প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

 

মেরে ঘর সে য়ে সামান নিকলা

প্রবুদ্ধ মজুমদার


(১)

পাঁচ থেকে পনেরো জোড়ী লাইনের এক একটি ঘজল। পাঁচ থেকে পনেরো বুঁদ চোখভেজানো জল। চোখের জল‚ কারণ ঘজলের জন্ম হয় দর্দ থেকে। এক ব্যথাতুর ক্ষতবিক্ষত শায়র লিখেছেন‚

চিপক রহা হ্যায় বদন পর লহু সে পয়রাহাঁ
হমারী জেব কো অব হাজাত-এ-রফু ক্যা হ্যাঁয়।

(রক্তে ভিজে শরীরে চেপে ধরেছে আমার জামা‚ এই জামার ছেঁড়া পকেটে আর সেলাই করার দরকারই বা কী।)

ঘজলের মজমুন বা থীম হলো মুহব্বত। সব দর্দের জড়‚ শিকড় হলো মুহব্বত। আশিক যদি মুহব্বতের বদলে নজরান্দাজ করে‚ উপেক্ষা করে‚ এমনকি ঘৃণাও করে‚ তাতেও পরোয়া নেই‚ বেশরম শায়র সুরায় ডুবে যেতে যেতে বলতে পারেন‚

দিখাকে জম্বীশ-এ-জব হী তামাম কর হমকো
না দে যো বোসা‚ তু মুহসে কহীঁ জবাব তো দে
পিলা দে ওক সে সাকী যো হমসে নফরৎ হ্যাঁয়‚
পিয়ালা গর নহী দেতা ন দে‚ শরাব তো দে।

(ঠোঁটের কম্পন দেখিয়ে আমায় মাৎ করে দে তুই‚ চুম্বন না দিস মুখ খুলে জবাব তো দে। আঁজলা থেকে আমায় সুরা পান করিয়ে দে‚ আমায় ঘৃণা করিস বলে পানপাত্র দিবি না তো দিস না‚ সুরা তো দে। )

মুহব্বতে পাগল হলে কি এমনি বৈপরীত্যের জন্ম হয়। কেউ কাউকে ঘৃণা করলে কি আঁজলা থেকে সুরা পান করিয়ে দিতে পারে। এরকম একটা লাইন পড়লেই তো মনে নেশা ছেয়ে যায়‚ তাহলে যে এরকম লিখতে পারে সে তো নেশায় আকন্ঠ ডুবে। সাদা চোখে কি আর ঘজল লেখা যায়।

এবার একটা গোটা ঘজল পড়া যাক‚ তাহলে এর গঠনটা বোঝা যাবে।

ও আকে খাব মেঁ তসকীন-এ-ইজতিরাব তো দে
ওয়ালে মুঝে তপিশ-এ-দিল‚ মজাল-এ-খাব তো দে
(আমার স্বপ্নে এসে দুশ্চিন্তাগুলোকে শান্ত করে দে‚
এই জ্বলন্ত হৃদয়কে স্বপ্ন দেখার শক্তি তো দে)

করে হ্যাঁয় কত্ল লগাবত মেঁ তেরা রো দেনা
তেরী তরহ কোঈ তেঘ-এ-নিগহ কো আব তো দে
(তোর এই ভালোবাসার কান্না আমায় যে মেরে দিলো
তোর মতো আর কেউ কি আমার রাগী চোখে জল এনে দিতে পারে)

দিখাকে জম্বীশ-এ-লব হী তামাম কর হমকো
না দে যো বোসা‚ তু মুহসে কহীঁ জবাব তো দে
পিলা দে ওক সে সাকী যো হমসে নফরৎ হ্যাঁয়‚
পিয়ালা গর নহী দেতা ন দে‚ শরাব তো দে।

আসাদ খুশী সে মেরে হাথ পাঁব ফুল গয়ে
কহা জো উসনে জারা মেরে পাঁব দাব তো দে

(আসাদ‚ খুশীতে আমার হাত পা ফুলে গেছে‚
ও যে আমায় ওর পা টিপে দিতে বলেছে)

