প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা

বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা - পনেরোই এপ্রিল ২০১৭

 

নাস্তির থেকে অস্তি

সুমিত রায়



ধর্ম, দর্শন আর বিজ্ঞান।

এই ত্রিমূর্তি আমাদের অস্তিত্ব নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এর মধ্যে ধর্ম হলেন জ্যেষ্ঠ, বাঘের দাঁত খিঁচুনিতে নাড়ী ছেড়ে দেওয়া বা বন্যার জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য দক্ষিণরায় বা বরুণদেব হয়ে আছেন আমাদের সঙ্গে। বয়োকনিষ্ঠ হলেন বিজ্ঞান, অনেক সহস্রাব্দ গর্ভবাসের পর তাঁর উদয়, অনেকদিন হাঁটি হাঁটি পা পা করার পর এখন দৌড়তে শুরু করেছেন। দর্শন মধ্যমা, কৃষিবিদ্যা আবিষ্কারের পর অন্যের শ্রম ভাঙিয়ে খেয়েপরে ঘুমিয়ে পরচর্চা করে যখন সময় কাটেনা তখন মানুষের অলস মস্তিষ্ক থেকে এঁর জন্ম, তারপর অনেকদিন রাজত্ব করার পর এখন মোটামুটি অবসর নিয়েছেন, বিজ্ঞানের ছত্রছায়ায় বেশীর ভাগ সময় কাটান।

পৃথিবীর অন্য সব ত্রিমূর্তির সঙ্গে এই ত্রিমূর্তির এক বিশেষ পার্থক্য হলো যে এঁদের মধ্যে মাঝে মাঝেই সদ্ভাবের অভাব দেখা যায়। ধর্ম অবশ্য "ঈশাবাস্য দিবানিশা" থেকে "বৃহস্পতিবার বার্তাকুভক্ষণ" পর্যন্ত যে কোনো রূপ নিতে পারেন, তাই আগেই বলে রাখা ভালো যে আমাদের নজর আবদ্ধ রাখবো শুধু "ঈশাবাস্য" অর্থাৎ সৃষ্টিতত্ত্ব আর স্রষ্টার ওপর -- সাধারণত যাকে মেটাফিজিক্স বলা হয় যাকে। যেদিন জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাবার অজুহাতে ধর্ম বিজ্ঞানকে স্বর্গ থেকে বিদায় দিয়েছে সেদিন থেকে জন্মেই ধর্মের সঙ্গে বিবাদ করার ব্রত নিয়েছে বিজ্ঞান।

এই তর্কে খেয়াল করার মতো প্রথম যুক্তি আসে অ্যারিস্টটলের কাছ থেকে, ঈশ্বরকে ওই "কারণ কারণ তুমি, তুমিই কারণ" (first cause) বলার ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকেছিলো তাঁর কাছে। তখন অবশ্য বিজ্ঞানের থেকে দর্শনের রম্‌রমা বেশী। [সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু কিছুতেই লোভ সামলাতে পারছি না, ছাপাখানার ভূতে লেখে "কাবল কাবল ভুষি ভুষিই কাবল"।] তারপর অনেকদিন চুপচাপ, ষোড়শ শতাব্দীতে এসে কোপার্নিকাস সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা বলে একটা সোরগোল তুলে দিলেন, তাঁর দেখাদেখি মুখ খুললেন আরো কিছু বিজ্ঞানী। মারধোর, শাস্তি, দাহ অবধি গড়িয়ে ব্যাপারটা বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানীদের পক্ষে খুব প্রীতিকর হলো না, কিন্তু বৈজ্ঞানিক সত্যটা চালু রয়ে গেলো। নিউটনও সেই বিপ্লবে যোগ করলেন কিছু, তাঁর নিয়ম ব্যবহার করলে গ্রহ-উপগ্রহ ঠেলে নিয়ে যাবার জন্য দেবদূতের আর প্রয়োজন হবে না, এই লোভ দেখিয়ে।

এইভাবেই দেবদূত আছে কি নেই ধরণের ছোটোখাটো হাঙ্গামাতেই গোলমালটা আটকে ছিলো, কিন্তু প্রায় দেড়শো বছর আগে ডারউইনের বিবর্তনবাদ এই সঙ্ঘর্ষটাকে বেশ জটিল করে তুললো। প্রসঙ্গত, সে সঙ্ঘাতের অনুরণন আজও শোনা যায় এই আমেরিকারই গঞ্জে গ্রামে, creationism, intelligent design, এমন সব বিকল্পের মারফৎ -- যদিও বিদ্বজ্জনের মতে আজকের বিজ্ঞানের জগতে বিবর্তনবাদ কঠিনতম পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশী সফল। ঈশ্বর ছদিনে বিশ্বসৃষ্টি করলেন, শেষদিনে মানুষ গড়লেন, ইত্যাদি ইত্যাদি যে সৃষ্টিতত্ত্ব জেনেসিস নামে প্রচলিত -- বিবর্তনবাদ করলো তার মূলে কুঠারাঘাত। যে পুঁথির ওপর ভিত্তি করে সারা ধর্মের ইমারৎ খাড়া করা হয়েছে, তার গোড়াতেই গলদ বার হওয়াটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, তার প্রতিক্রিয়া ব্যাপক তো হবেই। বিরোধটা অবশ্য নিছক অস্তিত্ববাদ ছাড়িয়ে আরো অনেক গভীরে প্রকাশ, আমরা তার মধ্যে গেলাম না। তবে যতক্ষণ তা সৃষ্টির গড়ন-গঠনের মধ্যে রাখা হচ্ছে, তাকে স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে তকরারে পৌঁছতে দেওয়া হচ্ছে না, ততক্ষণ বিবর্তনবাদকে ধার্মিকরা ঢেঁকি গেলার মতো করে মেনে নিচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

