প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা

ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫

 

হিমালয় ভ্রমণ ও জলধর সেন

দীপক সেনগুপ্ত


বাঙালী ভ্রমণপ্রিয়। ভ্রমণকারীদের মধ্যে দু’একজন বাঙালীর দেখা মিলবে না এ সম্ভাবনা খুবই কম। অবশ্য এরকম লোকও আছেন যারা কর্মক্ষেত্রে যাওয়া বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাজারের থলি হাতে বেরোন ছাড়া আর কোথাও নড়তে চান না। রাস্তাঘাট ও যাতায়াতের ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় ভ্রমণ পিপাসুদের অনেক সুবিধা হয়েছে। বহুলোকই অর্থনৈতিক দিক থেকে এখন অনেক সচ্ছল হওয়ায় দেশের মধ্যে ছাড়াও বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাও অনেকে বেড়েছে। দশ বারো দিনের মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকা ঘুরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেক ভ্রমণ সংস্থা এগিয়ে এসেছে। অনেকের কাছে সুরক্ষার দিকটা বা সঙ্গিহীনতা কোন সমস্যা নয়। একবার মাউন্ট আবু থেকে জয়সলমীর যাবার পথে বাসে এক ইসরায়েলের যুবকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ভারতবর্ষ তার খুব প্রিয়। সেবার তার তৃতীয়বার ভারতে আসা। একাই সে এসেছে, তার স্ত্রী গিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকায়। দু’জনের পছন্দমত জায়গায় আলাদা ভাবে বেরিয়ে পড়তে তাদের কোন অসুবিধা হয় নি। এটা আমাদের ভাবতে একটু অবাক লাগে। এক সময়ে ‘রেশম পথ’ (silk route ) ধরে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রয়োজনে যারা বেরোত, পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে চেপে দীর্ঘ যাত্রাপথ অতিক্রম করে দু’চার বছর পরে তারা হয় বাড়ি ফিরত। অনেকেই পথশ্রমে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে, দস্যুর হাতে পড়ে বা রোগাক্রান্ত হয়ে পথেই মারা যেত। এভাবেই কত শতাব্দী চলেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মার্কোপোলো ও তার সঙ্গীরা ইতালির ভেনিস শহর থেকে যাত্রা শুরু করে গোবি মরুভূমি পেরিয়ে চীনের সম্রাট কুবলাই খানের কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে বেশ কিছুকাল কাটিয়ে, জিনিসপত্র আদান-প্রদানের পর পথে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে চব্বিশ বছর পরে তারা যখন দেশে ফিরেছিলেন, আত্মীয় স্বজনরা তাদের চিনতে না পারায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। সে যুগের অবসান ঘটেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে সমস্ত পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়; মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় যে কোন জায়গায় যে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব কয়েকটি মাত্র সংখ্যার বোতাম টিপে, পৃথিবীর অপর প্রান্তে গিয়ে হাজির হওয়া যায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।

এবার পরিসর ছোট করে দেশে ফেরা যাক। এখানে ভ্রমণের উদ্দেশ্য মূলত: দুটো। নিছক বেড়ানোর আনন্দ উপভোগ করতে ও দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের জন্যই অনেকে ভ্রমণ করেন। আর দ্বিতীয় দলে আছেন তীর্থদর্শনেচ্ছু পুণ্যার্থীরা। এই শ্রেণীর সংখ্যা কিছু কম নয়। ভারতবর্ষে তীর্থস্থানের ত কোনো অভাব নেই; উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে দেবদেবীর মন্দির ও মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থান বিকীর্ণ রয়েছে। ভ্রমণের ক্ষেত্রে আবার হিমালয় একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য ও পুণ্যক্ষেত্র উভয়েরই মহাসঙ্গম ঘটেছে হিমালয়ে। হিমালয়ের ধ্যানমৌনী ভাব, বিশালত্ব, উদার বৈরাগ্যময় পরিবেশ ও নিঃসীম নিস্তব্ধতা মনকে গ্লানি মুক্ত করে ভূমার বার্তা বয়ে আনে। সাময়িক ভাবে হলেও এটা ঘটে, হয় ত কিছুটা অজান্তেই। রাস্তাঘাটের উন্নতি হওয়ায় অনেক জায়গাতেই আর পায়ে হেঁটে যেতে হয় না। শোনা যায় স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু অমরনাথ যাত্রার পথে পিশু চড়াইয়ের ভয়াবহতা দেখে ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখেই ফিরে এসেছিলেন। হিমালায় তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করত। প্রবোধকুমার সান্যালের লেখা ‘দেবতাত্মা হিমালয়’ গ্রন্থের ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ সালে তার নিজের স্বাক্ষর করা ভূমিকায় তিনি হিমালয়ের যে প্রশস্তি করেছেন সেটা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় – “যে কোন স্থানেরই পর্বত আমার খুব প্রিয়। কিন্তু হিমালয় আমার মধ্যে এক অদ্ভুত ভাল লাগার সৃষ্টি করেছে। এর সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছুই আমাকে আকর্ষণ করে। ভারতের বিশাল অঞ্চল জুড়ে এর যে শুধু ভৌগলিক অস্তিত্বই রয়েছে তা নয়, প্রতিটি ভারতবাসীর কাছে এটি এক গভীরতর বার্তা বয়ে আনে। ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকেই আমাদের জাতির সঙ্গে এর অঙ্গাঙ্গী যোগ রয়েছে এবং শুধু যে রাজনীতির ক্ষেত্রে এর প্রভাব রয়েছে তা নয়, শিল্প সাহিত্য ধর্ম ও পুরাণের সঙ্গেও এটি নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট। আমার মনে হয়, হাজার হাজার বছর ধরে ভারতের জাতীয় জীবন গড়ে তুলতে হিমালয় যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, অন্য কোন দেশের পর্বত বা পর্বতমালা সেরকম করে নি।” (অনুবাদ লেখকের)। একবার যিনি হিমালয়ের সৌন্দর্যে অবগাহন করেছেন, শান্তির পরশ পেয়েছেন, সুযোগ পেলেই তিনি আবার এখানে ছুটে এসেছেন ক্লান্তি অপনয়নের আশায়। তীর্থক্ষেত্রের ত কথাই নেই। হিমালয়ের কোলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহু ধর্মস্থান। এসবের মাহাত্ম্যের কাহিনী পুরাণ ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বিধৃত রয়েছে। এই গিরিশ্রেণীর কন্দরে কন্দরে যুগে যুগে কত সাধক যে আধ্যাত্মিক অভীষ্ট সাধনে ব্রতী হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। হিমালয় প্রকৃত অর্থেই দেবভূমি।

স্মরণাতীত কাল থেকে অগণিত যাত্রী হিমালয়ের পথে পা বাড়িয়েছেন, এর কতটুকুই বা লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ যুগের কথা আলাদা। এখন তো শোনা যাচ্ছে কেদারনাথ ও বদরীনাথে হেলিকপ্টার নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে, পয়সা খরচ করলেই পুণ্যার্জন। এখন যারা ওপথে যাচ্ছেন বা ভবিষ্যতে যাবেন, আগেকার পথশ্রম ও পথের দুর্গমতা তারা কল্পনাও করতে পারবেন না। সে সময়ে যাত্রাকালে আত্মীয় স্বজনদের কাছে বিদায় নেবার সময় অনেকেই জানতেন না আর দেখা হবে কি না। যারা পথে নামতেন এরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই তারা যেতেন। এরকমই একটি কাহিনির বর্ণনা রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ মহেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বদরীনারায়ণের পথে’ বইটিতে, ‘লছমনঝোলা’ প্রসঙ্গে। প্রাসঙ্গিক অংশটি দেখে নেওয়া যেতে পারে – “তিনি [স্বামী বিবেকানন্দ] এই ঝোলা দিয়া পার হইতে গিয়া দড়ির একটিতে পা দিলেন এবং দুই হাতে দুইটি টানা দড়ি ধরিয়া পার হইতে লাগিলেন। নীচে প্রখর গঙ্গাস্রোত বহিতেছে। বাঁশবাজির দড়ির উপর যেমন মানুষ যায়, অনেকটা সেই প্রকার করিয়া অপর পারে পৌঁছাইলেন। কিছুক্ষণ পরে একটি মাড়োয়ারি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক সেইরূপে দড়িতে পা দিয়া ও দুই হাতে দড়ি ধরিয়া অপর পারে পৌঁছাইলেন। বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটি যেমনি অপরদিকের ভূমিতে পা দিয়াছেন অমনি একটি দড়ি ছিঁড়িয়া দুই ভাগ হইয়া পাড়ে সবেগে পড়িল। দড়িটি যদি সবেগে বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের গায়ে লাগিত, তাহা হইলে বৃদ্ধা মারা যাইতেন এবং যদি এক মিনিট পূর্বে ছিঁড়িত, তাহা হইলেও তিনি জলে পড়িয়া মারা যাইতেন। স্বামী বিবেকানন্দ উৎকণ্ঠিত হইয়া বৃদ্ধাকে বলিলেন, ‘এ মায়ি, আভি ত মর যাতি থী’। বৃদ্ধা গম্ভীরভাবে স্বামী বিবেকানন্দের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘মরনে ত আয়া বাবাজী, মরনেমে কেয়া ডর হ্যায়?’” এই লছমনঝোলার ভয়েই অনেকে কেদার বদরীর পথে পা বাড়াতেন না। আর এখন? জলধরের ভাষায় – “এখন দুবছরের ছেলেরা পর্যন্ত মনের আনন্দে খেলা করতে করতে ঝোলা পার হতে পারে।” এখন অনেক সহজে এসব স্থান দর্শন করে হয় ত ফিরে আসা যায় ঠিকই, কিন্তু বহুদিন ধরে দুর্গম পথে হেঁটে, সহযাত্রীদের সঙ্গে বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অজানা পথের নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে পরিশেষে দেবস্থান দর্শনের যে আনন্দ ও রোমাঞ্চকর অনুভূতি, তা থেকে যাত্রীরা চিরকালের জন্য বঞ্চিত হয়েছেন। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকেও পথ ছিল দুর্গম। ১৯৩২ সালেও প্রবোধকুমার সান্যাল পদব্রজে যাত্রা করেছিলেন বদরিনারায়ণের পথে।

