কৃত্রিম বুদ্ধি - বাস্তব না কল্পনা, আশীর্বাদ না অভিশাপ
উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
ষাট দশকের কথা, তখন আমি স্কুলে পড়ি। একটি ছায়াছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। যদিও সিনেমার শেষটা, যাকে বলে, মাথার উপর দিয়ে গিয়েছিল, তবু মুগ্ধ হয়েছিলাম রোবট HAL কে দেখে। একটি মহাকাশ যানকে সে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মহাকাশচারীরা সেই যানে চলেছিল শুধুমাত্র যাত্রী হয়ে। ছবিটির নাম ছিল “2001: A Space Odyssey”। তার পরে যা হয়ে থাকে - রোবট আর মানুষের যুদ্ধ। তখন ভেবেছিলাম ২০০১ সালে এরকম হতেই পারে। [HAL এর নামের পেছনে কিন্তু একটা গল্প আছে]
কিন্তু ২০০১ এলো গেল, আর অনেক বছর চলে গেল, কই সেরকম তো কিছু দেখছি না? তবে কি এ শুধু কল্পনাতেই রয়ে যাবে? যদিও HALএর মত রোবট যে সব কিছু করতে পারে দেখা যায় না, কিন্তু এটা তো আমাদের মানতেই হবে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে machine learning আর artificial intelligence নিয়ে কম্পিউটার অনেক কিছু করছে যা কিছু দিন আগে ভাবাই যেত না। যদিও আমরা HAL-এর মত রোবট দেখতে পাই না, তবু একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলে কিন্তু অনেক কিছু চোখে পড়ে যা কিছুদিন আগে ছিল কল্পনার বাইরে। কিছু জিনিস তো মনে হয় যেন ম্যাজিক।
যেমন ধরুন আপনি যখন Google এ সার্চ করছেন, তখন কি আপনার কখনো মনে হয়েছে যে Google আপনার মনের কথা বুঝতে পারছে? আমার তো মাঝে মাঝেই মনে হয়। আবার এও ঠিক যে এতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে ঠিক suggestion না পেলে মনে হয়, এটাও বুঝতে পারছে না!
অভ্যাসের কথায় বলি, ছবি তোলার সময় ক্যামেরা যে মানুষের মুখ ঠিক ঠিক বুঝে নিতে পারে দেখেও আমার একটুও আশ্চর্য হই না। Facebook যখন আমাদের আত্মীয়, বন্ধুদের ঠিক ঠিক চিনতে পারে, তখনও আমরা একটুও অবাক হই কি?
স্বচালিত গাড়ি নিয়ে যে কাজ হচ্ছে তাও ফেলনা নয়। Google নাকি তিরিশ লক্ষ কিলোমিটার চালিয়ে ফেলেছে এরকম গাড়ি বিনা-দুর্ঘটনায়।
যদিও এগুলো সিনেমার HAL রোবটের মত সর্বগুন সম্পন্ন নয়, কিন্তু এরা নিজের কাজটা খুব ভালোভাবেই করে, এবং অনেক সময় মানুষের চেয়ে বেশি ভালো করে।
কিন্তু এটাও তো মানতে হবে যে এগুলো তো শুধুই প্রোগ্রাম। যা বলা হবে শুধু সেইটুকুই এরা করতে পারবে।
মজা হল যে এই সব প্রোগ্রাম গুলিকে সব কিছু বলে দিতে হয় না। এটা Artificial intelligence আর Machine Learning এর গবেষণায় যে উন্নতি হয়েছে তার ফল।
তবে এইগুলো কাজ করে কী করে?
