আধুনিক ‘নকল বুঁদিগড়’
ভাস্কর বসু
ছোট বেলার পড়া আমরা চট করে ভুলিনা। মনে পড়ে, চিতোর রাণার সেই পণ, ‘জলস্পর্শ করবো না আর” আর তার থেকে রাজাকে রক্ষা করার জন্য সুচতুর মন্ত্রীর পরিকল্পনা।
আমার খুব বদনাম যে কথায় কথায় ‘রবিঠাকুর’ ডাকি। কি আর করা! আজকের যা আলোচ্য বিষয়, তাতে মনে হল এই ‘নকল বুঁদিগড়’ বেশ যুৎসইরকম প্রাসঙ্গিক।
যে বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করতে যাচ্ছি, তাকে আবার ‘দুধের সাধ ঘোলে মেটানো’ও বলা যেতে পারে। যা চাই তা পাওয়া দুষ্কর হলে আমাদের দুঃখ হতে পারে। তখন সুখের রাস্তা কি? ডেল কার্নেগী বলেছিলেন, “সুখে থাকতে শুরু করার উপায় হল সুখে থাকার ভান করা”! “If you are unhappy and you wish to be happy, start pretending that you are happy ...। তাই আমরা মাঝে মাঝে একটু ‘ভান’ করি বা ‘নকল বুঁদিগড়’ পাতি – সুখে থাকার জন্য। আর একটু এগিয়ে ভাবা যাক তো!! আচ্ছা, কোন সময়, ‘নকল’ কি বেশী গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে ‘আসল’ এর থেকে? পারেই তো।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কথাই ধরা যাক। দুর্ঘটনাতে হাত পা হারিয়েছেন এরকম মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে প্রযুক্তি, কৃত্রিম অঙ্গ দিয়ে তাকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে। সম্প্রতি কৃত্রিম কিডনি বানিয়ে চমক দিয়েছেন এক বাঙালী বিজ্ঞানী। [১]
চিত্র ১ – কৃত্রিম কিডনি |
তেমনি এক আপাত মন্দ কথা হল ‘ভান করা’। অনেক সপ্রতিভ মানুষ এই ‘ভান’ কৌশলের দ্বারা সাফল্যের দরজা অতিক্রম পৌঁছে যাচ্ছেন উচ্চাসনে, ধরা পড়ার ও ভয় করছেন না। অপরদিকে সহজ, সরল মানুষ বিপদে পড়ে যাচ্ছেন, ইঁদুরদৌড়ে তাঁরা পরাজিত হচ্ছেন, কারণ ‘ভান’, ‘ভণিতা’, ‘ভড়ং’ – কিছুই তাঁদের করায়ত্ত নয়। এই নিয়েও আবার সমাজবিজ্ঞানীদের মহা চিন্তা। কিন্তু কিছু প্রযুক্তিবিদ আবার ‘নকল’ এর মত ‘ভান’ এরও সদর্থক ভূমিকা বার করে ফেলেছেন।
খুব সহজভাবে বলতে গেলে, আজকের প্রযুক্তির জগতে খুব বড় জায়গাতে রয়েছে ‘সাদৃশ্য কৌশল’ (Simulation Technique)। সাহিত্যে উপমা বস্তুটির খুব প্রচলন, অদেখা জিনিষকে বোঝাতে গেলে সহজলভ্য বস্তুর উপমা দিয়ে তাকে সহজপাচ্য করা হয়। ‘অনেকটা ঠিক প্যাঁচার মতন’ – এই মোক্ষম উপমাতেই ‘সৎপাত্র’ গঙ্গারামের মুখশ্রী দর্শন হয়ে যায় পাঠকের। ঠিক এই ভাবে কোন কিছুকে যদি আসল জিনিষটি না দেখিয়ে প্রায় আসল সদৃশ নকল জিনিষ দেখিয়ে কার্যসিদ্ধ করা যায়, তাহলে অনেক সুবিধে। ঠিক যেমন চিতোরের রানাকে ‘নকল বুঁদিগড়’ দেখিয়ে কাজ হয়েছিল। আমরা কিছু উদাহরণের সাহায্যে সহজ ভাষায় এই সুবিধের দিকগুলো আলোচনা করতে চাই।
