বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা
ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫
হেদো- হাতিবাগান – শ্যামবাজার- চণ্ডীমণ্ডপ
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল
তওবা, তওবা ! হালুঙ্কে ( আদর করে ‘গুণ্ডা” বলা) হ্যার সায়েডের
দেশভ্রমণের কথা লিখবো আমি ? বিলকুল গুণাহ্ ! দোজখ্ তো দূরের কথা,
নরকেও স্থান হবে না আমার ।
সৈয়দ মুজতবা আলী
|
লেখা গদ্যের কি স্বরলিপি হয়, না গাওয়া যায় ? রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়তো
বা আবৃত্তি করা যায় ,কিন্তু অন্য আর সব গান ! মুজতবা সাহেব তো
গদ্যে স্বরলিপি চালু করেছিলেন । সে স্বরলিপিতে লিখতে পারা কি,
যার তার কাজ ?
তবে, চাটুজ্জে মশাই, বৃদ্ধ বয়সে, রোয়াকে বসে, যখন প্রেমের কথা
বলেন, তখন ছেলে ছোকরারা খ্যাপায়-
“বুড়োর দাঁত নেই, আবার প্রেম করে!”
চাটুজ্জে মশাই খেপে গিয়ে বলেন :-
“ওহে বেতমিজ ছোকরারা শোন হে, প্রেম কি খাবার জিনিস যে খচর মচর
করে খাবার জন্য দাঁত থাকতে হবে?”
তাই-সিতু মিঁয়ার দেশভ্রমণ নিয়ে লেখা কি সহজ কথা ? তবু, দেশভ্রমণের
না থাকা দাঁত দিয়ে হাওয়া চিবুতে হবে ! সায়েড প্রেমে আমি নিজেও
যে হাবুডুবু!
নিজের বিদেশ দৌড়, ঘরের কাছে ভুটান, তাও ফুন্টসোলিং । ওখানে আবার
‘তামুক” খাওয়া নিষেধ ।
কি করে বোঝাই- খাঁটি তামাকের খুশবাই মগজের পাতালে প্রবেশ করে দিল্
কে তরর করে দেয় ।
হ্যার সায়েডের পণ্ডিত মশাই দেশভাগের আগে ম্যাট্রিক ফেল পালিয়ে
যাওয়া ভাগ্নেকে খুঁজতে একবার আগরতলা গিয়েছিলেন ।
জীবনে সেই প্রথম “দেশভ্রমণ” তাঁর । জাত যাবার ভয়ে তিনি ঝাড়া বারোটি
ঘণ্টা নিরম্বু উপবাসে ছিলেন ।
তার চেয়েও বড় কথা- এই একমেবাদ্বিতীয়ম্ ভ্রমণকালে, তাঁর সপত্নীর
হাতে গচ্ছিত করা কৃশানুদৃপ্ত তাম্রকূট শীর্ষ ডাবা সুন্দরীর সুচিক্কণ
কৃষ্ণগণ্ডে একটি মাত্র চুম্বন দিতে পারেন নি ।
তাই- আমি নিজেও ফুন্টসোলিং যাই না । সিতু মিঁয়া বলেছিলেন – দেশভ্রমণ
করলেই যদি জ্ঞানী হওয়া যায়, তবে রেলের গার্ড আজমল সাহেব মহা জ্ঞানী
!
এই আপ্তবাক্য – আমার মত অলস লোকের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় স্তব – “জবাকুসুম
সঙ্কাশং” - এর মত ।
এখন না হয়, বাঙালির পা- বেড়েছে । পাড়ার ভুতো, রামা- হরবকৎ, প্যারিস,
লাণ্ডান, ওয়াশিংটন যাতায়াত করছে এরোপ্লেনে । পাঁচ ঘণ্টায় হুশ করে
পেরিয়ে যাচ্ছে কালাপানি । ছোট্ট ছোট্ট প্ল্যাস্টিকের খাপে মোড়া
দাঁত মাজার বুরুশ, পেস্ট বের করে দেখিয়ে দেখিয়ে দাঁত মাজে, সেটা
নাকি প্লেন কোম্পানি মিনে মাগনায় দিয়েছে।
কিন্তু আমার?
ইচ্ছা সম্যক জগ দরশনে কিন্তু পাথেয় নাস্তি।
পায়ে শিকলি মন উড়ু উড়ু এ কি দৈবেরই শাস্তি!
( পাঠান্তরও আছে – ‘জগ দরশনে’ – ‘ভ্রমক গমনে’)
রবি ঠাকুরের বড়ো দাদার এই দুটো পঙক্তির কথাই শিরোধার্য করে চলে
মনে শান্তি পাই !
কিন্তু আজ থেকে ষাট সত্তর বছর আগে?
ঘরকুনো বলে তো বদনামই ছিল এই জাতটার। তার ওপর বিধান ছিল- ‘কালাপানি
পার হলে,জাত যাবে’। আমার বাবাই তার শিকার হয়েছিলেন । আগে, বড়জোর
হাওয়া বদল করতে যেত- পশ্চিমে । এই পশ্চিম, কিন্তু বিদেশ নয় !
দেওঘর, যশিডি, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ, বেনারস, এলাহাবাদ, ভাগলপুর পর্যন্ত
দৌড় ছিল। লেখায়, কিছু স্থানীয় লোকের কথা থাকলেও, পূর্ণ বিবরণ পাওয়া
যায় না। ড্যাঞ্চি বাবু (ড্যাম চীপ) পর্যন্ত আমি জানি। বাঙালিরা
নাকি যাই দরদাম করুক, কোলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় সস্তা, বলেই
এই ড্যাম চীপ বলত । আড় সেটাই ওখানকার “উরুশ্চারণে” ড্যাঞ্চি হয়
যেত আর যে বাবুরা বলতেন- তাদের নামই হয়ে গেল- ‘ড্যাঞ্চি বাবু’!
সৈয়দ মুজতবা আলীর কলমে আমরা প্রথম পেলাম- বৈঠকি মেজাজে বিদেশের
কথা। আফগানিস্তান থেকে, মিশর হয়ে ইউরোপ বা বলা ভালো জার্মানি। সামবাজারি বৈঠকি ভাষায়- তেরোস পরসো যোগ ( ত্র্যহস্পর্শ)।
ছবি ২– মুজতবা আলীর পাসপোর্ট
লিখতে গিয়ে তিনি আশকথা, পাশকথা লিখেছেন ।
“গুণীরা বলেন- এটা দুষ্কর্ম নয় । সদর রাস্তা ছেড়ে যদি পথিক পথের
ভুলে আশপথ বা পাশপথে না যায় তবে, অচেনা ফুলের নয়া নয়া পাখীর সঙ্গে
পরিচয় হবে কিভাবে?” –
“যে পথিক প্রাণের ভুলে,
এলো আমার প্রাণের ফুলে”
রবিঠাকুর যাঁর রক্তে, তিনি যে শুধু ‘পথের প্রান্তে তীর্থ’র কথা
না ভেবে ‘পথের দুধারে” পড়ে থাকা ‘দেবালয়ে’র সন্ধান করবেন, তা কিঞ্চিৎ
প্রত্যাশিতই।
তাই তাঁর জার্মানি ঘোরা কালেই জানতে পারি কিভাবে “চিঠিচাপাটি”
শব্দটা এসেছে আমাদের শব্দ ভাণ্ডারে।
সিপাহী বিদ্রোহের সময় চাপাটি বা রুটির ভেতর দিয়ে গোপন চিঠির আদান
প্রদান হতো ! জানতে পেরেছি অনেক অজানা তথ্য ।
আব্দুর রহমানের গাঁয়ের কথা, আফগানিস্তানের জীবন কল্লোল, অনভ্যস্ত
দেরেশী পরা কিম্ভূত লোকজন, কোলোনের জল, ফার্সি হুঁকো, এসপেরেগাস
স্যুপ, ঝড়তি পড়তি কয়েক টুকরো লেটিসের পাতা,আড়াই ফোঁটা নেবুর রস
আর তিন ফোঁটা তেল দিয়ে তৈরি সরেস মাখমের মত খেতে স্যালাডের বিবরণ!
