২০১৬-র বিজ্ঞান-সাধনার নোবেল
কেয়া মুখোপাধ্যায়
নোবেল পদক
১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর। সুইডিশ ভাষায় নিজের হাতে লিখে চার পৃষ্ঠার উইলে স্বাক্ষর করলেন আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল। কোন উকিলের সাহায্য ছাড়াই তৈরি নিজের উইলটি তারপর রেখে দিলেন নিজের কাজের ডেস্কে। সারাজীবনের সঞ্চিত ধনসম্পত্তির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দেওয়া ছিল সেই উইলে।
অ্যালফ্রেড নোবেলের উইল-এর প্রথম পাতা
১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ইতালির সান রেমোতে ৬৩ বছর বয়সে আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুর পর দেখা গেল উইলে তাঁর সম্পদের প্রায় চুরানব্বই শতাংশ দেওয়া হয়েছে ‘নোবেল ফাউন্ডেশান’ গড়ার জন্য। আর্থিক মূল্যে সেইসময় তা ছিল ৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার। এখন তার পরিমাণ প্রায় ২৬৫ মিলিয়ন ডলার। নোবেল ফাউন্ডেশানের সুনির্দিষ্ট দায়িত্বও উল্লেখ করা ছিল উইলে। প্রতিবছর চিকিৎসাবিজ্ঞান অথবা শারীরতত্ত্ব, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তি- এই প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবকল্যাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান যাঁরা রাখবেন, তাঁদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে নোবেল ফাউন্ডেশানের পক্ষ থেকে।
উল্লেখ করা ছিল, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের পুরস্কার দেবে সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শরীরতত্ত্ব-র পুরস্কার দেবে স্টকহোমের ক্যারোলিন ইন্সটিটিউট (নামান্তরে ক্যারোলিন্সকা ইন্সটিউট), সাহিত্যের পুরস্কার দেবে অ্যাকাডেমি ইন স্টকহোম এবং শান্তি পুরস্কার দেবে নরওয়ের পার্লামেন্ট কর্তৃক নিয়োজিত পাঁচ সদস্যের এক কমিটি।
নোবেল ফাউন্ডেশান গঠন করে ১৯০১ সাল থেকে সূচনা হল নোবেল পুরস্কারের। তারপর কেটে গেছে একশো পনেরো বছর। আরও বেশি অর্থমূল্যের অন্য পুরস্কার দেওয়াও হয়তো শুরু হয়েছে। কিন্তু আজও সম্মানের দিক থেকে মানবকল্যাণে নিবেদিত কাজের স্বীকৃতিতে প্রদত্ত আন্তর্জাতিক নোবেল পুরস্কারকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি আর কোন পুরস্কার।
প্রতি বছর অক্টোবর মাসে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা হয়। অন্য সব বিষয়ের পাশাপাশি খুব আগ্রহ থাকে বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার নিয়ে। ফ্রন্ট-পেজ স্টোরি হয় কাগজে। বিজ্ঞানের খবরে আগ্রহীরা ছাড়াও বিশ্ববিজ্ঞানের হেঁশেলের খবর জানতে উৎসুক হয়ে থাকেন এমন অনেকে, যাঁদের দৈনন্দিন জীবনচর্চার সঙ্গে বিজ্ঞান সম্পৃক্ত নয়। তাঁদের কাছে ২০১৬-র বিজ্ঞানের যে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলি নোবেল পুরস্কার পেয়েছে- সেগুলো সংক্ষেপে, সহজ কথায় পৌঁছে দিতেই এই নিবন্ধে বিশেষ গবেষণাগুলোর মূল নির্যাসটুকু তুলে ধরা। এ থেকে বিজ্ঞানের অগ্রগতি এখন কোন পথে, আর ফোকাস ঠিক কোথায়- সেটা পাঠকরা হয়তো বুঝতে পারেন। পৃথিবী জুড়ে সামগ্রিক ভাবে বিজ্ঞানের যে দুরন্ত অগ্রগতি হয়েছে, বাংলা পরিভাষা কিন্তু সেভাবে এগোয়নি। তাই প্রয়োজনে ইংরেজি শব্দগুলো রেখেই বাংলা আলোচনায় আবিষ্কারটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হল।
