বিবিধ প্রসঙ্গ
জুন ১৫, ২০১৬
প্রকৃতির বিচার
মধুমিতা ভট্টাচার্য
আজকাল চারিদিকে মাথা-গরম লোকের ছড়াছড়ি। আগেরদিনে বাপ দাদারা বলতেন বড়দের আর শিক্ষকদের মান্যি করে চলতে। প্রতিবাদী আগুনে সেসব এঁদো-পচা চিন্তাধারা পুড়েঝুরে সাফ। এখন শুধু গরম হাওয়ার যুগ।
জন্ম মুহূর্তে শিশু হাপুস কেঁদে প্রতিবাদ জানায় মাতৃগর্ভে তার এতদিনের নিশ্চিন্ত সুখের আশ্রয়টি নস্যাত হওয়ার দুঃখে। একটু বড় হতেই স্কুলে ভর্তির চাপ, তখনও প্রতিবাদ, “যাবনা ইশকুলে, যাও, এত সব পড়াশুনো পোষাবে না। কী করবে কর”। বোর্ডের পরীক্ষা, সেখানেও সেই একই প্রতিবাদ। “পরীক্ষাই দেবনা, ব্যস, লোকে মুখ্যু বলবে? তাতে কী! তোমার বাড়িতেই থাকব না আর, চললাম বাড়ি ছেড়ে”। অভিভাবকের তখন হেঁচকি ওঠে এসব মাথা গরম ছেলেপুলেদের সামলাতে।
শহরে আজকাল আকছার প্রতিবাদ চলে। ছোট ছেলেমেয়েরাও বাপ-দাদার ঘাড়ে চেপে সেসব মিছিলে যায়। তাদের কচি মাথা বাতানুকুল হোক বা না হোক, আর সব মাথা গরম লোকেদের দেখে সেও হাত-পা ছোঁড়ে। বুঝুক না বুঝুক। সবার মাথায় আগ্নেয়গিরি অবিরাম ধিকিধিকি জ্বলছে যা সহজে বুদ্ধিভ্রংশ ঘটাবার উৎকৃষ্ট অনুপান!
এই তো সেদিন ট্রেনে চেপে যাচ্ছিলাম কলকাতার পথে। ট্রেন খচাখচ ভরা। বাতানুকুল টু-টায়ার বগীর ওপরের বার্থে বসেছিলেন এক প্রায়-প্রবীণা। তিনি আসছিলেন উত্তরবঙ্গের কোনও শহরতলী থেকে। ঝালমুড়িওয়ালার চামচ আর টিনের বাক্সে বাজানো সুমধুর ঠং ঠং শব্দে উঠে বসে বললেন, “এই ছোকরা, মুকেও একটা ঝালমুড়ি দে কেনি”।
সাথে ছিলেন ওনার সুপুত্র সহ আরো অনেকে। মায়ের ঝালমুড়ি পিপাসা দেখে পুরো পরিবারের ঝালমুড়ি খাওয়ার সাধ জাগল। ঠং ঠঙিয়ে নাহোক করে প্রায় সাত আট প্যাকেট ঝালমুড়ি বানালো সে মুড়িওলা। ওপরের বার্থে বসে মহিলা সুখাবেশে চোখ বন্ধ করে ঝালমুড়ি খেলেন। ওপাশে আমার জায়গায় বসেই আমি ভালভাবেই ওনাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। এতক্ষণ ঠিকঠাকই চলছিল সব। আমিও সদ্য কেনা একটা ম্যাগাজিন দেখছিলাম মন দিয়ে। মিনিট দশেক পরেই হঠাৎ কানে এল তুমুল উত্তেজিত কন্ঠে বাদ-বিবাদ। একটু কান করে শোনার পর বুঝলাম, মাসিমার ঝালমুড়ি খাওয়া শেষ হওয়ার পর কোলে আর বসার জায়গায় যতগুলো মুড়ি পড়েছিল সেই সবটুকু ঝেড়েঝুড়ে নীচে ফেলেছেন ঠোঙা সমেত। বলা বাহুল্য সেগুলো সমস্তই গিয়ে পড়েছে নীচে বসা দম্পতির গায়ে, মাথায়, সিটে এবং বাকিটুকু অবশ্যই মেঝেতে। ঝালমুড়ির আগে সম্ভবতঃ বাদাম এবং ছোলাভাজাও খাওয়া হয়েছিল দু-এক দফা। মুড়ির সাথে সেগুলোর খানিক খোসা ইত্যাদিও ঝাঁপ দিয়েছে নীচতলার সহযাত্রীদের ওপর। ব্যস আর যায় কোথায়! লেগে গেল ধুন্ধুমার। লাগ ভেলকি...লাগ...লাগ...লাগ...। তর্ক বাড়তে বাড়তে তুমুল ঝগড়া! নীচের দুজন যুগলবন্দীতে যতনা চেঁচান ওপরের মহিলা তার দ্বিগুণ ফেরত দেন। সাথে রীতিমত গালমন্দ। “আমি একটা মেইয়েমানুষ, মুড়ি ঝাড়িতে নীচে নাববো না বাইরে যাব, এ্যাঁ? আপনাদের মাথাত এটুকু বুদ্ধিও নাই? কোনও মেইয়েমানষি কে দ্যাকেচেন বাইরে গিয়ে এসব ফেলাইতে? এট্টু পরেই তো লোক এইসে ঝাড়ু দিবে, দ্যাকো নাই আগে? এট্টু ঝালমুড়ি আর বাদাম পড়িচে তার লিগে কি অত সমিস্যা... অ্যাঁ? ঝগড়া কত্তি এসিচে, হুঃ”?