স্রষ্টার অস্তিত্বের স্বপক্ষে সবচেয়ে বড়ো যে প্রমাণ দাখিল করা হয় তা হলো সৃষ্টি। যদি সৃষ্টি থাকে, তাহলে স্রষ্টা থাকতেই হবে, নয়তো সৃষ্টিটা করলো কে? এর মধ্যেকার কথার কারচুপিটা বাদ দিলে প্রশ্ন দাঁড় করানো যায়, তার আগে কী ছিলো? "এক জ্যোতির্বিন্দু থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হলো", -- তার আগে কী ছিলো, তার আগে, তার আগে, ...। এইভাবে একসময়ে হাল ছেড়ে বলা হয়, ঠিক আছে বাবা, সবকিছুর আগে ছিলেন ঈশ্বর, অনন্ত, অপার তিনিই প্রথম কারণ। আর একটা প্রশ্ন প্রায়ই পেশ করা হয়ে থাকে, -- "নাস্তির (nothing) থেকে অস্তি (something) হলো কেন, হলো কীভাবে (যদি ঈশ্বর না করে থাকেন)"?

গত একশো বছর বা তার বেশী সময় ধরে বিজ্ঞান সক্রিয়ভাবে এই দুই প্রশ্নের মোকাবেলা করে আসছে। মনে রাখতে হবে বিজ্ঞানের যাত্রা যুক্তি-তর্ক-অনুমান-সিদ্ধান্তের বাঁধা সড়ক ধরে, বিশ্বাসের মেঘবাহনে নয়। সে যাত্রার দিগ্দর্শক হলো পরীক্ষিত সত্য। সে যাত্রায় গত তিন দশকে পারমাণবিক তত্ত্ব (particle theory), মাধ্যাকর্ষণ বিদ্যা (gravitation theory) আর মহাজাগতিক বিজ্ঞানের (cosmology) অগ্রসর অভাবনীয়, মহাবিশ্বের সৃষ্টি -- এবং স্থিতি আর প্রলয় -- নিয়ে যে সব তত্ত্ব, তথ্য আর সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে তাদের বিস্তার আর গভীরতা অবিশ্বাস্য। তার ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত উত্তর দেবার সময় এসেছে। এই প্রবন্ধে আমরা ওপরের দুটো প্রশ্নকে সামনে রেখে সেই উত্তর কি এবং কেন -- সেই দিকে এগিয়ে যাবো।

উনিশশো সতেরো সালে আইনস্টাইন এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক রচনা প্রকাশ করেন, যেটিকে ভৌত বিশ্বতত্ত্বের (physical cosmology) জনক বলা হয়। এর আগে সেই দশকের গোড়ার দিক থেকে শুরু করে তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (general relativity) নিয়ে লিখছিলেন। মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ঘিরে এই আপেক্ষিকতাবাদের মূল সূত্র, আর সেই সূত্রের অনুসরণ করে আমরা যে স্থান-কালে (space-time, আমরা এখন থেকে স্পেসটাইম বলবো) নিমজ্জিত হয়ে আছি, তার কাঠামো নিয়ে অনেক তত্ত্ব আইনস্টাইন উপস্থাপন করেন। তার একটি তত্ত্বে বলে যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আকর্ষক শক্তি, যে কোনো স্পেসে যে কোনো কালে অবস্থিত ভরগুচ্ছ (masses) পরস্পরকে আকর্ষণ করে এবং ভরগুচ্ছের বিন্যাসনির্ভর সেই শক্তি প্রভাবে সেখানকার স্পেসটাইম নানাভাবে দুমড়ে মুচড়ে যেতে পারে। এই পারস্পরিক আকর্ষণের ফলে ভরগুচ্ছ স্থিতিশীল (static) থাকতে পারে না, তাদের গতিশীল হতেই হয়। এই বিষয়ে আইনস্টাইনের যে সমীকরণ (equation) তা আঞ্চলিক (local) আর বৃহত্তর (uinversal), অর্থাৎ মহাবিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োগ করলে দেখা যায় যে ভরের বিতরণের ওপর নির্ভর করে যে কোনো অঞ্চলের বা মহাবিশ্বের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতও নির্ধারণ করা যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে সেই সময়কার তাত্ত্বিক আর ফলিত, বিজ্ঞানের দুই ধারাতেই আমাদের মহাবিশ্বের ছবিটি ছিলো এক অসীম, অন্ধকার, অপরিবর্তনীয় মহাশূন্যে নিমজ্জিত, তারায় ভরা একক একটি নীহারিকার -- Milky Way। তাই যদিও আকর্ষক মাধ্যাকর্ষণের ফলে মহাবিশ্বের সঙ্কুচিত হবারই কথা, তবু তখনকার মতানুযায়ী স্থিতিশীল বিশ্বের আবেদনটা আইনস্টাইন এড়াতে পারেননি। তাঁর সমীকরণের সমাধানে যাতে মহাবিশ্বকে স্থিতিশীল হয়ে দেখা যায় সেই উদ্দেশ্যে তখন তিনি তাঁর সমীকরণে একটি ধ্রুবকের (constant) প্রয়োগ করেন -- তাকে কসমোলজিকাল কনস্টান্ট আখ্যা দেওয়া হয়।

