প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা

বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা - পনেরোই এপ্রিল ২০১৭

 

বিজ্ঞানের নতুন প্রযুক্তি IoT এবং আমাদের প্রাত্যহিকতা

সোমেন দে



এর আগেও কয়েকবার আমাদের জীবনের ছন্দ পালটিয়ে দেবার কাজ করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। মনুষ্যসভ্যতা এবং সেই সঙ্গে বিজ্ঞান এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছে। তবে আমাদের জীবনে বদলগুলো ঠিক এক গতিতে আসছেনা। কখনো কখনো একএকটা বিজ্ঞানের আবিষ্কার এক লাফে আমাদের অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। অনেক কিছু সুবিধে এনে দিয়েছে আমাদের হাতের মুঠোয়। আবার কখনো বা তা এসেছে ধীরে সুস্থে।

বিজ্ঞানের অবিরাম অগ্রগতির সঙ্গে এ রকম নব নব প্রযুক্তি তো সব সময়েই আসছে এবং যতদিন যাচ্ছে বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্যে নতুন প্রযুক্তিগুলো আরো দ্রুত এসে পড়ছে আমাদের জীবনে। প্রযুক্তির এই বদলের গতির কথা কয়েকটি তথ্য দিলে বোঝা যাবে।

আজ থেকে প্রায় ২৫০০০ বছর আগে মানুষের কাছে এক প্রযুক্তি হাতে এসেছিল – তার নাম ছবি আঁকা। মানুষ পাহাড়ে গুহায় গাছের গায়ে , যা দেখত তা থেকে ছবি আঁকতে শিখেছিল। সেও এক আদি প্রযুক্তি। সেখান থেকে মানুষের চাষবাস শিখতে লেগে গেল ৫০,০০০ বছর। সেখান থেকে লিখতে শেখা এবং চাকা আবিষ্কার করতে লাগলো আরো ৫০০০ বছর। সেখান থেকে জমির মাপ করে তাকে সীমানা দিয়ে বেঁধে ফেলতে শিখল। দেশ শহর গ্রাম এই রকম অঞ্চলভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে গুছিয়ে নিতে লাগলো আরো ২৫০০ বছর। সেখান থেকে মানুষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পদ্ধতি আবিষ্কার করতে লাগলো ১৯০০ বছর। সেখান থেকে শিল্পায়ন শুরু করতে লাগলো ৩২৫ বছর। সেখান থেকে বিদ্যুৎ , টেলিফোন এবং রেডিও আবিষ্কার করতে লাগলো ৯৫ বছর , সেখান থেকে প্রথম ভ্যাকুম টিউব কমপিউটার আবিষ্কার করতে লাগলো ৬৫ বছর। আদি কমপিউটার থেকে আধুনিক পিসিতে আসতে লাগলো ২৫ বছর। এবং সেখান থেকে ইন্টারনেট আবিষ্কার করতে লাগলো ১৫ বছর , সেখান থেকে স্মার্টফোন , ক্লাউড প্রযুক্তি এবং মোবাইল কমপিউটিং-এ আসতে লাগলো ১২ বছর। দেখা যাচ্ছে এক প্রযুক্তি থেকে আর এক প্রযুক্তিতে পৌঁছানোর দৌড়ের গতি ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন – শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কি আছে শেষে পথের ? উত্তর পাওয়া যাবেনা।

এই কয়েক বছর আগে অবধি আমরা smart কথাটি মানুষের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করতাম। ছেলেটা বেশ smart বা মেয়েটি বেশ smart। এ রকমই বলে থাকতাম আমরা। আমরা কখনো বলতাম না যে আমার টুথব্রাশটি বা বা স্নান করার শাওয়ারটি বা রান্নার গ্যাস ওভেনটি বেশ স্মার্ট। যদিও smart কথাটার ঠিকঠাক মানে এক এক জনের কাছে এক এক রকম হত। চটপটে , ঝকঝকে , প্রত্যুৎপন্নমতিত্বসম্পন্ন , সুমেধাসম্পন্ন, সুদর্শন , সুবক্তা এই রকম নানা অর্থেই আমরা প্রয়োগ করতাম smart কথাটি। প্রযুত্তি যে শুধু আমাদের জীবনযাত্রাকেই বদলে দিচ্ছে এমনটা নয় , বদলে দিচ্ছে আমাদের পুরনো ধ্যান ধারণাও। এখন আর smart বিশেষণটি মনুষ্যজাতির জন্যে সংরক্ষিত নয়। এখন ফোন , ক্যামেরা , গাড়ি, পাড়া , অঞ্চল, শহর অবধি –সবাইকে smart করে দিতে উঠে পড়ে লেগে পড়েছে প্রযুক্তি।

