প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা

বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা - পনেরোই এপ্রিল ২০১৭

 

দর্শন, থুসিডাইডিস, ম্যাড-মেন আর স্ট্যাটিস্টিক্স

সুমন মাইতি



থুসিডাইডিস

গ্রীক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের লেখায় এক অদ্ভুত অসুখের বর্ণনা পাই আমরা – খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ শতকে তখন টোটকা, লোকাচার আর কুসংস্কারের সংমিশ্রণে চিকিৎসাবিদ্যা আর হাতুড়েবিদ্যা সমার্থক, সেসময় বিজ্ঞানসম্মতভাবে রোগলক্ষণ বর্ণনা করাটাই প্রায় যুগান্তকারী ঘটনা – সেসময় উনি লিখেছেন - এই অদ্ভুত রোগের কোন বহিঃপ্রকাশ থাকত না, প্রথমে জ্বর হত কিন্তু ত্বকের উপরিতলের তাপমাত্রা প্রায় বাড়তই না; এদিকে ভেতরের তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছত যে রুগী গায়ের ওপর সুতোটি রাখতে পারত না। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে জলের মধ্যে বসে থাকলেও তাদের যন্ত্রণার উপশম হতো না। উপরন্ত এই সংক্রামক রোগের সংস্পর্শে যে বা যারা আসত তাদের অনেকেরই রেহাই মিলত না। প্রথমে নাক মুখ ফুলে যেত, তারপর চামড়ার উপরিতল থেকে ক্রমান্বয়ে রক্তক্ষরণ হতো, দেহ থেকে গন্ধময় স্বেদ নিঃসরণ, নিঃশ্বাসে মারাত্মক দুর্গন্ধ -- আরো খারাপ অবস্থায় ভলকে ভলকে পিত্ত মেশানো বমি করত রুগী, শরীরে মারাত্মক খিঁচুনি দেখা দিত। শুরু হবার কয়েকদিনের মধ্যে অতিরিক্ত রক্তপাতে মৃত্যু ঘটত মানুষটির। থুসিডাইডিস বর্ণিত রোগটির পরে আর কোন উল্লেখ নেই পরবর্তীকালের অন্যান্য ঐতিহাসিকদের লেখায়। অসুখটি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, ফলত এই রোগের কার্যকারণ এখনো অজানাই থেকে গেছে -সম্ভবত যে প্যাথোজেনটি এর হোতা সেটি হয়ত বিলুপ্ত হয়েছে বা মিউটেশনের ফলে রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েছে।

এথেন্সের প্লেগ (থুসিডাইডিসের বর্ণনায়)

এরকম ঘটনা একটা নয় লিজিয়নেয়র্স ডিজিস থেকে মধ্যযুগের ব্ল্যাকডেথ বা গতশতকের স্প্যানিশ-ফ্লু বা হালের ইবোলা, আমাদের সমাজে মারণ রোগের প্রাদূর্ভাব ঘটেছে বারংবার যার মধ্যে বহু রোগের সঠিক উৎস নির্ণয় বা প্রতিরোধ অনেকটা চোখবুজে পাশার দান দেওয়ার মতোই চান্স ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভরশীল। এই চান্সের একাধিপত্য কমাতে রোগের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের অভাবটা প্রকট হয়ে ওঠায় জরুরী হয়ে পড়ল রোগের ব্যষ্টিগত চরিত্রনির্ণয় করা – জন্ম হল বিজ্ঞানের এক নতুন শাখার - হিপোক্রেটিসের পরিভাষায় এর নতুন নামকরণ হল এপিডেমিওলজি (Greek: epi (upon) , demos (people) , logos (study))।

