সমাজ ও সংস্কৃতি
ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৬
আকাঁড়া কিশোরী ও একটি নদী
শিবাংশু দে
..... আকাড়া [sic] কিশোরী যেন সেদিনের বসন্ত পঞ্চমী
হাসি নেই, অশ্রু আছে, দুচোখে চাঁদের ছায়া স্মৃতি টানে, গোপন সাবানে
জলজ গায়ের গন্ধ ।
লে যায় মরি হায় বসন্তের দিন চলে যায়....
( একদিন, শৈশবে,সমুদ্রে : এই আমি, যে পাথরে:- শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
বসন্তপঞ্চমী এরকমই ছিলো আমাদের সে বয়সে । বাসন্তী শাড়ি, লুকিয়ে চাওয়া, আতপচালের ছড়ানো সৌরভ, ছুটন্ত সাইকেলে ব্যস্ত পুরোহিত । আর, অন্যদিন যে কথাটা বলা যায়না একান্ত কোনও একজনকে, তা বলার জন্য শেষ রাত থেকে প্রস্তুতি, কিন্তু আর বলা হয়ে ওঠেনা । দু'জনেরই । চলে যায়, বসন্তপঞ্চমীর দিন । আজও বলা হয়নি, শোনার লোক পাল্টে গেছে কতো । কিন্তু কথাটা গচ্ছিত রয়ে গেছে ঐ ফর্সা অনন্তযৌবনা দেবীটির পায়ের কাছে হৃদয়কমল বনে ।
২. সরস্বান একটি বিশেষণ শব্দ । অর্থ সর-আশ্রয়বান, মানে শৈত্য ও সরোযুক্ত । অস্যার্থ, জলপূর্ণ ধারাবান নির্মাণ । স্ত্রীলিঙ্গে হয়ে যায় সরস্বতী । নদী তো চিরকালই নারী । মর্যাদার বিচারে ঋগবেদের বিভিন্ন মণ্ডলে দেখি সিন্ধুনদকেও অনেক স্থানে সরস্বতী নামে ডাকা হয়েছে । বলা হয়েছে 'দেবনদী' । ক্রমশ: পুষা, ইন্দ্র,অশ্বিন ও মরুৎগণের সঙ্গে দেবীরূপে তার উল্লেখ হতে থাকে । ঋগবেদে দ্বিতীয়মণ্ডলে ৪১তম সূক্তে ষোড়শ ঋকে সরস্বতী মাতৃগণের, নদীগণের ও দেবগণের শ্রেষ্ঠা বলে বর্ণিত হয়েছেন । যতোদিন গেছে নানাভাবে সরস্বতী শব্দের গরিমা বিকশিত হয়েছে সারা ভারতবর্ষে ।
৩. বৈদিক সভ্যতার ঢের আগে হরপ্পা সভ্যতারও ধাত্রী ছিলো সিন্ধু-সরস্বতী অববাহিকা । কিন্তু সেই সব সভ্যতার কোনও দস্তাবেজে সরস্বতীর কোনও প্রত্যক্ষ উল্লেখ দেখিনা। বৈদিক সভ্যতার প্রথম থেকেই সিন্ধু-সরস্বতীর আরাধনা অবিরাম করে আসা হয়েছে। ঋষিদের শ্লোক মাফিক দেখছি সিন্ধু-সরস্বতীর সলিলপুষ্ট ক্ষত্রিয়রা বলবান যোদ্ধা হয়ে ওঠে । আদি আর্যরা বাস করতো পশ্চিমদিকে পূর্ব আফঘানিস্তান থেকে পূর্বদিকে পশ্চিম উত্তর প্রদেশের মাঝে নানা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে। সিন্ধুনদ ছিলো তাদের প্রাণস্রোত। ঋগবেদের দশম মণ্ডলে ৭৫ নং শ্লোকে সিন্ধুনদের গুণগান করে যোগ করা হয়েছে, হে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, শতদ্রু (শতলজ), পরুস্নি (রাভি বা ইরাবতী),অসিক্নি (চনাব), বিতস্তা (ঝেলম) ও অর্জিকিয়া (বিয়াস বা বিপাশা) তোমরা সকলে সুসোমা (সিন্ধু) নদের সঙ্গে আমাদের প্রণতি গ্রহণ করো। আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে যে সপ্তসিন্ধুর উল্লেখ রয়েছে, সেখানে সিন্ধু ও তার পাঁচটি সন্তান শাখানদী এবং সপ্তম সিন্ধু হিসেবে সরস্বতীকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু সরস্বতী ছিলো 'নদীতমা', পবিত্রতম আরাধ্য নদী । যদিও সরস্বতীর উৎস সিন্ধু থেকে নয়। ঋগবেদের উল্লেখ অনুযায়ী পারস্যের আবেস্তায় যে হরখবতী নদী, অধুনা দক্ষিণ আফঘানিস্তানের হেলমন্দ, সেই ছিলো আদতে সরস্বতীর নামান্তর। একটি প্রচলিত মত সূত্র, ঘাগ্গর-হাকরা চ্যানেলই আদি সরস্বতী নদী, এখন তর্কসাপেক্ষ হয়ে গিয়েছে।