তারপর আইনস্টাইনের তত্ত্ব নানা ফলিত পরীক্ষায় সফল হয়ে বিজ্ঞানী সমাজে স্বীকৃতি পেতে আরম্ভ করলো। উনিশশো সাতাশ সালে এক বেলজিয়ান বিজ্ঞানী, লেমেইতর নাম, আইনস্টাইনের সমীকরণের একটা সমাধান করলেন, দেখা গেলো যে সেই সমাধানমতে মহাবিশ্ব স্থিতিশীল নয়, বস্তুত স্ফীতিশীল। আইনস্টাইন তখন অবশ্য এই মত গ্রহণ করলেন না। কিন্তু অন্যদিকে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের প্রযুক্তি তখন অনেক অগ্রসর হয়েছে, মহাকাশের অনেক কিছু স্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, আস্তে আস্তে শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্রের স্থাপনও হচ্ছে। সেসব যন্ত্র ব্যবহার করে কিছু বিজ্ঞানী আবিষ্কার করলেন যে আমাদের এই ছায়াপথ নীহারিকাটি মহাবিশ্বে একক নয়, বহুশত কোটি নীহারিকা সমগ্রের একটি। আবিষ্কৃত হলো পৃথিবীর সঙ্গে সেই সব নীহারিকার ব্যবধান আর তাদের আপেক্ষিক গতি মাপার উপায়। এই খাতে সংগৃহীত অনেক পরীক্ষিত তথ্য থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত করলেন যে কাছাকাছি কিছু নীহারিকা ছাড়া মহাকাশের প্রায় সব দৃশ্যমান নীহারিকা আমাদের ছায়াপথের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে -- শুধু তাই নয়, তুলনায় প্রতিটির গতি আমাদের থেকে সেই নীহারিকার দূরত্বের সরাসরি সমানুপাতিক। মানে যতো বেশী দূরে ততো বেশী জোরে,যতো গুণ, ততো গুণ। এটা স্বীকার করতে হলো যে আমাদের নীহারিকা এমন কিছু ব্রাত্য নয় যে বাকী সব নীহারিকারা তার কাছ থেকে পালাচ্ছে, কাজেই সনীহারিকা মহাশূন্যই স্ফীত হচ্ছে, তারই প্রকাশ এই পারস্পরিক বিকর্ষণ। এই তথ্যসম্ভারের সম্মুখীন হয়ে আইনস্টাইনকে স্থিতিশীল মহাবিশ্ব নিয়ে তাঁর স্থিরবিশ্বাস পরিত্যাগ করতে হলো। আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণ থেকে কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্টটি বাদ দিলেন। এডউইন হাবল (যাঁর নামে আজকের বিখ্যাত নভোচারী টেলিস্কোপটির পরিচয়) ছিলেন এই গবেষণা উদ্যোগের পুরোধা। এখন যদি আজ দেখা যায় যে সব নীহারিকা পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তাহলে এ সিদ্ধান্তে আসতেই হয় যে অতীতে তারা কাছাকাছি ছিলো, চাই কী ছিলো একসঙ্গে পুঞ্জীভূত হয়ে। হিসেব করে সময় আরো পিছিয়ে নিলে সেই পুঞ্জের আয়তন এক বিন্দুর পরিমাণ হতে পারে,তখন কোনো বস্তু বা ভর নেই, আছে যা তা অচিন্ত্যনীয় তাপমাত্রার নির্জলা শক্তি (আইনস্টাইনের E=mc2 ভাবুন)। সেই অবস্থা থেকে মহাবিশ্বের আয়তন বাড়তে থাকে, তাপমাত্রা আসে কমে আর শক্তি রূপান্তরিত হয়ে আস্তে আস্তে প্রোটন, নিউট্রন আদি মৌলকণিকা সব দেখা দিতে শুরু করে। মহাবিশ্বের সৃষ্টি আর বিবর্তনের এই তত্ত্বটিকে মহা-বিস্ফোরণ বা বিগব্যাং (Big Bang) তত্ত্ব (সংক্ষেপে বিগব্যাং) বলা হয়। এই তত্ত্বমতে জন্মক্ষণের এক সেকেণ্ড পরে সেই অগ্নিগোলকের তাপমাত্রা হচ্ছে সহস্র কোটি ডিগ্রি, মৌল কণিকা একত্রিত হয়ে মৌল উপাদানের (elements) সৃষ্টি হচ্ছে (আবার ভেঙেও যাচ্ছে) -- এভাবে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম আর লিথিয়াম, সবচেয়ে সরল এই তিনটি মৌলের উৎপত্তি। বিজ্ঞানীদের হিসেবমতো সেই সময় মহাবিশ্বে যে অনুপাতে এই তিনটি মৌলের সৃষ্টি হতে পারতো তা বিবর্তিত হলে আজকের মহাবিশ্বে তাদের যে অনুপাতে দেখা যায় তার আশ্চর্য মিল আছে। বিগব্যাং তত্ত্ব যে সঠিক, এই মিলটি তার অতি প্রত্যক্ষ প্রমাণ।

অর্থাৎ, আমাদের দৃশ্যমান এই মহাবিশ্বের বয়স গণিতব্য, আজ থেকে সসীম কাল আগে এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অগ্নিগোলক হয়ে তার জন্ম।

মহাবিশ্বের উৎসসন্ধান সফল হবার পর তার অবসান কী ভাবে হতে পারে, বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলেন। দেখা গেলো (অন্তত তখনকার মতো) যে এ প্রশ্নটির উত্তর নির্ভর করছে মহাবিশ্বে সামগ্রিকভাবে কতোটা ভর আছে তার ওপর। যদিও আজ মহাবিশ্ব স্ফীতিশীল, ভর যদি খুব বেশী থাকে, তাহলে মাধ্যাকর্ষণের তাড়নে কোনো এক সময় স্ফীতি বন্ধ হয়ে সঙ্কোচন শুরু হবে আর শেষ অবধি মহাবিশ্ব একেবারে নিষ্পেষিত হয়ে যাবে (big crunch)। যদি যথেষ্ট ভর না থাকে তাহলে এই এখনকার স্ফীতি চলতেই থাকবে, মহাকাশ স্ফীত হতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। আর ভরে ঠিক ঠিক সমতা থাকলে মহাবিশ্ব হবে স্থিতিশীল। এই তিন সম্ভাবনার সঙ্গে মহাবিশ্বের জ্যামিতিক গঠনের খুব ঘনিষ্ঠ যোগ আছে -- যথাক্রমে বদ্ধ (গোলক আকৃতি), মুক্ত (ঘোড়ার জিনের আকৃতি) বা সমতল। স্পেসের বক্রতা (curvature) হচ্ছে এই জ্যামিতিগুলোর মাপ -- যথাক্রমে ধনাত্মক, ঋণাত্মক আর শূন্য।

