প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা

বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা - পনেরোই এপ্রিল ২০১৭

 

বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণঃ পথের গোলাপ এবং কাঁটাগুলো

মানস প্রতিম দাস



বিজ্ঞানকে কি জনপ্রিয় করা উচিত? সহজ করে বিজ্ঞান বলার আমন্ত্রণ জানিয়ে এমন প্রশ্ন যদি কেউ করে বসে সভার মধ্যে তবে কেমন হয়? এমন পরিস্থিতিতেই পড়েছিলাম বছর দশেক আগে কলকাতা শহরের এক কলেজে। প্রশ্নটা যিনি করেছিলেন তিনি নিজেও কিছু বিজ্ঞানের লেখালেখি করতেন বহুল প্রচারিত এক বাংলা সংবাদপত্রে। পেশায় তিনি ওই কলেজেরই প্রাণীবিজ্ঞানের শিক্ষক। সভাকে জমজমাট করা বা নেহাৎ অন্তরের সংশয় প্রকাশ করতে এমন প্রশ্ন করতেই পারেন কেউ। একবার উচ্চারিত হয়ে গেলে সে প্রশ্নকে চট করে এড়িয়ে যাওয়াও চলে না। ভদ্রলোক নিজের বক্তৃতায় জনপ্রিয় বিজ্ঞানকে ভুল বিজ্ঞান আখ্যা দিলেন। স্ববিরোধ অবশ্যই তবে একটা যেন ইঙ্গিত ছিল যে বিজ্ঞানীদের হাতে যদি জনপ্রিয়করণ হয় তবে ভুল হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। বলা বাহুল্য, এটা একমাত্র ওই শিক্ষকের মত নয়। বিজ্ঞানের লেখালেখিতে যুক্ত অনেকেই এই ধারণা পোষণ করেন। মোট কথা, বিজ্ঞানী যদি সহজ করে বিজ্ঞান লেখেন বা বলেন তবে সেটাকে গ্রহণ করতে কোনো অসুবিধে নেই। বিশ্বসুদ্ধ সব মানুষ কি এতে একমত? তা বোধহয় না।

বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের অপরাধ

বিজ্ঞানের নিগড় সম্পর্কে আমরা কমবেশি অবহিত। এই নিগড়, এই শৃঙ্খলাই তার পরিচয়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশের মনে জনপ্রিয়তা সম্পর্কে যে অনুদারতা রয়েছে তার সঙ্গে আমাদের সবার পরিচয় বোধহয় নেই। এ কি ওই নিগড়েরই অঙ্গ? বিজ্ঞান নামে প্রতিষ্ঠানের কাছে জনপ্রিয়করণ এক অপরাধ। আধুনিক সময়ে ভারত থেকে শুরু করে ব্রিটেন বা অন্যান্য আরও অনেক রাষ্ট্রে জাতীয় বিজ্ঞান নীতিতে জনপ্রিয়করণের স্থান স্বীকৃত। কিন্তু তাতে কি এই মনোভাব পাল্টেছে? লেখাটা তাত্ত্বিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। উদাহরণে যাওয়া যাক।

হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতত্ত্ব এবং বিবর্তনবিদ্যার অধ্যাপক এডওয়ার্ড উইলসন ২০১২ সালে ভীষণ ক্ষেপে গেলেন তাঁর লেখা বইয়ের সমালোচনা প্রকাশ হওয়ার পরে। সমালোচকের নাম রিচার্ড ডকিন্স। দু’জনেই বয়সে প্রবীণ। উইলসন তখন ৮৩ আর ডকিন্স ৭১। ‘দ্য সোশ্যাল কনকোয়েস্ট অফ আর্থ’ বইতে বিবর্তনের ধারা নিয়ে যে সব কথা লেখেন উইলসন তার মূল অংশটাকে পুরোপুরি ভ্রান্ত বলে নাকচ করে দেন ডকিন্স। এতে এমনই ক্ষেপে যান উইলসন যে বিবিসি-র কাছে এক সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বলেন যে ডকিন্সের সঙ্গে তাঁর মতামত মেলা বা না-মেলার কোনো প্রশ্নই নেই। এর কারণ তিনি নিজে একজন বিজ্ঞানী আর ডকিন্স একজন সাংবাদিক যাঁর কাজ বিজ্ঞানীদের অবদান সম্পর্কে লেখা। নিজে কোনোদিন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখেন নি ডকিন্স আর তাই উইলসনের তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কের কোনো অধিকারই নেই তাঁর। এর উত্তর অবশ্য দিয়েছিলেন ডকিন্স। ট্যুইট করে বলেছিলেন, উইলসনকে তিনি সম্মান করেন গোষ্ঠীবদ্ধ পোকামাকড় যেমন পিঁপড়েদের সম্পর্কে দুর্দান্ত তত্ত্ব উপহার দেওয়ার জন্য। বিজ্ঞানের ইতিহাসে উইলসনের স্থান পাকা। কিন্তু বইতে তিনি যা লিখেছেন তা ভুল। আর নিজের কাজের সপক্ষে ডকিন্স বলেন যে অভিযোগকারীদের উচিত তাঁর লেখা বই ‘দ্য এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ’ পড়ে নেওয়া। তাহলেই তাঁরা বুঝে যাবেন যে রিচার্ড ডকিন্স বিবর্তনবাদের ক্ষেত্রে কী অবদান রেখেছেন।

ঘটনাটা জানানোর পর বোধহয় আর কিছু বলার থাকে না। ডকিন্স বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ। এর জন্য তিনি বই রচনা করেছেন, খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখেছেন, টিভি-রেডিওতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি বিবর্তনবাদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী উইলসন তাঁকে আক্রমণ করার জন্য বেছে নিলেন ডকিন্সের ‘সাংবাদিক’ পরিচয়টা (যা তিনি আদৌ নন)। বিজ্ঞানের বিতর্কে অপ্রস্তুত হয়ে তিনি যেমন একটা অনৈতিক কাজ করলেন তেমনি জনপ্রিয় বিজ্ঞানের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক ঘৃণাটা একেবারে প্রকাশ্যে এনে ফেললেন। বিজ্ঞানের প্রগাঢ় জ্ঞান সত্ত্বেও রেহাই পেলেন না ডকিন্স। এই যদি ডকিন্সের হাল হয় তবে তুলনায় সাধারণ বিজ্ঞান লেখকদের আসন কোথায় তা সহজেই অনুমেয়। তবে বিজ্ঞানী মাত্রই এমন মনোভাব পোষণ করেন এমন ভাবাটা ভুল হবে।