এত সব smart জিনিসের মধ্যে বাস করে আমরাও মানুষ হিসেবে আরো আরো বেশি করে smart মানুষ হয়ে পড়ছি কিনা সে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা পরে হবে।

যদিও সবাই জানেন তবুও শুরু করার আগে আগে মোদ্দা কথায় বলে নিই IoT বস্তুটি কি। বলা বাহুল্য এটি একটি বড় নামের সংক্ষেপকরণ। পুরো নামটি হল Internet of Things। অনেকে বলেন Internet of Everything। ভারতবর্ষে এখনো শব্দটি অপরিচিত হলেও অনেক উন্নত দেশে ইতিমধ্যেই IoT এসে পড়েছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে আরো একটা নতুন প্রযুক্তি যখন আসছেই তখন তা নিয়ে আর আলাদা করে ভাবার কি আছে ? কারণটা এই যে এই প্রযুক্তি শুধু আসছেই না , আমাদের মত আমআদমিদের জীবনশৈলীকে বোধহয় অনেকটাই ওলোট পালোট করে দেবে। এবং সেই সঙ্গে আমাদের এখনকার ভাবনা চিন্তার রকমসকম গুলোও হয়ত অনেকটা পালটাতে হবে আমাদের।

একটু বুঝে নেওয়া যাক সেটা কি ভাবে হতে পারে। এই প্রযুক্তির একটি সংজ্ঞা বলছে - The internet of Things is a system of interrelated computing devices, mechanical and digital machines, objects, animals or people that are provided with unique identifiers and ability to transfer data over a network without requiring human-to-human or human-to-computer interaction.

সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ‘Anything that can be connected will be connected’।

অর্থাৎ কিনা এ সংসারে যা কিছু বস্তু , অবস্তু ,প্রাণী , অপ্রাণী, সব কিছুকেই এই প্রযুক্তি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করবে , তাদের মধ্যে তথ্য বিনিময় করবে , নির্দেশ পাঠাবে , নির্দেশ পালন করবে এবং তা করবে কোনো মানুষে-মানুষে অথবা মানুষে-কম্পিউটারে যোগাযোগ ছাড়াই।

আমরা দৈনন্দিন জীবনে যা যা ব্যবহার করি যেমন টোস্টার , কফি মেশিন , ওয়াশিং মেশিন , এসি মেশিন , মোটোর গাড়ি এসব কিছুই যুক্ত হয়ে যাবে IoT দ্বারা। তাতে কি লাভ হবে ?

ধরা যাক একটা ঘড়ি এলার্ম দিয়ে আপনার ঘুম ভাঙ্গালো। তারপর আপনি যতক্ষণে আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে উঠছেন ততক্ষণে আপনার কফি মেশিন অন হয়ে এক কাপ কফি আপনার জন্যে তৈরি করে দেবে। কফি খেয়ে নিম্নচাপ অনুভব করে আপনি যখন বাথরুমে যাবেন বাথরুমের গিজার আপনার চান করার জন্যে জল গরম করে দেবে। আপনার দাড়ি কামানোর যন্ত্রটি আপনাকে মনে করিয়ে দেবে আপনার আজকে যে ক্লায়েন্ট মিটিং আছে সেখানে কি ধরনের পোষাক পরে যাওয়া ঠিক হবে। আপনার স্নান হয়ে আপনি বাথরুম থেকে বেরোলেই টোস্টার আপনার জন্যে গরম গরম টোস্ট বানিয়ে দেবে। তার পর জুসার ফ্রূট জুস বানিয়ে দেবে। আপনার ফ্রিজ আপনাকে মনে করিয়ে দেবে কি কি জিনিষের expiry date এগিয়ে আসছে। আপনার ওয়ার্ড্রোব আপনাকে পোশাক বেছে নিতে সাহায্য করবে। আপনার ড্রেসিং টেবিলের আয়না আপনাকে জানিয়ে দেবে আজ কোন কোন বন্ধুকে বার্থডে উইশ করতে হবে। অফিসে বেরোবার আপনার ফ্রিজ মনে করিয়ে দেবে আপনার দুধ মাখন মাছ মাংসর স্টক কতটা। অফিস থেকে ফেরার পথে কি কি জিনিষ নিয়ে আসতে হবে। কিম্বা আর একটু এগিয়ে সেই দোকানে নির্দেশ দিয়ে দেবে বাড়িতে এ সব জিনিশ পৌঁছে দেবার জন্যে।

