ধর্ম
জুলাই ৩০, ২০১৫
শান্ত হে, মুক্ত হে -
একটি সদ্ধর্ম-সপর্যা
শিবাংশু দে
'ধর্ম' বলতে যে প্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠীবদ্ধ লোকাচার ও দৈব নিবেদিত অভ্যাসগুলি'কে আমরা চিনি, শাক্যমুনির সময় সে রকম কোনও কিছুর অস্তিত্ত্বও ছিলোনা। প্রাক ও প্রাথমিক বৈদিক জনগোষ্ঠীর একমাত্র 'ধর্মীয়' আচার ছিলো যজ্ঞ অনুষ্ঠান। যেখানে অসংখ্য ও বহুরকম পশুবলি হতো বলে বুদ্ধ তার বিরোধিতা করতেন। তিনি যজ্ঞের উপাসনাকেন্দ্রিক আচারগুলির বিরোধিতা করেননি। কিন্তু 'বেদবিরোধী' তকমাটি তাঁর গায়ে স্থায়ীভাবে লেগে গিয়েছিলো। তাই তিনি যখন 'ধর্ম' শব্দের উল্লেখ করেন তখন সেখানে য়ুরোপীয় Faith নামক সংকীর্ণ ধারণাটির স্থান নেই। যে ধারণা পরবশ হয়ে গ্যালিলিপর্বতের শিখর থেকে নেমে আসা সেমিটিক ধর্মগুলির, অর্থাৎ ইহুদি, খ্রিস্টিয় ও ইসলামিক, অনুসারিরা সঙ্ঘবদ্ধ হতেন, আমাদের বিশ্বাস ও তার অনুপালন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চালিত হতো। যতোদিন না ভিক্ষুসঙ্ঘ বড়ো আকারে সংগঠিত হয়েছিলো, ততোদিন তিনি নিজে ও তাঁর অনুসারীরা 'সদ্ধর্ম' নামক কিছু আচরনীয় নৈতিক উপলব্ধি নিয়ে প্রচার চালিয়ে যেতেন। সেখানে কোনও লোকাচারকেন্দ্রিক রিচ্যুয়ালিস্টিক 'ধর্মীয়' প্রক্রিয়ার স্থান ছিলোনা।
শাক্যমুনি নিজে কুলীন আর্য ক্ষত্রিয়সমাজের সামন্তপরিবার থেকে এলেও অত্যন্ত প্রবলভাবে আর্য বৈদিক বর্ণাশ্রম প্রথাকে অস্বীকার করেছিলেন। বর্ণাশ্রম প্রথা শুধু তৎকালেই নয়, পরবর্তী আড়াই হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষীয় অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বুদ্ধের প্রতি ঘৃণা, অসূয়া ও অরুচির কারণটি 'ধর্মীয়' নয়, অর্থনৈতিক। কারণ বর্ণাশ্রম ও তদ্জনিত বিকশিত দাসপ্রথাই ছিলো ভারতীয় আর্থিক ব্যবস্থার মেরুদন্ড। বুদ্ধ সর্বপ্রথম বলেছিলেন এই বিভাজনটি অলীক, মিথ্যা ও বলপ্রযুক্ত। প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব দুঃখজয়ের সাধনা করার অধিকার আছে। সেখানে রাজা বা পুরোহিতের কোনও ভূমিকা নেই। এই জাতীয় মুক্তচিন্তা সেকালে, সেই পরিবেশে, ঐতিহাসিক পটভূমির সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ কিছু, কী করে তাঁর উপলব্ধির ফসল হতে পেরেছিলো, এটা ভাবলে এখনও স্তম্ভিত হতে হয়। তাঁর উপদেশ ( আমি দর্শন শব্দটি এড়িয়ে যাচ্ছি, কারণ তিনি নিজে কোনও দর্শন রচনা করেননি। তাঁর উপদেশের ভিত্তিতে পরবর্তীকালে যে মনন মন্থন হয়েছে সেখানে বহু দার্শনিক সূত্রের অবকাশ পাওয়া গেছে) সম্পূর্ণভাবে নৈতিকতার যুক্তি আধারিত। তৎকালীন আর্যসমাজের প্রাকৃত দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা যজ্ঞানুষ্ঠানকে তার সামনে ছেলেখেলা বলে বোধ হয়। আধুনিককালের সনাতনধর্মীয় ব্যাখ্যা, যা মূলতঃ স্বামীজী কথিত, " বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের বিদ্রোহী সন্তান" ধাঁচটিই অনুসরণ করে। যার যৌক্তিকতা স্বীকার্য নয় নানা কারণেই।
মহাযান ও হীনযান, যার আসল নাম মহাসাংঘিক ও থেরবাদ, তাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ অতি জটিল এক প্রক্রিয়া। গৌতমবুদ্ধ নিজের জীবৎকালে ভিক্ষুসঙ্ঘকে যথাসম্ভব পরিশীলিত ও অনুশাসিত একটি সামাজিক চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আমরা জানি, তাঁর প্রচারিত সদ্ধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শ্রেষ্ঠী ও বৈশ্যসমাজ। তাঁর সমসাময়িক আজীবক বা জৈনমতের অনুসারীরাও ছিলেন মূলত বণিকসমাজের মানুষ। এর একটি অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। সমাজের এই বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষদের নিজস্ব জীবিকাকে বিকশিত করার জন্য সামাজিক শান্তির প্রয়োজন। বুদ্ধ বা মহাবীর, চিরকাল এই সামাজিক শান্তির পক্ষেই ওকালতি করে গেছেন। তাই এই দুই মতানুসারী গোষ্ঠী চিরকাল বণিকসমাজের থেকে সর্বৈব সহায়তা পেয়ে এসেছে। কিন্তু ভারতীয় ও অনুশাসন, এই দুই ধারণা কখনও একযোগে থাকতে পারেনা। বুদ্ধ অনুভব করছিলেন সঙ্ঘে অনুশাসন ও নিবেদিত প্রত্যয়ের অভাব দেখা দিচ্ছে। সচেতনভাবেই তিনি কুশীনগরের দিকে তাঁর শেষ যাত্রার আয়োজন করেছিলেন।৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রায় আশি বছরের রোগজীর্ণ শরীর ও ক্লান্তি তাঁর সঙ্গী হয়েছিলো। তাঁর পরিনির্বাণের খবর পেয়ে সুভদ্দ নামে এক ভিক্ষু বলে ওঠেন, " আঃ, বাঁচিলাম। কঠোর শাসন হইতে আমাদের উদ্ধার হইলো। এখন আমরা যা খুশি করিতে পারিব।" এই সময় সঙ্ঘে রীতিমতো স্বৈরাচার মাথা তুলতে থাকে। প্রবীণ স্থবিররা একজোট হয়ে রাজগৃহে সপ্তপর্ণী গুহার সামনে বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য মহাকাশ্যপ'কে সঙ্ঘথের নির্বাচিত করেন ও প্রথম সংগীতি'র আয়োজন করে অবস্থা সামাল দেন। এর একশো বছর পর ৩৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সঙ্ঘথের ছিলেন সর্বকামী। সেই সময় 'দশবস্তু' নিয়ে বৈশালীর বজ্জিপুত্তদের সঙ্গে অন্য থেরবাদীদের প্রবল মতান্তর দেখা দেয়। তক্ষশীলা থেকে স্থবির রেবত এসে উব্বাহিকা করে অবস্থা সামলাতে চাইলেন। কিন্তু বজ্জিপুত্তরা বিদ্রোহ করে পৃথক দল তৈরি করলো, 'মহাসাংঘিক' নাম নিয়ে। যদিও বিদ্যা-বুদ্ধি-অর্থ-প্রতিপত্তিতে থেরবাদীরা অনেক এগিয়ে ছিলো, কিন্তু এই বিভাজনটি আটকানো গেলোনা। থেরবাদী ও মহাসাংঘিক দুটি পৃথক নিকায় হয়ে গেলো। এর পর ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের আয়োজিত মহাসংগীতির সময় মহাসাংঘিকদের মধ্যে ছয়টি পৃথক নিকায় ও থেরবাদীদের মধ্যে বারোটি ভিন্ন নিকায়ের সৃষ্টি হয়ে গেছে। পিয়দস্সি অশোক নিজে থেরবাদী মতে আস্থা রাখতেন বলে সে সময় সমগ্র দেশে থেরবাদীরা প্রাধান্য পেয়েছিলো। কিন্তু পুষ্যমিত্র সুঙ্গের হাতে মৌর্যশাসনের অবসান হয়ে যেতে সদ্ধর্মের কেন্দ্র ক্রমশঃ পূর্ব ভারত ছেড়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে স্থানান্তরিত হয়ে যেতে থাকে। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে অন্ধ্রসাম্রাজ্যে মহাসাংঘিক নিকায়ের অন্তর্গত একটি নিকায় 'চৈত্যবাদ' এবং বর্তমান মহারাষ্ট্রে তৎকালে শক্তিশালী 'সস্মিতীয়' নিকায় এই দুই মত মিলে মহাযানপন্থী সাধনা বিকশিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি আরো স্থিতি পায় যখন বাহ্লীকদেশের রাজা কণিষ্ক সদ্ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করেন । গান্ধারের পাঠানজাতির দুই ভাই অসঙ্গ ও বসুবন্ধু'র 'হেতুবাদ' ও তার প্রায় দুশো বছর আগে অন্ধ্রের নাগার্জুনের মাধ্যমিক বা 'শূন্যবাদে'র চর্চা শুরু হয়। এগুলি মহাযানপন্থী ধারা। খ্রিস্টিয় প্রথম শতক থেকে থেরবাদ বা হীনযানী সাধনা বিকশিত হয় মূলত সিংহল দ্বীপে।
'নির্বাণ' শব্দের আভিধানিক অর্থ নিভে যাওয়া। মাটির প্রদীপ বা জীবনপ্রদীপ, উভয়ের জন্যই এই পদটি প্রযোজ্য। এককথায় জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যাওয়া। এ হলো শব্দগত অর্থ। কিন্তু শাক্যমুনির নিজের ও তাঁর অনুগামীদের অনুসৃত অসংখ্য নিকায় অনুযায়ী তার অর্থের এতো রকম ব্যাখ্যা হয়েছে যে এক কথায় কোনও পরিভাষা দেওয়া যায় না।
বেশ কিছু মানুষের ব্যাখ্যা অনুযায়ী বুদ্ধ স্বয়ং আত্মার বিনাশকেই নির্বাণ মনে করতেন। এই পরিভাষাটি কেন্দ্র করে আদি শঙ্করাচার্য থেকে খ্রিস্টিয় মিশনারিরা তাঁকে 'বিনাশবাদী' বা নিহিলিস্ট দর্শনের প্রবক্তা বলে কটাক্ষও করেছেন। তিনি নিজে 'নির্বাণে'র কোনও পরিভাষা নথিবদ্ধ করেছিলেন কি না, তার কোনও সাক্ষাৎ প্রমাণ নেই। তাঁর দেহাবসানের প্রায় পাঁচশো বছর পরে একটি পালি প্রতিবেদনে পাওয়া যায় তিনি নাকি নির্বাণ'কে প্রদীপ নিভে যাবার সঙ্গেই তুলনা করেছিলেন। কিন্তু শ্রোতারা যখন তাঁকে প্রশ্ন করে নির্বাণের পর কী থাকবে, তিনি বলেন কিছু থাকবে না। আবার প্রশ্ন করা হলো, থাকা-না-থাকার মাঝে কোনও অবস্থান থাকবে কি? তিনি বললেন , না। পুনর্বার প্রশ্ন এলো, থাকা-না-থাকার ঊর্ধে কোনও অবস্থা থাকবে কি? তিনি আবার বললেন, না। তার অর্থ নির্বাণ মানে অস্তি, নাস্তি বা তার ব্যতিরেকে কোনও তৃতীয় অবস্থাও নয়। সে এক অনির্বচনীয়, অর্থাৎ বচনের অতীত উপলব্ধি। এই অবস্থাটিকে মহাযানে পরবর্তীকালে 'শূন্য' অবস্থা বলা হয়েছে।