বাংলায় একটা কথা আছে - দেখে শেখা - এই প্রোগ্রামগুলো করে ঠিক তাই। এদের অনেক অনেক তথ্য দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয়, তার থেকে ওরা নিজেদেরই শিখে নেয়। একে বলা হয় - Supervised Learning। কিছু কিছু প্রোগ্রামকে আবার শিখিয়েও দিতে হয় না। তথ্য থেকে তারা নিজেরাই শিখে নেয়। সেটা হল, ঠিক ধরেছেন - Unsupervised Learning।
এই প্রোগ্রাম গুলি যত বেশী তথ্য পাবে এবং যত বেশী শক্তিশালী কম্পিউটারে চলবে এরা হয়ে উঠবে তত বেশী বুদ্ধিমান। গুরু মারা বিদ্যে শেখার মত -- এরা অনায়াসে টপকে যায় বিশেষজ্ঞদের।
দাবা খেলাই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। একসময় মনে করা হত যে দাবার বিশ্ববিজেতাকে কম্পিউটার কখনোই হারাতে পারবে না। কিন্তু, ২০০৬ এর পর কম্পিউটার এতই শক্তিশালী হয়ে গেছে যে দাবার বিশ্ববিজেতাকে সে বলে বলে হারিয়ে দিতে পারে।
আপনি হয়ত বলবেন যে দাবা তো শুধু একটা খেলা যেখানে নিয়ম কানুন সব পরিষ্কার ভাবে জানা। সত্যিকারের জীবনে অত পরিষ্কার নিয়ম নেই।
একটু খুঁটিয়ে দেখলে আমার দেখতে পাই যে সব কাজের মধ্যেই অনেকটা অংশ কিন্তু থাকে যা নিয়মে ফেলা যায়। আর একবার নিয়মে ফেলতে পারলে তো হয়েই গেল। এই জন্যই Machine Learning প্রোগ্রাম অনেক কিছুতেই বিশেষজ্ঞদের সমান সমান হয়ে উঠেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো বিশেষজ্ঞদেরও ছাড়িয়ে গেছে। দাবার কথা তো আগেই বলেছি। আর কয়েকটা উদাহরণ বলি:
এই প্রোগ্রাম গুলো হয়ত মানুষের মতন করে চিন্তা ভাবনা করে না কিন্তু যে কাজের ভার এদের দেওয়া হয়েছে তা এরা খুব ভালো ভাবেই করতে পারে। যত দিন যাবে, যত Machine Learning নিয়ে গবেষণা হবে, ততই আমরা দেখতে পাব আরও অনেক এই ধরনের উদাহরণ।
কিছু বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে সেই চাকরিগুলোই থাকবে যা কোন বাঁধা-ধরা নিয়মের মধ্যে ফেলা যায় না। যার কিছু হবে বিশেষজ্ঞর চাকরি যেটা কম্পিউটার করতে পারবে না এবং যাতে মাইনে হবে অনেক। আর কিছু চাকরি থাকবে যাতে মাইনে এত কম যে কম্পিউটারকে দিয়ে করানোর চেষ্টা লাভজনক হবে না। মাঝের সব মধ্যবিত্তর চাকরি আর থাকবে না।
আমাদের দেশে এই সমস্যাটা এখনও ততটা প্রকট হয়নি। কিন্তু পশ্চিমের দেশে, গত কয়েক দশকে, মধ্যবিত্ত পরিবারের যে কোনও রকম আর্থিক উন্নতি হয়নি, তার অনেক প্রমাণ আছে। সেই একই সঙ্গে যে সমাজের একদম ওপরে যারা আছেন অর্থনৈতিক অবস্থার প্রচুর উন্নতি হয়েছে। যাদের চাকরি চলে যাচ্ছে তারা বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। এর ফলে সমাজে অসমতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদরা অবশ্য মনে করেন যে এই সমস্যাটা কোনও সমস্যাই নয়। এরকম তো আমরা অনেকবার দেখেছি অতীতে। যখনই কোন নতুন প্রযুক্তি এসেছে, তখনই আমরা দেখেছি যে কিছু মানুষের চাকরি গেছে কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়েছে। যখন আমরা কৃষি সমাজ থেকে শিল্পায়িত সমাজ ব্যবস্থায় প্রবেশ করি তখনও এইরকম সমস্যা দেখা গিয়েছিল। প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সংগে সংগে আমার এই ব্যাপারটা অনেকবার দেখেছি। চাকরি যেরকম চলে যাচ্ছে, সেরকম নতুন চাকরিও হচ্ছে।
তবে সেই “উল্ফ”, “উল্ফ” গল্পের মত এবারও যে সত্যি “উল্ফ” আসবে না, তা কি আমরা সত্যিই খুব জোর দিয়ে বলতে পারি?
