প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা

বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা - পনেরোই এপ্রিল ২০১৭

 

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং

কেয়া মুখোপাধ্যায়



১৯৫৫-র ১৮ এপ্রিল। নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারে প্রয়াত হলেন বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছেকে সম্মান দিয়ে সেদিনই দাহ করা হল তাঁকে। চিতাভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হল তাঁর জানিয়ে যাওয়া নির্ধারিত স্থানটিতে।

সেদিন কেউই জানতেন না, অটোপ্সি করার সময় প্রিন্সটনের প্যাথোলজিস্ট টমাস হার্ভে, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কটি সরিয়ে নিয়ে ডুবিয়ে রেখেছিলেন ফর্ম্যালিন ভর্তি একটা জারের ভেতর। প্রয়োজনীয় অনুমতি না নিয়েই। হার্ভের ইচ্ছে ছিল আইনস্টাইনের অসামান্য ধী-শক্তি বা মেধার জন্য তাঁর মস্তিষ্কের কী অবদান, সেটা পরীক্ষা করে দেখার। কিন্তু বাস্তবে সেটা কার্যকরী হয়নি সঙ্গে সঙ্গে। হার্ভের কিচেন কাউন্টারে ফর্ম্যালিনে ডুবে থেকে কয়েক দশক কাটিয়ে দিয়েছিল আইনস্টাইনের ব্রেন। মাঝে মধ্যে কোনও অতিথি এলে কিচেনের ছুরি দিয়েই সেই মস্তিষ্কের টুকরো কেটে নিয়ে ফার্মেসিতে যেসব প্লাস্টিকের কৌটোয় ওষুধ দেয়, তাতে ভরে স্মারক হিসেবে উপহার দিতেন হার্ভে।

গত শতকের আটের দশকে অবশ্য আইনস্টাইনের ব্রেনের কিছু টুকরো নিয়ে স্লাইড বানানো হয়েছিল। ন’য়ের দশকে হঠাৎই হার্ভের মনে হল আইনস্টাইনের নাতনির হাতে তাঁর মস্তিষ্কের বাকি অংশটুকু তুলে দেবেন। তাই ফ্লোরিডা থেকে ড্রাইভ করে তিনি চলে গেলেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। কিন্তু আইনস্টাইন নাতনি নিতে সম্মত হলেন না। তারপর হার্ভে সেই মস্তিষ্ক জমা দিলেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে।

টমাস হার্ভের উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে, আইনস্টাইনের অসামান্য মেধার সঙ্গে মস্তিষ্কের কোনও বিশেষ অ্যানাটমিক্যাল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, তাহলে প্রথমেই সে ব্যাপারে তিনি কেন উদ্যোগী হলেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শেষ অবধি অবশ্য কয়েকজন বিজ্ঞানী তাঁর মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করে কয়েকটি পেপার করেছেন। তাঁদের মধ্যে হার্ভেও আছেন। তবে যেভাবে বহু বছর হার্ভে মস্তিষ্কটি রেখেছিলেন, তাতে সংরক্ষণ করার নিয়ম যথাযথভাবে মেনে চলা হয়নি। তাই স্পেসিমেন হিসেবে সেটি আর খুব একটা ভাল অবস্থায় ছিল না। পেপারগুলির কাজ নিয়েও যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে।

আইনস্টাইনের প্রতিভা সম্পর্কে নানা কথা প্রচলিত ছিল। আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক সাধারণ মানুষের তুলনায় বড়, তাঁর মস্তিষ্কে খাঁজ সাধারণের চেয়ে বেশী ইত্যাদি। বাস্তবে তা ঠিক মেলেনি। দেখা গেল, তাঁর মস্তিষ্কের ওজন অন্য সাধারণ পুরুষদের তুলনায় বরং খানিকটা কমই।