হিপোক্রেটিস

প্রায় ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হিপোক্রেটিস রোগলক্ষণ নির্ণয়ে তাঁর লেখা বইতে(On Airs, Waters and Places))তিনটি সম্ভাবনার উল্লেখ করেছিলেন – প্রথমে দেখবে বছরের কোন ঋতু এটি; সেসময় সূর্য কোন দিকে রয়েছে, দিন-রাতের তফাত কিরকম। তারপর লক্ষ্য করবে সেই অঞ্চলের হাওয়ার অভিমুখ, তাপমাত্রার তারতম্য সেটারও খোঁজ রেখো। এরপর দেখবে জলের চরিত্র, (বাস্তবিক কোথাকার জল কোথায় গড়ায় সেটা জানা জরুরী) কি ধরনের মাটি – এঁটেল, বেলে না পলি – বৃষ্টির জল না বন্যার বাড়তিধারা ইত্যাকার সমস্ত তথ্য জানা আবশ্যিক। এখনকার সাপেক্ষে এই কথাগুলি সাধারণ জ্ঞান মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু সে সময় যে কোন রোগ – সাধারণ জ্বরজারি থেকে মহামারী সবকিছুই দেবতাদের অভিশাপ বলে ধরা হতো, সেখানে হিপোক্রেটসই প্রথম বিজাতীয় আতঙ্কের মধ্যে যুক্তির জায়গাটা তৈরি করলেন। এরপর মাঝে অনেকগুলো শতাব্দী চলে গেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে কিন্ত গবেষণার মূলঅভিমুখ ব্যক্তিগত অসুখের নিরাময়ের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট ছিল – সেখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সার্বিক স্বাস্থ্যর ব্যাপারে পর্যাপ্ত নজর দেওয়ার দিকটি একরকম উপেক্ষিতই ছিল। ব্যতিক্রম দুয়েকটা অসুখ যাদের সম্পর্কে জনসাধারণের অন্ততঃ কিছুটা ধারণা ছিল যেমন ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের সাথে খারাপ বাতাস বা জলাজমির একটা কোথাও যোগ রয়েছে এই তথ্যটি অনেকের অজানাই থেকে যেত যদি না রোমের প্রথম পোপ গ্রেগ্ররি দ্য গ্রেট নিজে ম্যালেরিয়ার ভুগতেন!এখনকার দিনে সেলেব্রিটিদের কোন অসুখ হলে মিডিয়ায় প্রচার বেশী হয় সেরকমই কতকটা।

জন গ্রাণ্টের বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ

পর্যবেক্ষণভিত্তিক গবেষণায় হিপোক্রেটিসের তৈরী করে যাওয়া কাঠামোর ওপর মৌলিক গবেষণার সাক্ষ্য রাখলেন জন গ্রান্ট। চার্চের রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে ১৬৬২ সালে প্রকাশিত হল “ Natural and Political Observations Mentioned in a Following Index, and Made Upon the Bills of Mortality” - সেখানেই গ্রান্ট লিখছেন – “Of the difference between the numbers of Males and Females. The next Observation is, That [sic] there be more Males than Females...There have been Buried from the year 1628, to the year 1662, exclusive, 209436 Males and but 190474 Females: but it will be objected, That [sic] in London it may be indeed so, though otherwise elsewhere; because London is the great Stage and Shop of business, wherein the Masculine Sex bears the greatest part. But we answer, That [sic] there have been also Christened within the same time 39783 Males and but 30866 Females, and that the Country-Accounts are consonant enough to those of London upon this matter.” গ্রান্ট দেখালেন এলাকাভিত্তিক জন্ম এবং মৃত্যুহারের তফাত, অঞ্চলভিত্তিক বার্ষিক শুমারি, ঋতুভিত্তিক পার্থক্য, পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে জীবিকা এবং পেশাভেদে মৃত্যুহারের তারতম্য কিভাবে ঘটে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা। অনুমাননির্ভরতা ছাড়িয়ে সংখ্যার সখ্যতার পথে একটু এগোল চিকিৎসাবিজ্ঞান।

