প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

জুলাই ৩০, ২০১৬

 

বঙ্গমেলার রঙ্গকথা

কেয়া মুখোপাধ্যায়

৮ থেকে ১০ই জুলাই উত্তর আমেরিকার অ্যালাবামা রাজ্যের বার্মিংহ্যাম শহরে হয়ে গেল এ বছরের বঙ্গমেলা।  অষ্টাদশতম বঙ্গমেলাটির মূল আয়োজক ছিলেন ‘মিড আমেরিকা বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন’, সঙ্গে ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ গ্রেটার বার্মিংহ্যাম।’

বিদেশের বুকে বঙ্গমেলার মত অনুষ্ঠানের সবচেয়ে ভাল লাগার দিকটা হল দূর-দূরান্তের বন্ধুদের সঙ্গে এক ছাদের তলায় দেখা হওয়া, কিছু আনন্দের মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়া আর নির্ভেজাল আড্ডা। লেখক-শিল্পী বন্ধুরাও এইসব খোলামেলা আড্ডার অংশীদার। প্রবাসে এক টুকরো বাংলাকে খুঁজে পেতে আমিও মাঝে মধ্যে শামিল হই এই উৎসবে।

এবারের বঙ্গমেলার টুকরো কিছু মুহূর্ত ছুঁয়ে যাবার আগে সংক্ষেপে বঙ্গমেলার আদিপর্বটা একটু বলে নেওয়া যাক।

সেটা ঊনিশ শতকের শেষ দিক তখন।  বাংলার তখন অবিভক্ত। হুগলি জেলার জনা কয়েক সিল্ক ব্যবসায়ী বাঙালি প্রথম পাড়ি জমালেন আমেরিকায় মাটিতে।  প্রথমে ঘাঁটি গাড়লেন উত্তর-পূর্ব উপকূলে আটলান্টিক ঘেঁষা বন্দর-শহরগুলোতে। উত্তর-পূর্বে নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি আর দক্ষিণের উঠতি শহর নিউ অর্লিয়েন্স- এ দুটি জায়গার বাইরে অবাধে ছড়িয়ে পড়া সম্ভব হয়নি। বিশ শতকের গোড়ায় শিল্পে এল মন্দার ধাক্কা, দ্য গ্রেট রিসেশন। এরপর ’৬০-এর দশকে মার্কিন অভিবাসন আইন-কানুন একটু শিথিল হতেই সাগরপাড়ি দিয়ে ভাগ্যের অন্বেষণে, জীবনে আরো বেশি প্রতিষ্ঠা অর্জনের বাসনায় ভিন-মুলুকে পাড়ি দেবার যে সুপ্ত বাসনা প্রতিভাবান বাঙালিদের মধ্যে উসখুশ করছিল, তাতে লাগল জোয়ার। দেশের মেধার বিদেশে থিতু হবার সেই হল নান্দীমুখ। 
পরিবেশ বিদেশ হলেও, আকাশ-বাতাস, আশপাশের মানুষজন ভিন্ন ধারার হলেও বাঙালি তার বাঙালিয়ানা ছাড়ে কী করে! ভ্রমণপিপাসু বাঙালির শিরা-উপশিরা জুড়ে বহমান নস্ট্যালজিয়া। ব্রিটিশ আমলে রাজধানী দিল্লিতে উঠে গেলেও ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী হবার গৌরব বা শিরোপা কলকাতার কাছ থেকে কেউ কাড়তে পারেনি। সংস্কৃতি চর্চা বাঙালির মজ্জায়। আর বাঙালি মাত্রেই তো লম্বা দাড়িওলা, জোব্বা পরা প্রাজ্ঞ বুড়োটির সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। সাহিত্যে সবেধন নীলমণি নোবেলটি নিয়ে গর্বও কম নয়। ঠাকুরবাড়ির কালচার বাঙালি সংস্কৃতির এক সুমহান ভিত্তিপ্রস্তর। তাই আর কিছু হোক না হোক, কালচার নিয়ে গর্ব কি ছাড়া যায়?  বিদেশে গিয়ে এই কালচারই যদি না রইল, তবে বাঙালির রইল কী! সেই ভাবনা থেকেই তৈরি হয়ে গেল বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ। তাঁদের উদ্যোগেই ১৯৮০ সাল থেকে আমেরিকা আর কানাডার বড় বড় শহরে শুরু হল বঙ্গসম্মেলন। ৪ঠা জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের ছুটি। লং উইকএন্ড। তাছাড়া স্কুল কলেজেও সেই সময় সামারের লম্বা ছুটি। তাই সেই সময়েই আয়োজন এই সম্মেলনের। দিব্যি চলছিল, কিন্তু বঙ্গ সম্মেলন সাধারণত হয় উত্তর আমেরিকার ইস্ট বা ওয়েস্ট কোস্ট-এর শহরগুলোতে। পুবে আটলান্টিক আর পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের কোল ঘেঁষে। গোল বাধল মধ্যবর্তী বাঙালিকুল নিয়ে। ততদিনে বাঙালি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা মার্কিন মুলুকের আনাচে-কানাচে। প্রতি বছর লটবহর বেঁধে এ-কূল নয় ও-কূলে ধাওয়া করা। নিজেরা কিছু শুরু করলে কেমন হয়! উত্তর হোক কি দক্ষিণ কলকাতায় ‘হঠাৎ জাগা সঙ্ঘ’, ‘ভাই ভাই সঙ্ঘ’ যেভাবে ইতি উতি গজিয়ে উঠেছিল, তাতেই এল একটা ম্যারিকান টাচ। ১৯৯৮-তে তৈরি হল, ‘মাবা’। মধ্য আমেরিকার ট্রাই-স্টেট, মানে কেন্টাকি-ইন্ডিয়ানা-ওহায়ো অঞ্চলের মানুষদের নতুন সংগঠন,  ‘মিড আমেরিকা বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন।’ বঙ্গমেলা শুরু হল তার পরের বছর, ১৯৯৯ থেকে। এ বছর আঠারোতে পা দিয়ে রীতিমতো সাবালক হয়ে উঠেছে সে।