১৯৮৫ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে-র নিউরোসায়েন্টিস্ট ম্যারিয়ান ডায়মন্ড জানালেন যে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে কিছু অতিরিক্ত কোষ রয়েছে। তাদের বলা হয় গ্লিয়া (glia)। বাঁ কানের পেছনদিকে, একটু উপরের দিকে মস্তিষ্কের যে অংশ, অর্থাৎ প্যারাইটাল লোব, সেখানকার তা চিন্তা-ভাবনায় নিয়োজিত নিউরোনদের সাহায্য করাই হল গ্লিয়ার কাজ। গণিতের উৎকর্ষের ব্যাপারে এগুলোর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। আবার এর সাত বছর পরে, ১৯৯২ সালে জাপানের ওসাকার এক বিজ্ঞানী তাঁর মস্তিষ্কের গ্লিয়া আর নিউরোনের উচ্চতর অনুপাতকেই চিহ্নিত করলেন তাঁর ডিসলেক্সিয়া বা, পাঠের ক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণ হিসেবে। ১৯৯৬-তে হার্ভে তাঁর পেপারে বললেন, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের নিউরোনের ঘনত্ব বেশি, সেটাই নিউরোনের পারস্পরিক কম্যুনিকেশন বাড়িয়ে দেয় এবং হয়তো সেটাই তাঁর বিশেষ ধী-শক্তির কারণ। এরপর ১৯৯৯ সালে কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট স্যান্ড্রা উইটেলসন ‘The exceptional brain of Albert Einstein’ শীর্ষক পেপারে, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের প্যারাইটাল লোবের ভিন্ন ধরনের গঠন, ভাঁজ আর খাঁজের কথা উল্লেখ করলেন। তাঁর ধারণা, অন্যান্য সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেকটা আগেই তৈরি হয়েছে তারা এবং হয়ত আইনস্টাইনের বিশেষ মেধার সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা। ২০১৩-তে ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যানথ্রোপলজিস্ট ডিন ফাক বললেন, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে একটা বিশেষ ওমেগা চিহ্ন, আর একটা নবের মতো ভাঁজ খুঁজে পাওয়া গেছে এমন জায়গায়, যেটা বাঁ হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে। মিউজিশিয়ানদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য থাকে। কে না জানে যে আইনস্টাইন একজন সুদক্ষ ভায়োলিনবাদকও ছিলেন।

আইনস্টাইন ও তাঁর মস্তিষ্ক

এইভাবে মোটামুটি ১৯৮৫ সাল থেকেই বিভিন্ন গবেষণালব্ধ ফল প্রকাশ হয়ে চলেছে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের অংশ, তা থেকে তৈরি স্লাইড, কোষ গণনা, নানা দিক ও কোণ থেকে তোলা অসংখ্য ছবির ওপর ভিত্তি করে আর তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের তুলনা করে। সামান্যতম পার্থক্য খুঁজে পেলেই আইনস্টাইনের অনন্য মেধার জন্য চিহ্নিত করা হচ্ছে সেই বিশেষত্বকে।

কিন্তু এই সব গবেষণাই হয়েছে বা চলছে সেই ১৯৫৫ সালে হার্ভের কেটে নেওয়া মস্তিষ্কের ছবি আর তার খণ্ড নিয়ে, বিশেষজ্ঞদের মতে, যা নাকি দক্ষ ভাবে কাটাও হয়নি আর সংরক্ষিতও হয়নি সঠিকভাবে। তাছাড়া, মস্তিষ্কের অ্যানাটমি শুধু আংশিক ধারণা দিতে পারে। মেধার অ্যানাটমি কি এভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব? সে যাই হোক, প্রশ্ন হল, ‘ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং’ নিয়ে লিখতে গিয়ে ধান ভানতে শিবের গীতের মতো আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে এতো কথা কেন?

আইনস্টাইন প্রসঙ্গ আসার একটাই কারণ। সময়কাল। একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারা যাবে, আইনস্টাইনের জীবদ্দশাতেই পদার্থবিজ্ঞানের এমন দু’দুটো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার নোবেল পুরস্কার পেয়েছে, যা পরবর্তীকালে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এমআরআই আবিষ্কারের প্রাথমিক ভিত্তি।

পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চৌম্বকধর্ম রেকর্ড করার রেজোনেন্স পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন ইসিডোর আইজ্যাক রাবি। আর ১৯৫২ সালে নিউক্লিয় চৌম্বকক্ষেত্রে সূক্ষ্ম পরিমাপের জন্য নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন ফেলিক্স ব্লখ ও এডোয়ার্ড এম. এম. পার্সেল। কিন্তু সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে ‘ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং’ আবিষ্কারে লেগে গেল আরো কয়েক দশক। তা না হলে, আইনস্টাইনের বিস্ময়কর প্রতিভার কারণ খুঁজতে তাঁর মৃত্যুর পর অটোপ্সির সময়ে সংগ্রহ করা ব্রেন স্পেসিমেনের ওপর নির্ভর করতে হত না। আইনস্টাইনের সচল মস্তিষ্কের মধ্যে নিউরাল ইমপালস বিভিন্ন মুহূর্তে কীভাবে কাজ করে জানার জন্য তাঁর মস্তিষ্কের ইমেজিং করা যেত। সেসব ছবি থেকে মেধার কারণ খোঁজ করার প্রয়াস অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গতও হত, কারণ অযত্নে রাখা ব্রেন স্পেসিমেনের পোস্টমর্টেম পরীক্ষায় তা কোনওভাবেই ধরা সম্ভব নয়।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে সার্বিকভাবেই পদার্থবিজ্ঞানীদের অবদান অবিস্মরণীয়। তার খুব গুরুত্বপূর্ণ সূচনাকাল বোধহয় ১৮৯৫ সাল। যখন উইলহেম কনরাড রন্টজেন এক্স রে আবিষ্কার করলেন। সংক্ষেপে একবার সেরকম কয়েকটি আবিষ্কার ফিরে দেখা যাক।

এক্স রে, নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স, আলট্রাসাউন্ড, পার্টিকল অ্যাক্সেলারেটর, রেডিয়ো আইসোটোপের মাধ্যমে ট্যাগিং-এর মতো জরুরি ডিটেকশন পদ্ধতিগুলো পদার্থবিদরাই পদার্থবিজ্ঞানের আঙিনা থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে নিয়ে এসেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এরাই চিহ্নিত হয়েছে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (magnetic resonance imaging (MRI)), কম্প্যুটারাইজড টোমোগ্রাফি স্ক্যানিং (computerized tomography (CT) scanning), নিউক্লিয়ার মেডিসিন (nuclear medicine), পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি স্ক্যানিং (positron emission tomography (PET) scanning), এবং বিভিন্ন রেডিয়োথেরাপি চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে। বিভিন্নভাবে মানবশরীরের ছবি তুলে রোগনির্ণয় করার বিষয়টিতে যুগান্তকারী অবদান রেখেছে চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞানের এই সমন্বয়।

কয়েক বছর আগে, ২০০৮ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিয়োজিত পদার্থবিদদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ ফিজিসিস্টস ইন মেডিসিন (American Association of Physicists in Medicine (AAPM)) তাদের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করল। সেই উপলক্ষে তাঁরা স্মরণ করেছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলিকে। সেখানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে নিউ ইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন-কেটেরিং ক্যান্সার সেন্টারের ‘মেডিক্যাল ফিজিক্স’ বিভাগের চেয়ার জাঁ এম জার্মেন বলেন, আজকাল সব নামী হাসপাতালের টিমেই একজন মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট থাকেন। রেডিয়েশন চিকিৎসাপদ্ধতি আর ইমেজিং পদ্ধতির কোয়ালিটি নির্ধারণে তাঁদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ল্যাবরেটরিতে পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষুরধার প্রযুক্তি আবিষ্কার করছেন পদার্থবিদরা আর ক্লিনিকে সেইসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সঠিক রোগনির্ণয় ও পরবর্তী চিকিৎসায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে সুস্থ করে তুলছেন চিকিৎসকরা।

মেডিক্যাল ফিজিক্স-এর যেসব অবদান চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, (১) পার্টিকল অ্যাক্সেলারেটর ব্যবহার করে ক্যান্সার চিকিৎসায় অগ্রগতি, (২) ব্রেস্ট ক্যান্সার চিহ্নিতকরণ, (৩) ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটারের সংঘর্ষের ইমেজিং, (৪) সিটি স্ক্যান করানোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।

সামগ্রিকভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে, এমনকি মানবসভ্যতার ইতিহাসে পদার্থবিজ্ঞানের অবদান-সূচক কিছু স্মরণীয় মুহূর্তকে কালানুক্রমিকভাবে একবার ফিরে দেখলে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং-এর গুরুত্ব সম্পর্কে হয়তো একটা ধারণা পাওয়া যাবে।

১) এক্স রে (X rays) - ১৮৯৫ সালে উইলহেম কনরাড রন্টজেনের এক্স রে আবিষ্কার চিকিৎসা পদ্ধতির ইতিহাসে এমনই যুগান্তকারী যে ১৯০১ এ প্রথম নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সূচনাতেই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনি।

২) নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স (Nuclear magnetic resonance, NMR) - ১৯৫২ সালে নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স আবিষ্কার করে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন ফেলিক্স ব্লখ এবং এডোয়ার্ড এম. পার্সেল।