অকাট্য যুক্তি। মেয়েমানুষ নীচে নেবে মুড়ি বাদামের উচ্ছিষ্ট ফেলবে? এ কী অন্যায় আবদার! দেখলাম নীচে বসা দম্পতি খানিকক্ষণ গজগজ করতে করতে মাথা টাথা ঝেড়ে বাদাম আর মুড়ি ফেলতে লাগল। তারপর খাবারের পুঁটুলি খুলে বসল। ততক্ষণে ট্রেনের মেঝেময় মুড়ি বাদামের আলপনা।
বিশ্বায়নের জমানায় আজ সবাই সবার প্রতিবেশী। মানচিত্রে দাগানো সীমারেখাটি নেহাতই তুচ্ছ রেখামাত্র। তদুপরি ফেসবুকের ফস্কা-গেরোয় নিখিল-বিশ্ব চোখের সামনে দিনভর দোদুল্যমান, কিম্বা বলা ভাল স্ক্রিনের ওপারে জম্পেশভাবে জাজ্বল্যমান। বন্ধু তালিকায় সারা পৃথিবীর লোক মজুদ। তবে তা আপনার ফেসবুক-তৎপরতার ওপর নির্ভর। যদি রোজ মধ্যরাতে উলুক-সদৃশ ভাঁটা চোখে ল্যাপ্টপটিকে কুক্ষিগত করে আন্তর্জাল-বাগিচায় ঘুরে বেড়াতে পারেন, তবেই এর সারমর্ম বুঝবেন, নাহলে নয়।
গরমকাল এলে আর কথাই নেই। এক প্যাচপ্যাচে গরমে প্রায় রাত প্রায় দুটোয় আমার কম্পিউটারের পর্দায় বার্তা এল, “হাই পঙ্কু, হাওজ় ইউ” (শুদ্ধ ইংরিজি কে চায়?)! আমি তখন উঠব ভাবছিলাম, ঘুমেরও তো দরকার। বিদেশবাসী সেই বন্ধুর ওখানে তখন দুপুর দুটো। মধ্যাহ্নভোজন সেরে আয়েস করে ভার্চুয়াল পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছেন। আমিও এটা-সেটা দু-চার কথার চালাচালি করলাম ঢুলতে ঢুলতেই।
তিনি জানালেন ওদেশে নাকি বরফ পড়ছে। আ-মোলো যা। আমি এদিকে গরমে আকুল! পাখা, এসি, হাতপাখা কোনও কিছুর ঝাপটেই দাপুটে গরমকে বশে আনতে পারছিনা, উনি মাতলেন তুষারপাতে। এ যেন অনশনরত নেতাকে তাজ-হোটেলের মেনু কার্ড পড়ে শোনানো। ঘাড়ের কাছে ঘামাচির কুটকুটি নিয়ে কার ভালো লাগে ভীনগাঁয়ের শীতল-কাব্য শুনতে! ঘুমটা চোখের কোণা-খামচিতেই ঘোরাফেরা করছিল, সেই অজুহাতে আলাপচারীতে ইতি টেনে বাঁচলাম।
ধান ভান্তে শিবের গাজন গাইছি? এ-ও যুগেরই হাওয়া। সোজা-সাপটা কথা আজকাল কেউ বলে? সোজা আঙুলে ঘি ওঠে কস্মিনকালে? সোজাকে সোজাভাবে বলা ভারী অন্যায়! আজকাল যে যা তাকে তা বলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
