প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

শিল্প ও সাহিত্য

জুন ১৫, ২০১৫

হারিয়ে যাওয়া বই

ঈশানী রায়চৌধুরী 

পরিমল রায়। জন্ম ২ রা অক্টোবর, ১৯০৯। প্রয়াণ  ১8 ই অক্টোবর, ১৯৫১।  আয়ুষ্কাল মাত্রই  ৪২ বছর। মানুষের আয়ুর বিচার করা হবে কীভাবে? সময়ের হিসেবে...দিন, মাস, বছর? নাকি জীবনকালের সাফল্যের নিরিখে? পরিমল রায় স্বল্পায়ু ছিলেন বটে ; কিন্তু মেধার ঔজ্জ্বল্যে, চিন্তাশক্তির দীপ্তিতে, লেখনীর তীক্ষ্ণতায় সেই সীমিত সময়্সীমাতেই সাহিত্যরসিক বিদ্বজ্জনমহলে রোশনাই ছড়িয়ে গেছেন। তিনি মনমর্জি লিখতেন। কখনো রম্যরচনা, কখনো বা ছড়া।  অধ্যাপক ও পরবর্তী জীবনে রাষ্ট্রসংঘে কর্মরত পরিমল রায় নিছক সাহিত্যচর্চাকে জীবিকা হিসেবে একমাত্র সম্বল করার কথা ভাবেননি কখনো। যদি ভাবতেন, যদি দীর্ঘায়ু হতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্যের শ্রীঅঙ্গ আরও কিছু মহার্ঘ অলংকারে ভূষিত হত, সন্দেহ নেই।

দুটি বই নিয়ে আলোচনা করব। একটি বই ছড়ার। অন্যটি রম্যরচনার। 

ছড়া আঁকা, ছবি লেখা 
....................................




"পদ্য যদি লিখতে তুমি, পরিমল 
মুগ্ধ হতাম সকলে,
হার মানাতে নামজাদা সব কবিদের 
ছন্দ মিলের দখলে।
যত কথা -- আজগুবি আর অসম্ভব 
ঘুরছে তোমার মগজে, 
দয়া করে কলম নিয়ে একটানা 
লিখতে যদি কাগজে ....."

এই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন পরিমল রায়ের সুহৃদ বুদ্ধদেব বসু। তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারি যে পরিমল রায়ের মেধা ছিল ক্ষুরধার। তিনি ধনবিজ্ঞান না পড়ে যদি সাহিত্য পড়তেন, অধ্যাপক না হয়ে হতেন ডাক্তার..তাতে সাফল্যের কিছু ইতরবিশেষ ঘটত না। সত্যকারের মেধা এক এমনই সম্পদ, যা থাকলে সিদ্ধিলাভ অনায়াসেই হয়।

পরিমল রায়ের পাঠক্রমে মুখ্য বিষয়টি ছিল ধনবিজ্ঞান। গৌণ বিষয় গণিত ও ইংরাজি। এদিকে তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য। ধাঁধা সমাধানে ক্ষিপ্র, সাহিত্যে স্বচ্ছন্দবিহারী।

ছাত্রাবস্থায় পরিমল রায় যে সব পদ্য রচনা করেছিলেন, তার কিছু কিছু "প্রগতি"পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকলেও প্রধান প্রচার ছিল বন্ধু ও আত্মজনের মুখে মুখে। এরপর অবশ্য অনেক ছড়া কবিতা পত্রিকায় বেরিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে শনিবারের চিঠিতে আর রংমশালে। দুটি প্রকাশ পেয়েছে চতুরঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পত্রিকাতেও বেশ কিছু।

ছড়া। খামখেয়ালী কৌতুক আর ছন্দ-মিলের গৌরবে গরীয়ান। এই সব পদ্য লেখা ইচ্ছেসুখে, ক্ষণিকের প্ররোচনায় বা আড্ডার আসরে। পদ্য লেখা এক বিষম ব্যাধি। একবার এর সংক্রমণ হলে তা নিতান্ত দুরারোগ্য। সেই ব্যাধির সানন্দ বাহক পরিমল রায়। তাঁর অধুনা -দুষ্প্রাপ্য ছড়ার বইটি সব বয়সের পাঠকের জন্য। তাতে আছে ছড়াকারের নিজের হাতে আঁকা ছবিও। ছান্দসিক পরিমল রায় স্বভাবসুলভ কৌতুকপ্রবণতায় পরিণত বয়সেও যে সব পদ্য লেখেন, তা বাংলাভাষায় কৌতুক-কবিতার জগতে রত্নবিশেষ।
এই বইটি আমার হস্তগত হয় পরিমল রায়ের পুত্র পৃথ্বীরাজ রায় মারফত।

ছড়ার বইটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা। প্রথম ভাগে লিমেরিক। একটি নমুনা দিই।

কনে সদ্বংশের, বসু ওরা বন-গাঁর,
দোষ শুধু রংটায়, একেবারে অঙ্গার।
হায় পিস-শাশুড়ীক 
চিকিৎসা আসুরিক 
অবিরল গায়ে জল ঢালে আদি গঙ্গার।

এই শ্রেণীর লিমেরিক একেবার নিয়মমাফিক। প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম পংক্তি সমান দৈর্ঘ্যের ও পরস্পর অন্ত্যমিলযুক্ত। তৃতীয় ও চতুর্থ পংক্তি দৈর্ঘ্যে বাকি তিনের অর্ধেক, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে অন্ত্যমিলযুক্ত।

এরপর কিন্তু অন্যরকম লিমেরিক এসেছে।

বৌ পেয়ে মন-মতো
ভারী খুশি মন্মথ।
বলে, এ তো হবারই 
জানা ছিল সবার-ই 
মাহেন্দ্রক্ষণে মোর জন্ম তো।

এখানে ৮ /৮ /৮ /৮ /(৮ + ৮ / ২ )। কিন্তু অন্ত্যমিল এসেছে লিমেরিকের নিয়ম মেনেই।

এবার আর একটি নমুনা। এখানে অন্য হিসেব। যদিও অন্ত্যমিলের ধারাটি নিয়ম মেনেই ।

রাগের চোটে নৌকো থেকে বৌকে দিল ফেলে , 
এক নিমেষে স্রোতের টানে কোথায় নিল ঠেলে।
এখন শুধু কপাল ঠোকে
বলে, মশাই, মরছি শোকে,
গয়নাগুলো সঙ্গে গেল, কাজ হত আজ পেলে।

এখানে ৫/৫/৫/২ এই হিসেবে প্রথম, দ্বিতীয় ও অন্তিম পংক্তি আর মাঝের দুটিতে ৫/৫ অক্ষরবৃত্ত হিসেবে লেখা হয়েছে।

এই শেষের "নিষ্ঠুর" ধরনের লিমেরিক রুথলেস রাইমস অনুসরণে লেখা। বিংশ শতকের প্রথমদিকে হ্যারী গ্রাহাম ও অন্য অনেকে এই ধরনের "মরবিড পোয়েমস" লিখেছেন।

এবার দেখা যাক এডওয়ার্ড লিয়ার কেমন প্রভাবিত করেছিলেন পরিমল রায়কে। 
লিয়ারের ছন্দ অনুসারী একটি নমুনা :

ভাগ্যিস থুতনীটা ছিল অত ছুঁচলো, 
তাই তো মিসেস জে-র 
উৎসাহ হল ঢের, 
সঙ্গীত না জানার দু:খটা ঘুচলো।

রামী -চণ্ডীদাস। সেই যে .. রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম কামগন্ধ নাহি তায় ....সেই রামীর গল্প...নব আঙ্গিকে।

এক যে আছে রামী নামে ধোপানী, 
পুকুরের সিঁড়িঘাটে সে কী তার ফোঁপানি !
চণ্ডীবাবু তাই না দেখে 
কাছে তাকে আনল ডেকে,
লোকে বলে সিঁড়িখানা অধ:পাতের সোপান-ই।

এর পরের পর্বে আছে ছোটদের জন্য কিছু ছড়া।

আমাকে বড্ড টানল নব্য রামায়ণ "হনুমান যদি " ( ১ আর ২ )। মূল ছড়াগুলি একটু বড়, তাই দুটি দুটি করে পংক্তির উল্লেখ করব।

হনুমান যদি লঙ্কার থেকে ফিরিয়ে আনতো সীতাকে 
আজো ধিকিধিকি জ্বলতে হতো না রাবণ রাজার চিতাকে।

এবং
হনুমান যদি লঙ্কার থেকে জানকীরে ধরে আনতো
তাহলে তো সব রাঘব রাজারে অতি ভীতু বলে জানতো।

এর পরে যে ছড়াটি বলব, তার নাম "কী বিপদ "| একজনকে ষাঁড়ে তাড়া করেছে। সে ভগবানকে ডাকছে প্রাণপণ। ভগবান বেপাত্তা। তাহলে উপায় কী ! গলকম্বলে কাতুকুতু, নাকি ভীষণ রেগে শিং দুটোকে ঠেসে ধরা ? তার চেয়ে বরং...