ছবি ৩– মুজতবা আলীর পাসপোর্ট (দ্বিতীয় ছবি)
আড্ডার বৈঠকি মেজাজে তিনি জানালেন অনেক তথ্য । হরফন মৌলার মত,
সিগারেটের তামাক, আঁবসাত থেকে শুরু করে চেজিং করে মদ খাওয়া, আড্ডাতে
বসেই স্যুটের অর্ডার দেওয়া- যে স্যুট দেখে বহু তালেবর তারিফ করেছিল
পরে- এই রকম বহু তথ্য। কায়রোর কফির আড্ডা, বার্লিনের ইণ্ডিয়ান
কফি হৌস, বার্লিন ইউনিভার্সিটির ওপরে ফ্ল্যাগ টাঙিয়েছিল কে ?
একবারও মনে হয় নি, তিনি আমাদের “জ্ঞান” দিচ্ছেন । বরং আমরাই উদগ্রীব
হয়ে পড়ে গেছি অক্লান্ত ভাবে সেই সব লেখা, কারণ ক্লান্ত হবার কোন
সুযোগই দেন নি। তাই “চুক্করে” পড়ে গেছি গোগ্রাসে তাঁর দেশ ভ্রমণের
কথা। মনে মনে পা ফেলেছি বন শহরের যাত্রী বিরল ট্রামে, এরোপ্লেনের
‘গর্ভ যন্ত্রণা’ সয়েছি। ভেবেই গেছি কত কথা! আচ্ছা, ‘সরস পাণ্ডিত্য’
কি একেই বলে!
ছবি ৪– চাচা কাহিনী বইয়ের একটি প্রচ্ছদ
|
এই পর্যন্ত যদি কোনো বিদগ্ধ পাঠক পড়ে থাকেন- তবে বলতেই পারেন,
-তারিফ করতে হলে, কে কি বলে জানলাম তো ওনারই লেখায় :
ফরাসিরা বলেছিল, ‘এপাতাঁ!’
জর্মনরা, ‘ক্লর্কে!’
ইতালিয়ানরা, ব্রাভো!’
স্প্যানিশরা, ‘দেলিচজো,দেলিচজো।’
আরবরা, ‘ইয়া সালাম, ইয়া সালাম!’
বাংলার রসগোল্লা খেয়ে কি বলেছিল সেই ফরাসী উকিল ?
ফরাসি উকিল আকাশের দিকে দুহাত তুলে অর্ধনিমীলিত চক্ষে, গদ্গদ্
কণ্ঠে বলছে,
‘ধন্য, পুণ্যভূমি ইতালি, ধন্য পুণ্যনগর ভেনিস! এ-ভূমির এমনই পুণ্য
যে হিদেন রসগোল্লা পর্যন্ত এখানে মিরাক্কেল দেখাতে পারে।
কোথায় লাগে মিরাক্ল্ অব মিলান' এর কাছে- এ যে সাক্ষাৎ জাগ্রত দেবতা,
পুলিশ-মুলিশ সবাইকে ঝেঁটিয়ে বার করে দিলেন এখান থেকে! ওহোহো, এর
নাম হবে মিরাক্ল্ দ্য রসগোল্লা।’
উকিল মানুষ সোজা কথা প্যাঁচ না মেরে বলতে পারে না। তার উচ্ছ্বাসের
মূল বক্তব্য, রসগোল্লার নেমকহারাম করতে চায় না ইতালির পুলিশ-বর।
রিয়োজা, মোসেল, কিয়ান্তি এই সবই বা কি জিনিস! চাখতে না পারি-
জানতে তো পারি !
"ঈশ্বর পরম দয়ালু
তাঁহারই কৃপায় দাড়ি গজায়
শীতকালে খাই শাঁকালু"
(পাঠান্তর :- "যীশু পরম দয়ালু
তাঁহারই কৃপায় দাড়ি গজায়
শীতকালে খাই শাঁকালু")
নব্য জর্মন ভাষা শিক্ষার্থীদের প্রতি আলী সাহেবের উপদেশ, আর আমরাও
সটকে শিখে যাই:-
“কোকিলকে জর্মনরা কুকুক্ বলে!
ৎসুম কুকুক্ নখমাল- অনেকটা আমাদের কচু- হাতী- ঘণ্টার মত । এখানে
কোকিলকেই কেন বেছে নেওয়া হলো, প্রশ্ন যদি আপনি করেন, তবে উত্তর-
কচু- হাতী- ঘণ্টাই বা আমরা বেছে নিলুম কেন ? ছাই জানো- কেন?”
মুশকিলটা এখানেই ! ছাই জানতে গিয়ে যে আমরা অমূল্য রতন পাই !
কি সেই রতন ?
জর্মনরা নিজেদের দেশেই সেই ১৯৭০ সালে বিভিন্ন জায়গায় পাবলিক টেলিফোন
বুথ বসিয়েছিল ।
নিয়ম ছিল – একটা কয়েন ফেললে, যদি এনগেজড টোন পাওয়া যায় বা লাইন
না পাওয়া যায়, তবে B বাটনে চাপ দিলে কয়েনটা বেরিয়ে আসবে ।
অধিকাংশ লোক ভুলে যেত ওই বাটনটা টিপতে ।
ফলং – অভিজ্ঞ বিদেশী লোকেরা ফোন করার আগে বাটনটা আগে চাপ দিত ।
ঠং করে কয়েন বেরিয়ে এসে আপনার ফোন করার পথ প্রশস্ত ।
না ফোন যদি করতে চান – তবে ওই রোক্কা কয়েন বিদেশে আপনার অন্যতম
মূল ধন !
করে, করে বিভিন্ন ফোন বুথে হানা দেওয়াই যেত “সৎপথে” মহার্ঘ কিছু
বিদেশী মুদ্রা ইনকাম করার জন্য ।
“ ছাই জানার” কি অপার মহিমা !!
রাইনের মাছ খেতে ভালো, তবে খোদ জর্মনের লোককে বোঝাচ্ছেন আলী
সাহেব হীদেন ইলিশ মাছের মহিমা।
গঙ্গা বইতে বইতে শিবের জটায় উঠে পড়ে। তারপর পাক খেয়ে আবার ভূতলে।
ইলিশ মাছও ঘুরে আসে শিবের জটায়। তাই এত সোয়াদ ইলিশের। রাইনের মাছের
সঙ্গে তুলনা কি হয় ? একেবারে হেদোর আড্ডা উঠে আসে খোদ বন শহরে।
খোদ কোলকাতার হাতীবাগান বা গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে কে এরকম ফারাকটা
বুঝিয়ে দেবে?
ধরা যাক, সোভিয়েত রাশিয়ার কথা (এখন বিলুপ্ত, কিন্তু রাশিয়া তো
আছে!)।
ছবি ৫ – চাচাকাহিনী বইয়ের অন্য একটি প্রচ্ছদ
|
একদল রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক গেছে মিশরে । তাঁরা খুঁজে পেলেন একটা
মমি ! ক্রুশ্চফ জিজ্ঞেস করলো :- কতদিনের পুরোনো?
পণ্ডিতেরা মাথা চুলকোন !
চব্বিশ ঘণ্টা ম্যাদ দিলো – ক্রুশ্চফ । হয় জেনে এসো, নয় সাইবেরিয়ায়
যাও ।
পণ্ডিতেরা প্লেনে গিয়ে আবার ফিরতি প্লেনেই ফিরে এলো । হাসি মুখে
ক্রুশ্চফকে বলল – হৌজুর, মমি চার হাজার দুশো বছরের পুরোনো!
কি করে জানলে?
কনফেশন হৌজুর ! চাপ দিলে কি না হয়- গয়রহ্ !
রুশেদের ভোদকা, ফরাসীদের অ্যাঁবসাতার চেয়েও চিন দেশে এক রকম
কড়া মদ আছে । একবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সকালে বিলকুল মাথা সাফ্ ।
এবারে এক গ্লাস গরম জল খেলেই – নেশা আবার চেপে বসবে । করে, করে
– এই ভাবে একই মদে তিনদিন নেশা !
