প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা

ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫

 

সাহিত্যের ট্যুরিস্ট

বিকাশ বসু


জয়নগর-মজিলপুর গিয়ে যদি কেউ বলেন, বিষবৃক্ষে বর্ণিত নগেন্দ্রের বৈঠকখানা ও সাতমহলা দেখতে চাই, তাহলে তাকেই বলব সাহিত্যের ট্যুরিস্ট। সেখানকার দত্ত-বাড়িই যে নগেন্দ্রের জমিদার-বাড়ির মডেল, নাই বা থাকল তার কোনো নিঃসংশয়িত প্রমাণ। সাহিত্যের ট্যুরিস্টের কাছে ওই বাড়িটিই একটি ছোটোখাটো তীর্থ। কারণ বাস্তবে ও উপন্যাসের বর্ণনায় অনেকটায় মিলে যায়, আর জয়নগরের নিকটস্থ বারুইপুরের একদা-হাকিম বঙ্কিমের বন্ধুসান্নিধ্যলোভে ওই বাড়িতে বেশ যাতায়াত ছিল।

ভাগলপুরে গিয়ে শরৎসাহিত্যের অনুরাগী কেউ কি খোঁজ করেন আদমপুর ও বাঙালিটোলার মধ্যবর্তী সেই বিশাল প্রাচীন ‘মূর্তিমান অন্ধকারের মত’ অশ্বত্থ বৃক্ষের, যার প্রায় ত্রিশ হাত নীচে গঙ্গাবক্ষে বাঁধা থাকত ইন্দ্রনাথের ক্ষুদ্র তরিখানি। (সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় যখন ‘শরৎ-পরিচয়’ লেখেন তখনও এই গাছটি জীবিত ছিল)। কেউ না কেউ অবশ্যই তা করেন, আর তিনিই সাহিত্যের একজন যথার্থ ট্যুরিস্ট।

আবার নিমতিতার রাজবাড়ির প্রশস্ত বারান্দার একপ্রান্তবর্তী ঘরে পা দিয়ে যদি কেউ আবেগ অনুভব করেন শুধু এই কারণে যে সেই ঘরটিতে একদিন লেখা হয়েছিল ক্ষিরোদপ্রসাদের ‘আলিবাবা’—(এমন নাটক বাংলায় আর লেখা হল কই?)—তাহলে তিনিও সাহিত্যের ট্যুরিস্ট।

অন্য দিকে, কেউ যদি কোনো সাহিত্যিকের জন্মস্থান বা পৈত্রিকভিটেতে, যেখানে তাঁর নামাঙ্কিত স্মৃতি-পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে তাঁর আবক্ষ-মূর্তির বেদিমূলে উৎকীর্ণ প্রশস্তিমাত্র পাঠ করে সভক্তি প্রণাম নিবেদন করেন, তাঁকেও সঠিক অর্থে সাহিত্যের ট্যুরিস্ট বলতে পারা যাবে না। কেন-না তাঁর এই সভক্তি প্রণাম এমন প্রমাণ করে না যে সত্যিই তাঁর প্রাণ সাহিত্যের সঙ্গে বাঁধা। শুধু এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বা প্রতিভার উদ্দেশেই তাঁর এই শ্রদ্ধা নিবেদন, এমন ঘটনাও অসম্ভব নয়। তা ছাড়া—এবং সেটাই আসল কথা—শুধু একটি স্মৃতি-পাঠাগার ও আবক্ষ-মূর্তির জোরেই কোনো স্থান সাহিত্যতীর্থ হয়ে ওঠে না। সাহিত্যতীর্থ হিসেবে পৈতৃকভিটে বা সাহিত্যিকের জন্মস্থানের দাবিও নামমাত্র। তাহলে?