প্রতি দুই লাইনের জোড়ী এক একটি শের। শের মিলে মিলে হয় শায়রী‚ অর্থাৎ কবিতা। শায়রী তা সে নজম হতে পারে‚ যার লাইনে লাইনে মিল। বা কাশিদা হতে পারে‚ যা কিনা কাউকে প্রশস্তি করে লেখা ode‚ বা ঘজল হতে পারে। ঘজলের প্রথম দুই লাইনকে বলা হয় মতলা। প্রতি লাইন জোড়ীর শেষে একটা শব্দ ঘুরে ফিরে আসবে‚ যাকে বলে রদীফ। এখানে রদীফ হল “তো দে”। রদীফের ঠিক আগের শব্দটি হল কাফিয়া। উপরের ঘজলে দেখা যাবে কাফিয়াগুলির ছন্দমিলের জন্যই ঘজলটি শুনতে এতো লিরিক্যাল লাগছে। মজাল-এ-খাব‚ আব‚ জবাব‚ শরাব‚পাঁব দাব। প্রতি জোড়ীর মিটার বা মাত্রা হবে একেবারে সমান‚ যাকে বলে বেহের। আর শেষ দুই লাইনকে বলে মখতা‚ যেখানে শায়র তাঁর তখল্লুশ‚ বা নাম লিখে জানাবেন এই ঘজল তাঁরই সন্তান।

মির্জা আসাদুল্লাহ বেইগ খান নিজের তখল্লুশে কখনো লিখতেন আসাদ‚ মানে সিংহ‚ আবার কখনো লিখতেন ঘালিব‚ মানে প্রভাবশালী‚ দাপুটে। তুরস্ক থেকে এঁর ঠাকুর্দা মির্জা কুকান বেইগ খান তরবারি হাতে হিন্দুস্তানে এসেছিলেন যোদ্ধা হিসেবে‚ আর তাঁরই নাতি কাগজে কলমের যে আঁচড়ের শব্দ করলেন‚ তাকে স্বর্গীয় বললে স্বর্গ লজ্জা পাবে।

আতে হ্যাঁয় ঘইব সে য়ে মজামীন খয়াল মেঁ
ঘালিব‚ সরীর-এ-খাম নবা-এ-সরোশ হ্যাঁয়।

(কোন গোপন যায়গা থেকে বেরিয়ে এলো এই ভাব‚ ঘালিব তোর কলমের আঁচড়ে কাগজে ফুটে ওঠে স্বর্গীয় শব্দ কতো।)

মির্জা কোকুন বেইগ খান দ্বিতীয় শাহ আলমের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। এ শহর সে শহর ঘুরে শেষে তিনি আগ্রায় ঘর বসালেন। দিল্লী তখন আন্ধেরা নামছে‚ সব রোশনাই লখনৌতে। এঁর দুই ছেলে কখনো লখনৌ‚ কখনো আলোয়ার‚ কখনো বা নিজামের হয়ে লড়েছেন। আলোয়ারে এমনি এক যুদ্ধে বড় ছেলে মির্জা আবদুল্লহ বেইগ খান যখন দেহ রাখলেন‚ আসাদের বয়স তখন মাত্র পাঁচ (জন্ম 1797)। কাশ্মীরী মা ইজ্জতউতনিসা বেগম আর কাকা মির্জা নাসরুল্লহ মিলে আসাদকে বড় করলেন। যুগের নিয়ম মেনে তেরো বছর বয়সেই আসাদের শাদী হয়ে যায় ফিরোজপুরের নবাব খানদানের মেয়ে উমরাও বেগমের সাথে। বড়ঘরের দামাদ আসাদকে কখনো কখনো অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছে ঠিকই‚ কিন্তু একেবারে দিন আনি দিন খাই কোনোদিনই করতে হয়নি।