আমি আগে উল্লেখ করেছি পিয়দস্সি অশোক থেরবাদে অনুগত ছিলেন বলে তাঁর সময়ে মহাসাংঘিক বা মহাযানীরা বিশেষ প্রশ্রয় পায়নি। সুঙ্গশাসন আসার পর তিনশো বছর ধরে মহাযানপন্থার অক্ষপথটি দেশের উত্তর-পশ্চিমে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। বাহ্লীকের রাজা কণিষ্কের পোষকতায় বৌদ্ধমতের এই শাখাটি বিকশিত হয়ে ওঠে। কণিষ্কের গুরু ছিলেন অশ্বঘোষ। রাজা তথা শিষ্যের অনুরোধে তিনি জনসাধারণের বোধগম্য করে শাক্যমুনির জীবনী ও ভাবধারা'কে লিপিবদ্ধ করতে উদ্যমী হ'ন। শাক্যমুনির মহানির্বাণের পাঁচশো বছর পরে সেকালের সব চেয়ে প্রামাণ্য বুদ্ধজীবনী 'বুদ্ধচরিত' তাঁর কলমে রচিত হয়। তাঁর নিজের ভাষায় বৈদ্যরা যেমন তিক্ত ঔষধের সঙ্গে মধু মিশ্রিত করে রোগীকে সেবনের জন্য পরিবেশনা করেন , তেমনই তিনি বৌদ্ধমতের দুরূহ ও জটিল সন্দর্ভগুলি কাব্যাকারে লিখে মানুষের মধ্যে প্রচার করছেন। তিনি'ও নির্বাণ বিষয়ে নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। একথা জানিত যে শাক্যমুনির সঙ্গে তাঁর সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি। উপরন্তু মাঝখানে পাঁচশো বছর কেটে গেছে। কিন্তু সেকালে অশ্বঘোষ ছিলেন রাজগুরু এবং সর্বজনমান্য বৌদ্ধমতের প্রধান প্রচারক ও গুরু। তাই তাঁর ব্যাখ্যা'কে অস্বীকার করা যায়না।
" দীপো যথা নিবৃর্তিমভ্যুপেতো
নৈবাবনিং গচ্ছতি নান্তরিক্ষম
দিশং ন কাঞ্চি`য় বিদিশং ন কাঞ্চিৎ
স্নেহক্ষায়াৎ কেবলমেতি শান্তিম ।।
এবং কৃতী নিবৃর্তিমভ্যুপেতো
নৈবাবনিং গচ্ছতি নান্তরিক্ষম
দিশং ন কাঞ্চিদ্বিদিশং ন কাঞ্চিৎ
ক্লেশক্ষয়াৎ কেবলমেতি শান্তিম ।।
অস্যার্থ,
প্রদীপ যেমন নিভে যাবার পর পৃথিবীতে যায়না, আকাশে যায়না, দিকদিগন্তরেও যায়না; তেল শেষ হলেই প্রদীপেরও শেষ; সাধকও তেমনি ভাবে পৃথিবী, আকাশ, দিকদিগন্তর কোথাও যান'না। তাঁর ক্লেশের অন্ত হয়। তাঁর সব কিছু শেষ হয়ে শান্ত হয়ে যায়।
এখানে অশ্বঘোষ কিন্তু সমগ্র অস্তিত্বলোপের কোনও ইশারা করেননি। বরং এর পরেই তিনি বলছেন তৃষ্ণাই যেহেতু সব জন্মের হেতু তাই তৃষ্ণাচ্ছেদন করলেই মুক্তির আস্বাদ পাওয়া যায়। এখানে তিনি 'ধর্মে'র একটি নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তা একটি উপলব্ধিমাত্র। তিনি বলছেন, তুমি যদি এই 'ধর্ম'কে প্রত্যক্ষ করো তবে তোমার তৃষ্ণা তথা দুঃখের ক্ষয় হবে। কারণ এ 'ধর্ম' শান্তিময়, মঙ্গলময়, তৃষ্ণাবিরোধী, পরিত্রাণকারী। এ এক চরম ও অচ্যুত পদ। এখানে জন্ম নেই, জরা, মৃত্যু, ব্যাধি নেই, শত্রুসমাগম, নৈরাশ্য, প্রিয়বিরহ কোনও কিছু নেই। এই 'ধর্ম' ,অর্জন করার উপযুক্ত ও শ্রেষ্ঠ বোধ। অতএব তিনি এখানে অস্তিত্বের পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, লোপের নয়। সেক্ষেত্রে 'নির্বাণ'কে বিনাশকারী অবস্থা মনে করাটা ঠিক স্বীকার্য নয়।
মহাযানী শূন্যবাদে 'শূন্য' মানে ভ্যাকুয়াম নয়। " অস্তিনাস্তিতৎ উভয়নুভয় চতুষ্কোটি বিনির্মুক্তং শূন্যম।" অর্থ, শূন্য মানে একটি অবস্থা, যা অস্তিনাস্তি প্রভৃতি চারটি অবস্থার অতীত। অতএব উক্ত পালি প্রতিবেদন ও অশ্বঘোষের ব্যাখ্যা অনুযায়ী 'নির্বাণ' ভাষা, বাক্য, ধারণার অতীত এক অনির্বচনীয় অবস্থা। য়ুরোপীয় দার্শনিকেরা বহুকাল পরে এই অবস্থাটিকে ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল অর্থাৎ অতীন্দ্রিয়বোধের কাছাকাছি কোনও অবস্থান বলে মনে করতেন। অশ্বঘোষ-উক্ত 'অচ্যুতপদ' কিন্তু 'অস্তি' নয়। কারণ আত্মা থাকলেই অহং থাকবে, জ্ঞান থাকবে, একত্ব সংখ্যা থাকবে। জ্ঞান থাকলেই দুঃখ থাকবে। অতএব অশ্বঘোষের ব্যাখ্যায় বুদ্ধ বলছেন, আত্মার অস্তিত্ত্ব যতোক্ষণ স্বীকার করা হবে, ততোক্ষণতার মুক্তি হবেনা। তাই আত্মার অস্তিত্ব নষ্ট করে তাকে চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত না করা পর্যন্ত নির্বাণ আসবে না।