তাহলে কথা এই, সাহিত্য অমর হয়ে আছে, অথবা অমর সাহিত্য রচিত হয়েছে—মোটামুটি এই দুই হল সাহিত্যচিহ্নিত দেশ। এই দুই দেশের প্রতি যিনি আন্তরিক টান অনুভব করেন, এবং এই দেশভ্রমণের সুযোগ কখনও হাতছাড়া করেন না, তিনিই সাহিত্যের ট্যুরিস্ট। লেখকের ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর সংগ্রহশালা, বিশেষ তা যদি হয় লেখকের বাসগৃহেই, তবে তাও সাহিত্যের ট্যুরিস্টের কাছে বড়ো আকর্ষণ, কিন্তু সাহিত্যে চিহ্নিত দেশের সঙ্গে ভক্তপাঠকের নিগুঢ় হৃদয়সম্বন্ধ—তার টানই আলাদা।

সাউথওয়ার্কের সরাই ‘দি জর্জ’
ছবি - Ewan Munro (উইকিপেডিয়া থেকে)

অতএব একালের ডিকেন্সভক্ত সাহিত্যের ট্যুরিস্ট ছোটেন সাউথওয়ার্কের সেই সরাইয়ে ‘দি জর্জ’ যার নাম, কেন-না এখানেই ডিকেন্স তাঁর ‘লিটল ডোরিট’-এর খানিকটা লিখেছিলেন, আর পুরোনো সেই হোটেলটি এখনও যথাসম্ভব সেই রকম ভাবে রাখা হয়েছে। ডিকেন্সভক্তদের কাছে আরও আকর্ষণ বোধহয় ইপস্উইচের ‘দি গ্রেট হোয়াইট হর্স হোটেল’। এই সেই হোটেলবাড়ি যেখানে স্রষ্টা ডিকেন্স এবং তাঁর সৃষ্ট অতিখ্যাত চরিত্র ‘পিকউইক দু-জনেই উঠেছিলেন। অর্থাৎ এই হোটেলের অভিজ্ঞতায় বর্ণিত হয়েছে ‘পিকউইক পেপার্সে’।

ওদেশের সাধারণ মানুষের কাছেও কিন্তু বিশেষ কোনো মুল্য নেই বিলেতের এই হোটেলগুলির, যদি না তিনি সুগভীরভাবে ডিকেন্সভক্ত হন। সাহিত্যচিহ্নিত দেশের মূল্য একমাত্র সত্যিকার ও ওয়াকিবহাল অনুরাগীদের কাছে। দেশগুলি আবিষ্কার ও চিহ্নিত করার কৃতিত্ব অবশ্য সাহিত্যগবেষকদের। যেদিন থেকে জানা গেল ডিকেন্সের ‘বারনেবি রুজ’ উপন্যাসে যে ‘মেপোল ইন’-এর কথা আছে তা আসলে এসেক্সের চিগওয়েল ‘ওল্ড কিংস হেড’ সেদিন থেকে সেখানে সাহিত্যতীর্থযাত্রীদের আনাগোনা। ডিকেন্সভক্তরা সেখানে পা রেখে তীর্থদর্শনের অনুভূতিতে রোমাঞ্চিত হন। অথচ সাধারণ একটি বাড়ি বই তো নয়, বড়ো জোর প্রাসঙ্গিক তথ্যসম্বলিত একটি ফলক সে বাড়ির দেওয়ালে।

ডিকেন্স পাখির পালকের লেখনীতে অমর হয়ে আছে লন্ডনের একটি কিউরিও- বিপনি, নাম ‘দি ওল্ড কিউরিওসিটি শপ’। ১৮৪১ সালে ডিকেন্সের ওই নামের উপন্যাসটি যখন বার হয়, তখনই ওই কিউরিও শপের যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। ১৫৬৭ সালে এই কিউরিও শপের জন্ম। সম্ভবত দোকানের এই বয়েস, এবংবিধ নাম, চেহারা ও চরিত্র, পরিবেশ, সমস্ত কিছু ডিকেন্সকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল লিটল নেল ও তার দাদুর ওই করুণ মধুর কাহিনী। এ তো শুধু স্বল্পালোকিত পুরোনো একটি দোকানঘর নয়, মানুষের আশ্রয়ও। নেল-এর উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির ভাই ফ্রেড-এর অবিবেচনায় একদিন হাতছাড়া হয়ে গেল সেই আশ্রয়। অর্থগৃধু ভিলেন ড্যানিয়েল কিল-তাড়িত হয়ে দাদু ও নাতনিকে স্মৃতিজড়িত আশ্রয় ছেড়ে বেড়িয়ে পড়তে হল অজানা পথে। তারপর কত বিচিত্র অমানবিক মানবিক অভিজ্ঞতা। ঘটনার শেষ পর্বে যখন দাদু ও নাতনির দুঃখ দিনের অবসান, স্বয়ং উদ্ধার-কর্তা (দাদুর প্রবাসী ভাই) হাজির, তখন দেখা গেল তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে—নেল মারা গিয়েছে দুঃখকষ্টের তাপে, আর তার দাদু মরণের পথে। ঘটনা অবশ্যই লন্ডনের এই দোকান থেকে ছড়িয়ে যায় বিচিত্র পথে, কিন্তু কখনওই যেন এই দোকানটিকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে যায় না। আর মনে হয়, চমৎকার নামকরণ এই উপন্যাসের।