" ফিক করে যেই ফেলবো হেসে মনটা যাবে গলে,
লক্ষ্মীছাড়া তাইতে যদি গুঁতিয়ে দিতে ভোলে !"

এরপরের যে ছড়ার বিভাগ, সেটি অভিনব। কিছু শব্দ কীভাবে বিভিন্ন বাক্যে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়, তা নিয়ে লেখা। যেমন "ধরা ", "ওঠা ", "তোলা "| একই পদ কখনো বিশেষ্য, কখনো বা ক্রিয়া। ছড়াগুলি পুরোপুরি না দিয়ে বরং প্রতিটি শব্দের জন্য দুটি করে ছত্র উদাহরণ হিসেবে দিই।

১ ) কান্না -ধরা কন্ঠে তখন বল, হুজুর, শুনুন
দুদিন ধরে রান্নাঘরে ধরছে না যে উনুন।
২ ) কথা ওঠে মেলা, চাঁদা ওঠে কম,
চুল ওঠা ব্যামো রোগের অধম।
৩ ) একটি ফোঁটা যায় না পেটে, কেবলই দুধ তোলে, 
ছেলেটা যে তুলবে পটল এমনটি রোজ হলে।

একটি ছড়া আছে বাংলায় ধ্বন্যাত্মক শব্দের বাহার নিয়ে। এটি থেকেও শেষ দু'ছত্র লিখি।

হৈ হৈ করে ঐ এলো বুঝি ঝড়
পৈ পৈ করে ক'ই,, ছাতা খুলে ধর।

ফিরি ওই একই শব্দের বিবিধ অর্থের ব্যবহারে। শব্দটি হল "ভাঙা"| আমি শুধু শেষ কয়েক ছত্র লিখি।

আড্ডা ভাঙে, সভা ভাঙে,
হঠাৎ ভাঙে ভুল, 
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ে
মন ভেঙে আকুল।
সিঁড়ি ভেঙে ছাতে উঠে 
ঘুড়ি ওড়ায় ছেলে,
পুঁজি ভেঙে ঘরকন্না 
টাকা ভেঙে জেলে।

এই ৮ পংক্তি নিয়েই ভাবা যাক। হালকা চাল থেকে অভিমান আর দু:খ ছুঁয়ে আনন্দ পেরিয়ে বাস্তবের মুখোমুখি এবং তারপর তৃতীয় রিপু বিষয়ে পরোক্ষ সতর্কবাণী। কত রকম রংবেরঙে মনের টানাপোড়েনের ছবি আঁকা !

এরপর একটি অন্য ধাঁচের ছড়া। পরপর প্রতি দুটি পংক্তির শেষ বর্ণ বা শব্দ এক। কিন্তু বর্ণ যখন শব্দ গঠন করছে, দুটি আলাদা শব্দ। যেখানে দুটি শব্দ এক, সেখানে ভিন্নার্থক শব্দ। কখনো বা প্রায় সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ। এটি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ কবিতা। আমি বর্ণ আর শব্দ নিয়ে ঠিক কী বোঝাতে চাইছি..তা দুটি দুটি ছত্র দিলেই স্পষ্ট হবে। মজা হল, সব মিলিয়ে এটি একটি আখ্যান কবিতাও বটে।

ক ) ভারী ভালো মেয়েটি সে মীনু সেন নামেতে 
রোজ করে লেখাপড়া বাজে কাজে না মেতে।
খ ) বোধোদয় ছেড়ে মীনু যবে ধরে ধারাপাত 
দু চোখ ভাসায়ে আহা কী ভীষণ ধারাপাত !
গ ) দু-গাছা কাচের চুড়ি বেগুনী ও সোনালী
তাই নিয়ে মিছিমিছি এত কথা শোনালি !

সেই আমলের বিখ্যাত দীর্ঘ ছড়া "মেয়ে মহল "। এখানে স্বল্প পরিসরে সম্পূর্ণ ছড়াটি লেখা অসুবিধাজনক। তাই আমি সামান্য নমুনা পেশ করব। নারীদের উদ্দেশ্যে অত্যাবশ্যক অমৃতবাণী। তাঁদের স্বভাবের বিবিধ "গুণ"। প্রতিটি স্তবকে চারটি পংক্তি। প্রথমে কোনো কোনো স্তবকে একটি পংক্তি কিঞ্চিদধিক প্রশস্তিসূচক। পুলকিত হতে না হতেই মূর্ছা !

তোমার খোকার আহা বুদ্ধির বহর 
শুনিয়া স্তম্ভিত হোক বেবাক শহর 
যদ্যপি এমন ইচ্ছা মায়ের স্বভাব,
তথাপি সে অতি বড় রুচির অভাব।

এমনই কথার পিঠে কথা। গান গাইবার অনুরোধ এলে ন্যাকামির বাই থেকে গয়না বিনে কোত্থাও না যাই ...পর্যন্ত। দোকানে শাড়ি কেনার নাম দোকানীর হেনস্তা থেকে সিনেমা হলে ছিঁচকাঁদুনে খোকার সম্যক ব্যবস্থা পর্যন্ত। আর পতি? সে তো পরম গুরু !

স্বামী যবে ব্যস্ত হয়ে রহে নিজ কাজে 
গভীর নিমগ্ন কোনো সমস্যার মাঝে,
তখন আসিয়া কাছে কর্ণের কুহরে
ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করিও না চীৎকারের স্বরে।
দিনে আর রাতে মিলে চব্বিশ প্রহর, 
বাজে কথা শোনাবার বহু অবসর।
শান্তিতে থাকিতে দাও দু-দণ্ডের তরে 
তারপর বাকীটা তো তোমারি খপ্পরে !

আমি নিশ্চিত, সম্পূর্ণ ছড়াটি পড়লে পুরুষ সম্প্রদায় ছড়াকারের জয়ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মাতিয়ে তুলবেন।

পরের পর্বে বিচার বিচিত্রা। বিচারক, উকিল, জুরি, বাদী, প্রতিবাদী। আসর সরগরম।

ছেলে বলে, ছিলাম আমি ঢাকাতে,
সেই সুযোগে বৌকে আমার ধরলে 
এসে ডাকাতে।
হাজার পাঁচেক নিয়ে গেছে গয়্নাতে
ও টাকাতে।

পরের পর্ব পাঁচমিশেলি। নাম ''নানাবিধ "| একটি দু পংক্তির কৌতুকী ছড়ার উল্লেখ করি।

" কেটে কুটে মাসকাবারে মাইনে এলো তিনশ' তিন,
কর্তা পেলেন তিনটি টাকা, একশ' করে তিন সতীন।

এতে আবার সেই দারুণ চাতুরী করে শব্দের ব্যবহার। তিনশ ' তিন এবং সমোচ্চারিত তিন সতীন।

এরপর হরেকরকম ছন্দে কিছু ছড়া পেরিয়ে আমার যে ছড়াটিতে চোখ আটকে গেল, সেটি হল "মজার দেশ"| সত্যিই আমাদের দেশ একই রকম রয়ে গেল !