শাক্যমুনির সমসময়ে, অর্থাৎ আদি ও মধ্য বৈদিক যুগে যেসব ঐশী অস্তিত্ত্বের উপাসনা করা হতো তাঁরা সব বিভিন্ন প্রাকৃত শক্তি; অগ্নি, বরুণ, মরুৎ, পর্জন্য, অর্যমা ইত্যাদি। এই উপাসনার উদ্দেশ্যই ছিলো এই সব শক্তিকে ভজনা করে ঐহিক লাভ সন্ধান করা। বস্তুত বিভিন্ন বেদের যাবতীয় ব্রাহ্মণে শুধু দেহি দেহি রব। গুপ্তযুগের পরবর্তীকালে সব পুরাণেও এই দৈব ভিক্ষাবৃত্তির বিরাম নেই। বরং তা আরো প্রকট হয়েছে। এমত স্পিরিচুয়াল বাতাবরণে গরিষ্ঠের কাছে শাক্যমুনির উপদেশ পৌঁছে দেবার সর্বাধিক সমস্যা ছিলো সেখানে কোনও নগদ'বিদায়ের প্রত্যাশা ছিলোনা। ব্রাহ্মণরা খুব জোরের সঙ্গে দাবি করতো যজ্ঞ ইত্যাদি করলে হাতে হাতে গোধন, ভূধন, স্ত্রীধন, কাঞ্চন সব লাভ হবে। উপরন্তু বোনাস হিসেবে অনন্ত স্বর্গবাসের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। সেখানে শাক্যমুনি স্বর্গের অস্তিত্ত্বেই বিশ্বাস করেন না। উপরন্তু পাবার মধ্যে রয়েছে শুধু নির্বাণের হাতছানি। আর নির্বাণ মানে শুধু নেতি নেতি। সব কিছু বিনাশপ্রাপ্ত হবার নিশ্চিত আহ্বান। 'নির্বাণ' মানে এক অনির্বচনীয় অবস্থা। যাকে ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না, বোঝা যায়না। শাক্যমুনি বলেন দুঃখ দূর করো, দুঃখের কারণ দূর করো, তৃষ্ণা দূর করো, কামনা দূর করো, তবেই মোক্ষ, তবেই নির্বাণ। এদিকে ব্রাহ্মণরা বলে যাচ্ছেন যজ্ঞবলে যে সম্পদলাভ হবে তা দিয়ে তুমি সব ঐহিক দুঃখের সমাধান করে দিতে পারবে। এখানে একটা 'কিন্তু' আছে। এই লাভ কিন্তু সবার জন্য নয়। তা শুধু উচ্চবর্ণের মৌরসিপট্টা। তবে সংখ্যাগুরু অন্ত্যজদের জন্য কী উপায় নির্দিষ্ট হবে? এই অনিশ্চিত অধ্যাত্ম স্পেসটিকে বুদ্ধের আশ্বাস দখল করে নিলো। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে।
প্রথমযুগের বৌদ্ধরা নির্বাণের এই 'চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত' আত্মার বিনাশকে স্বীকার করে নিয়েছিলো। কিন্তু কালক্রমে এতোটা বিমূর্ত কোন ধারণার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়লো। শূন্যরূপ আত্মার ধারণাকে পরিবর্তিত করে তারা বললো জীবন হলো 'ভাব'পদার্থ আর নির্বাণ হলো 'অভাব'। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে এটাও স্পষ্ট হলো যে সংসারও বস্তুত নেতিপদার্থ, অর্থাৎ তাকেও 'অভাব' বলা যায়' । এই যুক্তিতে ভব ও নির্বাণ দুইই শূন্য। বৌদ্ধ ধর্মের এই পর্যায়টা আসতে প্রায় এক হাজার বছর লেগে গিয়েছিলো। আমাদের ইতিহাসে সেটা চর্যাপদের যুগ। লামা সরহপাদের দোহা'তে আছে,
" অপণে রচি রচি ভব নির্বাণা।
মিছেঁ লোঅ বন্ধাবএ অপনা।।
অর্থ, ভব শূন্যরূপ, নির্বাণও শূন্যরূপ। ভব ও নির্বাণে কোনও ভেদ নেই। মানুষ আপন মনে ভব রচনা করে, নির্বাণও রচনা করে। এইভাবে তারা নিজেদের ক্রমশঃ বদ্ধ করে ফেলে। পরমার্থ সন্ধান করতে গেলে কিছুই পাওয়া যাবেনা। সবই শূন্যময়। তাঁদের স্লোগান হলো ' শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত স্বরূপ"। পরম যোগীও মুক্ত, চরম পাপিষ্ঠও মুক্ত। এই পথেই সহজিয়া বৌদ্ধমতের যাত্রা শুরু হলো। তবে আগেই বলেছি, তা পরবর্তীকালের ক্রমবিকাশ।
মহাযানীরা, কেবল শূন্যতায় পর্যবসিত হওয়াই জীবনের চরম উদ্দেশ্য, এই ম্যাক্সিমটি মেনে নিতে পারলেন না। তাঁরা এর সঙ্গে 'করুণা' নাম দিয়ে একটি ধারণার সূচনা করলেন। এটি ব্যক্তিগত সাধারণ করুণাভাব নয়। সর্বজীবে, সর্বভূতে করুণা। ইতোপূর্বে নির্বাণের সূত্রে তাঁরা রূপধাতুকে অরূপধাতুতে পরিবর্তিত করেছিলেন। সে কারণে সমস্ত পদার্থকেই আকাশের মতো অনন্ত অনুভব করতেন। এই নবসংযোজিত করুণাভাবকেও তাঁরা আকাশের মতো অনন্ত ঘোষণা করলেন। যে নির্বাণ এতোদিন শুধু শূন্য ছিলো, নিশ্চল, নিষ্প্রাণ, নিস্পন্দ, করুণাভাব তাতে প্রাণসঞ্চার করলো। অরহৎ হয়ে যাঁরা মুক্তির