বঙ্গ সম্মেলনের মতো বঙ্গমেলার আয়োজনও জুলাই মাসে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় উইকএন্ড জুড়ে। এখানে জমায়েত হন বেশ কয়েকশো বাঙালির।  কখনো কখনো সংখ্যাটা হাজার ছাড়ালেও, মেজাজে কিন্তু এই মেলা অনেকটাই ঘরোয়া, অন্তরঙ্গ। তা বলে ভাববেন না যে এই মাঝমুলুকের বাঙালিরা বঙ্গ সম্মেলনে যান না। অনেকেই বিপুল শক্তি আর ছুটি সঞ্চয় করে রাখেন বাংলার কালচারে দু’ দুটো উইকএন্ডে ভেসে যেতে।
বঙ্গ সম্মেলনই হোক কি বঙ্গমেলা, যোগ দেওয়ার প্রস্তাবনা বেশিরভাগ সময় প্রমীলাকুলের দিক থেকেই আসে। থোকা থোকা রঙিন ফুলে ভরা ক্রেপ মার্টাইল গাছের ফাঁক দিয়ে আসা সকালের রোদ্দুর যখন কফি টেবিল ছুঁই ছুঁই, তখন ধোঁয়া ওঠা কফির পেয়ালাটা টেবিলে রেখে, একথা ওকথার পর তিন চারদিন ছুটি নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরার আবদারটি পেশ হয়। গিন্নিদের মনে মনে প্ল্যান- রথ দেখার সঙ্গে সঙ্গে কলা বেচারও। দেশের গাইয়ে বাজিয়ে ফিল্মস্টারদের দেখা শোনা যাবে আবার শাড়ি গয়নার বাজারও হয়ে যাবে পুজোর আগে। কর্তারা সন্ত্রস্ত। তিনদিনের সংস্কৃতিচর্চা তো নয় শুধু, এসব মিলনমেলা মানেই টক ঝাল মিষ্টি মুচমুচে পরনিন্দা পরচর্চা, আড্ডা আর মোটা প্রাইসট্যাগের গুচ্ছের শাড়ি গয়না কেনায় কয়েকশো ডলার গচ্চা । 

“হে ভগবান! এর চেয়ে একটা আমেরিকান বউ কেন জুটিয়ে দিলে না গো! বছর বছর এই হাটুরে সংস্কৃতিচর্চা থেকে অন্তত হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম।” এমন বিলাপ যে তখন কর্তারা একেবারেই করেন না, তার গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না। তবে এও সত্যি, শেষ অবধি অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া তাঁদের গতি থাকে না, তা সে গিন্নির হাতে উইকএন্ড-এ আলুপোস্তর টানেই হোক বা পাঁঠার ঝোলের কথা ভেবেই হোক।  রাজি হতে হয়।

বঙ্গ সম্মেলনই হোক বা বঙ্গমেলা, ভাল করে খুঁজে পেতে যে শহরের বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের হাতে মেলা আয়োজনের দায় এবং দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়, সেখানকার আয়োজকদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। কলকাতার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিরাও দায়িত্ব ভাগ করে নিচ্ছে আজকাল। আগে আয়োজন হত চাঁদা তুলে। এখন তার সঙ্গে মাছের তেলে মাছভাজা ব্যাপারটাও আছে। ‘স্টার’ অভিনেতাদের স্পনসর করবে কলকাতার ফিলিম কোম্পানী, গাইয়ে-বাজিয়েদের স্পনসর করবে এমএনসি নয়তো ব্যক্তিগত ভালবাসায় কোন বিশিষ্ট ধনবান বা শিল্পপতি ইত্যাদি। মাঝে ক’বছর চিটফান্ড কোম্পানিগুলোর দৌলতে সে কী রমরমা! টাকার সিংহভাগই তোলা হচ্ছিল দেশ থেকে। তেমন নিরেট মাথা পেলে কাঁঠাল ভাঙতে কে আর ছাড়ে!