দোকান ভরা খাবার তবু
মানুষ মরে পথে, 
দেশের লোকেই দেশটাকে ভাই 
করে দিচ্ছে ফতে ! 
রোগে ভুগে ছেলে বুড়ো
মরছে লাখে লাখে 
বলছে সবাই, মারলে কৃষ্ণ 
কে -ই বা তারে রাখে !
এবং এভাবে এগোতে এগোতে শেষ চার পংক্তি...
মজার দেশের মজার কথা 
বলবো কত আর 
অধ:পাতের লম্বা সড়ক 
হচ্ছে পরিষ্কার।

কবি অজিত দত্তর সেই বিখ্যাত লাইন মনে পড়ে? "তুমিও বিখ্যাত হলে, সেই দু:খে লিখি না কবিতা "|

পরিমল রায়ের "বলীবর্দ্দ" ছড়ার শেষ দু'পংক্তি লিখি :

কোন মহা জেনাস -এর কহ তুমি লিডিং স্পিশিস, 
তুমিও পি -এইচ ডি হলে সেই দু:খে লিখি না থীসিস।

এটি ব্যঙ্গ কবিতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এক অল্পবুদ্ধি পণ্ডিতম্মন্য অধ্যাপকের প্রতি।

স্বভাব-রসিক পরিমল রায়ের লেখা তথাকথিত একটিমাত্র "বিমর্ষ" কবিতা হল "দৈনন্দিন "| ছাপা হয় "বাসন্তিকায় ", ১৩৫১ সালে। এই সংকলনে আছে দুটি শীর্ষকহীন গদ্য-কবিতাও। "কবিতা "পত্রিকার পৌষ ১৩৪৪ সংখ্যায় প্রকাশিত।

রবীন্দ্রনাথের একটি দীর্ঘ কবিতা আছে । "নিমন্ত্রণ "। নতুন বৌঠানের উদ্দেশ্যে লেখা তরুণ কবির ডাকে না -দেওয়া চিঠি। একই ছন্দে পড়লাম পরিমল রায়ের লেখা "একাল কবিতাটি। বা বলা ভালো, একালের চিঠি। শুরুটি লিখি। এবং শেষটি। দুটি কবিতার। প্রথমে থাক" নিমন্ত্রণ"।

মনে পড়ে বুঝি এককালে লিখিতাম 
চিঠিতে তোমারে প্রেয়সী অথবা প্রিয়ে
একালের দিনে শুধু বুঝি লেখে নাম 
থাক সে কথায়, লিখি বিনা নাম দিয়ে .....
..... তোমাতে আমাতে মিলিত নিবিড় একা 
স্থির আনন্দ, মৌনমাধুরীধারা,
মুগ্ধ প্রহর ভরিয়া তোমারে দেখা 
তব করতল মোর করতলে হারা।

এবার পরিমল রায়ের  "একাল "।

তোমায় পত্র লিখেছি ক'দিন আগে 
হয়তো সে চিঠি হয়েছে হস্তগত,
সযতনে তারে রেখেছ তো অনুরাগে 
অথবা ধূলায় ফিরিছে ইতস্তত?.....
............ এ কালে প্রণয় চলে এই ভাষা দিয়ে 
সোজাসুজি চালে চলে একই চতুরালি,
স্বপ্নের জাল একেবারে ছিঁড়ে নিয়ে 
তারপর বুঝি চলে এই জোড়াতালি।

সত্যি ! দুটি কবিতা পাশাপাশি রেখে মনে হল, কত দ্রুত আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়ে মধুর বৃত্তি ভুলে গিয়ে ছলচাতুরীর যাপনকে আশ্রয় করেছি।

প্রথম জীবনে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন পরিমল রায়। পরে রাষ্ট্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত। সমাজ সচেতনতার অন্তর্দৃষ্টি ছিল। কবির দিব্যদৃষ্টিও তো ছিল ! তাই লেখা হয়েছিল কালোবাজার নিয়ে পদ্য। তার দেখে চার ছত্র উল্লেখ করি।

খুলে এক কম্পনী ধরিয়েছ কম্পুনি
কানাকড়ি সবই নেবে হাতড়ে, 
শেখালো এ টোপ কে? মানুষের লোভকে 
বিঁধে সবই টানো নিজ পাত্রে।

পরপর এসেছে সোশালিস্টিক ছড়া, ইনফ্লেশন, মহাযুদ্ধকালীন ছড়া, স্বাধীনতা-উত্তর, ছেচল্লিশের দাঙ্গাও। বঙ্গভঙ্গের পর লিখেছিলেন,

ফুরিয়ে গেল রঙ্গ,
বঙ্গ হল ভঙ্গ।
এই তো ছিল পণ গো, 
চল বৃন্দাবন গো।
মহাযুদ্ধকালীন অবসরে লেখা :
চীনে সেনা ঘর্ম্মায় 
বলে, ওরে জাপানী 
মিছে তোর দাপানি
শুনে তাহা চুপি হাসে ইংরেজ শর্মায়।

এমন কি একটা দুটো? অনেক। যত লিখি এ নিয়ে, মনে হয় আরও লেখা বাকি রয়ে গেল।

ছড়া। আয়তনে লঘু ; কিন্তু অর্থবহতায় গুরু। ছড়া আনন্দ দেয়, তির্যক বাক্যে শরাহত করে ; আবার চিন্তার ভুরিভোজ সরবরাহ করে স্বল্পসময়ের পরিবেশনে অসীম দক্ষতায় । পরিমল রায়ের ছড়া আজ এত বছর পরেও আমাদের চমকে দেয় তাদের রসিকতার রাংতায় মোড়া ব্যঙ্গে, সমকালীন রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর বুদ্ধিদীপ্ত মতামতের প্রাচুর্যে, সমাজ ও পরিবারকেন্দ্রিক মানসিকতার স্ফুরণে বা নির্ভেজাল হাসিঠাট্টার উদ্ভাসে। বিষয়বৈচিত্র্যগুণে, অচিন্ত্যনীয় রসবোধে ছন্দের জাদুকরী পারঙ্গমতায় পরিমল রায় বাংলা সাহিত্যের এক নক্ষত্রবিশেষ ...শুধু যা হারিয়ে গিয়েছে অকালে, নি:সঙ্গ তমসাচ্ছন্ন মধ্যরাতের আকাশে ।

শেষের এ আলোচনা বড় গুরুপাক হল কি? তাহলে মেঘ কাটাতে একটি হাস্যরসে সিক্ত পদ্য। পরিমল রায়ের এই "পদ্য পদ্ধতি (২)" প্রকাশিত হয়েছিল "শনিবারের চিঠি"তে।

এমন লেখো পদ্য, মানে, এমনতরো গদ্য
বাংলাদেশের কারুর বাবার হয় না যেন বোধ্য।
সেকালে ভাই ছেলেরা সব লিখতে বসে কাব্য,
ভালোবাসাবাসির কথা লিখতো অসম্ভাব্য।
এম-এ পড়তে আসতো যারা, প্রেমে পড়তোই বেশি, 
পতন এবং মূর্ছা নিয়ে ছন্দে রেষারেষি ।
তাই না দেখে বাপের সব হতেন খড়্গহস্ত 
কবিত্বটা ফোটার মুখেই শুকিয়ে যেতো ত্রস্ত।
ছেলেরা তাই জটলা করে করলো পরামর্শ,
মেয়েরা আর কাব্যলোকের রবে না আদর্শ।
লিখতে হবে এমন কিছু, এমনতরো তত্ত্ব, 
বাপের যার বুঝবেই না ষত্ব কিংবা ণত্ব।
সেই থেকে ভাই বাপখুড়োদের ব্যাবসা গেছে থেমে,
একালেতে ছেলেরা আর কেউ পড়ে না প্রেমে।
কিন্তু ভায়া, সেই থেকে যে উধাও কাব্যলক্ষ্মী,
আসন জুড়ে রাজ্যই করে হুতুম প্যাঁচা পক্ষী।