সাধনা করার সংকল্প করেছিলেন তাঁরা পার্থিব জগতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী বিজড়িত থাকলেও তার প্রতি পূর্ণ উদাসিন ছিলেন। নির্বাণের সঙ্গে করুণার সংযোজনে তাঁরা শুধু আত্ম উদ্ধারের জন্যই ব্যাকুল থাকাটা সমীচীন মনে করলেন না। জগৎ উদ্ধারের তাঁরা আকুলতা বোধ করলেন। ব্যক্তিগতভাবে নির্বাণ লাভ করে লক্ষ্যপূর্তির স্বার্থসন্ধ উপায়কে তাঁরা ত্যাগ করলেন। আমি মুক্ত হবো আর কোটি কোটি জীব সংসারের মায়ায় বদ্ধ থাকবে, এই আত্মপরতাকে তাঁরা বিসর্জন দিলেন। মহাযানী বৌদ্ধ দর্শন, বাকি সব কীর্তিকে যদি অস্বীকারও করি, শুধু এই উপলব্ধিটির জন্য বৃহত্তর মানবজাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকলো। শাক্যমুনির পরম করুণাময় প্রতিচ্ছবিটি এভাবেই মূর্ত হয়ে ওঠে আগামী পৃথিবীর কাছে। এই পর্যায়ের নিরীক্ষার মাধ্যমে আরেকটি নতুন ধারণার সৃষ্টি হলো। এক নিবেদিত দৈবী কল্যাণকারক অস্তিত্ব, বোধিসত্ব। যিনি বোধির পথে অগ্রসর, কিন্তু বুদ্ধত্ব লাভ করেননি। আপামর মানুষের কল্যাণহেতু যাঁর পথচলা।
একজন বোধিসত্ত্ব ছিলেন । যাঁর নামটা সবারই খুব চেনা। অজন্তা গুহায় পদ্মপাণি তাঁর প্রতিকৃতিটির সঙ্গে আমরা শৈশব থেকে পরিচিত। তাঁর নাম অবলোকিতেশ্বর।
তিনি যখন সংসারের সব কৃত্যকর্তব্য শেষ করে, বোধিসত্ত্বের উপযুক্ত ধ্যান ধারণাদি সম্পন্ন করে ধর্মস্তূপের শিখর থেকে শূন্যতা ও করুণাসাগরে ঝাঁপ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন অসংখ্য মানুষের আর্তকোলাহল তাঁর কানে এলো। তখন তাঁর আমিত্ব নেই, তিনি আকাশের মতো অনন্ত সত্ত্বা, সাগরের মতো অনিঃশেষ তাঁর করুণা। তিনি প্রশ্ন করলেন, কিসের কোলাহল? লক্ষকোটি দুঃখনিপীড়িত জীব আর্তস্বরে বোধিসত্ত্বকে বললো, আপনি করুণার অবতার। আপনি যদি নির্বাণপ্রাপ্ত হয়ে যা'ন তবে আমাদের কে উদ্ধার করবে? ব্যথিত অবলোকিতেশ্বর তখন ঘোষণা করলেন, যতোক্ষণ জগতের একটিমাত্র জীবও বদ্ধ থাকবে, আমি নির্বাণ গ্রহণ করবো না।
সে সময় বৈদিক ধর্মে দৈবী দয়া, অনুগ্রহ ইত্যাদি প্রাপ্ত করার জন্য নানা উপায় ব্যক্ত ছিলো। কিন্তু তার মধ্যে করুণার কোনও উল্লেখ ছিলোনা। উল্লেখ্য, দেবতা দয়া করেন, অনুগ্রহ করেন, বরপ্রদান করেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত কোনও দেবতাকে করুণাময়রূপে আমরা দেখিনি। বস্তুত করুণা এমন একটা ভাব যা একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের প্রতিই বোধ করতে পারে। এই করুণার মাত্রা যোজনা করেই বৌদ্ধ দর্শন পৃথিবীর আর পাঁচটা ধর্মমতের থেকে একটা মহত্তর স্থান অর্জন করে ফেলে। আরো কিছুকাল পরে খ্রিস্টিয় দর্শনে করুণা একটা গরিমা হিসেবে গৃহীত হয়। খ্রিস্টের ধর্মে এই সংযোজনটি নিতান্তভাবে বৌদ্ধমত থেকে পাওয়া। কারণ আর কোনও সেমিটিক ধর্মে এ জাতীয় গরিমা নেই। বস্তুত খ্রিস্টিয় প্রথম শতক থেকে পঞ্চম শতক , অর্থাৎ প্রাক গুপ্তযুগ থেকে গুপ্তসাম্রাজ্যের শীর্ষ কাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে বৌদ্ধদের মধ্যে এই মতটিই সর্বমান্য ছিলো। সঙ্গত কারণেই তাঁদের ধারণা হয়েছিলো এর থেকে মহান কোনও অধ্যাত্ম মত বিকশিত হতে পারেনা। কারণ সমান্তরাল ব্রাহ্মণ্যমতে তখন ধর্মানুষ্ঠান মানে পশুবলি, যজ্ঞানুষ্ঠান বা অগভীর লোকাচারের বহ্বাড়ম্বর। বৌদ্ধদর্শনের এই করুণাময় মুখটিই সেদিন মানুষ মহাযান বলে জানতো। বোধিসত্ত্বেরা সর্বদা করুণায় অভিভূত। তাঁরা জন্মের বাঁধন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে গেছেন, তবু জীবের উদ্ধারের জন্য বারম্বার জন্ম নিতে দ্বিধা করছেন না। জীবের কল্যাণের জন্য তাঁরা স্বয়ং বুদ্ধের পঞ্চশীলের সঙ্গেও আপোস করতে প্রস্তুত। নাগার্জুনের শিষ্য আর্যদেব তাঁর 'চিত্তবিশুদ্ধিপ্রকরণে' বলেছিলেন, জগৎহিতায়, জীবের মঙ্গলের জন্য যদি কোনও আগ্রহী ব্যক্তি আপাতভাবে কোনও দোষও করে, তা ধর্তব্য নয়।