আলী সায়েবের দেশভ্রমণের লেখা পড়ার নেশাটা এই চিন দেশের কড়া মদের
মত । একবার পড়লে, নেশা সারা জীবন থাকে !
“ছাই জানার” কি অপার মহিমা !
“ভারতবর্ষ অমৃত (ইলিশ?) চেয়েছে । রবীন্দ্রনাথও বলেছেন:-
‘সুখের খেলায় বেলা গেছে, পাইনি তো আনন্দ’
আনন্দ তবে কি ?
অমৃত
চণ্ডীদাসও বলেছেন :- সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল
।
এবং সুখের পরেও শ্রীরাধা চেয়েছিলেন অমৃত, অমিয়া, তাই অমিয়া সাগরে
সিনান করিতে সকলি গরলি ভেল।”
অমৃতের অত্যুত্তম বর্ণনা পেয়েছি একটি শ্লোকে :-
“কেচিদ্ বদন্তি অমৃতোঽস্তি সুরালয়েষু
কেচিদ্ বদন্তি বনিতাধরপল্লবেষু
ব্রুমো বয়ং সকল শাস্ত্র বিচারদক্ষা
জম্বীরনীরপূরিত ভর্জিত মৎসখণ্ডে।”
আহা- হা ! কেউ কেউ বলেন, অমৃত আছে সুরালয়ে ( মদের দোকান) । কেউ
কেউ বলেন, না অমৃত বনিতার অধরপল্লবে । আর আমরা, আসলে “আমি” এখানে
সম্মানার্থে বহুবচন আমরা, কারণ আমি সকল শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি-
সকল শাস্ত্র বিচার দক্ষা – আমরা বলি, জম্বীর নীর পূরিত – অর্থাৎ
নেবু, জম্বীর, জামির- সিলেটিতে- নেবু, নেবুর রসে পূরিত মানে ভর্তি
মৎসখণ্ডে ।
সোজা বাংলায় মাছের ওপর ঠেসে নেবুর রস- সেই অমৃত ।
এ কবি শুধু কবি নন ! মহর্ষি, দিব্যদ্রষ্টা- কি করে সেই যুগেই
জানলেন, বাঙলাতে এমন দিন আসবে যেদিন শুধু লক্ষপতিরাই শ্বশুরবাড়ী
এলে মাছ কিনবেন !
আর ইতর জনা- আমরা মাছের কাঁটাটি পর্যন্ত পাবো না, সধবার একাদশী
ভাঙবার জন্যে! মুজতবাতে ডুবে থাকি- অমৃতের সন্ধানে। এই গদ্যের
স্বরলিপি হয় না, হলে গান গাইতাম!
হরিচরণ গঙ্গোপাধ্যায় "বঙ্গীয় শব্দকোষ " নামে একটা অভিধান
লিখে বলেছিলেন,
"এতে যদি কখনো কোনো সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে, সেটা যেন মুজতবা
আলী করেন।"
যুদ্ধ চলাকালীন আফগানিস্তানে বাদশাহের বড় ভাইয়ের সাথে আড্ডা
দিয়ে আব্দুর রহমানের রান্না গোস্ত-রুটি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর
তোলেন যে ভেতো বাঙ্গালী তার .... সুগন্ধ আপনা আপনি নিজের হাতে
চলে আসে ! আহা------ সেই আনিকি পাসিকিভি, ফন ব্রাখেল, সূয্যি রায়------
সেই কায়রোর কাফেতে বসে স্যুট কেনা, সেই গুল বাহাদুর-মোতি, দাবা
খেলা শেষে সুইস পরিবারে দাওয়াত!
প্রয়াত নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় একবার আড্ডা সম্বন্ধে লিখতে
গিয়ে বলেছিলেন :-
“বর কনে ছাড়া যেমন বিয়ে হয় না, তেমনি আড্ডা বলতে দুজন মানুষের
দরকার । বাকীরা সবাই বরযাত্রী ।
আড্ডার দুটি মানুষের মধ্যে একজন হলেন – স্বয়ং আড্ডাধারী । আড্ডার
সৌরজগতে তিনি হলেন সূর্য । তাঁকে কেন্দ্র করেই সব আড্ডা ধারীরা
ঘুরবে। তিনি আড্ডা জগতে স্থির বিন্দু। আড্ডাধারীর – কোনো সময় ফাঁকি
দেওয়া চলবে না । তাঁর শ্যালিকার পাকা দেখা থাকবে না, আপিস কাচারি
থাকবে না, সিনেমা দেখার বাতিক নেই গয়রহ্ । তিনি ধ্যানরত বুদ্ধের
মত অকম্পিত অবস্থায় বসে থাকবেন । আর অপর পক্ষ একজন শান দিয়ে যাবেন
মরচে পড়লে।”
( স্মৃতি থেকে লিখলাম, একটু অদল বদল হয়তো আছে )
ছবি ৬– নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
|
সিতু মিঁয়া ঠিক এই কাজটাই করেছেন – ইণ্ডিয়ান কফি হৌসে বা কায়রোর
আড্ডাতে, ট্রেনের কামরায়।
পিরামিড দেখা বাদ দিয়ে কায়রোর রেস্তোরাঁয় বসে বন্ধুদের সাথে ঘন্টার
পর ঘন্টা আড্ডা দিতেন। ইফেল টাওয়ারের কাছেই প্যারিসের কোনো এক
রাস্তার ধারে ক্যাফেতে বসে যার তার সাথেই ফরাসি ভাষায় গল্প জুড়ে
দিতেন। ওনার ভাষায় অবশ্য “পিজিয়ন ফ্রেঞ্চ” ।
আমরা সবাই শান দিয়ে নি – তাঁরই দেওয়া শান পাথরে । পাঠকেরা হলেন
বরযাত্রী।
তিনি লিখছেন- না না ভুল হলো কালি কলমে আড্ডা দিচ্ছেন,-পাঠানদেরও
যে বৈশিষ্ট্য বাঙালীদের মত আড্ডা -
“‘..............আড্ডা জমে উঠল। দেখলুম, পাঠানের বাইরের দিকটা
যতই রসকষহীন হোক না কেন, গল্প শোনাতে আর গল্প বলাতে তাদের উৎসাহের
সীমা নেই। তর্কাতর্কি করে না, গল্প জমাবার জন্য বর্ণনার রঙতুলিও
বড় একটা ব্যবহার করে না। সব যেন উডকাটের ব্যাপার – সাদামাটা কাঠখোট্টা
বটে, কিন্তু ঐ নীরস নিরলঙ্কার বলার ধরনে কেমন যেন একটা গোপন কায়দা
রয়েছে যার জন্য মনের উপর বেশ জোর দাগ কেটে যায়।..............’।
আর তার কিন্তু খুব, আত্মত্যাগী, নিষ্ঠাবান, আড্ডাবাজ-
‘..............পাঠান আড্ডা জমাবার খাতিরে অনেক রকম আত্মত্যাগ
করতে প্রস্তুত। গল্পের নেশায় বে-খেয়াল অন্ততঃ আধ ডজন অতিথি সুদ্ধু
শুকনো রুটি চিবিয়েই যাচ্ছে, চিবিয়েই যাচ্ছে। অবচেতন ভাবটা এই,
পোলাও-মাংস বাছতে হয়, দেখতে হয়, বহুৎ বয়নাক্কা, তাহলে লোকের মুখের
দিকে তাকাব কি করে, আর না তাকালে গল্প জমবেই বা কি করে।..............’