এই সব ছড়া এদিক ওদিক প্রকাশিত। এবার আমি দুটি ব্যক্তিগত ছড়ার উল্লেখ করে এ আলোচনার ইতি টানব। 
প্রথম ছড়াটি পেয়েছি বুদ্ধদেব বসুর কনিষ্ঠা কন্যা রুমিদির (দময়ন্তী বসু সিং ) আনুকূল্যে। ছোটবেলায় রুমিদি আর তাঁর ছোটভাই পাপ্পার (শুদ্ধশীল বসু) একটি অটোগ্রাফ খাতার যৌথ মালিকানা ছিল। বাড়িতে স্বনামধন্য অতিথি এলেই তাঁরা ভাই বোন খাতা এগিয়ে দিতেন। পরিমল রায় বন্ধুকন্যার উদ্দেশ্যে সেই খাতায় লিখেছিলেন,

ছোট্ট মেয়েই বড় হয়ে শেষকালে হয় বুড়ি 
বাপ মায়ে যে জানে না তা দৈব বাহাদুরি।

রুমিদির ভাষা ধার করেই বলি, " আবাল্য বন্ধুটির প্রতি বাবার ভালোবাসা এবং গুণগ্রাহিতা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল পরিমল রায় নিকটজন। কিছু মানুষকে আমরা জন্মসূত্রে পাই। সে সব সম্পর্ক চাক্ষুষদর্শননির্ভর নয়।আমার কাছে পরিমল রায় তেমনই একজন।"

পরের ছড়াটি  মণিকুন্তলা সেনগুপ্ত  (পরিমল রায়ের কন্যা ) -র কাছ থেকে পাওয়া। এই ছড়াটির এক অন্য মূল্য আছে। মণিদির জন্ম উপলক্ষ্যে পিতা পরিমল রায় ছড়াটি লিখেছিলেন। কিন্তু নিজের কথা, নিজের আবেগ নিয়ে নয়। মণিদির খুদে দাদা তিলকের (পৃথ্বীরাজ রায়ের) জবানীতে। পুত্রের আনন্দের অভিব্যক্তির সাক্ষীও পিতা এবং সেই শিশুপুত্র তো তার পুতুলের মতো বোনটার কথা ভেবে পদ্য লিখতে পারে না ...তাই সেই দায়িত্বও সানন্দে বহন করেন পিতাই। তখন তাঁরা ঢাকার পুরানা পল্টনের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র; তবে ওই জেলাতেই।

এগারো নম্বর বাড়ী, রাঙ্কিন স্ট্রীট
ওয়ারীতে পোস্টাপিস, ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট।
তের-শো বাহান্ন সন, চব্বিশে শ্রাবণ,
ন-মিনিট গত বেলা বারোটা তখন ।
যতদূর মনে পড়ে- বৃহস্পতিবার,
সকলের সবে শুরু মধ্যাহ্ন আহার ।
এ হেন মুহূর্তে এক মহা চীৎকার -
অচেনা অচেনা লাগে, কণ্ঠখানি কার?
আরে এ যে রাধুমণি তুই কোথথেকে?
বোন নাকি? ব'লে দাদা হেঁকে ওঠে ডেকে।
বাবা বলে, ওর নাম মণিকুন্তলা --
দেখেছিস চুলে ওর মণি উজ্জ্বলা ।

পরিমল রায় প্রয়াত হন মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে। তাঁর স্মৃতি ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসে সাহিত্যিক মহলে, পাঠক মহলে। এই বইও আর এখন পাওয়া যায় না। যদিও আমার হাতে যে সংস্করণ আসে, তা বিকল্প থেকে প্রকাশিত..২০০৯ সালে এবং এখন নি:শেষ। বাংলা সাহিত্যের এক অকালপ্রয়াত প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন আমার অতি সীমিত ক্ষমতার বাইরে। তবুও আজ এক অবোধ্য তাগিদে কিছু পছন্দের ছড়া সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম।

অচেনা ক্যালাইডোস্কোপ 
.......................................


 


এ লেখাটি পরিমল রায়ের রম্য রচনা সংকলন "ইদানীং" নিয়ে।

পুরানা পল্টন। ঢাকা শহর। ছেলেপুলের দল যখন পড়ন্ত রোদ্দুর গায়ে পিঠে মেখে ইস্কুল থেকে হইহই করে বাড়ি ফিরত, তখন সেই রাস্তার একটি বাড়িতে একতলার বিশাল বড় ঢাকা বারান্দায় চায়ের আসর বসেছে। মহিলারা   চা খেতে খেতে হাতের কাজ সারছেন, একজন দু'জন পুরুষও চোখে পড়ত কখনও কখনও ...হাসি গল্প আড্ডায় মশগুল। সে এক বর্ধিষ্ণু সংসার ছিল বটে ! মোরাম বিছানো পথ পেরিয়ে তবে বারান্দায় গিয়ে ওঠা। তার আগে পেরোতে হবে একটা বড় লোহার গেট। একপাশে পাথরের ফলকে বাড়ির নাম। “পরম ভবন”  |

আমার আজকের গল্প এই পরম ভবনের বাসিন্দা পরিমল রায়কে নিয়ে। যে পরিমল রায় প্রসঙ্গে তাঁর সুহৃদ বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, " তাঁর মেধা  ছিল তীক্ষ্ণ, কণ্ঠস্থ ছিল রবীন্দ্রনাথ ও কালিদাস, বাংলা উচ্চারণ ছিল সেই পূর্ববঙ্গের পক্ষে আশ্চর্যরকম শালীন, এবং পরিহাসের দ্যুতি, দীপ্তি ও যাথার্থ্যে তিনি ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ঈর্ষাভাজন। আমাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন সমবয়েসীর প্রণয়ের ও গুরুজনদের অমিশ্র প্রশংসার যোগ্য।"

ইদানীং। রম্যরচনা সংকলন। রচনাগুলি নানা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। লেখকের নিজ নাম ও ছদ্মনামে। বই হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে এম . সি . সরকার থেকে। দ্বিতীয় সংস্করণ হয় ১৯৬১ তে। নিউ এজ থেকে। তার ৪৫ বছর পর বইটি আবার প্রকাশ করে বিকল্প। ২০০৬ সালে। এবং এখন আবার তা দুষ্প্রাপ্য। 

বইটি আমার হাতে এল পরিমল রায়ের পুত্র পৃথ্বীরাজ রায়ের কল্যাণে। হাতে এল বললাম বটে। আসলে হাতে এল না। আমার বাবা বইটির দখল নিলেন। বাবা, মায়ের হাত ঘুরে আমার হাতে এল যেদিন আমি কলকাতা ছাড়লাম..তার আগের দিন রাতে। আমি পড়লাম ফিরে এসে। এখনও পড়ছি..কারণ সফল রম্যরচনা কি মাত্র একবার পড়লে মন ভরে?