নিজের বিবাহিত জীবনকে ঘালিব বলতেন দ্বিতীয় কয়েদখানা। পোষা টিয়াপাখীকে ঘালিব বলছেন‚ তুই ওরকম ঘাড় মুচড়ে বসে আছিস কেন‚ তোর তো আর বিয়ে হয়নি। উমরাওয়ের ধর্মের প্রতি খুব ভক্তি ছিলো‚ ঘালিব কাফিরদের মতো সুরা ও জুয়ায় মেতে থাকতেন বলে দুজনের থালাবাসন আলাদা রাখা হতো‚ উমরাও ঘালিবের থালায় খেতেন না। তবে ঘালিবও সারাদিন নিজের মতো করে কাটালেও রাতে ঘরে ফিরে আসতেন। এঁদের সাত সন্তানই ছোটোবেলায় মারা যায়। ঘালিবের যেরকম জীবনদর্শন ছিলো তাতে বিবাহিত সংসারী জীবন খাপ খায় না। তবু হয়তো ঘালিব উমরাওকে নিয়েই খুশী ছিলেন। উমরাও-ও হয়তো ঘালিবের সুরা জুয়া নারীসঙ্গ, বন্ধুসঙ্গ, লেখালেখি এসবকে মেনে নিয়েছিলেন। ঘালিবের দিওয়ান বা পদ্যসংগ্রহে উমরাও পুরোপুরি উপেক্ষিতা।


(২)


হোগা কোই অ্যায়সা ভি যো ঘালিব কো ন জানে
শায়র তো উওহ অচ্ছা হ্যাঁয় পর বদনাম বহুত হ্যাঁয়

(ঘালিব লেখে তো ভালই‚ কিন্তু বাজারে খুব বদনাম। )

ঘালিবের তালিম নিয়ে কিছু জানা যায় না। তিনি কোথায় পড়াশোনা করেছেন‚ কোথা থেকে লিখতে শিখলেন এসব জানা নেই। অল্প বয়সে হরমুজদ নামে এক শিক্ষিত পার্সী ব্যাক্তির কাছ থেকে তিনি ফার্সী শিখেছিলেন। বিয়ের পরেই তিনি বৌকে নিয়ে দিল্লে চলে আসেন। বোধ হয় কাকা মামা বা শ্বশুরবাড়ীর বোঝা হতে চাননি। ওদিকে উনিশ বছর হতে হতেই ওঁর বেশীরভাগ উর্দু শায়রী লেখা হয়ে যায়। এরপর কোনো কারণে উর্দু ছেড়ে তিনি ফার্সীতে লিখতে শুরু করেন। প্রায় কুড়ি বছর ফার্সীতে লিখলেও লোকে ওঁকে মনে রাখবে ওঁর উর্দু শায়রীর জন্যই।

১৮২৬-এ ঘালিব কলকাতায় আসেন। কতদিন ছিলেন জানি না‚ কিন্তু সেসময় তিনি মুঘল দিল্লী আর ব্রিটিশ কলকাতার ফারাকটা লক্ষ করেছিলেন। কলকাতায় থাকার সময় ওঁর পালিত সন্তান অরিফ শৈশবেই মারা যায়। শায়র তো শুধু শায়রীই করতে পারেন‚ অরিফের মৃত্যুর খবরে শোকার্ত ঘালিব লিখলেন‚

হাঁ অ্যায় ফলক-এ-পীর‚ জওয়ান থা অভী অরিফ
ক্যয়া তেরা বিগাড়তা যো না মরতা কোই দিন অওর ?

(ও আসমানের পীর‚ জওয়ান আরিফ আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে তোমার কি অসুবিধা হতো। )

ঘালিব কিন্তু শুধু চোখ বুঁজে কাব্য করে যাননি। দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর দিকে তাঁর নজর ছিলো। স্যার সৈদ আহমদ খান আইন-ই-আকবরীর ওপর একটি বই লিখে ঘালিবকে তার তকরিজ (ভূমিকা) লিখে দিতে বলেছিলেন। ঘালিব খুব কড়া ভাষায় একখানি শায়রী লিখে দেন‚ যাতে বলা হয়েছে আকবরের ঐসব লিবেরাল চিন্তা আজকের হিন্দুস্তানে অচল‚ এদেশে সাহেবরা divide and rule চালু করলে তবেই সবার মঙ্গল। স্যার সৈদের দ্বিজাতিতত্বের পেছনে ঘালিবের এই ধারণা কাজ করেছিলো। ঘালিব ব্রিটিশরাজকে খুব একটা অপছন্দও করতেন না। সিপাহী বিদ্রোহের সময়েও উনি নিজের ডায়েরী দস্ত-অম্বুহতে সিপাহীদের অত্যাচারের কথাই ফলাও করে লিখেছেন। ঘালিব চাইতেন ওঁর এই ডায়েরী রাণীর হাতেও পড়ুক‚ বই হিসেবে ছাপা হোক। উল্টোদিকে ঘালিব নিজের বন্ধুদের যেসব ছিঠি লিখেছেন‚ তাতে প্রচুর ব্রিটিশবিরোধী মতামত আছে। এগুলোকে ঘালিব কোনোদিন দিনের আলোয় আনতে চাননি‚ এমনকি চিঠির শেষে অনুরোধ করেছেন চিঠি পড়ে পুড়িয়ে ফেলতে। ঘালিব বিপ্লবী ছিলেন না‚ ঐ অস্থির সময়ে একজন নাগরিকের যেসব ভয়ভীতি থাকতে পারে সবই ওঁর ছিলো‚ আবার নিজের ভবিষ্যত মজবুত করতে ব্রিটিশপ্রীতিও খুব স্বাভাবিক ছিলো।

