বিবিধ প্রসঙ্গ
মার্চ ৩০, ২০১৬
একটি অপার্থিব সাক্ষাৎকার
সোমেন দে
সুনীল: নমস্কার। ইহলোকে পারিনি আপনার মুখোমুখি হতে। আমার বয়স যখন সাত বছর, আপনি তখন ছেড়ে আসলেন মাটির পৃথিবী। কিন্তু কত হাজার বার যে ভেবেছি যদি একবার পারতাম আপনাকে সামনা সামনি দেখতে, একটু কথা বলতে - এই মুহূর্তটার জন্যে একটা গোটা জন্ম অপেক্ষা করতে হল, কত কি বলবো আপনাকে ভেবেছিলাম - এখন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আমার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমিও বাঙলা ভাষায় একটু আধটু সাহিত্য চর্চা করেছি।
রবীন্দ্রনাথ: (স্মিত হেসে) একটু আধটু? এত বিনয় তো তোমার স্বভাবচিত নয় সুনীল। একটু আধটু কি বলছ, আমি তো শুনেছি তুমি আমার চেয়েও বেশি গদ্য লিখে ফেলেছ।
সু: সেকি আপনি আমার সম্বন্ধে জানেন?
র: নিজে আর কিছু সৃষ্টি করতে পারিনা ঠিকই। তবে আমার বাংলা দেশে কি ঘটছে তা জানতে তো বাধা নেই। আমি সবই খবর রাখি।
সু: তা হলে তো খুব মুস্কিল হল দেখছি। আপনি যদি সবই জানেন তাহলে নিশ্চয় এও জানেন আমি মাঝে মাঝে এমন অনেক কিছু বলেছি বা লিখেছি যাতে মনে হতে পারে আমার আপনার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ঠিক গড় পড়তা বাঙ্গালির তুলনায় একটু কম।
র: আমার তো তা মনে হয়নি। যে ভাবে, যে মনোযোগ দিয়ে তুমি আমার লেখা পড়েছ, আমাকে বুঝতে চেষ্টা করেছ, কারো প্রতি অশ্রদ্ধা থাকলে তো এমনটা করা যায় না।
সু : যাক একটু ভরসা পেলাম। কম বয়সে তো অনেক কিছু লিখেছি যে গুলো পরে মনে হয়েছে ঠিক হয়নি।
র : যেমন ঐ ' তিন জোড়া লাথির আঘাতে রবীন্দ্র রচনাবলী লুটায় পাপোশে ' -
সু: ছি ছি কি লজ্জা - আপনি এটাও জানেন -
র: জানি বৈ কি। সারা জীবন একটুও সময় নষ্ট না করে এত যে লিখলাম - উত্তর কাল তাকে কেমন ভাবে নিচ্ছে তা জানবার আগ্রহ থাকবে না !
সু: আসলে কম বয়সে যখন লেখক হবার কথা ভাবিনি, তখন আপনি এমন ভাবে আমাকে ঘিরে থাকতেন যে সব কিছুর মধ্যেই আপনি এসে দাঁড়াতেন। প্রেম পত্র লিখতে গিয়ে সেই আপনাকেই কোট করতাম, আকাশে মেঘ জমলে সেই আপনারই গান গাইতাম, কষ্ট পেলে সেই আপনার কোনো কবিতাকেই জড়িয়ে ধরতাম। কিন্তু যখন পাকে চক্রে আমি লেখক হয়ে গেলাম, তখন বুঝলাম আপনার হাত ছাড়িয়ে বেরোতে না পারলে আমার নিজের কোনো ভাষা তৈরি হবেনা। আর আপনার হাত ছাড়িয়ে যেতে হলে আপনাকে অস্বীকার করতেই হবে।
র: আমি বুঝতে পারি। প্রথম জীবনে আমিও বিহারীলাল চক্রবর্তীকে অনুসরণ করতাম। কিন্তু পরে বুঝতে পারি আমাকে ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাকেও নিজের ভাষা খুঁজে পেতে সময় লেগেছে।
সু: নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ থেকেই কি এই নিজের ভাষা খুঁজে পাওয়া?