লেখার বাঘ একবার কামড়ে দিলে সে ক্ষত সহজে নিরাময় হয় না। সেই ক্ষত স্বল্পায়ু পরিমল রায় সানন্দে বহন করতে স্বীকৃত হয়েছিলেন। তাঁর লেখনীর জাদু এমনই, যে বৈদগ্ধ্য আছে, তির্যকতা আছে ..আবার রমণীয়তাও অপ্রতুল নয় একেবারেই। এ লেখা গুরুভার নয়, দুষ্পাচ্য  নয়। বরং অম্লমধুর। পরিশীলিত বুদ্ধিমত্তায় ভরপুর। বুদ্ধদেব বসুর কথা ধার করেই বলি, " পরিহাসে না আছে পিত্তের প্রকোপ, না আছে  বিদূষকের মুখবিকৃতি। "
কল্পনার মিশেল আছে এতই নিপুণ চাতুর্যে, যে তা কোথাও না কোথাও বাস্তবকেই রঙিন করে তোলে।

আমি যেমন..এই বই পড়েই প্রথম জানতে পারলাম এবং ভরসা পেলাম যে "পাগলের কোনো নিরপেক্ষ সংজ্ঞা নাই  | উহা নিতান্তই একটা মতামতের ব্যাপার।"  শুধু আমি কেন, আমার মা-ও দেখলাম এরপর থেকে  মায়ের মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে বাবার বিশেষ বিশেষণ তুচ্ছ করছেন। 

পূজার ছুটি। বাবা দেখি পড়ছেন আর হাসছেন। 
" অধ্যাপকদের কর্মজগতে ছুটিটা একটু বেশি। অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা দুই-ই অত্যন্ত কঠিন কাজ। ভয়ানক মাথার খাটুনি। সেজন্য বিশ্রামগুলিও লম্বা। একবার আরম্ভ হইলে ...শখের থিয়েটারের বিরামের মতো ..আর শেষ হইবার নাম নাই। " এটি গৌরচন্দ্রিকা মাত্র। আসল গল্প এরপর। পাড়ার অধ্যাপক - গৃহিণী মহলের প্রতিযোগিতামূলক খবর বিনিময়। কে কোথায় যাবেন। গিরিডি, না শিলং?  যাঁর ছেলে অসুস্থ, তাঁকে সপরিবারে হাওয়াবদল তো করতেই হবে !।
এবার লেখকের কথা। 
" আমাদের ছেলেটি দুর্ভাগ্যক্রমে ভুগিতেছে না ; এবং আমার স্ত্রীর দু:খ ওখানেই।"  
 পরিমল-জায়া জিজ্ঞেস করেছিলেন..সবাই তো এদিক সেদিক যাচ্ছে। তাহলে তাঁরা কোথায় যাবেন? 
লেখকের জবানীতে ফিরে আসি  |" আমরা কোথায় যাব জানো? আমরা যাব...আমরা যাব..আমরা কোথাও যাব না  !" 
এরপর অবশ্য বাড়িতে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে, বলাই বাহুল্য। কিন্তু লেখকের যুক্তি শুনুন, " স্থান পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হইল নিত্য পরিচিত পরিবেশ হইতে কিছুকালের জন্য মুক্তি। তা সেই পরিচিত পরিবেশের সামগ্রীগুলিই যদি স্থানান্তরিত হয়ে যায়..তাহা হইলে আমাদের আর অর্থব্যয় ও পথশ্রম সহ্য করিয়া অন্যত্র যাইবার কী কারণ থাকিতে পারে?" অকাট্য অজুহাত ! আমি নিশ্চিত,  পুরুষকুল যারপরনাই খুশি হয়ে এই যুক্তি মগজস্থ করলেন। আর এই এই নিবন্ধে পুংকুলের আনন্দদায়ক আর একটি মন্তব্য উল্লেখ না করলে পরে এই বইটি  এখানকার কোনো পাঠকের হস্তগত হলে তিনি নিশ্চিত এ নিয়ে বাক্যবাণ বর্ষণ করবেন এবং কটাক্ষ করে বলবেন, আমি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তথ্য এবং তত্ত্ব গোপন করেছি।
 " স্ত্রীলোকের ব্যক্তিত্ত্ব-বোধ প্রবল নহে। প্রত্যেকে একটি প্রকাণ্ড কোলাহলমুখর জনতাপিণ্ডের অংশ মাত্র। বিচ্ছিন্নভাবে  কাহারও বিশেষ অস্তিত্ব নাই।"  
এই নিবন্ধের শেষ অংশটি আমার বড়ই মনের মতো। 
" নিজেকে লইয়া অবসর-ভুঞ্জনের মতো উৎকৃষ্ট জিনিস আর নাই।"
 কী যে সত্যি কথা ! 

এরপর যুদ্ধ। দু'শো  টাকা আয়ের সংসারে তিনশো সাতাত্তর টাকার বাজেট। এবং অথৈ জল ! খোকা বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল ..বাবা কি বাঘ মারতে পারে? উত্তর ইতিবাচক ছিল, বলাই বাহুল্য। সংসার সমরাঙ্গনে ভাঙা ঢাল আর ভোঁতা তলোয়ার নিয়ে সংসারী পুরুষের নিত্যদিনের যুদ্ধ ...সেকাল ও একালে একইরকম।

প্রবাসে থাকি। “আত্মীয়স্বজন” কথাটি অনবরত মুখে মুখে ফেরে। দু’টি কি সমার্থক? লেখকের উত্তর নেতিবাচক। ‘স্বজন’ কথাটি অনেক আপন, অনেক গভীর। স্বজন মানে আমার নিজের লোক। যেখানে আমি আমার মতো হয়ে কোনো বাহ্যিক আড়ম্বরের চোগা-চাপকান না চাপিয়ে আটপৌরে সাজে আসতে পারি। এই বোধ রক্ত -নিরপেক্ষ। 
 আর ‘আত্মীয়’? রক্ত বা সামাজিক কারণে একসঙ্গে জুড়ে থাকা। কিন্তু অনেক আত্মীয়ই সেই অর্থে স্বজন নন। "অথচ স্বজনসুলভ অন্তরঙ্গতা প্রদর্শন সামাজিক কর্তব্য। নহিলে লোকে মনে করিবে কী ! অথচ মন অতখানি অগ্রসর হইতে প্রস্তুত নহে। এই অন্তর্বিরোধই আত্মীয়তার মৌল পদার্থ।" 

আরও আছে। " সম্পর্ক যত শিথিল, অভিমান তত বেশি। মানসিক দূরত্ব যত বেশি, অভিযোগ অনুযোগের দৌরাত্ম্য তত প্রবল । উহারা আপনার প্রতি অতি  স্নেহশীল। আপনি নিজেই অতিশয় বর্বর, অসামাজিক এবং স্বজন -বিমুখ। তাই এই সকল স্বজাতীয় স্নেহ-সরোবরগুলি এড়াইয়া ইয়ার বন্ধু সমাজের বিদেশী কলের জলে গাত্র মার্জনা করিয়া ফিরিতেছেন। "

পড়ছি আর ভাবছি ...যে কথাগুলো মনে মনে সহস্রবার ভেবেছি, মুখে বলে ওঠার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি...আজ থেকে কয়েক দশক আগে আর একজন মানুষ কত অনায়াসে কোনো কিছুর পরোয়া না করে এই কঠিন সত্য কলমের খোঁচায় প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন।

দাম্পত্য কলহ। সেও লেখনীর গুণে এক অন্য মাত্রা পায় ; যখন " একাদিক্রমে ব্যঙ্গ, শ্লেষ, তাড়না, তিরস্কার ইত্যাদির ছোটখাটো স্টেশনগুলি পার হইয়া ভাষা স্রেফ গালাগালির জংশনে পৌঁছায়।" 

বইটি এগোয় নিজস্ব গতিতে। লেখক এমন সুচারু ভঙ্গিতে লেখেন, যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আমাদের আমোদ জোগানোই তাঁর মূল উদ্দেশ্য। এবং আমরা সাগ্রহে পড়তেই থাকি, পড়তেই থাকি। কিন্তু কখন যেন আমাদের অজান্তেই তিনি চলে যান খেলাচ্ছলে..গভীরতর প্রসঙ্গে। 
" উপভোগ শব্দটির মধ্যে ভোগের একটি মুখ্য রূপের ইঙ্গিত আছে। ভোগ্যের  মধ্যে একটি প্রধান হইলেই অপরগুলি উপভোগ্য পর্যায়ে পড়ে। উপভোগ সেখানে উদ্বৃত্ত প্রাণশক্তির পরিচয় ; প্রাচুর্যের নিদর্শন। ..... যেখানে এক মুষ্টি মনোহীন সজীবতা হাজারখানেক বদ্ধ জলাশয়ে ব্যাঙের ন্যায় লাফালাফি করিতেছে মাত্র, সেখানে হৃদয়-দিগন্তে সমুদ্র-রেখার ইঙ্গিত কোথায়? এ ধরনের সর্বগ্রাসী উৎসাহে কোনো মনের পরিচয় পাওয়া যায় না। কোনো মূলের সন্ধান নাই। "

বিকিকিনির গল্প আসে। লেখক খোকনের ধারাপাত কিনতে গিয়ে খোকনের মায়ের সেলাই শেখার বই কিনে ঘরে ফেরেন। এও বিজ্ঞাপনের পরোক্ষ অবদান। প্রয়োজনের বোধ সৃষ্টি করা। বিক্রেতার দোষ দিয়ে লাভ কী ! সে তো জবরদস্তি করেনি ! আপনারই খানিক পরে মনে হয়েছিল , সীবন শিক্ষা কিনে ফেলতে পারলে একটা কাজের কাজ হয় বটে ! 