২০১৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ তিন বিজ্ঞানী। সিয়াটেলের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ডেভিড জে. দোলেস, নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির এফ. ডানকান এম. হ্যালডেন, আর রোড আইল্যান্ডের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির জে. মাইকেল কস্টারলিৎজ। পুরস্কার মূল্যের অর্ধেক পেয়েছেন ডেভিড জে. দোলেস আর বাকি অর্ধেক এফ. ডানকান এম. হ্যালডেন ও জে. মাইকেল কস্টারলিৎজ।
এ বছরের পুরস্কার প্রাপক তিন বিজ্ঞানী এমন এক অজানা জগতের দরজা খুলে দিয়েছেন, যেখানে পদার্থ অস্বাভাবিক বা বিচিত্র অবস্থায় বদলে যেতে পারে। তাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে বস্তুর অপ্রত্যাশিত আচরণ ও নিয়ন্ত্রণ আবিষ্কার করেছেন তাঁরা। গণিতের প্রতিষ্ঠিত ধারণা টপোলজি দিয়ে তাঁরা ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করেছেন এই আবিষ্কার।
কোনও পদার্থ যখন চরম অবস্থায় থাকে, তখন সেই পদার্থের পরমাণুগুলোর আচরণ অস্বাভাবিক হয়। পদার্থের এই বৈশিষ্ট্যি তার কঠিন, তরল ও বায়বীয়- এই তিনটি অবস্থাকে পূর্ণতা দেয়। খুব বেশি তাপ, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা কিংবা খুব শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে পদার্থের নানা ধরনের অস্বাভাবিক অবস্থা দেখা যায়। যেমন, সুপারকন্ডাকটর বা সুপারফ্লুয়িড কিংবা খুব পাতলা ম্যাগনেটিক ফিল্ম। তখন পদার্থের যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তা পর্যায়ক্রমে পাল্টাতে পারে। পদার্থের তিন পরিচিত অবস্থার বাইরে এই তৃতীয় অস্বাভাবিক অবস্থারই ব্যাখ্যা করে নতুন এক দিকের সন্ধান দিয়েছেন দোলেস, হ্যালডেন আর কস্টারলিৎজ।
গত শতকের সাতের দশকের প্রথমদিকে সুপারকন্ডাকটর (খুব নিম্ন তাপমাত্রায় যেসব বস্তু বিদ্যুৎ পরিবহন করে) বা সুপারফ্লুয়িড সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা, অর্থাৎ খুব পাতলা স্তরে বিদ্যুৎ পরিবহন সম্ভব নয় বলে যে তত্ত্ব ছিল, তাকে পালটে দিয়েছিলেন দোলেস ও কস্টারলিৎজ। নিজেদের গবেষণায় খুবই কম তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাকটরের পাতলা স্তরেও ইলেকট্রনের প্রবাহ বা বিদ্যুৎ পরিবহন সম্ভব দেখিয়েছিলেন তাঁরা। একইসঙ্গে তাঁরা এর পদ্ধতি এবং অবস্থার পরিবর্তন সাপেক্ষে, খুব উচ্চ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাকটিভিটি বা পরিবাহিতা বিলোপও ব্যাখ্যা করেন।
মসৃণ আকৃতির সমতলীয় বা পাতলা স্তরের ভেতরের বস্তুকে দ্বিমাত্রিক বিবেচনা করে টপোলজির মাধ্যমে পদার্থের অবস্থা বা দশার পরিবর্তনগুলো দেখান দোলেস ও কস্টারলিৎজ। টপোলজি হচ্ছে জ্যামিতির এমন একটি আধুনিক শাখা বা রূপ, যার সাহায্যে বস্তুর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা যায়। টপোলজি অনুযায়ী, কোনো বস্তুর প্রসারণ বা মোচড় বা আকৃতির পরিবর্তন হলেও সেই বস্তুর বৈশিষ্ট্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। বস্তুর বৈশিষ্ট্য কেবল কতগুলো পূর্ণ ধাপেই পরিবর্তিত হবে। এক্ষেত্রে বস্তুকে ছিঁড়ে ফেলা বা খণ্ডিত করা হলে তার বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হয়ে যাবে। পরবর্তীকালে হ্যালডেন টপোলজির ধারণার মাধ্যমে আরও পাতলা, যাকে প্রায় একমাত্রিক ধরা যেতে পারে, এমন বস্তুর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন।