আজকের আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং তার দোসর এপিডেমিওলজি হিপোক্রেটিস, গ্রান্টের সময়ের তুলনায় কয়েকযোজন এগিয়ে গেছে বললে হয়ত অতিশয়োক্তি হবে না, কিন্তু অগ্রগতি, উন্নতি ইত্যাদির মাপকাঠি ভীষণভাবেই আপেক্ষিক। ধরা যাক –র‍্যাডিক্যাল ম্যাস্টেক্টমি, ডাক্তার উইলিয়াম হ্যালস্টেডের প্রণীত এই অপারেশান একসময় স্তনক্যান্সারের একমাত্র স্বীকৃত চিকিৎসা ছিল। ক্যান্সার ধরা পড়লেই এককথায় সার্জিক্যাল টেবিলে নিজেদের আত্মপরিচয়ের অন্যতম অভিজ্ঞান একরকম আত্মসমর্পণে বাধ্য হতেন মহিলারা। এখন ভাবলে সেটাকে বর্বর মনে না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। কাজেই রিসার্চের ক্ষেত্র যত বিস্তৃত হবে ততই পুরনো ধারণাগুলি বাতিল হয়ে নতুন চিন্তাভাবনা সেটার স্থান নেবে – সেটাই স্বাভাবিক, চিকিৎসাবিজ্ঞানও এর ব্যাতিক্রম নয়। ক্যান্সারের প্রসঙ্গ যখন এলোই তখন ধূমপানের প্রসঙ্গও উঠবে। ক্যান্সার এবং ধূমপান এই দুটোর সাথেই জড়িয়ে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম যুগান্তকারী গবেষণার ইতিহাস।

এখন আট থেকে আশি সবাই জানে ধূমপান করা স্বাস্থ্যের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক এবং বহু চেন স্মোকার সামাজিক বাধ্যবাধকতায় সিগ্রেট খাওয়া অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন মাচোনেস, সামাজিক প্রগতিশীলতা, প্রক্রিয়াশীল বৈপ্লবিক চেতনা ইত্যাদি পরস্পরবিরোধী সবকটি সত্তার সমার্থক ছিল ধূমপান! নিউ ওয়ার্ল্ড থেকে ফিরে কলম্বাস স্পেনের রানি ইসাবেলাকে উপহার দেন তামাক পাতা। স্পেন থেকে সারা ইওরোপে ছড়িয়ে পড়ে তামাক, চাহিদা বাড়তে বাড়তে আকাশ ছোঁয় শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে। ইওরোপে ভার্জিনিয়া তামাক রপ্তানি করে অ্যামেরিকা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করত। নিন্দুকেরা বলে থাকে অ্যামেরিকার স্বাধীনতা তামাক পাতা আর কেণ্টাকি মাস্কেটের দান! তামাকের বিশেষ করে সিগারেটের স্বর্ণযুগ বলা চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে – কন্সক্রিপ্ট থেকে সাধারণ ফ্যামিলি ম্যান, অফিসের ঘাঘু বস থেকে আর্মস ফ্যাক্টরির সদ্য কাজে যোগ দেওয়া মহিলা সবাই তখন পাকানো কাগজে তামাকের নেশায় মজে। ছেলেবুড়ো তো বটেই, ডাক্তারেরা নিজেরাও সময় করে দুয়েকটা সুখটান দিয়ে নিতেন।