আর পছন্দসই কেনাকাটা? ও ব্যাপারে তো মা লক্ষ্মীদের জুড়ি মেলা ভার। তাঁরা কী চান..জানেন না।  কী চান না….কেবল সেটুকুই কোনোরকমে বলতে পারেন। তাই পর্বতপ্রমাণ শাড়ির ভেতর থেকে একটি শাড়িও পছন্দ করা যায় না..কারণ কোনো শাড়ির পাড় বোকা বোকা , কোনোটিতে রঙের বোকামি দোকানিকেও লজ্জা দেয়। আর সত্যিকারের চতুর শাড়ি যে কোন গভীর অরণ্যে আত্মগোপন করে মুচকি হাসি হাসে..কে জানে ! 

 নারী ও পুরুষ ক্রেতা। খুব কিছু ফারাক নেই কিছু কিছু জিনিসে। স্নো  ক্রীম হেজলীন পমেটম? সেও তো কৌটো খুলে পট করে একটি খাবলা তুলে নেওয়া ...পুরুষ হলে ; আর স্ত্রী হলে অল্প  করে মেখেও নেওয়া। চিরুনির ধার মাথায় চালিয়ে পরখ করা , ব্লেড কিনতে গিয়ে পটাং করে মোড়ক খুলে মরচে খোঁজা , টুথ ব্রাশ কয়েকবার হাতের তালুতে ঘষে নেওয়া। বিক্রেতার ব্যাজার মুখ। খদ্দের যে লক্ষ্মী !

কোন পাষণ্ড বলে বাঙালি সম্প্রদায়ের সাহিত্যপ্রীতি নেই? কেউ কেউ তো রীতিমতো লেখক হওয়ার সাধু প্রচেষ্টায় রত। এইসব রচনা মূলত দুই ধরনের। ভ্রমণকাহিনী ও কবিতা সমালোচনা। আর এ কথা বলেছেন লেখক নিজে।  জনসাধারণ শীর্ষক রচনায়।

ভ্রমণ বৃত্তান্ত। কে না জানে যে তার মানেই  সপরিবার দার্জিলিং ভ্রমণ। সেই বিরাট নিবন্ধে সেজবৌদি , রানুপিসি আর রাঙাদিদি বৃত্তান্ত। সেজবৌদির পা মচকানো থেকে রাঙাদিদির হারানো জর্দার কৌটো ঘুরে ফটক থেকে অন্দরমহল। আবার ফটক। মাঝেমাঝে ভ্রমণ কথাটা মনে পড়ে গেলে  নিতান্ত অপরাধবোধে চারটি ভুলভাল উদ্ধৃতি। ফটো? বাতাসিয়া লুপ, টাইগার হিল..বাজারে মেলে। আর অন্য ছবি? ঝর্ণার সামনে রানুপিসি , রুগ্ন ঘোড়ার পিঠে ভাগ্নে নন্তু আর পাহাড়ের গায়ে সেজবৌদির তন্বী সুশ্রী ছোট বোন...বকুল ...ইয়ে ...মন্দ লোকে পাঁচ কথা তো বলবেই ! বয়েই গেল ! এই গোটা বর্ণনা ছবির মতো স্পষ্ট আর নিখুঁত। 

আবার ফিরে যাই  সহজ ভাষায় সহজ উদাহরণের মধ্যে দিয়ে গভীর তত্ত্বকথা এসেছে যেখানে। ঘটনা খুব সাধারণ। লেখকের চোখের খেয়াল কম। ঘরের পাশেই ডাকঘর। নজরে পড়ে না। কোথাও গেলে বাড়ি ফেরার পর গৃহিণী সেখানকার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলে কর্তা নিতান্ত নাচার। কেন? 

" দৃষ্টিশক্তি নির্ভর করে দৃষ্টিকোণের উপর। হয়ত আমার দৃষ্টিকোণ চক্ষুষ্ম|নের দৃষ্টিকোণ হইতে বিভিন্ন। স্বভাব , শিক্ষা ও রুচি অনুযায়ী এক এক জনের দৃষ্টি এক এক দিকে। স্ত্রীলোকের দৃষ্টি ও পুরুষের দৃষ্টি সম্পূর্ণ পৃথক। একটি ভদ্রমহিলার সহিত  আপনার আলাপ হইল। বাড়ি ফিরিয়া বলিতে পারেন , তিনি কী রকম শাড়ি পরিয়াছিলেন , কিংবা তাঁহার কর্ণে স্বর্ণাভরণ ছিল কিনা? আপনি যদি পুরুষ হন , কিছুতেই পারিবেন না ..যতই  চক্ষুষ্ম|ন হন না কেন। কারণ  পুরুষের দৃষ্টি সমগ্র মানুষটির উপর  , যেমন স্ত্রীলোকের দৃষ্টি মানুষ ব্যতীত আর সমস্ত কিছুর উপর। ভদ্রমহিলাটি চলিয়া গেলে মেয়েমহলে তাঁহার বেশভূষা লইয়া তুমুল আলোচনা আরম্ভ হইয়া যাইবে। আপনার হয়ত কেবলমাত্র মনে হইবে , মহিলাটি কথা বলেন ভারী চমৎকার।"

মিথ্যাবাদী বালক। “আত্মরক্ষার প্রথম ও আদিমতম অস্ত্র হইল মিথ্যা বলা। যে বালক বেগতিকে পড়িয়াও মিথ্যা বলিতে পারে না , তাহার সম্বন্ধে চিন্তিত হইবার কারণ আছে। তাহার আত্মরক্ষার সহজ প্রবৃত্তিটি সম্যক পরিস্ফুট হয় নাই , নিজের ভালো মন্দ বিচার করিবার জ্ঞান হয় না , কল্পনাশক্তিও দুর্বল। ...একাধারে বুদ্ধিমান , সপ্রতিভ এবং প্রত্যুৎপন্নমতি না হইলে বানাইয়া বলিবার ক্ষমতা থাকিতে পারে না। আপনার ছেলেটি সত্যবাদী বলিয়া আপনি গর্বিত হইতে পারেন , আমি কিন্তু শুনিয়া দু:খিতই হইব। আমার ছেলেটির মতো উহার বানাইয়া বলিবার ক্ষমতা নাই। "

এরপর সেই জর্জ ওয়াশিংটনের গল্পটি। খুব চেনা। গল্পটি  শুনে আমার পুত্র বলেছিল " ওয়াজ হী নরম্যাল?"  আর এখানেও লেখক দেখি লিখেছেন , " কুঠার হাতে পাইয়া যে বৃক্ষ ছেদন করিয়া কিংবা ছেদন করিয়া সেই দুষ্কর্ম অস্বীকার না করে , সে বালকের চিকিৎসার প্রয়োজন আছে।"  

আনন্দ এক আলোকমঞ্জীর। তাকে দেখা যায় না। অনুভব করতে হয় তার নি:শব্দ  শিঞ্জিনী , তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাই " পঞ্চেন্দ্রিয় উত্তীর্ণ হইয়া প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যখন মানসিক অনুভূতিতে রূপান্তরিত হয় , তখনই উহা আনন্দ।"

আবার ফিরি প্রচ্ছন্ন কৌতুকে। বাড়ি খুঁজতে বেরিয়েছেন লেখক। 

'নিতান্ত আপনজনের মতো আবদারের সুরে নিবেদন করিলাম , 'একখানি ভালো বাসা খুঁজছি।'
'ভালোবাসা খুঁজছেন?'
... কী সর্বনাশ ! আমার কি মতিভ্রম হইয়াছে? আজ বাদে কাল রিটায়ার করিব , এই বয়সে একটি ভদ্রপল্লীর মধ্যখানে রাজপথে  দাঁড়াইয়া ভালোবাসা খুঁজিয়া ফিরিতেছি ! গৃহিণী জানিলে কি আর রক্ষা আছে ?

