হেডি লামার – সুন্দরী, চিত্রতারকা, বৈজ্ঞানিক
শমীতা দাশ দাশগুপ্ত
চিত্র ১ - হেডি লামার |
১৯১৪ সালের ৯ই নভেম্বর, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ভিয়েনা শহরের এক সম্ভ্রান্ত ইহুদী পরিবারে জন্মাল একটি ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে। বাবা এমিল কিসলার আর মা গেরট্রুড কেসলার কন্যার নাম রাখলেন হেডউইগ এভা মারিয়া। এমিল কিসলার ছিলেন ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মচারী আর গেরট্রুড সঙ্গীতজ্ঞা – পিয়ানো বাদিকা। দুজনেই ভিয়েনার প্রাচীন ইহুদী সমাজের সম্মানিত সদস্য। সুন্দরী হেডউইগ ভিয়েনা শহরেই বড় হচ্ছিল, কিন্তু তার লেখাপড়ায় মনোযোগ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই তার আকর্ষণ অভিনয়ে। কন্যার ইচ্ছে মেনে নিলেন মা-বাবা। মাত্র সতেরো বছর বয়সে জার্মান চিত্র প্রযোজক ম্যাক্স রাইনহার্ড তাকে নিয়ে চলে গেলেন বার্লিন শহরে – অভিনয় শেখাতে। শিক্ষার শেষে হেডউইগ ফিরে এলো অস্ট্রিয়ায়, আঞ্চলিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে চিত্রনাট্য সহযোগী হিসেবে কাজ করতে। সেই প্রান্তিক পদ থেকে নায়িকার ভূমিকায় উঠতে তার সময় লেগেছিল মাত্র এক বছর। এই মেয়েটিই পরে হলিউডের নায়িকা ‘হেডি লামার’ নামে খ্যাতি পেয়েছিল।
অবসরের এই বিশেষ সংখ্যাটি বিজ্ঞান বিষয়ক। সেখানে হলিউডের স্বর্ণযুগের এক চটকদার চিত্রতারকাকে নিয়ে লিখতে বসলাম কেন? এর একটা কারণ অবশ্যই বিজ্ঞান সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা। আমি সমাজবিদ – অঙ্ক, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, প্রযুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কে আমার বিদ্যে দিয়ে প্রবন্ধের দু’পাতাও ভরবে না। তবে হলিউডের নায়ক-নায়িকা সম্পর্কে অন্যান্য অনেকের মত আমারও যথেষ্ট উৎসাহ রয়েছে, বিশেষত তাদের মধ্যে যদি কিছু বিশেষত্ব দেখি। আমি জানি মার্ল ওবেরন শুধু ভারতবর্ষে জন্মাননি, তাঁর মা ছিলেন শ্রীলঙ্কার অধিবাসী। এছাড়া গায়ক এঙ্গেলবার্ট হাম্পারডিঙ্ক, অভিনেত্রী জুলি ক্রিস্টি, ভিভিয়ান লে’র জন্মও ভারতে। অর্থাৎ এঁদের জীবনে একটা কিছু স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। তাই যখন শুনলাম হেডি লামার শুধু সুন্দরী অভিনেত্রী নন, তাঁর আবিষ্কারের জোরে আধুনিক মোবাইল ফোন তৈরি সম্ভব হয়েছে, তাঁর সম্পর্কে জানতে উৎসুক হলাম।
নায়িকা হিসেবে হেডউইগের প্রথম ছবি বের হয় চেকোস্লোভাকিয়া থেকে, ১৯৩২ সালে। ঐ সময়ে জার্মানিতে হিটলার নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে আরম্ভ করেছে। আর কয়েক বছরের মধ্যে এই ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা তুঙ্গে উঠে পৃথিবীর পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়াবে। সেই সময়েই হিটলারের আগ্রাসে আতঙ্কিত হয়ে ইউরোপের ইহুদী সমাজ নিরাপত্তার খোঁজে নিজেদের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। বাঁচার তাগিদে হেডউইগের মা, গেরট্রুড, ধর্মান্তরিত হয়ে ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করলেন আর কন্যাকেও ইহুদী ধর্ম পরিত্যাগ করতে উৎসাহ দিলেন। এর কয়েক বছরের মধ্যে হেডউইগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাস গ্রহণ করে ‘হেডি লামার’ হয়ে হলিউডে অভিনয় করতে আরম্ভ করলেন। সেখান থেকে তাঁর প্রথম ছবি প্রকাশ পায় ১৯৩৮ সালে। ধর্ম যাই হোক না, হেডি সারা জীবনে নিজেকে ‘হিব্রু’ বলেই পরিচয় দিয়েছেন।