ঘালিবের যে বদনামের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম‚ সেটা পুরোপুরি অমূলক না হলেও তাতে জল মেশানো ছিলো। এর পেছনে ঘালিবের প্রতিদ্বন্দ্বী শায়র মির্জা ইব্রাহিম জউকের হাতও ছিলো। এরকম ব্যাক্তিগত স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইওরোপেও দেখেছি‚ মোৎজার্ট-সালিয়েরী‚ ওয়াগনার-মেন্ডেলসনের শত্রুতা শৈল্পিক স্তর থেকে ব্যক্তিগত স্তরে নামতে বেশী সময় লাগেনি। তবে সব গল্পই মিথ্যা নয়‚ ঘালিবকে দরিয়াগঞ্জের কোতোয়ালীতে বার দুয়েক রাত কাটাতে হয়েছে‚ জুয়াখেলার জন্য।

ঘালিব নিজেই বলেছেন‚

য়ে মসাইল-এ-তসাউফ‚ য়ে তেরা বয়ান ঘালিব
তুঝে হম য়লী সমঝতে‚ জো ন বদখয়ার হোতা।

(ঘালিব‚ তোর বয়ান(লেখা) তো খুবই রহস্যময়‚ তবে তোকে আমি য়লী (রাজকুমার) বলতাম যদি না তুই বদখয়ার (মাতাল) হতিস। )

শেইখ শাবাইয়ের শায়রীর প্রশংসা শুনে ঘালিবের সরল প্রশ্ন‚ ও কি করে শায়র হয়? ও মদ খায় না‚ জুয়া খেলে না‚ আশিকের হাতে মার খায় না‚ এমনকি কয়েদখানাতেও যায়নি।

এমনকি এমন কথাও বলেছেন‚ যা কিনা রীতিমত অধর্ম:

জাহিদ‚ শরাব পিনে দে মসজিদ মেঁ বৈঠকর‚
য়া বো জগহ বতা যঁহা খুদা নহী হ্যাঁয়।

(মৌলভীসাহেব‚ আমায় মসজিদে বসে শরাব খেতে দাও‚ বা এমন কোনো জায়গা বলো যেখানে খুদা নেই!)

এটা আমার বড়ো প্রিয় একটা শের।

মির্জা ইব্রাহিম জউকের সাথে দুশমনীকেও ঘজলে নিয়ে এসেছেন ঘালিব। এমন দুশমনী একজন শিল্পীই করতে পারেন। মোৎজার্টও একসময় তৎকালীন হাল্কাফুলকা সংগীতের প্রতি বিরক্ত হয়ে মিউজিক্যাল জোক নামে এক হাল্কাফুলকা ডাইভারটিমেন্টো লিখলেন‚ কিন্তু সেই জোক বা ব্যঙ্গ এমনি উঁচুদরের হলো যে সে সৃষ্টি আজো লোকে শোনে।

ঘালিবের একটি ব্যাতিক্রমী ঘজল‚ মির্জা জউকের প্রতি ব্যঙ্গ ঝরালেন‚ কিন্তু কি অসাধারণ সেই ঘজল:

হর এক বাত পে কেহতে হো তুম কে ‘তু ক্যায়া হ্যাঁয়’ ?
তুমহী কহো কে য়ে অন্দাজ-এ-গুফতগূ ক্যায়া হ্যাঁয় ?