৪. সরস্বতীকে দেবী হিসেবে স্বীকৃতি সেই সময় থেকেই দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিলো। গঙ্গানদীর গরিমা অনেক পরবর্তী কালের ব্যাপার। বিভিন্ন পুরুষ বৈদিক দেবতাদের রাজগৌরব ভাগ করে নিতে হয়েছিলো দু'জন নারীদেবতার সঙ্গে, ঊষস ও সরস্বতী। সরস্বতীর এই পর্যায়ের মহিমা প্রচার করেছিলেন সেই সব ঋষির দল, যাঁরা সরস্বতী নদীতীরে ধর্মানুষ্ঠান পালন করার সময় শ্লোক রচনা ও আবৃত্তি করতেন। ক্রমশ: তাঁদের কল্পনায় এই বাচিক সৃজনশীলতার উৎস হয়ে উঠলেন সরস্বতীদেবী। তাঁরা এই দেবীর জন্য একটি নতুন বিশেষণ যোজনা করলেন, বাগদেবী। পরবর্তী পুরাণযুগে বাগদেবীকে বিষ্ণুর সহচরী হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস হলো । যদিও বহু আগে থেকেই দেবী সরস্বতী প্রজাপতি ব্রহ্মার কন্যা হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছিলেন
নবকুন্দধবলদল সুশীতলা
অতি সুনির্মলা, সুখ সমুজ্জ্বলা,
শুভ সুবর্ণ-আসনে অচঞ্চলা । ।
স্মিত-উদয়ারুণ-কিরণ বিলাসিনী
পূর্ণসিতাংঅশুবিভাসবিকাশিনী
নন্দনলক্ষ্মীসুমঙ্গলা । । ( রবীন্দ্রনাথ)
৫. ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক পরিকাঠামো ও মানসিক গঠনে গত তিন হাজার বছরে কী পরিমাণ পরিবর্তন এসেছে তা সবার জানা । তৎসত্ত্বেও আদি বৈদিক দেবদেবীদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত শুধু সরস্বতীই কেন প্রাসঙ্গিক থেকে গেছেন তা নিশ্চয় মানুষের কৌতূহল উদ্রেক করবে । নদী থেকে দেবী হওয়া আর কোনও ঐশী প্রতিমার নসিব হয়নি। যদি আমরা সরস্বতীর রূপগত প্রতীকগুলি বিচার করি, তবে মহর্ষি অগস্ত্যের নামে প্রচলিত একটি স্তুতিশ্লোক দিয়ে শুরু করা যায় । উপরোক্ত কবিতাটি রচনার সময় কবি নিশ্চয় এই শ্লোকটি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
য়া কুন্দেন্দু-তুষার-হার-ধবলা
য়া শুভ্র-বস্ত্রাভৃতা
য়া বীণাবরদন্ড-মণ্ডিত কর
য়া শ্বেত-পদ্মাসনা ।
য়া ব্রহ্ম-অচ্যুত-শংকর-প্রভৃতিভির্দেবহ সদা পূজিতা
সা মাং পাতু সরস্বতী ভগবতী নিঃশেষ-জাড্যাপহা ।।
... হে কুন্দফুলের মতো শ্বেতবর্ণ, চন্দ্রের মতো শীতল,
তুষারের মতো উজ্জ্বল এবং মুক্তামালার মতো ঝলসিত ।।
যাঁর হস্ত বীণাশোভিত এবং বরমুদ্রায় স্থিত, যিনি শুভ্রকমলাসনা
যিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শংকর ও দেবগণের পূজিতা
সেই দেবী সরস্বতী, আমাদের রক্ষা করো, অজ্ঞান মুক্ত করো ।।