সমসাময়িক একটি বিজ্ঞাপন

ধূমপানের এই সর্বজনমান্য গ্রাহ্যতার মধ্যেই সমান্তরাল গবেষণায় উঠে আসছিল অন্য ছবি। ১৯৪০ দশকের শুরু থেকেই একাধিক রিসার্চ ধূমপানের সাথে ক্যান্সারের একটা যোগ রয়েছে সেটার প্রমাণ পাচ্ছিল – কিন্তু সাহস করে কেউ আর সাধারণ্যে এই খবরটা ভাঙ্গার দায়িত্ব নিতে চাইছিলেন না, পাছে একঘরে হতে হয়! তখনকার সমাজে সিগারেটের এলিট ইমেজ ভাঙ্গার সাহস বিজ্ঞানীদের ছিল না। এর সাথে যোগ হয় প্রবল পরাক্রমী টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রির লবি যারা এধরনের যে কোন খবরকে যেনতেন প্রকারেণ চেপে দিতে চাইত। যাঁরা “ম্যাড মেন” সিরিজ দেখেছেন তাঁরা জানবেন পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে ন্যু ইয়র্কের ম্যাডিসন আভেন্যুর একটি কাল্পনিক বিজ্ঞাপন সংস্থার ওপর সিরিজটি নির্মিত যেখানে মার্কিন কনজিউমারিস্ট নাগরিক সংস্কৃতির বিবর্তন বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে সেলুলয়েডে। সেখানে একটি ঘটনা আছে - সিগারেট কোম্পানির মালিকের পুত্র এসেছে সংস্থার সঙ্গে বিজ্ঞাপনের কন্ট্রাক্ট রিনিউ করতে। ডার্করুমে একাকী পেয়ে ক্লায়েন্টটি এজেন্সীর আর্ট ইলাস্ট্রেটরের সাথে জোর করে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে- ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেলে, ক্লায়েন্টের দাবী মেনে কোম্পানি বিনাদোষে পত্রপাঠ আর্টিস্টকেই ছাঁটাই করে। কারণটা সহজবোধ্য- এজেন্সীর বার্ষিক আয়ের সিকিভাগই আসে সিগারেটের বিজ্ঞাপন থেকে ফলে ক্লায়েন্ট যা চাইবে সেটা মানতে ম্যানেজমেন্ট বাধ্য! গল্প নয় তখন অধিকাংশ এজেন্সীতে এটাই ছিল বাস্তব।

এরকম সময়ে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হল সার্জেন জেনারেলের রিপোর্ট। এই রিপোর্টে প্রথম সরকারিভাবে স্বীকার করা হল ধূমপানের সাথে বর্ধিত মৃত্যুহারের সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। আটলান্টিকের ওপারে ব্রিটেনের দুই গবেষকের প্রায় এক দশকব্যাপী গবেষণা এই রিপোর্টকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ডঃ অস্টিন ব্রাডফোর্ড হিল এবং চিকিৎসক রোনাল্ড ডাল চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে ব্রিটেনের ডাক্তারদের ওপর একাধিক সমীক্ষা করেন। সদ্য গঠিত হওয়া ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কর্মরত ডাক্তারদের নিজস্ব স্বাস্থ্যসম্পর্কিত তথ্যসংগ্রহ ছিল এই সমীক্ষার মূল উদ্দেশ্য। প্রশ্নমালার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল – তাঁরা ধূমপান করেন কিনা এবং করলে সেটার মাত্রা কিরকম (প্রত্যেক দিন/ সপ্তাহে কয়টি সিগারেট খান?)। প্রাথমিকভাবে প্রায় পঞ্চাশহাজার ডাক্তার এতে অংশ নেন। সমীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেল ডাক্তারদের মধ্যে যাঁরা সিগ্রেট খেতেন না তাঁদের তুলনায় যাঁরা সিগ্রেট খেতেন তাঁদের ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১২ গুণ বেশী। বৃহত্তর সমাজে সমীক্ষাপরবর্তী প্রতিক্রিয়া হিলের মানসিকতায় কিরকম প্রভাব ফেলেছিল তার কিছুটা আভাষ পাওয়া যায় ১৯৬৫ সালে লন্ডনের Occupational Medicine of the Royal Society of Medicine আয়োজিত স্মারক সভায় তাঁর দেওয়া বক্তৃতায়। সেই বক্তৃতার অংশবিশেষ –

ডঃ ব্র্যাডফোর্ড হিল ও তাঁর গবেষণাপত্র (ব্রিটিশ মেডিকাল জার্নালে প্রকাশিত)

“I have no wish, nor the skill, to embark upon a philosophical discussion of the meaning of ‘causation’. The ‘cause’ of illness may be immediate and direct; it may be remote and indirect, underlying the observed association. But with the aims of occupational, and almost synonymously preventive, medicine in mind, the decisive question is whether the frequency of the undesirable event B will be influenced by a change in the environmental feature A.”