(মির্জা জউককে বলছেন‚ আমার সব কথায় বলিস‚ তুই কে‚ তোর কথার মানে কি। )

ন শোলে মেঁ য়ে করিশ্মা ন বর্ক মেঁ য়ে অদা
কঈ বতাও কি বো শউখ-এ-তুন্ড খু ক্যায়া হ্যাঁয়?

(আগুনেও এতো তেজ নেই‚ বিদ্যুৎচমকেও এতো জাঁক নেই‚ কেউ তো বলো আমার ওপর এর এতো রাগী ব্যাবহার কেন। )

চিপক রহা হ্যায় বদন পর লহু সে পয়রাহাঁ
হমারী জেব কো অব হাজাত-এ-রফু ক্যা হ্যাঁয়।

(আমায় আর কি বলবি‚ আমি তো এমনিতেই হতভাগ্য। আমার রক্তেভেজা জামা সারা শরীরে লেপ্টে আছে‚ সেই জামার ফুটো পকেটে সেলাই করার দরকারই বা কী?)

জলা হ্যাঁয় জিস্ম যঁহা দিল ভী জল গয়া হোগা
কুরদতে হো জো অব রাখ‚ জুস্তজু ক্যা হ্যাঁয়?
(শরীর মন জ্বলে গেছে আমার‚ এখন আর সেই ছাইয়ের মধ্যে কি খুঁজবি?)

রগোঁ মেঁ দউড়তে ফিরনে কে হম নহী কায়ল
জব আঁখ হী সে ন টপকা তো ফির লহূ ক্যা হ্যাঁয় ?

(শিরায় শিরায় দৌড়েই কি রক্তের কাজ শেষ? যদি চোখ থেকেই না গড়িয়ে পড়লো তো সে আর কি রক্ত হলো।)

হুআ হ্যাঁয় শাহ ক মুসাহিব‚ ফিরে হ্যাঁয় ইতরাতা
বগর্না শহর মেঁ ঘালিব কী আব্রূ হ্যাঁয়?

(বাদশার মুসাহিব হয়েছিস‚ ভাও বেড়েছে তোর‚ তাই আজ শহরের সামনে ঘালিবের ইজ্জত নিয়ে প্রশ্ন তুলছিস)

চোখ থেকে না গড়িয়ে পড়লে সে আর রক্ত কি। ঘালিবের পাঠক বা শ্রোতাকে বারে বারে উচ্চস্বরে বাহ বাহ করে উঠতে হয় না। ঘালিবের পাঠক বা শ্রোতা এক একটি শের শুনে নীরবে শুধু মাথা নাড়েন। পাঠক বা শ্রোতার কাছ থেকে এই নীরবতা আদায় করাতেই তো শায়রের জিৎ।


(৩)


কলকত্তে কা যো জিক্র কিয়া তুনে হমনশিঁ‚
ইক তীর মেরে সীনে মেঁ মারা কে হায় হায়….

( কলকাতার কথা কেন তুললি দোস্ত‚ ঐ শহর তো আমার বুকে এক তীর মেরে দিয়ে গেছে‚ হায় হায়। )

এই হায় হায় ঘালিব খুব কম চীজের জন্যই করেছেন। যেমন মোমিন খান মোমিনের একটি শের‚ যার জন্য ঘালিব নিজের পুরো দিয়ান বা শায়রী সংগ্রহ বিক্রী করে দিতে চেয়েছিলেন‚

তুম মেরে পাস হোতে হো গয়া‚
যব কই দুসরা নহি হোতা।

(তুমি আমার কাছে আছো যখন আর কেউ নেই। )

ঘালিব আর একজন শায়রের কথাতেও হায় হায় করে উঠতেন। তিনি খুদা-এ-সুখন‚ কবির ঈশ্বর‚ মীর তকি মীর‚ লখনৌয়ের নবাব আসফ-উদ-দৌল্লার সভাকবি‚ যাঁর মসনভী (দীর্ঘ কবিতা)মুয়ামলত-এ-ইশক পড়ে স্বয়ং খুদাও হয়তো হায় হায় করে উঠবেন।

