বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা
ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫
ভ্রমণ-দৈলিপী
সুমিত রায়
একটু তলিয়ে দেখলে, ভ্রমণসাহিত্য ব্যাপারটা যে বেশ গোলমেলে, একথা
মানতেই হবে।
পুরাকালে পরিব্রাজকেরা প্রব্রজ্যায় বার হয়ে অন্য দেশের কথা লিখে
যেতেন, -- ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, এমন আরো কতো -- সব সত্যি নিশ্চয়,
কেননা তাই নিয়ে ইতিহাস লেখা হতো আর আমরা ইতিহাস পড়তে গিয়ে তাঁদের
নাম জানতে পারতাম। তারপর দুটো ঘটনা ঘটলো -- এক, ভ্রমণ ব্যাপারটা
নিয়ে যে ব্যবসা করা যায়, মানুষের মগজে সেই চিন্তা বাসা বাঁধলো।
মানে তার বিজ্ঞাপন আছে, কোথায় কোথায় যাবেন, কেমন করে যাবেন, কী
দেখবেন, কী না দেখলেও চলবে, কী কী খাবেন, কী কী খাবেননা, কোথায়
কতো গাঁটগচ্চার জন্য তৈরী থাকবেন আর সেই সঙ্গে গাঁটকাটাদের জন্যেও
-- এই সব ব্যবহারিক কথাবার্তা লিখে বিক্রি করা যায় আর মানুষে তা
কেনেও। আর দুই, লেখকেরা আবিষ্কার করলেন যে ভ্রমণের কথার ফাঁকে
ফাঁকে ইতিহাস, দর্শন, শিল্প, প্রেমের গল্প, এমনকি রহস্যকাহিনীও
একটু বুদ্ধি করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, লোকে চট করে খেয়াল করেনা আর
খেয়াল করলেও খুব একটা আপত্তি করে না। এই চালাকিটির সুবিধে হচ্ছে
প্রবন্ধ বা উপন্যাসের মতো আটঘাট বাঁধা, গবেষণা করা, যুক্তিগ্রাহ্য
ভাবে সব কিছু সাজিয়েগুছিয়ে পেশ করা, চরিত্রচিত্রণে গলদঘর্ম, ঘটনার
প্রবাহ ঠিকঠাক রাখা -- এ সব ছেঁড়া কাজে সময় ব্যয় করতে হয়না।
নিজে পড়েছি আর অন্যে পড়েছে এমন বইপত্র ঘেঁটে ভ্রমণসাহিত্য নিয়ে
কিছু তথ্য বার করা গেলো। স্টাইলের দিক দিয়ে দেখলে তা নিছক তথ্যমূলক,
ডকুমেণ্টারী, থেকে প্রেরণাত্মক, সাহিত্যগন্ধী থেকে সাংবাদিকসুলভ,
কৌতুককোমল থেকে যুক্তিপরুষ। কলমের ওপর দখল থাকলে বহু বিশেষ বিশেষ
শৃঙ্খলার তথ্য আর তত্ত্ব ভ্রমণসাহিত্যে খুব সুষ্ঠুভাবে ফোটানো
যায়। উদাহরণ: ভি. এস. নয়পলের গভীর অন্তর্দৃষ্টিময় প্রবন্ধ ("দি
উণ্ডেড সিভিলাইজেশন"), চার্লস ডারউইনের প্রকৃতিবিজ্ঞান ("দি
ভয়েজ অফ দি বিগল"), ওয়াশিংটন আর্ভিঙের সাহিত্যপদবাচ্য সাংবাদিকতা
("আল্হাম্ব্রা), রবীন্দ্রনাথের স্বচ্ছ দিনপঞ্জী ("য়ুরোপযাত্রীর
ডায়ারি"), জোসেফ কনরাডের বা জ্যাক কেরুয়াকের ঔপন্যাসিকতা
("হার্ট অফ ডার্কনেস" বা "অন দি রোড")। বৈচিত্র্য
ভালো কিন্তু এতো বৈচিত্র্যের একটা ঘোর অসুবিধে হচ্ছে কখন যে কোনো
একটা রচনাকে ভ্রমণসাহিত্য বলা যাবে আর কখন যাবে না সেইটা পাকাপাকিভবে
ঠিক করা তর্কসাপেক্ষ আর বিশেষ দুষ্কর হতে পারে। জল আরো ঘোলা করার
জন্য এক ভ্রমণসাহিত্যিক টমাস সুইকের উদ্ধৃতি দেওয়া যাক, --
"ভ্রমণসাহিত্যে
থাকবে উপন্যাসের মতো চরিত্র আর প্লট, কবিতার মতো চিত্রকল্প, ইতিহাসের
শিক্ষা, প্রবন্ধের যৌক্তিকতা আর স্মৃতিচারণের আত্মউপলব্ধি।"
গোলমেলে বলেছি কি সাধে!
এই খোঁজার সূত্রেই আরো দুটো লেখার ওপর নজর পড়লো।
"যদি সাহিত্যিক
রূপরীতির কথা বলতে হয়, তাহলে ভ্রমণসাহিত্য হলো হট্টগোলের টঙে আসীন
এমন এক ভরা হাট যেখানে সাহিত্যের নানা জাঁর এসে ভীড় করে ধাক্কাধাক্কি
লাগিয়েছে, তুমুল হল্লা। একই খদ্দেরকে নিয়ে মহাসমারোহে দরাদরির
ধুম লাগিয়েছে ব্যক্তিগত ডায়েরী, প্রবন্ধ, খোসগল্প, গদ্যকবিতা,
পদ্যকবিতা, দর্শন -- এ বলে আমাকে নাও, ও বলে আমিও আছি। বর্ণনাত্মক
আর যুক্তিভিত্তিক রচনার ধারা পাশাপাশি গলাগলি চলেছে যেন যমজ ভাই" --
লিখছেন জোনাথন রাবান। আর এক জায়গায দেখি এক সাক্ষাৎকারে ভি.