আপনি যেই অফিস যাবেন বলে গাড়িতে উঠলেন গাড়ি আপনাকে বলে দিল কোন রাস্তায় গেলে আপনি সব চেয়ে কম সময়ে অফিস পৌঁছাতে পারবেন। কোথায় কোথায় জ্যাম আছে , কোথায় জল জমেছে , কোন রাস্তায় মিছিল বেরিয়েছে। আপনি অফিস পৌঁছালে আপনার স্ত্রীকে জানিয়ে দিল আপনি অফিসে পৌঁছে গেছেন। আর যদি আপনি ট্রেন ,মেট্রো , বাস বা যে কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এ যাতায়াত করেন , তাহলেও আপনি এই সব খবরই পেয়ে যাবেন।

শুধু তাই নয় IoT আমাদের স্বাস্থ্যেরও খেয়াল রাখবে নিবিড় ভাবে। বাজারে এই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে যে সব যন্ত্র আসতে চলেছে কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

চিত্র ১ - ইন্‌টারনেট অফ থিংস-এর বিশ্বরূপ
[Image credit: pixabay]

যাদের হাঁপানি আছে তাঁরা যে ইনহেলার ব্যাবহার করে থাকেন সেই সাধারণ ইনহেলারকে করে দেওয়া যাবে IoT যুক্ত। ইনহেলারের মধ্যে একটি জিপিএস সেন্সর যুক্ত করে দেওয়া হবে। এতে করে যিনি ইনহেলার ব্যাবহার করছেন তাঁর ব্যাক্তিগত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্যভান্ডারে খবর চলে যাবে সে ঠিক কোন জায়গায় ইনহেলার বেশি ব্যবহার করেছে , সেই জায়গার আবহাওয়া , পরিবেশ কেমন। এতে করে বোঝা যাবে ঠিক কি রকমের জায়গায় তার হাঁপানি বেড়ে যাচ্ছে। এই তথ্য নিরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু তাকে সঠিক ওষুধ দিতে পারবেন।

ডায়বেটিক রোগীদের জন্যে এক ধরনের কন্ট্যাক্ট লেন্স তৈরি হবে যা পরে থাকলে চোখের জল থেকে তার শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা বোঝা যাবে এবং সেই তথ্য সরাসরি গ্লুকোজ মনিটারে অথবা তার বা তার ডাক্তারের মোবাইলে বা চলে যাবে। এই ভাবে সহজে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।

এক ধরণের Bio-stamp যা শরীরে লাগিয়ে রাখলে অনেকটা টাটুর মত দেখাবে। এই নিরীহ দর্শন টাটুটি কিন্তু নীরবে অনেক কাজ করে যাবে। যার শরীরে লাগানো থাকবে তার যাবতীয় বায়োমেট্রিক তথ্য – যেমন রক্ত চাপ , সমস্ত পেশীর কার্যকলাপ , হৃদয় স্পন্দন , মস্তিষ্ক তরঙ্গ ইত্যাদি , সংগ্রহ করবে এবং তার ডাক্তারকে জানাতে থাকবে।

Glowcabs নামের আর এক প্রযুক্তি মানুষের জীবনীশক্তি বাড়াতে চেষ্টা করবে। এই ব্যবস্থায় ওষুধের শিশিগুলোতে লাগানো থাকবে একধরনের আলো এবং শব্দ সঙ্কেত। রোগীর কোন সময়ে কোন ওষুধ খেতে হবে সেটা সঙ্কেত দিয়ে জানিয়ে দেবে। শুধু তাই নয় ওষুধ খাওয়ার পর রোগীর হালচাল ডাক্তারকে এবং ওষুধ প্রস্তুতকারকদের জানাতে থাকবে।