আর তা যদি হয়ও তাহলে তো আমাদের ভালোই হবে। কম্পিউটার সব কাজ করবে আর আমার পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকব। তাই না?
সেরকম যদি সত্যিই হয় তবে তো খুবই ভালো হয় কিন্তু দুটি সমস্যা তো থেকেই যায়।
প্রথম হল, সুকুমার রায়ের ভাষা একটু বদলে বলি, কাজের আমি - কাজের তুমি - কাজ দিয়ে যায় চেনা। যারা কোন কাজ না করে শুধু বসে বসে খায় তাদের আমরা নিষ্কর্মা, বাউণ্ডুলে, অলস এইরকম সব নামে ডেকে থাকি।
দ্বিতীয় সমস্যা হল,যে আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমন যাতে কাজ না করে অর্থ উপার্জন করার কোনও উপায় নেই। কম্পিউটারের কল্যাণে কাজ যাদের থাকবে না তাদের উপার্জনও থাকবে না। আর এখন আমাদের সমাজে বিনা উপার্জনে তো কোন কিছুই করা সম্ভব নয়।
তাই কাজ না করে সব কিছু পেয়ে যাওয়া শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু আমাদের সমাজ কি সেটা মেনে নিতে পারবে? নাকি আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে?
আপনি হয়তো বলবেন কাজের অভাব কোথায়? আমাদের দেশের গ্রামের উন্নতি করতে যা কাজ করা দরকার সেই করতেই আমাদের সারা জীবন লেগে যাবে। তারপর বিজ্ঞানের জ্ঞান যতই আমার অর্জন করছি ততই আমাদের না জানার পরিধি বেড়ে যাচ্ছে। কোথায় কাজের অভাব?
কাজের অভাব হয়ত থাকবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই সব কাজ করাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করলে যথেষ্ট উপার্জন করা কি সম্ভব হবে? ব্যবসায়ীরা এইসব কাজে টাকা ঢালবেন? এতে মুনাফা কোথায়? শেষে কি সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে?
এখনকার অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে অর্থনৈতিক ব্যাপারে সরকারের একদম নাক গলান উচিত না। “Market Economy” হচ্ছে শেষ কথা। তাঁদের তিনটি মূল মন্ত্র হলও, "demand vs supply determines price", "return on investment guides all investment decisions" আর "productivity determines wages"।
আমরা এই নিয়ম মেনেই চলছি। সব ব্যবসায়ীরাই চেষ্টা করছেন কী করে কম লোকবল লাগিয়ে বেশি মুনাফা কামানো যায়। যে কাজটা না করলেই নয় শুধু সেইটুকু রেখে বাকি সব কিছু বাদ দিয়ে দিলেই ত হয়। একবার কাজটা automate করতে পারলে আর চিন্তা নেই। প্রথমেই যা খরচা। তারপরে যত উৎপাদন বাড়বে তত খরচ কমবে। যত কম লোক থাকবে ততই মুনাফা!
এর ফল কী দাঁড়াবে? সবকিছুরই দাম কমবে। বেশিরভাগ জিনিস অপর্যাপ্ত পরিণামে পাওয়া যাবে। কিন্তু অনেক জনেরই চাকরি থাকবে না … আয় থাকবে না … জিনিস কেনবার জন্যে টাকা থাকবে না।
না: … এরকম একটা অদ্ভুত ব্যাপার হওয়া কি সম্ভব?