এস. নয়পল বলছেন,
"আমার বইগুলোকে ভ্রমণসাহিত্যই বলতে হবে বটে,
কিন্তু সেই আখ্যা আমাদের ভুল পথে চালিত করতে পারে। কেননা এককালে
এই সাহিত্যে ভ্রমণকারী মানুষেরা তাঁদের পথচলার বর্ণনা লিখতেন।
... আমি যা করি তা কিন্তু একেবারে ভিন্ন, ... আমি একটা থীম নিয়ে
পথ চলি, আমি ভ্রমণ করি এক বিশেষ অনুসন্ধিৎসা নিয়ে। ... আমি সাংবাদিক
নই, আমি বই লিখি আমার সেই অনুসন্ধানকে ঘিরে।"
স্মৃতির মণিকোঠায় দুটো আলো জ্বলে উঠলো, নয়পাল আর রাবান যা বলছেন
তার সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায় এমন কী দুটো বাংলা বই আমি পড়েছি
আমার যৌবনে? কাদের লেখা? বেশীক্ষণ স্মৃতি হাতড়াতে হলো না, আমার
অন্য কিছু সাম্প্রতিক রচনার তাগিদে যে সব লেখকের লেখার সঙ্কলন
ঘাঁটতে হয়েছে, সেখান থেকেই উত্তর পাওয়া গেলো। দুটি বইয়েরই লেখক
একজনই আর তিনি হলেন দিলীপকুমার রায়, সুরকার, গায়ক আর লেখক বলে
এককালে বাংলাদেশে বিশেষ খ্যাত ছিলেন।
দিলীপকুমার রায়
চিত্র সূত্রঃ http://www.aurobindo.ru/persons/00078_e.htm
|
দিলীপের ভ্রমণ, দিলীপের লেখা, তাই দৈলিপী। বিশেষণটি তাঁরই উদ্ভাবিত
ও ব্যবহৃত। ব্যুৎপত্তিটা বোঝা কঠিন নয়, যদিও কোনো বৈয়াকরণ এমন
প্রয়োগে সম্মতি দিতেন কিনা বলা কঠিন। জন্ম ১৮৯৭ সালে, দিলীপকুমারের
পিতা প্রথিতযশা সাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। অল্পবয়সে মাকে হারিয়েছিলেন,
দ্বিজেন্দ্রলাল একাধারে বাবা আর মায়ের স্নেহ দিয়ে তাঁকে বড়ো করছিলেন,
তারপর ষোলো বছর বয়সে দিলীপকুমার একেবারে অনাথ হন। শুধু সঙ্গীতেই
নয়, পড়াশোনাতেও তাঁর ভগবদ্দত্ত প্রতিভা, এতো দুঃখশোকের মধ্যেও
তিনি স্বল্পবয়সেই গান বুঝতে শিখেছেন, গান গেযে গায়ক বলে যশোলাভ
করেছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হবার পর বৃত্তি নিয়ে ইংল্যাণ্ডে
যান, কথা ছিলো আইসিএস হবেন কিন্তু ভবিতব্যে তা লেখা নেই তাই ইউরোপে
নানা দেশ ঘুরে সঙ্গীতে বিশেষজ্ঞ হয়ে দেশে ফেরেন। মৃত্যু ১৯৮০ সালে,
জীবদ্দশায় পঞ্চাশাধিক বই লিখেছেন -- উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা,
স্মৃতিকথার সঙ্গে ভ্রমণকাহিনীও আছে।
বিলেতে বছর তিনেক থাকার পর সঙ্গীতশাস্ত্রে স্নাতক হয়ে দিলীপকুমার
দেশে ফিরলেন। বিলেতে থাকার সময়েই তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীত শেখার
জন্য সারা ইউরোপ ঘুরেছেন আর সেই সুযোগে কথিকা আর প্রয়োগের সহায়তায়
ইউরোপীয় শ্রোতাদের ভারতীয় সঙ্গীত সম্বন্ধে অবহিত করেছেন। গানের
সঙ্গে তাঁর নাড়ীর যোগ, জ্ঞান হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি গান শিখতে
আর গাইতে শুরু করেছেন, ভারতীয় সঙ্গীতের তত্ত্ব আর তথ্য দুইই তাঁর
জানা আছে ভালো করে।
তাঁর কথাতেই বলি --
"দেশে ফিরে যখন প্রথম দেশবিদেশের গুণীর
গান শোনার খেয়াল চাপে, তখন আমি নিছক গান শোনার লোভেই পরিব্রাজক
হই। ... আমি বেরিয়েছিলাম আমাদের বর্তমান সঙ্গীতের মধ্যে যেটুকু
খাঁটি আর্ট আজও বিরাজ করতে সেটুকুর খবর নিতে। "
তখন তিনি
ফুটন্ত তরুণ, তিনি অক্লেশে সারা ভারত চরকি দিয়েছেন। আর সেই ভ্রমণের
কথা ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন, প্রথম "ভ্রাম্যমাণের দিনপঞ্জিকা"
নাম দিয়ে কিছু সাপ্তাহিক আর মাসিক পত্রিকায় আর বছর কয়েক পরে সেসব
সংগ্রহ করে বইয়ের আকারে, নাম "ভ্রাম্যমাণ"। প্রমথ চৌধুরী
স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেই বইয়ের একটি "পরিচায়িকা" লিখে
দেন, সেখানে বলছেন
"ভ্রাম্যমাণ বাঙলাভাষায় যথার্থ একখানি
অপূর্ব গ্রন্থ। ইতিপূর্বে এ-ধরণের বই কেউ কখনো লেখেননি। "
তারপর সে কথার সমর্থনে যুক্তি দিয়েছেন, যেমনটি তাঁর কাছ থেকে আশা
করা যায়। দেশ ঘুরেছেন "গান শোনার লোভে" বলছেন দিলীপকুমার,
প্রমথ চৌধুরী কিন্তু তার পিছনে দেখেছেন "বিদ্যা অর্জন করবার
অদম্য প্রবৃত্তি।" তিনি দেখছেন যে এই তাগিদ দিলীপকুমারকে
সত্যিই "ভ্রাম্যমাণ" করিয়েছে, আর তাঁর "ভ্রমণের
পথ বৃত্ত, সরল রেখা নয়। " সে কথার সমর্থনে দিলীপকুমার জানিয়েছেন
যে তাঁর এই ভ্রমণকাহিনীতে কোনো "ধারাবাহিকতা বা পর্যায়"
খুঁজে পাওয়া যাবে না, ভ্রমণের বইতে যে সব খুঁটিনাটি লোকে আশা করে,