লক্ষ্য করার বিষয় শ্বেতবর্ণের জয়জয়কার । বৈদিক ককেশয়েড আর্যগোষ্ঠীর অশ্বেতকায় স্থানীয় জনসম্প্রদায়ের সমীপে নিজেদের গাত্রবর্ণকে মহিমান্বিত করার সজ্ঞান প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে । যা কিছু পবিত্র, বরণীয়, দোষশূন্য সবই শ্বেতবর্ণের সঙ্গে সম্পর্কিত । ভারতীয় বর্ণসচেতনতার একটি নথিবদ্ধ উদাহরণ হয়তো । আর্যমতে সত্ত্বগুণের আধার হিসেবে শ্বেতবর্ণকেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে। সরস্বতীর অপর নাম মহাশ্বেতা। গুণগত তাৎপর্য ; শুদ্ধ, সেরিব্রাল ও অতীন্দ্রিয় চেতনাসম্পন্ন। শ্বেতবর্ণকে আবার ব্রাহ্মণ্যত্বের সঙ্গেও যোগ করা হয়েছে । অপর একটি শ্লোকে সরস্বতীর স্তুতি এভাবে গীত হয়েছে,
" হে মহাদেবী, মহাকালী, মহালক্ষ্মী, তোমায় প্রণাম করি,
তুমিই ব্রহ্মা, তুমিই বিষ্ণু, তুমিই শিব এবং আদরণীয় ব্রাহ্মণ, তুমিই আমাদের বন্দনা গ্রহণ করো।"
আপাতভাবে অনেক কম প্রভাবশালী প্রতীত হলেও দেখা যাচ্ছে আদি দেবী হিসেবে আর্যশাস্ত্রে সরস্বতীর গুরুত্ব ভালোভাবেই স্বীকৃত ছিলো।
৬. প্রকৃতিবাদী বৈদিক আর্য প্যান্থিয়নের একজন হবার সুবাদে সরস্বতী একাই যথেষ্ট হিম্মত রাখতেন । কারণ সেই সময় পর্যন্ত আর্যসম্প্রদায়ের মধ্যে নারীর স্বাধিকার স্বীকৃত ছিলো। পিতৃতন্ত্র তখনও ততো আগ্রাসী হয়ে ওঠেনি। মূলগতভাবে সরস্বতী অন্য কোনও প্রভাবশালী দেবতার সহচরী হিসেবে কখনও গণ্য হননি। কারণ তাঁর শুভ্র পবিত্রতা কুমারিত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু পৌরাণিক যুগে তাঁকে এক আধ জায়গায় ব্রহ্মার সঙ্গিনী হিসেবে ভাবা হয়েছে । তার কারণ ব্রহ্মা কল্পিত হয়েছিলেন যাবতীয় বাক্য ও শব্দের বিধাতা হিসেবে । অতএব পিতৃতন্ত্রের প্রয়োজনে বাগদেবীকে ব্রহ্মার নিয়ন্ত্রণে রাখাটা জরুরি হয়ে পড়েছিলো। আদিরূপে সরস্বতীকে ব্রহ্মা থেকে জাত কল্পনা করা হতো, তার একটা অর্থ করা হয়েছিলো সরস্বতী ব্রহ্মার কন্যা । পরবর্তীকালে ভাবা হলো সরস্বতী ব্রহ্মার প্রকৃতি, যেমন লক্ষ্মী হলেন বিষ্ণুর এবং শক্তিদেবী শিবের । সেক্ষেত্রে একটা ধারণা তৈরি হলো ব্রহ্মা নিজ কন্যাকে ভার্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এই গপ্পোটি পরবর্তীকালে লোকের ঔৎসুক্য জাগিয়েছিলো। তবে কি 'হিন্দু'ধর্মে অজাচারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে? এই ধারণাটির একটি প্রধান উৎস ছিলো পরবর্তীকালের ভিন্ন ধর্মীয় আগন্তুকদের 'হিন্দুশাস্ত্র' সমূহের দূষণীয় লক্ষণ নির্ণয় ও ব্যাখ্যা। সেভাবেই ঐশী 'অজাচারে'র অভিযোগটি বেশ প্রচার পেয়েছিলো। কিন্তু এই আখ্যানটি বৈদিকযুগের নয়, নেহাৎ অর্বাচীন, পরবর্তী পুরাণযুগে রচিত হয়েছিলো। পরে কিঞ্চিত বিশদ চর্চা হবে।