হিমালয় ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে অনেকেই বিস্তারিত লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন স্যার আশুতোষের কনিষ্ঠ পুত্র উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, বিশ্বদেব বিশ্বাস, শঙ্কু মহারাজ প্রমুখ ভ্রমণকারীরা। উমাপ্রসাদের ‘হিমালয়ের পথে পথে’, ‘পঞ্চকেদার’, ‘মণিমহেশ’ প্রভৃতি গ্রন্থ লেখকের নৈর্ব্যক্তিক মনের পরিচয় দেয়। তার যেন কোন অভীষ্ট নেই, পথ চলার আনন্দেই তিনি চলেছেন। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় বর্ণনা যেন খুব সংক্ষিপ্ত, আরও তথ্য থাকলে ভাল হত। প্রবোধকুমার সান্যাল তার ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ও ‘দেবাতাত্মা হিমালয়’ লিখে বিখ্যাত হয়ে আছেন। প্রমোদকুমারের ‘হিমালয়ের মহাতীর্থে’, ‘হিমালয়ের পারে কৈলাস ও মানস সরোবর’ নিঃসন্দেহে তথ্যসমৃদ্ধ ও সুখপাঠ্য। এছাড়াও রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অখন্ডানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, স্বামী অপূর্বানন্দ এবং আরো অনেক সন্ন্যাসী সামান্য পাথেয় সম্বল করে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় দুর্গম পথে যাত্রার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। মহেন্দ্রনাথ দত্তের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। জলধর সেন তার ‘শতবর্ষ পূর্বে বদরিকাশ্রম’ প্রবন্ধে Asiatic Researches-এর একাদশ খণ্ডে Captain Webb প্রমুখ তিন জন ইংরেজের একশ বছর আগের বদরিনাথ ভ্রমণের কথা উল্লেখ করেছেন। সাল তারিখের কোন উল্লেখ না থাকলেও মনে হয় ভ্রমণকাল ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বা ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায়। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই কাহিনীতে যাত্রাপথ বা স্থানের বর্ণনা তেমন কিছু নেই, অধিকাংশই পুরোহিতদের অর্থলিপ্সা ও মন্দিরের সম্পত্তির কাহিনী।

এখানে আমি আর মাত্র তিনটি বইয়ের উল্লেখ করব। প্রথমটি হিমালয় পরিব্রাজক শরৎচন্দ্র দাসের (১৮৪৯-১৯১৭) লেখা। শরৎচন্দ্র দার্জিলিঙে শিক্ষকতা করতেন; তিব্বত ভ্রমণের বাসনায় তিনি তিব্বতী ভাষাই শিখে ফেলেন। দার্জিলিঙ থেকে যাত্রা করে পূর্ব নেপালের ইয়ালুঙ, ইয়াতামারি প্রভৃতি হিমবাহ পথে কাঞ্চনজঙ্ঘার উত্তরে অবস্থিত জংসংলা দিয়ে সিকিম পেরিয়ে তিব্বতে প্রবেশ করেন। জংসংলা-এর উচ্চতা ২০২০৭ ফুট। ফেরার পথে সিগাৎসে হয়ে উত্তর সিকিমের পথে দার্জিলিঙ ফিরেছিলেন। ১৮৮২ সালে হিমালয়ের পথেই লাসা গিয়েছিলেন তিনি। ১৮৯৯ সালে লন্ডন জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি থেকে তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বইটি ‘হিমারণ্য’ নাম দিয়ে লিখেছেন স্বামী রামানন্দ ভারতী। রামানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল রামকুমার ভট্টাচার্য, প্রখ্যাত লেখিকা লীলা মজুমদারের দাদামশায়। জন্ম ১৮৩৬ সালে ফরিদপুর জেলায়। প্রথম পত্নীর মৃত্যু হলে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তিনটি মেয়ে হয় – সুষমা, সুরমা ও রমা। তিন মেয়েকে ব্রাহ্মবন্ধুদের কাছে মানুষ করার দায়িত্ব দিয়ে ভারমুক্ত হয়ে তিনি হিমালয়ের পথে পা বাড়ান। আর সংসারে ফেরেন নি। মেজ মেয়ে সুরমাই ছিলেন লীলা মজুমদারের মা। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ২৭শে জ্যৈষ্ঠ রামানন্দ যোশিমঠ থেকে তিব্বতের পথে যাত্রা করেন। তার অসমাপ্ত ভ্রমণ কাহিনী অধুনা লুপ্ত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির ভূমিকা লিখেছেন উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সঙ্গে রয়েছে লীলা মজুমদারের লেখা রামানন্দের সংক্ষিপ্ত জীবনী। যারা পড়েন নি পড়ে নিতে পারেন। তৃতীয় পুস্তকটির নাম ‘দুইবার শ্রীকৈলাস দর্শন’, লেখক যতীন্দ্র মোহন গঙ্গোপাধ্যায়। এই বইটির উল্লেখ আমি কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। লেখক দু’বার কৈলাস মানস সরোবরে গিয়েছেন; একবার মা’কে সঙ্গে নিয়ে এবং দ্বিতীয়বার মা-এর মৃত্যুর পর। প্রথম ভ্রমণকাল ১৯৪১ সাল। যাত্রাপথ ও বিভিন্ন স্থানের বিবরণ বিশদ ভাবে না থাকলেও বইটি সুখপাঠ্য। ‘উত্তরাখন্ডের পথে’, ‘উত্তরাখন্ড পরিক্রমা’ বইগুলি তথ্যসমৃদ্ধ কিন্তু দুষ্প্রাপ্য। উল্লেখ করা যেতে পারে যে হিমালয় ভ্রমণের বহু বই বাজারে রয়েছে, এখনও এ ধরণের বই প্রকাশিত হচ্ছে। এখানে শুধুমাত্র কয়েকটি অপেক্ষাকৃত পুরানো দিনের বইয়ের কথাই বলা হল।

জলধর সেন

এবারে আসা যাক যাকে বাদ দিলে হিমালয় ভ্রমণ কাহিনী অসম্পূর্ণই থেকে যায় সেই জলধর সেনের কথায়। পুরনো দিনের একটি জনপ্রিয় পত্রিকা 'ভারতবর্ষ'-র সম্পাদক জলধরের জীবন নিয়ে অবসর-এ অন্যত্র আলোচনা করেছি। তার পুনরাবৃত্তি এখানে করছি না। পাঠকরা এইখানে ক্লিক করে সেটা পড়ে নিতে পারেন। স্বজন বিয়োগের শোকে কাতর হয়ে জলধর হিমালয়ের পথে পা বাড়িয়েছিলেন, মানসিক শান্তির খোঁজে। তিনি সেটা কতটা পেয়েছিলেন সেটা বিচার্য নয়, কিন্তু এই মানসিকতা নিয়ে বেরোবার জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা নির্লিপ্ততা ও আত্মনিবেদনের ছাপ পড়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আস্বাদন ও তার নিস্পৃহ বর্ণনভঙ্গীর জন্য হিমালয়ের কাহিনী অনেক আকর্ষণীয় হয়েছে। এ ছাড়া তার অতুলনীয় রচনা শৈলী তো রয়েইছে। জলধর সেনের হিমালয় ভ্রমণ সংক্রান্ত বইগুলি হল – ‘প্রবাসচিত্র’ (১৩০৬/১৯০০), ‘হিমালয়’ (১৩০৭/১৯০০), ‘পথিক’ (১৩০৮/১৯০১), ‘হিমাচল বক্ষে’ (১৩১১/১৯০৪)। ‘হিমাচল পথে’ নামে দার্জিলিং ভ্রমণের একটি কাহিনী তার ‘মুসাফির মঞ্জিল’ নামক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এছাড়া রয়েছে হিমালয় নিয়ে তার কয়েকটি ভ্রমণ কথা যেগুলি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে – ‘প্রবাসের সুখ’(‘প্রদীপ’ মাসিক পত্রিকা, ১৩০৪/১৩০৫ বৈশাখ ও শ্রাবণ সংখ্যা), ‘প্রবাসে এক রাত্রি’(‘প্রদীপ’, ১৩০৮ বৈশাখ সংখ্যা), ‘প্রবাসের কথা’(ঢাকা সম্মিলন ও রিভিউ, ১৩১৮ ভাদ্র সংখ্যা), ‘হিমালয়ের কথা’(চিত্র সহ) (‘ভারতবর্ষ, ১৩২৩ আশ্বিন)। ছোটদের জন্য প্রকাশিত হয়েছে ‘হিমাদ্রি’(১৩১৮/১৯২৫) এবং ‘বদ্রিকাশ্রমে নারায়ণ দর্শন’(‘ধ্রুব’ মাসিক পত্রিকা, ১৩১৯ অগ্রহায়ণ পৌষ সংখ্যা)।