এই পর্যায়টি ছিলো বৌদ্ধধর্মের শীর্ষ সমৃদ্ধি এবং তা মহাযানী মতের আশ্রয়েই বেড়ে উঠেছিলো। শাক্যমুনির পরবর্তী প্রায় হাজার বছর ধরে সারা দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, অধ্যাত্মিক, সর্বক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উন্নতির ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। এই ঐহিক সাফল্যের ইতিবাচক প্রভাব ধর্ম ও দর্শনের উপর গভীরভাবে পড়েছিলো। আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে নির্বাণের পরিভাষাও বদলে যেতে থাকে।
মহাযান ও হীনযানে নির্বাণের প্রকৃতি, স্বরূপ ও প্রয়োগ একেবারে ভিন্ন। থেরবাদী বা প্রত্যেক বুদ্ধরা, যাঁরা বস্তুত হীনযানী, মনে করতেন যেসব মানুষ চারটি আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ নিষ্ঠাভরে মেনে চলেন, বহুকাল অভ্যেসের পর তাঁরা 'সোতাপন্ন' বা অধ্যাত্ম উন্নতির স্রোতের মধ্যে পড়ে যান। তাঁদের বারম্বার জন্ম হলেও তাঁরা আবার সংসারের মায়ায় ফিরে যাননা। 'সোতাপন্ন' মানুষ যখন আরো একবার জন্মগ্রহণ করেন তখন তাঁর অবস্থা হলো 'সকৃদাগামী'। অর্থাৎ তিনি আর জন্মগ্রহণ করবেন না ও নির্বাণের অধিকারী হয়ে গেলেন। স্বয়ং গৌতমবুদ্ধ'কে 'সকৃদাগামী' মনে করা হতো। সকৃদাগামী মানুষ সাধনার পরবর্তী স্তরে হয়ে যান 'অনাগামী' ও তার পর 'অরহৎ'। অরহৎ হবার পরেও যদি কেউ কিছুদিন জীবিত থাকেন তবে তিনি মুক্তপুরুষ হিসেবে জ্ঞাত হ'ন। তার নাম স্বউপাধি শেষনির্বাণ। এই নির্বাণে কিছু 'উপাদান' অর্থাৎ পুনর্জন্মের রেশ কিন্তু থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ সমগ্র কর্মক্ষয় এখনো হয়নি। এই জীবন্মুক্ত অবস্থায় অরহৎ আরো কিছুদিন থাকতে পারলে তাঁর সব কর্মের ক্ষয় হয়, কোনও সঞ্চয় থাকেনা। তখন তাঁর মৃত্যুর কাল উপস্থিত হয়। মৃত্যুর পর তিনি 'নিরুপাধি শেষনির্বাণ' ধাতুতে প্রবেশ করেন। তখন তাঁর কোনও কর্ম থাকেনা, কর্মজনিত সংস্কারও থাকেনা, তিনি নির্বাণ অর্জন করেন। হীনযানী বা প্রত্যেকযানীদের কাছে যাবতীয় জাগতিকমাত্রাগুলির কোনও সম্মান নেই। তাঁদের জন্য জগতের থাকা না থাকা কোনও পৃথক ভাবসঞ্চার করেনা। নির্বাণপ্রাপ্ত হলে তাঁরা একেবারে নৈসর্গিক গুণসম্পন্ন হয়ে পড়েন। কাঠ, পাথর, মাটির মতো প্রাণের লক্ষণহীন। পারিপার্শ্বিক থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত ও তিরোহিত।
মহাযানীরা স্বভাবতই হীনযানীদের এই নির্বাণপ্রক্রিয়াটি'র নিন্দা করে থাকেন। তাঁদের মতে গোটা ব্যাপারটাই নীরস, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর ও সংকীর্ণমনা। তাঁরা বিশ্বাস করেন নির্বাণ মানুষকে করুণাময় করে, পরার্থপর করে। ব্যক্তিগত অর্জনের থেকে সমষ্টির কল্যাণই একজন নির্বাণপ্রাপ্তের প্রেয় লক্ষ্য। তাঁরা বলেন 'নির্বাণ'কে নিষেধমুখে, অর্থাৎ নেতিবাদী চর্চার অভিমুখ থেকে দূরে রাখতে হবে। নির্বাণের সার্থকতা নির্ধারিত হবে বিধিমুখে, অর্থাৎ ইতিবাচক চর্চায়। হীনযানীদের কাছে নির্বাণ মানে আত্মার, জ্ঞানের, বুদ্ধির বিনাশ। কিন্তু মহাযানীরা মানেন না যে পরম কারুণিক শাক্যমুনি এইরকম নেতিবাচী দৃষ্টিকোণ থেকে নির্বাণকে পরিস্থাপিত করেছেন। তাঁদের মতে জীবনে চারটি আর্যসত্য ও অষ্টাঙ্গিক মার্গের সুপথে স্থিত হয়ে সাধনা করাই নির্বাণের উদ্দেশ্য। মানবহৃদয়ের যাবতীয় আকাঙ্খা, ঈপ্সা'কে বলিদান দিয়ে বিনাশ করা নির্বাণের উদ্দেশ্য হতে পারেনা। আশা-আকাঙ্খাকে চরিতার্থ করতে হবে, কিন্তু তাতে বদ্ধ থেকে গেলে হবেনা। সর্বদা তার ঊর্ধে যাবার প্রয়াস পেয়ে যেতে হবে। এর নাম নিরালম্ব নির্বাণ। এই পথে বোধিচিত্ত যাবতীয় ক্লেশ, কুদৃষ্টি থেকে অব্যাহতি পাবেন এবং ধর্মকায়ের পবিত্র মূর্তি দেখতে পাবেন। তাঁর পথপ্রদর্শক হবে সর্বভূতে করুণা ও সর্বব্যপী জ্ঞান। তিনি 'সম্যক সব্বোধি' অর্জন করবেন এবং নির্বাণ লাভের জন্য কোনও দুর্বলতা বোধ করবেন না। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হবে সর্বজীবের পরিত্রাণ এবং সে জন্য তিনি বারম্বার জন্ম নিতেও দ্বিধা করবেন না। তিনি সর্বব্যপী প্রজ্ঞাবল লাভ করবেন এবং সমস্ত প্রাণীর মুক্তির জন্য জীবনের যাবতীয় উৎসাহ নিয়োগ করবেন। তাঁর নির্বাণে তৃপ্তি নেই, নির্বাণে আসক্তি নেই, নির্বাণে বসতিও নেই। তাঁর ভব বা নির্বাণ কোনও আলম্বনই নেই। তাই তাঁর নির্বাণের নাম নিরালম্ব নির্বাণ।