প্রযুক্তির কথা বলার আগে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখা যাক। ধরা যাক, কোন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেবে। তারজন্য সে প্রস্তুতি নেবে, সে নিজে বাড়ীতে বসে নিজের মত করে ছোটখাটো পরীক্ষাও দিচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আসল পরীক্ষার পরিবেশ হচ্ছে না। হয়তো সে আসল পরীক্ষার মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারছে না, ফলে প্রস্তুত থাকলেও সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত পরিবেশের জন্য সে ভাল ফল করতে পারলো না। এখন সেজন্য আসল পরীক্ষার আগে বিভিন্ন ‘Mock Test (মক টেস্ট)’ হয়। সেখানে চেষ্টা করা হয় প্রায় একেবারে মূল পরীক্ষার মত পরিবেশ তৈরী করার। একাধিক টেস্টের ব্যবস্থা থাকে। কাজেই ছাত্র ছাত্রীরা চূড়ান্ত পরীক্ষাতে অনেক বেশীমাত্রায় প্রস্তুত থাকে। কিন্তু এ পরিস্থিতি তো অনেক সহজ। কিন্তু ধরা যাক কোন পাইলট প্লেন ওড়ানোর শিক্ষা নিচ্ছে! তাকে তো একবারে প্রথমেই প্লেনে ঢুকিয়ে উড়তে বলা যায় না, -- সেক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির প্রয়োগ একেবারে মোক্ষম। আসছি পরে সে কথায়।
আচ্ছা, আমাদের দেশে রেল-দুর্ঘটনার কথা প্রায়শই কাগজে পড়া যায়। এখানেও ভাবা যায় রেল কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য “ট্রেন সিমুলেটর” এর কথা। আসলে দিনে দিনে রেলের গতিপথ অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠছে। অবিশ্বাস্য ভাবে বেড়েছে ট্রেনের সংখ্যা, বাড়ছে গতিবেগও। তাদের সামাল দিতে আসছে নিত্যনতুন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, নিত্য নতুন লাল, হলুদ, সবুজ সঙ্কেত। আরো আছে বিভিন্নভাবে যাত্রাকে নিরাপদ করার আধুনিক পদ্ধতি। এর সঙ্গে মিলিত হচ্ছে তাদের নিত্য নৈমিত্তিক দেখাশুনো করা, তত্ত্বাবধান করা যাতে তারা কাজের সময় ঠিকঠাক নিজের কর্তব্য পালন করতে পারে। সব মিলিয়ে রেলযাত্রাকে নির্বিঘ্ন, আরামপ্রদ অথচ দ্রুত গতিবেগসম্পন্ন করার জন্য চাই একটি বিশাল সুশিক্ষিত কর্মীদল। এই ‘সুশিক্ষা’র পিছনেও বড় অবদান থাকবে একটি দ্রুতগতিতে ধাবমান ট্রেন সদৃশ যন্ত্র, “Train Simulator”!