৩) রেডিয়োইমিউনোঅ্যাসে (Radioimmunoassays) - ১৯৭৭ সালে রেডিয়োঅ্যাকটিভিটি ব্যবহার করে রেডিয়োইমিউনোঅ্যাসে নামক অত্যন্ত সেন্সিটিভ একটি ডায়াগনসটিক পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞান অথবা শারীরতত্ত্বে নোবেল পেলেন রোজালিন ইয়ালো।

৪) কম্প্যুটার-অ্যাসিস্টেড টোমোগ্রাফি (Computer-assisted tomography) - ১৯৭৯ সালে অ্যালান এম কর্ম্যাক এবং গডফ্রে নিউবোল্ড হাউন্সফিল্ডকে চিকিৎসাবিজ্ঞান অথবা শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল কম্প্যুটার-অ্যাসিস্টেড টোমোগ্রাফি আবিষ্কারের স্বীকৃতিতে। সিটি (CT) পদ্ধতিতে তৈরি ইমেজের স্পষ্টতা এতোটাই বেশি যে সামগ্রিকভাবে ইমেজিং পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল এর মাধ্যমে।

২০০৩-র চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরতত্ত্বের নোবেল:
পল সি. লটারবার ও স্যর পিটার ম্যানসফিল্ড

৫) ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (Magnetic Resonance imaging) - ১৯৫২ সালে ব্লখ এবং পার্সেলের আবিষ্কৃত নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স পদ্ধতি ব্যবহার করে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (Magnetic Resonance imaging, MRI) আবিষ্কারে লেগে গেল আরো কয়েক দশক, মানবশরীরে রোগনির্ণয়ের জন্য আজ যা অত্যন্ত জরুরি পদ্ধতি। ২০০৩ সালে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং আবিষ্কারের স্বীকৃতিতে চিকিৎসাবিজ্ঞান অথবা শারীরতত্ত্বে নোবেল পেলেন পল সি. লটারবার ও স্যর পিটার ম্যানসফিল্ড।

৬) পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি (Positron emission tomography, PET) - আরেকটি জনপ্রিয় ইমেজিং প্রযুক্তি, যা সব বয়সের রোগীদের রোগনির্ধারণেই খুব জনপ্রিয় এখন, তা হল- পজিট্রন ইমিশন টোমোগ্রাফি বা পেট। সাইক্লোট্রনে তৈরি মেটাবলিক্যালি অ্যাকটিভ তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক বা রেডিয়োনিউক্লিয়াইড ব্যবহার হয় এই প্রযুক্তিতে। গ্লুকোজ, টেস্টোস্টেরন, আর অ্যামিনো অ্যাসিড-এর মতো শারীরবৃত্তীয় যৌগ উপাদানগুলোর সঙ্গে নিউক্লিয়াইডগুলো যুক্ত থাকে লেবেল হিসেবে। রক্তের মধ্যে এই রেডিয়োনিউক্লিয়াইড বা রাসায়নিক ইনজেকশন করে প্রবেশ করানো হয় এবং তারপর সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে যন্ত্রের সাহায্যে ইমেজিং করা হয় রেডিয়োনিউক্লিয়াইড-এর উপস্থিতি। হঠাৎ হৃদরোগের আক্রমণ, করোনারি হার্ট-সংক্রান্ত সমস্যা, ইস্কিমিয়া, ক্যান্সার ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তরেই রোগনির্ণয় করে ফেলতে পারে পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞানের এইসব অসামান্য পদ্ধতির মধ্যে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (Magnetic Resonance imaging)-এর ভূমিকা আজ অবিস্মরণীয়। রোগনির্ণয়ে আজকাল PET/ CT আর PET/ MRI এর প্রয়োগ ও ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক কীভাবে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং আজকের চিকিৎসা বিজ্ঞানে এতো জরুরি হয়ে উঠল, তা জানার আগে একবার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এমআরআই-এর মূল কথাগুলো সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।

ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এমআরআই কীঃ

শরীরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অংশের সুস্পষ্ট আর নিঁখুত ছবি তোলা, টিউমার, ক্ষত, ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু, ভাঙা হাড় ইত্যাদিকে সনাক্ত করার একটি অসাধারণ ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি হল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং। এমআরআই একটি নন ইনভেসিভ পদ্ধতি। শরীরের ভেতরের অংশে না প্রবেশ করে বাইরে থেকে একেবারে যন্ত্রণাহীন পদ্ধতিতে ছবি তোলা হয় শুধু। ইমেজিং প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) আর ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এফএমআরআই)-ই সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়।