চিত্র ২ - ফ্রিকোয়েন্সি হপিং রেডিওযুক্ত টর্পেডো |
আমেরিকায় এসে ব্যক্তিগত ভাবে হেডি নিরাপদ হলেন ঠিকই, কিন্তু ইউরোপে তখন ইহুদী-মেধ যজ্ঞ চলছে। অভিনয় করার পাশাপাশি তিনি ঠিক করলেন এই যুদ্ধে আমেরিকার সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করা তাঁর কর্তব্য। জার্মানির আর এক অভিবাসী, পড়শি সঙ্গীতজ্ঞ জর্জ অ্যান্থিয়েলের সঙ্গে গল্পের ছলে হেডি আলোচনা করলেন নৌ-যুদ্ধে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সির সংকেত প্রচার করে শত্রুপক্ষের রেডিওযুক্ত টর্পেডো বিভ্রান্ত করার সম্ভাবনা। সেই সঙ্গে একই ভাবে নিজেদের টর্পেডোও সুরক্ষিত রাখা যাবে। এই আলোচনা থেকেই অ্যান্থিয়েলের সঙ্গে হেডি গড়ে তুললেন নাৎসি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে “Secret Communication System।” প্রচার ও গ্রহণের সময়ে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বিভিন্ন এবং নিয়মবহির্ভূত ভাবে পালটিয়ে তাঁরা প্রায় অলঙ্ঘনীয় এক সংকেত-সারি সৃষ্টি করলেন। প্রথম স্বামী ম্যান্ডেলের ব্যবসা থেকে শেখা টর্পেডো সম্পর্কে জ্ঞান আর অ্যান্থিয়েলের সঙ্গীত ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তিনি নিয়োগ করলেন এই সংকেত পদ্ধতি সৃষ্টি করতে। পিয়ানোর ৮৮টি চাবি সম্পূর্ণ অনিয়মিতভাবে ব্যবহার করে সঙ্গীতের ভিত্তিতে লামার ও অ্যান্থিয়েল আবিষ্কার করলেন “ফ্রিকোয়েন্সি হপিং,” যা পরে মোবাইল ফোনের মুখ্য বিল্ডিং ব্লক হয়ে দাঁড়াল।
চিত্র ৩ :নতুন বার্তা পদ্ধতির প্যাটেন্ট-এর পাতা |
১৯৪২ সালে লামার (তাঁর বিবাহিত পদবী ‘মার্কি’ নামে) এবং অ্যান্থিয়েল এই নতুন বার্তা পদ্ধতির জন্যে প্যাটেন্ট পেলেন: US 2292387 A। হেডির বয়স তখন আঠাশ। এই মৌলিক চিন্তার পূর্ণ কৃতিত্ব অ্যান্থিয়েল দিলেন হেডি লামারকে। কিন্তু মার্কিন নৌবাহিনী প্রযুক্তিটি ব্যবহার করতে রাজি হল না। হয়ত এক সুন্দরী চিত্রতারকা ও এক সঙ্গীতজ্ঞের তৈরি পদ্ধতিতে তাদের খুব একটা আস্থা হয় নি। ১৯৬২ সালে কিউবান মিসাইল সঙ্কটের সময় পদ্ধতিটি সাফল্যের সঙ্গে প্রথম ব্যবহার করা হল। ততদিনে প্যাটেন্টের সময়সীমা পার হয়ে গেছে। তবে নিজেদের অবদান নিয়ে হেডি এবং অ্যান্থিয়েল কখনই কোন স্বীকৃতি দাবী করেন নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মিত্রশক্তির যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য করতে হেডি ‘ন্যাশনাল ইনভেন্টার্স কাউন্সিল’-এ (এন.আই.সি.) যোগ দিতে চান। সংস্থার দামি সদস্যরা তাঁকে পরামর্শ দিলেন তিনি যদি নিজের ‘তারকাশক্তি’ খাটিয়ে যুদ্ধের জন্যে টাকা তুলতে ঘুরে ঘুরে ‘বন্ড’ বিক্রি করেন দেশ বেশি লাভবান হবে। একমাত্র জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে হেডি লামার তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্যে সম্মান পান। ১৯৯৭ সালে “ইলেক্ট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন” আধুনিক বার্তা আদানপ্রদান ব্যবস্থায় লামারের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘পাওনিয়ার’ ও ‘বাল্বি ন্যাস স্পিরিট অফ অ্যাচিভমেন্ট’ ব্রোঞ্জ পুরস্কার দেয়। ২০০০ সালে মৃত্যুর