এই গবেষণার ফলে ভবিষ্যতে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দিশা দেখা দিয়েছে। বিশেষত, এর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স-এর নানা প্রয়োজনীয় উপাদানের উন্নতি হবে। নতুন প্রজন্মের ইলেকট্রনিক্স ও সুপারকন্ডাকটর বা ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রে টপোলজিক্যাল বস্তু ব্যবহারযোগ্য হতে পারে বলে এখন আশা জেগেছে৷ কোয়ান্টাম কম্পিউটার বা অত্যন্ত দ্রুতগতির কম্পিউটার তৈরির পথও সুগম হবে বলে বিশ্বাস।
এ বছর আণবিক যন্ত্র (মলিকুলার মেশিনস) নিয়ে কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে রসায়নে নোবেল পেলেন ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গ ইউনিভার্সিটির জাঁ পিয়েরে সভেজ, আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির স্যার ফ্রেজার স্টডডার্ট ও নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিঙ্গেন ইউনিভার্সিটির বার্নাড ফেরিঙ্গা।
দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মলিকুলার মেশিনস বা আণবিক যন্ত্রের নকশা ও সংশ্লেষে অবদান রাখায় তিন বিজ্ঞানী এই পুরস্কার পাচ্ছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট এই মলিকুলার মেশিন বা আণবিক যন্ত্র নিয়ন্ত্রণযোগ্য, ন্যানোমিটার আকৃতির কাঠামো- যা রাসায়নিক শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তি ও গতিতে রূপ দিতে পারে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে রসায়নবিদেরা আণবিক সুইচ থেকে শুরু করে আণবিক মোটর পর্যন্ত নানা যন্ত্র তৈরি করতে পারেন।
মেশিনকে আণবিক স্তরে পৌঁছে দেওয়া এই আবিষ্কার রসায়নকে এক বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। ১৯৮৩ সালে এই গবেষণার প্রাথমিক ধাপের সূচনা শুরু করেছিলেন জাঁ পিয়েরে সভেজ। রিং আকারের দুটো অণুকে জুড়ে দিয়ে একটা চেইন তৈরি করেছিলেন সভেজ সেইসময়ে, নাম দিয়েছিলেন ক্যাটেনেন (catenane)। সাধারণত অণুরা শক্তিশালী কোভ্যালেন্ট বন্ড-এর মাধ্যমেই পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে থাকে, আর পরমাণুরা সেখানে ইলেকট্রন শেয়ার করে। কিন্তু এই বিশেষ চেইনে অণুরা যুক্ত হয়েছিল এক ধরনের যান্ত্রিক বন্ড এর মাধ্যমে। একটা মেশিনের প্রতিটি যন্ত্রাংশকে কাজ করতে হলে তার প্রতিটা অংশকেই অন্যগুলোর সাপেক্ষে চালু রাখতে হবে। ঠিক এই শর্তটাই পূরণ করেছিল দুটো পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে থাকা রিং।
১৯৯১ সালে রোটাক্সেন আবিষ্কারের মাধ্যমে এই গবেষণার দ্বিতীয় ধাপের সূচনা শুরু করেছিলেন ফ্রেজার স্টডডার্ট। আণবিক রিং-কে তিনি জুড়ে দিলেন একটা পাতলা আণবিক অক্ষ-র সঙ্গে আর দেখালেন, আর দেখালেন অক্ষ বরাবর রিং ঘুরতে পারছে। রোটাক্সেন-এর ওপর নির্ভর করেই তিনি আণবিক লিফট, আণবিক মাসল এবং আণবিক কম্পিউটার চিপ তৈরি করেন।