...সর্বনাশা শব্দ দুইটির মধ্যে উপযুক্ত 'সম ' ফেলিতে না পারিয়া কী কেলেঙ্কারীটাই না বাধাইয়া তুলিয়াছিলাম !"

হাস্যকৌতুকের মোড়কে আসে শিউপূজনের থিসিস লেখা। পদটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিশনেয়ারের। তাঁর কর্মের মধ্যে চাপরাশি সম্প্রদায়ের ওপর ছড়ি ঘোরানো এবং কর্তৃপক্ষের তাঁবেদারি। বেতন ৪৫ টাকা। ফ্রি কোয়ার্টার। কিন্তু শিউপূজন দেখেছে পি এইচ ডি না হলে আর কলকে পাওয়া যায় না। তাই সে গোপনে গোপনে থিসিস লেখে। থিওরি অফ গেট -কিপিং উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু ইণ্ডিয়া। আহা, এত বছর বাদেও..সেই ট্র্যাডিশন সর্বত্র বিদ্যমান। ক্ষমতার বলে অধস্তনের ওপর ছড়ি ঘোরানো  এবং উর্ধ্বতনের পায়ে তৈলমর্দন। এবং এই রচনার শেষে যোগ্যতর প্রার্থী হয়েও শিউপূজনের চাকরি হয়নি। কার্য নির্বাহক সিণ্ডিকেট বিশেষ কাজকর্ম না করা সত্ত্বেও বড় সাহেবের চাপরাশিকে নির্বাচন করে। যথারীতি !

"দেখা" আর "দেখা এবং বোঝা "| যদি শুধু দেখাই সার হয়, তবে একবার দেখলেই শেষ ! আর যদি তা বোঝার জায়গায় নিয়ে আসা যায়..তবেই প্রতিবারের দেখা নতুন নতুন ভাবে উপস্থাপিত হতে পারে। 
" যাহা বুঝি না , তাহা দেখিবার সার্থকতা যৎসামান্য , এবং সে বিবেচনায় না দেখিলেও বিশেষ ক্ষতি নাই। .... আমি কোনদিন আর্ট একজিবিশন দেখিতে যাই না। কারণ আমার চিত্রবোধ নাই। কেবলমাত্র চোখের দৃষ্টিতে যাহা গ্রহণ করিতে পারিব , তাহা তো আর গ্রাহ্য নয় ! পঞ্চেন্দ্রিয় আমাদের পাঁচটি ভৃত্য  বটে , কিন্তু সেই পঞ্চ ভৃত্যের নিপুণ পরিচর্যা শিক্ষাসাপেক্ষ। ছবি দেখিলেই ছবি দেখা হয় না।...আমাদের সব কিছুতেই অধিকার , আমরা সবই দেখিয়া ফিরিতেছি !"

আবার দাম্পত্য কলহ। এবং তারপরে মধুর বচন। লেখক স্ত্রীর প্রতি ক্রুদ্ধ হলে তাঁকে 'ইডিয়ট' বলে সম্ভাষণ করেন কখনো সখনো। কেন? "উহাতে অপরপক্ষ অপমানে এত গর্জাইতে থাকে যে দেখিয়া বড় আনন্দ হয় !"  

আলাপচারিতার দু'টি ধারা। জানা এবং জানানো। লেখক কোনোটিতেই গা ভাসাতে অনিচ্ছুক। কারণ তিনি সব কিছু জানতে চান না। এমনকি যা জানতে চান ..তা আর যাই হোক, চায়ের টেবিলে বা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে নয়। আর জানাবে যে..তার জ্ঞানের পরিধি বিচার করবে কে? লেখক নিজের জানাবার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সন্দিহান। " আমি এমন কী জানি , যাহা অন্যকে না জানাইলেই নয়?"

দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল আসে বয়সে , তখন ঠিক কেমন লাগে? সে এক আশ্চর্য গোধূলিবেলা।  আকাশের অদৃশ্য সীমারেখার এপারে ঝলমলে রোদ , ওপারে মেঘলা আকাশ। মধ্যবর্তী স্থানে রঙের হোরিখেলা। শুধু দেখবার চোখ চাই। 
" একালের তরুণ তরুণীগণ যৌবনের কাঁচা রঙে ঝলমল করিয়া ফিরিতেছে। বয়সের রোদ লাগিয়া আমাদের অবশ্য সে রঙ নাই। কিন্তু যে রংবেরঙের সেকেলে শাড়ি আমাদের মুগ্ধ স্মৃতিকে বেষ্টন করিয়া আছে , কোনো দু:শাসন নবযৌবনের দর্প তাহাকে বিস্রস্ত করিতে পারে এমন সাধ্য নাই।"

বাল্যসখী নিবন্ধে লেখকের  বাকচাতুর্য। 
" ইদানীং লজ্জা , নম্রতা, স্থিরতা ইত্যাদি সেকেলে সদগুণগুলি শিশুদের উপর আরোপ করিলে তাহাদের মাতাপিতাগণ অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। দুষ্টামিটা বুদ্ধির লক্ষণ।  ছেলেটি ধীর স্থির প্রকৃতির হইলে আশংকা থাকিয়া যাইত , উহা হয়ত আসলে বুদ্ধিহীনতারই নিদর্শন। "
লেখক এই দুরারোগ্য মানসিক অবস্থার নাম দিয়েছেন" দুষ্টু কমপ্লেক্স"। এ রোগটি সাধারণত "মায়েদেরই" নাকি হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে "বাপেদেরও "। 

স্বামীনিন্দা প্রসঙ্গ। এ নাকি কিছুই নয় , " নিন্দার ভান করিয়া স্বামীর উৎকর্ষ প্রমাণের প্রয়াস বিবাহিতাদের একটি বিশেষ দুর্বলতা"মাত্র ! এক সখী বড় দু:খে বলেন , স্বামীটি নিতান্ত নিষ্কর্মা। সংসারে সন্ন্যাসীর ভূমিকা। এই উক্তির "কালীপক্ষে ও বিদ্যাপক্ষে দুই তাৎপর্য। প্রথম অর্থের পিছনে অনতিপ্রচ্ছন্ন দ্বিতীয় অর্থ, ‘আমার স্বামী তোমারটির মতো সংসারের আলু পটল গুনিয়া সময় কাটান না। তাঁহার বিদ্যা ও রুচি উচ্চশ্রেণীয় ও ভিন্নধর্মী।’ “
 তখন অপর সখীরও বক্তব্য একই। অর্থাৎ বিবাদ করে কাজ নেই। দুই পুরুষই অতি উচ্চকোটির ! এবং অবশ্যম্ভাবী উপসংহার ... এমন স্ত্রী রত্ন আছে বলেই না ছাইয়ের সংসার আজ সোনার সংসার !  
পড়ছি আর প্রমাদ গণছি। আহা , সত্যি কথা বুঝি এমনি করে বলে দিতে আছে !