এমন বিশেষ উল্লেখ্য সাহিত্যচিহ্নিত দেশে তো ডিকেন্সভক্তরা ছুটে আসবেনই। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় আমাদের বিভূতিভূষণের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর কথা। বাংলা এই উপন্যাসের কেন্দ্রে ছিল রানাঘাটের একটি হোটেল, সেই হোটেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজন, তাদের সরলতা কপটতা, সুখ দুঃখ, মান-অভিমান, আশা-আকাঙক্ষার সঙ্গে বাঁধা পড়ে গেছে বেশ কিছু বিভূতি-অনুরাগী পাঠক। কিন্তু তাঁদের কেউ কি কোনোদিন শনাক্ত করবার চেষ্টা করেছেন হাজারিঠাকুরের সেই হোটেলটিকে। যদি করে থাকেন তাহলে তিনি একজন সাহিত্যের ট্যুরিস্ট। বিভূতি স্মৃতি কমিটির একটি চমৎকার কাজ হতে পারে সেই হোটেলের গায়ে একটি ফলক বসিয়ে দেওয়া, যাতে সংক্ষিপ্ত দু-একটি বাক্যে বিবৃত থাকবে হোটেলটির বিশেষ মাহাত্ম্যের কথা।

কালের প্রয়োজনে বা উপেক্ষায় সাহিত্যচিহ্নিত দেশের যদি ক্ষতি হয়, বা রূপান্তর ঘটে সাহিত্য-অনুরাগী স্বভাবতই বেদনাবিদ্ধ হন। ব্রিটেনের হাল শহরের যে ডকটি থেকে ডিফোর নায়ক রবিনসন ক্রুশো বেরোতেন সমুদ্র অভিযানে, সে ডকটি এখন কোথায়? কোথাও নেই। সেখান থেকে এখন আর কোনো জাহাজ সমুদ্র পাড়ি দেয় না। সেখানে এখন ডকের বদলে শুধুই একটি খোলামেলা চত্বর—কুইন ভিক্টোরিয়া স্কোয়ার। বাস্তবে কোথাও নেই সেই রবিনসন ক্রূশোর ডক—কিন্তু সাহিত্যে তো তা চিহ্নিত হয়ে আছে চিরকালের জন্যে। অতএব কিছু একটা করা দরকার। শুধু এই কারণেই সেই চত্বরেরই একধারে সংরক্ষিত হয়েছে পুরোনো ডক অফিসটি, —সেটা আর ভেঙে ফেলা হয়নি, রুপান্তরিত করা হয়েছে জাহাজি জাদুঘরে। আর সেখানেই স্থাপন করা হয়েছে ক্রুশোর নামাঙ্কিত এক ফলক।