তাহলে পরের কর্তব্য হলো মহাবিশ্বে সামগ্রিক কতো ভর আছে তার হিসেব নেওয়া। এখানে একটা কথা খোলসা করা উচিত। আমরা যখন মহাকাশে দূরের কোনো জিনিস দেখি তখন আমরা কালের ব্যবধানেও পিছিয়ে যাই। ধরা যাক আমরা একহাজার আলোকবর্ষ (এক আলোকবর্ষ = এক বছরে আলোকরশ্মি যতোটা পথ যেতে পারে, প্রায় দশ লক্ষ কোটি কিলোমিটার) দূরের কোনো তারার ছবি দেখলাম -- যে আলোর রশ্মিতে সেই ছবি আমাদের কাছে প্রকট হলো, সেটি কিন্তু এক হাজার বছর আগে সেই তারা থেকে রওনা দিয়েছে, অর্থাৎ ছবিটি একহাজার বছর পুরোনো ঘটনার। আমাদের মহাবিশ্বের বয়স প্রায় তেরোশো কোটি বছরের মতো হবে, তার মানে তেরোশো কোটি আলোকবর্ষের বাইরে মহাবিশ্বের যাঅংশ আছে তা আমরা দেখতে পাইনা। এই যে আলোকগতির সীমাবদ্ধ মহাবিশ্ব, যাকে অবেক্ষণীয় মহাবিশ্ব (observable universe) বলা যায়, আমরা যখন মহাবিশ্ব সম্বন্ধে কথা বলি তখন তা এই অবেক্ষণীয় মহাবিশ্ব সম্পর্কে বলা হচ্ছে এটা বুঝে নিতে হবে।

সামগ্রিক ভর নিতে গিয়ে এক বিস্ময়কর আবিষ্কার, অনেক নীহারিকার গতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেলো দৃশ্যমান ভর অনুযায়ী তাদের গতি যেমন হওয়া উচিত তেমন নয়, যেন তার চেয়ে অনেক বেশী ভর উপস্থিত রয়েছে। আশ্চর্যের কথা হলো যে আমাদের বর্তমান মাপ নেবার কোনো যন্ত্রেই সে ভরকে ধরা যায়না, তাকে কৃষ্ণভর (dark matter) আখ্যা দেওয়া হলো। মাধ্যাকর্ষণ বিশ্লেষণ করে তার ওজনের একটা মাপও করা গেছে, মহাবিশ্বের সামগ্রিক ভরের প্রায় পঁচাশি শতাংশ এই কৃষ্ণভর (বাকি ১৫ শতাংশ দৃশ্যমান)। কৃষ্ণভর জিনিসটির প্রভাব বোঝা গেলেও তার আসল স্বরূপ কী, তা এখনো জানা যায়নি।

বিগব্যাঙের হিসেব বলে যে সৃষ্টির প্রায় তিনলক্ষ বছর পরে মহাবিশ্বের গড় তাপমাত্রা হবে তিনহাজার ডিগ্রি। এই তাপমাত্রায় মহাবিশ্বের অন্তর্গত বিকিরণের (radiation) শক্তি এতো প্রবল যে তার প্রভাবে চারদিকের মৌল পদার্থ (এক্ষেত্রে প্রায় সবই হাইড্রোজেন বললেই চলে) ভেঙে আবার প্রোটন-নিউট্রন-ইলেক্ট্রনের মৌলকণায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই মিশ্রণের নাম প্লাজমা, প্লাজমার একটি ধর্ম এই যে তা ভেদ করে আলোককণা (photon) বার হতে পারে না। অতএব আমরা এই বাধার পেছনে (অর্থাৎ কালের মাত্রায় হিসেব নিলে সৃষ্টির তিনলক্ষ বছরের কম সময়ের মধ্যে) কিছুই দেখতে পাবো না। যা দেখবো তা হবে ওই সময়ের পরেই মৌলকণা আবার গঠিত হয়ে যে আলো পুনর্বিকিরণ করেছে তারই ছবি। বিগব্যাঙের মতে সেই ছবি (কুতূহলীদের জন্য এই বিকিরণের নাম cosmic microwave background radiation, CMBR) আজকের দিনে আমাদের চতুর্দিক ঘিরে থাকবে। মহাবিশ্ব এর মধ্যে একশো গুণ বেড়েছে তাই তার তাপমাত্রা কমে গিয়ে দাঁড়াবে তিন ডিগ্রির কাছাকাছি আর মোটামুটি অভিন্ন (uniform)। এছাড়া সেই বিকিরণসমুদ্রে সামান্য যা উনিশবিশ দেখা যাবে তার মধ্যে আজকের দিনের নীহারিকাগুচ্ছের গঠন, সমাহার আর মহাবিশ্বের গঠনের যথার্থ সঠিক পূর্বাভাস থাকতে হবে।