কিন্তু, আমাদের প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে এ ছাড়া আর উপায় কি? তবে কি আমাদের এই গণ্ডির থেকে বেরিয়ে আসতে হবে? অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর সমাজ ব্যবস্থাকে কি আমাদের একটু অন্যরকম করে ভাবতে হবে?
প্রথমে ধরুন, যেখানে “supply” অফুরন্ত সেখানে তো দাম কি "demand vs supply” ভিত্তিক হওয়া সম্ভব? কৃত্রিম ভাবে দাম স্থির করা ছাড়া তো উপায় নেই। না হলে তো বিনা মূল্যে জিনিস দিতে হয়।
আপনি ভাবছেন বিনামূল্যে কিছু পাওয়া কি সম্ভব?
অনেক সমই চোখের সামনে যে জিনিস থাকে তা আমরা দেখতে পাই না। আপনি WhatsApp ব্যবহার করেন? Facebook? Gmail? Youtube? Twitter? LinkedIn? দিনে কত সময় দেন এর পেছনে? দু ঘণ্টা? এক ঘণ্টা? তার জন্য টাকা লাগে কি?
এই বিনা মূল্যে দেওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
সেই যে কথা আছে না - “ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরনো”, এও অনেকটা তাই। সেই যে উটের গল্প আছে - রাত্তিরে শোবার সময় উট বেদুইনকে, আমার বাইরে শীত করছে, আমাকে নাকটা তাম্বুতে ঢোকাতে দেবে। তার পরে উট একটু একটু করে মুখ, গলা, শরীর তাঁবুর মধ্যে ঢুকিয়ে নিলো আর বেদুইনকে হয়ে গেল তাঁবুর বাইরে।
যেখানে একজন নতুন গ্রাহক প্রায় বিনামূল্যে সংগ্রহ করা যায়, তখন সেই গ্রাহকের থেকে টাকা না নিলেই বা কী ক্ষতি? নতুন গ্রাহকদের দৈনন্দিন জীবন ধারার মধ্যে একবার ঢুকে পড়তে পারলে আর কোন কথা নেই, সেই বিনা মূল্যে সংগ্রহ করা গ্রাহকেরই টাকা দিয়ে আর অনেক কিছু কিনবে। সবাই না কিনলেও ক্ষতি নেই, যারা কিনবে তাদের থেকেই পুরো ব্যাবসাটাই লাভজনক হয়ে যাবে। প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে গ্রাহক ভাঙ্গিয়ে আনার এটা যেমন একটা উপায়, তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে গ্রাহক ধরে রাখারও উপায় এটাই। তা ছাড়া, যত গ্রাহক তত বিজ্ঞাপনের টাকা, তত কোম্পানির দাম বাড়ে।
এর থেকেই Freemium বলে একটা চালু হয়েছে। এর মানে হল বেশিরভাগ গ্রাহকদের basic service বিনামূল্যে দিয়ে premium গ্রাহকদের full service দিয়ে টাকা নেওয়া এবং সেই টাকায় পুর ব্যাবসা চালানো।
সব সফল ব্যবসায়ীরাই বোঝেন যে premium গ্রাহকদের থেকে লাভের অংশটা আসে বেশি। তাই এই ধরনের গ্রাহকদের জন্য কিছু premium সেবা রাখতে হয়। এখন কিন্তু long tail বলে একটা কথা চালু হয়েছে। ইন্টারনেটের আর কম্পিউটারের কল্যাণে এখন প্রায় বিনা খরচে লক্ষ লক্ষ গ্রাহক পাওয়া সম্ভব। সেরকম একজন গ্রাহকের থেকে লাভ হয়ত কিছুই হয় না, কিন্তু এই বিশাল গ্রাহক সংখ্যা কিন্তু ফেলনার নয়। এদের খাতিরেই এখন অনেক ব্যাবসা চলছে।
এ ছাড়া আর একটা কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। আমরা কিন্তু অনেক সময়েই বিনা মূল্যে অন্যকে সাহায্য করি। করি আমাদের ভাল লাগে বলে। করি, কারণ আমরা সব কিছুতে কতটা লাভ হল তা বিচার করি না বলে।
২০০১ সালে এই রকমই এক উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল Wikipedia। পৃথিবীর সবথেকে বড় বিশ্বকোষ যা গত ষোল বছরে তিন কোটি সম্পাদকের চেষ্টায়। সেই তিন কোটি সম্পাদক যারা কাজ করেছেন একদম বিনা মাসুলে। কেন করেছেন তারা? করেছেন কারণ তারা মনে করেন -
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উত্সমুখ হতে উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায় অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়,
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি...