এখানেই শেষ নয়, পাঠানের আড্ডার আরো বৈশিষ্ট্য,
‘..............জানেন তো পাঠানেরা বড্ড আড্ডাবাজ। গল্পগুজব না
করে সে এক মাইল পথও চলতে পারে না। কাউকে না পেলে সে বসে যাবে রাস্তার
পাশে। মুচীকে বলবে,‘দাও তো ভায়া, আমার পয়জারে গোটা কয়েক পেরেক
ঠুকে।’ মুচী তখন ঢিলে লোহাগুলো পিটিয়ে দেয়, গোটা দশেক নূতনও লাগিয়ে
দেয়। এই রকম শ’খানেক লোহা লাগালে জুতোর চামড়া আর মাটিতে লাগে না,
লোহার উপর দিয়েই রাস্তার পাথরের চোট যায়। হাফসোল লাগানোর খরচাকে
পাঠান বড্ড ভয় করে কিনা। সেই পেরেক আবার হরেক রকম সাইজের হয়। পাঠানের
জুতো তাই লোহার মোজায়িক। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, লোহা ঠোকানো না-ঠোকানো
অবান্তর – মুচীর সঙ্গে আড্ডা দেবার জন্য ঐ তার অজুহাত।’ আড্ডা
আর কৃপণতা, পাঠানের এই একটাই পরিচয়?”
আবার ধরুন, তিনি চলে গেলেন ইংলণ্ডে । লিখছেন –
“একবার দেখা গেল মার্কিন মুলুকের হেনরী ফোর্ড রোলস্ রয়েস চড়ে
দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সারা লণ্ডন।
রাজা পঞ্চম জর্জ শুধুলেন-
করেন কি ফোর্ড সাহেব! আপনারা ফোর্ড গাড়ীর বিজ্ঞাপনে বলেন, আপনাদের
গাড়ী দুনিয়ার চিপেস্ট এবং বেস্ট গাড়ি, আর আপনি রোলস্ রয়েস চড়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছেন?
তিনবার বাও করে ফোর্ড সাহেবের উত্তর:- ম্যানেজারকে বলি তো আমাকে
ফোর্ড গাড়ী দিতে! শোনে না। বলে, ফোর্ড গাড়ী তৈরি হতে না হতেই
বিক্কিরি হয়ে যায়। আগে, খদ্দের সামলাবো, না মালিক? তাই সেকেণ্ড
বেস্ট রোলস্ রয়েস কিনেছি!
বারে বারে উঠে এসেছে – দেশের কথা বিদেশে বেড়াতে গিয়ে। এমনকি বাঙালী
দোকানদারের অকর্মন্য মনোভাবের পীড়াদায়ক কাহিনীর কথাও শুনেছি তাঁর
কলমে।
দুপুরে আলী সাহেব স্নান করবেন । দেখলেন – সাবান নেই । ভরদুপুরে
বাঙালি দোকানদার ভাত ঘুম দিচ্ছে কাউন্টারে হাতের ওপর মাথা রেখে
।
আলী সাহেবের জিজ্ঞাসা – পামঅলিভ সাবান আছে ?
দোকানদার অতি কষ্টে উত্তর দিল – নেই !
আলী সাহেব বললেন :- ওই তো- শো কেসে আছে ।
দোকানদার :- ও সাবান বিক্রির না । ( কষ্ট করে কে আর ওঠে ?)
আবার বাঙালী কবির শ্রেষ্ঠত্বও গর্বভরে শুনে থাকি –
“সুকুমার রায়ের মত হাস্যরসিক বাংলা সাহিত্যে আর নেই সে কথা রসিক
জন মাত্রেই স্বীকার করে নিয়েছে, কিন্তু এ কথা অল্প লোকেই জানেন
যে, তাঁর জুড়ি ফরাসী, ইংরেজী, জর্মন সাহিত্যেও নেই, রাশানে আছে
বলে শুনিনি। এ-কথাটা আমাকে বিশেষ জোর দিয়ে বলতে হল, কারণ আমি বহু
অনুসন্ধান করার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছি। ---- একদিন প্যারিস শহরে
আমি কয়েকজন হাস্যরসিকের কাছে ‘বোম্বাগড়ের রাজা’র অনুবাদ করে শোনাই-
অবশ্য আমসত্তভাজা কী তা আমাকে বুঝিয়ে বলতে হয়েছিল (তাতে করে কিঞ্চিৎ
রসভঙ্গ হয়েছিল অস্বীকার করিনে) এবং আলতার বদলে আমি লিপস্টিক ব্যবহার
করেছিলাম (আমার ঠোঁটে কিংবা চোখে নয়- অনুবাদে)।
ফরাসী ক্যাফেতে লোকে হো-হো করে হাসে না, এটিকেটে বারণ, কিন্তু
আমার সঙ্গীগণের হাসির হররাতে আমি পর্যন্ত বিচলিত হয়ে তাঁদের হাসি
বন্ধ করতে বারবার অনুরোধ করেছিলুম। কিছুতেই থামেন না। শেষটায় বললুম,
“তোমরা যেভাবে হাসছ, তাতে লোকে ভাববে, আমি বিদেশী গাড়ল, বেফাঁস
কিছু একটা বলে ফেলেছি আর তোমরা আমাকে নিয়ে হাসছ- আমার বড় লজ্জা
করছে।” তখন তাঁরা দয়া করে থামলেন, ওদিকে আর পাঁচজন আমার দিকে আড়নয়নে
তাকাচ্ছিল বলে আমি ত ঘেমে কাঁই।
তারপর একজন বললেন, “এরকম weird, ছন্নছাড়া, ছিষ্টিছাড়া কর্মের ফিরিস্তি
আমি জীবনে কখনও শুনিনি।”
আরেকজন বললেন, “ঠিক! এবার একটা চেষ্টা দেওয়া যাক, এ লিস্টে আর
কিছু জুতসই বাড়ানো যায় কি না।”
সবাই মিলে অনেক্ষণ ধরে আকাশ পাতাল হাতড়ালুম, দু-একজন একটা দুটো
অদ্ভুতকর্মের নামও করলেন, কিন্তু আর সবাই সেগুলো পত্রপাঠ ডিসমিস
করে দিলেন।
ছবি ৭– বোম্বাগড়ের রাজা
|
আমরা জন পাঁচ প্রাণী প্রায় আধ ঘন্টা ধস্তাধস্তি করেও একটা মাত্র
জুতসই এপেনডিক্স পেলুম না। গোটা কবিতার তো প্রশ্নই ওঠে না।
আগের থেকেই জানতুম, কিন্তু সেদিন আবার নতুন করে উপলব্ধি করলুম,
যদিও সুকুমার রায় স্বয়ং বলেছেন, “উৎসাহে কি না হয়, কি না হয় চেষ্টায়”,
যে জগতে সুকুমার বিচরণ করতেন, সেখানে তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম।”
‘দেশে বিদেশে’ বইয়ে. লেখক ট্রেনে পরিচিত হন পাঠানদের সাথে। লেখকের
জবানীতে,
“গাড়ি এর মাঝে আবার ভোল ফিরিয়ে নিয়েছে। দাড়ি লম্বা হয়েছে, টিকি
খাটো হয়েছে, নাদুসনুদুস লালজীদের মিষ্টি মিষ্টি ‘আইয়ে বৈঠিয়ে’
আর শোনা যায় না। এখন ছ’ফুট লম্বা পাঠানদের ‘দাগা, দাগা, দিলতা,
রাওরা’, পাঞ্জাবীদের ‘তুসি, অসি’, আর শিখ সর্দারজীদের জালবন্ধ
দাড়ির হরেক রকম বাহার। পুরুষ যে রকম মেয়েদের কেশ নিয়ে কবিতা লেখে
এদেশের মেয়েরা বোধ করি সর্দারজীদের দাড়ি সম্বন্ধে তেমনি গজল গায়;
সে দাড়িতে পাক ধরলে মরসিয়া-জারী গানে বার্ধক্যকে বেইজ্জৎ করে।”
দাড়ি না হয় যীশুর (পাঠান্তরে ঈশ্বরের বা খোদার) দয়ায় – কিন্তু
তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, যা তাদের একেবারে নিজস্ব জিনিষ, তার সম্পর্কেও
একটু শোনা যাক -
“............জিজ্ঞাসা করলুম, ‘সর্দারজী শিলওয়ার বানাতে ক’গজ
কাপড় লাগে?
বললেন,“দিল্লীতে সাড়ে তিন, জলন্ধরে সাড়ে চার, লাহোরে সাড়ে পাঁচ,
লালামুসায় সাড়ে ছয়, রাওয়ালপিন্ডিতে সাড়ে সাত, তারপর পেশাওয়ারে
এক লম্ফে সাড়ে দশ, খাস পাঠানমুল্লুক কোহাট খাইবারে পুরো থান।’
‘বিশ গজ!’