এফএমআরআই মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহের তারতম্য তুলনা করার মাধ্যমে ইমেজ করে দেখায় যে মস্তিষ্কে কোন অংশ বেশি সক্রিয় আর কোন অংশ কম সক্রিয়। কোনও কাজ করার সময় কোনো ব্যক্তির কোন অংশ সক্রিয় থাকে বা মস্তিষ্কের কোন অংশ কী কাজ করে তা এফএমআরআই প্রযুক্তির সাহায্যে জানা সম্ভব। তাছাড়া মস্তিষ্কের জেনেটিক ও নিউর‌্যাল বিন্যাস উন্মোচনেও এ প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। তাই আইনস্টাইনের সচল মস্তিষ্ক থেকে অনেক তথ্যই হয়তো আহরণ করতে পারত এফএমআরআই প্রযুক্তি।

ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং-এর কার্যপদ্ধতিঃ

আমাদের শরীরের শতকরা সত্তরভাগই জল আর ফ্যাট। তার মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন পরমাণু। এই পরমাণুগুলো সাধারণত তাদের নিজস্ব ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা চৌম্বকক্ষেত্রে ইতস্ততভাবে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়ায়।

যদি আমরা একটা শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রে থাকি, তাহলে এই হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো জোড়ায় জোড়ায় এমনভাবে সজ্জিত হয় যে মোটামুটি প্রায় অর্ধেক সংখ্যক পরমাণু চৌম্বকক্ষেত্রের উত্তর মেরুর দিকে এবং বাকি প্রায় অর্ধেক সংখ্যক চৌম্বকক্ষেত্রের দক্ষিণ মেরুর দিকে সজ্জিত হয়ে যায়। কিন্তু তার পরেও কিছু হাইড্রোজেন পরমাণু বিজোড় অবস্থায় থেকে যায়।

ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিংঃ চৌম্বক-ক্ষেত্রের প্রভাবে হাইড্রোজেন পরমাণুর প্রতিক্রিয়ায় তৈরি ইমেজ

ওপরের ছবিতে সবুজ পরমাণুগুলো জোড় গঠন করতে পারেনি। এই অবস্থায় যদি রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি ওয়েভ বা পালস্‌ (বেতার কম্পাঙ্কের তরঙ্গ) পাঠানো হয়, তাহলে এই বি-জোড় পরমাণুগুলো শক্তি গ্রহণ করে বর্তমান অবস্থান পরিবর্তন করে আর উলটোদিকে ঘুরে যায়। এরপর যদি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি পালস্‌ বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন এই পরমাণুগুলো আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে এবং এনার্জি বা শক্তি নিঃসরণ করে। সেই এনার্জি তখন সংকেত পাঠায় কম্প্যুটারে এবং কম্প্যুটারে গাণিতিক সূত্র ও অ্যালগরিদমের সাহায্যে তা দিয়ে ইমেজ তৈরি করে।

এমআরআই মেশিনে যে রেডিয়ো পালস্‌ পাঠানো হয় তার কম্পাঙ্ক সাধারণত হাইড্রোজেনের নিজস্ব কম্পাঙ্কের সমান। তার ফলে হাইড্রোজেন পরমাণুতে অনুরণন (Resonance) সৃষ্টি হয়। এই কারণেই এই ইমেজিং পদ্ধতিকে ‘রেজোনেন্স ইমেজিং’ বলা হয়। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের মান মাত্র ০.৫ গস (Gauss) কিন্তু চৌম্বকক্ষেত্র তৈরির জন্য এমআরআই মেশিনে যে চুম্বক ব্যবহার করা হয়, তার শক্তি সাধারণত ৫০০০ থেকে ২০০০০ গস (Gauss) পর্যন্ত হয়ে থাকে। হাইড্রোজেন পরমাণুর ম্যাগনেটিক মোমেন্ট তথা চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রতি সংবেদনশীলতা বেশি (কারণ এতে অযুগ্ম বা বিজোড় ইলেক্ট্রন থাকে) এবং মানবদেহে এদের সংখ্যা অগুন্তি। তাই হাইড্রোজেনকেই বেছে নেয়া হয়েছে।