এরকম করার যে আনন্দ আছে তার থেকেই সৃষ্টি হয়েছে “Linux”এর মতো operating system এবং অনেক “Open Source” সফটওয়্যার। এই ইচ্ছাটাই “Open Source” আর “Creative Commons” আন্দোলনের মূল মন্ত্র।
কিন্তু সব কিছু এরকম বিনামূল্যে দেওয়া সম্ভব কি?
বিশ্বকাপ ফাইনাল কি সবাই মাঠে গিয়ে দেখতে পারে? টিকেটের সংখ্যা তো সীমিত। কিন্তু তা’বলে টিভিতে দেখতে কারুরই কোন বাধা নেই এবং ক’জন দেখতে পাবে তার কোন সীমা নেই। আর টিভির একজন দর্শক বাড়ান যায় প্রায় বিনামূল্যে। এখানেই শুরু হচ্ছে “Virtual Reality”র খেলা।
এখন আমরা virtual realityর কল্যাণে পঞ্চেন্দ্রিয়র মধ্যে দুই ইন্দ্রিয় - চক্ষুন্দ্রিয় আর শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে আমরা virtual ভোগ করতে পারি। শুধু টিভির পর্দায় নই, virtual realityর যন্ত্র চোখে পরে, virtual realityর যন্ত্র হাতে লাগিয়ে, virtual জগতের মধ্যে হেঁটে চলে বেড়াতে পারি। ভবিষ্যতে হয়ত বাকি তিন ইন্দ্রিয় - ঘ্রাণেন্দ্রিয়, রসনেন্দ্রিয় আর স্পর্শেন্দ্রিয় এর virtual বিকল্প বেরিয়ে যাবে।
এ তো গেল "demand vs supply”এর কথা। এর পরে আসা যাক অর্থনীতির দ্বিতীয় মূল মন্ত্র “return on investment (ROI)” এর কথায়। আমাদের দেখতে হবে যে সব বিনিয়োগই কি আমরা ROI ভিত্তিক করি?
এমনও তো দেখতে পাই যে সফলতার চুড়ায় এসে অনেকেই মানব জাতির কল্যাণের জন্যে কিছু করতে চান। Bill Gateএর মত সব কিছু ছেড়ে দেওয়ার উদাহরণ হয়ত কম আছে, কিন্তু philanthropy কমের চেয়ে বেশির দিকেই বেশি। Corporate Social Responsibility তে টাকা ঢালা যে শুধু সরকারের চাপে পড়ে নয়, তার উদাহরণ অনেক দেখতে পাই। কোনও ত্রাণ কার্যে অর্থ ঠিকই চলে আসে।
তার পরে ধরুন “Venture capital”এর কথা। এই পুঁজি বিনিয়োগ করা হয় নতুন কিছু করার জন্য, এমন কিছু যা সব কিছু বদলে দেবার সম্ভাবনা রাখে। এই পুঁজি বিনিয়োগে দেখা হয় না যে কতটা লাভ হবে। দেখা হয় যে চিন্তাটি কতটা যুগান্তকারী। পুরো ব্যাপারটা আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া আর কি। একশোটার মধ্যে নিরানব্বইটা ব্যর্থ হলেও কোন অসুবিধা নেই - একটা যদি লেগে যায় তবেই কেল্লা ফতে। নতুন উদ্ভাবনের যুদ্ধে ভাগ নেয় অনেকই, কিন্তু জয়ী হয় একজনই। যে জয়ী তার জয় বিশাল। আপনি একটু এদিক ওদিক তাকালেই জয়ীদের নাম চোখে পড়বে - Google, Facebook, Apple ইত্যাদি। এদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় কি? আর এদের লাভের পরিমাণের কথা আর কি বলবো।
“Venture capitalist”রা কি লাভ-ক্ষতির কথা ভাবেন? তাঁরা ভাবেন যে ঢিলটা লাগবে সেটা কি পরশপাথর?