এই ব্যাপারটা ঠিক কি ভাবে কাজ করবে সেটা বেশ জটিল ব্যাপার। তবে সংক্ষেপে বলা যেতে পারে গোটা ব্যাপারটাই একধরনের sensor এর খেলা। এই sensor গুলির বিশেষত্ব হল তাপমাত্রা ,শব্দ ,আলো, গতি এবং বায়বীয় চাপের কোনো পরিবর্তন হলেই তা বুঝে ফেলতে পারবে। ঠিক মানুষ যেমন করে এগুলো বুঝতে পারে তাদের চোখ কান খোলা রেখে। এই বুঝে নেওয়ার পর তাকে ঠিক যে পরিবর্তন হলে programming এর মাধ্যমে তাকে যে কাজটি করে নেওয়ার জন্যে নির্দেশ দেওয়া আছে ঠিক তাই করে ফেলবে। যে প্রযুক্তি দিয়ে এই sensor গঠিত তাকে বলে Microelectromechanical system সংক্ষেপে MEMS।

এ গুলি তৈরি হয় অনেকটা যেমন করে Microprocessor তৈরি হয় , তেমনি Lithography process এ দিয়েই। এই sensor গুলির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় application-specific integrated circuit (ASIC )। এই circuit গুলির programming capability খুব সীমিত বা নির্দিষ্ট। কিছু বিশেষ ধরনের নির্দেশ পালন করতে পারে। যে কোন microprocessor এর সঙ্গে এই গুলিকে জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। তাই যে সব gadget এ microprocessor লাগানো আছে সেই সব gadget গুলিকে IOT Systems এর মাধ্যমে পরিচালিত করা যাবে programming দ্বারা।

এই তথাকথিত system of system ব্যবস্থা যে শুধু মানুষের উপকারে লাগবে তা নয় , এর দ্বারা একটা বিশাল মাপের বাজার যে সারা পৃথিবীতে তৈরি হবে সেটা বলা বাহুল্য। স্মার্টফোন এবং কম্পিউটারের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আমাদের যাবতীয় ঘরকন্যার যন্ত্রগুলি নতুন ধরণের হয়ে দেখা দেবে। ছোটো বড়ো সব গ্যাজেটের মধ্যেই মাইক্রোচিপ এবং আলাদা আলাদা software লাগানো থাকবে। সব কাজ অনেক দ্রুত করা যাবে তাতে করে মানুষের এবং যন্ত্রের কর্মদক্ষতা বেড়ে যাবে। যাতায়াত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রচুর উন্নতি হবে। জীবনযাত্রার মানও উন্নত হবে।

তাহলে কি এবার একেবারে নিখুঁত ভাবে এই দুনিয়ায় ‘অচ্ছে দিন’ আসতে চলেছে। IoT নামক আলাদিন এসে আমাদের আমাদের সব মুসকিলকে আসান করে দেবে ! কিছু কিছু আশঙ্কার জায়গা অবশ্যই আছে। আমাদের জীবনযাত্রা যখন পুরোপুরি IoT নির্ভর হয়ে যাবে তখন আমাদের মনোভাব সেই পিপুফিশুর মত হয়ে উঠবে না তো ? তা ছাড়া আন্তর্জাল নিয়ন্ত্রিত জগতে bug , virus , system crush , link failure এ সব হলে যে পরিষেবা কি ভাবে ‘ঠপ’ মেরে বসে যায় সে সব অভিজ্ঞতা তো আমাদের আছেই। কিন্তু এখন রেলের টিকেট কাটা , ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলা , ওলা উবের গাড়ি বুক করা এসব নাহয় কিছুক্ষণ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু IoT নিয়ন্ত্রিত জীবন যাত্রায় একবার এই সব বিপত্তি ঘটলে তো মানুষের নাওয়া খাওয়াই বন্ধ হয়ে থাকবে। এবং chain reaction হয়ে গিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থা থেকে বাজার হাট অফিস কাছারি সবই থমকে যাবে।

আর ইলেট্রনিক ব্যবস্থা মানেই তো সব কিছু পাসওয়ার্ড নিয়ন্ত্রিত। এ দেশে তো হ্যাকারদের স্বর্গরাজ্য। আমার বাড়ির সিস্টেম যে পাসওয়ার্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত , সে পাসওয়ার্ড যদি আমার সেই পড়সি , যার সঙ্গে আমার সব কিছুতেই রেষারেষি চলে, তার কাছে কোনো রকমে পৌঁছে যায় , তা হলে সে তো আমার হাঁড়ির খবর অনায়াসেই জেনে যাবে। আমার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স , গিন্নির জুয়েলারি , আমার রোগ জ্বালার ফিরিস্তি , গিন্নির মেক আপের রহস্য এ সব তো তার নখদর্পণে চলে যাবে। আর তা ছাড়া আমাদের মত দেশে আমাদের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ছোটো খাটো প্রয়োজন মেটাবার কাজ গুলি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। কাজের মাসি , রাঁধুনি, মাছওয়ালা ,দুধওয়ালা , কাগজওয়ালা , মুদির দোকান এরা আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। IoT যখন আলাদিনের মত আমাদের সেবায় সারাদিন নিয়োজিত থাকবে তখন এদের বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহের পরিসরটুকু কমে আসবে কিনা সেটাও একটা ভয়ের জায়গা।