তাও নেই। "তাহলেও", প্রমথ চৌধুরী বলছেন, "তিনি
ধ্যানস্তিমিত-লোচনে ঘুরে বেড়াননি ... এই অনন্যসাধারণ দেশভ্রমণে।
"
কী আছে এই ভ্রমণসাহিত্যে? আছে গানের জগতের মানচিত্র, সেখানকার
রীতিনীতির ব্যাখ্যান। মধ্যে মধ্যে একটু আধটু ভৌগোলিক তথ্যও এসে
পড়েছে, কিন্তু সব ছাপিয়ে যা আছে তা হলো সেই গানের জগৎ আর তার আশপাশের লোকজনদের র কথা, "গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি",
তখন যে ছবি দেখি তার কথা। একে কি ভ্রমণকাহিনী বলা ঠিক হবে, --
কোনো মূর্তির, মন্দিরের, ভাস্কর্যের ব্যাখ্যান নেই, নেই কোনো নিসর্গের
উচ্ছল বর্ণনা? আমি বলবো বিলক্ষণ, সঙ্গীতও শিল্প, কাজেই সাধারণ
ভ্রমণকাহিনীতে যে সব শিল্পকৃতির বিবরণ পাওয়া যায়, তার জায়গায় সঙ্গীত
শব্দটা বসিয়ে দিলেই হলো। আর মানুষের গল্প হলো যে কোনো ভালো ভ্রমণকাহিনীর
মেরুদণ্ড বিশেষ, তার তো কোনো অভাবই নেই এখানে। এ ছাড়া অন্তঃসলিলা
হয়ে যে স্রোতটি এই কাহিনীর তলায় তলায় বয়ে চলেছে, সতর্ক পাঠক যার
কম্পন টের পাবেন, পেয়ে উল্লসিত হবেন, সেটি হলো সঙ্গীতশাস্ত্রের
গভীর তত্ত্ব আর দর্শনের কথা, আর সেই সূত্রে দিলীপকুমারের নিজের
সঙ্গীত-উপলব্ধি আর চিন্তার বিবর্তনের কথা। তাঁর ভবিষ্যতের অসাধারণ
উজ্জ্বল সঙ্গীতব্যক্তিত্বের আবির্ভাব আর বিকাশের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত
পাওয়া যাবে এই ভ্রমণকাহিনী থেকে।
বইটি সাড়া তুলেছিল,নাম আর বদনাম, দুদিকেই। পঁয়ত্রিশ বছর পরে বইটির
দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হয়, তার ভূমিকায় দিলীপকুমার লিখছেন,
"একসময়ে 'ভ্রাম্যমাণের দিনপঞ্জিকা' সঙ্গীতকোবিদদের কাছেও
আদরণীয় ছিল। এমনকি স্বনামধন্য গায়ক ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ও একবার
আমাকে বলেছিলেন যে, পুরাকালে তিনি এ-বইটি থেকে নানা সঙ্গীততথ্য
তথা তত্ত্ব আহরণ করতেন। "
শুধু এই শংসাবাণীটির জন্যই দ্বৈরথ
যুদ্ধে নামা যায়। খুসী হয়েছেন যে তখন যে সব কথা বলার কারণে তাঁকে
গঞ্জনা সইতে হয়েছিলো, "আমার [যে-সব] মন্তব্য আজ সবাই মেনে
নিয়েছেন। " প্রথম সংস্করণে ভাষার কিছু আড়ষ্টতা ছিলো বলে মনে
হয়েছে, তার সংস্কার করেছেন, আর জুড়ে দিয়েছেন তাঁর সঙ্গীত সাধনার
আখ্যান -- ওই অন্তঃসলিলা যে স্রোতটির কথা আগে লিখেছি, তারই বহিঃপ্রকাশ।
একত্র সমস্ত সংযোজনের নাম হয়েছে "পুনর্ভ্রাম্যমাণ",
বইটির নাম "ভ্রাম্যমাণ"ই আছে, "রচনাসংগ্রহ"এর
প্রথম খণ্ডে লেখাটি পাওয়া যাবে।
যাত্রা শুরু লক্ষ্ণৌতে, তারপর গেছেন রামপুর, বেরিলি, দিল্লি,
আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন। তাজমহল দেখে লিখলেন "...মুগ্ধ হয়েছিলাম
এ কথা বলাই বেশি। তবে তাজমহল সম্পর্কে উচ্ছ্বাস করে লাভ নেই"
- ব্যস। গানবাজনার খবরের ঘাটতি নেই কিন্তু -- ভালো, মন্দ, কেন
ভালো, কেন মন্দ, কেন ভালোর চেয়ে মন্দই বেশী দেখছেন -- যাঁরা উচ্চাঙ্গ
সঙ্গীত বোঝেন বা অন্তত কৌতূহলী, তাঁদের পোয়া বারো। মাঝে মধ্যেই
যেখানে গেছেন সেখানকার মানুষদের আর প্রচলিত প্রথা -- বেশীর ভাগই
নাচগান সম্পর্কিত -- নিয়ে মনোজ্ঞ মন্তব্য করছেন, যেমন লজ্জাশীলা
গুজরাটি মেয়েরা কেমন স্বচ্ছন্দে গর্বা নাচে যোগ দিচ্ছেন, তার কথা।
ভ্রমণে বার হবার আগেই দিলীপকুমার লক্ষ্য করেছেন যে সাহিত্য থেকে
শুরু করে অভিনয়, চিত্রকলা আদি সব সুকুমার শিল্পে একটা নবযুগের
অভ্যুত্থান হচ্ছে, কেবল হিন্দুস্তানি সঙ্গীত তার নমনীয়তা, তার
সৌকুমার্য সব হারিয়ে কেমন যেন প্রস্তরীভূত হয়ে এসেছে, ঐতিহ্যের
জুজুর ভয়ে ঠিক চর্চাটি আর হয়ে ওঠে না। তিনি অবশ্য শুধু এই পতনের
দিকে আঙুল দেখিয়েই থেমে থাকতে চান না, সে পতন রোধ করার উপায়ও বাৎলাতে
চান। তাই তিনি বেশ ঋজু মাপকাঠি নিয়ে যন্ত্র আর কণ্ঠ, দুই সঙ্গীতকলার
শিল্পীদের উপস্থাপনা যাচাই করেছেন, সারা ভারতজোড়া নাম, এমন ওস্তাদদের
গায়ন বা বাদনরীতির কঠোর সমালোচনা করতে পিছপা হননি। এদিকে আবার
যখন তাঁর মনের মতো কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন তার প্রশংসাতেও তিনি
অকুণ্ঠ। দিলীপকুমার যাঁদের কথা লিখেছেন তাঁদের অনেকেই আমাদের দূরবীক্ষণের
সীমার বাইরে কিন্তু আমাদের চেনা অনেক দিকপালদের কথাও বলেছেন, দিলীপকুমারের