পরে তাঁকে ‘ন্যাশনাল ইনভেন্টার্স হল অফ ফেম’-এ সদস্যপদ দেওয়া হল। জুন ৩, ২০০৮ সালে বিজ্ঞানের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা, সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান, হেডি লামারের সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে: “Hedy Lamarr: Not Just a Pretty Face।” লেখাটি হেডি লামারের বৈজ্ঞানিক অবদানের ওপর ভিত্তি করে একটি ব্রডওয়ে নাটকের সারাংশ। পরে জানুয়ারি ৯, ২০১২ সালে একই পত্রিকায় তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী প্রকাশিত হয়: “Hop, Skip and a Jump: Remembering Hedy Lamar।”
চিত্র ৪ - ‘পৃথিবীর সেরা সুন্দরী' |
নায়িকা হেডি লামারকে এক সময় হলিউড ‘পৃথিবীর সেরা সুন্দরী” আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু তিনি ঠিক হলিউড নায়িকার ছকে বাঁধা ছিলেন না – মদ খেতেন না, পার্টিতে যেতেন না। শোনা যায় তাঁর ভাল লাগত বন্ধুদের সঙ্গে বাড়িতে বসে নানান নতুন উদ্ভাবনা সম্পর্কে আলোচনা করতে। বলা বাহুল্য, হলিউড সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা খুব ব্যাপক হয়নি। নতুন আবিষ্কারের খসড়া করার জন্যে নিজের বাড়িতে তিনি একটা বড় নকশা আঁকার টেবিল রেখেছিলেন। সেইখানেই হেডি রাস্তার যানবাহন নিয়ন্ত্রণের লালবাতির উন্নতির পরিকল্পনা করেছিলেন; কোকা কোলার মত পানীয় বাড়িতে তৈরি করার জন্যে বড়ি বানিয়েছিলেন। পরে অবশ্য এই সব উদ্ভাবন নিজের ‘ছেলেমানুষি’ বলে হেসে উড়িয়ে দেন। এখন বিজ্ঞানের জগতে হেডি লামারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে স্বীকৃত হয় ‘স্প্রেড স্পেকট্রাম রেডিও’ যা আজকের জি.পি.এস., ব্লু-টুথ, ওয়াই-ফাই, সিডিএমএ (কোড ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাকসেস) প্রযুক্তিকে সমৃদ্ধ করেছে।
হেডি লামার সম্পর্কে বহু বই এবং জীবনী লেখা হয়েছে, কিন্তু তাতে হেডির বৈজ্ঞানিক দিকটি এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই বেশি। একে তো মহিলা, তার ওপর চিত্রতারকা এবং সুন্দরী। সেই সঙ্গে তিনি যে বুদ্ধিমতী ও উদ্ভাবকও হতে পারেন তা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে হেডির বক্তব্য শুনলে বোঝা যায় জীবনের কোন অংশকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাঁর মতে, ‘সুন্দরী কুহকিনী হতে গেলে বিশেষ কিছু করার দরকার নেই; বোকা বোকা মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাই যথেষ্ট।’ হেডি লামার নিজেই এই ধারণা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। তিনি সুন্দরী, চিত্রতারকা, বুদ্ধিমতী, বৈজ্ঞানিক, এবং উদ্ভাবক।
লেখক পরিচিতি - লেখক একজন শিক্ষক, গবেষক ও সমাজকর্মী। তিন দশকের অধিককাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয় সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা ও তাঁদের ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টায় নিযুক্ত। উত্তর আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশিয় পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী সংস্থা মানবী-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অবসর-এর জন্মলগ্ন থেকে উপদেষ্টা মণ্ডলীতে যুক্ত।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.