র: হ্যাঁ, তা বলতে পারো। তার আগের রচনা গুলির অনেক গুলিই ডিমের মধ্যে শাবক হয়ে ছিল, পাখি হয়ে উড়তে শেখে নি।
সু : তবুও সে গুলি রেখে দিয়েছিলেন, বর্জন করেন নি।
র : তুমি একজন লেখক, তুমি জানো নিজের লেখা বর্জন করা কত কঠিন। প্রতিটি রচনার সঙ্গে অনেক অনুষঙ্গ, অনেক স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। পরে কোনো সময়ে আমি বলেছিলাম সব কিছুকে রাশীকৃত করলে সমগ্রকে কে চেনা যায় না। সাহিত্য রচয়িতা হিসাবে আমার চিত্তের যে একটা চেহারা আছে সেটাকে স্পষ্ট করে প্রকাশ করে যেতে পারলেই আমার সার্থকতা। অরণ্য কে চেনাতে গেলে জঙ্গলকে সাফ করা চাই , কুঠারের দরকার।
সু: আপনি সে কুঠার তুলে নিতে পারেননি।
র: হয়তো সময় পাইনি অথবা ইচ্ছের জোর ছিল না |
সু: যতদূর জানি ব্রহ্ম বান্ধব উপাধ্যায় মশাইয়ের উৎসাহে আপনি শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় খুলতে আগ্রহী হন। কিন্তু সেই স্কুল খুলতে গিয়ে আপনি গুরুদেব হয়ে গেলেন। আপনার কখনো মনে হয়নি গুরুদেব সম্বোধনের মধ্যে কেমন একটা আধ্যাত্মিক আড়াল তৈরি হয়ে যায়। একজন কবির জন্যে সেটা খুব অভিপ্রেত নয় বলে আমার মনে হয়।
র: শান্তিনিকেতনের আমার কল্পিত ভাবধারার সঙ্গে গুরুদেব সম্বোধনটা বেমানান ছিল না। কিন্তু কি ভাবে সেটা শান্তিনিকেতনের বাইরেও সেটা প্রচলিত হয়ে গেছলো সেটা আজ আর মনে পড়ে না। তবে আমার ছাত্রদের কাছে ছাড়া আমার অন্য কোনো রচনার মধ্যে অন্তত আমি কোনো গুরুদেব-সুলভ বানী প্রচার করার চেষ্টা করেছি এমন অভিযোগ তো কেও করেনি। আর আমার চেয়ে যারা বয়সে নবীন ছিল তাদের সম্বোধনের জন্যে তো একটা জুৎসই নাম প্রয়োজন ছিল। রবি দাদু বা রবি জ্যেঠু এগুলো বোধহয় তখন ঠিক মানান সই হত না। তাই হয়তো গুরুদেবটাই চালু হয়ে গেছলো। তবে হ্যাঁ, এই সম্বোধনটা কখনো একটু ভারি লেগেছে। কিন্তু তখন বোধহয়ে আর কিছু করার ছিল না।
সু: আপনার ১৩০২ সালে লেখা ১৪০০ সাল কবিতায় আপনি কল্পনা করেছিলেন ১০০ বছর পার করে কেও আপনার কবিতা পড়ছে ' কৌতূহল ভরে ' এই কবিতায় চিত্রা তে আপনি লিখেছিলেন
'আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগ সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শত বর্ষ পরে। '
পরে আমরা সঞ্চয়িতা তে দেখি
'আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগ সিক্ত করি পারিব কি পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শত বর্ষ পরে? '
প্রথমে না পারার কথা স্বীকার ও পরে তা নিয়ে সংশয় এর কি কোনো বিশেষ কারণ ছিল?