মতো গভীর সঙ্গীতগুণীর আতসকাঁচ ভাষ্যে তাঁদের প্রতিভার দীপ্তি আরো
উজ্জ্বল। সে তালিকায় আছেন বাংলার বাইরে আলাউদ্দিন খান, আবদুল করিম
খান, ফৈয়াজ খান, বিষ্ণুদিগম্বর পালুসকর প্রমুখ, আর বাঙালী সঙ্গীতগুণীদের
মধ্যে রাধিকামোহন, জ্ঞান গোস্বামী, ভীষ্মদেব, তারাপদ চক্রবর্তী,
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। এতো তারকার মধ্যে তাঁকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ করেছিলেন
পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে -- সেটা বোঝা সহজ কেন না দুজনেরই
সঙ্গীতের প্রয়োগ ছাড়াও তত্ত্ব বিষয়ে বিশেষ ঔৎসুক্য ছিলো, এবং দুজনেই
সেই তত্ত্বের বিশেষ গভীরতায় পৌঁছতে পেরেছিলেন। এই বইতে পণ্ডিতজীর
সংক্ষিপ্ত জীবনী, ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে তাঁর অভূতপূর্ব গবেষণার কথা,
পণ্ডিতজীর সঙ্গে সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা -- এসব দিলীপকুমার লিখেছেন
বড়ো যত্ন নিয়ে, বারবার পড়া যায়।
সংযোজনে লিখেছেন নিজের সঙ্গীতশিক্ষার ইতিহাস -- সেও একরকম পরিক্রমা
বটে তবে আমাদের বর্তমান রচনার সংজ্ঞায় ঠিক নাও মিলতে পারে। এই
পর্ব যখন লিখেছেন তখন তিনি ভক্ত সাধক, কেবল ভক্তিমূলক গানেরই চর্চা
করে থাকেন, দেশে নানা জায়গায় আমন্ত্রিত হয়ে জনসমাগমে কীর্তন, ভজন,
বিশেষত মীরা ভজন বা তাঁর শিষ্যা ইন্দিরার লেখা ভজন গান করেন। সেই
সূত্রে তিনি আবার ভ্রাম্যমাণ, উত্তর ভারতের যেসব জায়গায় আগে গিয়েছিলেন
সেসব জায়গা, আর কিছু বেশীই হবে, তারই বিবরণ লিখেছেন। তবে এবারে
উদ্দেশ্য আর গান শোনা নয়, গান শোনানো তাই লেখার ধারা অন্য রকম।
আবার লিখেছেন অনেক মানুষের কথা -- আলাউদ্দিন খান, রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণান
ইত্যাদি -- আর এখন দিলীপকুমার তাঁর শৈলীর শিখরে পূর্ণ মর্যাদায়
বিরাজমান, কোনো একটা সাক্ষাৎকারের কথা দিয়ে শুরু করে কথায় কথায়
কোথায় কোথায় চলে যাচ্ছেন। বলছেন পিতা দ্বিজেন্দ্রলালের কথা, দেখাচ্ছেন
ভগবৎপ্রেম আর দেশপ্রেমের যোগসূত্র, শ্রীঅরবিন্দকে তো আসতেই হবে,
সাধিকা মীরার কথা হচ্ছে, তাঁর ভজনের টিকা দিচ্ছেন, ফাঁকে ফাঁকে
উদয়পুরের নিসর্গের বর্ণনা এসে পড়ছে -- চারুভাষণের মহাভোজ। আর নৈবেদ্যের
ওপরের সন্দেশটির মতো আছে গান গেয়ে এক হতদরিদ্র মুসলমান কৃষাণের
কাছ থেকে তিনি কী উপহার পেলেন তার কথা -- পদ্যে লেখা! নয়পাল সায়েব
তাঁর লেখা ভ্রমণসাহিত্য নিয়ে যা বলছেন তা সব খেটে যায় এই বইটার
ক্ষেত্রে।
পণ্ডিচেরী অরবিন্দ আশ্রমে প্রায় দশ বছর অজ্ঞাতবাসে কাটিয়ে দিলীপকুমার
জনসমক্ষে বার হবার অনুমতি পেলেন গুরুর কাছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই
--
"...সদলবলে কাশ্মীর গিয়েছিলাম। অতঃপর পেশোয়ার ও শিলং,
সিলেট। তারপর যাই একা হায়দ্রাবাদ ও ঔরঙ্গাবাদ। ... এ কয়টি ভ্রমণের
খবর দিয়েছিলাম চিঠিতে ... এ ঢঙের সুবিধা এই যে, এতে প্রথম গদ্য
ও পদ্য তথা কাব্য মিশিয়ে লেখা চলে স্বচ্ছন্দে; দ্বিতীয়, ব্যক্তিগত
কথার অবতারণা করা যায় অকুতোভয়ে। "
চিঠির ব্যাপারটা শিখেছিলেন
অবশ্য তাঁর "কবিবরের" কাছ থেকে -- য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র,
জাভাযাত্রীর পত্র আর রাশিয়ার চিঠি লিখে যে পথিকৃৎ বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের
পথ কেটে দিয়ে গেছেন। গদ্য-পদ্যের অবাধ মিশ্রণটা দিলীপকুমারের নিজস্ব
এবং মনোরম, যেমন তাঁর শিষ্যা হাসিকে বলছেন "তুমি ছড়ায় চিঠি
চেয়েছ", বলে ছড়াতেই চিঠি লিখে দিয়েছেন।
১৯৪০ সালে দিলীপকুমার এই ভ্রমণের কাহিনী প্রকাশ করেছেন "ভূস্বর্গ
চঞ্চল" নাম দিয়ে [রচনাবলী ৩]। ত্রিশ বছর পরে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের
সময় অনেক কাটছাঁট করেছেন, অন্যত্র লিখেছেন বলে আসামপর্ব একেবারে
বাদ। সেই অধুনা চালু সংস্করণটিতে তেরোটি পরিচ্ছেদ, পরিচ্ছেদকে
তিনি বলছেন "উল্লাস", প্রতিটি উল্লাস এক একটি চিঠি,
বিভিন্ন প্রিয়জনকে লেখা। যাঁরা পড়তে ভালোবাসেন তাঁদের জন্য প্রতিটি
"উল্লাসে" উল্লসিত হবার মতো অনেক কিছু আছে। তার কারণ
এই ভ্রমণকাহিনীতে দিলীপকুমার একেবারে বাঁধনহারা -- একদিকে নিসর্গের