ডারউইনের মনোভাব

যে বিবর্তনবাদ নিয়ে এত টানাহ্যাঁচড়া তার জনক কি সমর্থন করতেন জনপ্রিয়করণকে? একটা সময় অবধি নিজের তত্ত্বকে জনপ্রিয় করে তোলার আগ্রহে মশগুল ছিলেন চার্লস ডারউইন। সে ব্যাপারটা অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ওরিজিন অফ স্পিসিস’। এই বইকে তিনি সবার বোঝার মত করে, আকর্ষণীয় ঢঙে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে তাঁকে এত টীকা-টিপ্পনী জুড়তে হল, প্রুফ সংশোধন করে এত নতুন পরিভাষা আর তথ্য ঢোকাতে হল যে তিনি নিজেই বিরক্ত হতে শুরু করলেন। বুঝে গেলেন যে বিজ্ঞানী মহলে প্রতিষ্ঠার জন্য তত্ত্ব যেভাবে লেখা হয় তা সাধারণ পাঠকের কাছে কখনই আকর্ষণীয় হবে না। নিজের অদক্ষতায় বিরক্ত হয়ে তিনি হাক্সলির দ্বারস্থ হলেন। সেই টমাস হেনরি হাক্সলি যিনি গোঁড়া বিশপের সঙ্গে লড়ে গিয়েছিলেন ডারউইনের পক্ষ নিয়ে। তিনিই আবার শ্রমজীবীদের বোঝার জন্য ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে রচনা করেছিলেন সিক্স লেকচারস টু ওয়ার্কিং মেন (১৮৬৩)। চতুর্থ এবং পঞ্চম লেকচারের প্রুফ পড়ে এত অভিভূত হন ডারউইন যে হাক্সলিকে আরও বড়সড় রচনায় হাত দিতে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন তিনি। ১৮৬৪ সাল নাগাদ ‘পপুলার ট্রিটাইজ অন জুলজি’ লেখার জন্য অনুরোধ করেন ডারউইন। তাঁর বক্তব্য ছিল যে এতে মানুষ খুব উৎসাহিত হবে। হাক্সলির লেখার যে প্রসাদগুণ আছে তাতে বিষয়গুলো খুব গ্রহণীয় হবে সবার কাছে। কিন্তু হাক্সলির হাতে তখন অত সময় নেই। তিনি জানিয়ে দিলেন যে গবেষণার কাজে এতটাই সময় লাগছে তাঁর যে এ ব্যাপারে তিনি কিছু করতে পারবেন না। হতাশ হলেন বন্ধু ডারউইন।

এদিকে তাঁর বিবর্তনবাদ নিয়ে ইউরোপে চলল এক অদ্ভূত জনপ্রিয়করণ যা আসলে তাঁর তত্ত্বের বিরোধী। এই ব্যাপারটার উল্লেখ না করলে সময়টাকে ঠিক বোঝা যাবে না। ডারউইনের তত্ত্বে কোথাও ঈশ্বর বা কোনো অলৌকিক শক্তির ভূমিকা ছিল না। বরং জীবজগতের বিবর্তনকে নিতান্তই বস্তুময় এবং ধারাবাহিক এক প্রক্রিয়া হিসাবে প্রমাণ করাতে ছিল তাঁর আগ্রহ। পাশাপাশি তিনি এও বোঝাতে চেয়েছিলেন যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে জটিল, উচ্চতর প্রাণী তৈরি হলেও বিবর্তনের কোনো নির্দিষ্ট অভিমুখ হয় না। অথচ তাঁর তত্ত্বকে সঙ্গে নিয়ে শেষমেষ ঈশ্বরের ভূমিকা প্রমাণে আগ্রহী হয়ে উঠলেন অনেকে। দেখাতে চাইলেন যে বিবর্তনের একটা অভিমুখ অবশ্যই আছে এবং সেটা ঈশ্বর নির্ধারিত। সেই অভিমুখের সীমানায় মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় মহান গুণ, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি। এমনই এক গ্রন্থ লিখলেন জন ফিস্‌কে, ১৮৮৪ সালে। নাম ‘ডেস্টিনি অফ ম্যান ভিউড ইন দ্য লাইট অফ হিজ ওরিজিন’। মূলতঃ হারবার্ট স্পেন্সারের ভক্ত এই লেখক বলতে চাইলেন যে ডারউইনের তত্ত্ব আসলে ক্রিয়েশন বা ঈশ্বরের হাতে সৃষ্টিকে সমর্থন করে! এই তত্ত্বে দেখানো হয়েছে যে প্রকৃতি মানুষকে আরও নিখুঁত করার লক্ষ্যে কাজ করে। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ফিস্‌কের বই। শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই প্রায় ছাব্বিশ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ডারউইনের শিবিরে থাকার পরে এক সময় মতিগতি বদলাতে শুরু করে এক জীববিজ্ঞানীর, নাম তাঁর আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস। ‘ডারউইনিজ্‌ম’ নামে যে বই তিনি লেখেন তাতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বকে সহজভাবে উপস্থাপনের একটা প্রয়াস ছিল। কিন্তু অচিরেই তিনি এনে ফেললেন ঈশ্বরকে। বললেন, অন্ততঃ তিনটে ক্ষেত্রে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ স্পষ্ট। কী সেগুলো? এক, যখন অজৈব থেকে জৈবে রূপান্তর ঘটল। দুই, যখন প্রথমবার জীবের মধ্যে চেতনার উন্মেষ ঘটল আর তৃতীয়, যখন মানুষের মধ্যে মহান গুণাবলীর বিকাশ ঘটল। নিজের তত্ত্বের এমন বিকৃত ব্যবহারে কতটা কষ্ট পেয়েছিলেন ডারউইন তা সহজেই অনুমান করা যায়।

