বিবিধ প্রসঙ্গ
অক্টোবর ১৫, ২০১৬
রম্যরচনা- ‘বাহন-বিচিত্রা’
মধুমিতা ভট্টাচার্য
নাঃ, এবারের বছরটা মোটেই ভাল যাচ্ছেনা পশুরাজের। গেলবার মর্ত্যধাম থেকে ফেরার পর থেকে সেই যে পেটের ব্যামো শুরু হয়েছে, সারছেই না। চেনাজানা ঘাসপাতার টোটকাতেও কাজ হচ্ছে না। তদুপরি বিকট গরমে শরীরের ছাল-বাকলও বেহাল। দেশের জঙ্গলে যত্ন-আত্তির তেমন সুব্যবস্থা নেই। লোকে রোগা প্যাংলা সিঙ্গি দেখে ‘হায় হায়...গেল গেল’ বলে খবরের কাগজে লেখালিখি বা টিভিতে ঘণ্টাখানেক ঠান্ডা ঘরে বসে তক্কাতক্কি করে বেশি আনন্দ পায়। এই গরমে চাঁদিফাটা রোদে বসে হাঁপানো যে কী কষ্টের তা কে বোঝে!
এ পশুরাজ কিন্তু যে সে লোক...থুড়ি...সিংহ নন। স্বয়ং মা-দুর্গা এঁর পিঠে সওয়ার হন। সম্বচ্ছরে অসুর-নিধন করতে এই পশুরাজেরই তলব পড়ে।
কৈলাসে মহাদেবের ছত্রছায়ায় এতদিন বিনা ঝঞ্ঝাটেই কেটেছে। শান্ত, নিঃঝুম, ঠান্ডা জায়গায় এতদিন মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরে অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে এখন যুগ বদলেছে। পূজোর পাঁচদিনে পৃথিবীতে আগেকার আন্তরিকতা নেই। সবই কেমন গা-ছাড়া। লোকদেখানো মেকি জাঁকজমক আর ফালতু আড়ম্বর। প্রসাদের নামে মা-কে দেয় শুকনো চাল কলা অথচ প্যান্ডেলের জন্যে লাখো টাকার বরাদ্দ।
সেকালে মায়ের বাহন হিসেবে সিংহরাজের দেমাকই ছিল অন্য। মায়ের আশীর্বাদে আরামসে পেটের রসদ জোগাড় হত। বাবা ভোলানাথ নিরামিশাষী হলেও সিংহ-বাহনের জন্যে দেদার হরিণের মাংস রাখতেন। চামড়াটা অবশ্য আসনের কাজে লাগত। কিন্তু সমস্যা হয়েছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কড়াকড়িতে হরিণ শিকার বন্ধ। বাবাও আজকাল বিদেশ থেকে আমদানী করা নকলি চামড়ায় কাজ চালান। এমনিকি পরণের বাঘছালটাও নকল। ডিজাইনার কোমরবন্ধে লটকানো থাকে। তবে আসলি-নকলি ধরে কার সাধ্যি।
ওদিকে গণেশ বাবার একনিষ্ঠ চ্যালা ভেলকিরাম চান্দিওয়ালা ভক্তি-গদগদ হয়ে কিছুদিন আগে মা-জননীকে ইয়াব্বড় এক বিদেশি গাড়ি ভেট চড়িয়েছে। ফলং... মা-দুর্গা সপরিবারে ওই গাড়ি ছাড়া আজকাল আর কিছু চড়েন না। ওই চারচাকার গড়গড়িতে সওয়ার হয়েই ইদানীং ভূমন্ডল ভ্রমণে যান। স্বর্গে অন্য দেবতাদের চোখ টাটায়। পশুরাজও প্রথম প্রথম দু-একদিন তাতে চেপেছিল, কিন্তু মুখের সামনে গাড়ির এত প্রশংসা সহ্য