‘হ্যাঁ, তাও আবার খাকী শার্টিঙ দিয়ে বানানো’।...............”
পড়ে ও জেনে অবাক হলাম। বিস্ময় আর বিস্ময়!
কি বিলাসী পোশাক তাই না? বিধিবাম, পরের পাতায় দেখেন উল্টো কথা,‘............
আপনি বুঝি ভেবেছেন, পাঠান প্রতি ঈদে নূতন শিলওয়ার তৈরী করায়?
মোটেই না। ছোকরা পাঠান বিয়ের দিন শ্বশুরের কাছ থেকে বিশগজী একটা
শিলওয়ার পায়। বিস্তর কাপড়ের ঝামেলা – এক জায়গায় চাপ পড়ে না বলে
বহুদিন তাতে জোড়াতালি দিতে হয় না। ছিঁড়তে আরম্ভ করলেই পাঠান
সে শিলওয়ার ফেলে দেয় না, গোঁড়ার দিকে সেলাই করে, পরে তালি লাগাতে
আরম্ভ করে- সে যে-কোন রঙের কাপড় দিয়েই হোক, পাঠানের তাতে বাছবিচার
নেই। বাকী জীবন সে ঐ শিলওয়ার পরেই কাটায়। মরার সময় ছেলেকে দিয়ে
যায় – ছেলে বিয়ে হলে পর তার শ্বশুরের কাছ থেকে নূতন শিলওয়ার
পায়, ততদিন বাপের শিলওয়ার দিয়ে চালায়।...........................’
জামাকাপড়ে যাদের এত কৃচ্ছসাধন, খাওয়ার ব্যাপারে একেবারে মুক্তকচ্ছ-
‘আর কী খানাপিনা! প্রতি ষ্টেশনে আড্ডার কেউ না কেউ কিছু না কিছু
কিনবেই। চা, শরবৎ, বরফজল, কাবাব, রুটি, কোনো জিনিসই বাদ পড়ল না।
কে দাম দেয়, কে খায়, কিচ্ছু বোঝবার উপায় নেই। আমি দু’একবার আমার
হিস্যা দেবার চেষ্টা করে হার মানলুম। বারোজন তাগড়া পাঠানের তির্যকবূহ্য
ভেদ করে দরজায় পৌঁছবার বহু পূর্বেই কেউ না কেউ পয়সা দিয়ে ফেলেছে।
আপত্তি জানালে শোনেনা, বলে,‘বাবুজী এই পয়লা দফা পাঠানমুল্লুকে
যাচ্ছেন, না হয় আমরা একটু মেহমানদারী করলুমই। আপনি পেশাওয়ারে আড্ডা
গাড়ুন, আমরা সবাই এসে একদিন আচ্ছা করে খানাপিনা করে যাবো।’ আমি
বললুম,‘আমি পেশাওয়ারে বেশী দিন থাকব না।’ কিন্তু কার গোয়াল, কে
দেয় ধুঁয়ো। সর্দারজী বললেন,‘কেন বৃথা চেষ্টা করেন? আমি বুড়ো মানুষ,
আমাকে পর্যন্ত একবার পয়সা দিতে দিল না। যদি পাঠানের আত্মীয়তা-মেহমানদারী
বাদ দিয়ে এদেশে ভ্রমণ করতে চান, তবে তার একমাত্র উপায় কোনো পাঠানের
সঙ্গে একদম কথা না বলা। তাতেও সবসময় ফল হয় না।..............’
আর পাঠানের অতিথিপরায়ণতা – তার জন্য পড়তে হবে দরাজ সংশাপত্রটি
-
‘..............আজ বলতে পারি পাঠানের অভ্যর্থনা সম্পূর্ণ নির্জলা
আন্তরিক। অতিথিকে বাড়িতে ডেকে নেওয়ার মত আনন্দ পাঠান অন্য কোন
জিনিসে পায় না – আর সে অতিথি যদি বিদেশী হয় তা’হলে তো আর কথাই
নেই। তারো বাড়া, যদি সে অতিথি পাঠানের তুলনায় রোগদুবলা সাড়ে পাঁচফুঢী
হয়। ভদ্রলোক পাঠানের মারপিট করা মানা। তাই সে তার শরীরের অফুরন্ত
শক্তি নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না। রোগদুবলা লোক হাতে পেলে আর্তকে
রক্ষা করার কৈবল্যানন্দ সে তখন করে ..............’
ছবি ৮ – দেশেবিদেশে বইয়ের প্রচ্ছদ
|
পাঠান যে শক্তিমান তা আমরা জানতে পারি। আরো জানি অকাতরে সে সেই
শক্তির বিতরণ করে তুলনামূলকভাবে দুর্বলদের সাহায্যার্থে,
‘..............গরমে, ধুলোয়, কয়লার গুঁড়োয়, কাবাব-রুটিতে আর স্নানাভাবে
আমার গায়ে তখন আর একরত্তি শক্তি নেই যে বিছানা গুটিয়ে হোন্ডল বন্ধ
করি। কিন্তু পাঠানের সঙ্গে ভ্রমণ করাতে সুখ এই যে, আমাদের কাছে
যে কাজ কঠিন বলে বোধ হয় পাঠান সেটা গায়ে পড়ে করে দেয়। গাড়ির ঝাঁকুনির
তাল সামলে, দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে উপরের ব্যাঙ্কের বিছানা বাঁধা আর
দেশলাইটি এগিয়ে দেওয়ার মধ্যে পাঠান কোন তফাৎ দেখতে পায় না। বাক্স-তোরঙ্গ
নাড়াচাড়া করে যেন অ্যাটাচি কেস।..............’
পাঠানের দৈত্যাকার চেহার দেখে যাই মনে হোক না কেন, তার রসবোধ কিন্তু
উপছে পড়ছে,
‘..............লোকটার হিম্মৎ ছাড়া নাকি আরো একটা গুণ আছে। যাকে
বলে হাজির-জবাব। সব কথার চটপট উত্তর দিতে পারে। শুনলুম চারবার
প্রমাণ অভাবে খালাস পেয়ে পাঁচ বারের বার যখন হাকিম ইজাজ হুসেন
খানের আদালতে উপস্থিত হল, তখন তিনি নাকি চটে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এই
নিয়ে তুই পাঁচবার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিস; তোর লজ্জা-শরম নেই?’
সর্দার নাকি মুচকি হেসে বলেছিল, ‘হুজুর প্রমোশন না পেলে আমি কি
করব?’ ..............’ হা হা হা।
আপনি কি জানেন সর্দারজীদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্ক কোনটা? আসুন
দেখি,‘..............শেষটায় থাকতে না পেরে আমি বললুম,‘আপনি পণ্ডিত
মানুষ, শোকে এত বিচলিত হচ্ছেন কেন? আর আপনার সহ্য করবার ক্ষমতা
যে কত অগাধ সে তো আমরা সবাই দেখেছি – দুটি ছেলে, স্ত্রী মারা গেলেন,
আপনাকে তো এতটুকু কাতর হতে দেখিনি’।
‘খুদাবখশ আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি বদ্ধ উম্মাদ। কিন্তু
মুখে কথা ফুটল। বললেন, ‘আপনি পর্যন্ত এই কথা বললেন? ছেলে মরেছিল
তো কি? আবার ছেলে হবে। বিবি মরেছেন তো কি? নূতন শাদী করব। কিন্তু
ভাই পাব কোথায়?’ ..............’