পর্দার আড়ালের গল্প থাক। আবার বঙ্গমেলার শুরুতে ফিরে আসা যাক। ২০০৮-এ কলম্বাস-এর পর এবার বার্মিংহ্যাম। এর মধ্যে বঙ্গ সম্মেলনে গেলেও বঙ্গমেলায় যাওয়া হয়নি আমার। বৃহস্পতিবার সন্ধেয় স্যান অ্যান্টোনিও থেকে অ্যাটলান্টা উড়ে যাওয়া হল প্রথমে। পরেরদিন, শুক্রবার, অগাস্টা থেকে সেখানে এসে পৌঁছল সোমাদি আর নীল। তারপর একসঙ্গে যাত্রা শুরু বার্মিংহ্যামের পথে। ওই যেমন কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যাস্‌! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, এও ঠিক তেমনি। একবার ইন্টারস্টেট-২০ ধরে ফেললে একেবারে সিধে রাস্তা। দেড়শ’ মাইল, সময় সোয়া দু’ঘন্টা। চমৎকার রাস্তার দু’ধারে সবুজের সমারোহ। লম্বা লম্বা পাইনগাছ আকাশ ছুঁতে চাইছে। স্টিয়ারিং সোমাদির হাতে। গল্পে আর সোমাদির বানিয়ে আনা সুস্বাদু চিকেন রোল খেতে খেতে দু’ঘন্টায় বার্মিংহ্যাম পৌঁছে গেলাম আমরা পাঁচজন।

বঙ্গমেলায় শাড়ির স্টল

হোটেলে চেক্ ইন করে, সেজেগুজে আবারো গাড়িতে সওয়ার। বঙ্গমেলার আয়োজন হয়েছে মাইল চারেক দূরের শেডস্ ভ্যালি হাই স্কুলে। স্কুলটা একটা টিলার ওপর। পার্কিং এর জায়গাও নীচ থেকে ওপরে, কয়েক ধাপে। সারি সারি গাড়ি পার্ক করা। গাড়ি থেকে নেমে শাড়ির আঁচল দুলিয়ে হাঁটতে গিয়ে প্রথমটায় একটু ধন্দে পড়ে গিয়েছিলাম। এখানেই হচ্ছে তো! বাইরে তো লোকজন নেই তেমন! কিন্তু মূল দরজাটা খুলে ঢুকতেই সব সংশয়ের ঝটিতি নিরসন। কেন? দুটো কারণে। প্রথমটি, শাড়ি আর গয়নায় সুবেশাদের ঝলমলে উপস্থিতি। হ্যাঁ, শাড়ি আর গয়না হল বাঙালির মিলনমেলার দুই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একেবারে জগাই-মাধাই কেস্। গাইয়ে-বাজিয়ে ছাড়াও বঙ্গসম্মেলন হতে পারে। চাই কী, সেলিব্রিটি ছাড়াও। কিন্তু শাড়ি-গয়না ছাড়া? নৈব নৈব চ। শাড়ি-গয়না ঝলমলিত পোস্ট দু’বেলা ফেসবুকে দিতে হবে না? তাছাড়া এ মেলায় উপরি-পাওনা কলকাত্তাইয়া সেলিব্রেটি। বন্যেরা বনে সুন্দর। সেলিব্রিটিরা বিদেশে। কলকাতায় যাঁদের নাগাল পাওয়া দুঃসাধ্য, এবেলা-ওবেলা হাঁটতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গেই ধাক্কা খাওয়ার যোগাড়। তাঁরাও ইমেজ সচেতন, এনআরআই-দের না চটিয়ে, হাসি-হাসি মুখে চমৎকার পোজ দেন, সেলফি তোলাও দুঃসাধ্য নয়। সেইজন্যেই তো তিনদিন চারবেলা পাল্টে পাল্টে পরার ডজনখানেক শাড়ি সঙ্গে আনা।

আর দ্বিতীয় কারণ? চা-সিঙাড়া। রেজিস্ট্রেশনের কাগজপত্র মিলিয়ে দেখে, গলায় মালা করে পরার আই.ডি. কার্ডটি তুলে দেওয়া হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন কাউন্টার-এ। কিন্তু সেই লাইনের থেকে চা-সিঙ্গাড়ার টেবিলের লাইনটি দীর্ঘতর দেখেই বুঝে নিতে আর দেরি হল না যে এক্কেবারে ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছি।
লাইনে দাঁড়িয়েই চকিতে কেউ খুঁজে পাচ্ছিলেন কিছু চেনামুখ। লাইন রেখেই ঝটপট্ কাউকে অনুরোধ,
“আমাদের একটা ছবি তুলে দেবেন, প্লিজ?”

কাউকে না পেলে ‘নিজস্বী’ তো আছেই। তারপর সোজা ফেসবুকে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে আপডেট- “এসে গেছি বঙ্গমেলায়।” সঙ্গে স্মাইলি। অন্যদিক থেকে আসা কমেন্ট-এর উত্তর দিতে দিতেই হাতে উঠে আসে গরমাগরম সিঙাড়া, গলায় মালা। মেজাজ ফুরফুরে।

বঙ্গমেলার শুরু

মোটামুটি ঠিক সময়েই শুরু হল অনুষ্ঠান। আয়োজক কমিটির সভাপতির বক্তব্যের পর আমেরিকা, বাংলাদেশ আর ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। সমবেত গানে বৈতালিকও ভাল লাগল। প্রদীপ জ্বালানোরও কথা ছিল। কিন্তু সময়ে এসে পৌঁছয়নি সেটি। পরের দু’দিন মনের দুঃখে সে ব্যাকস্টেজেই পড়ে রইল। যাক সে কথা, তারপর উদ্বোধনী নৃত্যে ‘নটিনী’র উপস্থাপনা। এখানে একটা কথা উল্লেখ করে নেওয়া ভাল, বঙ্গমেলায় দেশ থেকে শিল্পীরা তো আসেনই, তার পাশাপাশি সব সময়েই আমেরিকার স্থানীয় প্রতিভাদের অনেকখানি সুযোগ দেওয়া হয়। নটিনী দলটি তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল। শুরুতে একমাত্র বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতটি সংশ্লিষ্ট গায়িকা ভুল সুরে গাইলেন, তাছাড়া ছাড়া বাদবাকি উদ্বোধন পর্ব সুসম্পন্ন।

রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক, লোকগান, পল্লীগীতি, নাটক, শ্রুতিনাটক– লম্বা লিস্টি অনুষ্ঠানের। এর সঙ্গে লিস্টে অনেকদিনই যোগ হয়েছে ব্যান্ডের গান। স্থানীয় অনুষ্ঠান, লোকাল ব্যান্ডের গান ছাড়া এ রাতের মূল আকর্ষণ ছিলেন চন্দ্রবিন্দু-খ্যাত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। সে গানের তালে তালে শ্রোতারা নেচেও উঠেছেন শোনা গেল।
পরের দিন, শনিবারই বঙ্গমেলার আসল দিন। সকাল থেকে রাত নানা আয়োজন অনুষ্ঠানের। ওদিকে সকাল থেকেই সাজ সাজ রব হোটেলেও। আয়েস করে হোটেলের ঘরে টিভিতে নিউজ দেখছিলেন কর্তা। ঠেলে তাঁকে রেডি হতে পাঠান গিন্নি। আর নিজে বসে পড়েন আয়নার সামনে। মুখের ক্যানভাসে পেইন্টিং-রত গিন্নিকে আড় চোখে দেখে কর্তা বলেন, 

“যাবে,  ক’টা প্রোগ্রাম দেখবে, খাবে-দাবে আর এর-ওর সঙ্গে খানিক ভাটাবে। তার জন্যে অ্যা--তো! পারেও সত্যি”! কিন্ত- মনে মনে। এসব কথা মুখে আনার হিম্মত কি অত সোজা?

সেজেগুজে হোটেল থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে কর্তা-গিন্নিরা এসে পড়তে না পড়তেই শুরু হয়ে গেল শনিবার সকালের অনুষ্ঠান। এসময়ের গায়ক সৌগত কুণ্ডুর সঙ্গে শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাপচারিতা। এরকম অন্তরঙ্গ গানের আড্ডা বঙ্গমেলার বিশেষ আকর্ষণ। সৌগতর প্রথম আমেরিকা সফরের আড্ডাটিও দিব্যি জমে গিয়েছিল কথায়, সুরে।

শ্রুতি নাটক

এর পরে আবারো স্থানীয় অনুষ্ঠান। দৃষ্টিহীন দিয়ার সঙ্গে সুর মেলালেন তাঁর বাবা ইন্দ্রনীল। ‘ড্রামা আর্টিস্টস অফ আটলান্টা’ এসেছিলেন শ্রুতিনাটক নিয়ে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের রহস্যকাহিনি ‘ঝাঁঝাঁ জংশন’-এর নাট্যরূপ। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গল্প এখনকার ক’জন পড়েছেন, জানি না। তাঁর লেখার সঙ্গে এখনকার শ্রোতাদের পরিচয় করে দেওয়া নিঃসন্দেহে খুব ভাল কাজ। আলো-আঁধারি মঞ্চ আর দুর্দান্ত সাউন্ড এফেক্টে জমে গিয়েছিল কুমুদিনী, হেমলতা, প্রীতিলতা আর গোবিন্দ ডাক্তারের গা-ছমছমে গল্প। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল এই নাটকের একটা চরিত্রে মার্কিন মুলুকের দ্বিতীয় প্রজন্মের এক অভিনেতার সুন্দর অভিনয়। আসলে বঙ্গ সম্মেলন বা বঙ্গমেলা শুরুর একটা লক্ষ্য ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মকে বাংলার সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী করে তোলা। তাই এসব জায়গায় খুদেগুলোকে মা-বাবা টেনে-টেনে নিয়ে যান। ওই টানাটানিতে কারোর কারোর মনে একটু টান তৈরি হয় বটে। তবে বেশিরভাগই সমবয়সী বন্ধুদের খুঁজে নিয়ে আড্ডায় মাতে। নয়তো ট্যাবে গেমস্ নিয়ে ভিড়েও একলা। একটু বড় হয়ে গেলে আর আসেই না। সেই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে ঝরঝরে বাংলায় গোবিন্দ ডাক্তার-রূপী নীলাভ্র-র অভিনয় মনে আশা জাগায় বৈকি! স্বাতী, সোমা, টুম্পা-র অভিনয় আর ব্যাসদেবের  ভাষ্যও যথাযথ। এর পরে সাউথ ক্যারোলিনার ‘ছন্দেশি’ দলটির নানা স্বাদের গানের উপস্থাপনা ও টুকরো কবিতা খুব মনোগ্রাহী হয়েছিল।

মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন ক্যাফেটেরিয়ায়। এক টুকরো কলকাতা যেন উঠে এসেছে সেখানে। খাবার ফাঁকে ফাঁকে তুমুল আড্ডায় শিল্পী-শ্রোতারা। গান-সাহিত্য-সিনেমার সিরিয়াস আলোচনার সঙ্গে টুকরো গসিপও ছিল মিলেমিশে। এর ওর লেগপুলিং-ও বাদ নেই সেখানে।