হয়নি। চরম আদেখলেপনা। কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী এমনকি বিদ্যেধরী সরস্বতী-মা পর্যন্ত কথায় কথায় গাড়ি আর গাড়ি। এই যে এতদিন কোমরে বাত-কনকনানি সত্ত্বেও মা-জননীকে নিয়ে কৈলাসের পাহাড় চষে বেড়িয়েছে তা কি কেউ মনে রেখেছে? যুদ্ধে মহিষাসুরকে কব্জা করতে গিয়ে কম ঝক্কি পোয়াতে হয়েছে? অসুর যেমন বনবন করে খাঁড়া ঘোরায়, কতবার পশুরাজের নাক কাটতে কাটতে বেঁচে গেছে। সারা গায়ে আঁচড় খাঁচড় তো ছিলই। যুদ্ধু করতে গিয়ে বিশল্যকরণীর রসই বা কোথায় পেত? চেটেচুটেই সারিয়ে ফেলতে হোত সে সব। ব্যথা-বিষের কথা তো ছেড়েই দিচ্ছে। তা সেসব কি কেউ মনে রাখে? কেবল গাড়ির সুনাম! শুনলে গা-পিত্তি রি রি করে ওঠে পিঙ্গল-কেশরীর! মায়ের ভয়ে গলা খুলে গর্জন-প্রতিবাদও করতে পারেনি।
একদিন তো চোখে জলই এসে গেছিল। গাড়ি চেপে সবাই মিলে বেরিয়েছিল ভ্রমণে। বলা বাহুল্য, মনে ভীষণ ফূর্তি সবার। গাড়ি চালু হয়েছিল হালকা ঘুর্র্ ঘুর্র্ আওয়াজ করে। পশুরাজের কানে অবশ্য শব্দটা ‘ধূর্র্ ধূর্র্’ বলে মনে হতে মায়ের চোখ এড়িয়ে মুখ বেঁকিয়ে হেসেছিল একটু।
-“দেখো দেখো কি দারুণ না... যেন ডলারের ডানা লাগিয়ে উড়ছি”, সাথে সাথে ঝমঝমিয়ে বলে উঠেছিলেন লক্ষ্মী ঠাকরুণ। কিলিক কিলিক করে গোটা কয়েক হাসিমুখ নিজস্বী তুলে বিষ্ণুকে “লাব্বিউ” লিখে হোয়াটস্যাপে চটপট পাঠিয়েও দিলেন সে ছবি।
-“আহা কী অপূর্ব রঙ”, ঘোমটার আড়ে কলাবউয়ের বচন।
-“ওওওমাআআ...কী মিষ্টি হর্ণের শব্দটা”, বীণাবাদিনীর রিনরিনে গলায় সাতসুরের লহর। “আমার নতুন বীণাটা এই ফ্রিকোয়েন্সিতেই টিউন করে নেব ভাবছি”। কিলিক... সেলফি উঠে গেল।
-“আরে...দেখেছ! জানলার কাঁচটা কেমন সরসর করে অটোমেটিক্যালি উঠে আসছে! গিয়ার বদলানোর ঝামেলাও নেই দেখছি”! অবাক হয়ে বলে ফেলেছিল কাত্তিক। আমার ময়ূরটা আজকাল ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। সে ব্যাটা বর্ষার মেঘ না দেখলে পেখম মেলেনা! বুড়ো হয়ে তার হাঁটুতেও বাত। নাচতে গেলে উল্টে পড়ে যায়। আপডেটও করারও উপায় নেই। ডিসগাস্টিং”! ময়ূরের বুড়োটেপনায় কার্তিক স্পষ্টতঃই ব্যাজার।
সাথে গণেশদাদাও ফুট কাটে, “এটাই আজকালকার স্ট্যাটাস সিম্বল বুঝলে? আমরা দেবের দেব মহাদেবের পরিবার বলে কথা! লোকে আমাদের ফলো করে। আমরাই ট্রেন্ড সেটার বলতে পারো”!