কাব্যময় (সময় সময় আক্ষরিক অর্থে) বর্ণনা থেকে শুরু করে তাঁর সঙ্গী-সঙ্গিনী
আর পথে দেখা মানুষদের নিয়ে মন্দভালো-হাসিকান্নার কথা বলে তাঁর
নিজের গভীর চিন্তা, অনুভূতি, তাদের বিশ্লেষণ ও ধর্ম-দর্শনের তত্ত্বালোচনা,
-- একটু ধৈর্য নিয়ে পড়লে সবই পাওয়া যাবে। তাঁর লেখার প্রসাদগুণ
অনস্বীকার্য, জ্ঞান গভীর, উপস্থাপনা, যদিও সুসংহত বলা যায় না,
চিত্তাকর্ষক, সংলাপ মঞ্জুভাষ। মোহিতলাল মজুমদার বইটি পড়ে "অকুণ্ঠে
প্রশংসা করেননি ... কিন্তু বলেছিলেন এ-বইটি সাহিত্য-পাংক্তেয় হয়েছে"
-- দিলীপকুমারের তা পছন্দ হযেছিলো, তিনি ভূমিকায় একথা লিখেছেন।
প্রসঙ্গত দিলীপকুমার খুব একটা ঢাকাঢুকির মানুষ ছিলেন না, নিজের
ত্রুটি আর স্খলন নিয়ে তাঁর অসঙ্কোচ স্বীকৃতিও পড়তে ভালো লাগে।
দিলীপকুমার রায় ও উমা বসু
চিত্র সূত্রঃ http://www.aurobindo.ru/persons/00078_e.htm
|
"ভ্রাম্যমাণ"-এ দিলীপকুমার বেরিয়েছিলেন খুব সংহত একটা
উদ্দেশ্য নিয়ে। এবারে তা নয়, নিছক সবান্ধবে ভ্রমণ ছাড়া আর কোনো
উদ্দেশ্য নেই। ঠিক বলা হলো না বোধহয় কেননা সঙ্গে নিযেছেন তাঁর
সদ্যোবিধবা বোন মায়াকে, তাঁর স্বাস্থ্যোদ্ধারের কারণে। আরো ছিলেন
সপরিবার ধরণী বসু,তাঁর কন্যা অসাধারণ গায়িকা উমা বসু, হাসি, ছিলেন
দিলীপকুমারের প্রিয় শিষ্যা। গান ছাড়া দিলীপকুমারকে কল্পনা করাই
দুষ্কর, কাজেই গানে উমা আর নাচে তাঁর ভাগ্নী এষা, সোনায় সোহাগা,আর
দিলীপকুমার নিজে তো আছেনই। দিলীপকুমার ছিলেন আনন্দময়, রসিক, জীবনপ্রেমী
পুরুষ, অরবিন্দআশ্রমে দশ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে গুরুর আদেশে কর্মযোগের
অভ্যাস ঠিক তাঁর চরিত্রানুগ নয় একথা নিশ্চিত বলা যায়। আমার মনে
হয় যে সেই তপোক্লেশ থেকে অন্তত সাময়িক মুক্তি পেয়ে দিলীপকুমার
তাঁর জীবনকে তার সহজ আনন্দোচ্ছল গতি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এবং
সেই আনন্দের প্রকাশ তাঁর এ রচনায় উপচে পড়েছে।
গৌরচন্দ্রিকা করে যাত্রা শুরুর কথা লিখে লাহোরে দেখা পেয়েছেন
ধর্মবীর দম্পতীর, তাঁরা তাঁর এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ইংল্যাণ্ড
বাসকালীন বন্ধু। সেই উপলক্ষ্যে সুভাষচন্দ্রের কথা উঠেছে, আর সুভাষচন্দ্রের
কথা উঠলে দিলীপকুমার থামতে পারেন না, তাই সে কথা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
বা উল্লাসে পৌঁছেছে। তারপর সদলে চললেন পেশোয়ার হয়ে কাশ্মীরের পথে
-- খেয়ে, খাবার কথা লিখে, গেয়ে, গানের গল্প করে। গাইডবুক হাতে,
ক্যামেরা চোখের যে পর্যটকের দল,, দিলীপকুমার সে দলে পড়েন না, সে
কথা পরিষ্কার বলে দিলেন গোড়াতেই --
"ঐতিহাসিক চিহ্ন দেখা
কারুর কারুর মানস স্বাস্থ্যের অনুকূল হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে
অবান্তর। ... কাশ্মীরের পথে যেতে কী যে ভালোই লাগল। ঐতিহাসিক ঘনঘটার
কোনো বালাই-ই নেই এই রাজ্যে। দুধারে শুধু সৌন্দর্যের জয়ধ্বনি।
"
একেবারে গোড়াতেই বললেন যাতে ইতিহাস-ঘেঁষা পাঠক পরে তঞ্চকতার
অভিযোগ তুলতে না পারেন। তারপর তাঁর অনন্য ভঙ্গীতে সেই সৌন্দর্যের
কথা বলতে থাকলেন, মনে রাখতে হবে দিলীপকুমারের কাছে এই সৌন্দর্য
শুধু নৈসর্গিক নয়, এ সৌন্দর্য প্রকটভাবে মানবিকও। উপমাটা একটু
স্থূল হলেও, এর মধ্যে দেশী-বিদেশী নাচগানের কথা থেকে থেকেই পাওয়া
যাচ্ছে, বাদশাহী পোলাওয়ে (দিলীপকুমার লিখছেন "পোলোয়া",
কতোদিন পরে এই কথাটা দেখলাম) কিসমিসের মতো। ঝিলম নদী দেখলেন, কাশ্মীরে
ডাল হ্রদে থাকলেন, দেখা হলো মহাত্মা গান্ধী আর সীমান্ত গান্ধীর
সঙ্গে। গুণীজনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কথা লিপিবদ্ধ করায় দিলীপকুমারের
লেখনীর ঔৎকর্ষ অবিসংবাদিত -- পরিসর স্বল্প, কিন্তু এখানেও তার
ব্যতিক্রম হয়নি।
কাশ্মীর পর্ব শেষ করে শিলঙে এলেন শিষ্যা হাসির বাবা ধরণী বসুর
অতিথি হয়ে। সময় কাটছিলো আনন্দে, এর মধ্যে সদলে শিলচরে যাবার পথে
দারুণ বাস দুর্ঘটনায় অল্পবিস্তর আহত হলেন সবাই, ধরণী বসু প্রাণ
হারালেন। অদ্ভুত সংযমের সঙ্গে দিলীপকুমার এই শোকের মোকাবেলা করেছেন
তাঁর রচনায়, প্রলাপ তো নেইই, বিলাপও নয়। দিলীপকুমার উপনিষদ মানেন,
প্রিয়জনকে অগ্নির হাতে সমর্পণ করার পর যে উপনিষদ নির্দেশ দেন,