এখন প্রশ্ন হল মার্কিন সার্জেন জেনারেলের রিপোর্ট এবং ডঃ হিল কিভাবে এই সিদ্ধান্তে উন্নীত হল? মূল প্রতিপাদ্যে পৌঁছনোর জন্য আমাদের কিছুটা দর্শনের আশ্রয় নিতে হবে। কোন ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কতগুলো শর্ত পুরণ করা জরুরী। তারমধ্যে একটি হচ্ছে নির্দিষ্টতা (Specificity) – অন্যান্য বহু সম্ভাব্য কারণের মধ্যে শুধুমাত্র যে ফ্যাক্টরটি সর্বত্র বিরাজমান তার সাথে ঘটনার(event outcome) সরাসরি যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশী। ভিন্ন ভিন্ন রুগীর ক্ষেত্রে তাঁদের নিজস্ব পরিধির মধ্যে যদি একই ঘটনা বারংবার ঘটে সেক্ষেত্রে কারণটির প্রযোজ্যতা আরো নির্ণায়ক বলে ধরা যেতে পারে(Strength of Association)। কিন্ত সমাপতন মানেই তো কারণ নাও হতে পারে (Correlation doesn’t always imply Causation)। সেক্ষত্রে কি হবে? এই সূত্র ধরে হিল আরেকটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরলেন - তিনি প্রমাণ করে দিলেন অধিকাংশ রুগী আগে ধূমপান শুরু করেছে পরে তাদের ক্যান্সার ধরা পড়েছে – অর্থাৎ কারণটি ঘটনার পূর্বে বর্তমান (temporality – preeminence of causation)। কিন্তু এতেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না সমালোচকরা- হতেই পারে হয়ত এই সমীক্ষায় এটা ধরা পড়েছে কিন্তু একই ঘটনা অন্যান্য ক্ষেত্রেও ঘটবে তার প্রমাণ কি? অতএব চালানো হল একাধিক প্রসপেক্টিভ এবং রেট্রস্পেক্টিভ স্টাডি; সবকটি সমীক্ষার ফলাফল প্রায় একই বেরল অর্থাৎ Consistency upon repetition ।

সমীক্ষালব্ধ ফলাফলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেন না তাঁরা –কেন এমন হচ্ছে তার সম্ভাব্য বায়োলজিক্যাল হাইপোথিসিস খাড়া করলেন। দেখালেন ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বয়েস এবং ধূমপানের মাত্রা বাড়ার সাথে সমানুপাতিক। শুধু তাই নয় সমবয়স্ক মহিলা এবং পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার হবার তারতম্য তাঁদের ধূমপানের হারের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে। এবং একই লিঙ্গের মধ্যেও যাঁরা যত বেশী সিগ্রেট খান তাঁদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রবণতা তত বেশী( Dose-Response relationship)। ডিডাকটিভ রিজনিংএর ওপর দাঁড়িয়ে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে এলেন ব্রাডফোর্ড হিল। এর আগে ১৯৫৭ সালেই মার্কিন সার্জেন জেনারেল লিরয় বার্নি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন ধূমপান এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, ১৯৬৪ সালের রিপোর্টটি অ্যামেরিকান জনগণের সামনে আরো বৃহত্তর প্রেক্ষিতে সমস্যাটি তুলে ধরতে সক্ষম হল। ম্যাড-মেনের গল্পে ফিরি – প্রোটাগনিস্ট ডন ড্রেপার গেছে অ্যামেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির এক সভায়; সেখানেই সার্জেন জেনারেল রিপোর্টটি পড়া হচ্ছে। নেক্সট সিন - কনফারেন্স থেকে ফিরে ন্যু ইয়র্ক টাইমসে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্যামেল কম্পানীর সাথে সম্পর্কের যবনিকা টানছে ড্রেপারের বিজ্ঞাপন সংস্থা – এরসাথেই যেন পূর্ণ হল একটি চক্র। এতটাই ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ছিল রিপোর্টটি যে পঞ্চাশ বছর পরেও পপুলার সিরিজে সেটা দেখাতে হয়!