র: ঠিক মনে নেই। তবে অমরত্বের কোনো প্রত্যাশা মনের কোনে ছিলনা এ কথা বললে বোধহয় সত্যের অপলাপ করা হবে। সত্যি কথা বলতে কি কবির মনে যদি অনেক পাঠকের কাছে অনেক দিন ধরে পৌঁছাবার আগ্রহ না থাকে তাহলে তাহলে সে তার সৃষ্টির অনুপ্রেরণা আসবে কি করে? তুমি যেন কি লিখেছিলে -
শুধু কবিতার জন্যে আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি '
আমার তো মনে হয় তাচ্ছিল্য না লিখে দাবী লিখে আরো ভালো শোনাত।
স: এই যে আপনাকে নিয়ে বাঙ্গালির এখনো এত মাতামাতি, এটা আপনার কেমন লাগে?
র: খারাপ লাগে সেটা বলব না। তবে এত যে হৈ চৈ সবই তো আমার কিছু বাছাই করা গান নিয়ে বা দু একটা নাটক নিয়ে বা কিছু আবৃত্তিযোগ্য কবিতা নিয়ে। অর্থাৎ যে গুলো পারফর্ম করা যায়, বা যে সব গান গুলো শুনতে শুনতে বাঙ্গালির এক ধরণের অভ্যেস তৈরি হয়ে গেছে, সে গুলো নিয়ে। এর বাইরে এত যে লেখা সব তো বাঙ্গালীদের জন্যে লিখেছিলাম। সত্যি কি সে গুলো মনোযোগ দিয়ে কেও পড়ে এখন? আসলে ঐ এনটারটেনর রবীন্দ্রনাথকেই বাঙালি মনে রেখেছে। বাকিটা ভুলে গেছে। বা ভুলে যাচ্ছে।
সু: বাঙ্গালির পক্ষে একেবারে আপনাকে ভুলে যাওয়া হয়তো কোনো দিনই সম্ভব হবে না। আপনি ১৪ বছর বয়সে লেখা বঙ্গ দর্শনে ছাপা সেই প্রথম কবিতা ভারত-বিলাপ থেকে মৃত্যুর ২২ দিন আগে লেখা কবিতা 'তোমার সৃষ্টির পথ' পর্যন্ত যে হাজার হাজার পৃষ্ঠা নিয়ম করে লিখে গেছেন - এই লেখার প্রেরণা কি ভাবে পেয়েছেন?
র: তুমিও তো কিছু কম লেখনি বাপু।
সু: আজ স্বীকার করতে বাধা নেই প্রথম দিকে যতটা নিজের ভিতরের তাড়া খেয়ে লিখেছি, পরে তো লেখাটাই আমার বৃত্তি হয়ে গেছলো। অনেক লেখাই শুধু টাকা রোজকার করার জন্যে লিখেছি। একটি কবিতায় লিখেছিলাম ' এবার কবিতা লিখে আমি একটা রাজপ্রাসাদ বানাবো।'
র: হুমম, আমিও বোধ হয় একটু বেশি ই লিখে ফেলেছি- মৃত্যুর কিছুদিন আগে রাণীকে বলেছিলাম - এত লিখেছি জীবনে যে লজ্জা হয়। এত লেখা উচিত হয়নি ..... জীবনে আশি বছর অবধি চাষ করেছি অনেক। সব ফসলই যে মড়াই এ জমা হবে তা বলতে পারিনে। কিছু ইঁদুরে খাবে। তবুও থাকবে কিছু। জোর করে কিছু বলা যায় না। যুগ বদলায় কাল বদলায়, সবই তো বদলায়।
সু: এই কথা টা আমি বলতে গিয়েছিলাম বলে তো আপনার ভক্তরা তো আমাকে এই মারে তো সেই মারে -
র: তাই বুঝি, তা তোমার কাছে শুনি তাহলে আমার কোন লেখা গুলো কোন গুলো ইঁদুরে খাওয়ার মত।
সু: আমি সে কাজের যোগ্য নই তবু আপনি যখন অভয় দিচ্ছেন তাই বলি কখনো কখনো আপনার প্রথম দিকের কোনো কবিতায় মনে হয়েছে কিছু জায়গায় আপনি হাই সাউন্ডিং শব্দ ঝংকারের মোহে পড়ে গেছেন। তাতে যেন কবিতার রহস্যময়তা থাকেনি।