তাই ইদানিং ভোলেবাবার পরিবারের গাড়ি ছাড়া চোখে আঁধার। গাড়ি চড়েই নিজেরা গদি-আঁটা সিটে গুছিয়ে বসেন। ওদিকে বাহনগুলোর চরম চাকরী-সঙ্কট। প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারেনা কেউ।
“সবাই আলাদা আলাদা বাহনে না চেপে একসাথে গাড়িতে চেপে গেলেই তো হয়। পয়সা আর পরিশ্রম দুটোই বাঁচে!” অর্থনীতিবিদ গণেশের খোলামেলা বক্তব্য। কার্তিকও দেরী না করে “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক” বলে তাতেই সায় দেয়। ময়ূরকে পাত্তাই দেয়না।
ইঁদুরের ওপরেও গণেশবাবা আজকাল বেজায় খাপ্পা। দিনকয়েক আগে ধনকুবেরের হাফপ্যান্টের গোপন পকেটটা কেটে ফেলেছে কুটি কুটি করে। ফলে দিব্যকোষের চাবির গোছাটা সেখান দিয়ে গলে বেরিয়ে গেছে। কুবেরের যাবতীয় দু-নম্বরী ধন-দৌলতের আড়ত কালো-আলমারীর চাবিটাও ওতেই ছিল। এখন বিশ্বকর্মার মন ভিজলে তবেই আবার নতুন চাবি হবে। তারও বহুত হ্যাপা! তাছাড়া কুবেরও ভরসা পাচ্ছেন না কাউকে চাবির ‘নো-হাও’ জানাতে। বলা যায়না, কখন কোন স্টিং অপারেশন হয়। আজকাল ঘুষের জমানায় কাউক্কে বিশ্বাস নেই।
ফ্যাশনদুরস্ত ভোলানাথ পরিবারের বিদেশি গাড়ি সওয়ারির জেরে সাবেকি বাহনেরা আজকাল বছরভর নিজেদের দেশের বাড়িতেই বসে থাকে। কেবল দুর্গাপুজো আর বাসন্তীপুজোয় প্যান্ডেলের শোভা বাড়ানোর জন্যে মর্ত্যে আসতে হয়। তারপর কৈলাসে ফিরে মা-দুগ্গা আবার যখন সব্বাইকে নিয়ে গাড়ি চেপে বেড়ান তখন বড্ড অভিমান হয়। বিশেষ করে সিংহের। পশুরাজ বলে কথা, তাকেও কিনা সাধারণ সিংহের মত গভীর জঙ্গলে গিয়ে শিকার ধরতে হয়! তার উপর আজীবন মা-জননীকে ঘাড়ে বয়ে কোমর হয়ে গেছে তিন-ব্যাঁকা। এতকালের অনভ্যাসে শিকারগুলো হাত-ফসকে পালায় আর দূর থেকে জিভ ভ্যাঙচায়। পশুরাজের তখন রাগে কেশর ছেঁড়া ছাড়া উপায় থাকেনা।
সেদিন রাতে খিদের জ্বালায় ঘাসবনে ঘুর ঘুর করছিল পশুরাজ। সারাদিনে কেবল হরিণের আধখানা ঠ্যাং জুটেছে, তা-ও কারো ফেলে রাখা, আধখাওয়া। আগে হলে ছুঁয়েও দেখতই না। আজকাল বাছ-বিচার করার উপায় নেই। হঠাত সেখানেই পেঁচক ভায়ার সাথে দেখা। মা-লক্ষ্মীর গাড়ী-বিলাসের ফলে তার চাকরিও টলোমলো। অবশ্য ডানা থাকায় ইচ্ছেখুশি উড়তে পারে। পশুরাজের সে সুবিধে নেই।
একটা ঝাঁকড়া বাবলা গাছের মগডালে বসে পেচকভায়া গোল গোল চোখে চৌকিদারী করছিল। শোনা গেছে রাতে চোরা-গোপ্তা শিকারীরা এসে গণ্ডার, বাঘ, হাতি মেরে তাদের খড়্গ, দাঁত, চামড়া এসব কেটেকুটে বা ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। পেঁচকচন্দর রাতেও দিব্যি দেখতে পায়। তাছাড়া লক্ষ্মীর বাহন হলেই বা কি হয়, তার পকেট সবসময়েই গড়ের মাঠ। তাই সংসারের টানাটানি সামলাতে আজকাল চৌকিদারীর কাজ ধরেছে। তারই ওভারটাইম চলছিল।
“কি গো দাদা, কী খবর? বড্ড কাহিল দেখাচ্ছে যে! কঠোর ডায়েটিং করছ নাকি আজকাল”? সিংহকে দেখতে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে প্যাঁচা।
শুনেই দাঁত খিঁচিয়ে উঠল পশুরাজ। “ইয়ার্কি হচ্ছে? ডায়েটিং? আমি? দুবেলা উপোস করছি দেখছিস না? আজ সারাদিনে শুধু হাড়-বাসি হরিণের আধখানা ঠ্যাং চিবিয়ে বসে আছি। কাহিল দেখাবে না? তোর আর কী! সুযোগ পেলেই ডানা মেলে ফুরুত হবি। খাবার জোগাড়ের কোনও ঝামেলাই নেই”!