জলধর সেনের লেখা হিমালয় ভ্রমণ কাহিনীর জন্য এখন আর পুরানো মাসিক পত্রিকা খুঁজে বেড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই। সুবিমল মিশ্র সম্পাদিত ‘হিমালয় ভ্রমণ-জলধর সেন’ গ্রন্থে সব রচনাই সন্নিবেশিত হয়েছে। যারা এখনই বইটি যোগাড় করতে পারবেন না, তাদের জন্য বিভিন্ন গ্রন্থে যে সব স্থানের ভ্রমণ কথা লেখা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল। ‘প্রবাসচিত্র’ গ্রন্থে রয়েছে – ‘প্রবাসযাত্রা’ (যাত্রাপথে একজন বিপদগ্রস্তা যুবতীকে সাহায্য করার কাহিনি), ‘গুরুদ্বার’ (দেরাদুনের গুরুদ্বারের কথা), ‘নালাপানি’ (দেরাদুনের অদূরে নালাপানি পাহাড় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা), ‘কুলংগার যুদ্ধ’ (ইংরেজদের সঙ্গে গোর্খাদের সংঘর্ষের কাহিনি), ‘টপকেশ্বর’ (দেরাদুনের সন্নিকটে টপকেশ্বর নামক তীর্থস্থানে মহাদেব দর্শন), ‘গুচ্ছপানি’ (দেরাদুন থেকে গুচ্ছপানি নামক ঝরণা দর্শনের কথা), ‘চন্দ্রভাগা তীরে’ (দেরাদুন থেকে পদব্রজে চন্দ্রভাগা নদীর পারে শিবমন্দির দর্শনের কাহিনী), ‘সহস্রধারা’ (এটি বদ্রীনাথের কাছে যে সহস্রধারা রয়েছে সেটি নয়; দেরাদুন থেকে দু’মাইল দূরে লছমনসিদ্ধি পাহাড় হয়ে সহস্রধারা জলপ্রপাত দর্শনের কথা), ‘মুসৌরি’ (দেরাদুনের কাছে মুসৌরি এখন একটি দর্শনীয় স্থান। দেরাদুন গিয়েছেন অথচ মুসৌরি যান নি, এদের সংখ্যা খুব কম), ‘তিহরি’(গঙ্গোত্রী যাত্রাপথে তিহরি একটি পরিচিত স্থান। স্থানের ইতিহাস সহ তিহরি ভ্রমণের কথা), ‘অতিপ্রাকৃত কথা’ (গাড়োয়ালের রাজধানী শ্রীনগর থেকে তিহরি হয়ে গঙ্গোত্রীর পথে এক সন্ন্যাসীর অলৌকিক ঘটনা), ‘উত্তর-কাশী’ (উত্তর কাশী ভ্রমণের কথা)। জলধর এক সময়ে দেরাদুনে ছিলেন বলে, দেরাদুনের আশেপাশের দর্শনীয় স্থান গুলির কথা প্রধানত: এই বইতে স্থান পেয়েছে। এগুলি সবই ‘সাহিত্য’, ‘ভারতী ও বালক’, ‘জন্মভূমি’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘টপকেশ্বর’ ও ‘গুচ্ছপানি’ প্রবন্ধ দুটিই জলধরের প্রথম প্রকাশিত ভ্রমণ কাহিনী, প্রকাশিত হয়েছিল সরলা দেবী সম্পাদিত ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকার ১২৯৯ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায়।

প্রকাশনার ক্রম অনুযায়ী এর পর আসে ‘হিমালয়’ নামে গ্রন্থটি। কিন্তু এটি সম্বন্ধে আলোচনা করার আগে অন্য বইগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে নেওয়া যাক। ‘পথিক’ বইটির প্রথমেই রয়েছে তিহরি ও উত্তরকাশী হয়ে গঙ্গোত্রী যাত্রা কাহিনী। শারীরিক সমস্যার জন্য অবশ্য গঙ্গোত্রী দর্শন হয়ে ওঠে নি সেবার। ধারাসু হয়ে মুসুরিতে প্রত্যাবর্তন করেছেন তিনি। এরপর ‘হৃষীকেশ’ নিবন্ধে হৃষীকেশের বর্ণনা, সঙ্গে রয়েছে অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলা এক মেয়েকে উদ্ধারের রোমাঞ্চকর কাহিনী। এখন যারা এখানে যাবেন তাদের দেখার সঙ্গে জলধরের বর্ণনা মিলবে না। প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক বলেছেন, “... সাধারণত যে সকল যাত্রী তীর্থ দর্শনোপলক্ষ্যে হরিদ্বার অবধি গমন করেন, তাহারা হৃষীকেশ পর্যন্ত যাইতে চাহেন না, কেননা পথ বড়ই দুর্গম।” এখন পিচের মসৃণ রাস্তা ধরে গাড়িতে হরিদ্বার থেকে হৃষীকেশ যাওয়ার সময় সেদিনের কথা মনে থাকে না। মহেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বদরিনারায়ণের পথে’ বইটিতেও হৃষীকেশের রাস্তার দুর্গমতার কথা সবিস্তারে লেখা আছে। এর পরে ‘পথিক’ বইটিতে রয়েছে ‘শতবর্ষ পূর্বে বদরিকাশ্রম’ প্রবন্ধ, যার কথা আগেই বলা হয়েছে। অন্য দু’টি প্রবন্ধ হল-‘ফয়জাবাদের সমাধিমন্দির’ ও ‘দার্জিলিঙয়ের পথে’। এগুলি ঠিক হিমালয় ভ্রমণ কাহিনী নয়। ‘হিমাচল বক্ষে’ বইতে রয়েছে – ‘শ্রীনগর’ (এটি কাশ্মীরে অবস্থিত নয়, গাড়োয়ালের রাজধানী)। এর পর ‘তিহরির পথে’ প্রবন্ধে রয়েছে ‘তিহরি’ ভ্রমণের কাহিনী এবং শেষে ‘হিমাচল পথে’ নাম দিয়ে দার্জিলিং ভ্রমণের কথা। এর পর কতগুলি ছোট ছোট প্রবন্ধের কথা। ‘প্রবাসের সুখ’-এ রয়েছে সাহারানপুর, মিরট হয়ে শিভালিক পর্বতে যাবার কাহিনী। ‘প্রবাসে একরাত্রি’তে হিমালয় প্রশস্তি সহ দেরাদুনের সন্নিকটে একটি স্থানে ভ্রমণ কথা; ‘প্রবাসের অভিজ্ঞতা’য় বলা হয়েছে দেরাদুন-সাহারানপুর ভ্রমণকালে এক ইংরেজ ভদ্রলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। পরিশেষে ‘হিমালয়ের কথা’; এটি চিত্র সহ স্মৃতি রোমন্থন এবং মূলত পূর্বে বর্ণিত ভ্রমণ কথারই পুনরাবৃত্তি। লেখকের এক বন্ধু হিমালয়ের অনেকগুলি ছবি তুলে এনেছিলেন। সেগুলি দেখে জলধর পুরানো দিনের কথায় ফিরে গিয়েছেন; যেমন – “হৃষীকেশের পরেই মনে হয় ‘লছমনঝোলার’ কথা। আমার এই স্থানটির কথা বিশেষ ভাবে মনে হয়,-কারণ এই স্থান হইতেই বহুবর্ষ পূর্বে-সেই সুদূর অতীতে-একদিন আমি বদরিনারায়ণ যাত্রা আরম্ভ করিয়াছিলাম। এই লছমনঝোলার অপর তীরে এক জঙ্গলের মধ্যে আমি রাত্রিবাস করিয়াছিলাম। এখন যে ছবি দেখিতেছি, লছমনঝোলার যে আলোকচিত্র আমার সম্মুখে রহিয়াছে, তাহা দেখিয়া বহুদিন পূর্বের কথাটাই স্মৃতিপথে উদিত হইতেছে ......”।

সবশেষে ‘হিমালয়’ গ্রন্থ প্রসঙ্গ। ‘হিমালয়’ জলধরের সবচেয়ে সাড়া জাগানো ও বিতর্কিত গ্রন্থ। বিতর্কিত কেন সে আলোচনায় পরে আসছি, তবে ভ্রমণ কাহিনী হিসাবে যে ‘হিমালয়’ শতকরা একশ’ ভাগ সফল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই লেখাগুলি ‘ভারতী’ পত্রিকায় ১৩০০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। তবে গ্রন্থাকারে বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশিত হবার পর কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। ‘হিমালয়ের’ প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩০৭ বঙ্গাব্দে, প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়, দাম ছিল পাঁচ সিকা। চতুর্দশ সংস্করণটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৮-এ। ১৯৮৮ সালে ‘কলেজ ষ্ট্রীট’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় গ্রন্থটি চিত্র সহ মুদ্রিত হয়েছিল। ১৯৯০ সালে বিশিষ্ট গবেষক বারিদ বরণ ঘোষের সম্পাদনায় ‘মিত্র ও ঘোষ’ থেকে এটি আবার প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি ২০০৮-এর এপ্রিলে ড: সুবিমল ঘোষের সম্পাদনায় ‘হিমালয়’ ও অন্যান্য রচনা অখণ্ড ভাবে বেরিয়েছে। পরিবেশক-দে বুক স্টোর/দে’জ পাবলিশিং। মূল্য আড়াইশো টাকা। এইখানে ক্লিক করলে বিনামূল্যে ই-বুক হিসেবে 'হিমালয়' ডাউনলোড করতে পারেন।