র: যে শব্দ গুলো এখন হাই-সাউন্ডিং মনে হচ্ছে, সেগুলো ব্যাবহার করা সময়ের দস্তুর ছিল। আমি একজন বাঙালি কবি। অল্পবিস্তর বিদেশি সাহিত্য পড়ে থাকলেও আমি যখন লিখেছি তখন বাঙালি পাঠকদের কথা ভেবেই লিখেছি। কম বয়সে আমি যখন লিখছি তখন আমার সামনে বিহারীলাল, হেম চন্দ্র, মধুসূদন এদের কবিতা ছিল। তাদের লেখা বাঙালি পাঠক আগ্রহের সঙ্গে পড়ত। তখন একজন অর্বাচীন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠকের কাছে পোঁছে দিতে হলে কিছুটা তাদের ধারা অনুসরণ করতেই হত। সেটা তোমার সময়ে দাঁড়িয়ে কিছুটা অপ্রয়োজনীয় শব্দ ঝংকার মনে হতে পারে। আমারও পরের দিকে কখনো তাই মনে হয়েছে।
সু: আপনি যেমন একজন আদ্য প্রান্ত সুন্দর মানুষ, চেহারায়, শারীরিক উচ্চতায়, গাত্রবর্ণে, কথায়, কণ্ঠে,চিন্তায় ভাবনায়, ভাবনার প্রকাশ ভঙ্গীতে তেমনি আপনার সব রচনার মধ্যে যেন সুন্দরের জয়গান, সুন্দরের স্তব - জীবন তো এত সুন্দর নয়। কখনো মনে হয়নি এমন কিছু নিয়ে লিখতে যা অসুন্দর কিন্তু রূঢ় বাস্তব -
র: ইয়োরোপে তখন একটা মত ছিল আর্ট মানেই সুন্দরের স্তব। তবে শুধু সুন্দরের স্তবই আর্ট নয়। মানুষের প্রাণের প্রতি প্রাণের, হৃদয়ের প্রতি হৃদয়ের, মনের প্রতি মনের একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে। এটা যে ঠিক সুন্দরের আকর্ষণ তা বলা যায় না। আমি বাঙালি বলে এই বাংলার অনেক অকিঞ্চিৎকর দৃশ্য অনেক সাধারণ মানুষ কেও আমার ভালো লাগে। এর মধ্যে হয়তো স্তব করার মত কিছু নেই। তবু আমার রচনায় এরা যদি সুন্দর হয়ে যায়, তা মানুষের ভালো লাগে তা হলে সেটাও আর্ট হয়ে যায়। আমি তা পেরেছি কিনা জানি না।
সু: কিন্তু আপনি যেন বড় বেশি সংযত, সাবধানী থেকেছেন।
র: অসংযত কল্পনাবৃত্তি দিয়ে কোনো সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় বলে আমার মনে হয় না। প্রদীপের আগুন আলো করে কিন্তু সে আগুন কে কাবু না রাখতে পারলে সে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে পারে। মানুষের সব প্রবৃত্তি গুলোকে যদি পুরোমাত্রায় জ্বলে উঠতে দিই, তা হলে রাঙ্গা হবার জন্যে যেটুকু জ্বলা দরকার তার চেয়েও অনেক বেশি জ্বলে সব ছাই করে দিতে পারে। মানুষের সৌন্দর্য বোধ মানুষের ক্ষুধা তৃপ্তির সঙ্গে একটা উচ্চতর সুর লাগিয়ে দেয়। তাই বর্বর মানুষ ধীরে ধীরে সভ্য হয়েছে। খুব জোর খিদে পেলেও আমরা রাক্ষসের মত কিছু খাইনা। আমাদের সৌন্দর্য বোধ আমাদের সংযত করে।
স: কিন্তু বাস্তবের রুক্ষতাকে আমরা দূরে সরিয়ে রাখব?