সাহিত্যের ট্যুরিস্টকে সাহিত্যচিহ্নিত দেশ চিনিয়ে দেবার পক্ষে এইটুকুই যথেষ্ট, বাদবাকি সংশ্লিষ্ট সব খবরই যে তাঁর জানা। অন্যান্য সব খবর যদি তাঁর জানা না থাকে তবে তিনি কীসের সাহিত্যের ট্যুরিস্ট? সবচেয়ে বোকার কাণ্ড (এবং রুচিহীনও) করেছি আমরা মাইকেলের সমাধিলিপি নিয়ে। যে লিপি একমাত্র সমাধির জন্যেই বিশেষভাবে রচিত তার আর একটি প্রতিভূ-সংস্করণ বানিয়ে বসিয়ে দিয়েছি দারোয়ানের ঘরের ঠিক পাশটিতে বড়োরাস্তার ওপর—উদ্দেশ্য কবি অনুরাগীদের সাহিত্যচিহ্নিত দেশ চিনে নিতে সাহায্য করা। যেখানে ‘কবির সমাধি ভিতরে’, এই টুকরো লেখনই যথেষ্ট ছিল, সেখানে—হায়।

লোয়ার সার্কুলার রোডের সমাধিক্ষেত্রের সেই একটুকরো জমি যেখানে কবি ও কবি- জায়া চিরদিনের মতো পাশাপাশি শয়ান, যেখানে মহির কোলে নিদ্রাবৃত দত্তকুলোদ্ভব শ্রীমধুসূদন, মাইকেল অনুরাগীদের কাছে (এবং একমাত্র তাঁদের কাছেই) তা সাহিত্যতীর্থ। এই নিরালয় তীর্থযাত্রী যখন এসে দাঁড়াবেন, তখন তিনি ফিরে যাবেন কবির জীবনের শেষ কটি দিনে, সেই নিঃসঙ্গতায় সঙ্গ পাবেন তাঁর প্রিয়কবির, হয়তো বা চলে যাবেন, ‘কবোতাক্ষ তীরে সাগরদাঁড়িতে’—কিন্তু হায়। তার উপায় আমরা রাখিনি। এখানে এসে দাঁড়াবার অনেক আগেই প্রবেশদ্বারেই কবির স্বরচিত করুণ মধুর সমাধিলিপির গোটাটাই সেই তীর্থযাত্রীর পড়া হয়ে গেছে। কাঙ্খিত সব বস্তুই সুলভ করে দিতে নেই। আর সাহিত্যতীর্থযাত্রী ব্যাপারটা ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের মতোই। কেদারবদরীর পথ রেডরোডতুল্য হলে তার মাহাত্ম্য অনেক কমে যায়। তীর্থপথের খবরাখবর নিয়েই তাঁরা বার হন তীর্থযাত্রায়। আর তীর্থের মাহাত্ম্যের মূল্য হিসেবেই তাঁদের যাবতীয় শ্রমস্বীকার।

হেমিংওয়ের ভক্তরা জানেন স্প্যানিশ শহর প্যামপ্লোনার কাফে ইরুনার মাহাত্ম্য। ষাঁড়ের লড়াই নিয়ে তাঁর অধিকাঁশ রচনায় ব্যবহৃত উপাদান অভিজ্ঞতা তো এখান থেকেই সঞ্চয় করা। এখানকার বার্ষিক উৎসবমেলায় তাই বছরের পর বছর এসেছেন তাঁর রচনার অনুরাগীরা, মিলিয়ে নিয়েছেন গল্পে উপন্যাসে বর্নিত বিষয়াদি। কয়েক বছর আগে যখন সেই কাফে ইরুনা রূপান্তরিত হল আধুনিক এক বিংগো হলে তখন তো হোমিংওয়ের ভক্তদের কাছে হয়েছিল ভয়ানক শোকের ব্যাপার।

ওয়ার্ডসওয়ার্থের বহু রচনার উৎসভূমি লেক ডিস্ট্রিক্ট। বিলেতের ওই অঞ্চল অভিমুখি পর্যটক সংখ্যাও অগণিত। তাঁদের লক্ষ্য কিন্তু শুধু গ্রাসমেয়ারের ‘ডোভ কটেজে’ সংরক্ষিত কবির ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নয় সেই কুটিরের অভ্যন্তরের প্রবেশ করে তাঁরা অবশ্যই এসে দাঁড়ান প্রায় দুশো বছর আগের এক কবির সান্নিধ্যে।

