বিবিধ প্রসঙ্গ
অক্টোবর ১৫, ২০১৬
পুজোসংখ্যা, তুমি আর নেই সে তুমি!
সরোজ দরবার
নীল সামিয়ানা আকাশ থেকে একখানা দলছুট সাদা মেঘ দক্ষিণের জানলার ওপারে হুস করে ছুটে গেলেই, সনৎ সিংহমশাই মনে করিয়ে দিতেন, এতক্ষণে হয়তো মায়ের মুখ হল রঙ করা...। মন বসে কী আর! বসার কথাও নয়। কেননা যে অতীত বেশি দূরে নয়, আমার শৈশব-কৈশোরের সেই বাতাসে ততক্ষণে শিউলি সুবাসের সঙ্গে মিশে যেত নতুন পুজোসংখ্যার গন্ধ। আর এ কথা আমার একারও নয়। চোখ বুজে বলা যায়, এ আসলে ঘর ঘর কি কাহানি।
সন্দেহ নেই, বাঙালি লেখক ও পাঠকের যোগাযোগের জংশন যদি বইমেলা হয়, তবে সবথেকে বড় প্ল্যাটফর্ম অবধারিত এই পুজো। কর্মব্যস্ততার গ্যালপিং ট্রেনটি এইখানেই বেশ খানিক্ষণ দাঁড়ানোর অবকাশ পায়। ফলে পাঠক-লেখক অলৌকিক প্রেমের মোলাকাতটাও নতুন সৃষ্টিতে ভর করে হয়ে এসেছে বহুকাল ধরে। পুজোসংখ্যা যেন পাড়ার সেই ছোকরাটি, অমুখ পাড়ার দাদার চিরকুট হাতে যে গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় ও বাড়ির যৌবনে পা রাখা দিদিটির পাশে। তখন চোখে চোখে যে কথা তাইই গাঁটছড়া হয়ে যেত কটাদিন পরে। সেই শুভ পরিণয়ে শেষপাতে দুটো রসগোল্লা বেশি খেতে খেতে সেদিনের অনুঘটক চিরকুট বাহক ছোকরাটি যে গোপন শ্লাঘা বোধ হতো, লেখক-পাঠক সম্পর্কে পুজোসংখ্যার ভূমিকাও তাই।
তারপর একদিন পাড়া ফাঁকা করে চলে যেত সুন্দরীদের দিন। ঘনযৌবন গন্ধে মিশে যায় জিরে-হলুদের প্রয়োজনীয়তা। কপালের পাশে চূর্ণ অলকে আটকে থাকা বিন্দু ঘামের কুহকে লেগে যায় সংসারের ক্লান্তি। স্বপ্ন আর সুরাহার ভিতর সাঁকোতে শুধু স্মৃতির গতায়াত। ওই ছোকরার সেখানে বাহুল্য মাত্র। আর মেট্রোর পাতাল থেকে উপরে উঠে ঝকঝকে একটা শরতের আয়নাদিন দেখে আমাদের মনেও উসখুশ প্রশ্ন জাগে, পুজো সংখ্যার গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে?