"স্মর, কৃতং স্মর"। দিলীপকুমার তাই করেছেন, পরম স্নেহে
আর শ্রদ্ধায় মানুষ ধরণী বসুকে স্মরণ করেছেন, স্মরণ করেছেন তঁর
কীর্তিকে। বাকী বইতে ঘুরে ফিরে তাঁর কথা এসেছে, মৃত্যুও এসে উঁকি
মেরেছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই, দিলীপকুমার তাকে ভয় করে নয়, তাকে
মেনে নিযে জীবনের জয়গান করে তার পাল্টা দিয়েছেন। বাকী বইতে দাক্ষিণাত্য
ভ্রমণের কথা আছে, হায়দ্রাবাদ, নক্শাপুর, এলোরা। বালাসরস্বতীর
নাচ দেখলেন, গান শুনলেন, মুগ্ধ হলেন আর নিজের অনুকরণীয় রীতিতে
দুচারকথায় উত্তর ভারতীয় আর কর্ণাটিক সঙ্গীতের তুলনা লিখলেন। আগে
ইতিহাস আর প্রস্তরমূর্তির প্রতি অনীহার কথা খুব জোরগলায় বলেছিলেন
বটে কিন্তু এলোরা গুহায় ঢুকে তাঁর নিরাসক্তি গেলো ভেসে, উচ্ছ্বসিত
হয়ে এলোরার শিল্পের কথা লিখলেন, ভারতবর্ষের ঐতিহ্য, দর্শন বাদ
পড়লো না, প্রমাণ সাইজের কবিতাও দুচারটে জুড়ে দিলেন। প্রসঙ্গত "পোলোয়া"-র
কিসমিস, অর্থাৎ গানের কথা যথারীতি উপস্থিত। এই লেখাটি একেবারে
জোনাথন রাবানের রেসিপি-মতন।
শিষ্যা ইন্দিরার সঙ্গে দিলীপ কুমার
রায়
চিত্র সূত্রঃ http://www.harikrishnamandirindiraniloy.com/
|
১৯৫০ সালে শ্রীঅরবিন্দের মৃত্যুতে দিলীপকুমার তাঁর জীবনের ভারসাম্য
হারিয়ে ফেললেন। আশ্রমে মন টেঁকেনা, তিনি কী করবেন তার হদিশ করতে
পারেন না। এই চিত্তচাঞ্চল্যের মধ্যে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে আমন্ত্রণ পেলেন সেখানে গিয়ে ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে বক্তৃতা দেবার।
আগে ১৯২৭ সালে আমেরিকা যাবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, পথে বেরিয়েও
পড়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতে পারেননি। ইউরোপ ঘুরেই
চলে এসেছিলেন। এবারে আর তা করলেন না, বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে পথে
বার হলেন, সঙ্গে নিলেন শিষ্যা ইন্দিরাকে, তিনি প্রস্তুত দিলীপকুমারের
গানের সঙ্গে ভারতীয় নৃত্যকলা পরিবেশন করতে। দিলীপকুমার বিদেশে
যাচ্ছেন জেনে ভারতসরকার তাঁকে ভারতের সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে পাঠাতে
চাইলেন, দিলীপকুমারের কথায়, "নিরীহ সাংস্কৃতিক পরিবেশককে
[যখন] রাজমহল থেকে ভাতা দিয়ে করা হল রাজপ্রতিনিধি", তাঁর
ভ্রমণসুচী আর শুধু আমেরিকাতেই আটকে রইলো না, তিনি পূর্বদিক দিয়ে
উড়ে ১৯৫৩ সালে প্রায় ছমাস ধরে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে তবে ফিরলেন।
চীন, জাপান, আমেরিকার বড়ো বড়ো শহর, তেমনি ইউরোপের বড়ো বড়ো শহর,
কায়রো হয়ে বাড়ী।
তারপর সেই ভ্রমণের কথা লিখে রাখলেন তাঁর প্রমাণ সাইজের "দেশে
দেশে চলি উড়ে" বইতে [রচনাবলী ৪]। খুব নাম করেছিলো বইটা, চারটে
সংস্করণ হয়। সাধারণ ভ্রমণকাহিনী যেমন হয়,-- গেলাম, পথক্লেশ পেলাম,
দেখলাম, দেখে চমৎকৃত হলাম, ভালো ভালো মানুষদের সঙ্গে আলাপ হলো,
ওদেশের ব্যাপারস্যাপার কী তাজ্জব ভাই, ইত্যাদি-- দিলীপকুমারের
লেখা সেই ছাঁচের সবচেয়ে বেশী কাছে এসেছে এই বইটিতে, বিশেষত ইউরোপের
কথা যেখানে লিখেছেন। বার্ট্রাণ্ড রাসেলের সঙ্গে পুনঃসাক্ষাতের
কথা আছে তবে অতি স্বল্পসময়ের বলে সে কথায় ধার বা ভার কিছুই নেই
তেমন। ইতিহাস আর মূর্তিদর্শন তাঁর খুব একটা পছন্দ নয়, সে কথা আমরা
আগের লেখা থেকে জানি কিন্তু এবারে ইন্দিরাকে দেখাবার দায়ে লুভ্র্সহ
প্যারিসের নানা যাদুঘরে চক্কর দিতে হয়েছে। স্নেহের বিড়ম্বনা। জার্মানী,
সুইজারল্যাণ্ড, ইটালী, কায়রো ভালো লেগেছে -- শেষের তিনটে জায়গায়
বোধহয় এই প্রথম পদক্ষেপ -- তাই পুরনো দৈলিপী চাল ধরা গেছে আবার।
কিছু নিসর্গ, কিছু মানুষের সৃষ্টি, কিছু মজার আর ভালো মানুষ, --
ছোটো ছোটো ছবি, তাতে গান আর ধর্মের একটু আধটু ছিটে লেগেছে।
জাপান আর আমেরিকাই এবারের প্রধান আকর্ষণ, লিখেছেনও বেশ ফলাও করে।
রবীন্দ্রনাথের "জাপান-যাত্রী"র কথা মনে পড়ে গেলো। ভালোলাগা
মন্দলাগার হিসেব কষলে দুজানেরই শেষপর্যন্ত জাপান ভালোই লেগেছিলো।
রবীন্দ্রনাথের রচনায় জাপানের থেকে অনেক বেশী কথা জলপথে জাপান-যাত্রা
নিয়েে, দিলীপকুমার তো উড়েই গেলেন ফুড়ুৎ করে, তা নিয়ে লেখার কিছু