সুকল্যাণের কোরিওগ্রাফি ছবিঃ সুরেশ গান্ধী

মধ্যাহ্নভোজের পরের পর্বের সূচনা হল সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের একক উপস্থাপনায় নানা স্বাদের গল্প-নাটক-কবিতা-গান দিয়ে। শুরুতেই অভিনেতা বিকাশ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘তোমার ভুবনে মাগো কত পাপ’ গানটি গাইলেন সতীনাথ। কবিতার ফাঁকে ফাঁকে দু’বাংলার কথাসাহিত্যিকদের ভাণ্ডার থেকে বেছে নেওয়া গল্পের মধ্যে মিলেমিশে থাকা নানা আবেগে মনে স্থায়ী রেশ রেখে গেল সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর ‘হালুইকর ও যোগাড়ে’, হুমায়ূন আহমেদ-এর ‘অসময়।’ আর অরুণাচল দত্তচৌধুরীর লেখা 'বাবার চিঠি'-র আবৃত্তির সময় অনেক প্রবাসীরই চোখে জল।

এরপর স্টেজে এলেন সৌগত কুণ্ডু। রিয়্যালিটি শো থেকে প্রথম সারিতে চলে আসা সৌগত এখন বেশ চেনা নাম। আগে তাঁর গান শুনিনি। ভাল লাগল কোনরকম প্রিটেনশনহীন তাঁর নিজস্ব গায়নভঙ্গিটি। নানারকম গানে শ্রোতাদের মন ভরালেন সৌগত।

শ্রেয়া গুহঠাকুরতা - ছবিঃ সুরেশ গান্ধী

সন্ধের মূল আকর্ষণ ছিলেন শ্রেয়া গুহঠাকুরতা। রবীন্দ্রনাথের গানের সম্ভার থেকে শোনালেন অনেকগুলি গান। তাঁর সঙ্গের বাদ্যযন্ত্রীদের মধ্যে তবলিয়াটি স্থানীয়। ভাল তবলিয়ার অভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে তাঁকে মঞ্চে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল বোধহয়। রবি ঠাকুর তো সেই কবেই বলে গেছেন,  ‘আমাদের আসরে সবচেয়ে বড় দাঙ্গা এই তাল নিয়ে। গান বাজনার ঘোড়দৌড়ে গান জেতে কি তাল জেতে এই নিয়ে বিষম মাতামাতি। ...তাল জিনিসটা সঙ্গীতের হিসাব বিভাগ, এর দরকার খুবই বেশী সেকথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু দরকারের চেয়েও কড়াকড়িটা যখন বেশী হয় তখন দরকারটাই মাটি হতে থাকে। তবু আমাদের দেশে এই বাঁধাটাকে অত্যন্ত বড় করতে হয়েছে কেননা মাঝারির হাতে কর্তৃত্ব।’ সঙ্গত করতে আসা তবলিয়াটির দৌড় বুঝে যেতেই শ্রেয়া চলে গেলেন তালছাড়া গানে। ঢালালয়ে গাওয়া রবীন্দ্রনাথের টপ্পা অঙ্গের কাব্যসঙ্গীতগুলি শ্রেয়ার কন্ঠে উপভোগ্য হল। বড় কোনও  বিপর্যয়ের সম্ভাবনাও এড়ানো গেল।

বিশাখা সেনের 'নটিনী'র শিক্ষার্থীরা - ছবিঃ সুরেশ গান্ধী

সুকল্যাণ আর তাঁর ছাত্রছাত্রীরা ছড়িয়ে আছে দুনিয়ার নানা প্রান্তে। তাঁদের উপস্থাপনায় সুকল্যাণের কোরিওগ্রাফিতে উজ্জ্বল নাচের অনুষ্ঠান ভারি মনোগ্রাহী। তার আগে, আরও একবার আকর্ষণীয় নাচ দেখিয়ে গেলেন নটিনীর শিক্ষার্থীরা। এঁদের অনেকের সঙ্গেই ভারতের কোনও যোগ নেই। কেউ মার্কিনী, কেউ চিনা, কেউ আবার এল সালভাদোর-এর। কিন্তু ভারতীয় নাচে তাঁদের আগ্রহ দেখার মত। তাঁদের পারঙ্গম করে তুলেছেন নটিনীর কর্ণধার বিশাখা সেন।

ডিনারের পরের আকর্ষণ শ্রীকান্ত আচার্য আর জয়তী চক্রবর্তী। সে কথায় যাবার আগে, চট করে উল্লেখ করে নিই আর একটা দিক। মূল অডিটোরিয়াম থেকে ক্যাফেটেরিয়ার হলওয়ে জুড়ে শাড়ি-গয়নার স্টল। সংস্কৃতি, সাহিত্যচর্চা,  দেদার খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে দেশ থেকে বাছাই করে আনা সম্ভার নিয়ে শপিং-এর ঢালাও  ব্যবস্থা।  বাঙালির মিলনমেলায় এ আকর্ষণ এড়ানো কঠিন। ছুটন্ত গিন্নিরা এক ঝলক তাকিয়েই কর্তাদের হুকুম দেন, “স্টলগুলো মনে রাখবে”। কর্তারা তখন সায়লেন্ট মোডে। মুখে হাসির আভাস। শ্যামের বাঁশি শুনে ছুটে যাওয়া শ্রীরাধিকার মত অনুষ্ঠান শেষে গিন্নিরা ছুটে গিয়ে সেখানে লাইন দিলে তাঁদের ত্রাহি মধুসূদন জপা ছাড়া উপায় নেই! ও হ্যাঁ- সেই বিপণীতে বইও আছে। তবে কিনা শাড়ি-গয়নার মাঝে সে ব্রাত্য। বাংলা ছবির ডিভিডি তবু কিছু বিক্রি হয়। কিন্তু বই? সেরকম বই-পাগলের দেখা মেলা ভার, বুঝলেন কিনা? একটু নেড়েচেড়ে, দু’পাতা উল্টেই চলে যাচ্ছেন সকলে। মুক্তধারা-র কর্ণধারের সংশয়, ভবিষ্যতে বঙ্গমেলাতে বই নিয়ে আসার কি আর দরকার আছে!