এর মধ্যে এক ধরনের বিনিয়োগ থাকে যাকে বলা হয় “moonshot project” যেখানে সফলতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, কিন্তু সফল যদি হয় তাহলে দেবে পৃথিবীর চেহারা পালটে। এইরকম প্রকল্পতে ROI ভিত্তিক সিদ্ধান্ত কোন ভাবেই নেওয়া চলে না।
তবেই দেখুন, অর্থনীতিবিদদের প্রথম দুটি মূল মন্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই আর খাটছে না। এবার তাহলে তৃতীয় মন্ত্রটাও আমরা ছেড়ে দিতে পারব না কেন? সব মাইনের বেলায় শুধু “productivity”র কথা ভাবতে হবে কেন? যেমন ধরুন Tim Leberecht তাঁর TED Talk এ তাজমহল বানানোর স্বপ্ন দেখতে বলেছেন। তিনি বলেছেন অদরকারি কাজ করারও দরকার আছে। আর অদরকারি কাজের ত কোন শেষ নেই।
“...To maintain our humanity in the this second Machine Age, we may have no other choice than to create beauty. Beauty is an elusive concept. For the writer Stendhal it was the promise of happiness. For me it's a goal by Lionel Messi…”
বেশির ভাগ জিনিস অপর্যাপ্ত পরিণামে পাওয়া যাবে, কিন্তু অনেক জনেরই চাকরি থাকবে না … আয় থাকবে না … জিনিস কেনবার জন্যে টাকা থাকবে না। তখন কি হবে? চাকরি না থাকলে লোকে উপার্জন করবে কি করে?
একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়ীদেরও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
গণতন্ত্রে যদি দেখা যায় যে বেশিরভাগ মানুষের চাকরি নেই, তাহলে কি সরকার নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকতে পারবে? আপনি হয়ত বলবেন যে সরকার সবসময় সবদেশে পুঁজিপতিদের সুবিধাটাই শুধু দেখে, সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে না। কিন্তু ভোট তো দেয় সাধারণ মানুষই, তাদের তো পুরোপুরি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। পুঁজিপতিরাও কিন্তু চাইবেন না যে সাধারণ মানুষ বেকার হয়ে থাকুক। সাধারণ মানুষের হাতে টাকা না থাকলে তাদের ব্যাবসা চলবে কি করে?
যাদের চাকরি নেই তাঁদের হাতে কিভাবে টাকা তুলে দেওয়া যায় সেই নিয়ে ভাবনা চিন্তাও শুরু হয়েছে।
এ বছরের ভারতের “Economic Survey”তে “Universal Basic Income” কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে আমরা এর জন্যে তৈরি নই কিন্তু এই নিয়ে কথাবার্তা শুরু হলে ভালই হবে।
শুধু আমাদের দেশেই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গত বছরের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ...