ছবি ৯ – দেশেবিদেশে বইয়ের অন্য একটি প্রচ্ছদ
|
তবে একেবারে অন্তমপর্বের এসে সে অতি বিনয়ের সঙ্গে একটু আত্ম-প্রশংসা
করে, বড়ই মর্মস্পর্শী তার সেই কথাগুলি -
‘সৈয়দ সাহেব, কিছু মনে করবেন না। আপনারা বোমা মারেন, রাজনৈতিক
আন্দোলন চালান, ইংরেজ আপনাদের ভয়ও করে। এসব তো আরম্ভ হয়েছে মাত্র
সেদিন। কিন্তু বলুন তো, যেদিন দুনিয়ার কেউ জানত না ফ্রন্টিয়ার
বলে এক ফালি পাথরভর্তি শুকনো জমিতে একদল পাহাড়ী থাকে সেদিন ইংরেজ
তাদের মেরে শেষ করে দিত না, যদি পারত? ফসল ফলে না, মাটি খুঁড়লে
সোনা চাঁদি কয়লা তেল কিছুই বেরোয় না, এক ফোঁটা জলের জন্য ভোর হবার
তিন ঘণ্টা আগে মেয়েরা দল বেঁধে বাড়ি থেকে বেরোয়, এই দেশ কামড়ে
ধরে পড়ে আছে মূর্খ পাঠান, কত যুগ ধরে, কত শতাব্দী ধরে কে জানে?
সিন্ধুর ওপারে যখন বর্ষার বাতাস পর্যন্ত সবুজ হয়ে যায় তখন তার
হাতছানি পাঠান দেখেনি? পূরবৈয়া ভেজা ভেজা হাওয়া অদ্ভুত মিঠে মিঠে
গন্ধ নিয়ে আসে, আজ পর্যন্ত কত জাত তার নেশায় পাগল হয়ে পুব দেশে
চলে গিয়েছে – যায়নি শুধু মূর্খ আফ্রিদী মোমন্দ’।
সৈয়দ মুজতবা আলী নতুন নতুন দেশ পর্যটনের ভেতর দিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা
তাঁর বিদগ্ধ মনকে করেছিল অনুরঞ্জিত। অতি অল্প সময়ে তিনি ইংল্যান্ড,
ফ্রান্স, জার্মানি, মিসর, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া
ও ইতালি সফর করেছেন। এ ছাড়া সিরিয়ার রাজধানী শহর দামেস্ক, ইরাকের
রাজধানী বাগদাদ এবং ইসরায়েলের রাজধানী শহর তেলআবিবসহ মধ্যপ্রাচ্যের
বিখ্যাত শহর ভ্রমণ করে মুসলিম সভ্যতা ও কৃষ্টির নিদর্শন দেখে মুগ্ধ
হন। এ ছাড়া সৈয়দ মুজতবা আলী ভারতের বহু অঞ্চল ভ্রমণ করেন। প্রবাসে
যখন যেখানে গিয়েছেন, সেই জায়গায় মানুষ, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি
সম্পর্কে অপরিসীম কৌতূহল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন, গ্রহণ করেছেন
তিলতিল করে রচনার মালমসলা, তাঁর সাহিত্যজীবনেও এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
যথেষ্ট মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে। জীবিত অবস্থায় তাঁর সাহিত্য নিয়ে
আলোচনা হয়েছে বিদগ্ধ মহলে, মৃত্যুর পর বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার
পত্র-পত্রিকায় বহু লেখক, সাহিত্যিক, পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁর স্মৃতির
প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণতি জানিয়েছেন অনেকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
লিখেছেন,-
“'লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর চেয়েও মানুষ সৈয়দ মুজতবা আলী কম বিস্ময়কর
ছিলেন না। যাঁরা দীর্ঘকাল ধরে তাঁর অন্তরঙ্গ ছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই
পরে সে সম্পর্কে লিখছেন। অত্যন্ত চঞ্চল এই মানুষটিকে কিছুতেই সাধারণ
সংসারী মানুষদের মাপে আঁটানো যায় না। প্রতিভা জিনিসটা খুব সুখের
নয়; বরং এর জ্বালা আছে, এই জ্বালাতেই ইনি সারা জীবন ছটফট করেছেন।'
[সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মুজতবা প্রসঙ্গ, সিলেট, ১৯৭৭, পৃ ১৪৬]
‘দেশে – বিদেশে’ বইটি যারা পড়েছেন, তাদের কাছে এ বইয়ের কথা
নতুন করে বলার কিছু নেই নাই । এ বইয়ের প্রধান আকর্ষণীয় চরিত্র
আবদুর রহমান । বাংলা সাহিত্যের সৌভাগ্য মুজতবা আলি আফগানিস্থানে
গিয়েছিলেন আর মুজতবার সৌভাগ্য তিনি আব্দুর রহমান এর মত মানুষের
সংস্পর্শ পেয়েছিলেন । মাঝে মাঝে ভাবি, এখন কি আর আব্দুর রহমানের
মত মানুষ আছে! বইটার শেষের দিকে মন টা একদম খারাপ হয়ে যায়। ওঁর
অমর অ্যানেকডোটগুলো না পড়লে দেশভ্রমণ শেষ হবে না ।
“সিন্ধু নদের বালুচরে বসে দুপুর রোদে আটজন পাঠান ঘামছে। উট ভাড়া
দিয়ে তারা ছিয়ানব্বই টাকা পেয়েছে, কিন্তু কিছুতেই সমানেসমান
ভাগ বাঁটোয়ারা করতে পারছে না। কখনও কারও হিস্যায় কম পড়ে যায়,
কখনও কিছু উপরি থেকে যায়। ক্রমাগত নতুন করে ভাগ হচ্ছে, হিসেব
মিলছে না, ঘাম ঝরছে আর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গলাও চড়ছে।
“এমন সময় তারা দেখতে পেল, অন্য পার দিয়ে এক বেনে তার পুঁটুলি
হাতে করে যাচ্ছে। পাঠানরা চেঁচিয়ে বেনেকে ডাকল এপারে এসে ওদের
হিসেব ফৈসালা করে দিতে। বেনে হাত-পা নেড়ে বোঝাল অত মেহন্নত তার
সইবে না, আর কত টাকা ক’জন লোক তাই জানতে চাইল। জানানো হল চার কুড়ি
দশ ও তার উপরে ছয় টাকা আর হিস্যেদার আটজন।
“বেনে বলল, ‘বারো টাকা করে নাও।’ পাঠানরা চেঁচিয়ে বলল, তুই একটু
সবুর কর, আমরা দেখে নিচ্ছি বখরা ঠিক মেলে কি না।’
মিলে গেল সবাই অবাক। তখন তাদের সর্দার চোখ পাকিয়ে বলল, ‘এতক্ষণ
ধরে আমরা চেষ্টা করলুম, হিসেব মিলল না, এখন মিলল কী করে? ব্যাটা
নিশ্চয়ই কিছু টাকা সরিয়ে নিয়ে হিসেব মিলিয়ে দিয়েছে। ওপার
থেকে ও যখন হিসেব মেলাতে পারে তখন নিশ্চয়ই কিছু টাকা সরাতেও পারে।
পাকড়ো শালাকো!”