স্থানভেদে চিত্র একই

আমাদের দেশে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের প্রতি অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মনোভাবটা খুব যে আলাদা তা নয়। সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর সময়ে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করে ও করিয়ে। মাতৃভাষা ছাড়াও ইংরেজি, জার্মান, ফরাসী ভাষায় পাণ্ডিত্য ছিল এই বিজ্ঞানীর। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন তার সমর্থনে পাশে পেয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা, নিখিলরঞ্জন সেন, দেবেন্দ্রমোহন বসু প্রমুখদের, যাঁদের কেউ তাঁর সহপাঠী, কেউ বা শিক্ষক। এর বাইরেও ছিলেন কিছু বিজ্ঞানী ও লেখক। কিন্তু সব মিলিয়ে গোষ্ঠীটা খুব ছোট। তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন যাঁরা তাঁদের সংখ্যাটা কিন্তু খুব কম নয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেটুকু উল্লেখ আছে তাতে বোঝা যায় যে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের অনেক অধ্যাপকই ভালোভাবে নেন নি তাঁর প্রচেষ্টাকে। বরং বিদ্রূপের সুযোগ ছেড়ে দিতেন না অনেকেই। ইংরেজের কাছ থেকে শেখা বিজ্ঞানের ভাষাও যে ইংরেজি হতে হবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না তাঁদের। এঁদের টিটকিরির যোগ্য জবাব দিতে সত্যেন্দ্রনাথ জীবনের শেষ দিকে ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা ছাপেন জার্নালের আকারে। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে বাংলা ভাষায় লিখে অনেক গবেষণাপত্র জমা দেন সহযোগী বিজ্ঞানীরা। একটা মাত্র সংখ্যায় সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয় নি।

আজও যে সত্যেন্দ্রনাথের প্রয়াস নিয়ে খুব একটা মাতামাতি আছে তা নয়। হিগ্‌স বোসন আবিষ্কারের কথা কাগজে বেরোলে, তার সঙ্গে বিজ্ঞানী বসুর নামের যোগটা কেউ ধরিয়ে দিলে গদগদ হয়ে ওঠেন যারা তাদের অনেকেরই সময় নেই বাংলা ভাষায় সত্যেন্দ্রনাথের বিজ্ঞানের লেখাগুলো পড়ার। অন্যদিকে এমন অনেক বিজ্ঞানী আছেন যারা তাঁর শুরু করা পত্রিকা ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’এ লিখলেও তাঁর আদর্শে একেবারেই বিশ্বাসী নন। কথা উঠলে পরিষ্কার বলেই দেন যে বাংলায় বিজ্ঞান লেখার কাজটা নেহাৎই পণ্ডশ্রম। বলতে তৃপ্তি অনুভব করেন যে বিজ্ঞানীরা এসব কাজ করে সময় নষ্ট করেন না। এই অসামান্য পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনকেও এই সুরে কথা বলতে শুনেছি নিজে। শুরুতেই যে কলেজ শিক্ষকের উল্লেখ করেছি তাঁর অন্তর্ভুক্তি এই দলেই। এঁদের অজ্ঞতা যে সীমাহীন তা আলাদা করে উল্লেখ না করলেও চলে। জনপ্রিয় বিজ্ঞান যে কত ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সুগভীর অনুসন্ধানের অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে তার ধারণাই নেই এঁদের। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় ঢঙে প্রচার না করলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষকরা যে বহু দুর্দান্ত ধারণার ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হবেন সেটা ঢোকে না এঁদের মাথায়। কারণটা খুব সহজ – দশকের পর দশক ধরে গবেষণার ফলে যে বিপুল জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছে বিভিন্ন শাখায় তা কোনো একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে মস্তিষ্কে ধারণ করা সম্ভব নয়।