র: একজন গর্ভিণী নারী কে যেমন দেখছো, তেমনি বর্ণনা করলে তা হয়তো প্রচলিত সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে সুন্দর নাও হতে পারে। কিন্তু নারীর চরম সার্থকতার জন্যে যে প্রতীক্ষা আছে তা যদি বর্ণনা থাকে তাহলে চোখের বিলাসে যে টুকু কম পড়েছে মনের ভক্তি সেটুকু পূরণ করে দেবে।
স: আর মানুষের দৈহিক চাহিদার কথা লেখার থেকে আপনি যে খুব সাবধানে বিরত থেকেছেন, সেটা কি সমাজের ভয়ে?
র: মানুষ যখন জীবমাত্র তখন তার যৌনতার দিকটাকে অস্বীকার করা যায় না। তবে মানুষের কাছে যৌনমিলনের যে সার্থকতা তা তো ‘প্রজনার্থং’ নয়। কেননা সেখানে সে পশু। সাহিত্যে মানুষের মধ্যে এই পশুর জগৎ আর মানুষের জগতের নিয়ে একটা সীমানা ভাগাভাগির লড়াই আছে।
যৌন মিলনের মধ্যে দুটি মহল আছে। দৈহিক আর মানসিক। সাহিত্য এর কোনটিকে অলংকৃত করে নিত্য কালের গৌরব দিতে চাইবে সেটাই important ।
আমার মনে হয় মানুষের রস বোধের মধ্যে একটা নিত্য আব্রুতা আছে। বে-আব্রুতাটা জোর করে আমদানি।তাই ওটা বেশি দিন টিকবে না।
সু: এবার আপনার উপন্যাস প্রসঙ্গে আসি। প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন বাইশ বছর বয়সে-বৌ ঠাকুরানীর হাট। তারপর আরো আটান্ন বছরের মধ্যে আর মাত্র এগারোটি উপন্যাস। সংখ্যায় একটু কমই মনে হয়। যখন আমার মত একজন সামান্য লেখক আরো কম সময়ে দুশোর বেশি উপন্যাস লিখে ফেলেছি।
র: আমার উপন্যাস গুলি ঠিক গল্প বলার প্রয়োজনে তো লিখিনি। যা কবিতায় বলা যায়না যা গানে প্রকাশ করা যায় না অথচ যা বলা প্রয়োজন ছিল তাই উপন্যাসে বলেছি। উপন্যাস লিখতেই আমাকে সব চেয়ে বেশি খাটতে হয়েছে। মানুষের সম্পর্ক নিয়ে, মানব মনের নানা স্তর নিয়ে আমার অনেক ভাবনা চিন্তা অন্তর্দ্বন্দ্ব শুধু মাত্র উপন্যাসেই বলতে পেরেছি। তাই খুব বেশি লেখা হয় নি। আর আমার লেখাতো পণ্য করার কোনো তাড়া আমার ছিল না ।
সু: হ্যাঁ, সেটা বোঝা যায়। আপনি ভাবী কালের জন্যে কিছু পথ নির্দেশ রেখে যেতে চেয়েছেন উপন্যাসের মাধ্যমে। যেমন গোরা তে আপনি ভারতবর্ষের ধর্ম চিন্তার যে দান্দ্বিক বিশ্লেষণ করেছেন তা আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক।
র: প্রায় আড়াই বছর ধরে প্রবাসী পত্রিকায় পর্বে পর্বে লিখেছিলাম উপন্যাস টি। রামানন্দবাবু অগ্রিম তিনশো টাকা দিয়েছিলেন।
সু: আপনি কি আদৌ আপনার লেখার পারিশ্রমিক মূল্য নিয়ে ভাবতেন কখনো?