নেই। জাপানীদের গৃহসজ্জা, বিনীত ব্যবহার, অনাবিল আতিথেয়তা তাঁদের
ভালো লেগেছিলো, সঙ্গীত আর নাটক ভালো লাগেনি। রবীন্দ্রনাথ অনেকদিন
জাপানে কাটিয়েছেন, লিখেছেনও অনেক কিছু -- যেমন জাপানী চিত্রকলা
নিয়ে, এ ব্যাপারটা আবার দিলীপকুমারের ঠিক আসে না। যেটা নজরে না
পড়েই পারেনা, সেটা হলো রবীন্দ্রনাথ জাপানের ইতিহাসের ধারা অনুসরণ
করে আজকের জাপানীদের চরিত্র আর ব্যবহার নিয়ে সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন।
আর দিলীপকুমার যে ইতিহাস নিয়ে বেশী ঘাঁটাঘাঁটির দিকে ঘেঁষেন না,
সে আমাদের আগের লেখাতেই জানিয়েছেন। অমার্জনীয় অপরাধ নয়, তবু তুলনা
করলেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথের রীতি রচনায় একটা বুদ্ধিগ্রাহ্য মনোহারিত্ব
এনে দেয়।
এই বইয়ের বড়ো অংশটাই আমেরিকা নিয়ে। তার মধ্যে তিনটি বিষয় বারবার
দেখা যাচ্ছে তাঁর লেখায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তার একটা হলো নানান
প্রযুক্তি আর দৈনন্দিন জীবনে তাদের প্রয়োগের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে
তাঁর অকৃত্রিম বিস্ময়। প্রথম তো বিরাট নিঃশব্দ গাড়ী করে
মসৃণ রাস্তায় পাড়ি দেওয়া। তারপর রেডিও টেলিফোন, ভেণ্ডিং মেশিন,
এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, সিনেরামা ইত্যাদি। ওদিকে আবার মানুষজনের
কথাবার্তা আর ব্যবহারও তাঁকে চমকে দিচ্ছে -- চিকাগোয় এক মহিলা
সর্বসমক্ষে বললেন তিনি বহুবল্লভা, কোথায় এক নিগ্রো কুলি অবিশ্বাস্য
পরিমাণ মাল বইছে, এমনতরো আরো কিছু। আর দিলীপকুমার শিশুর মতো আনন্দে
উচ্ছল হয়ে তা উপভোগ করছেন আর লিখছেন।
তিনি যা করতে এসেছিলেন, অর্থাৎ বিদেশের মানুষদের ভারতের সংস্কৃতি
সম্পর্কে কিছু জানানো, সেই সূত্রে যেসব জলসা করেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন,
এমনকি গান শিখিয়েছেন, সেখানকার শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া, প্রশ্ন,
উত্তর এসবের কথা লিখেছেন। তাঁর এবং ইন্দিরার যৌথ কন্সার্ট বারবার
শ্রোতাদের মন জয় করতে পেরেছে, সে খবরটা তো আমাদের ভালো লাগবেই,
আরো মজা পেয়েছি কতো বিচিত্র উপায়ে তিনি দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ
করেছেন তার কথা পড়ে। মনে রাখতে হবে যে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে দিলীপকুমার
ছিলেন একেবারে প্রথম সারির, তিনি বাংলা, হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত,
ইংরেজী আর ফরাসী -- এ সব ভাষায় গান করতে পারতেন এবং করেছেন। দর্শকদের
সঙ্গে তাঁর প্রশ্নোত্তরের বিবরণ যা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তা প্রায়ই
শিক্ষা বা ব্যাখ্যামূলক, তাদের থেকে ভারতীয় সঙ্গীত সম্বন্ধে কিছু
শেখা যায়। আর বোঝাতে হয়েছে বিদেশীদের, কাজেই তাঁর "সাঙ্গীতিকী"
বা ওই ধরনের বইতে যেমন আটঘাট বেঁধে, শাস্ত্রমাফিক সংজ্ঞা আর শব্দ
ব্যবহার করে বিষয়টা বুঝিয়েছেন এখানে তা করতে পারেননি, কাজেই সহজ
ভাষায় আর রীতিতে বলতে হয়েছে। এমনটি তাঁর অন্য কোনো বইতে দেখিনি,
বিশেষ চিত্তাকর্ষক, তা মানতেই হচ্ছে।
আর আছে মানুষের সঙ্গে তাঁর দেখা আর আলাপের কথা। অনেক জায়গায় ঘুরলেন
তাই অনেক লোক, অনেকরকমের লোক। তাদের মধ্যে অনেকে দিলীপকুমারকে
মুগ্ধ করেছে, তার স্বীকৃতিতে তিনি বইটি উৎসর্গ করেছেন তাঁদের --
"আমাদের বিশ্বভ্রমণ সার্থক হয়েছে যাঁদের প্রসাদে -- ",
তার পরের তালিকায় পঁচাত্তরটি নাম আছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই নিজের
নিজের বিষয়ে কৃতবিদ্য আর যশস্বী, তার মধ্যে অল্ডাস হাক্সলি আর
ক্রিষ্টোফার ইশারউডের নাম এবং তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কথা মনে
রাখার মতো (লণ্ডনে বার্ট্রাণ্ড রাসেলও এই দলে পড়বেন)। গুণীজনদের
সঙ্গে সাক্ষাৎকার আর তার বৃত্তান্ত লেখায় দিলীপকুমার বিশেষ খ্যাত,
এখানেও তার অন্যথা হয়নি। এঁদের, এবং এই চক্করে পরিচিত কিছু মানুষের
সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যতে বিস্তৃত পত্রালাপ হয়েছিলো, তার কিছু চয়ন করে
একটা সংযোজন তৈরী হয়েছে, সেটিও পড়তে ভালো লাগে।
প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলেন,