‘হিমালয়’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার পর বিভিন্ন পত্রিকা এবং বিদগ্ধ জনেরা তাদের সমালোচনায় কি মত প্রকাশ করেছিলেন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এরকম কয়েকটি সমালোচনায় একবার চোখ বুলিয়ে নেব। প্রথমেই বলে রাখি, ব্রজমোহন দাশ সম্পাদিত ‘জলধর কথা’য় প্রকাশিত মতামত আমি সুবিমল মিশ্র সম্পাদিত বই থেকে সংগ্রহ করেছি। এজন্য ঋণ স্বীকার করছি।

ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন –

“ ‘হিমালয়’ ও ‘প্রবাসচিত্র’-এই দুইখানি অপূর্ব গ্রন্থ ছেলেবেলায় যখন প্রথম পাঠ করি তখন একটা অনির্বচনীয় রসানন্দ মনপ্রাণকে ভরিয়ে দিয়েছিল। এই দুইখানা বইয়ে এক ঈপ্সিত অজানা জগতের আভাস যেন আনিয়া দিয়াছিল।”

সুসাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়ের বক্তব্য –

“তাঁর আগেও বাংলাভাষায় আরও অনেক ভ্রমণ কাহিনী বেরিয়েছে, কিন্তু ভ্রমণ কাহিনীর ভিতরে যে কতখানি মৌলিকতা, সরস লেখার কায়দা, তাজা আনন্দ ও আন্তরিকতা এবং উপন্যাসের উত্তেজনা থাকতে পারে, জলধরবাবুর রচনাগুলিই বাঙালীকে সর্বপ্রথম তা দেখিয়ে দিল।”

‘হিমালয়’ গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পরেই ‘ভারতী’ পত্রিকার ১৩০৮-এর বৈশাখ সংখ্যায় যে সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে, তার কিছু অংশ –

“...... দুর্ম্মদ নব্য বাঙ্গালীর উচ্চ অভিলাষ কিছু খাট করিয়া আনিতে হইবে, অপরিমিত লোভকে কিছু সংযত করিয়া আনিতে হইবে এবং আমাদের যাহা আছে তাহারই প্রতি ফিরিয়া তাকাইতে হইবে;-তীর্থতম, প্রাচীন, কঠিন, শুভ্র হিমাদ্রি। যে চাহ, তাহার জন্য এখনও ইহার শিখরে শিখরে বিপদ ও বৈচিত্র্য প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছে এবং তরঙ্গে তরঙ্গে শান্তি ও সুষমা। স্বদেশে গেরুয়া বসনে একখানা কম্বল ও কিছু তাম্রমুদ্রার সহায়ে স্বল্পায়োজন ভ্রমণও যে বিপদসঙ্কুলতায় ও চিত্তহারিতায় যুবাজন লোভন হইতে পারে, নব্যবঙ্গে ‘হিমালয়’ লেখক কয়েক বৎসর পূর্ব্বে সর্ব্বপ্রথম ‘ভারতীর’ পৃষ্ঠার ধারাবাহিক ক্রমে এ সত্য ঘোষণা করেন। সে কাহিনীগুলি তিনি এখানে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। এ বিষয়ে আর সকল বঙ্গীয় লেখকের অগ্রবর্ত্তিতায় লেখক অভিনন্দনযোগ্য এবং বঙ্গভাষায় এরূপ ভ্রমণ বৃত্তান্তের অভ্যুদয় বাঙালী মাত্রেরই আত্মাভিনন্দনের কারণ জ্ঞান করি।”

‘প্রদীপ’ পত্রিকার ১৩০৭-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ‘হিমালয়’ গ্রন্থের যে সমালোচনা করেছেন, তার সম্পূর্ণ অংশটি ‘অবসর’-এর ‘পুরানো পত্রিকা থেকে নির্বাচিত রচনা’ ধারাবাহিকে সংযোজিত হয়েছে। এর কিছুটা অংশ –

“ভাষার বিশেষত্ব আছে, তাহা পুস্তকের ভাষা নহে, অথচ আদ্যন্ত মাধুর্যে ও গাম্ভীর্যে সুসংবদ্ধ; ভাবে বিশেষত্ব আছে,-তাহা সাম্প্রদায়িক মতামতের ক্ষীণগণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নহে, অথচ সর্ব্বত্র সদভাবে সুসংবৃত, বিষয়বিন্যাসেও বিশেষত্ব আছে,-তাহা শুষ্ক কঠোর কঙ্কর বা পাষাণস্তূপের ন্যায় দুরধিগম্য নহে, অথচ নানা তত্ত্বকথায় সুসংযত। এরূপ সুলিখিত সুললিত ভ্রমণ কাহিনীর কে না সমুচিত সমাদর করিবে?”

এবার ‘হিমালয়’ গ্রন্থ থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃতি দিলে লেখকের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির হয়ত কিছুটা আভাস মিলবে। জলধর সংসারের আবর্ত থেকে শান্তির খোঁজে হিমালয়ের আশ্রয়ে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু তার কোমল হৃদয়ের মায়াময় আবেগ ও স্নেহপ্রবণতা পথের মধ্যেও তাকে বিচলিত করে। এরকম দুটি ঘটনা। প্রথমটি দেবপ্রয়াগের অভিজ্ঞতা –

“নদীর দিক হতে মুখ ফিরিয়ে পিছনে চাইতেই দেখি একটু দূরে দুটি মেয়ে,-বেশ সুন্দর দেখতে! অরচিত বেশ, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে এদিক ওদিক লতিয়ে পড়েছে, হাতে কতকগুলো সুন্দর লতাপাতা ও ফুল। তারা উপর থেকে নেমে আসছিল। আমাকে দেখে তারা একটু থমকে দাঁড়াল, দুজনে কি বলাবলি করলে, তারপর যেদিক থেকে এসেছিল সেপথে ফিরে যাবার জোগাড় করলে। আমি তাদের সঙ্গে কথা কইবার প্রলোভন কিছুতেই সংবরণ করতে পারলুম না। তাদের ডাকতেই ফিরে এলো। মেয়ে দুইটির মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত বড়, সে একটু বেশি লাজুক। সে সলজ্জভাবে পাশের একটি বড় পাথরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আজন্ম পার্বত্য প্রকৃতির মধ্যে হলেও তার লজ্জাশীলতা দেখলুম আমাদের বঙ্গবালিকাদের মতই প্রবল এবং সেই রকমই মধুর। ছোট মেয়েটি আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। আমি তাদের বাড়ি কোথা, কে আছে, কয় ভাই, কয় বোন প্রভৃতি প্রশ্নে আলাপ আরম্ভ করলুম। প্রথমে তাদের কথা কইতে একটু বাধবাধ ঠেকলো, কিন্তু শীঘ্রই সে সঙ্কোচভাব দূর হয়ে গেল। অনেকক্ষণ কথাবার্তা হল। সব কথা মনে নেই, কিন্তু একটা কথা আমাকে বড় বেজেছিল, তাই সেটা বেশ মনে আছে। আমি তাকে যখন বললুম যে, “আমার বাপ নেই, স্ত্রী নেই, ছেলেও নেই” তখন সে তার করুণ আয়ত চক্ষুদুটি আমার মুখের উপর রেখে কোমল স্বরে বলল “লেড়কি ভি নেহি?” কথাটা আমার প্রাণে তিরের মত বিদ্ধ হল! আমার একটি “লেড়কি” ছিল, জানিনে কোন অপরাধে তাকে তিন বৎসর হারিয়েছি। আজ এই বালিকার একটি কোমল প্রশ্নে সেই সুপ্ত স্মৃতি জেগে উঠলো। আমার চোখে জল দেখে বালিকার মুখখানি কেমন শুকিয়ে গেল। সে তার অপরিষ্কার ওড়না দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে, তার কোমল ছোট ছোট আঙুল দিয়ে আমার হাতের আঙুল নাড়তে লাগল। আর তার সেই স্নেহস্পর্শে, তার সেই অকপট সহানুভূতিতে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলুম। বালিকা আমাকে আর কোন কথা বলতে পারলে না। ...... সন্ধ্যা বেশ ঘন হয়ে এল। মেয়ে দুটি আগে আগে পথ দেখিয়ে চলতে লাগলো, আর ঘন ঘন “হুঁশিয়ারি” “খবরদারি” বলতে লাগলো, পাছে আমার পায়ে ঠক্কর লেগে আমার পায়ে ব্যথা হয়। আমাকে তারা রাস্তায় তুলে দিয়ে বিদায় নিলে। আমার বড় কষ্ট বোধ হল। হায়, আবার কখনো কি জীবনে তাদের সঙ্গে দেখা হবে? যদিই বা হয়, তা হলে আর কি তাদের সেই করুণারূপিণী সরলা বালিকা মূর্তিতে দেখবো-দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বাসার দিকে অগ্রসর হলুম।” দ্বিতীয় ঘটনাটি বিষ্ণুপ্রয়াগে – “আমরা ধীরে ধীরে গ্রাম্য পথে প্রবেশ করে দেখলুম, একটি গৃহস্থের মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে; বিবাহের পরে এই তার প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাত্রা। তখন আমোদে উৎসাহের মধ্যে দিয়ে শ্বশুরালয়ে দুই একদিন ছিল, আর আজ কতদিনের মত ঘরকন্না করতে যাচ্ছে। তাই তার মা, মাসি, বোন এবং নিতান্ত আপনজনের ন্যায় পাড়াপড়শিরা এসে রাস্তার ধারে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বিদায় দিচ্ছে। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার সবচেয়ে মধুর বোধ হলো। যে মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, তার কোলে একটি বছর দুইয়ের ছোট ছেলে; অনুমান করলুম সে তার ছোট ভাই। ভাইটি কিছুতেই তার শ্বশুরবাড়ি গমনোন্মুখ দিদির কোল ছাড়বে না। যতই সকলে তাকে সাগ্রহে ডাকছে, ততই সে তার দিদির ঘাড়টি দু’হাতে ধরে বারে বারে মুখ ফিরুচ্ছে, বুঝি সে কত কালের মত তার দিদির স্নেহময় ক্রোড় হতে নির্বাসিত হতে বসেছে, তা বুঝতে পেরেই শিশু তার আজন্মের স্নেহাধিকার ত্যাগ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে এবং অন্যান্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একটা আসন্ন বিপদের কল্পনা করে ডাগর চক্ষু মেলে চেয়ে রয়েছে। ...... আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখতে লাগলুম। এই পর্বতের উপরে পাহাড়ে মেয়ের বিদায় দৃশ্য; কিন্তু এই দৃশ্য আমাদের প্রীতিরসসিক্ত মাতৃভূমি, বহুদূরবর্তী বঙ্গের একটা মৃদুস্মৃতি মনের মধ্যে জাগিয়ে দিলে। সে যে বাংলা, আর এ যে পশ্চিমদেশ, তা আমি ভুলে গেলাম; শুধু মনে হলো সেখানেও যেমন মা ভাই, এখানেও তেমনি। দুই দেশের মধ্যে প্রভেদ বিস্তর, কিন্তু হৃদয় ও স্নেহের মধ্যে সর্বত্রই অমর সম্পর্ক সংস্থাপিত।”