এই CMBR নিয়ে অনেকদিন গবেষণা চলেছিলো। উনিশশো নব্বইয়ের দশকে Cosmic Background Explorer, COBE নামের কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহার করে CMBR সম্বন্ধে প্রামাণ্য তথ্য জোগাড় আর বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেন যে বিগব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে আসল CMBR-এর আশ্চর্য মিল পাওয়া যাচ্ছে। একটা বিশেষ তথ্যও জানা গেলো যে বর্তমান মহাবিশ্বের জ্যামিতি সমতল জ্যামিতির অবিশ্বাস্য রকম কাছাকাছি। এসব তথ্যের প্রকাশ পাওয়াতে বিগব্যাং তত্ত্বের ভিত্তি আরো দৃঢ় হলো বটে কিন্তু দুটি কঠিন প্রশ্ন উঠলো। প্রথম, মহাবিশ্বের জ্যামিতিতে সমতলতা এতো প্রকট হলো কী করে (flatness problem বলে খ্যাত) ? মনে রাখতে হবে যে সমতল হতে গেলে বক্রতার মান শূন্যের খুব কাছাকাছি থাকা দরকার, একটু হেরফের হলেই মহাবিশ্বের জ্যামিতি হয় মুক্ত নয় বদ্ধ হয়ে যাবে। এই মিলটা জন্মমুহূর্তের খুব কাছাকাছি সময় থেকেই হওয়া দরকার, সেই সময় একটু ফারাক থাকলে যতো সময় যাবে ততো ফারাক বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়টি হলো (horizon problem) সারা মহাবিশ্বের CMBR-তে তাপমাত্রার এরকম আশ্চর্য অভিন্নতা ( লক্ষে মাত্র কয়েক ভাগ) এলো কোথা থেকে? এই দ্বিতীয় সমস্যাটা আর একটু খোলসা করা যাক। আজ আমরা উত্তর দিকে তাকিয়ে প্রায় তেরোশো কোটি বছর আগের CMBR দেখছি, সেই বিকিরণ আলোকগতিতে আমাদের কাছে এসেছে। আবার দক্ষিণে তাকালে সেই একই ব্যাপার -- এবং কিমাশ্চর্যম্ এই দুই বিকিরণের তাপমাত্রার তফাৎ নেই বললেই চলে। এই যে দুজায়গার তাপমাত্রা আমরা দেখছি, এরা কিন্তু পরস্পরের থেকে ছাব্বিশশো কোটি আলোকবর্ষের তফাতে রয়েছে। এদিকে আইনস্টাইনের তত্ত্ব বলছে যে মহাবিশ্বে কোনো কিছু আলোকের চেয়ে দ্রুত যেতে পারেনা, মহাবিশ্বের বয়সই তো তেরোশো কোটি বছরের বেশী নয়, তার মানে তেরোশো কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো কিছুর খবরই কোনো কিছুর কাছে পৌঁছবে না। তাহলে ছাব্বিশশো কোটি আলোকবর্ষ দূরেরএই দুটো জায়গা পরস্পরের তাপমাত্রার খবর পেলো কী করে, যাতে তাদের মাত্রা এতো কাছাকাছি আসতে পারে? প্রসঙ্গত তথ্য, তত্ত্ব, নতুন তথ্য, নতুন প্রশ্ন, নতুন তত্ত্ব, ... বিজ্ঞানের বিবর্তন তো চলে এইভাবেই।

CMBR

চিত্র ১: মহাবিশ্বব্যাপী CMBR বিকিরণ-তাপের ছবি, রঙের তারতম্য দিয়ে তাপমাত্রার তারতম্য বোঝানো হয়েছে। মনে রাখতে হবে এই তারতম্যের মাত্রা হচ্ছে মাত্র +-.০০০৩ ডিগ্রী (কেলভিন)। অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চল থেকে নীহারিকাগুচ্ছের সৃষ্টি হয়েছে, অধুনা তারা যেমন বিন্যস্ত তার সঙ্গে সুন্দর মিল পাওয়া যায়।

প্রথমদিকে বিগব্যাং তত্ত্ব শুরু হয় এইভাবে: আজ মহাবিশ্বে যতো শক্তি ছড়ানো দেখি, অতীতে সব ছিল একত্রিত, কখনো কোনো এক ব্রাহ্মমুহূর্তে (যেটিকে singularity বলা হয়; এটি নিয়ে খুব গোলমাল কেননা কালের ঠিক এই ক্ষণটিতে আমাদের গণিত কাজ করে না) সেই শক্তিপুঞ্জে বিস্ফোরণ ঘটে আর তার ফলে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়ে স্ফীতি শুরু হয়। এখন বিস্ফোরণ দিয়ে যার শুরু তার মধ্যে সমতলতা আর তাপসাম্য আশা করাটা ঠিক নয়, কাজেই মহাবিশ্বের এই সৃষ্টিক্ষণ আর তার কাছাকাছি কিছু সময়ে কী ঘটছে, তা আরো খুঁটিয়ে দেখা দরকার। সেই চেষ্টা শুরু করে পদার্থবিদ্যার এক প্রচলিত সূত্রের খোঁজ পাওয়া গেলো যাতে বলে যে স্পেসের ধর্মই হলো কোনো স্পেসে কিছু শক্তি জমা হলে স্পেস সেই শক্তির ঘনত্ব (energy density) সবচেয়ে সম্ভাব্য কমের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। ঘনত্ব, density, কথাটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করি -- শক্তি নয়,শক্তির ঘনত্ব। স্পেসের সেই সর্বনিম্ন ঘনত্বের অবস্থাকে বলা হয় ট্রু ভ্যাকুয়াম ( true vacuum)। সাধারণত এই পরিবর্তন শ্লথগতি। কিন্তু কখনো কখনো ব্যাপারটা এমন দাঁড়াতে পারে যাতে কিছু সময়ের জন্য এই হ্রাসপ্রাপ্তি বন্ধ হয়ে গিয়ে শক্তির ঘনত্ব ট্রু ভ্যাকুয়ামের ওপরে একজায়গায় এসে আটকে যায় -- যেন সত্যই সবচেয়ে কম, কিন্তু আসলে তা নয়। তেমন অবস্থাকে বলে ফলস্ ভ্যাকুয়াম (false vacuum)।