রোগনির্ণয় ও ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিংঃ

শরীরের যে অংশের ছবি তোলা হবে, নানা দিক থেকে, নানা অ্যাঙ্গেলে তার অসংখ্য ক্রস-সেকশন্যাল ভিউর ছবি তোলা হয় এমআরআই-তে। রেডিয়েশন নয়, খুব শক্তিশালী চুম্বক ব্যবহার করা হয় এই পদ্ধতিতে। অন্য পরীক্ষায় ধরা পড়বে না, শরীরের এমন সফট টিস্যুর সুস্পষ্ট ছবি তুলতে সক্ষম এমআরআই। এ পরীক্ষা করাতে আলাদা কোনও প্রস্তুতির দরকার হয় না, শুধু শরীরে কোনও ধাতব বস্তু থাকা চলবে না।

টিউমার ও ক্যান্সার- উন্নততর ডায়াগনোসিস: বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার নির্ধারণে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং আজ অপরিহার্য। শুধু রোগনির্ণয়ই নয়, চিকিৎসা ও নিয়মিত ফলো-আপের ক্ষেত্রেও এমআরআই অত্যন্ত জরুরি। কনট্রাস্ট ডাই বা রঞ্জক ব্যবহার করে এমআরআই পদ্ধতিতে ব্রেন আর স্পাইনাল কর্ডের টিউমার চিহ্নিত করা যায়। কোনও টিউমার ক্যান্সারাস কিনা, তাও জানা যায়। চিকিৎসার পরবর্তী ধাপ হিসেবে সার্জারি অথবা কেমোথেরাপি কোনটা গ্রহণযোগ্য- সেই সিদ্ধান্ত নিতেও সাহায্য করে এমআরআই।

ব্রেস্ট ক্যান্সার এর ক্ষেত্রে এমআরআই এর ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্রেস্ট ক্যান্সার সনাক্তকরণে প্রাথমিক পরীক্ষা ম্যামোগ্রাম। এটা আসলে ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং-এর জন্য ব্যবহৃত এক্স রে পরীক্ষা। এক্স রে-র মাধ্যমে তোলা ছবি দেখে কোনও অংশ অস্বাভাবিক মনে হলে চিকিৎসক আলট্রাসাউন্ড-এর মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। শব্দ-তরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সিস্ট ইত্যাদি অংশের ছবি তৈরি করে আলট্রাসাউন্ড। এর পরবর্তী পর্যায় হল বায়োপ্সি, যার মাধ্যমেই ব্রেস্ট থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কোষের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরে কোষগুলো পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয় ক্যান্সার। এই পরীক্ষাই জানিয়ে দেয়, ঠিক কী ধরণের কোষ ক্যান্সারের জন্য দায়ী, ক্যান্সারের স্টেজ বা গ্রেড কী, ক্যান্সারের কোষগুলো হরমোন সংবেদনশীল কী না- ইত্যাদি।

এমআরআই স্ক্যানার ও ম্যাগনেট

কিন্তু ক্যান্সার হয়েছে জানার পর, সেই ক্যান্সার শরীরের ঠিক কতখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, কোন কোন অঙ্গে মেটাস্ট্যাসিস হয়েছে, লিম্ফ নোডগুলিও আক্রান্ত কিনা - সেসব জানতে গেলে এমআরআই অপরিহার্য। ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং-এ এমআরআই মেশিনের মাধ্যমে চুম্বক আর রেডিয়ো তরঙ্গ ব্যবহার করে বুকের অভ্যন্তরের কোষকলা বা টিস্যুর ছবি তোলা হয়। এক বিশেষ ধরনের এমআরআই ব্রেস্ট টিস্যুতে ক্যান্সার চিহ্নিত করতে খুব কার্যকরী।

কোলন ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও সফট টিস্যুর কতটা গভীরে ক্যান্সার ছড়িয়েছে জানিয়ে দেয় এমআরআই।

অটিজমঃ একটি শিশু অটিজমে আক্রান্ত কিনা, তা সাধারণত আগে থেকে জানা যায় না। তাই সঠিকভাবে চিকিৎসা শুরু করাও সম্ভব হয় না। সাধারণত দুই বা তিন বছর বয়সের পর শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানা যায়। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, মস্তিষ্কের এমআরআই পরীক্ষা করে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য আগেই জেনে নেওয়া সম্ভব। এই পদ্ধতিতে ৮০ শতাংশ নির্ভুলভাবে অটিজম আর এটি শিশুর এক বছর বয়সের মধ্যেই করা সম্ভব। এর ফলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও আগে শুরু করা সম্ভব।