চলার পথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লেখককে মুগ্ধ করেছে। বিশাল ব্যাপ্তি ও অনুপম দৃশ্যপট তাকে সৃষ্টিকর্তার মহত্বকে মনে করিয়েছে। যোশীমঠের রাস্তায় –

“বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে দেখলুম, আমরা এক সুবিশাল বরফের পাহাড়ের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছি, তার চারিটি সুদীর্ঘ শৃঙ্গ আগাগোড়া বরফে আচ্ছন্ন। তখন সূর্য আকাশের অনেক উচ্চে উঠেছে, তার উজ্জ্বল কিরণ এসে তার সেই সমুন্নত শুভ্র পর্বতশৃঙ্গগুলির উপর পড়েছে, প্রাতঃসূর্যকিরণ সেই তুষার-ধবল আর্দ্র পর্বতশৃঙ্গে হিল্লোলিত হওয়াতে বিভিন্ন বর্ণের সমাবেশে প্রতিক্ষণে কি যে অপূর্ব সৌন্দর্য প্রতিফলিত হচ্ছিল, বর্ণনা করে তা বুঝিয়ে দেওয়া যায় না, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম চিত্রকরের তুলিতে সেই অপূর্ব দৃশ্যের অতি সামান্য প্রতিকৃতিও অঙ্কিত হতে পারে না। মানুষের দু’খানি হাত আশ্চর্য কাজ করতে পারে, প্রকৃতিকে লজ্জা দেবার চেষ্টাতেই বুঝি মানুষের ক্ষুদ্র দু’খানি হাতে আগ্রার জগদবিখ্যাত সৌধ নির্মিত হয়ে পথিকের নয়ন মুগ্ধ করেছে। তাজমহল আমি অনেকবার দেখেছি,-সে সৌন্দর্য, সে ভাস্কর নৈপুণ্য নিষ্কলঙ্ক শুভ্র মার্বেল প্রস্তরের সেই বিচিত্র হর্ম্য প্রকৃতির স্বহস্তের কোন রচনা অপেক্ষা হীন বলে বোধ হয় না, কিন্তু আজ আমার সম্মুখে সহসা যে দৃশ্য উন্মুক্ত হয়েছে, এ অলৌকিক! মানুষের ক্ষমতা ও ক্ষমতার গর্ব এই বিরাট বিশাল নগ্ন সৌন্দর্যের পাদদেশে এসে স্তম্ভিত হয়ে যায়; প্রতি মুহূর্তে নূতন বর্ণে সুরঞ্জিত অভ্রভেদী শৃঙ্গের দিকে তাকালে আমাদের ক্ষুদ্রতা ও দুর্বলতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি; সৃষ্টি দেখে আমরা স্রষ্টার মহান ভাব কতক পরিমাণে হৃদয়ে ধারণা করবার অবসর পাই।”

পথের দুর্গমতা ও শারীরিক ক্লেশ সত্বেও যাত্রাপথে লেখকের রসবোধ ও কৌতুক প্রবণতা হারিয়ে যায় নি। শ্রীনগরের কাছে কমলেশ্বর দর্শন সম্বন্ধে –

“...... আরতি শেষ হলে মহান্ত ভিতরে প্রবেশ করলেন। পন্ডিতজি বললেন, মহান্ত এখন বৈঠকখানায় যাবেন-সেখানে আমাদের যাওয়ার কোন আপত্তি নেই; সুতরাং আমরাও তার বৈঠকখানায় উপস্থিত হলুম ... অন্দরে অবশ্য পরিবারাদি কেউ নাই; সেখানে তার শয়নকক্ষ, বিশ্রামকক্ষ ইত্যাদি আছে। অন্যান্য মহান্তের ন্যায় কমলেশ্বরের মহান্তেরাও চিরকুমার থাকেন, মৃত্যুকালে চেলাদের মধ্যে কাকেও উত্তরাধিকারী করে যান। বর্তমানে মহান্তের বয়স পয়ঁত্রিশ ও চল্লিশের মধ্যে বলে বোধ হলো, দেখতে বেশ হৃষ্টপুষ্ট। কোন মঠের মহান্তকেই ত এ পর্যন্ত কাহিল দেখলাম না। মহাদেবের সেবাইত ও ষন্ড উভয়েই চিরকাল দিব্য সুগোল-দেহ।”

অন্যত্র –

“...... পন্ডিতজি অপরাহ্নে এমন এক সিধে পাঠিয়েছিলেন যে, তাতে আমাদের পাঁচ দিন বেশ সমারোহ করে চলতে পারে। এর উপরে আবার আমাদের পরিচিত বন্ধুবান্ধবগণ দেখা করতে এসে যথেষ্ট মিষ্টান্ন উপহার দিয়ে গিয়েছেন। আমার সঙ্গী বৈদান্তিক ভায়া পৃথিবীটা মায়াময় বলে নস্যাৎ করতে সম্পূর্ণ রাজি, কিন্তু প্রত্যক্ষ বিদ্যমান মিষ্টান্ন মায়াময় বলে ত্যাগ করতে কিছুতেই রাজি হন নি। বৈদান্তিকের দন্তের ক্রিয়া দেখে আমিও অবাক! আমার ভয় হয়েছিল সন্দেশগুলো বৈদান্তিকের যথেষ্ট মুখরোচক হলেও তাঁর পাকযন্ত্র সেগুলো হয়ত খুব সমাদরে গ্রহণ করবে না।”

সংসারের বঞ্চনা থেকে মুক্ত হতে শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে হিমালয়ের বিবিক্ত প্রদেশে শান্তিলাভের আশায় তার যে কৃচ্ছসাধন, সেটা কতটা সফল হয়েছিল, কতটা তিনি শান্তির স্পর্শ পেয়েছিলেন, জলধরের লেখায় তার কোন উল্লেখ আছে কিনা এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। না, তা তিনি পান নি, পাবার কথাও নয়, সাময়িক স্বস্তি লাভের বাসনাতেই তিনি বেরিয়েছিলেন; তিনি সাধক নন। লেখকের নিজের ভাষায় –

“বাঙালির ছেলে ক্রমাগত এই রকম লোটা কম্বল ঘাড়ে করে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে আর কিছুতেই ভাল লাগছে না। সুখ চেয়ে স্বস্তি ভাল-অতএব এখন মনে করছি একবার বাড়ি ফিরে যাব; এই সন্ন্যাস বা তার চেয়েও অতিরিক্ত কিছু আমার আর পুষিয়ে উঠছে না ভাবছি-...... যারা আমার এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত একটু ঔৎসুক্যের সঙ্গে পড়েছিলেন, এবং প্রতি মুহূর্তে আমাকে একটা দিগগজ সাধুরূপে পরিণত হওয়া দেখবার আশায় ধৈর্যাবলম্বন করেছিলেন, তাঁরা হয়ত এতদিন পরে আমার এই লোটা কম্বল ও বক্তৃতার মধ্যে থেকে আমার স্বরূপ নিরীক্ষণ করে ভারি নিরুৎসাহ হয়ে পড়বেন, কারো কারো মুখ দিয়ে দু’চারিটি কটুবাক্যও বের হতে পারে। আমার তাতে আপত্তি নাই, এ ছদ্মবেশের চেয়ে সে বরং ভাল।”