বর্ষা নামক নিবন্ধটি থেকে আমরা জানতে পারি, মিশরের কায়রোতে বৃষ্টি
খুব কম হয়। লেখকের ভাষ্যে
‘কাইরোতে বছরে ক’ইঞ্চি বৃষ্টি পড়ে এতদিন বাদে সে কথা আমার স্মরণ
নেই। আধা হতে পারে, সিকিও হতে পারে।’
এটুকু পাঠ করেই বোঝা যাচ্ছে
কায়রোতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কেমন। সম্ভবতঃ বিবরণে পরিমিতিবোধের
সংজ্ঞা হতে পারে এই ছোট্ট পংক্তিটি। কায়রোতে লেখকের চোখের সামনেই
একদিন বৃষ্টি এল। এই বৃষ্টি নিয়েই সুদানের এক ছেলে একটি গল্প বলল।
গল্পটি এরকম:-
সুদানের একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হ’ল। সে বললে, তার দেশে নাকি ষাট
বছরের পর একদিন হঠাৎ কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি নেবেছিল। মেয়েরা কাচ্চা-বাচ্চারা,
এমন কি গোটা কয়েক জোয়ান মদ্দরা পর্যন্ত হাউমাউ করে কান্নাকাটি
জুড়েছিল, ‘আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে আমাদের ঘাড়ে ভেঙ্গে পড়লো গো। আমরা
যাব কোথায়? কিয়ামতের (মহাপ্রলয়ের) দিন এসে গেছে। সব পাপের তওবা
(ক্ষমা-ভিক্ষা) মাঙবার সময় পেলুম না, সবাইকে যেতে হবে নরকে।’ গাঁও-বুড়োরা
নাকি তখনো সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এতে ভয় পাবার কিছু নেই। আকাশটুকরো
টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে না। এ যা নাবছে সে জিনিস জল। এর নাম মৎর্
(অর্থাৎ বৃষ্টি)।’ সুদানী ছেলেটি আমায় বুঝিয়ে বললে,’আরবী ভাষায়
মৎর্ (বৃষ্টি) শব্দ আছে; কারণ আরব দেশে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়,
কিন্তু সুদানে যে আরবী ভাষা প্রচলিত সে-ভাষায় মৎর্ শব্দ কখনো
ব্যবহৃত হয়নি বলে সে শব্দটি সুদানী মেয়েছেলেদের সম্পূর্ণ অজানা।’
বেদে নামক নিবন্ধে লেখক প্রথমেই একটু ভূমিকা টেনেছেন। সেখানে
‘রাসল পাশা’র একটি বইয়ের কথা বলেছেন। এই বইয়ে রাসল পাশা মন্তব্য
করেছেন, পৃথিবীর সকল বেদের (জিপসী) ভাষা আদতে ভারতীয়। মুজতবা আলী
এটা বিশ্বাস করতে চাননি। সন্দেহ পোষণ করেছেন এভাবে:
“পণ্ডিত নই, তাই চট করে বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না। ইউরোপীয়
বেদেরা ফর্সায় প্রায় ইংরেজের সামিল, সিংহলের বেদে ঘনশ্যাম। আচার-ব্যবহারেও
বিস্তর পার্থক্য, বৃহৎ ফারাক। আরবিস্থানের বেদেরা কথায় কথায় ছোরা
বের করে, জর্মনীর বেদেরা ঘুষি ওঁচায় বটে, কিন্তু শেষটায় বখেড়ার
ফৈসালা হয় বিয়ারের বোতল টেনে। চীন দেশের বেদেরা নাকি রূপালি ঝরণাতলায়
সোনালি চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চুকুস চুকুস করে সবুজ চা চাখে”
কিন্তু নিজের জীবনের একটি ঘটনার শেষে তিনি বিশ্বাস না করে পারলেন
না। তখন তিনি জার্মানীর রাজধানীতে। বয়স ২৫/২৬। একদিন কলেজের পাশের
কাফেতে বসে কফি খাচ্ছিলেন। তখন এক বেদেনী তাকে ‘যবনিকা’ ভাষায়
কি জানি বলতে লাগল।
“সে ভাষা আমার চেনা-অচেনা কোন ভাষারই চৌহদ্দি মাড়ায় না, কিন্তু
শোনালো – তারই মুখের মত-মিষ্টি।”
পরে কাফে মালিক মুজতবা আলীর অনুরোধের প্রেক্ষিতে যখন বললেন যে
তিনি ভারতীয়, তখন মেয়েটা হুঙ্কার দিয়ে কাফেওয়ালাকে বলল,
“সেই কথাইতো
হচ্ছে। আমরা বেদে, ভারতবর্ষ আমাদের আদিম ভূমি। এও ভারতীয়। আমার
জাতভাই। ভদ্রলোক সেজেছে, তাই আমার সঙ্গে কথা কইতে চায় না।”
(পরে
মুজতবা আলীর সাথে আলাপচারিতায় জানা গেল। এরা বেদে, কিন্তু পড়াশোনা
করে না। তারা ভাবতেও পারে না, কোন বেদে কখনও পড়াশোনার চৌহদ্দি
মাড়িয়েছে)
“বুঝতে পেরেছি বাপু, বুঝতে পেরেছি; বাপ তোমার দু’পয়সা
রেখে গিয়েছে- হঠাৎ নবাব হয়েছ। এখন আর বেদে পরিচয় দিতে চাও না!
হাতে আবার খাতাপত্র- কলেজ যাও বুঝি? ভদ্রলোক সাজার শখ চেপেছে,
না?”
আমি বললুম, ‘ফ্রালাইন, তুমি ভুল বুঝেছ। আমার সাতপুরুষ লেখাপড়া
করেছে। আমিও তাই করছি। ভদ্রলোক সাজা না সাজার কোনো কথাই উঠছে না।’
মেয়েটি এমনভাবে তাকালো যার সোজা অর্থ ‘গাঁজা গুল’। জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি ভারতীয় নও?
‘আমি বললুম, ‘আলবৎ’!
আনন্দের হাসি হেসে বলল, ‘ভারতীয়েরা সব বেদে।’
আমি বললুম, ‘সুন্দরী, তোমরা ভারতবর্ষ ছেড়েছ, দু-হাজার বছর কিংবা
তারও পূর্বে। বাদবাকী ভারতীয়রা এখন গেরস্থালী করে।’
মুজতবা আলীর বক্তব্য মেয়েটা কিছুতেই বিশ্বাস করে নি। পরে জানাল
শহরের বাইরে রাখা তাদের সার্কাসের গাড়ি রাখা আছে। তার বাবা-মার
সাথে তর্ক করার আমন্ত্রণ জানাল। বলল -
”বাবা সব জানে। কাচের গোলার
দিকে তাকিয়ে সব বাৎলে দেবে।”
ভাষাতত্ত্ব নিবন্ধের একটি রসিকতা-
‘ফরাসী ভাষাটা সব সময় ঠিক বুঝতে পারি কি না বলা একটু কঠিন। এই
মনে করুন, কোনো সুন্দরী যখন প্রেমের আভাস দিয়ে কিছু বলেন, তখন
ঠিক বুঝতে পারি আবার যখন ল্যান্ডলেডি ভাড়ার জন্য তাগাদা দেন তখন
হঠাৎ আমার তাবৎ ফরাসী ভাষাজ্ঞান বিলকুল লোপ পায়।’
দাম্পত্য জীবন নামক নিবন্ধে তিনটি সংস্কৃতির দাম্পত্য জীবন নিয়ে
কাহিনী আছে। মুজতবা আলীর একজন চীনা বন্ধু ছিল। তারা দুজনে অফিস
ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই ক্লাবে এসে আড্ডা দিতেন। ক্লাবের এক কোনে নিমগাছের
তলায় বসে তারা গল্প-গুজবে মজে যেতেন, সাথে একজন ইংরেজ ।
কথায় কথায় তাদের মধ্যে একটি বিবাহিত জীবন নিয়ে আলোচনা শুরু হল।
প্রথমে ইংরেজের গল্প। তাঁর গল্পটি এরকম।
লন্ডনে একবার স্বামীদের বিরাট প্রতিবাদ সভা হচ্ছিল। মিছিল মিটিং
চলছে।
প্রসেশনের মাথায় ছিল এক পাঁচ ফুট টিঙটিঙে হাড্ডি-সার ছোকরা। হঠাৎ
বলা নেই, কওয়া নেই ছ’ফুট লম্বা ইয়া লাশ এক ঔরৎ দুমদুম করে তার
দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললে, ‘তুমি
এখানে কেন, তুমি তো আমাকে ডরাও না। চলো বাড়ি।’ সুড়সুড় করে ছোকরা
চলে গেল সেই খাণ্ডার বউয়ের পিছনে পিছনে।’
এবার চীনা বন্ধুর গল্প। চীনা গুণী আচার্য সূ রচিত শাস্ত্রে এই
ঘটনার উল্লেখ আছে।