চিত্র ২ – নকল ট্রেনের কেবিন |
প্রায় সব ধরনের কর্মীরাই এর দ্বারা শিক্ষিত হতে পারেন। প্রথমত চালকরা শিখতে পারবেন কিভাবে নির্বিঘ্নে, অথচ দ্রুতগতিতে ট্রেন চালানো যায়। কোন বিপদের সম্মুখীন হলে তাঁদের কি কর্তব্য, কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে, বিপদের আগাম সঙ্কেত পেলে কি কি করণীয়, দুর্ঘটনা এড়ানো কিভাবে সম্ভব, কিভাবে অন্য চালকদের সাবধান করা যায়, - সব কিছুই তাঁরা আসল ট্রেনে না বসে এই যন্ত্রটির সাহায্যে শিখে ফেলতে পারবেন। এবার ধরা যাক, অন্যান্য মূল কর্মের সঙ্গে যারা জড়িত যেমন স্টেশন মাস্টার, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক, সহায়ক কর্মীরা, নিরাপত্তা রক্ষীরা – তাঁদেরও এই পদ্ধতিতে উঁচু মানের শিক্ষাদান সম্ভব। এমনকি ট্রেনের নতুন কোন প্রযুক্তি বা ব্যবস্থা চালু করার আগে দেখে নেওয়া যেতে পারে এর সুবিধা / অসুবিধাগুলো। সেই অনুযায়ী অগ্রিম, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব। বিদেশে খুব প্রচলিত, সুখের কথা ভারতেও ধীরে ধীরে এর প্রচলন বাড়ছে। [২]
এত গেল পরিবহন ক্ষেত্রের কথা। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বহুল প্রয়োগ রয়েছে এই পদ্ধতির। একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা। সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ধরা যেতে পারে ভূমিকম্পকে। আর আমরা সবাই জানি ভূমিকম্পের প্রভাব জাপানে খুব বেশী। কিন্তু আজ জাপানে তৈরী বাড়ি ঘর সেই ভূমিকম্পের মোকাবিলাতে অনেক প্রস্তুত। তাঁরা অনেক গবেষণা করে বার করেছেন কিভাবে বাড়ী বা অন্যান্য সৌধ - যেমন, রাস্তা, সেতু, কারখানা, অফিস বানানো যায় যাতে ভূমিকম্প সেরকম ক্ষতি না করতে পারে। এই নির্মাণে তাঁদের সাহায্য করেছে আধুনিক প্রযুক্তি। নকশা বানালেই তো হল না, তাকে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে তা সত্যিই ভূমিকম্পের আঘাতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কিনা। এখানেই আবার সেই ‘অনেকটা ঠিক প্যাঁচার মতন’। আধুনিক প্রযুক্তির দ্বারা, কোন নির্মিয়মান সৌধের ওপর ভূমিকম্পের মত আঘাত তৈরী করা সত্যিই সম্ভব। এটা আবার ঠিক, হুবহু সেইরকম তৈরী করতে গেলে চড়া দামের প্রশ্নও এসে যেতে পারে। উল্টো দিকে, দামের ভয়ে ‘হুবহু’ না করতে পারলে আবার আসবে আসন্ন বিপদের সম্ভাবনার কথা। এখানেই পরিকল্পনাকারীর পরীক্ষা, সব মিলিয়ে একটি এমন ব্যবস্থা করতে হবে যা সেখানকার বাসিন্দাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
বিভিন্ন দুর্যোগের ফলে আমাদের তথাকথিত আধুনিক নগরগুলির করুণ, বেহাল অবস্থা হয়। তার পেছনে কারণ হল আগুপিছু না ভেবেই দুমদাম নগরায়ন। উপযুক্ত পরিকাঠামোর কথা না ভেবে, নিয়মমাফিক পরিকল্পনা ছাড়াই এই ‘তথাকথিত’ উন্নয়ন ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনছে। আশার কথা, একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানুষের কিছু শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। এখন নতুন কোন নির্মাণ করতে গেলে পরিকল্পনাকে আগে থেকে যাচিয়ে নিতে হবে। এই নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে একেবারে খুব নিখুঁতভাবে দেখে নেওয়া যায় যে নতুন নির্মিত বস্তুটি, তা সেতু, রাস্তা, সৌধ, বাঁধ – যাই হোক না কেন তা পরিবেশের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ। একটি