শ্রীকান্ত আচার্য ও জয়তী চক্রবর্তী

ডিনার শেষে সকলেই হলে ছুটলেন গানের টানে। আগের দিনই শুনেছি, শ্রীকান্ত আচার্য-র বাদ্যযন্ত্রী টিমের তবলিয়ার বাঁয়া তবলাটি মিসিং। বার বার ফোন করে কালঘাম ছুটে গেলেও রহস্যময়ভাবে উধাও তবলার হদিশ দিতে পারেননি ডেল্টা এয়ারলাইন্স। অন্য কারোর বাঁয়া যোগাড় করে মঞ্চে এলেন তিনি। এই অনুষ্ঠানটির জন্যে শ্রোতাদের প্রতীক্ষা ছিল। বাধ সাধল সাউন্ড ব্যালেন্স। কখনো যন্ত্রের প্রতাপ বেড়ে যায়, কন্ঠ ম্লান, আবার কখনো ঠিক উল্টোটা। একটি করে গান হয়, তারপর আবার ব্যালেন্স-এর চেষ্টা। শব্দ যে এমন জব্দ করে ছাড়বে, আগে বোঝা যায়নি। শিল্পীর কাছ থেকে সমস্যাটা বুঝে সাউন্ড ব্যালেন্স সামলাতে উদ্যোক্তারাও ছুটোছুটি করতে লাগলেন, একবার স্টেজে আর একবার অডিটোরিয়ামের পেছনে- যেখানে শব্দ প্রক্ষেপণের লোকজন বসে আছেন।

মনে পড়ল, একবার আমেরিকায় সলিল চৌধুরী এক পিয়ানিস্টকে বলেন- “দেখো, তুমি যেটাকে 'মাইনর বি উইথ আ রেইজড্‌ ফিফ্থ্ অ্যান্ড অ্যান অ্যাডেড নাইন্‌থ' বলছ, ওটা আমার কাছে মিয়াঁ কি টোড়ি রাগ৷” বিদেশিরা যখন প্রোগ্রেসিভ কর্ডস্ কি, জ্যাজ ভাবেন, আমরা ভাবি মিয়াঁ কি টোড়ি। তেমনি আবার কন্ঠের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের সমান গুরুত্ব বা একটু বেশিই গুরুত্ব পাশ্চাত্য সঙ্গীতে। কিন্তু আমাদের গানে কন্ঠই প্রধান, বাদ্যযন্ত্র তাকে সহায়তা করে। এই ব্যাপারটাই মার্কিনী শব্দ প্রক্ষেপকরা বুঝতে হিমসিম খাচ্ছিলেন। তাই মাঝে মাঝেই যন্ত্রের সে কী দাপট! এ ব্যাপারগুলো ভাবার৷ সমস্যার ব্যাপারও বটে।

তারই মধ্যে শ্রীকান্ত আর জয়তী চেষ্টা করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে আধুনিক- নানা গানে শ্রোতাদের মন জয় করার। শ্রীকান্তর কন্ঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা জয়তীর কন্ঠে গীতা দত্তর অমর গান আবারো শুনতে ভাল লাগে। যন্ত্রের যন্ত্রণা সইতে না হলে আরো উপভগ্য হত অনুষ্ঠানটা। শেষ হল যখন ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত দেড়টা পার!