কলকাতার এক সভায় এমন কিছু ‘বিজ্ঞানী’কে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন চন্দ্রভূষণ। বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক জনপ্রিয় পত্রিকা ‘ডাউন টু আর্থ’এর পরিচালক সংস্থার কর্তাব্যক্তি তিনি। সালটা সম্ভবতঃ ২০১৩। সভায় যখন অনেকে জনপ্রিয় বিজ্ঞান বা বিজ্ঞান সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারটাকে খাটো করে দেখাতে আগ্রহী তখন চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন তিনি। স্পষ্ট বলে দিলেন যে তাঁদের পরিবেশিত সংবাদ ভারতবর্ষ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনেক বিজ্ঞানীকে অনুপ্রাণিত করেছে নতুন গবেষণা প্রকল্প রচনা করতে। দু’ একটা উদাহরণও দেন তিনি। আসলে বাস্তব সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা যে নতুন তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে পালটায় এবং সেটাকে অবলম্বন করে বিজ্ঞানীকে নতুন অনুসন্ধানে মেতে উঠতে হয় তার উপলব্ধি নেই বিজ্ঞান নামক প্রতিষ্ঠানের সব সদস্যদের। বারেবারে প্রমাণিত হয় এটাই। এদেশের সব বিজ্ঞানী যে মৌলিক গবেষণা করছেন না তা জানতে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় না। ভারতের বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রের citation সূচক এবং plagiarism এর ব্যাপারে তাঁদের অবদান সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো পড়ে নিতে পারেন যে কেউ। সেগুলো যদি ভুল না হয় তবে বলতেই হবে যে এদেশে বিজ্ঞান গবেষণার স্বাস্থ্যটা খুব ভালো নয়। কিন্তু তাতে কী? প্রাতিষ্ঠানিক গুমর থেকে মুক্ত হতে পারেন না অধিকাংশ বিজ্ঞানী। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের প্রতি অবজ্ঞার দৃষ্টি দেওয়াকে একটা মহান কর্তব্য বলে মনে করেন তাঁরা। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে তবে সেটা সম্ভবতঃ নিয়মকেই প্রমাণ করে। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি এই সমস্যাটা অনুধাবন করেছে। লিখিত আকারে তা প্রকাশও করেছে। টমাস হাক্সলি, জন টিন্ড্যাল, জেমস জীন্‌স, আর্থার এডিংটন প্রমুখের উল্লেখ করে সোসাইটি জানিয়েছে যে এঁরা নেহাৎই ব্যতিক্রম। কেন? একটা লাইনে তার সারাৎসার ধরা আছে। উদ্ধৃত করতে চাইবঃ

Indeed, within the scientific community there is still often a stigma associated with being involved with the media. (The Public Understanding of Science, The Royal Society 1985)

এখানে মিডিয়া বলতে লেখা বা বলার সব উপস্থাপনকেই বোঝানো হয়েছে। তবে ওই স্টিগমা সব কথা নয়। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে যে যোগ্যতা লাগে তার অভাবেও বিজ্ঞানীকুল থেকে পপুলারাইজার তৈরি হয় না বড় সংখ্যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষার প্রয়োজন স্বীকৃত হয়েছে রয়্যাল সোসাইটির দলিলেঃ

The first requirement is to learn how to communicate science effectively to a lay public. Some aspects of this can and should be taught formally to all professional scientists.... ... . Fluent communication of science to the lay person, however, ultimately depends on experience. (Ibid.)

আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠান

দীর্ঘ আঠেরো বছর ধরে কলকাতার এফ এম চ্যানেলে বিজ্ঞানের লাইভ অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে গিয়েও ঔদাসীন্য আর অবজ্ঞার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে বারেবারে। একটা বড় অংশের বিজ্ঞানীর বক্তব্য, বিজ্ঞানের কথা যদি বলতেই হয় তবে সব সমীকরণ-সূত্র-প্রকল্প সহ উপস্থাপন করা উচিত। তা যদি না করা হয় তবে সেটা বিজ্ঞানই নয়। আর মিডিয়া কোনো অবস্থাতেই বিজ্ঞানের জন্য নিরাপদ স্থান নয়। বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানকে বোঝার যে স্বাভাবিক আগ্রহ আছে মানুষের মধ্যে তা সঙ্কোচে গুটিয়ে যায় এঁদের অনাবশ্যক হুঙ্কারে। বেতারে যে মানুষটি বিজ্ঞান শুনতে আসছেন তিনি একটা বৈজ্ঞানিক ঘটনার মূল কথাটা বুঝতে চান। চাকরিবাকরি ছেড়ে পরের দিনই ফের অনার্স কোর্সে ভর্তি হওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাঁর। তথাকথিত বিজ্ঞানীদের অজ্ঞানতা প্রসূত উচ্চারণে এনারা বিজ্ঞান ছেড়ে আবার গান বা নাটককেই আশ্রয় করেন। নিজেকে বলেন, বিজ্ঞান বোঝাটা সবার কাজ না। সেটা থেকে আনন্দ পাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই নেই। তাই মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে যে কুসংস্কারের কারিগররা যতটা না ক্ষতি করেন আমাদের মানসিকতার তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি হয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের কিছু আস্ফালনকারীদের কাজে।

আবারও বলতে হয়, অন্য ভাবনার বিজ্ঞানীরা আছেন বলেই আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাঝে মাঝে সফল হয়। সংখ্যাটা অবশ্য হাতে গোনা। ফলে যা হয় তা সহজেই অনুমেয়। বেতারে রেকর্ড করা কথিকায় কান পেতে আজও কিছু মানুষ বিজ্ঞান জানার চেষ্টা করেন। এঁদের অনেকেই জানতে চান আবহাওয়া এবং জলবায়ুর রহস্য সম্পর্কে। এদিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাষ সম্পর্কে সবাই পরিচিত হলেও সহজ কথায় আবহাওয়া বিজ্ঞান শোনার সুযোগ নেই কলকাতায়। অগ্রণী সংবাদপত্রের সাংবাদিক আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরে ফোন করে যা শোনেন কখনও হয়ত তার একটা সহজবোধ্য ব্যাখ্যা দেন কয়েক ছত্র লিখে। তাতে শীত কবে পড়বে বা বর্ষা কবে আসবে ইত্যাদি কৌতূহল মিটে যায়। কিন্তু আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে যে সব বিষয়, তাদের ওঠাপড়া এবং সে ব্যাপারে অনিশ্চয়তা – এগুলো বিজ্ঞানের তত্ত্ব এবং তথ্য সহ বুঝিয়ে বলার মানুষ কই? এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন অধ্যাপকের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল আমরা। প্রত্যেকবার তিনিই আমাদের বুঝিয়ে বলছেন কালবৈশাখীর সৃষ্টিকথা বা শীতের ধরা-নাহি-দিব অ্যাটিচুডের রহস্য। আবহাওয়া দপ্তরে চাকরি করা অনেককে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমরা হতাশই হয়েছি। তাঁদের মনের মধ্যে কাজ করে এক মারাত্মক চাপ, ইংরেজিতে যাকে বলে peer pressure. এই চাপে থাকা মানুষ কল্পনা করে নেন এক সমগোত্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে যিনি তত্ত্ব বা তথ্যের সামান্য এদিক-ওদিক হলেই ত্রুটি ধরবেন। সেই কল্পিত মানুষটিকে সন্তুষ্ট করার জন্য পরিভাষার পাহাড় আর পরিসংখ্যানের বিস্তৃতি রচনা করেন আমন্ত্রিত বিজ্ঞানী। পাশাপাশি ভাষার দখলটা না থাকায় কঠিন থেকে কঠিনতর শব্দের জটলায় আবেদন হারায় তাঁর উপস্থাপন।