তা অন্যায়ের কথা-ই যখন উঠল, তখন বলি, আজকাল সর্বংসহা-পবিত্রপ্রাণা-প্রকৃতিদেবীও কম যাননা। তিনিও ইদানীং পক্ষপাত-দোষে দুষ্ট। কেন? তবে শুনুন।
ওই যে বললাম যখন এক দেশে গরমে প্রাণ আইঢাই, তখন আরে প্রান্তে লোকে জোড়া-কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে! এদিকে যদি অনাবৃষ্টি, আরেক দিকে অতিবৃষ্টির অনাসৃষ্টি! এপাশে যদি ঝড়ের তাণ্ডব, ওপাশে বয় নবীনবসন্তের ঝিরিঝিরি মলয়-বাতাস। এগুলো অন্যায় নয়? তার ওপর গ্রীষ্মে গরম, বর্ষায় বৃষ্টি, শীতে হাড়কাঁপানী উত্তুরে হাওয়া ইত্যাদির জুলুম তো আছেই।
আমার কথাই ধরুন, এই পাগল করা গ্রীষ্মে ঘরের ভেতরটুকু যদি বা বাতানুকুলের আনুকুল্যে শীতল, বাইরে ট্রামে, বাসে, হাঁটা-পথে উপায়?! স্নানঘরেও গরমের উৎপাত। রান্নাঘর অগ্নিকুণ্ড! তবে কিনা ওটা হচ্ছে গিন্নির দপ্তর। কাজেই ছোটখাটো সমস্যা। আমি বড় বড় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে থাকি। প্রাত্যহিক চাল, ডাল, তেল, নুনের হিসেব আমার আবার পোষায় না।
সকালে বাজারে যেতে হয় চাপে পড়ে। নইলে আমি ও পথে পা মাড়াতে চাইনা সচরাচর। আজও গেছিলাম। তা সেখানে একজন একটা ইস্তেহার ফট্ করে গুঁজে দিলো হাতে। আমিও পরে দেখব ভেবে সেটাকে পকেটে চালান দিয়ে ট্যাংরা মাছের দর করতে লাগলাম। মাছের মধ্যে ট্যাংরা আমার আবার বিশেষ প্রিয়। গিন্নি খ্যাংড়া নিয়ে তেড়ে আসবেন জানি কারণ রান্নার মাসি আজ না আসার ফরমান দিয়ে রেখেছে দুদিন আগেই। তবু নিলাম। মাঝে মাঝে এভাবেই আমার প্রতিপক্ষ মানে আমার অর্ধাঙ্গিনীর সাথে আমি লড়াই করে থাকি। তখন নিজেকে বেশ বাঘ বাঘ মনে হয়। অন্য সময় অবশ্য বাঘের মাসি হয়ে থাকারই পক্ষপাতি আমি। তাতে সাপও মরে লাঠিও ভাঙ্গেনা।
সে যাক। বাজার সেরে ঘেমে-নেয়ে ঘরে ফিরে পাখাটা চালাতে গিয়ে দেখি লোড-শেডিং। দেহ-জুড়োনোর আশায় ছাই।
“কি মাছ”?
“ইয়ে ...ওই মানে ট্যাংরা”।
“ট্যাংরা? কতটা”?