মহাযানীদের মধ্যে আরেক রকম নির্বাণেরও খোঁজ পাওয়া যায়। সেটি ভব বা নির্বাণের অতীত এক পরম মুক্তি । ধর্মের যে তত্ত্ব বা তথত, তাকে তাঁরা ধর্মকায় বলে থাকেন। যিনি মুক্তিলাভ করেন তিনি তথাগত, অর্থাৎ তিনি পরমসত্যে আগত হয়েছেন। ধর্মকায় মহাযানীদের এক নিজস্ব ধারণা। ধর্মকায়ের ইচ্ছা আছে, বিবেক , করুণা ও বোধি আছে। সব সজীব পদার্থ ধর্মকায়ের অংশ। ধর্মকায় তত্ত্ব দিয়ে মহাযানীরা সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা করেন। হীনযানীদের মধ্যে প্রকৃতির সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই। মহাযানীদের কাছে নির্বাণ মানে চৈতন্য বা চিন্তার বিনাশ নয়, তা কেবল অহমভাবের নাশ করে। নিষেধমুখে ( নেতিবাদীব্যাখ্যায়) অহং মানে এক অলীক কল্পনা এবং অহমজাত যাবতীয় ভাবও অলীক। আর বিধিমুখে ( ইতিবাচক ব্যাখ্যায়) অহং মানে করুণা বা সর্বভূতে দয়া। অতএব নির্বাণ মানে সংকীর্ণ, অলস অহমগ্রস্ত মনোবৃত্তি থেকে নতুন জীবনের উল্লাসে উৎফুল্ল হয়ে সমগ্র জীবজগতের উদ্ধারের জন্য নিযুক্ত হওয়া। যতোক্ষণ একটিও প্রাণী বদ্ধ থাকবে, ব্যক্তিগত নির্বাণের কোনও সার্থকতা থাকবে না।
একটা কথা আমার চিরকালই মনে হয়, ব্রাহ্মণ্য ধর্মে রীতি'র থেকে নীতি এসেছে। সদ্ধর্মে নীতিই রীতিকে নির্মাণ করতে চেয়েছে। এর কারণেই অহংকারী আর্যরা, যারা নিজেদের আচার, লৌকিকতার ঐতিহ্যকে নির্ভুল ও গরিমাময় মনে করতো, খুব সহজে ব্রাহ্মণ্যধর্মে স্বচ্ছন্দ হতে পেরেছে। সদ্ধর্ম থেকে মহাযান বা থেরবাদ, যেখানে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মেরুদন্ড বর্ণাশ্রম'কেই অস্বীকার করা হয়েছে, স্বতস্ফূর্তভাবে অনার্য কৌম সমাজের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে। বিকাশের শীর্ষে থেকেও সদ্ধর্মে মানুষের প্রতি মানুষের করুণাবোধই প্রধান অনুপ্রেরণা। দৈব অনুগ্রহের তাড়না নয়। মানুষের আনুগত্য জয় করার জন্য প্রধান বৌদ্ধ রাজারা, পিয়দস্সি, কণিষ্ক থেকে হর্ষবর্ধন, দেবপাল, সচরাচর অকারণ হিংসার আশ্রয় নিতে চাননি। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে রাজা'র শ্রমণভাব অবলম্বন করা প্রজার জন্য হিতকর নয়। বীর্যহীন রাজা প্রজার পক্ষে চূড়ান্ত দায়। তাই বৌদ্ধধর্মে অনুগত প্রধান রাজারা নির্বীর্য ছিলেন না। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী রাজ্যবিস্তার করলেও ব্রাহ্মণ্য রাজাদের থেকে তাঁদের কঠোরতা বা নিষ্ঠুরতার গল্প অনেক কম শোনা যায়। এখনও পর্যন্ত কোনও বৌদ্ধ রাজা'কে অশ্বমেধযজ্ঞ করে আনুগত্য আদায়ের গল্প শুনিনি। পরবর্তীকালে যখন বৌদ্ধমতে পুরোহিততন্ত্রের নীতিহীনতার কারণে চূড়ান্ত অবক্ষয় দেখা দেয়, তখনও দরিদ্র অনার্যসমাজের শ্রমজীবী মানুষ, যাদের বৃহত্তর অংশ তখনও ইসলামে আশ্রয় নেয়নি, ন্যূনতম নৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বস্ত ছিলো।
নানা কারণেই সদ্ধর্ম তার জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত হয়ে যায় অথবা তাকে অন্যরূপে বিভিন্ন লোকায়ত বিশ্বাস ও উপাসনাপদ্ধতির মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে হয়। আমাদের তন্ত্রসাধনা, নিত্যানন্দীয় বৈষ্ণব সাধনপদ্ধতি ও বাউল যাপনের মধ্যে সহজযান শাখার বৌদ্ধ ব্যবস্থা মূল-আকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তবে এদেশে বুদ্ধ ও তাঁর সদ্ধর্মের ফিরে আসা ঊনবিংশ শতকে য়ুরোপীয় বিদ্বানদের হাত ধরে। এই সাধনায় ভারতীয় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে মুখ্য নাম রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র। বাংলাভাষায় এর চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেন ব্রাহ্মসমাজের মনীষীরা। সে এক অন্য বিষয়। ব্যক্তি আমি ভক্তিমার্গের পথিক নই। মুগ্ধ করার মতো ঐশী চমকে বিশ্বাস করিনা। কিন্তু শাক্যমুনি বুদ্ধ আমাকে ক্রমাগত বিস্মিত করে যান। আড়াই হাজার বছর আগে তাঁর মতো সেরিব্রাল চিন্তা ও অমানুষী স্তরের শ্রমদক্ষতা নিয়ে একজন মানুষ যে আমাদের দেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন, সেই দেশবাসী হিসেবে আমি গৌরবের অংশভাগী । রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় সম্বোধন করেছিলেন, সেটা বুঝতে পারি।