আর একটা জিনিসের প্রতি ঘালিবের আকর্ষণ রীতিমত ফেটিশের পর্যায়ে পৌঁছেছিলো‚ তা হলো আম। আমীর খুসরু একে বলেছেন ফক্র-এ-গুলশন। বাহাদুর শাহ জাফর লালকিল্লার হায়াতবকশ বাগানে নিজে হাতে আম ফলিয়েছেন। রসালো আম‚ যাকে ঘালিব বলতেন কলমী আম‚ তা তাঁর হৃদয়ের কাছে ছিলো। কলকাতার বন্ধু মীর সরফরাজ হুসেনকে চিঠি লিখছেন‚ ওরে আমায় বাংলার গুলবকশ আম কিছু পাঠা। হুসেন দু ঝুড়ি আম পাঠালেন দিল্লীতে। এমনকি আমের জন্য একবার সাহেবের সিপাহী ঘালিবকে ধরে নিয়ে যায়। তখন মিউটিনির সময়‚ ঘালিব ও তাঁর বন্ধু মেরঠের আমবাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন‚ সিপাহী এসে ধরে নিয়ে গেলো সোজা কোতোয়ালীতে‚ কর্নেল বার্নের কাছে। সাহেব জিগ্যেস করলেন‚ তোমার ধর্ম কি। ঘালিবের অমর উক্তি‚ আমি আধা মুসলমান। কারণ আমি সুরা পান করি‚ তবে শূকরমাংস খাই না। সাহেব এসব শুনেটুনে ঘালিবকে ছেড়ে দিলেন।

ঘালিব বলতেন আম মিষ্টি হতে হবে‚ আর অনেক পাওয়া যাবে‚ তাহলেই কাফি। আম নিয়ে একটা গোটা মনসভী আছে ঘালিবের।

অওর দওড়াইয়ে কিয়াস কহাঁ
জান-এ-শীরীন মেঁ য়ে মিঠাস কহাঁ

(যত দূর কল্পনা করি আম নিয়ে‚ কম লাগে। আত্মার মিষ্টত্বেও আমের মতো মিঠাস নেই। )

ঘালিবের চিঠির কথা আগে বলেছি। ঘালিবই প্রথম চিঠিকে কথা বলালেন। এর আগে উর্দুতে লেখা চিঠির কোনো সাহিত্যমূল্য ছিলো না।

সও কোস সে ব-জবান-এ-কলম বাতেঁ কিয়া করো অওর হিজ্র মেঁ ভিসাল কে মজে লিয়া করো। একশো ক্রোশ দূর থেকে কলমের মুখে কথা বলো‚ দূরত্বেও কাছে থাকার মজা নাও। এই রকম একটা লাইনের কি বাংলা করা যায়। হায় হায়। ঘালিব বলতেন‚ ম্যাঁয় কোশিশ করতা হুঁ কে কৈ অ্যায়সী বাত লিখুঁ জো পড়ে খুশ হো যায়ে। নিজের দোস্তদের লেখা ঘালিব-কে-খাতুত এক একটি মুক্তো।

ঘালিবের হিন্দু শিষ্য মুনশী হরগোপাল তুফতাকে লেখা চিঠির বিষয় অতি নীরস‚ পার্সী ভাষার উৎপত্তি‚ কোনো উর্দু শব্দের সঠিক ব্যবহার‚ কিন্তু ঘালিবের লেখার যাদুতে সেসব চিঠি অমূল্য। আবার বন্ধু আলাইকে লেখা চিঠিতে একটি অনবদ্য শের‚

কৈ উম্মিদ বর নহী আতি ‚ কৈ সুরত নজর নহী আতি
মওত কা এক দিন মুআয়াঁ হ্যাঁয়‚ নীন্দ কিউঁ রাত ভর নহী আতি।


(কোনো আশা নেই‚ কোনো দিশা নেই‚ মৃত্যু তো আসবেই একদিন‚ তবু রাতে ঘুম কেন আসে না।)

আলাইকে লেখা আর এক চিঠিতে ঘালিবের অমর ফলসফা (এই শব্দটা থেকেই ফিলোসফি শব্দটা এসেছে)