“না গো দাদা। আমারও সমস্যার শেষ নেই। গিন্নির ভয়েই জঙ্গল পাহারা দেবার কাজটা জুটিয়েছি। দু-কুড়ি দশ দিন কাজ করলে তবে কিছু জোটে। আজ এই তল্লাটে ডিউটি পড়েছে তাই তোমার দেখা পেলাম। আমাদের আর আগের সেদিন নেই গো। মা-জননীর গাড়ি এসে আমাদের ভাতে মেরেছে”।
“সে কথা আমাদের মা বুঝলে তো। আমরা মরছি খিদের জ্বালায় আর ওনারা সবাই গাড়ি চেপে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছেন। একমাত্র বাবা ভোলানাথেরই ওসবে হেলদোল নেই। ষেঁড়োটা দিব্যি কৈলাসে বসে আছে। তাল বুঝে দিয়েছিলাম সেদিন ব্যাটার পেছনের পায়ে এক কামড়। বললাম বেশি না, জাস্ট একটা বাইট দেব, তা সে এমন লাফালাফি শুরু করল যে বাবা মহেশ্বরের তৃতীয় নয়ন খোলে আর কি। আমি তো একছুটে পগার। আর ওমুখো হইনি। বাবার নালিশে রেগেমেগে মা-জননীও দিলেন আমায় দু-ঘা। সেই থেকেই বড় মনোকষ্টে আছি হে ভায়া। আমার পশুরাজ নামই বৃথা। অপমান আর সহ্য হচ্ছেনা। আমার চেয়ে গণেশদাদার নেংটিটাও ঢের সুখে আছে। শুনলাম হারান জমিদারের ধানের মড়াইতে পরিবার নিয়ে ডেরা বেঁধেছে। দেদার খাওয়া-দাওয়া”!
প্যাঁচা সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে না পেয়ে দু’বার ডানা ঝেড়ে বলল “এবার আমি আসি। অফিসে রিপোর্ট দিতে হবে। চিন্তা কোরনা, একটা কিছু উপায় হবেই”। সিংহ ব্যাজার মুখে তাকিয়ে তার উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে ফোঁৎ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা।
বছর ঘুরে গেল। আবার ফিরে এসেছে আশ্বিন মাস। চকচকে নীল আকাশ জুড়ে তুলো তুলো সাদা মেঘের দঙ্গল ভেসে বেড়াচ্ছে। পালকঝাড় কাশ বনে দুলকি হাওয়ার নাচন। ধান ক্ষেতে সবুজের মখমলী বাজার। আকাশপথে মা-দুগ্গা সপরিবারে চলেছেন মর্তে। এবার আর আলাদা আলাদা বাহন নয়। সবাই মিলে একসাথে গেলে যে সাশ্রয় হয় সেটা ইদানীং ওঁরা শিখে ফেলেছেন। তাই ঢাউস বিদেশি গাড়িটাতেই সকলে সওয়ার। কিন্তু কোথায় যেন তাল কাটছে আজ!
“হ্যাঁরে, আজ গাড়িতে সেই আরাম পাওয়া যাচ্ছেনা কেন বলতো কাতু”? কার্তিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন জগজ্জননী। ছেলেপুলে নিয়ে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে মা-র। দিব্যদৃষ্টিও ঘোলাটে লাগছে! “চাকাগুলো যেন খোঁড়াচ্ছে সেই থেকে, না রে? ঢুকঢুক...ঢক্ঢক্...ঠংঠং... এত রকমের বিজাতীয় শব্দে কানে একেবারে তালা লেগে গেল। মর্ত্যে পৌঁছবার আগেই নাজেহাল হয়ে গেলাম। দেখতো একটু বাবা”!