দাম্পত্য। এবং কলহ। কলহ ..অর্থাৎ দুই পক্ষের কোলাহল। 
" আমাদের বিসম্বাদে আমার দিকটা নিতান্তই কোলাহলশূন্য। যেটুকু  উষ্মা  উক্ত বিসম্বাদের জীবনীশক্তি , তাহার জন্ম এবং অবস্থান চিরকালই স্ত্রীর অন্ত :পুরে। আমার মানসিক বহির্বাটি সর্বদা পরিচ্ছন্ন। 
.... আমি মনে করি , তর্জন প্রবণতার দিক হইতে স্ত্রী জাতির 'তর্জনী' নাম অতি প্রশস্ত। আমাদের নাসাগ্রে উহারা উদ্যত হইয়াই আছে। 
.... আমার স্ত্রী প্রত্যহ অন্তত একবার হুহুঙ্কারে ঘরে প্রবেশ করিয়া কিঞ্চিৎ উচ্চ কন্ঠে ঘোষণা করেন , মনু আর খোকন ..এই দুই দস্যির তাণ্ডবে তিনি সর্বদা অস্থির। ... আমি কিঞ্চিৎ নিম্নভাবে নিবেদন করি , তাঁহার যেখানে দুই , আমার  সেখানে তিন।" 

এক ছত্র থেকে পরের ছত্রে যাই, এক নিবন্ধ থেকে অন্য নিবন্ধে ..আর অন্ত:সলিলা ফল্গুর মতো তিরতিরে ভালোলাগা ছড়িয়ে যায় শিরায় ধমনীতে। এবং পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বুঝে যাই শুধু মনুষ্যচরিত্র ও পারিপার্শ্বিকতা "দেখলেই " হয় না...সম্যক "অনুধাবন" করতেও জানতে হয়... লেখার আগে ! তা না হলে কি এমনভাবে "নখদর্পণ " লেখা যায়? 

যে ব্যক্তির পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় নখদর্পণে , তাঁকে দেখে লেখকের মনে হয় , " সমস্ত জ্ঞানের পিণ্ড দুই হাতে চটকাইয়া হাত দু’খানি ধুইয়া রাখিয়াছেন। এখন অগণিত তত্ত্বতালাশের সৌগন্ধ দশ আঙ্গুলের বিবিধ মুদ্রায় নিরন্তর উৎসারিত হইতেছে। ..যেন গোটা পৃথিবীকে বাটিয়া চাটিয়া খাইয়া তর্কের ও সন্দেহের মশামাছি তাড়াইয়া নিশ্চিন্ত মতামতের মশারির তলায় অবসর লইয়াছেন।"  

এবার ভেগোলজি। সন্ধ্যাবিদ্যা। মনের কিংবা জ্ঞানের রাজ্যে আলো-আঁধারির জগত। অর্থাৎ বুঝি বুঝি বুঝি না।  জিজ্ঞাসার সংকীর্ণতা থেকে বাঁধনছাড়া হয়ে যথেচ্ছ বিহারের আনন্দ। গন্তব্যবিহীন গমন, ক্ষুধাবিহীন ভুঞ্জন , বক্তব্যবিহীন বাক্য। একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাখি। লেখকের জবানীতে।
" আপনারা এদিক থেকে এই করতে থাকুন। আর আমরা ওদিক থেকে ওই করতে থাকি। আপনারা যদি এটুকু করেন , তাহলে আপনাদের কাছ থেকে আমাদের এতে একটা সত্যিকারের সাহায্য হবে। এখন আমরা যদি  এটা না করি..মানে এদের ব্যাপারটি তো বুঝতে পারছেন? এরা দেবে  না  | কিন্তু দেবে না বললেই তো আর আমরা এ করতে পারি না। আমাদের কেড়ে নিতে হবে। আর তাহলেই বুঝতে পেরেছেন, ওটা বিশেষ দরকার।"

কী সংকেতময় ভাষা  ! কী বিভ্রম ছড়িয়ে গেল ! এ সব বুঝতে হলে বহুকালের সাধনা চাই।  কত কিছুই যে বলা হল ...বোঝানোর দায় তো ভেগোলজিস্ট-এর নয় ! বোঝার দায় যে শুনছে তার ! একবার আয়ত্ত করতে পারলেই কেল্লা ফতে !

অনেকগুলি নিবন্ধের উল্লেখ করলাম। অনেকগুলি বাদও গেল। মোট ৩৫ টি নিবন্ধ আছে বইটিতে। প্রতিটি বিষয়বস্তুর নির্বাচনে চমক জাগিয়েছে আমার মনে। রম্যরচনা এক সরস উপস্থাপনা , যেখানে বিদ্যার আলো আছে..কিন্তু তা লেখনীর জাদুতে এমনই যে অকারণ বাগাড়ম্বর বলে মনে হয় না। সুকৌশলে নিজের মত জনসমক্ষে প্রকাশ করা যায় এবং তা বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে না। সাধুভাষায় লেখা। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও পাঠকের কাছে তা গুরুভার নয়। সাধুভাষায় লেখা বলেই হয়ত রচনার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছে যথাযথ...কারণ রম্যরচনার প্রধান গুণটি হল ছদ্ম -গাম্ভীর্যে হাস্যরসের বাতাবরণ সৃষ্টি করে নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠা করা। 
" শব্দের দ্যোতনা , অক্ষরের ভঙ্গি , বাক্যবিন্যাসের কৌশল এবং সর্বোপরি পাঠকের একান্ত নিভৃত মনোরাজ্য "..এর সব ক'টিকে সুনিপুণ দক্ষতায় নিয়ন্ত্রণ করেছেন যে মানুষটি..তিনি পরিমল রায় । 

"পরম ভবন " দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম। ওই যে শ্বেতপাথরের ফলক। যাতে নাম লেখা ছিল "পরম ভবন"। দেশভাগের পর আর তো তেমন কিছুই আনা যায়নি , পরিমল রায়ের পরিবার বুকে করে ওই ফলকটি নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের দক্ষিণ কলকাতার আবাসে। তারপর তো মাত্র ৪২ বছর বয়সে চলেই গেলেন পরিমল রায়। সময়ের ঘূর্ণিপাকে কোথায় যে হারিয়ে গেল ওই ফলক। কিন্তু সব হারিয়েও কিছু রয়ে গেল। পরিমল রায় রয়ে গেলেন তাঁর খোকন আর মনুর কাছে। 
আর সেই অকালপ্রয়াত লেখকের তরুণী স্ত্রী? শত দু:খেও যাঁর মুখের হাসিটি অম্লান , কন্ঠে গান ... শুধু চোখ দু’টিতে এক বিধুর মায়া জড়িয়ে থাকত নাবালক সন্তানদের জন্য। অসম্ভব মনের জোর না থাকলে আজ থেকে ৬৩ বছর আগে একা হাতে দুটি অবোধ অসহায় শিশুকে সর্বার্থে মানুষ করে তোলা নিতান্ত সহজসাধ্য ছিল না।  দুটি অবোধ শিশু..তারা রক্তমাংসের বাবাকে খুব বেশি দিন পায়নি। স্মৃতিও বড়ই আবছা ...তবু আবার পেয়েওছে। কিছু উত্তরাধিকার। তীক্ষ্ণ ধীশক্তিতে , লেখনীর জাদুতে, কৌতুকপ্রিয়তায় , অমলিন চরিত্রগুণে। 

ওই শ্বেতপাথরের ফলক ...তাই আজও ঝকঝক করে। আলো ছড়ায়। নির্মল আনন্দের। 

 


আলোচক পরিচিতি - বিজ্ঞানের ছাত্রী । কিন্তু প্রথম ভালোবাসা সাহিত্য । তিন দশক ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত । বেশ কিছু অনূদিত বই প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য আকাদেমি, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইত্যাদি বিখ্যাত সংস্থা থেকে । ভাষান্তরের পাশাপাশি নিজস্ব লেখালেখির ঝোঁক । তবে খুব নিয়মিত নয় । ভালোবাসেন টুকরো গদ্য, পদ্য লিখতে । নানা স্বাদের লেখা নিয়ে এবছর প্রকাশিত হয়েছে ওঁর আরেকটি বই 'ম্যাজিক লণ্ঠন'।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।