বোঝ বো সর সে গিরা হ্যাঁয় কি উঠায়ে ন উঠে‚ কাম বো আন পড়া হ্যাঁয় কি বনায়ে ন বনে
ইশক পর জোর নহী হ্যাঁয় য়ে বো আতিশ ঘালিব‚ কি লগায়ে ন লগে অওর বুঝায়ে ন বুঝে।

(সে এমনই বোঝা যে পড়ে গেলে ওঠানো যায় না‚ সে এমনই কাজ যে পড়ে থাকলে আর শেষ হয় না।
ভালোবাসায় জোরজারী হয় না ঘালিব‚ এ এমন আগুন যে লাগালে লাগতে চায় না‚ আবার নেভাতে গেলে নেভেই না)

আবার অনেক চিঠিতে ঘালিব লিখেছেন‚ দিল্লীর সেই সব বাজার‚ খাস বাজার‚ উর্দু বাজার সেসব কোথায় গায়েব হয়ে গেলো‚ সুরা আর শয়রীর নেশায় শেষরাতে সেই বাজারের অলিগলিতে ঘোরার মজা কোথায় গেলো। এরকম একজন বারমুখো শৌহর পেয়ে উমরাও বেগমের কত মুসীব্বত সে নিয়েও দু:খপ্রকাশ আছে।

উর্দু শায়রীর রবরবা শুরু হয় বিজাপুর গোলকোন্ডার রাজসভা থেকে‚ তারপর লখনৌ ঘুরে দিল্লীর মসনদে। ঘালিবের মেন্টর হিন্দুস্তানের শেষ বাদশা বহাদুর শাহ জফর নিজেও শায়র ছিলেন। যেসময় দিল্লী ও লখনৌতে দরকার ছিলো একজন আকবর বা আসফ-উদ-দৌল্লার‚ সেই সময় এদিকে জফর ওদিকে ওয়জীদ আলী শাহের মতো অপদার্থ শাসকের হাতে পড়ে দিল্লীও লখনৌয়ের শাহয়ানার শেষ ঘন্টা বেজে যায়। ঘালিব একাধারে জফরের গুরু‚ ওঁর বড় ছেলে ফকর-উদ্দীন মির্জার শিক্ষক ও রাজদরবারের তারীখদান বা ইতিহাসকার। তিনটি ভূমিকা পালন করার জন্যই বোধ হয় তিনবার খেতাব পান ঘালিব‚ দবীর-উল-মুলক নজম-উদ-দৌল্লা মির্জা নউশা। ১৮৫০ থেকে সিপাহী বিদ্রোহ অবধি ঘালিব জফরের দাক্ষিণ্যে বজম(মেহফিল)‚ ইয়ারদোস্ত‚ শরাব‚শবাব‚শায়রী‚বাজার নিয়ে মেতে ছিলেন। সেসময় তাঁর প্রবল ইগো‚

আসান কহনে কি করতে হ্যাঁয় ফর্মায়শ
গোয়ম মুশকিল বর্না গোয়ম মুশকিল….
(সহজ করে লিখতে বলে আমায়‚ বুঝতে মুশকিল না হলে তো লেখাই মুশকিল।)

হ্যাঁয় অওর ভি দুনিয়া মেইন সুখনয়ার বহুত অচ্ছে‚
কহতে হ্যাঁয় কি ঘালিব ক হ্যাঁয় অন্দাজ-এ-বয়ান অউর…

(দুনিয়ায় তো ভালো কবি অনেক আছে‚ কিন্তু লোকে বলে ঘালিবের বলার স্টাইলই আলাদা।)

দিল্লী কলেজে পার্সী পড়ানোর জন্য ডাক এলে উপেক্ষা করেন‚ কারণ সাহেব প্রিন্সিপ্যাল নিজে ঘালিবের ঘরে না এসে কোনো কর্মচারীকে পাঠিয়েছেন। সে সময় জুয়ায় আসক্ত ঘালিবের আর্থিক অবস্থা আদৌ ভালো নয়‚ এমনকি ধারদেনাও প্রচুর। ছোটো ভাই মানসিক রোগী‚ তার পেছনেও খরচ আছে। এত কিছুর পরেও ঘালিবের লেখাতে উদাসীপন আছে‚ কিন্তু ব্যাক্তিগত মায়ুসী নেই।