এ প্রশ্ন নতুন নয়। নানাভাবে এর উত্তর খোঁজা হয়েছে। তবে এমন একটা সময় প্রশ্নখানা পানকৌড়ির মতো ভুস করে ভেসে উঠল যখন নতুন একটা শারদীয়া আত্মপ্রকাশ করল। আমার ভুল ধরিয়ে অগ্রজ সাহিত্যিক বিনোদ ঘোষাল বললেন, একটা কেন, ছোট বড় অনেক পত্রিকারই পুজো সংখ্যা প্রকাশিত হল। বিনোদদার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, পুজো সাহিত্যের পাঠক কমছে কি না? "পুজো সাহিত্যের পাঠক কমেছে বলে তো মনে হয় না। নইলে এখন ম্যাগাজিন আগের থেকেও অনেক বেশি, সেগুলো যদি বিক্রি না হত প্রকাশকরা খরচ করে ছাপবেনই বা কেন?", উত্তর তাঁর। অতএব লেখক অন্তত পাঠক কমার ভাবনায় ভাবিত নন। এ তো সুস্বাস্থ্য বলতে হবে।
তবু যা রটে তার কিছু তো বটে। অর্থাৎ এই যে পুজো সংখ্যার আবেদন কমেছে বলে তার মধ্যে সারবত্তা কি কিছু নেই? আছে। শেষ উপন্যাসটা যে কীভাবে লেখা হয় পূর্ণেন্দু পত্রীর সেই বিখ্যাত কবিতার দৌলতে তা আমাদের জানা।
পুজো সংখ্যার পাঠক কমা বা না কমার বিতর্কের মাঝে দাঁড়িয়ে কয়েকটি সমস্যা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। যেমন:
১) সঠিক পরিকল্পনার অভাব- পুজো সংখ্যা বহু লেখককে তৈরি করেছে অতীতে। খুব সাধারণভাবেই উল্লেখ করা যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আত্মপ্রকাশ’ ছাপা হয়েছিল এক পুজো সংখ্যাতেই। বাকিটা তো ইতিহাস। বর্তমানে এই নতুন লেখক তৈরির প্রক্রিয়ায় কি ব্যর্থ পুজো সংখ্যা? সাম্প্রতিক কিছু নমুনা দেখে তা মনে হয় না। সমস্যা হচ্ছে, পুজো সংখ্যার পরিকল্পনাতে। অনেক ক্ষেত্রেই তা বার্ষিক নিয়মরক্ষার নৈবেদ্য হয়ে উঠছে। ফলে হচ্ছে সবই, কিন্তু কোনওটাই প্রত্যাশিতভাবে ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
২) প্রতিযোগিতায় চমক দেওয়া- এ ওকে টেক্কা দিতে গিয়ে আদতে ক্ষতিই হচ্ছে শারদ সাহিত্যের। অমুখ কাগজ অমুখ লেখকের অপ্রকাশিত চিঠি ছাপলে, তমুখ কাগজ যেন নিয়মের মতো করে তমুখ লেখকের অপ্রকাশিত ডায়রি ছাপবেনই। বিজ্ঞাপনে তা চমক বটে, তবে সাহিত্য পাঠকের কাছে তা কতখানি প্রয়োজনীয়? খুব কি জরুরি তা, নাকি তার বদলে অন্য কোনও লেখকের বিশেষ ভাবনাকে জায়গা দেওয়া যেত পারত? গতে বাঁধা সূচি থেকে বেরনোর সময় হয়েছে মনে হয়।
৩)সঠিক পাঠক গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে না পারা- এ বেশ অদ্ভুত সমস্যা। ধরি ধরি মনে করি অথচ ধরতে পারলাম না গোছের ব্যাপার। ধরা যাক, একটি পত্রিকা গোষ্ঠীর একাধিক শারদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ফলত, সিনেমা সংক্রান্ত কোনো শারদীয়ায় একটি ভাল লেখা থাকলেও হয়তো সাহিত্যমনস্ক পাঠক সে সংখ্যা কিনলেন না। উলটে তিনি যে সংখ্যা কিনলেন সেখানকার সাহিত্য উপচারে তাঁর মন ভরল না। ফলে একজনের ধারণা আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক থেকে গেল, আদতে যা ক্ষতিকর।