এই তথ্য ব্যবহার করে আশির দশকে পদার্থবিদ অ্যালেন গুথ এক অভিনব সমাধান আবিষ্কার করেন, মহাজাগতিক স্ফীতিতত্ত্ব (cosmic inflation theory) নামে তা এখন প্রচলিত। তাতে গুথ দেখান যে যদি কোনো এক স্পেসে শক্তি উচ্চ মাত্রার ঘনত্ব (energy density) লাভ করে ফলস্ ভ্যাকুয়াম অবস্থায় পৌঁছোয় তাহলে অকস্মাৎ, অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেই স্পেস অপরিসীমভাবে স্ফীত হয়ে যেতে পারে। আপাতসদৃশ একটা উদাহরণ: একটা অত্যন্ত ঠাণ্ডা বিয়ারের বোতলের -- ছিপি আঁটার কারণে ভেতরের বিয়ার তরল অবস্থায় আছে -- ছিপি যদি হঠাৎ খুলে দেওয়া যায় তাহলে সমস্ত বিয়ার মুহূর্তের মধ্যে জমে বরফ হয়ে গিয়ে বোতল ভেঙে ফেলতে পারে। আশ্চর্যের কথা এই যে এই স্ফীতির কালে স্পেসের আয়তন বেড়ে গেলেও তার শক্তির ঘনত্বের, আবার বলি ঘনত্বের, পরিবর্তন হয় না, অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে এই স্ফীত স্পেসের ভিতরকার শক্তিও অপরিসীমভাবে বেড়ে যায়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো (বিশদ আলোচনা এই প্রবন্ধের পরিসরের বাইরে) যে এ কারণে শক্তিসংরক্ষণ (conservation of energy) নিয়ে যে ধ্রুবক প্রচলিত আছে তার কিন্তু কোনো ব্যত্যয় হয়না। এই তত্ত্বমতে স্ফীতির গুণ যদি হয় দশের পরে চব্বিশটি শূন্য (মনে রাখতে হবে স্ফীতির কোনো নির্ধারিত পরিসীমা নেই) তাহলে স্ফীতির আয়তনের গুণ হবে দশের পরে চুয়াত্তরটি শূন্য। আর একটা প্রোটনের থেকে দশ সহস্র কোটি (দশমিকের পর চব্বিশটি শূন্যের পর এক সেণ্টিমিটার) গুণ ছোটো স্পেসের মধ্যে স্ফীতি শুরু হলেই যতো শক্তি জমবে তা আজকের মহাবিশ্বে শক্তি আর ভরের যা উপাদান দেখা যায় তার জোগান দিতে পারবে। একসময় অবশ্য স্ফীতিপর্ব শেষ হয়ে যাবে, এই ফলস্ ভ্যাকুয়াম অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে স্পেস আবার প্রথা মতো আস্তে আস্তে শক্তির ঘনত্ব কমিয়ে ট্রু ভ্যাকুয়ামের দিকে যেতে থাকবে। স্ফীতির ফলে স্ফীত স্পেস যে বিশাল শক্তির আধার হলো,সেই শক্তি তখন রূপান্তরিত হয়ে ভর, বিকিরণ ইত্যাদি আটপৌরে শক্তি হয়ে প্রকাশ পাবে।

স্ফীতি শুরু হবার আগের স্পেস যদি এতোটা ছোটো হয় তাহলে সেখানকার সর্বত্র তাপমাত্রা পলকেই সমান -- গরম চা যেমন করে জুড়িয়ে যায়। আর, একবার তাপমাত্রা সমান হয়ে গেলে স্ফীতির পরেও তা সমানই থাকবে। স্ফীতিতত্ত্বের প্রয়োগে তাহলে horizon problem-এর মীমাংসা হলো। সমতলতার সমস্যারও সমাধান সম্ভব কেননা মহাবিশ্ব যতো স্ফীত হতে থাকবে তার পৃষ্ঠতলের (surface) বক্রতাও ততো কমে গিয়ে চ্যাপটা হয়ে যাবে-- অনেকটা যেমন একটা ফোলানো বেলুনের মতো, বা পৃথিবী গোলাকার হলেও পৃথিবীপৃষ্ঠ যেমন সমতল মনে হয়। এই সত্যটির একটা সুন্দর গাণিতিক প্রমাণও আছে তবে তা জটিল। স্ফীতিতত্ত্ব ব্যবহার করে তাহলে যুগপৎ horizon problem আর flatness problem-এর মীমাংসা করা গেলো, পরীক্ষিত তথ্যের সঙ্গে তার মিলও লক্ষ্যণীয়। আজ অবধি এর থেকে ভালো তত্ত্বের দেখা পাওয়া যায়নি। বিগব্যাং তত্ত্বকে বিস্তৃত করে এই cosmic inflation তত্ত্বই আজকের বিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছেন।

ত্রিশের দশকে মোটামুটি অকস্মাৎই আবিষ্কার হয় যে পদার্থবিদ্যামতে কণিকার (particle) যে যে ধরণ হয়, তার প্রতি ধরণের জোড়া হিসেবে সেই কণিকার প্রতিকণিকারও একটি করে ধরণ পাওয়া যায় । যে কোনো কণিকা আর তার জোড়া ধরণের প্রতিকণিকা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী, যথা ইলেক্ট্রন (ঋণাত্মক চার্জ) আর পজিট্রন (ধনাত্মক চার্জ)। পরস্পরের সঙ্ঘাত হলেই তারা ধ্বংস হয়ে যায়, রেখে যায় নিছক বিকিরণ শক্তি। এর পরে কোয়াণ্টাম তত্ত্ব (quantum theory) মারফৎ জানা যায় যে আমরা যাকে শূন্য স্পেস বলে জানি, অর্থাৎ যেখানে দৃশ্যমান ভর বা বিকিরণ কিছুই নেই, সেখানে খুব অল্প সময়ের জন্য অকস্মাৎ এক জোড়া কণিকা-প্রতিকণিকা আবির্ভূত হয়ে আবার শক্তিতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। কোয়াণ্টাম তত্ত্বই আবার বলছে যে এরা আমাদের দৃষ্টিগোচর হবে না, এ কারণে তাদের অলীক কণিকা (virtual particles) বলা হয়। কিন্তু তারা যে আছে তা নিয়ে সন্দেহ করার উপায় নেই কেননা ঠিকঠাক পরীক্ষা চালাতে পারলে আশেপাশের প্রকৃত কণিকার ওপর তাদের উপস্থিতির প্রভাব হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়। তাদের জীবিতকাল খুব স্বল্প হওয়াটা বিশেষ দরকার, আর মজা এই যে এই সময় যতো কম হবে, অলীক কণিকা জোড়ের শক্তিও ততো বেশী হবে। এই যে শূন্য থেকে অলীক জোড়ের সৃষ্টি হয়ে আবার মিলিয়ে যাওয়া, এর সমস্ত ব্যাপারটাকে কোয়াণ্টাম দোলাচল (quantum fluctuation) বলা হয়।