গানের আড্ডা

শেষদিন রবিবার। একটু দেরিতেই অনুষ্ঠান শুরু। কিন্তু চমৎকার সূচনা। জয়তী, শ্রীকান্ত, শ্রেয়ার সঙ্গে গানের আড্ডায় সতীনাথ। টুকরো গান আর গানের গল্প। সূচনা হল জয়তীর কন্ঠে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আজি নূতন রতনে, ভূষনে যতনে প্রকৃতি সতীরে সাজিয়ে দাও’ দিয়ে। শ্রীকান্তর কন্ঠে টুকরো নানা গান, শ্রেয়ার রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যেই কথায় কথায় এল একটা প্রসঙ্গ – রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া মানেই শুধু তাঁর গানেই আটকে থাকা নয়। অনেক সফল, জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়কই অন্য গানও সমান দক্ষতায় গেয়েছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এক্ষেত্রে স্মরণীয়। দেবব্রত বিশ্বাসেরও ছিল আইপিটিএ-র ব্যাকগ্রাউন্ড। তেমনি একজন সুরকার, যেখান থেকে ভালো বুঝবেন, সেখান থেকেই প্রয়োজন মত আহরণ করবেন।  নিজের মতো করে ব্যবহার করবেন। তাঁর দায়বদ্ধতা শুধু সঙ্গীতের প্রতি।  শুধু কথা ও সুরের একটা সম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি৷ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই নানা দেশের নানা গান শুনতেন, তাঁর সুরে সে প্রভাবও পড়েছে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল একজন শিল্পীর মনন আর সাংগীতিক বোধ। সেটাই শেষ কথা বলে। ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’ এ গানটি দেবব্রত বিশ্বাস গেয়েছেন, আবার শ্যামল মিত্রও গেয়েছেন। রোম্যান্টিক্যালি ভাল লাগে শ্যামল মিত্রের গায়কী আর অনুভবের গভীরতায় পৌঁছে দেন দেবব্রত বিশ্বাস। টুকরো টুকরো গানে শ্রীকান্ত শোনালেন কে, কীভাবে গেয়েছেন। আড্ডার শেষ হল সতীনাথের কন্ঠে সলিল চৌধুরীর আমেরিকা সফরের সময় অভিবাসী ভারতীয়দের অনুরোধে লেখা একটা গান দিয়ে, ‘স্বদেশে বিদেশে যেখানেই থাকি।’ গানের এই আড্ডা নিঃসন্দেহে বঙ্গমেলার অন্যতম সেরা অনুষ্ঠান।

নাচের দৃশ্য - ছবিঃ সুরেশ গান্ধী

আমেরিকায় বসে সংস্কৃতির চর্চা করছেন যাঁরা , তাঁদের নাচ - গান - অভিনয় প্রতিভার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াটা কম প্রাপ্তি নয়। একই কথা প্রযোজ্য অভিবাসী লেখকদের ক্ষেত্রেও। শেষদিন স্থানীয় লেখকদের নিয়ে ছিল লিটারারি সেমিনার। তবে বঙ্গমেলার প্ল্যাটফর্ম এখনো সাহিত্য নিয়ে পাঠকদের সঙ্গে মত - বিনিময় বা আলোচনার জন্যে যথার্থ নয়। লিটারারি সেমিনার সাধারণ দর্শকদের কাছে এখনো সুয়োরাণির মর্যাদা পেতে পারেনি। তাই আয়োজকরাও সন্ত্রস্ত থাকেন , লিটারারি সেমিনার দীর্ঘ হলে , পরের তারকা শিল্পীর গান শুনতে হাজির শ্রোতারা বিরক্ত হবেন না তো !

অভিবাসী লেখকদের সৃষ্টির সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হল লিটারারি সেমিনার-এ। শুরুতে ছিল রবীন্দ্রনাথ - এর পৃথিবী কবিতা নিয়ে অনিরুদ্ধ সান্যালের শর্ট ফিল্ম। অনিরুদ্ধ সান্যাল আর সোমা মুখোপাধ্যায় ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রুদ্রশঙ্কর , রিমি পতি , সতীনাথ মুখোপাধ্যায় এবং বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলাম আমিও। আড্ডা - আলোচনার সুতো ধরে রেখেছিলেন অনিরুদ্ধ সান্যাল আর সোমা মুখোপাধ্যায় আর রম্যরচনা পাঠ ও কবিতা আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানটিকে প্রাণবন্ত করে তুললেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। কবি-সাহিত্যিকরা নিজেদের কবিতা, সাহিত্য পাঠ করলেন।

সাহিত্য আলোচনার আসর

এই লিটারারি সেমিনার নিয়ে সেরকম প্রচার হয়নি। বঙ্গমেলা নিয়ে সামগ্রিক প্রচারও আরো জোরদার হলে ভাল হত। তার ওপর , শ্রোতাদের একটা বড় অংশ আসলে অপেক্ষায় ছিলেন পরবর্তী অনুষ্ঠানের। তবু তারই মধ্যে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেছেন কিছু মানুষ। আমার লেখা বই ‘ঠিক যেন ক্যালেইডোস্কোপ’-এর নির্বাচিত অংশ পাঠের পর বেশ কয়েকজন ভালো লাগা জানিয়েছেন , বইটির খোঁজ করেছেন। এই সিরিয়াস পাঠকদের সঙ্গে পরিচয়টা নিঃসন্দেহে একটা বড় প্রাপ্তি।

বঙ্গমেলার স্মারক সাহিত্য পত্রিকা ‘মাতৃকা’-র কথা না বললে অসম্পূর্ণ থাকে সাহিত্যের দিকটা। নানা সময়ে, অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু পড়েছি এবারের পত্রিকাটি, তাতে চমৎকার কিছু গল্প, নাটিকা আর কবিতা মন ভরিয়ে দিয়েছে। মাতৃকার সম্পাদক সোমা মুখোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে এই কৃতিত্বের দাবীদার।
বঙ্গমেলার শেষ আকর্ষণ একঝাঁক পরিচিত লোকগান নিয়ে ‘সুরজিৎ ও বন্ধুরা।’ শেষ সন্ধেয় সুরে সুরে মেতে উঠলেন সকলে। আসন ছেড়ে এগিয়ে, মঞ্চের সামনে গিয়ে ছোট-বড়, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সম্মিলিত নৃত্য দেখার মতো। তাঁদের উচ্ছ্বাসে ধারাবাহিকভাবে মদত দিয়ে গেল সুরজিতের লোকগান।