জনপ্রিয় বিজ্ঞান সম্পর্কে একটা অদ্ভুত ধারণা হল, এটা ছোটদের জন্য। প্রবীণ মানুষদের অনেকেই এই উদ্ভট ধারণার চাপে পড়ে বিজ্ঞান সম্পর্কে নিজেদের স্বাভাবিক প্রশ্নগুলো উচ্চারণ করেন না। কিন্তু বিজ্ঞানের মূল কথা পৌঁছে দিতে হবে সবার কাছে। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। অতএব উৎসাহিত করা দরকার প্রবীণদের। ধর্মশাস্ত্রের অবৈজ্ঞানিক কথা শুনে বড় হয়ে উঠেছেন এই সব প্রবীণ মানুষদের অনেকে। তাঁদের মনে অনেক বিষয় নিয়েই ধোঁয়াশা রয়েছে। আঠেরো বছর ধরে চলা লাইভ অনুষ্ঠান ‘বিজ্ঞান রসিকের দরবারে’ এঁরা বিনা সঙ্কোচে এঁদের সহজ প্রশ্নগুলো করার সুযোগ পান। জানেন, এর জন্য কেউ বিদ্রূপ করবে না। বরং উপস্থাপকের পক্ষ থেকে সৎ চেষ্টা থাকবে একটা যুক্তিগ্রাহ্য উত্তরে পৌঁছনোর। তার জন্য বই, ইন্টারনেট, জার্নাল, বিজ্ঞানীদের পরামর্শ সবই নেওয়া হবে। উত্তর জানা না থাকলে পরবর্তী অনুষ্ঠান অবধি সময় চেয়ে নেওয়া হবে। বিতর্কের অবকাশ থাকলে তা এড়িয়ে যাওয়া হবে না কোনোভাবেই। কিন্তু সবথেকে বড় কথা যেটা তা হল উত্তর দেওয়া বা আলোচনার মধ্যে থাকবে একটা বৈঠকি ঢঙ। বাঙ্গালির কালচারে এই আড্ডা স্বাভাবিক, রবিঠাকুর থেকে শুরু করে মুজতবা আলি শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন এই মনোরম কথকতার কৌশল। শেখার চেষ্টা এবং মিডিয়ায় তার প্রয়োগে দোষ কোথায়?

জনপ্রিয়করণের অধিকার

জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে কোনোদিন জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনা করতে বারণ করেছিলেন কিনা জানা নেই। বিশ্বপরিচয় ছেড়ে দিলাম, তার ব্যাপ্তি আলাদা। কিন্তু ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বহু পত্রপত্রিকায় যে বিজ্ঞানের খবরাখবর দিতেন রবীন্দ্রনাথ তা কি জানতেন না জগদীশচন্দ্র? এ কাজ করতে বন্ধুকে বারণ কি করেছিলেন তিনি? কয়েকজনের ধারণা যদি মানতে হয় তবে তো বলতে হয় যে অ-বিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথকে অবশ্যই বারণ করা উচিত ছিল বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের! একইভাবে শান্তিনিকেতনে বসে জগদানন্দ রায় কেন লিখবেন বিজ্ঞান বা কল্পবিজ্ঞান? অক্ষয় দত্তের কী অধিকার আছে ভূগোল নিয়ে বই লেখার? ভূগোল বিষয়টা তো আর বিজ্ঞানের গণ্ডীর বাইরে নয়। এমন যুক্তিতে আজও বহু সুলেখকের বিজ্ঞান রচনার অধিকার কেড়ে নেওয়া যেতে পারে। তারপর যেটা পড়ে থাকবে সেটা অবশ্যই বিস্তীর্ণ মরুভূমি। পাবলিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং অফ সায়েন্স নিয়ে মাথাব্যথা যে যুগে সেখানে কি এই মরুভূমি কাম্য?