খুব ছোট উদাহরণ দেওয়া যাতে পারে – সম্প্রতি ভারতেও ‘স্মার্ট সিটি’ বলে একটি নতুন ভাবনা এসেছে। ১০০টি নতুন শহরকে এভাবে গড়ে তোলা হবে। শোনা যাচ্ছে, সেই শহরগুলির নির্মাণে এই প্রযুক্তির হাতে-নাতে প্রয়োগ হবে। এখন শহরের অনেক তথ্যই আমাদের হাতে, কত লোকের বাস, কত ঘরবাড়ি, কত স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কত, তার প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক অবস্থা কেমন, অধিবাসীবৃন্দের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কেমন, কত পরিমাণ জল বা বিদ্যুৎ দরকার, কত গাড়ী চলে, কত রাস্তা আছে বা প্রয়োজন ইত্যাদি। ধরা যাক, এই শহরে কোন বড় রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল, যেখানে মাননীয় অতিথিরা আসবেন, আসবেন বহু দর্শক। সাম্প্রতিককালে “সাজানো ঘটনা” শব্দবন্ধটি অতি দোষণীয়, কিন্তু এক্ষেত্রেও ঐ ঘটনাটি বাস্তবে ঘটার আগে একেবারে কৃত্রিমভাবে “সাজিয়ে” দেখে নিলে বোঝা যায়, কিরকম সমস্যা হতে পারে। সেই মত আগে থেকে পরিকল্পনা করে নিলে অনেক দুর্ভোগ এড়ানো সম্ভব।
আপামর বাঙালী Yes, No, Thank you এর পর যে ইংরেজি শব্দটির সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত তা হল Load-Shedding। এই বস্তুটির ক্ষেত্রেও সিমুলেসনের প্রয়োগ খুব কার্যকরী। উৎপাদিত বিদ্যুৎশক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কোন কোন ক্ষেত্রে কোন সময় কত পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি আবশ্যক, কি অনুযায়ী লোড শেডিং করা হবে, কিভাবে ধাপে ধাপে করা হবে আর উৎপাদিত শক্তির পরিমাণ কমবেশি হলে কিভাবেই বা তার মাত্রার পরিমাণ কমবেশি করা হবে তার আগাম আঁচ পাওয়া সম্ভব। যে সমস্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা এভাবে শিক্ষণপ্রাপ্ত হবেন, আসল কাজের সময় তাঁরা খুব ঠাণ্ডা মাথায় সুসিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, কারণ কৃত্রিম ভাবে এ সমস্যা তাঁদের অনেকবার মোকাবিলা করতে হয়েছে। ঠিক ঐ “মক টেস্ট” পরীক্ষার্থীর মত। এভাবে আগে থেকে পরীক্ষা করে রাখলে জানা যাবে কি সুবিধা অসুবিধা হতে পারে। এই পদ্ধতিতে অনেক রকম সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা সম্ভব কারণ তা আদৌ বাস্তব নয়, কৃত্রিম। ফলে সব চেয়ে সুসঙ্গত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।
চিত্র ৩ – বিদ্যুৎ পরিবহন ও বিতরণ ব্যবস্থা। |
হাসছেন তো!! জানি আপনারা কি বলবেন, ‘ছাড়ুন ছাড়ুন, যতই ভাবুন প্রযুক্তি, আসলে মন্ত্রীমশাই যেখানে যাবেন সেখানেই ‘নো লোডশেডিং’! তা অবশ্য একেবারে বেঠিক নয়, কিন্তু মন্ত্রীমশাইকে বোঝানোর জন্য এই রকম একটি কৃত্রিম, চমৎকার পরিবেশ খুব সহায়ক। ঠাণ্ডা ঘরে বসে, আরাম করে, দেয়ালে ছবি দেখেই তিনিও বুঝে যেতে পারেন - সোজা কথায় যাকে বলে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিলে ‘সাপ ও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না’ বা কিভাবে ‘একঢিলে দুই পাখি’ বধ করা সম্ভব। নাহলে হয়তো বিস্তর পরিশ্রমের পর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মন্ত্রী আর আধিকারিক মশাই, দুজনকেই আপশোস করতে শোনা যাবে, “সাত মন তেলও পুড়ল, রাধাও নাচল না!” সোজা কথায়, শুধু শিক্ষাদান নয়, সঠিক, সময়োপযোগী, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যও এই পদ্ধতি বহুল প্রচলিত।