The Internet of Things: An Explosion of Connected Possibility

চিত্র ২ - IoT-র একটা সম্ভাব্য বিবর্তন
[The Internet of Things: An Explosion of Connected Possibility. (Image Credit: The Connectivist)]
Click on the picture to enlarge

প্রথমে যে প্রশ্নটি তুলে ছিলাম সেটিতে ফিরে যাই এত সব smart devices যখন আমাদের ঘিরে থাকবে তখন কি আমরা আরো বেশি smart হয়ে উঠবো ?

হয়ত আমরা ভুল করতে ভুলে যাবো , ছক ভাঙ্গতে চাইব না , আবেগকে মাথায় উঠতে দেবোনা , অকাজে মন দেবোনা , কাজের কথার বাইরে আর কোনো কথা বলবো না, খেজুরে আলাপে সময় নষ্ট করব না , সংসারের খুঁটিনাটি কাজের চিন্তায় নিজেদের ভারাক্রান্ত করবো না , ঘড়ি ধরে সব কিছু করাতে রপ্ত হয়ে যাবো ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সব করতে পারলে তো আমরা অবশ্যই smart হয়ে উঠবো।

শুধু ‘লিপিকা’র ’ভুল স্বর্গ’ লেখাটির সেই লোকটিকে মনে পড়ছে। লোকটা নেহাতই বেকার লোক ছিল। তার কাজ ছিল কিছু, শুধু শখ ছিল নানারকমের। মৃত্যুর পর তাকে ভুল করে স্বর্গে পাঠানো হল যেখানে সবাই সব সময় ঘড়ি ধরে কাজ করে। সেখানে সে নানারকমের অকাজ করতে লাগলো। যেমন একটি মেয়ে যে রোজ ঘড়া নিয়ে ঝর্ণা থেকে জল আনতে যায় তার ঘড়া নিয়ে – ‘সেইটিকে ঘিরে ঘিরে বেকার আঁকতে লাগল কত রঙের পাক, কত রেখার ঘর’

তারপর সেই মেয়েটির জন্যে রঙ্গীন সুতো বুনে বুনে তার বেণী বাঁধবার দড়ি বানিয়ে দিলে।

দেখা গেল স্বর্গে যেন কাজের জগতে কোথাও একটা ফাঁক এসে ঢুকতে লাগলো। স্বর্গের সভাপতি খুব চিন্তিত হয়ে সভা ডাকলো।

তার পর যা হল তা এই রকম

‘-ভুল লোকটিকে সভায় আনা হল। তার রঙিন পাগড়ি আর কোমরবন্ধের বাহার দেখেই সবাই বুঝলে, বিষম ভুল হয়েছে।

সভাপতি তাকে বললে, 'তোমাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে। '

সে তার রঙের ঝুলি আর তুলি কোমরে বেঁধে হাঁফ ছেড়ে বললে, 'তবে চললুম। '

মেয়েটি এসে বললে 'আমিও যাব। '

প্রবীণ সভাপতি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এই সে প্রথম দেখলে এমন-একটা কাণ্ড যার কোনো মানে নেই। ’

আমাদের IoT নিয়ন্ত্রিত স্বর্গে এ রকম বেকার লোকগুলো , যারা কোনো মানে নেই এমন কাজ নিয়ে বেঁচে থাকে, তাদের কি এই দুনিয়ায় আর কোনো জায়গা হবে , সে রকম একটা চিন্তা মাথায় খোঁচা মারছে।

তবে চিন্তা করে আর কি লাভ। সুনামী , ভূমিকম্প , প্রেমে পড়া এবং নতুন প্রযুক্তি কে কবে আটকে রাখতে পেরেছে।

বরং যে আসছে তার উদ্দেশে গেয়ে উঠি - শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও , IoT এসেছে দ্বারে।


লেখক পরিচিতি - চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী। বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.