সঙ্গীত ছিল জলধরের অত্যন্ত প্রিয়। এক সময়ে তিনি হরিনাথ মজুমদারের ফিকিরচাঁদের দলেও ছিলেন। ‘হিমালয়’ গ্রন্থটিতেও তিনি রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত ও ফিকিরচাঁদের গান ব্যবহার করেছেন। মাঝে মাঝে তিনি স্থানীয় ইতিহাস তুলে ধরেছেন, স্থান মাহাত্ম্য আলোচনা করেছেন। এতে তার কাহিনী আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

হিমালয়ের ভ্রমণ শেষে লেখক ফিরে এসেছেন, সংসারে প্রবেশ করেছেন। স্ত্রী পুত্র হয়েছে। তাহলে কি হিমালয় তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে? তা কিন্তু নয়। তার ‘হিমালয়ের কথা’য় তিনি লিখেছেন –

“এতকাল চলিয়া গিয়াছে-যুগের পর যুগ অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে-আমি আর এক মানুষ হইয়াছি; তবু হিমালয়ের কথা আমি এখনও ভুলিতে পারি নাই। যেদিন আমার ইহ জগতের সমস্ত খেলা শেষ হইবে-যেদিন এই কলঙ্কিত, অভিশপ্ত জীবনের অবসান হইবে – সেদিন – সেই শেষের দিনে অন্তিম শয়নেও আমি বুঝি ভগবানের নাম করিতে পারিব না,-সেদিন হিমালয়ের কথাই আমার মনে হইবে। ... এত যে অধঃপতন হইয়াছে-এমন যে স্বার্থের কামনার দাস হইয়াছি-এত যে ক্ষতিলাভগণনাপরায়ণ হইয়াছি-এত যে গ্লানি নিন্দা-অসহিষ্ণু হইয়াছি-এত পতিত অবস্থাতেও যখন হিমালয়ের কথা মনে করি, তখন সেই সময় টুকুর জন্য আমি অন্য মানুষ হইয়া যাই। তাহার পর, যেই সে দৃশ্য আমার নয়ন-সম্মুখ হইতে অন্তর্হিত হইয়া যায়, অমনি চারিদিক হইতে সংসার, কামনা, বাসনা, অতৃপ্তি আসিয়া আমাকে ঘিরিয়া ধরে। তাই আমি যখন-তখন জোর করিয়া হিলামলের কথা চিন্তা করিতে বসি।”

লেখকের এই হিমালয় প্রীতিই তার ভ্রমণ কাহিনীকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে, একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। তার কাহিনীর বর্ণনায় আদ্যন্ত এই মানসিকতাই সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে। শুধুমাত্র অস্থিরচিত্ত প্রশমিত করতে কয়েকদিন ভ্রমণের কথা তার কাহিনীকে এমন মাধুর্যমন্ডিত করত না। বঙ্কিমাগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্রের বিখ্যাত ‘পালামৌ’ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তার ‘আধুনিক সাহিত্যে’ বলেছেন

–“সঞ্জীব বালকের ন্যায় সকল জিনিস কৌতূহলের সহিত দেখিতেন এবং প্রবীণ চিত্রকরের ন্যায় তাহার প্রধান অংশগুলি নির্বাচন করিয়া লইয়া তাঁহার চিত্রকে পরিস্ফুট করিয়া তুলিতেন এবং ভাবুকের ন্যায় সকলের মধ্যেই তাঁহার নিজের একটি হৃদয়াংশ যোগ করিয়া দিতেন।”

জলধরের ‘হিমালয়’-এর প্রসঙ্গেও মনে হয় একই বীক্ষণ প্রযোজ্য।

জলধর প্রসঙ্গে ইতি টানার আগে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয়। একটি হ'ল স্বামী বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ। হিমালয় ভ্রমণ কালে সামীজীর একবার 'প্রাণ সংশয়' উপস্থিত হয়। মৃত্যুর সব লক্ষণ প্রায় উপস্থিত। সে সময়ে জলধর ঘটনাচক্রে সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি একটি বনজ ওষধি প্রয়োগ করে স্বামীজীকে 'বাঁচিয়ে তোলেন'। জলধর লিখেছেন -

" ... পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে বর্ণিত ব্যাপার দিবালোকের ন্যায় সম্পূর্ণ সত্য। উহার মধ্যে কোথাও বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জন নাই। তবে খুঁটিনাটির ভুল থাকতে পারে বটে, কারণ অনেকদিনের কথা।"

ঘটনাটির সত্যতা সম্বন্ধে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে ‘পরিব্রাজক স্বামীজী : দেশে ও বিদেশে’ বইটিতে একটি ঘটনার কথা উল্লেখে করা হয়েছে, সেটি হল –

“হৃষীকেশে কিছুদিন থাকার পর স্বামীজী ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলেন। জ্বর-বিকার একদিন এত প্রবল হল যে, স্বামীজীর নাড়ী ছেড়ে গেল, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেন শেষ সময় উপস্থিত। গুরুভাইয়েরা একমনে ভগবানকে ডাকছেন। কাছাকাছি কোন চিকিৎসক নেই যাকে ডাকা যায়, বা যার কাছে রোগীকে নিয়ে যাওয়া যায়। এমন সময় দৈবনির্দেশেই কোথা থেকে এক সাধু এলেন সেই কুঠিয়ায়। তিনি এসে একটু মধু ও পিপুল-চূর্ণ একসঙ্গে মিশিয়ে স্বামীজীকে খাইয়ে দিলেন। অমনি আশ্চর্য ফল হল; কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বামীজী চোখ মেলে তাকালেন”।

যে সাধুটির কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে ইনিই জলধর সেন কিনা সেটা জানা যায় নি। অবশ্য একাধিক বার জলধরের সঙ্গে স্বামীজীর দেখা হয়েছে। জলধর তার ‘হিমালয়ের কথা’য় সশ্রদ্ধ ভাবে স্বামী বিবেকানন্দের কথা উল্লেখ করেছেন। তখনও তিনি ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ হয়ে ওঠেন নি, বিদেশেও যান নি। জলধর লিখেছেন –

“তাঁহাকে আমি একবার হিমালয়ের মধ্যে পাইয়াছিলাম। ...... বিবেকানন্দ একদিন পাহাড়ের মধ্যে আমাকে বলিয়াছিলেন, “ভাই যখন বাহির হইবে, তখন নিঃসম্বল অবস্থায় বাহির হইও; এই আমার পরামর্শ, এই আমার উপদেশ।” আমি তার পর যখন যেখানে গিয়াছি, একটি পয়সাও সঙ্গে লইয়া যাই নাই। কিন্তু বলিতে শরীর পুলকিত হইয়া উঠে যে, সে সময়ে কোনদিন আমি ক্ষুধায় কষ্ট পাই নাই; বিশ্বজননী যথাসময়ে আমার ক্ষুধার অন্ন, পিপাসার জল জোগাইয়া দিয়াছেন। আর যেবার টাকা লইয়া বাহির হইয়াছিলাম, ...... সেবার কতদিন অনাহারে গিয়াছে।”

দ্বিতীয় ঘটনাটি গুরুতর। জলধর সেন রচিত বহু লেখার আসল 'রচয়িতা' না কি দীনেন্দ্রকুমার রায়। দীনেন্দ্রকুমারের সে রকমই দাবী। অন্যের লেখা জলধর নিজের নামে ছাপিয়েছেন কোন রকম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়াই। মারাত্মক অভিযোগ। 'অবসরে'র পাতায় ইতিপূর্বেই বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এখানে কিছু নির্দিষ্ট তথ্য শুধু তুলে ধরা হবে। দীনেন্দ্রকুমারের বক্তব্য হল, জলধরবাবু তার হিমালয় ভ্রমণ কালে যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন, সেটাকে পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে দীনেন্দ্রকুমার সেটা প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন জলধরকে সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত করার মহৎ‌ সঙ্কল্প নিয়ে, অথচ জলধর তাকে সে স্বীকৃতি দেন নি।