ব্রাডফোর্ড হিলের গবেষণাপত্রটি আধুনিক এপিডেমিওলজির এক মাইলস্টোন বিশেষ- সংখ্যাতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে জন গ্রান্ট বিজ্ঞানের যে ধারাটির সূচনা করেছিলেন ব্রাডফোর্ড হিল স্টাডি তার যোগ্য উত্তরসূরী। জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর এই কয়েকটি মূলনীতির ওপর স্থাপিত। পালস পোলিও হোক বা স্মল পক্স, সার্স থেকে ইবোলা, অথবা একদম হালের ডেঙ্গি কিংবা জিকা ভাইরাস, পরমাণু বোমার থেকে কোন অংশে কম বিপজ্জনক নয় এগুলি, অনবধানতায় আমাদের শমন হতে পারত প্রত্যকেটি এবং হয়েওছে, মধ্যযুগের ইতিহাস সাক্ষী। কিন্তু হিপোক্রেটিস যে রাস্তা দেখিয়েছিলেন, দর্শনের হাত ধরে ফলিতবিজ্ঞানের যে শাখাটার সূচনা, পরিকল্পনাভিত্তিক যূথবদ্ধ প্রতিরোধ রূপায়ণে সেটাই আমাদের সভ্যতার জিয়নকাঠি - দুহাজার বছরে এপিডেমিওলজির বহু বিবর্তন-পরিমার্জন ঘটেছে কিন্তু এর মূলনীতিগুলো এখনো সমান প্রাসঙ্গিক এবং ভবিষ্যতেও থাকবে কারণ আমাদের গোষ্ঠীবদ্ধ অস্ত্বিত্বের সাথেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞান।

তথ্যপঞ্জী

(১) The Writings of Hippocrates and Galen. Epitomized from the Original Latin Translations, by John Redman Coxe. Philadelphia: Lindsay & Blakiston, 1846.
(২) Hippocrates. On Airs, Waters and Places. In: Adams F ed., The Genuine Works of Hippocrates. New ork: Wood, 1886.
(৩) Graunt J. Natural and Political Observations Mentioned in a Following Index, and Made Upon the Bills of Mortality. 2ND ed, London. 1662.
(৪) Kargon R. John Graunt, Francis Bacon, and the Royal Society. The reception of statistics. J. Hist Med Allied Sci. 1963;10:337-348
(৫) Halsted, William Stewart. "I. The results of radical operations for the cure of carcinoma of the breast."; 1907 Annals of surgery 46.1: 1.
(৬) Hill AB. The environment and disease: association or causation? Proc R Soc Med 1965;58:295-300.
(৭) Doll R and Hill AB. A study of the aetiology of carcinoma of the lung. Br Med J 1952;2:1271-86.
(৮) U.S. Department of Health, Education adnWelfare, Public Helath Service. Smoking and Helath, Report of the Advisory Committee to the Surgeon General of the Public Health Service. Washington, DC: GPO; 1964.

ছবির ঋণস্বীকার-

https://www.college.columbia.edu/core/content/thucydides
http://www.ancient.eu/image/5521/
https://en.wikipedia.org/wiki/Hippocrates#/media/File:Hippocrates.jpg
https://en.wikipedia.org/wiki/John_Graunt#/media/File:Graunt_Observations.jpg
http://nfs.unipv.it/nfs/minf/dispense/patgen/lectures/files/images/bradford_hill_causality.jpg
https://legallegacy.wordpress.com/2015/01/11/january-11-1964-the-u-s-surgeon-general-issued-the-first-report-linking-smoking-and-health/


লেখক পরিচিতি - জন্ম- পড়াশুনো-প্রথম যৌবন হাওড়া আর তার দোসর কলকাতায়। উচ্চতর গবেষণায় মার্কিন মূলুকে আসা। ডক্টরেট করার পর বর্তমানে কর্মসূত্রে টেক্সাসনিবাসী। শখের রাঁধুনি, হবি বলতে ইতিহাসের বই আর হপ্তা শেষের রোড ট্রিপ। ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.