কইদ-এ-হয়াত-ও-বন্দ-এ-ঘম‚ অসল মেঁ দোনো এক হ্যাঁয়‚
মউত সে পেহলে আদমি ঘম সে নিজাত পায়ে কিঁউ।
(জীবনের কয়েদখানা আর দু:খের বাঁধন আসলে একই‚
মরার আগে এই দু:খ থেকে কি মুক্তি নেই।)

মৃত্যু তাঁর শায়রীকে বারে বারে চুম্বন করে গেছে।

নাদান হো জো কেহতে হো কি কিউঁ জীতে হো ঘালিব
কিসমত মেঁ হ্যাঁয় মরনে কি তমন্না কৈই দিন অউর।

(যে জিগ্যেস করে তুই বেঁচে কেন আছিস ঘালিব‚ সে বোকা। মরার ইচ্ছে আছে‚ ভাগ্যে লেখা আরো কিছু দিন পরে।)

ঘজল মানে হরিণীর কান্না। সে কান্না পাওয়ার ব্যথায়ও হতে পারে‚ না পাওয়ার বেদনাতেও হতে পারে। ঘজল দিনের শেষে সেই ব্যথারই গান। ইতিহাস সাক্ষী‚ ঘালিবের লেখায় এইভাবে ঘালিব প্রেম ঈশ্বর ও মৃত্যু বেদনা একে অন্যের গলা জড়িয়ে রয়েছে।

১৮৬৯-এর ১৪ ফেব্রুয়ারী ঘালিবের ইচ্ছা সফল হলো। অনেকদিন আগেই তো লিখেছিলেন‚

মরতে হ্যাঁয় আর্জু মেঁ মরনে কি
মউত আতী হ্যাঁয় পর নহী আতী।

মউত এলো‚ কিন্তু ঘালিব মরলেন না। এই দুনিয়ার খুবসুরতীর প্রতি তাঁর দিলকশীর মধ্যে তিনি বেঁচে রইলেন।

উনকে দেখে সে যো আ জাতী হ্যাঁয় মুহ পর রৌনক
বো সমঝতে হ্যাঁয় কে বীমার ক হাল আচ্ছা হ্যাঁয়।

এই “সে”‚ যাকে দেখে চেহারায় রৌনক আসে‚ সে আশিকও হতে পারে‚ খুদাও হতে পারে‚ মওতও হতে পারে‚ তার সাথে ঘালিবের খেলা ফুরোবে না।

নিজামুদ্দীন বস্তির চৌষট খম্বার সমাধিতে শুধু তাঁর দেহটা রাখা আছে‚ ওঁর আত্মাটা তো আমাদের জিম্মায় দিয়ে গেছেন ঘালিব।

উম্র ভর ঘালিব য়হীঁ ভুল করতা রহাঁ
ধুল চেহরে পর থী অওর আইনা সাফ করতা রহাঁ।

ধুলো তো আমার মুখে লেগে ছিলো বুঝিইনি‚ আমি সারা জীবন ধরে আয়না পরিষ্কার করে এলাম।

ঘালিবের শের গুলি ওঁর ভুলজনমের কতগুলি আঁচড়ের দাগ বই তো নয়।

খেল খতম।


লেখক পরিচিতি - প্রবুদ্ধ (জন্ম ১৯৭৩): যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্স্ট্রুমেন্টেশন ইঞ্জিনীয়ারিংএর স্নাতক। গেইল ইন্ডিয়া লিমিটেডে কর্মরত‚ চাকরীসূত্রে বরোদানিবাসী। দেশ ও স্টেটসম্যানে চিঠি লেখা দিয়ে সিরিয়াস লেখালেখির শুরু ছাত্রাবস্থাতেই। সিনেমা সঙ্গীত আর্ট খেলা রাজনীতি খাওয়াদাওয়া অনেক বিষয়েই "জ্যাক" হিসেবে লিখে থাকেন‚ তবে সময় নেই এই বাজে অজুহাতে মাঝে মাঝে লেখায় ছেদ পড়ে। পড়া শোনা দেখা ও খাওয়াটা মন দিয়ে করে থাকেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।