গ্রাসমেয়ারের ‘ডোভ কটেজ’


কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ

রাইডাল মাউন্টের সেই বাড়িটাও তাঁরা ঘুরে আসেন যেখানে কবি ও তাঁর বোন ডরোথি কাটিয়েছেন শেষ জীবন। কিন্তু কবিভক্তরা বোধহয় সর্বাধিক আবেগ অনুভব করেন উইন্ডমেয়ার লেকের ধারে সেই বিশেষ জায়গাটিতে এসে যেখানে একদা কবি নিজেও থমকে দাঁড়িয়েছিলেন দশ সহস্র ড্যাফোডিল ফুলের সমারোহ প্রতক্ষ করার আবেগে। সেখানে—ঠিক সেই জায়গাটিতে আজও অজস্র ড্যাফোডিল ফুটে থাকে, ফোটানো হয়ে থাকে—হয়তো বা ঠিক সেদিনের মতো। হাঁ, সেদিনের মতো—অন্তত সাহিত্য পর্যটকরা সেই রকম ভাবতেই ভালোবাসেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইচ্ছে করে সত্যি সত্যি একা হয়ে যান দলছুট হয়ে—কবি নিজে যেমন ছিলেন সেদিন। ওঁদের মধ্যে খুব দু-একজন হয়তো আবার সাহিত্যের এই তীর্থ সম্পর্কে আরও বিশদ নেপথ্য খবর রাখেন। তিনি জানেন সেদিন ওয়ার্ডসওয়ার্থ সত্যি সত্যি ‘নিঃসঙ্গ মেঘের মতো একাকী’ একক ঘুরছিলেন না—ওটা এসেছে কবিতার দাবিতে—তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রিয় ভগ্নী ডরোথি। তবু এই সেই স্থান—একথা ভাবতেই তাঁদের রোমাঞ্চ লাগে।

আর এক সাহিত্যচিহ্নিত দেশ আমেরিকার ছোট শহর হ্যানিবল। মিসৌরি প্রদেশে এই ছোটো শহর মার্ক টোয়েন অনুরাগীদের কাছে মক্কা। অথচ এই শহরে তাঁর জন্ম বা কর্ম কোনোটাই নয়। ৭৫ বছরের জীবনে প্রথম দিকের মাত্র চোদ্দটি বছর কাটিয়েছিলেন তিনি এখানে। এদিকে মিসিসিপি তীরবর্তী এই ছোটো শহরেই ছুটে আসেন বছরে আড়াই লক্ষেরও বেশি সাহিত্যের ট্যুরিস্ট। কারণ, পৃথিবীর নানান প্রান্তের এইসব টোয়েনভক্তরা জানেন, তাঁদের প্রিয় টম সোয়ার ও হাক্‌লবেরি ফিন-এর লীলাভূমি এই শহর—সাহিত্যে যাকে অমর রেখে গেছেন তাঁদের প্রিয় লেখক মার্ক টোয়েন ‘সেন্ট পিটারস্‌বার্গ’ এই নামে। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, অধ্যাপক সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর দলবল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ‘অপুর দেশ’ দেখার ইচ্ছাপ্রকাশ করলে, বিভূতিভূষণ তাঁদের বনগাঁয়ের চালকে—ব্যারাকপুরে নিয়েও যান। সুনীতিকুমারের এই দলটি ছিলেন যথার্থ সাহিত্যের ট্যুরিস্ট। বিভূতিভূষণও নিশ্চয়ই তাঁদের দেখিয়েছিলেন সোনাডাঙার মাঠ, ইছামতীতে স্নান করতে যাবার ঘুঘুডাকা নির্জন পথ। হয়তো বা সল্‌তেখাগী আম গাছটাও ছিল তাঁদের দ্রষ্টব্য তালিকায়।