এই পদ্ধতির এক বড় প্রয়োগ আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতে। আজকাল ডাক্তারি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাণীবধ নিষিদ্ধ। কিন্তু শিক্ষা তো আবশ্যক! নকল প্রাণীর ওপর যথেচ্ছ কাঁটাছেড়া একসঙ্গে মনোগ্রাহী এবং মেধাগ্রাহী হওয়ার সম্ভাবনা খুব উজ্জ্বল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন,
“Medical simulation has emerged as an important tool in modern medical education. However, the full range and impact of artificial environments can be hard to appreciate in a profession where real patients teach the most powerful lessons” [৩]
এমনকি অসুখ সারানোর ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটছে সুচারুরূপে। অনাবশ্যক ভীতি (Phobia) এক মারাত্মক ব্যাধি। অনেক শক্ত মানুষকেও তা কাবু করে দিতে পারে। এর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া্র সম্ভাব্য পথ,- সেই অসুস্থ মানুষকে কৃত্রিম ভীতিপ্রদ পরিবেশে রেখে তার নিয়মিত চিকিৎসা করা। ডাক্তাররা মনে করছেন, এই চিকিৎসার জন্য এই পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নিম্নরূপ,-
“This requires gradual and sequential exposure to the object(s) of the phobia as a part of the process. So yes, if a psychologist could create a few different scenarios, or have access to a number of objects, within a [VR] format it could be useful.” [৪]
অর্থাৎ ধাপে ধাপে, নির্দিষ্ট কালানুক্রম অনুসরণ করলে এই চিকিৎসাতে সুফল পাওয়া সম্ভব। ফলে চিকিৎসক যদি এই প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন রকমের কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন বা বিচিত্র সব ভীতিপ্রদ বস্তুগুলির সমাহার ঘটাতে পারেন, চিকিৎসা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা খুব উজ্জ্বল।
“Flight Simulator” বস্তুটি খুব প্রচলিত। এর সাহায্যে ‘নকল বুঁদিগড়’ এর মত নকল উড়োজাহাজ তৈরী সম্ভব। সে জাহাজ আবার উড়বে মানে প্রায় স্বাভাবিক ওড়ার ‘ভান’ করবে। আর হবু পাইলটরা এখানে বসেই শিখে ফেলবে কিভাবে দক্ষ চালক হতে হয়। তাদের সেই কাল্পনিক যাত্রাপথে ঝড়, ঝঞ্ঝা আসবে, বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত ও নামবে। এমনকি বিমানের মধ্যে কোনরকম যন্ত্রপাতির সমস্যাও হতে পারে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নও হতে পারে। এখানে কাজ করতে করতে চালকরা প্রায় সব ব্যাপারেই সিদ্ধহস্ত হয়ে যান। যেহেতু কোনপ্রকার ঝুঁকি নেই তাই তাঁদের অনেকরকম পরীক্ষা করা যেতে পারে। পরীক্ষাগারে বসে সেই বিভিন্ন পরীক্ষাতে তাঁরা কিভাবে মোকাবিলা করছেন, তার মূল্যায়ন ও খুব সহজ। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতি আলাদা হতেই পারে। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশেষভাবে শিক্ষার্থী অনুযায়ী আলাদা ভাবেও শিক্ষাদান সম্ভব। এইভাবে শিক্ষালাভ করার পর যখন শিক্ষার্থী চালক আসল উড়োজাহাজে হাত দেন, তার মনে হয় বেশ পরিচিত পরিবেশ। খুব সহজেই তারা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। আজকে এই পদ্ধতিতে শিক্ষণপ্রাপ্ত চালকরা ও স্বীকার করছেন যে এভাবে প্রায় সম্পূর্ণ শিক্ষা সম্ভব। ‘পথের দুধারে’ থাকা সকল ‘দেবালয়ে’র সঙ্গে পরিচিতি