স্ফীতিতত্ত্বের সঙ্গে যদি কোয়াণ্টাম দোলাচল মেলানো যায় তাহলে এইমতো একটা ছবি দাঁড়ায়: দোলাচলের ফলে শূন্য স্পেসে কোথাও খুব ছোটো জায়গায় খুব অল্প সময়ের জন্য একজোড়া অলীক কণা-প্রতিকণার জন্ম হলো, তারপর ধ্বংসও হলো। স্বল্প আয়তনের ফলে সেখানকার শক্তির ঘনত্ব হলো বেশী, ফলস্ ভ্যাকুয়াম হবার জমি তৈরী, তারপর কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো মুহূর্তে ফলস্ ভ্যাকুয়াম হয়ে গেলো। ফলে ছোটো সেই স্পেস স্ফীত হয়ে অভাবনীয় শক্তি সঞ্চারিত হলো -- আগে যেমনটি বলা হয়েছে। কিছু সময় পরে সৃষ্টিছাড়া স্ফীতি থেমে গিয়ে বিশাল সেই শক্তিপুঞ্জ থেকে তাপসাম্য রক্ষা করে সমতল একটা মহাবিশ্ব বিবর্তিত হতে থাকলো। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সৃষ্টি হলো আমরা যাকে বস্তু বলি -- ভর বা বিকিরণ -- তার থেকে নয়, একেবারে শূন্য স্পেস থেকে।

স্ফীতিপর্বের আর একটু গভীরে প্রবেশ করলে আমরা দেখতে পাই যে ফলস্ ভ্যাকুয়ামের প্রভাবে ছোটো স্পেস ঘাত-অনুসারী মাত্রায় (exponentially) বেড়ে যাচ্ছে। একসময় সেই স্ফীত হতে থাকা স্পেসের মধ্যেকার কোনো ছোটো অঞ্চলে ফলস্ ভ্যাকুয়াম থেমে গিয়ে সেখানে এই দুর্জয় স্ফীতি বন্ধ হয়ে গেলো আর (হয়তো আবার কোয়াণ্টাম দোলাচলেরই কারণে) সাধারণ হারে স্ফীতি শুরু হলো। সে অঞ্চলের চতুর্দিকের স্পেস কিন্তু তখনো বিপুল গতিতে বাড়ছে। সেই বর্ধমান স্পেসে আবার আরেকটা অঞ্চলে স্ফীতি হ্রাস পেলো, আরেকটায়, আরেকটায় , ... -- এমনি চলতেই পারে। তার যে কোনো দুটি অঞ্চলের মধ্যে স্পেসের ফারাক হবে অপরিমেয়, পরস্পরের মধ্যে কোনো সংযোগ রাখা চলবে না। এ যেন অনেকটা ফুটন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্গত লাভাস্রোতের মতো, কিছু কিছু জায়গায় লাভা ঠাণ্ডা হয়ে পাথর হয়ে জমে যাচ্ছে আর সেই পাথর সব দ্বীপ হয়ে স্রোতের ভেতর ছড়িয়ে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পদার্থবিদ আন্দ্রেই লিন্ড এই ব্যাপারে একজন অগ্রণী গবেষক, তিনি দেখিয়েছেন যে এই স্ফীতির মধ্যে শক্তির ঘনত্ব আবার সবসময় না কমে কোথাও কোথাও বেড়েও যেতে পারে, অর্থাৎ আস্তে আস্তে অনেক স্ফীতিরহিত দ্বীপ (ভবিষ্যৎ মহাবিশ্ব) তৈরী হতে থাকলেও পুরো স্ফীতি (লাভাস্রোত) এবং মহাবিশ্ব (আগ্নেয় পাথর) সৃষ্টির ব্যাপারটা অনন্তকাল ধরে চলতে পারে। এসব দ্বীপ-বিশ্বের মধ্যে কোনো যোগাযোগ সম্ভব হবে না কখনো, কিন্তু তাছাড়াও এদের প্রতিটির শুরুতে কী অবস্থা আর কী ঘনত্ব ছিলো তারও কোনো সঙ্গতি থাকবে না। এই অসঙ্গতির ফলে পদার্থবিদ্যার যেসব নিয়মকানুন এসব বিশ্বের প্রতিটিতে কার্যকরী হবে, সেসব নিয়মেও অসঙ্গতি থাকতে বাধ্য। লিন্ড এর নাম দিয়েছেন গোলমালের স্ফীতি (chaotic inflation), আর তার ফলে এই যে অনন্তসংখ্যক বিশ্বের জন্ম হলো, সামগ্রিকভাবে তাদের বলা হয় মাল্টিভার্স (multiverse)।

মনে করিয়ে দিই যে যখনই আমরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সৃষ্টিতত্ত্বের শুরুতে পৌঁছে গেছি বলে মনে করি, তখনই প্রশ্ন ওঠে, "তার আগে কী ছিলো?"। ধর্ম এই চক্রের নিষ্পত্তি করেন এক অনন্ত অপার ঈশ্বরকে স্রষ্টা হিসেবে মঞ্চে নামিয়ে। এখন মাল্টিভার্সের এই কাহিনীতে বলা হচ্ছে যে স্রষ্টার বদলে যদি সৃষ্টিই অনন্ত অপার হয় তাহলে তো আর স্রষ্টার প্রয়োজন থাকে না। তার সঙ্গে আর একটি সিদ্ধান্ত ফাউ পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো যে আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করি তার ভৌত স্বতঃসিদ্ধসমূহের (physical laws) মধ্যে আহামরি এমন কিছু নেই যার জন্য এক সূক্ষ্ম কারিগর স্রষ্টাকে ডেকে আনতে হবে। মহাবিশ্বের সংখ্যা যদি অনন্ত হয় তাহলে তার মধ্যে অন্তত একটি মহাবিশ্ব ঠিক এইরকমই হতে হবে, আর কিমাশ্চর্যম্, আমরা সেখানেই বাস করছি। প্রসঙ্গত এই একবারে ঠিকঠাক আমাদের মাপে গড়া আমাদের মহাবিশ্বের ভাবনাটি মানবীয় তত্ত্ব (anthropic principle) বলে খ্যাত।