যাইহোক, হ্যানিবলে এসে টোয়েন ভক্তরা সেই কাঠের তৈরী বিশেষ পাঁচিলটি দেখতে চান, যে পাঁচিলের এখন নতুন নামকরণ করা হয়েছে—‘টম সোয়ারের পাঁচিল’। ভক্তদের নিশ্চয়ই মনে পড়ে যায় সেই উপভোগ্য ঘটনা। আন্টি পলি এই পাঁচিলের রং করার কাজ দিয়েছিলেন টমকে—আর ফাঁকিবাজ টম কেমন করে কথায় ও কৌশলে তার বন্ধুদের দিয়ে এর চমৎকার দুধসাদা রং করিয়ে নিয়েছিল। একবার নয়, তিন তিন বার। যতক্ষণ একটুও রং অবশিষ্ট ছিল মহোৎসাহে তার বন্ধুরা কাজ করেছিল, অথচ টমের বন্ধুরা কেউই তেমন বোকা ছিল না। শুধু তাই? এই মহান কাজের সুযোগ দিয়ে টম তার বন্ধুদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ঘুস হিসেবে আদায় করেছিল নানাবিধ উপহার। ছেলেবয়েসে পড়া টোয়েন ও টম-অনুরাগীদের মনে গেঁথে আছে এই উপভোগ্য ঘটনা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাই উজ্জ্বল সাদারঙের পাঁচিলটির ছবিও তুলে নিয়ে যান।

এই রাস্তার পারেই আবার লরা হকিন্সের বাড়ি, টোয়েনের বাল্যসখী লরা উপন্যাসের যার নাম বেকী থ্যাচার। বাড়িটির নতুন নামও ‘বেকি থ্যাচার’স হাউস’। অনুরাগীর কাছে এটিও বিশেষ দ্রষ্টব্য। তবে ট্যুরিস্টরা কাছেপিঠের সেই বিখ্যাত গুহাটি দেখতে কখনোই ভোলেন না যেটির অভ্যন্তরের বিস্ময়কর সৌন্দর্যের বর্ণনা আর যেখানে বন্দি টম ও তার সঙ্গী বেকির মধুর উজ্জ্বল উদ্ধারের কথা আছে টোয়েনের রচনায়।

ডেনমার্ক থেকে সাগর টপকে ভেসে বা উড়ে আসে ট্যুরিস্ট, শুধু স্টোক-অন-ট্রেন্ট দর্শনের অভিলাষে। কোনো বিলাসী বড়ো শহর নয় স্টোক-অন-ট্রেন্ট। কোনো রকমের ইতিহাস প্রসিদ্ধও নেই এই জায়গার। কলাচর্চার পীঠস্থান? তাও নয়। তবে? কী পায় এই ট্যুরিস্ট পটারি কারখানার আবর্জনাভূষিত এই এলাকায়? স্বদেশে ও প্রতিবেশী দেশে এত সব শৈলশহর ও সাগরসৈকত থাকা সত্ত্বেও এখানে সে ছুটে আসে কেন? শুধু একটি কারণে, এটি তার প্রিয় লেখক আর্নল্ড বেনেটের দশ। কান্ড বটে। বেনেট কিছু পৃথিবীবিখ্যাত লেখক নন। পর্যটন দফতরের মহিলা গাইড তাই নিজেই অবাক হয়ে যায় ডেনিশ ভদ্রলোকের অস্বাভাবিক বেনেটভক্তিতে।

অস্বাভাবিক? কে জানে। আর্নল্ড বেনেটের এই ডেনিশভক্ত হয়তো প্রথম যৌবনে ‘ক্লেহ্যাঙ্গার’ পড়েই মুগ্ধ। এই সেই পথ, উপন্যাসের নায়ক এডউইনের মতো লেখক বেনেট নিজেও যে পথ দিয়ে হেঁটে রোজ ইস্কুলে যেতেন। সুযোগ পেলে একবার তার প্রিয় লেখকের দেশ দেখে আসবে না?