১৯৯৯ সালে বার্নাড ফেরিঙ্গাই সর্বপ্রথম একটা মলিকুলার মোটর তৈরি করলেন। সেবছরই একটা আণবিক রোটর-ব্লেডকে একই দিকে ক্রমাগত ঘোরান তিনি। আণবিক মোটর ব্যবহার করে, মোটরের চেয়ে ১০,০০০ গুণ বড় একটা গ্লাস সিলিন্ডারকে ঘুরিয়েছিলেন তিনি। ফেরিঙ্গা একটা ন্যানোকারও ডিজাইন করেন।
নতুন ধরনের সেন্সর বা শক্তি সঞ্চয়কারী সিস্টেম তৈরিতে এই আণবিক মেশিনের ব্যবহার হবে।
নিজের শরীর নিয়ে মানুষের ভালবাসা বেশি বলেই চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত নোবেল পুরস্কারে মানুষের আগ্রহ যথেষ্ট বেশি। ২০১৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অথবা শারীরতত্ত্বে নোবেল পেয়েছেন টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ইয়োশিনোরি ওশুমি।
দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন ইয়োশিনোরি ওশুমি। ১৯৪৫ সালে জাপানের ফুকুওয়াকায় তাঁর জন্ম। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে পিএইচডি করেন ওশুমি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর গবেষণার পর ১৯৮৮ সালে তিনি টোকিওতে আগের কর্মস্থলে যোগ দেন এবং নিজস্ব ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অধ্যাপনা করছেন।
ক্ষয়প্রাপ্তকে কোষীয় বস্তুকে পুনঃব্যবহারযোগ্য (recycle) করে কোষের সজীব থাকার কৌশল উদ্ঘাটনের জন্যই চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর নোবেল পুরস্কার। কোষের এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘অটোফেজি’। অটোফেজি শব্দটির উৎস দুটি গ্রিক শব্দ- অটো (self, স্বয়ং) ও ফেজেইন (phagein, খাওয়া, ভোজন)। বাংলায় ‘স্ব-ভোজন’ বা ‘আত্মভোজন’ বলা যেতে পারে।
অটোফেজি সংক্রান্ত ধারণা নতুন নয়। মোটামুটি ১৯৫০ সাল থেকেই এ বিষয়ে নানা চিন্তাভাবনা হয়েছে। পাঁচের দশকের মাঝামাঝি আবিষ্কার হয় লাইসোজোমের। তখনই প্রথম দেখা গিয়েছিল যে কোষ তার নিজের কোনও উপাদান বা প্রোটিনকে অপ্রয়োজনীয় মনে করলে তাকে আবরণী (membrane) দিয়ে ঘিরে ফেলে থলির মতো ‘ভেসিকল’-এ (sack-like vesicles) পরিণত করে। তারপর ক্ষয় (degradation) করার জন্য তাদের পাঠিয়ে দেয় লাইসোজোম (lysosome) নামক পুনঃব্যবহারযোগ্য করার বিশেষ প্রকোষ্ঠে (recycling compartment)। বেলজিয়ান বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান রেনে দি দুভ লাইসোজোম আবিষ্কাররের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৭৪ সালে। ‘অটোফেজি’ নামে তিনিই চিহ্নিত করেন প্রক্রিয়াটিকে। নতুন ভেসিকলগুলোর নাম দেন ‘অটোফেগোজম’ (autophagosome)।
সাতের দশকের শেষে ও আটের দশকে কোষের প্রোটিন ক্ষয় করার জন্য প্রোটিয়জোম (proteasome) আবিষ্কার হয়। ইউবিকুটিন (ubiquitin-mediated protein degradation)-এর মাধ্যমে প্রোটিন ক্ষয় আবিষ্কার করে ২০০৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান অ্যারন সিচানোভার, অ্যাভরম হারশকো ও আরইউন রোজ। একটি একটি করে প্রোটিনের অবক্ষয় ঘটায় ইউবিকুইটিন।