“ঠিকই বলেছ মা। মনে হয় যান্ত্রিক গোলমাল কিছু”। চিন্তিত মুখে বলে কার্তিক।
“ওদিকে পঞ্চমী প্রায় শেষ হতে চলল তো রে। ষষ্ঠীতে বোধনের আগে না পৌঁছলে অনর্থ হয়ে যাবে বাবা”। মা অসহায় হয়ে সূর্যের অবস্থান দেখেন। তারপর মহাদেবের দিকে চেয়ে বলেন, “বলি হ্যাঁগো, সেই থেকে তো ঝিমোচ্ছ কেবল। কিছু একটা উপায় করনা”।
মহাদেব গাড়ি চড়েন না। তিনি তাঁর সাবেক দিব্যবাহন নন্দীর পিঠে চড়ে গাড়ির আগে আগেই চলেছিলেন। ষাঁড়ের চলার দুলুনীতে ও সাথে গঞ্জিকা সেবনের ফলে একটু ঢুলুনী এসেছিল। মায়ের ডাকে চমকে গিয়ে চোখ মেলে তাকালেন। গঞ্জিকার মৌতাতে বিঘ্ন ঘটায় একটু বিরক্তই হলেন অবশ্য। তবে মায়ের বকুনীর ভয়ে তা প্রকাশ না করে বলেন, “বোঝো এখন ঠ্যালা। পই পই করে তখন বলেছিলাম বাহনগুলোকে তাড়িওনা। গাড়ির অভ্যেসটাও বিপদজনক। শুনেছিলে সে কথা? এখন প্যানপ্যান করছ? ওদিকে বাহনগুলো না জানি কি কষ্টেই কালাতিপাত করছে। তোমরা হলে গিয়ে নূতনের পূজারী। ট্রাডিশনকে হতচ্ছেদ্দা করেই আনন্দ পাও। এখন আমি কী করব”?
ঝকাং...ক্যাট...ক্যাট...ক্যাট...খটাং...ঢিং...! ভীষণ রকম শব্দটব্দ করে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। তার মানে মামলা সিরিয়াস। কলাবউ থেকে শুরু করে কার্তিক অবধি সকলের মুখ চুন। এখন উপায়? সময়ও নেই হাতে।
মা এবার অধৈর্য্য এবং কুপিত। “ধূত্তোর এই হাড় জ্বালানো বিদেশি গাড়ির নিকুচি করেছে! গনু, শিগ্গির তোর ওই চান্দিওয়ালাকে এই যন্তর ফেরৎ দে। সাথে ওর বরাদ্দের লাভের টাকাগুলোও হাপিস করে গরীব ছেলেমেয়েগুলোকে দিয়ে দে দিকিনি। যত্তোসব কালোবাজারীর দল! এখন কি হবে তা-ই ভেবে পাচ্ছিনা। আমি এখানেই নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। আর চড়ছি না বাবা”! বলেই দরজা খুলে এক টুকরো মেঘের ওপর আলতা পরা চরণ-কমল রেখে নীচে নামলেন।
স্বর্গলোকে খবর রটে গেছে। সকলেই ভয়ে তটস্থ। মাতা কুপিতা। আর বোধহয় রক্ষে নেই। সমূহ বিপদ দেখে নারদ মুনি ঢেঁকিমার্কা রকেট চেপে হাতে গিটার নিয়ে হাজির। “নারায়ণ...নারায়ণ। বলি মা জননী, ওদিকে যে সময় বয়ে যাচ্ছে, যাহোক কিছু একটা কর! তুমি না পৌঁছলে যে পূজোর সব আয়োজন ব্যর্থ। নিদেন পক্ষে আগের বাহন গুলোকেই ডেকে পাঠাও। তারাও খেয়ে পড়ে বাঁচবে আর তোমারও মুখ রক্ষে হবে”।
“তা মন্দ বলেন নি দেবর্ষি। হ্যাঁ গা, তুমি কি বল”?
“হুম”। নেশা কাটাতে আর রাজি নন, তাই সংক্ষেপেই জবাব সারেন মহাদেব।
নতুন পরামর্শে মা পলকে খুশী। আঁচলের খুঁট থেকে হীরক খচিত ওয়াকি-টকিটা বের করে হাতে নিলেন।
-“হ্যালো, কে?...সিংহু? ভাল আছিস বাবা? আহা কত্তদিন পর তোর গলা শুনলাম রে। তা আওয়াজটা এত মিয়ানো কেন তোর? সর্দি-কাশি হল নাকি? সিজন চেঞ্জের সময় বলেছি না কতবার সাবধানে থাকবি! তা শোন বাছা, বড্ড বিপদে পড়েছি। মাঝপথে গাড়ি খারাপ হয়ে তার আর চলার নামগন্ধ নেই। ওদিকে ষষ্ঠীর বোধনের সময় হয়ে গেছে। এখন তোরাই ভরসা। তুই সব্বাইকে নিয়ে চলে আয় বাবা...এক্ষুণি”।
“গেঁয়াও..., মা জননী, তুমি কিচ্চুটি চিন্তা কোরোনা। আমরা এই এলাম বলে। সব্বাইকে এখনই খবর দিচ্চি”। অভিমান ভুলে সিংহ খুশিতে একপাক নেচে নেয়। আহ্লাদে সোনালী কেশর ফুলেফেঁপে একসা। চাটি-বাটি গুটিয়ে গ্রাউম্ম্ম্ বলে তক্ষুনি তৈরী মা-র চরণ তলে আশ্রয় পেতে। ভাগ্যিস গাড়ি খারাপ হয়েছে। নইলে কি আর মায়ের মনে পড়ত তাকে?
