়ণ সান্যাল --দেজ পাবলিকেশন, সপ্তম সংস্করণ, শ্রাবণ – ১৪১৮, পৃঃ – ৯
মহাপ্রস্থানের পথে – প্রবোধ কুমার সান্যাল --মিত্র – ঘোষ, ত্রিশ মুদ্রণ, জ্যৈষ্ঠ – ১৪২২, পৃঃ – ৭৩-৭৪
পথের মহাপ্রস্থান – নারায়ণ সান্যাল --দেজ পাবলিকেশন, সপ্তম সংস্করণ, শ্রাবণ – ১৪১৮, পৃঃ – ৫১
পথের মহাপ্রস্থান – নারায়ণ সান্যাল --দেজ পাবলিকেশন, সপ্তম সংস্করণ, শ্রাবণ – ১৪১৮, পৃঃ – ৫২
পথের মহাপ্রস্থান – নারায়ণ সান্যাল --দেজ পাবলিকেশন, সপ্তম সংস্করণ, শ্রাবণ – ১৪১৮, পৃঃ – ৬৩
পথের মহাপ্রস্থান – নারায়ণ সান্যাল --দেজ পাবলিকেশন, সপ্তম সংস্করণ, শ্রাবণ – ১৪১৮, পৃঃ – ৫১
১০ - http://www.downtoearth.org.in/news/man-made-reasons-for-uttarakhand-disaster-41407
১১ - http://www.theguardian.com/commentisfree/2013/jun/28/india-floods-man-made-disaster
১২ - -http://timesofindia.indiatimes.com/india/Geologist-explains-why-Uttarakhand-tragedy-was-man-made/articleshow/20780742.cms

 


লেখক পরিচিতি - জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিন চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।