সংযোজন
এ পর্যন্ত যে চর্চা হলো, আপাতভাবে তার মূল বিষয়গুলিকে একটু সংক্ষেপে বিন্যস্ত করে দিই।
প্রথমতঃ, শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ ভেবেছিলেন বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় বৃহত্তর কৌমসমাজের জন্য একটা নতুন নীতি ভিত্তিক অধ্যাত্ম ব্যবস্থার প্রয়োজন। কালক্রমে তাঁর এই উদ্যম জন্ম দিয়েছিলো একটি নতুন ধর্মব্যবস্থার, যার পরিধি ছড়িয়ে গিয়েছিলো প্রায় সমগ্র সভ্য বিশ্বে। যে কোন ধর্মব্যবস্থাই মূলতঃ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বিকশিত হয়। একক মানুষ-সামূহিক সমাজ-ধর্মব্যবস্থা, ত্রিভুজের এই তিনটি বিন্দু'র মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কগুলি ক্রমাগত বিবর্তিত হতে থাকে। আমাদের কবি যে রকম বলেছেন, মানুষ সবচেয়ে জটিল তার আপন অন্তরালে। তাই মানবসমাজের মূল্যবোধের বিবর্তনও ততোধিক জটিল। যেখানে তার যুক্তিবোধ ব্যহত হয়, সেখানে মানুষ ভক্তির অন্তরাল খুঁজে নেয়। গৌতমবুদ্ধ ছিলেন যুক্তিবদ্ধ মহামেধাবী এক কর্মযোগী। সারাজীবন ভক্তিবাদী বিগ্রহপূজা ও লোকাচারের বিরোধিতা করে এসেছেন। কিন্তু মানুষ তাঁর এই প্রতিজ্ঞার মর্যাদা রক্ষা করতে পারেনি। তাঁর জীবনাবসানের তিন শতক পরেই তাঁর মূর্তি কল্পনা করে ফেলা হয়। তাঁকে নানারকম কল্পিত গল্পকথার নায়কে পর্যবসিত করে তাঁর প্রতি অলীক দেবত্ব আরোপ করা হয়। সত্যসন্ধানকে বিসর্জন দিয়ে লোকাচারের সূক্ষ্ণ ভিন্নতা আবিষ্কারের ছলে অহমবাদী অনুসারিরা গোষ্ঠীর পর গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়। যে আশা নিয়ে গৌতমবুদ্ধ একটি ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন লোকসমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, এইভাবে তার মূল উদ্দেশ্যটিকেই পরাভূত হয়ে যেতে দেখি।
দ্বিতীয়তঃ, যে মূল প্রশ্নগুলির ভিত্তিতে মহাযান বা হীনযান নামক দু'টি সম্প্রদায় পৃথক হয়ে হয়েছিলো, তার মধ্যে মুখ্য ছিলো মানুষের জীবনে নির্বাণের ভূমিকা কী? প্রথমদিকে ব্যাপারটি মোটামুটি সরলই ছিলো। কিন্তু কালক্রমে সেটি জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। ফলতঃ ব্রাহ্মণ্যধর্মের মতো'ই ইতরমানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।
তৃতীয়তঃ, এই বিবর্তনপ্রক্রিয়ার নানা হলাহলের মধ্যে থেকে যে অমৃতটি উঠে আসে, তা হলো অধ্যাত্মচেতনার মধ্যে 'করুণা' নামক শাশ্বত অনুভূতিটিকে স্থান করে দেওয়া। তখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে আর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে করুণাকে এই স্তরের মহান স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। খ্রিস্টের ধর্ম এই লক্ষণটি বুদ্ধের ধর্ম থেকেই নিয়েছিলো।
চতুর্থতঃ, এসব ইতিহাস একান্ত গোড়ার কথা। কালক্রমে বুদ্ধের নামে প্রবর্তিত ধর্মের আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। বজ্রযান আদি তন্ত্রসমন্বিত মহাযানী প্রকরণের মধ্যে আদি পরম কারুণিক শাক্যমুনির স্পর্শ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো।
যেকোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকথাই সরল হয়না। তার অসংখ্য অন্তঃসলিলা স্রোতপ্রবাহ থাকে। সদ্ধর্মও তার ব্যতিক্রম নয়।
ছবি - লেখক
লেখক পরিচিতঃ শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।