কিন্তু এই পদ্ধতিগুলোর কোনটাই ব্যাখ্যা করতে পারেনি ঠিক কোন পদ্ধতিতে কোষ থেকে বড় আকারের প্রোটিন কমপ্লেক্স কিংবা ক্ষয় হয়ে যাওয়া কোষীয় অরগ্যানেলগুলো বেরিয়ে যায়। অটোফেজি প্রক্রিয়াতেই যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে তার বিস্তারিত ও স্পষ্ট ধাপগুলো কী, কোষে অটোফেজির অস্তিত্বই বা খুঁজে পাওয়া যাবে কীভাবে! ওশুমির আবিষ্কারের ফলেই কোষে অটোফেজির প্রক্রিয়াটি নিয়ে বিস্তারিত জানা গেল। তাই ওশুমির গবেষণা বিজ্ঞানীমহলে অত্যন্ত সমাদৃত।
১৯৮৮ সাল থেকেই ওশুমি বেকারিতে ব্যবহার্য ইস্ট কোষের রসপূর্ণ গহ্বর (vacuole)-এর মধ্যে থাকা প্রোটিনের অবক্ষয়-প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণায় খুব আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গঠনগত দিক থেকে ইস্ট কোষ মানবদেহের কোষের মতো। সেইজন্যই গবেষণার জন্য ইস্ট-কোষ বেছে নিয়েছিলেন ওশুমি। অবশ্য কারিগরি ও প্রযুক্তিগত কারণে এ কোষের অটোফেজি পদ্ধতি আবিষ্কার করতে কিছু সমস্যাও হয়েছে।
সুদীর্ঘ গবেষণায় ওশুমি অটোফেজি প্রক্রিয়ার সূক্ষ্ম বিষয়গুলো উন্মোচন করেন। বেকারিতে ব্যবহৃত ইস্ট নিয়ে গবেষণা চালিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, কী করে কোষ তার নিজের উপাদানগুলোকে নিজেই হজম করে ফেলে। ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় দেহকোষ নিজস্ব উপাদানের ক্ষয়রোধ করে এবং পুনর্ব্যবহারের উপযোগী হয়ে ওঠে সেটি তিনি স্পষ্ট করেন। ওশুমির এ আবিষ্কার দেহকোষের উপাদানগুলোর অবক্ষয় ও সেসবের পুনর্বার ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠার বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করেছে।
ওশুমির অটোফেজি পদ্ধতির মডেল
ইস্টে অটোফেজি আবিষ্কারের এক বছরের মধ্যেই অটোফেজির জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট জিনগুলোকেও শনাক্ত করেছেন তিনি। এই জিনগুলোর তৈরি প্রোটিনগুলোকেও নির্দিষ্ট করেন তিনি। দেখা গেল কয়েকটি প্রোটিন ও প্রোটিন কমপ্লেক্স মিলে একের পর এক ধাপে ধাপে অটোফেজির পুরো পদ্ধতিটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। অটোফ্যাগোজোম তৈরির সূচনা ও তার কাজ নিয়ন্ত্রণের প্রতিটি ধাপে এক একটি প্রোটিন লাগে।
অটোফেজি প্রক্রিয়া মাধ্যমেই গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় বিষয়, কোষের পুষ্টির ঘাটতি ও বিভিন্ন রোগের কারণ জানা যাবে। অটোফেজি জিনে মিউটেশন হলে নানা রোগ দেখা দেয়। অটোফেজি পদ্ধতিতে ঠিক কোন জটিলতার কারণে ক্যান্সার থেকে শুরু করে পারকিনসন্স ডিজিজ ও অন্যান্য কিছু স্নায়বিক রোগ হয়, তার কারণ নির্ণয় ও নিরাময়ের ওষুধ তৈরির জন্য ওশুমির এই আবিষ্কার খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আবারও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে অক্টোবর মাস পর্যন্ত, বিজ্ঞানের আর কোন কোন যুগান্তকারী আবিষ্কার এ বছর নোবেল পুরস্কার পেল, তা জানার জন্য।
লেখক পরিচিতি - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এখন আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা। আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। মনের আনাচ-কানাচ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া খেয়ালখুশির রঙচঙে টুকরো কাচের বর্ণময়তাকে অক্ষরে অক্ষরে ধরে রেখেছেন প্রথম বই ‘ঠিক যেন ক্যালেইডোস্কোপ’-এর পাতায়।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.