৭. নদী থেকে দেবী হবার পথে সরস্বতী প্রধানত দু'টি গুণের অধিকারিণী হয়ে যান। প্রথমটি নদীর নির্মল শুদ্ধি ক্ষমতা এবং দ্বিতীয়টি শষ্যপ্রজননের নিয়ন্তা । এই সংসর্গের জন্য তিনি প্রাথমিকভাবে পূজিতা হতেন । পরবর্তীকালে বৈদিকসাহিত্যে( ব্রাহ্মণ অংশে ) তাঁকে বাগদেবী হিসেবেই অধিক মর্যাদা দেওয়া হয় । স্রোতস্বিনীর প্রাথমিক সংসর্গের প্লাবনকে ছাপিয়ে তিনি হয়ে গেলেন বাক, কাব্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের দেবী । আর্যদের নিজেদের মতো তাঁদের ধর্মীয় বোধও ছিলো যাযাবর । তাদের কোনও নির্দিষ্ট তীর্থস্থান বা দেবালয় ছিলোনা। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে যখন তাঁরা ভারতবর্ষের পূর্ব উল্লেখিত প্রান্তটিতে স্থিত হতে শুরু করলেন, তখন তাঁদের প্রথম কোনও নির্দিষ্ট ধর্মসম্পর্কিত উপাসনাস্থলের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিলো । সরস্বতী নদীর তীরভূমিকে তাঁরা গ্রহণ করলেন নতুন বিধানের অধ্যাত্মিক পূজাস্থল হিসেবে । এর অপর একটি জরুরি মাত্রাও ছিলো। যাযাবর আর্যরা স্থিত হবার অল্পদিনের মধ্যেই তাঁরা শ্রম ও ধীশক্তির মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে কৃষিচর্চার পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়ান । সরস্বতী নদীর উর্বর অববাহিকা তাঁদের সুযোগ করে দেয় কৃষি উৎপাদনে আপন উৎকর্ষ প্রমাণ করার । সেই সময় এই স্থানবিশেষটিকে বিশ্বের নাভিকেন্দ্র বলে দাবি করা হতে থাকে। সরস্বতীনদীর আশীর্বাদে গড়ে ওঠা কৃষিসভ্যতার সুবাদে ভূমিসম্পদকে সেই প্রথম মানুষের শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র সম্পদ হিসেবে স্বীকার করা হলো। দেবী সরস্বতী বন্দিতা হলেন পবিত্রভূমির অধিষ্ঠাত্রীরূপে। বৈদিকসাহিত্যে সরস্বতী কীর্তিত হতে থাকলেন প্রাচুর্য, প্রজয়িতা, সম্পদ ও নির্মলতার প্রতীক হিসেবে। ধীরে ধীরে অবশ্য তিনি এই সব ভৌত ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে হয়ে গেলেন শুদ্ধ জ্ঞান ও বোধির দেবতা।
৮. উত্তর বৈদিক যুগ থেকে নদী হিসেবে সরস্বতীর গৌরব হ্রাস পেতে থাকে কিন্তু দেবী হিসেবে তাঁর আর্য প্যান্থিয়নে একটা প্রভাবশালী স্থান তৈরি হয়ে যায়। সিন্ধু উপত্যকা থেকে আর্যরা যতো বেশি দেশের পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করেন ততো-ই তাঁদের জীবনচর্যায় সরস্বতী নদীর স্থান গঙ্গা নদী নিয়ে নেয়। পরবর্তীকালে গুপ্তশাসনের সময় থেকে যখন পুরাণযুগের শুরু, ভারতবর্ষে দেবদেবীর রাজপাটেও বৃহৎ মন্থন আন্দোলন সূচিত হয়ে গেলো । পুরাণগুলি কল্পকাহিনী হলেও তার মধ্যে ইতিহাস, সমাজচিত্র, অর্থনীতি, রাজনীতি, অধ্যাত্ম প্রসঙ্গ ইত্যাদি বিশদভাবে এসেছে। এগুলি মানুষের পরিবর্তে দেবতাদের চরিত্র অবলম্বন করে রচনা করা হয়। কোনও বৈজ্ঞানিক প্রামাণ্যতা নেই, কিন্তু পুরাণ ইতিবৃত্তের সাহিত্যমূল্য ঢের রয়েছে। সেকালে মানুষের যে কোনো সৃষ্টিই রাজ অনুগ্রহ ব্যতিরেকে টিকে থাকতে পারতো না । রাজারা সব থেকে নিরাপদ বোধ করতেন দেবদেবীদের সান্নিধ্যে। রাজশক্তির এই চাহিদাটি পূর্ণ করতে মানুষ অসংখ্য পুরাণ রচনা করতে শুরু করলো। এর মধ্যে মহানতম রামায়ণ ও মহাভারত । এদের আরো একটি অনন্যতা রয়েছে। উভয়ই শুধু পুরাণ নয়, এরা মহাকাব্য এবং মানুষের কথাশিল্প। দেবদেবী বা ঐশী চরিত্ররা অবশ্যই আসাযাওয়া করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানবিক ইতিবৃত্ত হিসেবেই তাদের প্রতিষ্ঠা।