র: অন্ন চিন্তা চমৎকারা- মাঝে মাঝে ভাবতে হোতো বৈকি। যতদূর মনে পড়ে একবার যেন কোন এক সম্পাদককে লিখেছিলুম আমার ছোটো গল্পের দক্ষিণা আশি থেকে বাড়িয়ে একশো টাকা করার জন্যে।
সু: আপনি ঘরে বাইরের মত অমন একটি অসাধারণ উপন্যাস লেখার পর আপনি প্রায় একযুগ আর উপন্যাসে হাত দিলেন না।
র: এখন তোমরা বলছ বটে অসাধারণ ‚ কিন্তু এই উপন্যাস পড়ে এ দেশে সমালোচনার ঢেউ বয়ে যায়। আমার সময়ে বিশেষ কেও আমাকে বুঝতেই পারেনি। পাঠকদের কাছে সুখপাঠ্য উপন্যাস লেখার জন্য যে ভাষার তখন প্রয়োজন ছিল সেটা আমার আয়ত্ত ছিল না । তাই ভেবে ছিলাম আর উপন্যাস লিখবো না। পরে অবশ্য বিচিত্রার সম্পাদকের অনুরোধে আবার 'যোগাযোগ' উপন্যাস লিখেছিলাম।
স: এক সময় ‘চার অধ্যায়’ আমার মুখস্থ ছিল সে উপন্যাসের ভাষার জন্য। এমন ভাষায় কিন্তু আর কোনো উপন্যাস কেন লিখলেন না?
র: তোমাদের ভালো লাগবে জানলে হয়ত লিখতাম।
সু: আমার প্রথম আলো নামের একটি উপন্যাসে আপনাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে আপনার সময় ও সেই সময়ের সমাজটাকে একটু ধরতে চেষ্টা করেছিলাম আমি।
র: সে খবরও আমি জানি। তবে তোমার রবীন্দ্রনাথ খানিকটা আমার মত হলেও অনেকটাই আবার আমার মত নয়। সেটা অবশ্য তোমার দোষ নয়। আমার সময়ে যারা আমাকে কাছ থেকে চিনতেন তারা কেও মানুষ আমিটাকে নিয়ে বিশেষ কিছু লিখে যায়নি। যেটুকু লিখেছিলেন তা ছিল হয় অতি ভক্তির বাড়াবাড়ি নয় ঈর্ষা ক্লিষ্ট। তাই তোমাকে লেখার সময়ে প্রশান্ত আর প্রভাতের লেখা আমার জীবনীতে যা আছে তার বাইরে পুরোপুরি কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। আসলে কোনো বিশেষ সময়ের সার্থক ইতিহাস হল সেটাই যা লেখক নিজে সেই সময়ে কল্পনায় পৌঁছে গিয়ে নিজের অনুভূতি দিয়ে বর্ণনা করতে পারে। তুমি অনেকটাই সেটা করতে পেরেছো।
স: আমি ধন্য হলাম। আপনার বিশ্রামের সময় হল এবার তাহলে আসি।
র: বেশ। আবার এসো।
আত্নপক্ষ - বলা বাহুল্য সাক্ষাৎকারটির বিবরণ কল্পনাশ্রিত। তবে দুই কবির বয়ানে যা বলা হয়েছে তা পুরোপুরি কাল্পনিক নয়। দুজনেই এই ধরণের মতামত ব্যাক্ত করেছেন তাঁদের কোনো প্রবন্ধে , চিঠিপত্রে বা অন্য কোথাও । সে গুলি নানা জায়গা থেকে বেছে নিয়ে কথোকথনের রূপ দেওয়ার স্বাধীনতাটুকু লেখক নিয়েছে ।
লেখক পরিচিতি - চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী।
বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।