“… Whether a universal income is the right model—is it gonna be accepted by a broad base of people?—that’s a debate that we’ll be having over the next 10 or 20 years … What is indisputable, though, is that as AI gets further incorporated, and the society potentially gets wealthier, the link between production and distribution, how much you work and how much you make, gets further and further attenuated ... We underpay teachers, despite the fact that it’s a really hard job and a really hard thing for a computer to do well. So for us to reexamine what we value, what we are collectively willing to pay for—whether it’s teachers, nurses, caregivers, moms or dads who stay at home, artists, all the things that are incredibly valuable to us right now but don’t rank high on the pay totem pole—that’s a conversation we need to begin to have …”
শুধু সরকারের দিক থেকে এই কথা ভাবা হচ্ছে তা নয়। Pierre Omidyar, যিনি eBay স্থাপন করেছেন, তিনি ৫ লক্ষ ডলার দিয়ে একটি পরীক্ষা শুরু করছেন। অনেকের ধারনা আছে যে বিনা পরিশ্রমে টাকা পেলে লোকে আলস হয়ে যায়। এই নিয়ে আগেও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে কিন্তু তার ফলাফল নিয়ে বিতর্ক আছে। “Universal Basic Income” নিয়ে কেনিয়াতে এটি একটি ১২ বছরের পরীক্ষা হয়ত এই বিতর্কের সমাধান পাওয়া যাবে।
এই বিষয়ে ২০১৬ সাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরে Automationএর ফলে যে কি হতে পারে তা নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে। আমাদেরও এই নিয়ে ভাবনা চিন্তা করবার সময় এসেছে।
যদি অর্থনীতিবিদরা তাঁদের মূল মন্ত্রর থেকে সরে আসেন তাহলে আমাদেরও কি চিন্তাধারা বদলাতে হবে না?
যেমন ধরুন ... মন দিয়ে পড়াশুনা করলে, পরীক্ষায়ে ভাল নম্বর পেলে ভাল চাকরি হবে ... লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করা ভাল কিন্তু তাতে পড়াশোনার ক্ষতি যেন না হয় ... মন দিয়ে, নিয়ম মেনে, নিজের কাজটা করলেই উন্নতি হবে ... চাকরি চলে যাওয়া মানে জীবন শেষ ... ঝুঁকি নিয়ে নতুন কিছু করতে চাওয়া খুব ভয়ের ব্যাপার … বেচাকেনাটা ঠিক ভদ্রলোকের কাজ নয় … শখ শখের জায়গায় আর পেশা পেশার জায়গায়, দুটো মেশে না … এই কথাগুলো, কমবেশি, আমরা সকলেই মনে করি।
হয়ত আমাদের এই ধারনাগুলো পাল্টানোর সময় এসেছে।
● মন দিয়ে পড়াশুনা করে যা শেখা যায়, তা কিন্তু ভবিষ্যতে কম্পিউটারের করতে পারার সম্ভাবনা খুব বেশি। আর যে কাজটা কম্পিউটার করতে পারে, চাকরির বাজারে তার মূল্য তো প্রায় শূন্য। কম্পিউটার অনেক কিছু করতে পারবে কিন্তু লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করাটা মনে হয় এখনও অনেক দেরি আছে। কাজেই এই একটা জিনিষ শেখার মূল্য চাকরির বাজারে অনেক বেশিই থাকবে। জিনিস বেচার কাজটা ঠিক ভদ্রলোকের কাজ নয়, এরকম ধারনা আমাদের অনেকেরই আছে। কিন্তু যখন সবকিছুই অতিরিক্ত পরিমাণে পাওয়া যায় তখন বিক্রি করতে পারাটাই হয়ে যায় সবচেয়ে বড় ক্ষমতা, যেটাতে কম্পিউটারের চেয়ে আমরা একটু এগিয়ে থাকব। তাই এই ক্ষমতাটা কোন ভাবেই অবহেলা করা যাবে না।