"... স্বদেশকে ঘরে বসে
যে-চোখে দেখি বিদেশে গেলে আর তাকে সে-চোখে দেখা যায় না -- যেতে
পারে না। আমেরিকা সম্বন্ধে ও আমাদের মাতৃভূমি সম্বন্ধে দৃষ্টান্ত
দেব। "
ঠিকই তো, যদিও কথাটা এভাবে আগে শুনিনি। খুব কৌতূহলী
হয়ে রইলাম হয়তো এই বাড়তি দেখাটার কথা খুলে লিখবেন। ভূমিকাতেই লিখছেন
যেভাবে আমেরিকান সভ্যতাকে কল্পনা করেছিলেন ঠিক তেমনটি নয়। পাশাপাশি
আমাদের দেশের ছবি দাঁড় করিয়ে উপলব্ধি করেছেন যে আমাদের দেশ এক
অনন্য মহিমায় উজ্জ্বল -- "সে মহিমার পরম স্বরূপ -- ধর্ম।
" এমন কথাই দিলীপকুমারের কাছ থেকে আশা করা যায়, জীবনের আধ্যাত্মিক
দিককেই তিনি আশৈশব গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন, আর এই ভ্রমণের কালে তিনি
শ্রীঅরবিন্দের শিক্ষার পূর্ণ স্নাতক। আবার বলেছেন, "আমার
এ দেখার খবর আমি সাধ্যমতো কিছু দিতে চেষ্টা করেছি এ-বইটিতে। "
আমি যতোটা আশা করেছিলাম তার কাছাকাছি কিছু পেলাম না, হয়তো যুক্তিবাদী
মন নিয়ে পড়ার কারণে ভক্তিবাদী ছবিটা আমার অগোচরই রয়ে গেলো। যদি
পাঠক এর কিছু ব্যত্যয় দেখে আমায় জানান তাহলে কৃতজ্ঞ থাকবো। ওঁর
অন্য দুটো ভ্রমণকাহিনীর তুলনায় এটি প্রচলিত ভ্রমণকাহিনী বলতে যা
বোঝায় তার অনেক কাছাকাছি, সুখপাঠ্য তো বটেই। সেই কারণে চারটে সংস্করণ
হবার মতো জনপ্রিয় হযেছিলো বোধহয়। তবে ওঁর আগের দুটোতে ব্যক্তিগতভাবে
আমার চমক লেগেছিলো, ভালো লেগেছিলো বেশী। এ নিয়ে মতানৈক্য হতেই
পারে।
দিলীপকুমারের ভিন্ন স্বাদের পোষাকী ভ্রমণকাহিনী বলতে এই তিনটেই,
["এদেশে ওদেশে" নামে বইটির নাম ভ্রমণকাহিনী বলে দেখছি
দুয়েক জায়গায়, জোগাড় করতে পারিনি] যদিও এদের যা উপাদান সেই একই উপাদান সহযোগে লেখা আরো কয়েকটা বই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। যেমন,
ইংল্যাণ্ডে থাকার সময় তিনি সারা ইউরোপ ঘুরে অনেক গুণীজনের সংস্পর্শে
এসেছিলেন আর সেসব দিয়ে শুরু করে আরো কিছু সাক্ষাৎকার যোগ দিয়ে
লিখেছিলেন "তীর্থঙ্কর" বইটি, ইংরেজীতে অনূদিত হবার পর
খুব খ্যাতি পায়। সে বইতে মানুষের কথা আছে, দেশবিদেশের কথা আছে
কিন্তু সেটিকে তাঁর ভ্রমণকাহিনীর মধ্যে ধরা হয়না। কেন হয়না তার
কারণ শুধু উপাদানের উপস্থিতি নয়, তাদের মাত্রার হ্রস্বদীর্ঘ বিচারও
বটে, যেমন মুলতান রাগে পঞ্চম কম লাগালে তাকে আর মুলতান বলা হয়
না, সে হয়ে যায় তোড়ী। সেসব বিষয় পণ্ডিতদের তকরারের বিষয়, আমাদের
তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। দিলীপকুমারের এই তিনটি বইই মোটামুটি
জনপ্রিয় হয়েছিলো, একাধিক সংস্করণ তার প্রমাণ (নিজেও সে জনপ্রিয়তার
কথা লিখেছেন), শেষেরটির তো চতুর্থ সংস্করণ হয়েছে দেখছি। যাই হোক,
আর সব কিছুর মতন দিলীপকুমারও একদিন জনচিত্ত থেকে মুছে গেলেন, তাঁর
অন্য সব বইয়ের সঙ্গে এ বইগুলোয় মহাফেজখানার অন্ধকার কোণে হারিয়ে
গেলো। ভেবে দেখুন আজকাল কজন লোক আর "পালামৌ" বা "পথে
প্রবাসে", চাইকি "রাশিয়ার চিঠি" পড়ে? দিলীপকুমারের
গানই আমরা হারিয়ে ফেললাম (সে কথা অন্যত্র লিখেছি)। তবে আমার মতে
বাঙলা ভ্রমণসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বইযের একটা তালিকা যদি কখনো তৈরী
করা হয় তাহলে শুধু বিষয়-বর্ণালী বিচারের ভিত্তিতেই দিলীপকুমারের
"ভূস্বর্গ চঞ্চল" সে তালিকায় বেশ উপরের দিকে জায়গা পেতে
পারে। অন্য দুটিও ফেলে দেবার মতো নয়। সুখের কথা যে তাঁর স্থাপিত
হরিকৃষ্ণ মন্দির সংস্থার আগ্রহে আজকাল তাঁর বাংলা রচনাসমগ্র উজ্জ্বলকুমার
মজুমদারের উৎকৃষ্ট সম্পাদনায় আর আনন্দ পাবলিশার্সের প্রকাশনে সুলভ।
লেখক পরিচিতি - পাঁচ দশক হোলো আমেরিকাবাসী।
চাকরীজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র।
অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী, নিউ
জার্সিতে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ও তিনটি সফল রবীন্দ্রমেলার
সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গীতবিতান.নেট
রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট,
সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। "অবসরের"
সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।