অ্যালঝাইমারঃ মানুষকে সুস্থ, সুন্দর দীর্ঘ জীবন দিতে বিজ্ঞান গবেষণার অন্ত নেই৷ বয়স বাড়লেও মানুষ যাতে স্মৃতিবিভ্রম বা অ্যালঝাইমারের শিকার না হয়, সেজন্য এই রোগ ধরা পড়ার অন্তত ২০ বছর আগেই তা চিহ্নিত করার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। অ্যালঝাইমারের লক্ষণ দেখা দেবার কয়েক বছর আগে থেকেই মস্তিষ্ক কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে৷ সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রায় সব ধরণের অ্যালঝাইমার রোগের জন্য দায়ী মস্তিষ্কের বিশেষ দু'টি উপাদানের পরীক্ষা করেন৷ একটি হলো, স্পাইনাল ফ্লুয়িডের অ্যামাইলয়েড বেটা৪২-র ঘাটতি পরীক্ষা৷ কারণ স্পাইনাল রসে এর ঘাটতির অর্থই হচ্ছে মস্তিষ্কের অন্য কিছু অংশে এই একই উপাদানের ক্ষতিকর বৃদ্ধি, যা স্নায়ুকোষ ধ্বংস করে এবং পরিণামে স্মৃতিশক্তির মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ দ্বিতীয়টি হল, স্নায়ুতন্তুর জটে ‘টাও’ নামের একটি উপাদান বৃদ্ধি যা স্নায়ুকোষের মৃত্যুর জন্য দায়ী৷ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং এই গবেষণার প্রধান গবেষক ব়্যান্ড্যাল বেটম্যান বলেছেন, ‘‘বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার আগেই আমরা চিকিৎসা শুরুর মাধ্যমে এই রোগের সাথে সংশ্লিষ্ট মস্তিষ্কের কোষগুলোর ক্ষতি ঠেকাতে চাই৷”

এমআরআই/পেট পদ্ধতিতে স্বাভাবিক ও অ্যালঝাইমার রোগাক্রান্ত মস্তিষ্ক

এই গবেষণায় অ্যালঝাইমারের ঝুঁকি-সম্পন্ন থাকা ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের কোষের পরীক্ষা চালানো হয়েছে এমআরআই, এফএমআরআই, পেট পদ্ধতি ব্যবহার করে। ডমিন্যান্টলি ইনহেরিটেড অ্যালঝাইমার নেটওয়ার্ক-এর আওতায় এই গবেষণায় দেখা গেছে পিতা-মাতার ক্ষেত্রে ঠিক যে বয়সে অ্যালঝাইমারের লক্ষণ ধরা পড়েছিল, তার চেয়ে ১০ থেকে ২০ বছর আগেই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে সন্তানদের ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে৷ ফলে তাদের বিশেষ চিকিৎসার আওতায় এনে এর হাত থেকে বাঁচানোর আশা দেখছেন বিজ্ঞানীরা৷ অ্যালঝাইমার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান চিকিৎসা ও বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মকর্তা উইলিয়াম থিজ আশা প্রকাশ করেছেন যে, এই পরীক্ষার ফল থেকে অ্যালঝাইমারের রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সম্ভব।

গর্ভস্থ সন্তানের পর্যবেক্ষণঃ মা-বাবা যদি এখন তাঁদের অনাগত সন্তানের বেড়ে ওঠা ও তার হৃৎস্পন্দন দেখতে-শুনতে চান, এখন তাও সম্ভব। আলট্রাসাউন্ডে ভ্রূণ দেখা গেলেও খুব একটা উন্নত ছবি পাওয়া যায় না। কিন্তু ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং-এ সাধারণত উচ্চ রেজোল্যুশনে ভ্রূণ ও প্ল্যাসেন্টার ছবি দেখানো সম্ভব। গবেষকেরা এমআরআই ও আলট্রাসাউন্ড-এর তথ্য ব্যবহার করে শিশুর (ফিটাস) বেড়ে ওঠা সব মা-বাবার সামনে তুলে ধরার টেকনোলজি আবিষ্কার করেছেন। কম্পিউটারনিয়ন্ত্রিত থ্রিডি ভার্চ্যুয়াল রিয়্যালিটি যন্ত্রের মাধ্যমে সন্তানের বেড়ে ওঠা দেখতে পারেন মা-বাবা।