● নিয়ম মেনে যে কাজ করা যায়, তা একদিন কম্পিউটারই করবে এটাই মেনে নিতে হবে। নিয়ম মেনে চলার চেয়ে নতুন নিয়ম তৈরি করাই হবে বড় কাজ। সেটা যে করতে পারবে তারই হবে উন্নতি। নতুন কিছু করার চেষ্টা করব কিন্তু ব্যর্থতার মুখোমুখি হব না, এ তো হয় না। বিনা ঝুঁকির কাজ খোঁজাটাই হবে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কাজ। চাকরিতে নিরাপত্তা খোঁজা হবে বোকামি। ঝুঁকি নিয়ে নতুন কিছু করতে চাওয়া এবং ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়ে আবার নতুন কিছু শুরু করা হবে সবচেয়ে নিরাপত্তার বিষয়।
● একসময় ভাবা হত যে শখ শখের জায়গায় আর পেশা পেশার জায়গায়, দুটো মেশানো যায় না। সেদিন কিন্তু এখন চলে গেছে। একসময় ছিল যখন পেশাদারি খেলোয়াড়দের বাঁকা চোখে দেখা হত। লেন হাটনের আগে কোন পেশাদার ক্রিকেটার ইংল্যান্ডের অধিনায়ক হননি। ১৯৬৮ সালের আগে পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়দের উম্বিলডন খেলার অধিকার ছিল না। এখন পেশা ছাড়া খেলার কথা ভাবা যায় না আর নেশা না থাকলে প্রথম শ্রেণির পেশাদার হওয়া অসম্ভব। এটা এখন জীবনের সব ক্ষেত্রেই সত্যি। কাজেই পেশা খুঁজতে গেলে শখ আর নেশাটা মাথায় রাখতে হবে।
● আমরা চলচ্চিত্রে দেখে থাকি যে নায়ক একাই সব কিছু করে ফেলছেন। আসল জীবনে কিন্তু একা কিছুতেই করা যায় না। কোন কিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গেলেও সেটা একা করা যায় না। তাতে সতীর্থ লাগে যারা হবে সমচিন্তক। নেতারও অনুসরণকারী লাগে, গুরুরও লাগে শিষ্য। নতুন কিছু করতে হলে “loner” বা একা বিদ্রোহীর কোন জায়গা নেই। কাজেই, সমচিন্তক মানুষ জন খুঁজে বার করা, তাঁদের একত্র করা, ভাবের আদানপ্রদান করা খুবই জরুরি। প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে তাঁদের খুঁজে বার করাও এখন সম্ভব।
নতুন যুগ আসছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। নতুন যুগে আসবে নতুন নিয়ম। সেই নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে সেই নতুন যুগ হবে উদ্দীপক আর রোমাঞ্চকর। আর পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে বদলাতে না পারলে নতুন যুগ হবে বিভীষিকার যুগ।
-----------------------------------------------------------References:
নতুন যুগ কি হবে উদ্দীপক আর রোমাঞ্চকর? তার ওপর কিছু লেখা
কিছু উদাহরণ - machine learning আর artificial intelligence কি এবং তার প্রয়োগ
বিশ্বে অসমতার উদাহরণ
Universal Basic Income এবং সেই ধরনের কিছু ভাবনা চিন্তা
রোবটদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা চিন্তা
Virtual Reality রিসার্চের উদাহরণ
HAL এর সম্পর্কে কিছু তথ্য
লেখক পরিচিতি - লেখক কানপুর আই আই টি-র প্রাক্তন ছাত্র ও তথ্যপ্রযুক্তির আদিকাল থেকেই তার সাথে যুক্ত। বর্তমানে ব্যাঙ্গালোর নিবাসী। সংগীতপ্রেমী। সময় পেলেই প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেন ও নিজের ব্লগে ইতিহাস, তথ্যপ্রযুক্তি ও অন্যান্য বিষয়ে আলোকপাত করতে ভালোবাসেন।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.