ইংরেজি ভাষার অনতিখ্যাত লেখকদেরও এই এক সৌভাগ্য, এমন একটা ভাষায় তাঁরা লিখে থাকেন যে কিছু না কিছু আন্তর্জাতিক ভক্ত জুটে যায়ই তাঁদের কপালে। এ ব্যাপারে বাঙালি লেখকদের কপাল মন্দ। এমন পৃথিবীতে অন্তত দুটি স্বাধীন দেশ রয়েছে যেখানকার মানুষ বাংলাভাষী। তবু জীবনানন্দের অগণিত ভারতীয় ভক্ত (পশ্চিমবঙ্গীয়) কেন ছুটে যায় না বরিশাল কুমিল্লার রূপসি বাংলায়? যেখানে টুপটাপ ঝরে বটফল নরম ঘাসের বুকে ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে। বুদ্ধদেব বসুর রমনার সবুজ স্বচক্ষে দেখবে বলে কেউ ভিসার জন্যে লাইনে দাঁড়িয়েছে এমনও তো শোনা যায় না। শুধু সাহিত্যের টানে ভিসার ঝামেলা পোয়াব তেমন মানসিকতা এখনও আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি।

শুধু তাই? দুয়ার হতে অদূরে কাঁথি—সন্নিহিত সেই বিশেষ কালী মন্দিরে যেখানকার পুরোহিত অধিকারী মশাই ছিলেন কপালকুণ্ডলার পিতৃপ্রতিম, যেখানে নবকুমারের সঙ্গে তার বিবাহ নিষ্পন্ন হয়েছিল আশ্চর্য নাটকীয়তায়, যেখান থেকে তার পতিগৃহযাত্রা। শেষোক্ত ঘটনা তো শকুম্তলার পতিগৃহে যাত্রাকেই স্মরণ করায়। সাধারণ কালীভক্তের অবশ্যই দেখা মেলে এই মন্দিরে, কিন্তু বঙ্কিমভক্তের? সাহিত্যভক্তের? এদিকে সেখানে গেলে নাকি চাক্ষুষ করা যায় কপালকুণ্ডলার স্মৃতিচিহ্ন—কাপলিকের খাঁড়া। হয়তো প্রামাণিক কিছু নয়। তীর্থক্ষেত্রের দ্রষ্টব্যের কত কিছুই তো প্রামাণিক হয় না, স্রেফ আনুমানিকতায় হয়ে ওঠে মুল্যবান।

শিবরাম চক্রবর্তী

৩৪ নং মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে মুক্ত আরামে সুদীর্ঘকাল বাস করে গিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অদ্বিতীয় লেখক শিবরাম চক্রবর্তী। ‘ক্ষেত্র কুটীর’ নামের এই বাড়ির ২নং ঘরটি বোধহয় একটি আদর্শ সাহিত্যিচিহ্নিত দেশ, অন্তত তা সহজেই হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা সাহিত্যানুরাগীর মানসিকতায় একে সংরক্ষণ করতে পারি। অর্থাৎ ঘরের অভ্যন্তরে শিবরামের কোনো আবক্ষ মূর্তি নয়, ছবি নয়। শিবরাম-সম্পর্কিত জ্ঞাতব্য তথ্যাদি সবই থাকবে ঘরের বাইরের দিকের দেওয়ালে। আর বাড়ির সদর দরজায় ঠিক পাশটিতে একটি ফলকে বড়ো ও পরিচ্ছন্ন হরফে থাকবে : শিবরামের স্মৃতিবিজরিত ঘরটি বাড়ির ভেতরে।

বলাবাহুল্য ঘরের মধ্যে ছারপোকাপোষা তক্তাপোশটি অবশ্যই থাকা চাই, আর ঘরের চার দেওয়ালে শিবরামের নিজের হাতে লেখা পরিচিতদের অজস্র ঠিকানা— সেগুলো যেন মুছে না দেওয়া হয়। শুধু এইটুকু কাজ—এটুকু করলেই ‘ক্ষেত্র কুটীরের’ এই ঘরটি অসামান্য সাহিত্যচিহ্নিত দেশ হয়ে যাবে।