রোববার বিকেলের মঞ্চের সুর, আর ব্যাকস্টেজের অনাবিল আড্ডা গড়িয়ে গেল হঠাৎ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েও ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে স্টারবাকস্ - এ। সাহিত্য - সমাজ - রাজনীতি - বাদ রইল না কিছুই।
এবারের মত ফুরোল বঙ্গমেলা। কিছু ভাবনা রেখে গেল।  আয়োজকরা ভেবে দেখবেন কিনা জানা নেই, তবু ভাবনাগুলো ভাগ করে নেওয়া যাক।

প্রথমত, বঙ্গমেলার বহুল প্রচার দরকার। শুধু আমেরিকার মধ্যবর্তী রাজ্যগুলোতে নয়, গোটা আমেরিকা জুড়ে। আমাদের বেশ কিছু আগ্রহী বন্ধু জানিয়েছেন তাঁরা এই আয়োজনের কথা সেভাবে জানতেনই না। আগে জানলে সামারের ছুটিতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাড়ি দিতেন বঙ্গমেলায়।

দ্বিতীয়ত, আমন্ত্রিত শিল্পীদের তালিকা অনেক আগে থেকে ফাইনাল করে নিয়ে ওয়েবসাইটটিকে নিয়মিত আপডেট করা। ওয়েবসাইট থেকে শিল্পী তালিকা দেখেই মূলত সকলে ঠিক করেন যোগ দেবেন কিনা।
তৃতীয়ত, অনেক অভিবাসী লেখক ছড়িয়ে আছেন আমেরিকা জুড়ে। দেশের নানা সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন তাঁরা। তাঁদের কাছে পৌঁছতে হবে। তাঁরাও বঙ্গমেলাকে পাবেন অনেক পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। এ ব্যাপারে 'মাতৃকা' একটু উদ্যোগ নিয়ে অভিবাসী লেখকদের একটা তালিকা তৈরির কথা ভাবতে পারে।

চতুর্থত, আজকাল নামীদামি শিল্পীদের স্টেজ প্রস্তুতির সময় অতীব দীর্ঘ। এক বন্ধু তো বলেই বসলেন- ‘তাড়াতাড়ি স্টেজ, সাউন্ড  রেডি হয়ে গেল মানে বাপু তুমি তত দরের আর্টিস্ট নও। তাই যত বেশি নামডাক, তত বেশি সময়!’ বঙ্গ সম্মেলনের মতো একই সময়ে নানা স্টেজে রকমারি অনুষ্ঠান হয় না এখানে। তাই ওই মঞ্চ প্রস্তুতির সময়টা শ্রোতাদের পক্ষে বড় ক্লান্তিকর, এমনকী অনেকসময় বিরক্তিকরও। বিশেষত, যখন কোনও শিল্পীর সহকারীরা ঘোষণা করে দেন, মঞ্চ প্রস্তুত হবার আগে কাউকে তাঁরা প্রেক্ষাগৃহে থাকতে দেবেন না। অনেক বয়স্ক মানুষও যান বঙ্গমেলায়। কোথায় যাবেন তাঁরা তখন? সকলের কথা ভেবে তাই ওই মধ্যবর্তী  সময়টাতে অন্যত্র, অন্য কোনও ইভেন্ট এর ব্যবস্থা রাখা দরকার।

পঞ্চমত, বঙ্গমেলার প্ল্যাটফর্মে স্থানীয় শিল্পীদের প্রতিভা তুলে ধরা নিঃসন্দেহে খুব ভাল। কিন্তু তাঁদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুণগত মানের একটা ন্যূনতম মাপকাঠি থাকা অত্যন্ত জরুরি। শনিবার যেমন ছন্দেশি চমৎকার সমবেত অনুষ্ঠান করেছেন, তেমনি তার আগে ছড়িয়ে লাট করে গেছেন মেমফিসের একটি দল। একইভাবে, উদ্বোধনী সন্ধেতেও ভুল সুরে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে গেলেন একজন। এগুলো বাঞ্ছনীয় নয়।
যাই হোক, মেলার আসল কথা হল সকলের খুশি। সকলের ভরপুর আনন্দ। তার অনেক ব্যবস্থাই ছিল। যে কোনও বড় আয়োজনের নানা ভুল-ত্রুটি থাকেই। সমালোচনাও থাকে। তবু দেশ থেকে আট হাজার মাইল দূরে প্রবাসে বসে অনেক মানুষ যে এক টুকরো বাংলা কি ভারতকে খুঁজে পেলেন এই ক’টা দিনে- সে বড় কম পাওয়া নয়। সেই প্রাপ্তিটুকু নিয়েই আবার পা বাড়ানো, নিজের নিজের ঘরে ফেরা।

মনে মনে প্রতীক্ষা- আবার আসছে বছর। আবার প্রবাসে বাঙালির রঙ্গমেলা, বঙ্গমেলা।



লেখক পরিচিতি - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এখন আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা। আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। মনের আনাচ-কানাচ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া খেয়ালখুশির রঙচঙে টুকরো কাচের বর্ণময়তাকে অক্ষরে অক্ষরে ধরে রেখেছেন প্রথম বই ‘ঠিক যেন ক্যালেইডোস্কোপ’-এর পাতায়।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।