'সেকালের স্মৃতি'তে দীনেন্দ্রকুমার লিখেছেন -

"কিছুদিন পরে জলধরবাবুর দপ্তর ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে এক অপূর্ব্ব দ্রব্য আবিষ্কার করিলাম। একখানি বাঁধানো খাতা,-তাহার এক দিকে ফিকিরচাঁদ ফকিরের কয়েকখণ্ড গীতাবলী , -'কুমারখালী মথুরানাথ যন্ত্র' হইতে প্রকাশিত; অন্য দিকে তাঁহার স্বলিখিত ভ্রমণ-বৃত্তান্ত, -জলধরবাবুর হিমালয় ভ্রমণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ; পেন্সিলে লেখা - মোটা মোটা অক্ষর। .... সেই ভ্রমণ-কাহিনী আগাগোড়া পাঠ করিয়া বুঝিতে পারিলাম, জলধরবাবু হিমালয়-পর্য্যটন উপলক্ষ্যে যথন যেখানে গিয়াছেন, সেই স্থানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছেন, কতকটা ডায়েরীর ধাঁচে লেখা। বর্ণনার পারিপাট্য বা কৌশল আদৌ কোথাও ছিল না। তথাপি তাঁহার সেই ভ্রমণ-কাহিনীতে নূতনত্ব থাকায় আমার বড়ই ভাল লাগিল; কিন্তু তাহা এতই সংক্ষিপ্ত ও বাঁধুনি-বর্জ্জিত যে পাঠ করিয়া হৃদয় পরিতৃপ্ত হয় না, আগ্রহও মেটে না। একদিন ভয়ে ভয়ে বলিলাম, 'মাষ্টার মহাশয়, আপনার এই ভ্রমণ-বৃত্তান্ত কোনও মাসিকে প্রকাশ করিলে হয় না?' - মাষ্টার মহাশয় চুরুটের ধোঁয়ার সঙ্গে আমার কথা হাসিয়াই উড়াইয়া দিলেন; বলিলেন-'ও কি ভ্রমণ-বৃত্তান্ত ? অশান্ত হৃদয় লইয়া যেদিকে দুই চোখ গিয়াছে, সেই দিকে গিয়াছি, যা চোখের সম্মুখে পড়িয়াছে, তাই, যেমন খেয়াল হইয়াছে, সেই ভাবে লিখিয়া রাখিয়াছি। কখনও দেশে ফিরিব, উহা ছাপার হরফে প্রকাশ করিব - এরূপ আকাঙ্ক্ষা কোন দিন ছিল না, সে ভাবে লিখিও নাই। কেন উহা সাধারণে প্রকাশ করিয়া আমাকে সাহিত্য-সমাজে হাস্যাস্পদ করিবেন ?"

"আমার জিদ বাড়িয়া গেল; আমি বলিলাম, উহা ভারতীতে প্রকাশ করিব। - তিনি আমার কথা বিশ্বাস করিলেন না। আমিও বুঝিয়াছিলাম ভ্রমাণ-কাহিনীটি যে ভাবে লিখিত হইয়াছিল, তাহা অবিকল নকল করিয়া পাঠাইলে কোন মাসিক-সম্পাদকই সে লেখা পত্রস্থ করিবেন না। আমি বলিলাম, 'নলচে ও খোল' বদলাইয়া উহা কথ্য ভাষায় লিখিয়া একটা কিস্তী শ্রীমতী সরলাদেবীকে পাঠাই - দেখি, তিনি কি বলেন। .... আমি কাপি প্রস্তুত করিয়া জলধরবাবুকে দেখিতে দিলাম, তিনি তাহা না দেখিয়াই ফেরত দিয়া বলিলেন, 'কি ছেলেখেলা আরম্ভ করিলেন ? হিমালয় কখনও দেখেন নাই, আমার তিন পৃষ্ঠার লেখাটুকু ফেনাইয়া-ফুলাইয়া ষোলো পৃষ্ঠা করিলেন; আপনি আশা করিতেছেন, উহা ভারতীতে প্রকাশিত হইবে ?' - কিন্তু আমার আশা অপূর্ণ রহিল না; সরলা দেবী আমার হাতের লেখা কাপি পাইয়া অজ্ঞাত লেখক জলধরবাবুর অস্তিত্ত্বে একটু সন্দিহান হইলেন বটে, কিন্তু আমাকে তিনি বিশ্বাস করিতেন। তিনি সেই কাপিতে আমার ভাষার প্রকাশভঙ্গি বিশেষত্ব পরিস্ফুট দেখিলেন; তথাপি আমার কথায় নির্ভর করিয়া জলধরবাবুর নাম দিয়াই তাহা ছাপিতে আরম্ভ করিলেন। শ্রীযুক্ত সরলা দেবীর এ সকল কথা এখনও স্মরণ থাকিতে পারে। হয় ত এতদিন পরে আমার এই কবুল জবাব পাঠ করিয়া তিনিও মনে মনে হাসিবেন।"

এই বিতর্ক সে সময়ে সাহিত্য-জগতে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে কবি নরেন্দ্র দেব সরলা দেবীকে একটি চিঠি লিখে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় গবেষক বারিদবরণ ঘোষ এই বিতর্ক নিয়ে একটি তথ্যপূর্ণ নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি এই চিঠির উল্লেখ করেছেন। ১৯৩৩-এর ১২ই নভেম্বরে লেখা উত্তরে সরলাদেবী জানিয়েছেন, "..... দীনেন্দ্র রায় তাঁর বন্ধু জলধর সেনের কুমারী লেখা (maiden) আমাকে দেন। বলেন , তাঁর বন্ধু অতি লাজুক, তিনি অনেক কষ্টে ডায়েরী থেকে এটি উদ্ধার করেছেন। তাঁর বন্ধুর ভরসা নেই যে আমি জিনিসটা পছন্দ করে ভারতীতে স্থান দেব। এর পর দীনেন্দ্রকুমার জিজ্ঞাসা করেন, আমি কি মনে করি এর ভিতর কিছু পদার্থ আছে ? - পদার্থ ? আমি দেখিলাম এটি একটি অনুদ্ধার খনি হইতে লব্ধ একখানি মণি .... ।" এর পর সরলা দেবী জানিয়েছেন -"কলম্বাস যেমন আমেরিকা আবিষ্কার করিয়াছিলেন, দীনেন্দ্র রায় তেমনি জলধরকে আবিষ্কার করিয়াছিলেন, একথা সত্যি। বেশী আর কিছু নয়।” সরলা দেবীর এই চিঠিতে কি দীনেন্দ্রকুমারের বক্তব্যের কোন সমর্থন মেলে?”

এবার 'হিমালয়' সম্বন্ধে জলধরের নিজের বক্তব্য শোনা যাক। ১৩২৩-এর 'ভারতী'র বৈশাখ সংখ্যায় ('ভারতী'র ৪০ বছর পদার্পণ উপলক্ষ্যে 'ভারতী-স্মৃতি' রচনায়) লিখেছেন -

"দীনেন্দ্রবাবু আমাকে ধরিয়া বসিলেন যে, আমার হিমালয়-ভ্রমণ কথা ভারতীতে লিখিতে হইবে। আমি ত কথাটা প্রথমে হাসিয়া উড়াইয়া দিলাম। ... কিন্তু দীনেন্দ্রবাবু কিছুতেই ছাড়িলেন না, জোর করিয়া হিমালয়-ভ্রমণের প্রস্তাব লিখিয়া লইলেন এবং নিজেই বিশেষ উদ্যোগ লইয়া 'ভারতী' পত্রে প্রেরণ করিলেন। ... আমি কিন্তু সনির্বন্ধ অনুরোধ করিয়াছিলাম যে, আমার নামটা যেন ছাপা না হয়; ... কিন্তু সম্পাদক মহাশয়া বোধ হয় রহস্য দেখিবার জন্যই আমার আকার-ইকার-উকার-বর্জ্জিত নামটা প্রবন্ধের শেষে ছাপিয়া দিলেন এবং আমাকে আরও লিখিবার জন্য উত্‍‌সাহ প্রদান করিলেন।... সম্পাদিকা মহাশয়া আমাকে জানাইলেন যে, আমার হিমালয়-ভ্রমণ পাঠকদের ভাল লাগিয়াছে এ সংবাদ তিনি পাইয়াছেন ... সে যাহাই হউক আমি 'ভারতী'তে লিখিতে লাগিলাম।

আর একবার দীনেন্দ্রকুমারের 'সেকালের স্মৃতি'তে ফিরে আসা যাক। তিনি লিখেছেন -

"এক দিন সাহিত্য-সম্পাদক বন্ধুবর সুরেশবাবু (সুরেশ্চন্দ্র সমাজপতি) বলিলেন, "জলধরবাবুর হিমালয় ত লিখিয়া দিলেন, আপনার নাম কেহ জানিল না; আপনি কি পরিশ্রম করিলেন, তাহা কেহ বুঝিল না; কিন্তু আপনার রচনা-ভঙ্গী লেখার বিশেষত্ত্ব, এবং ভাবপ্রকাশের মধ্যে আপনার যে individuality জাজ্জ্বল্যমান হইয়া উঠিয়াছে, জলধরবাবু কি করিয়া তাহা নিজস্ব বলিয়া সপ্রমাণ করিবেন ?"