খবর পেয়ে খানিকক্ষণের মধ্যে প্যাঁচা, হাঁস, ময়ূর, ইঁদুর সক্কলে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে সার বেঁধে। এতদিন পরে ডাক এসেছে বলে কথা। লগ্ন বয়ে যাচ্ছে। আর দেরী করার উপায় নেই।
দুচার মিনিট অপেক্ষা করতে না করতে সব বাহনেরা হুড়মুড়িয়ে আকাশপুরীতে হাজির। মেঘেদের বস্তিতে বিকল গাড়ি ফেলে রেখে মা এবং আর সকলে আবার রওনা হলেন মর্ত্যের উদ্দেশ্যে। সেখানে তখন শাঁখ আর হুলুধ্বনীর ধূম। বোধন শুরু হবে। দাদারা মাইকে জোরদার ঘোষণা করে চলেছে।
অবশেষে চতুর্দিকে চোখ ঝলসানো আলো নজরে পড়তে মা-র মনে স্বস্তি ফিরে এল। প্যান্ডেল সাক্ষী রেখে মা বললেন, “গনু, জেনে রাখ এই শেষ। আর কোনওদিনও তোর ওইসব চারচাকায় চড়ছিনা বাপু। নাঃ কিছুতেই না। আমার চারপেয়ে সিংহই ভালো”।
“সরো, তোর আর মিষ্টি-মধুর হর্ণের সাথে ফ্রিকোয়েন্সি মিলিয়ে বীণা বাজানো হল না রে”! মা লক্ষ্মী বোনের পেছনে লাগেন একটু।
“তুমিও আর গাড়িতে হেলান দিয়ে সেলফি তুলতে পারবে না, সেটা বল”? সরস্বতীও হার মানতে রাজী নন।
“কার্তিকের ময়ূর এতদিন মর্ত্যে থাকাকালীন কঠোর প্রাণায়াম আর যোগব্যায়াম করে শরীর একেবারে তরতাজা করে ফেলেছে। ব্যথা বেদনা গায়েব। ঝুমঝুম করে পেখম মেলে দেয় সুযোগ বুঝে। কার্তিক হাঁ।
গনেশবাহন মূষিক কুমার আড়চোখে কাজু কিশমিশের থালাটা দেখে একবার ঠোঁট চেটে নেয়।
এই ফাঁকে মহিষাসুরকে একটু কাতুকুতু দিয়ে সিংহ ফিসফিস বলল, “দেখেছিস, আমায় ছাড়া মায়ের একেবারেই চলেনা! এবার থেকে আমায় আর একটু সমঝে চলিস। বুঝলি”?
অসুর তার খিঁচোন দাঁতের পাটি আরেকটু খিঁচিয়ে খুবসে মুখ ভেংচালো।
কিন্তু পশুরাজের তাতে ভারী বয়েই গেল!
লেখক পরিচিতি : লেখালিখিকে ভালবাসার সূচনা আসানসোলে, স্কুলবেলা থেকে। কলেজবেলার শুরু থেকে বারো বছর শান্তিনিকেতনে ওতপ্রোত হয়ে থাকা। সংসারসূত্রে প্রথমে আসাম ও এখন ডুয়ার্সের হরিয়ালি চা বাগানের বাসিন্দা। প্রকাশিত কবিতার বই "নক্ষত্র নাবিক"। লেখা (কবিতা, গল্প ইত্যাদি) প্রকাশিত হয়েছে 'দেশ', 'কৃত্তিবাস', 'সানন্দা, 'এবেলা', 'ফেমিনা(বাংলা)', ও আরও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।