আজ যদি শুধু ভারতের দিকে তাকাই তবে দেখব যে প্রকৃতি ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের ধ্যানধারণায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। অবিজ্ঞান থেকে বিজ্ঞানে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকে। এর কৃতিত্ব সেই সব বিজ্ঞান প্রচারকের যাঁদের অনেকেই কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান গবেষণার চাকরি করেন না। পাশাপাশি, এ প্রশ্ন তোলাই যায় যে ‘বিজ্ঞানী’ হিসাবে পরিগণিত হতে পারেন কারা? শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ে কি কেউ বিজ্ঞানী হতে পারেন? গত দশ বছরে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের মূল্যায়ন করলে বিজ্ঞান চাকুরেদের সবাই কি নিজের ‘বিজ্ঞানী’ পরিচয় ধরে রাখতে পারবেন? সংশয় থেকেই যায়। কিন্তু এ সংশয়ে মেতে কোনো সদর্থক কাজ হয় না। বরং সব মানুষের সঙ্গে কত কার্যকরীভাবে বিজ্ঞানের জ্ঞান ভাগ করে নেওয়া যায় সেটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত। তার জন্য আজকের পরিভাষায় ‘সায়েন্স কমিউনিকেটর’ তৈরি করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এটা সম্ভব হলে সবথেকে ভালো হত। বিজ্ঞানের সেই সব ছাত্রছাত্রী যাঁরা বিজ্ঞানকে নিয়ে যেতে চান মানুষের কাছে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করাটা সবথেকে ভালো কাজ। সে কাজে শিক্ষক হয়ে আসবেন বিজ্ঞানী-ভাষাবিদ-সাহিত্যিক-সমাজতাত্ত্বিক। কিন্তু তা হচ্ছে কই? তাই কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান দপ্তরের অধীন বিজ্ঞান প্রসার বা এন-সি-এস-টি-সির মত স্বশাসিত সংগঠন চেষ্টা করছে ছোট ছোট কর্মশালার আয়োজন করে বিজ্ঞান লেখক তৈরি করার। নিজের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে যে এতদিন পরে যেন ধীরে ধীরে সিরিয়াস হচ্ছে প্রক্রিয়াটা। তবে প্রশিক্ষিত ফুটবলারের পাশাপাশি যেমন সহজাত দক্ষতার অধিকারী খেলোয়াড়ের আশায় তাকিয়ে থাকেন অভিজ্ঞ কোচ, তেমনটা এক্ষেত্রেও হওয়া প্রয়োজন। তাহলে নিশ্চিতভাবে একটা নতুন ভোরের আশায় থাকতে পারব আমরা।


লেখক পরিচিতি - পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা। আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠান প্রযোজক। পেশা ও নেশা কিছুটা মিলেছে কর্মস্থলে, যেখানে বিজ্ঞানের বহু জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেছেন তিনি। ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে এফ এম রেনবোতে পরিবেশন করছেন লাইভ অনুষ্ঠান 'বিজ্ঞান রসিকের দরবারে'। বাকি নেশার মধ্যে লেখালেখি ধারাবাহিকতা রাখতে পেরেছে। সময় পেলে কিঞ্চিৎ ফোটোগ্রাফি। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখ্যঃ সুস্থায়ী উন্নয়নের নীল নকশা, জলবায়ু বিতর্ক, অনুপ্রেরণার নাম কালাম, একবিংশ শতকের নোবেলজয়ী-চিকিৎসাবিজ্ঞান, রিমেম্বারিং রামানুজন।।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.