৪) কম দামে বেশি দেওয়ার প্রবণতা- অন্যের থেকে আমি কত কম দামে কটা বেশি গল্প, উপন্যাস দিচ্ছি সেই দেখনদারিতে ক্ষতি হচ্ছে পুজো সাহিত্যের । সংখ্যায় বেশি দেখাতে এমন কিছু অপাঠ্য লেখা জায়গা পাচ্ছে, যা না থাকলেও কিছু ক্ষতি হত না। একটা প্রশ্ন অবশ্য আসে যে, লেখা ভাল-মন্দর বিচার যখন মহাকালের হাতেই ন্যস্ত, তখন আর এ প্রশ্নের অবতারণা কেন! কিন্তু পুজোসংখ্যার বিক্রির সঙ্গে ব্যবসার একটা এতপ্রোত সম্পর্ক আছে। বিজ্ঞাপনদাতার সমস্যায় সামগ্রিকভাবে প্রিন্ট মিডিয়া ভুক্তভোগী। সেখানে এক একটা পুজো সংখ্যার খরচও বিপুল। কিছু বিজ্ঞাপনদাতা এখনও পাওয়া যায়, যাঁরা উসাহ দেখান. এবার সংখ্যা বাড়িয়ে অপাঠ্য লেখা গুঁজে যদি পত্রিকা বিক্রি না হয়, তবে মালিক তাকে লোকসানের খাতায় তুলে দেবেন। এবং পরবর্তী বছরে পত্রিকা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আবার সেই গোড়ার পরিকল্পনার অভাবের সমস্যায় ফিরে যেতে হবে।
এ সমস্যার সমাধান কোন পথে তা নিয়ে বিস্তর ভাবনার অবকাশ আছে। পত্রিকা গোষ্ঠীগুলিই এর পথ খুঁজে বের করতে পারেন। কেননা সামগ্রিকভাবে প্রিন্টকে ধাক্কা দিচ্ছে ডিজিটাল মিডিয়া। যতই চ্যানেল ও ওয়েব থাকুক ছাপানো পুজোসংখ্যার এখনও কোনও বিকল্প নেই। তবু তারা যে অদ্বিতীয় তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। কেননা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ওয়েব সংস্থা পুজোসংখ্যা করা শুরু করেছে. এমনকী প্রিন্ট থেকে ডিজিটাল ভার্সনেও প্রকাশ করা হচ্ছে পুজোসংখ্যা।
তাহলে কি নতুন পুজোসংখ্যার গন্ধ কালে কালে হারিয়ে যাবে। খারাপ লাগলেও বাস্তব যেন সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। স্পনসরের অভাব থেকে শুরু করে বিপণনের সমস্যা জুড়ে পুজোসংখ্যার ভবিষ্যত খুব যে আশাবাহী তা বলা যাবে না। বরং ডিজিটাল ভার্সনে পুজোসাহিত্যের ফুলেফেঁপে ওঠার সূহ সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। সুগন্ধি মাখানো চিঠির পাতা যেমন বদলে গেল ইমেল থেকে হোয়্যাটসঅ্যাপ চ্যাটে। পুজোসাহিত্যও হয়তো একদিন জায়গা নেবে মোবাইলের কন্দরে। বিছানা-বালিশে আর ঘোরাঘুরি করবে না ঢাউস বইখানা। পড়তে পড়তে আনমনা দুপুরে নতুন ছাপা পাতার গন্ধে বাতাস খানিক্ষণ বিহ্বল হয়ে পড়বে না। এরকম দিন ভাবতেও কষ্ট হয়। অন্তত সদ্য শেষ করা বেশ কয়েকটি পুজোসংখ্যার দিকে তাকিয়ে তা তো একরকম কষ্টকল্পনাও বলে মনে হচ্ছে। তবু এ যেন প্রথম প্রেমের মতোই। চিরকাল হয়তো থাকবে না, তবু স্মৃতির গায়ে লেপটে থাকে কুমারীগন্ধ মাখা বিকেল। প্রকৃত প্রস্তাবে সে জীবনে থাকুক আর নাই থাকুক, তার অস্তিত্ব কখনও মিলিয়ে যায় না। পুজোসংখ্যার মান, সংখ্যা নিয়ে তাই আসলে যত প্রশ্নই উঠুক এ বাঙালি পাঠকের সেই আবেগ, শহরে শিউলি না ফুটলেও যে আবেগে শরতে শিউলিগন্ধ পান গোপনসূত্রে উদ্বাস্তুরা।
আলোচক পরিচিতি - সরোজ দরবার যাদবপুরের মাস কম্যুনিকেশনের ছাত্র।
পেশায় খবর লিখিয়ে। বর্তমানে সংবাদ প্রতিদিন-এ কী-বোর্ড চালান নিয়মিত। পাশাপাশি কবিতা ও গল্প লেখেন। প্রকাশিত বই- ‘চলতি হাওয়ার পংক্তি'।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।