ফলস্ ভ্যাকুয়ামে আটকে যাবার ফলে কেয়টিক ইনফ্লেশন বিশ্লেষণের পর বিজ্ঞানীরা ফলস্ ভ্যাকুয়ামে পৌঁছবার আগে কী হলো, সেইদিকে নজর ফেরালেন। এইবার একটা বিরাট বাধার সম্মুখীন হতে হলো। মনে রাখতে হবে তখন মহাবিশ্বের আয়তন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, বয়স পলমাত্র, শক্তির ঘনত্ব অভাবনীয়। কোয়াণ্টাম তত্ত্ব, যা বস্তুর ওপর প্রযোজ্য আর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ যা স্পেসকে জড়িয়ে, -- এর আগে এই দুটিকে একসঙ্গেই প্রয়োগ করা হচ্ছিল, কিন্তু এবার দেখা গেলো যে স্থানকালের এসব নিগড়ের মধ্যে পড়ে আপেক্ষিকতার গণিত আর ঠিকমতো কাজ করে না (এটা একটা মত মাত্র ; মোদ্দা কথা দুই তত্ত্বে বিরোধ দেখা যায়)। অর্থাৎ প্রয়োজন এমন একটি মহাকর্ষ তত্ত্বের যা কোয়াণ্টাম স্তরেও কাজ করে। সেই তত্ত্বের নাম দেওয়া হলো কোয়াণ্টাম গ্র্যাভিটি। তত্ত্বটি খুবই জটিল হবে আশা করা যায় কিন্তু আমাদের নিরাশ করে আজও তার পুরোপুরি সমাধান করা যায়নি, যদিও কিছু সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তে উপস্থিত হওয়া গেছে।

তার একটি বিখ্যাত বিশ্বতত্ত্ববিদ (cosmologist) স্টিভেন হকিং-এর গবেষণাভিত্তিক, সেখানে তিনি বলছেন যে কোয়াণ্টাম গ্র্যাভিটি প্রয়োগ করলে আমরা দেখবো যে সম্পূর্ণ শূন্য (যেখানে কোনো বস্তু তো নেই বটেই, এমনকি স্পেসটাইমও নেই) থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে অকস্মাৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্পেসটাইমের (অলীক কণিকার বদলে স্পেসটাইম -- এবার অলীক নয়) আবির্ভাব ঘটতে পারে। সেসব স্পেসটাইমে ভর বা বিকিরণ, দুইই থাকতে পারে, যতোক্ষণ তার মোট শক্তির পরিমাণ (মাধ্যাকর্ষণের ঋণাত্মক শক্তিকেও ধরে) শূন্য। তাদের আয়ুষ্কাল স্বল্পাতিস্বল্প সময়, যদি না স্ফীতি শুরু হয়ে যায়, এবং সেক্ষেত্রে তা বিবর্তিত হয়ে একসময় সমতল মহাবিশ্বের রূপ নিয়ে নেয়। এই মত অনুসরণ করে আমরা সৃষ্টির গোড়াতে স্পেসটাইমের উপস্থিতিটাও নস্যাৎ করে দিতে পারি।

CMBR

চিত্র ২: কসমিক ইন্ফ্লেশন মতানুসারে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিবর্তন [মাত্রা স্কেল-মাফিক নয়]

তাহলে কোয়াণ্টাম দোলাচল আর স্ফীতিতত্ত্ব মিলিয়ে আমরা যে ছবিটি পাচ্ছি তাতে বস্তুহীন শূন্য থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঙ্গে কেয়টিক ইনফ্লেশন যোগ দিলে পাওয়া যায় মাল্টিভার্স, যেখানে সৃষ্টিই অনন্ত অপার, সেখানে অনন্ত অপার স্রষ্টার অনুপ্রবেশ অপ্রয়োজনীয়। আর তৃতীয় ধাপে কোয়াণ্টাম গ্র্যাভিটির তত্ত্ব যোগ দিলে শুধু বস্তুহীন নয়, এমনকি স্পেসটাইমের অস্তিত্ববর্জিত শূন্য থেকেও আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্ট হতে পারে। মনে রাখতে হবে এসব তত্ত্ব ও তথ্য বিজ্ঞানসম্মত অর্থাৎ যুক্তি-প্রতিযুক্তি-পরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই করা। এবং সব বৈজ্ঞানিক সত্যের মতোই এদের পরীক্ষার শেষ নেই, প্রতি পরীক্ষায় হেরে বা জিতে, যে ভাবেই হোক এরা বিবর্তিত হবে, নতুন তত্ত্ব আর তথ্যের জন্ম দেবে আর তার মাধ্যমে আমরা সত্যের আরো কাছে পৌঁছবো।

নাস্তির থেকে অস্তি! একবিংশ শতাব্দীর জাগরণবাণী।

------------------------------------------------

উৎস :

(১) Lawrence M. Krauss, "A Universe from Nothing", Free Press, 2012

(২) A. Guth, "Was Cosmic Inflation the Bang of Big Bang?", The Beamline vol 27 no 14, 1997

(৩) Nick Borstrom, "Is There a God?", Yale, http://www.anthropic-principle.com/preprints/god/god.html



লেখক পরিচিতি - সুমিত রায় - পাঁচ দশক হোলো আমেরিকাবাসী। চাকরীজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী, নিউ জার্সিতে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ও তিনটি সফল রবীন্দ্রমেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গীতবিতান.নেট রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। "অবসরের" সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.