অন্যত্র দীনেন্দ্রকুমার লিখেছেন -

"চন্দননগরের সুবিখ্যাত সাহিত্যসেবক শ্রদ্ধাভাজন শ্রীযুক্ত হরিহর শেঠকে এক দিন এইরূপ বিস্ময় প্রকাশ করিতে দেখিয়াছি। এক জনের কণ্ঠ হইতে অন্যের বেসুরো কণ্ঠস্বর নিঃস্বারিত হইলে বিস্মিত হইবারই কথা বটে।"

১৩০০ ও ১৩০১ বঙ্গাব্দের বেশ কয়েকটি সংখ্যায় 'হিমালয়' ধারাবাহিকভাবে 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৩০৭ বঙ্গাব্দে (১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ); বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন জলধরের বনিষ্ঠ বন্ধু দীনেন্দ্রকুমার রায়। তার লিখিত ভূমিকার কিছুটা অংশ দেখে নেওয়া যাক। তিনি লিখেছেন -

"সৌভাগ্যক্রমে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন বন্ধু বাবু জলধর সেন মহাশয় একবার সংসার সাগরের ঘূর্ণাবর্ত্ত ভেদ করিয়া তাঁহার সংসার-বাসনা-বর্জিত কর্মহীন জীবন মৃত্যুর মহিমাময় তটে নিক্ষিপ্ত করেন, সংসারের সুখের প্রলোভন ছাড়িয়া শান্তির আশায় তিনি হিমালয়ের বিজন বক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাহা কতদূর পূর্ণ হইয়াছিল, সে সংবাদ আমরা রাখিনা, কিন্তু তাঁহার সুদীর্ঘ বিরহী জীবন আমাদের বঙ্গভাষার দীনভাণ্ডারে যে মহার্ঘ্য রত্ন দান করিয়াছে তাহা চিরদিন বঙ্গসাহিত্য সমালঙ্কৃত করিয়া রাখিবে বলিয়া আশা হয়। বিধাতা তাঁহার হৃদয়ের প্রিয়তম সামগ্রী হরণ করিয়া তাঁহার হৃদয়ের যে তন্ত্রীতে আঘাত করিয়াছিলেন, তাহার করুণ ঝংকার প্রত্যেক বঙ্গীয় পাঠকের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হইবে। বঙ্গভাষার সৌভাগ্য তিনি হৃদয়ের গভীর আঘাত পাইয়া হিমালযের অমর কাহিনী বঙ্গভাষায় ব্যক্ত করিয়াছেন; এ আঘাতে তাঁহার যতই ক্ষতি হউক, বঙ্গভাষার মহোপকার হইয়াছে; পাঠকগণও একটি বিস্ময়পূর্ণ, অদৃষ্টপূর্ব্ব, অসাধারণ দৃশ্য পরম্পরার সহিত পরিচিত হইয়াছেন। - ইংরাজীতে একটা প্রবাদ আছে, নাইটিঙ্গেল পক্ষী কণ্টকের উপর বক্ষ স্থাপন না করিয়া কখনও গান গাহিতে পারে না। কবিবর শেলীও বলিয়াছেন 'Our sweetest songs are those that tell of saddest thought' - তাই বুঝি জলধরবাবুর ভ্রমণকাহিনী এত সুমধুর।"

সম্পূর্ণ ভূমিকাটি দীর্ঘ বলে দেওয়া গেল না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশটিই উদ্ধৃত হয়েছে। এটা পড়ে কি কখনও সামান্যতম মনে হয়েছে দীনেন্দ্রকুমার জলধরের 'হিমালয়' গ্রন্থটি নিজে লিখেছেন। সেটাই যদি হবে তবে তিনি এই ভূমিকা লিখলেন কেন ?

'ভারতী' পত্রিকায় 'হিমালয়' ক্রমিক ভাবে প্রকাশিত হবার আগেই জলধরের ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। তার রচিত 'টপকেশ্বর ও গুচ্ছপানি' প্রকাশিত হয় ১২৯৯-এর 'ভারতী ও বালক' পত্রিকার মাঘ সংখ্যায়। ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয় যথাক্রমে 'সহস্রধারা' ও 'হৃষিকেশ'। যে সুরেশচন্দ্র না কি ‘হিমালয়ে'র প্রকৃত রচয়িতা বিষয়ে দীনেন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তারই সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকার ১৩০১ এববং ১৩০২-এর বিভিন্ন সংখ্যায় ‘প্রবাস চিত্রে’র অধিকাংশ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দীনেন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন -"কেবল হিমালয়েই শেষ নহে; তাঁহার রচিত 'প্রবাস-চিত্র' নামক ভ্রমণ-বৃত্তান্ত খানির বিবিধ প্রবন্ধ সাধু ভাষায় লিখিত হইয়াছিল; হিমালয়ের পর সেই ভারও আমাকেই গ্রহণ করিতে হইয়াছিল।" 'প্রবাস চিত্র' যে জলধর রচনা করেন নি এ তথ্য যদি সুরেশবাবু জানতেন, তবে তিনি জলধরের নাম দিয়ে তার পত্রিকায় সেটা প্রকাশ করলেন কেন? শুধু তাই নয়। শ্রদ্ধেয় বারিদবরণ ঘোষ জানিয়েছেন -"'প্রবাস চিত্র' বইটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স। এটা কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য নয়। কিন্তু তাঁদেরকে ছাপার জন্য কে বা কারা অনুরোধ করেন শুনলে দীনেন্দ্রকুমার 'হতচকিত' হবেন। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ও তাঁর ভাই যতীশচন্দ্রের আগ্রহেই এটি তাঁরা ছাপেন। শুধু তাই নয় - তাঁরা এই রকমের সব বই ছাপতে আগ্রহী হন এবং তাতেই 'হিমালয়' গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়।"

পরিশেষে একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার উল্লেখ করে এই প্রসঙ্গ শেষ করব। 'হিমালয়' গ্রন্থের রচনার ভঙ্গী সম্বন্ধে জলধর 'ভারতী'-র ১৩২৩-এর বৈশাখ সংখ্যায় ('ভারতী-স্মৃতি') লিখেছেন -

"আমি যখন 'ভারতী'তে হিমালয়-ভ্রমণ লিখিতে আরম্ভ করি, তাহার কিছুদিন পূর্ব্বে পূজনীয় রবীন্দ্রনাথ তাঁহার 'ইউরোপযাত্রীর পত্র' প্রকাশিত করিয়াছিলেন। আমি হিমালয় লিখিবার সময় তাঁহারই অতুলনীয় লিখন-পদ্ধতি (style) অনুসরণের চেষ্টা করিয়াছিলাম।"

এ বার দীনেন্দ্রকুমার তার 'সেকালের স্মৃতি'তে কি লিখেছেন দেখা যাক -

"জলধরবাবু 'হিমালয়ে'র রচনাসংক্রান্ত সকল ভার আমার আগ্রহেই আমার হাতে ছাড়িয়া দেওয়ায় উহার ভাষার নির্ব্বাচন সম্বন্ধে তাঁহার অভিমত জিজ্ঞাসা করি নাই। তাঁহার চোখের জলে, কি আমার বুকের রক্তে এই সৌধের গাঁথুনী হইবে - এ বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে আমি কবিবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের 'য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র' পাঠ করিতেছিলাম, আমি সেই পুস্তকের ভাষার এবং তাঁহার রচিত কবিতাগুলির প্রতি আকৃষ্ট হইয়া, যৌবনসুলভ উত্‍‌সাহে 'হিমালয়ে' কবিবরের 'পত্রের'র ভাষারই অনুকরণ করিয়াছিলাম, এবং তাহাতে তাঁহার কবিতার কোন কোন অংশ উদ্ধৃত করিয়া রচনাটি সরস করিবারও চেষ্টা করিয়াছিলাম। এ সকল কথা ত জলধরবাবুর অজ্ঞাত নহে।"

অতএব দেখা যাচ্ছে দু'জনেই লিখেছেন তারা রবীন্দ্রনাথের 'ইউরোপ যাত্রীর পত্রে'র ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন। বিচিত্র ব্যাপার!

তবে একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। দীনেন্দ্রকুমার বা অন্য কেউ কিন্তু জলধরের লেখা শুরুর সময়ে কোন অভিযোগ তোলেন নি; তুলেছেন যখন জলধরের খ্যাতি মধ্য গগনে। 'হিমালয়' গ্রন্থটি অসামান্য জনপ্রিয় হয় এবং ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দেই অর্থাৎ‌ জলধরের জীবিত কালেই গ্রন্থটির চতুর্দ্দশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বলা বাহুল্য 'হিমালয়' গ্রন্থটির আনুকূল্যে জলধর শুধু সাহিত্যিক হিসাবে খ্যাতনামা হন নি; আর্থিক দিক দিয়েও তিনি যথেষ্ট উপকৃত হয়েছেন। এই যশ ও অর্থ প্রাপ্তিই কি জলধরের বিপদ ডেকে এনেছে ? দীনেন্দ্রকুমার লিখেছেন -"জলধরবাবুর হিমালয়ের এ পর্যন্ত আট দশটি সংস্করণ হইয়াছে; পুস্তকের মূল্য দেড় টাকা, সুতরাং এ পর্যন্ত ন্যূনকল্পে পনের হাজার টাকার হিমালয় বিক্রয় হইয়াছে।" আবার অন্যত্র বলেছেন -" 'হিমালয়ে' ও 'প্রবাসচিত্রে' জলধর বাবু যে বহু টাকা পাইয়াছেন, আশা করি তাহাতে আমাকে অঙ্ক শিখাইবার দক্ষিণা পরিশোধ হইয়াছে।" এতদিন পরে এই বিতর্কের সমাধানের কোন সম্ভাবনা নেই। সংশ্লিষ্ট কেউই আর ইহলোকে নেই; অবশ্য যখন সবাই জীবিত ছিলেন, তখনই প্রকৃত রহস্য জানা যায় নি। তবে জলধর যে অত্যন্ত সজ্জন এবং অজাতশত্রু ছিলেন এ কথা অনেকেই স্বীকার করেছেন। তিনি দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে 'ভারতবর্ষ' নামক একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা যোগ্যতা ও সুনামের সঙ্গে সম্পাদনা করে গেছেন, কোন অনুযোগ কখনও শোনা যায় নি। অতএব রহস্য চিরকাল রহস্যই থেকে যাবে।


লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়ে এখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 




(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।