“এক কিলো”। মিনমিন করে বলি।
“দুজনের জন্যে এক কিলো? জানো না কমলা দুদিন ছুটি নিয়েছে? আজই ট্যাংরা না আনলে চলছিল না? এখন এতগুলো মাছ কে সাফ করবে আর কে-ই বা রাঁধবে? তুমি? নড়েও তো বসবে না। তার ওপর এই গরম! শরীরে একটুও দয়ামায়া নেইগো? বুঝবে ঠ্যালা যেদিন চিতেয় উঠব। খেও তখন ট্যাংরার তেল-ঝাল তরিজুত করে”।
বুঝলাম হাওয়া একটু বেশিই গরম হয়ে গেছে। বেগতিক দেখে আমি কোনওরকমে গিন্নির হাতে ট্যাংরার থলি তুলে দিয়েই পত্রপাঠ বসার ঘরে নিজেকে চালান দিই। গিন্নির সামনে থেকে সরে এসে এবার মনে মনে শ্রীমান সাহসের দেখা পেলাম। সে বড় অসময়ে আমায় ছেড়ে পালায়। বিশেষ করে গিন্নির সামনে এলেই তার যেন মৃগী ব্যারাম হয়।
এখন চা চাওয়াটা নিরাপদ নয় ভেবে চুপচাপ খবরের কাগজটা নিয়ে আরামকেদারায় সেঁধোই। আজ ট্যাংরা আনাটা বোধহয় সত্যিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। তবু প্রাণের কোন গভীরে কে জানে আমার সেই বাঘটা “ঘেঁআউ” বলে একবার আলতো জানান দিতেই চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। গরম হাওয়া আর তেমন গরম লাগল না।
তখনই আচমকা ইস্তেহারটার কথা মনে পড়তে পকেট থেকে কাগজটা বের করলাম। ঘামে আগাগোড়া সিঁটকে গেলেও দিব্যি পড়া যাচ্ছে। দেখলাম বাতাবরণ-দিবস উপলক্ষে কাছাকাছিই মাঠে বিরাট জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। অত্যাধুনিক উপায়ে গরমকে বাগে আনা হবে। আলোচনায় এক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। তারই আমন্ত্রণ-পত্র। ক্যালেন্ডারে দেখি আজই সেই দিন! নাঃ যেতে হচ্ছে একবার। কি ব্যাপার দেখে আসা যাক।
বিকেলে গিন্নির কাছে বিধিপূর্বক অনুমতি নিয়ে গুটিগুটি হাজির হলাম সেই সভায়। প্রকৃতিদেবীকে কোণঠাসা করা হবে, সোজা কথা?
বহুদিনের জমানো দাড়ি-গোঁফ, উস্কো-খুস্কো চুল, মোটা কাঁচের চশমা আর বেঢপ জামা-কাপড় পড়া একজন মঞ্চে উঠতেই বুঝলাম ইনিই সেই বৈজ্ঞানিক-বক্তা (ওঁদের দেখলেই বোঝা যায় কিনা)!
প্রকৃতিদেবীর বিরুদ্ধে ঝাড়া একঘণ্টা জ্বালাময়ী বক্তৃতার পর তাঁকে কাবু করার অসাধারণ অত্যাশ্চর্য্য উপায় বাতলালেন তিনি। প্রবল হর্ষধ্বনি উঠল।
অতঃপর চতুর্দিকে বার্তা রটিল এবং জোরদার কর্মযজ্ঞ চালু হইল। বৈজ্ঞানিকের পরামর্শমত দেশের প্রতিটি গাছে আর ল্যাম্প-পোস্টের গায়ে একটা করে এয়ার-কুলার বসানো হবে। কতগুলো লাগবে সেই সংখ্যাটা হিসেব করতে সাহস পেলাম না তেমন। মানে বেশ কয়েক কোটির নীচে তো নয়ই। কানাঘুষো গরম দূর হবে অচিরেই। আবহাওয়া ঠান্ডা থাকলে মানুষের মাথাও কারণে-অকারণে গরম হবেনা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা দূর হয়ে শান্তি কায়েম হবে আর শান্তিময় দেশের অগ্রগতি অবশ্যম্ভাবী।
অর্থাত, প্রগতির আসল চাবিকাঠিটি এতদিন প্রকৃতির হাতেই চুপিসারে গচ্ছিত ছিল। আমরাই অজ্ঞান ছিলাম এযাবত্।
অসুখটা খুব জোর ধরা পড়ে গেছে। মোক্ষম ওষুধও আবিষ্কার হয়ে গেল এবার। আর ক’দিনেই নির্ঘাত সেরে উঠব। যখন তখন ট্যাংরা মাছ খাওয়ারও বাধা থাকবে না আর।
শান্তি এল বলে! ঘরে বাইরে উভয়তঃই।
লেখক পরিচিতি - লেখালিখিকে ভালবাসার সূচনা আসানসোলে, স্কুলবেলা থেকে। কলেজবেলার শুরু থেকে বারো বছর শান্তিনিকেতনে ওতপ্রোত হয়ে থাকা। সংসারসূত্রে প্রথমে আসাম ও এখন ডুয়ার্সের হরিয়ালি চা বাগানের বাসিন্দা। প্রকাশিত কবিতার বই "নক্ষত্র নাবিক"। লেখা (কবিতা, গল্প ইত্যাদি) প্রকাশিত হয়েছে 'দেশ', 'কৃত্তিবাস', 'সানন্দা, 'এবেলা', 'ফেমিনা(বাংলা)', ও আরও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।