একবার পেপিং শহরে অত্যাচার-জর্জরিত স্বামীরা এক প্রতিবাদ সভার
আয়োজন করেছিল। কিভাবে স্বামীদেরকে খান্ডার গৃহিনীদের হাত থেকে
উদ্ধার করা যায় সেই বিষয়ের আলোচনা সভার প্রধান উদ্দেশ্য। সভাপতি
ছিলেন ষাট বছর ধরে দজ্জাল গিন্নীর হাতে নিপীড়িত এক দাড়িওয়ালা অধ্যাপক।
সভায় বক্তারা নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বলে গেলেন। -”স্ত্রীলোকের অত্যাচারে
দেশ গেল, ঐতিহ্য গেল, ধর্ম গেল, সব গেল, চীন দেশ হটেনটটের মুল্লুকে
পরিণত হতে চলল, এর একটা প্রতিকার করতেই হবে। ধন-প্রাণ, সর্ব দিয়ে
এ অত্যাচার ঠেকাতে হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন সময় দারোয়ান হন্তদন্ত
হয়ে ছুটে এসে জানালো এ সভার খবর পেয়ে গিন্নীরা ‘ঝাঁটা, ছেড়া জুতো,
ভাঙা ছাতা’ ইত্যাদি নিয়ে তেড়ে আসছে। এ কথা শুনে তো সবাই পড়িমড়ি
করে পালিয়ে গেল। শুধুমাত্র সভাপতি তার আসনে শান্ত গম্ভীর মুখ নিয়ে
বসে আছেন। দারোয়ান কাছে গিয়ে বলল-
হুজুর যে সাহস দেখাচ্ছেন তাঁর সামনে চেঙ্গিস খান তসলীম ঠুকতেন,
কিন্তু এ তো সাহস নয়, এ হচ্ছে আত্মহত্যার শামিল। গৃহিনীদের প্রসেশনে
সক্কলের পয়লা রয়েছেন আপনারই স্ত্রী। এখনো সময় আছে। আমি আপনাকে
নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।। সভাপতি তবু চুপ। তখন দারোয়ান তাঁকে
তুলে ধরতে গিয়ে দেখে তাঁর সর্বাঙ্গ ঠাণ্ডা। হার্টফেল করে মারা
গিয়েছেন।
এবার মুজতবা আলীর পালা। গল্পটি অবশ্য পরিচিত।
রাজা নিজ বৌয়ের (রাণীর) অত্যাচারে মন খারাপ করে বসে আছেন। মন্ত্রী
কারণ জানতে চাইলে বললেন- “ঐ রাণীটা- ওঃ কি দজ্জাল, কি খাণ্ডার।
বাপরে বাপ! দেখলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।”
মন্ত্রী বললেন এ আর কি ব্যাপার, বউকে তো সবাই ডরায়। এজন্য মন খারাপ
করে বসে থাকতে হবে নাকি? রাজা বিশ্বাস না করলে মন্ত্রী জনসমাবেশের
ব্যবস্থা করলেন। সেখানে বলা হলো, যারা বউকে ভয় পায়না তারা একদিকে
আর যারা ভয় পায় তারা পাহাড়ের দিকে যেন যায়। মুহূর্তের মধ্যে পাহাড়ের
দিকটা ভর্তি হয়ে গেল। একজন শুধু ফাকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তখন
মন্ত্রী তাকে ডেকে বললেন-”তুমি যে বড় ওদিকে দাঁড়িয়ে? বউকে ডরাও
না বুঝি?”
লোকটা কাঁপতে কাঁপতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, ‘অত শত বুঝি নে, হুজুর।
এখানে আসবার সময় বউ আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, “যেদিকে ভিড় সেখানে
যেয়ো না।” তাই আমি ওদিকে যাই নি।’
এসব পড়তে পড়তে, কখন যে টুক করে সুদান, ইংলণ্ড, কায়রো, চিন এই
সব ঘুরে এলেন বুঝতে পেরেছেন? ফাঁকতালে শুনে নিলেন-ঘর গেরস্থালির
কথা!
ছবি ৯– গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন বইয়ের প্রচ্ছদ
|
রবীন্দ্রনাথ নিজেও যে একজন আড্ডাধারী ব্যক্তি ছিলেন সে কথাও অনেকে
ভুলে গিয়েছেন। মুজতবার ‘গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন’ বইটি তে শান্তিনিকেতনে
শিক্ষা লাভের কথা আছে। তবে তাঁর ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতন নিয়ে আরো
কিছু লেখার। জীবন সায়াহ্নে এসে অনেকের কাছে নিজের আগ্রহের কথা
জানিয়েছিলেনও তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর তা লিখতে পারেননি। শান্তিনিকেতনে
অবস্থানকালীন সময়ের কথা লিপিবদ্ধ করতে পারলে শান্তিনিকেতনের আড্ডার
অনেক কথাই জানা যেত।
সেই সময়ের কথাই যেন উঠে এসেছে গৌরকিশোর ঘোষের বক্তব্যে ‘মুজতবা
প্রসঙ্গ’ বইয়ে তিনি ‘তমোগ্ন মুজতবা’ নিবন্ধে লিখেছেন-
‘আড্ডা এবং সৈয়দ মুজতবা আলী, এছিল সমার্থক। এরকম আড্ডাধারী আর
হবে না; কেননা এত বিচিত্র বিষয়ে, এত সরস চুটকি ছেড়ে আড্ডাকে সর্বক্ষণ
জিইয়ে রাখার ক্ষমতা সকলের থাকে না। অমন মেজাজও না।...সৈয়দদার গোটা
জীবনটাই ছিল আড্ডা কেন্দ্রিক।’
মুজতবা আলী কথা বলতে শুরু করলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তা অব্যাহত রাখতে
পারতেন। এক কথায় বলা চলে তিনি ছিলেন অনর্গল বর্ষী। আজীবন আড্ডাধারী
মুজতবা আলী যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই জামিয়েছেন আড্ডার পাঠ। বিশ্বভারতীয়
প্রাঙ্গণে কিংবা বার্লিনের হিন্দুস্থান হাউসে, কায়রোর কফিখানায়
কিংবা নিজ আলয়ে যখন যেখানে অবস্থান করেছেন সেখানেই নিঃসৃত হয়েছে
তাঁর কথার ফুলঝুরি। আশ্চর্য হবার বিষয় ছিল, কথা বলার সময় উদ্ধৃতির
জন্য কখনও তিনি থমকে যেতেন না, এতই প্রখর ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কবিতা এবং ২৫ থেকে
৩০ শতাংশ প্রবন্ধ তাঁর মুখস্থ ছিল। মাইকেল মধুসুদন দত্তের মেঘনাধ
বধ কাব্য থেকেও অনর্গল বলে যেতেন তিনি।
বনফুল লিখেছিলেন :-
“শুধু জানি এই বাংলাদেশেই
রসিকদের হৃদয় স্বর্গের খুব উঁচু থাকে
রাখবে তারা তাদের মুজতবাকে ” ।
“ধন্য আশা কুহকিনী!”
অন্য আর পাঁচজন বাঙালীর মতই আড্ডা আমার প্রাণ। আবার শখও বিদেশ
ভ্রমণের কিন্তু নিরুপায়। তাই আজও নিজের বৈঠকখানা ঘরে বসেই যখন
একটু ‘ভূপর্যটনা’র সাধ হয়, হাত বাড়িয়ে টেনে নিই ‘রচনাবলী’। পাতা
ওলটাই আর চলে যাই কখনো প্যারিসের কাফেতে, আব্দুর রহমানের অতিথিশালায়,
বা জার্মানীর রাস্তায়। হাত ধরে থাকেন ‘সায়েড সায়েব’ – আর একাকী
নহে, দুজনে মিলে, “বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে” !
তথ্যঋণ :-
১। সৈয়দ মুজতবা আলী রচনা সমগ্র
২। বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকা :- কালের কণ্ঠ
৩। বাংলাদেশের ব্লগ :- বাঁধভাঙ্গার আওয়াজ ।
৪। সৈয়দ মুজতবা আলী :- জীবনকথা । লেখক :- অধ্যাপক নূরুর রহমান
খান, ঢাকা ।
লেখক পরিচিতি - প্রাক্তন ঔষধ বিপনন প্রতিনিধি। শখের
লেখালেখি করেন। বর্তমানে দমদমে বসবাস রত। প্রকাশিত বই: চাপড়ঘন্ট,
দোতালা বাস এবং নাট্যে উপেক্ষিত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।