ও বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পর্ব সাঙ্গ করে পথের প্রান্তে র তীর্থে পৌঁছে তারা পুরোমাত্রায় সেই শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন যা আসল যাত্রাতেও হত। পরবর্তী কালে তাঁরা যাত্রাকালীন অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে দেখেছেন, ফল আশাতিরিক্ত ভাবে সন্তোষজনক। শুধু তাই নয়, এই পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য আরো নতুন প্রযুক্তির উচ্চমানের বা উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিমান তৈরিতেও খুব কাজে দেয়। আগেই বলেছি, ঝুঁকি নেই, তাই নানা রকম উদ্ভট, আপাত অবাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষাও করা চলে যা আসল বিমানে করা অসম্ভব।
উঃ, কি কথার কচকচি! মাথা ধরিয়ে দিল। পাঠক, অধৈর্য হয়ে পড়েছেন এতক্ষণে। ‘আরে, এবার একটু হাতে কলমে কিছু দেখান না’। এই যে নীচে দেখুনঃ
একেবারে অবাক কাণ্ড! এই ভিডিওতে দেখবেন পাইলট একেবারে ২২-২৩ ঘণ্টার যাত্রা করে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর থেকে একেবারে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পাড়ি দিচ্ছে। এমনকি বিমানবন্দরে নামার আগে তার চোখে পড়ছে লন্ডনের বিখ্যাত সৌধ লন্ডন আই, মানে যেমন স্বাভাবিক যাত্রাতে চোখে পড়ত আর কি। এরপরেতে ধীরে ধীরে যখন বিমান রানওয়ের মাটিতে অবতরণ করছে, আস্তে আস্তে বেগ কমে আসছে এবং মাটি স্পর্শ করার সময় একেবারেই মনে হচ্ছে না যে এটি আসল নয়। তবে কেন পরমুখে ঝাল খাবেন, লাগান এক ক্লিক!! দেখতে পাচ্ছেন মাঝে মাঝে কেমন সেই ঘরের বাইরে এসে দেখা যাচ্ছে, এটি আদৌ উড়ছে না, ওড়ার ‘ভান’ মাত্র।
চিত্র ৪ – ড্রিবলিং রত গ্যারিঞ্চা |
আচ্ছা, মতি নন্দীর ‘স্ট্রাইকার’ মনে আছ? সেই যে গ্যারিঞ্চার কোচ গ্যারিঞ্চাকে ড্রিবলিং অভ্যাস করতে বলেছিল কিভাবে, - না পরপর দাঁড় করানো সারিবদ্ধ কিছু কাঠির ভিতর দিয়ে বল নিয়ে গেলে নাকি ভাল প্র্যাকটিস হবে। গ্যারিঞ্চা রাজি হননি, “অপোনেন্ট তো আর খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না, সে নানা ভাবে বাধা দেবেই। কাজেই প্র্যাকটিস করতে গেলে সচল মানুষের সঙ্গে ড্রিবল করা দরকার?” [৫]
খুব সত্যি কথা। ‘সাজানো ঘটনা” আসলের একেবারে কাছাকাছি হতে হবে, তবেই না সত্যিকারের প্র্যাকটিস।
এই প্রযুক্তির মূল আকর্ষণ বা পরীক্ষা সেখানেই। ‘নকল’ আর ‘আসল’ বুঁদিগড় হুবহু একরকম হতে হবে। আজকালকার ‘চিতোর-রানা’ রা অনেক চালাক। কাজেই তাদের যদি ‘জলস্পর্শ’ করাতে হয়, তাহলে সেই ‘বুঁদিগড়’ এর এমন “নকল কেল্লা” পাততে হবে যা অবিকল আসলেরই মত। আশার কথা, প্রযুক্তির অভিমুখ সে দিকেই।
----------------------------------------------------------
- ১ http://www.anandabazar.com/others/science/bengali-scientist-has-invented-artificial-kidney-coming-in-market-soon-dgtlx-1.559550
- ২ http://www.delhimetrorail.com/training-institute/dsimulator.html
- ৩ https://hms.harvard.edu/simulation-medical-education-what-can-you-really-teach
- ৪ - https://uploadvr.com/virtual-reality-helping-people-overcome-fears-phobias/
- ৫ দশটি কিশোর উপন্যাস - মতি নন্দী, আনন্দ, পৃঃ ৭০
লেখক পরিচিতি - জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত। ।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.