৯. এই যুগেই আরো অনেক দেবদেবীর সঙ্গে সরস্বতী চরিত্রও নতুনভাবে রূপায়িত হতে আরম্ভ করে। বেদের ব্রাহ্মণ অংশে বারবার সরস্বতীর উল্লেখ হয়েছে বাগদেবী হিসেবে। সেখানে সরস্বতীর সঙ্গে ব্রহ্মার কোনও যোগ দেখা যায়না । পুরাণযুগে এসে সরস্বতীর সঙ্গে ব্রহ্মার চরিত্র জড়িয়ে পড়লো নানাভাবে। একটি আখ্যান বলছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টির সংকল্প করে নিজের দেহকে দুই ভাগে বিভক্ত করলেন। একটি ভাগ পুরুষ, অপরভাগ প্রকৃতি । প্রকৃতিভাগের নাম দেওয়া হলো সরস্বতী । এই সরস্বতী বেদোক্ত বাগদেবী কি না তা নিয়ে কোনও উল্লেখ নেই । কারণ পুরাণযুগেই বাগদেবী সরস্বতীর উৎস বিষয়ে অন্যতর তত্ত্বও তৈরি হয়েছে। এই ব্রহ্মা ও সরস্বতীর মিলনে জন্ম নিলেন মনু, যাঁর থেকে মানবজাতির উদ্ভব। একই ধরণের অপর একটি গল্প রয়েছে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও দেবীভাগবত পুরাণে । এখানে ব্রহ্মার জায়গা নিয়েছেন স্বয়ং কৃষ্ণ। আগের গল্পের মতো-ই কৃষ্ণ নিজেকে বিভক্ত করলেন দুভাগে, পুরুষ ও প্রকৃতি । কিন্তু এখানে প্রকৃতি আবার বিভক্ত হয়ে গেলেন পাঁচটি শক্তি হিসেবে, যার মধ্যে একটি শক্তির নাম সরস্বতী। শক্তি হিসেবে এই সরস্বতী ছিলেন সত্ত্বগুণের আধার এবং বোধির দেবতা। তাঁর উপর দায়িত্ব ছিলো বাকি চার শক্তির মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি ও জ্ঞানের সঞ্চার করা। অথচ এই পুরাণেই রয়েছে বীণাবাদিনী সরস্বতীর সৃষ্টি হয় কৃষ্ণ বা ব্রহ্মার জিহ্বা থেকে। এই রূপটিকে বেদোক্ত বাগদেবীর সব থেকে কাছের মনে হয় । কিন্তু এখানেই শেষ নয়। অন্য এক পুরাণ বলছে সরস্বতীর জন্ম বিষ্ণুর জিহ্বা থেকে । কারণ বিষ্ণু সহচরী হিসেবে লক্ষ্মীর সঙ্গে সরস্বতীকেও পেতে চেয়েছিলেন। এই পুরাণ রচয়িতার মতে লক্ষ্মী 'ভুক্তি' ( পার্থিব তৃপ্তি)) ও সরস্বতী 'মুক্তি'র (আত্মিক পূর্ণতা) প্রতীক। এই দুজনকে নিয়েই বিষ্ণুর জগতসংসারের পরিপূর্ণতা ।
১০. সরস্বতীর রূপকল্প নিয়ে নানাবিধ বিভিন্নতা রয়েছে । তবে বামনপুরাণে যে রূপটি গ্রন্থিত হয়েছিলো পরবর্তীকালের আর্যধর্মে সেটিই প্রামাণ্য বলে স্বীকৃত । এই রূপ অনুযায়ী দেবী চতুর্ভুজা, জলের উপর ভাসন্ত শ্বেতকমলাসনা, রাজহংস (পরমহংস) বাহিনী। হস্তমুদ্রার ক্ষেত্রেও বিভিন্নতা রয়েছে । কোথাও দুহাতে বীণা, একহাতে পুস্তক অন্য হাতে বরাভয় । আবার অন্যরূপে একহাতে বীণা, একহাতে পুস্তক ও অন্য দুহাতে অক্ষ-কমন্ডল। এছাড়া অন্যতর রূপেও, উপবিষ্টা বা দন্ডায়মানা ও ভিন্ন হস্তমুদ্রার কল্পনাও দেখা যায় ।