শরীরে বিভিন্ন যন্ত্রণার কারণ নির্ধারণঃ জয়েন্ট-এ অপটিক যন্ত্র বসিয়ে যে ডায়াগনস্টিক আর্থ্রোস্কোপি করা হত, হাঁটুর কার্টিলেজ বা লিগামেন্টের যন্ত্রণার ক্ষেত্রে, সেসব পরীক্ষাকে সহজ করে দিয়েছে এমআরআই। এন্ডোস্কোপির মতো ইনভেসিভ পরীক্ষার বদলে এমআরআই এসে রোগীর যন্ত্রণা কমিয়েছে তো বটেই, ইনফেকশনের সম্ভাবনাও প্রায় নাকচ করে দিয়েছে।

ভবিষ্যতের দিশা

রোগনির্ণয়ে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং-এর অবদান যুগান্তকারী হিসেবে ইতোমধ্যেই চিহ্নিত। আরও কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে এমআরআই। সে প্রসঙ্গে, শুরুর কথাতেই ফিরে আসা যাক একবার। পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু সম্ভবত মানুষের মস্তিষ্ক। সেই রহস্য উন্মোচনের নেশা বিজ্ঞানীদের চিরকালীন। ভ্লাদিমির লেনিন, ওয়াল্ট উইটম্যান, কার্ল ফ্রিডরিখ গাউসের মস্তিষ্কও সংরক্ষণ করা হয়েছিল। আইনস্টাইনের কথা আগেই বলেছি। কিন্তু উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবে অসাধারণ এবং সর্বজনগ্রাহ্য কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি মস্তিষ্কের অ্যানাটমির পর্যালোচনায়।

পদার্থবিজ্ঞানের খুব উন্নত কিছু প্রযুক্তি এখন আমাদের আয়ত্তে। আমরা এও জানি নিশ্চিতভাবে, আমাদের মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কর্টেক্স-এর ফ্রন্টাল লোব, অক্সিপিটাল লোব, টেম্পোর‌্যাল লোব ও প্যারেইটাল লোব কী কী কাজ করে। মনোযোগ প্রক্রিয়াকে ধারণ করাই প্যারেইটাল লোব-এর কাজ। আমরা যখন কোনো বিষয়ে মনোযোগী হয়ে পড়ি, তখন আমাদের মস্তিষ্কে প্যারেইটাল লোবের স্নায়ুগুলো একটি সুনির্দিষ্ট বিন্যাসে গতিশীল হয়। অর্থাৎ মনোযোগ প্রক্রিয়াকে উপস্থাপনের জন্য প্যারেইটাল কর্টেক্সে একটি স্নায়বিক ব্যবস্থা আছে, যা আসলে ছোট ছোট স্নায়বিক সার্কিটের সমন্বয়ে তৈরি একটি বৃহৎ স্নায়বিক সার্কিট। মস্তিষ্কের যে কোনো কার্যক্রম ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সেই কাজের জন্য নির্দিষ্ট স্নায়বিক সার্কিট আবিষ্কার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মনোযোগের স্নায়বিক সার্কিটের সঙ্গে জড়িত প্রায় ১৮৫টি জিন আবিষ্কারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন মাইকেল পসনার। সেই আবিষ্কারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং প্রযুক্তির। ভবিষ্যতে ‘হিউম্যান কগনোম প্রোজেক্ট’-এও এমআরআই-এর অপরিসীম গুরুত্ব।

আইনস্টাইনের মতো অসামান্য মেধাসম্পন্ন মানুষের সময়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনও সুযোগ ছিল না। কিন্তু আজকের উজ্জ্বল প্রতিভাবান পদার্থবিদ আর গণিতজ্ঞদের সচল মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ আছে ফাংশন্যাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং আর পজিট্রন এমিশন টোপোগ্রাফির মাধ্যমে। মস্তিষ্কের গঠনের পাশাপাশি মস্তিষ্কের কার্যপদ্ধতি পর্যালোচনা করারও সুযোগ আছে। ভবিষ্যতে সে ধরনের গবেষণা, আজকের এইসব উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারকে শুধু রোগনির্ণয় বা চিকিৎসাপদ্ধতি নিরূপণের সীমাটুকুতে আটকে না রেখে মেধার বিশ্লেষণেও উল্লেখনীয় করে তুলবে।

-----------------------------------------------------------------------


লেখক পরিচিতি - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এখন আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা। আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। মনের আনাচ-কানাচ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া খেয়ালখুশির রঙচঙে টুকরো কাচের বর্ণময়তাকে অক্ষরে অক্ষরে ধরে রেখেছেন প্রথম বই ‘ঠিক যেন ক্যালেইডোস্কোপ’-এর পাতায়।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.