দেওয়ালের লেখার কথায় মনে পড়ে যায়— শেক্সপিয়রের জন্মস্থানের কথা। সেটিও নিজগুনে এক সহিত্য চিহ্নিত দেশ। সেখানকার অতিরিক্ত আকর্ষণ দেওয়ালের গায়ে যুগ যুগের শেকসপিয়রভক্ত সাহিত্য-পর্যটকদের স্বাক্ষর। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন স্যার ওয়াল্টার স্কট, লর্ড বায়রন, এঁরাও।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি অনেক সময় ভাবি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঘরের সেই পিয়ানোটির কথা যা রবীন্দ্রনাথের প্রথম যুগের গানের উৎস। সেই পিয়ানো যার সুরের সঙ্গে মিলিয়ে কথা বসিয়ে যেতে হত নবীন কবি রবিকে। সেভাবেই তো তাঁর গান রচনার সূচনা। রবীন্দ্র-ভক্তের কাছে তা হত এক সত্যিকার সাহিত্যচিহ্নিত দেশ। সেই পিয়ানোটি এখন কোথায়? সেটি যদি উদ্ধার করা যেত। কিন্তু সে বোধহয় আর হয় না। সবই অলস কল্পনা।

তবে এমন তো সহজেই হতে পারে—মনে করুন, সারা বছর ধরেই কিছু না কিছু মানুষ এপার বাংলা ওপার বাংলা করছে শুধু সাহিত্যের টানে। তাহলে কেমন হয়? এপার বাংলার মধুসূদন ভক্তরা যাচ্ছে যশোরের সাগরদাঁড়িতে, শুধু একবার কপোতাক্ষ নদের জল ছুঁয়ে আসতে। সেই কপোতাক্ষ যা ‘কবোতাক্ষ’ এই বানানে অমর হয়ে আছে আমাদের সাহিত্যে, যার কথা কবি সুদূর প্রবাসেও ভুলতে পারেননি। আবার ধরুন ওপার বাংলার নজরুল ভক্তরা আসছেন বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় তাঁদের প্রিয়কবির বাল্যলীলাময় দেশে কিছুটা সময় কাটিয়ে যেতে, বাবুদের তালপুকুরটা একবার স্বচক্ষে দেখে যেতে। এমন তো হয় না। অথচ এমনই তো হবার কথা।

আর রবীন্দ্রনাথের ‘ভূতলের স্বর্গখন্ডগুলি’ সে তো সব পড়ে আছে ওপার বাংলায় পদ্মাসংলগ্ন গ্রামগুলিতে, শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর। সেই শিলাইদহ যেখানে গিয়ে দাঁড়ালে রবীন্দ্রনাথের একদা-বন্ধু কুষ্ঠিয়ার হাকিম দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান কান পাতলে হয়তো শোনা যাবে, কিংবা দেশবন্ধু-ভগ্নী অমলা দাশের কন্ঠে রাতের নৌকায়—‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’। অথবা যেখানে রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে জগদীশচন্দ্র বসু চলেছেন কচ্ছপের ডিম শিকারের আশায়। অথচ এই পরিবেশ ও জীবনেরই তো ফসল তাঁর ‘সোনারতরী’, ‘চিত্রা’, অনেক ছোটো গল্প আর ছিন্নপত্র।

না, তেমনটা হয় না এদেশে। এ সবই কল্পনা। তেমন সাহিত্যের ট্যুরিস্ট নেই আমাদের যে ভিসার জন্যে লাইন দেবে স্রেফ সাহিত্যের টানে। অথচ ওদিকে ডিকেন্সভক্ত ছোটে সাউথওয়ার্কের সেই সরাইয়ে ‘দি জর্জ’ যার নাম, কেন-না এখানেই ডিকেন্স তাঁর ‘লিটল ডোরিট’-এর খানিকটা লিখেছিলেন, আর পুরোনো সেই হোটেলটি এখনও যে অনেকটা সেইরকমই আছে।

 


লেখক পরিচিতি - বিকাশ বসু (১৯৩৪ – ২০১২) - বাংলার সুখ্যাত প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও কবি। এই লেখাটি তাঁর গ্রন্থ (বিকাশ বসু গদ্যসংগ্রহ, প্রতিভাস থেকে প্রকাশক ও সত্ত্বাধিকারির অনুমতিগ্রহণ পূর্বক পুনঃপ্রকাশিত।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।