১১. সরস্বতী কোনও গার্হস্থ্য দেবী ন'ন। এই জন্যই তাঁর স্থায়ী মন্দিরের অভাব এই বিপুল দেশে । ছাত্র-ছাত্রী বা অধ্যাত্মবিশ্বাসী বিদ্যাপ্রার্থী জনগণও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য দেবী কালিকার শরণ নেবেন, কিন্তু সরস্বতীর নয় । কারণ ভাবমূর্তি হিসেবে সরস্বতী 'শক্তি'রূপা ন'ন। হিন্দুরা রণদুর্মদ, রক্তরঞ্জিত নারীশক্তিকে বিশ্বাস করে। অন্তত লক্ষ্মীদেবীর মতো পারিবারিক সুখসমৃদ্ধির আশ্বাসে উদার কোনও দেবীকে চাই। সরস্বতী, দেবী হিসেবে কিছু পাইয়ে দিতে পারেন না, এমত গূঢ় আশংকা আছে মানুষের । আসলে দেবী সরস্বতীর ভাবমূর্তি বড়ো বেশি সাত্ত্বিক। একটি পুরাণ অনুযায়ী ব্রহ্মা যখন তাঁকে কামনা করেন, তখন তিনি সৃষ্টিকর্তাকে প্রত্যাখ্যান করে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যান । তিনি কোনও পুরুষ দেবতার সহচরী, গৃহিণী, ভার্যা ন'ন । তিনি কোনও দেবতার সন্তানের জন্ম দেননি । তিনি একমাত্র বেদগর্ভ, অর্থাৎ শুধু বেদকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। এমত দেবতার কাছে নগদবিদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম, তাই তাঁর দেবালয় গড়ে শক্তিসামর্থ্যের অপচয় বিশেষ কেউ করেননি।
১২. জনপ্রিয়তা বা স্বীকৃতির নিরিখে যদি বিচার করি তবে দেখা যায় ভারতবর্ষে সরস্বতীর স্থায়ী মন্দিরের বিশেষ অভাব। প্রাচীনতম মন্দির বলতে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে কিশনগঙ্গার তীরে সারদাপীঠ । এই মন্দিরটি ছিলো একযোগে একটি শক্তিপীঠ, জৈন, বৌদ্ধ ও শৈব উপাসনাস্থল। হিউ এন সাং সপ্তম শতকে এখানে দু বছর জ্ঞানচর্চা করে গেছেন । আদি শংকর থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের অগণিত জ্ঞানতাপসদের সঙ্গে এককালে সংশ্লিষ্ট ছিলো এই মন্দির। এখন তা ধ্বংসস্তূপ । কাঞ্চীর শংকরাচার্য কাশ্মীর উপত্যকায় রামবানে একটি নতুন সারদাপীঠ স্থাপন করেছেন। অপর প্রাচীন মন্দিরটি রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশে আদিলাবাদের কাছে গোদাবরী ও মঞ্জিরা নদীর সঙ্গমে । এই মন্দিরটি ষষ্ঠ শতকে নির্মিত হয়েছিলো। মনে হয় এটিই ভারতবর্ষে বর্তমানে সব চেয়ে লোকাদৃত সরস্বতী মন্দির । হায়দরাবাদের কাছে মেডক জেলায় একটি নতুন সরস্বতী মন্দির নির্মিত হয়েছে কাঞ্চী শংকরাচার্যের উদ্যোগে । তামিলনাড়ুর কুম্ভকোণমের কাছে কুথানুরে একটি নাতিপ্রাচীন কিন্তু বেশ বড়ো লোকপ্রিয় সরস্বতী মন্দির রয়েছে।
১৩. সনাতনধর্ম ব্যতিরেকে বৌদ্ধ মহাযানী সাধনায় সরস্বতী একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেন। তৎকালে মহাযানী পন্থায় বজ্রযানের উদ্ভব পুরাণযুগের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে হয়েছিলো। সমগ্র আর্যাবর্তে দেবী সরস্বতীর জনপ্রিয়তা দেখে বজ্রযানী সাধকরা দেবী সরস্বতীকে নিজেদের তান্ত্রিক বৃত্তে আত্মস্থ করে নেন। সেই সময় দেবী সরস্বতী জ্ঞান ও শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে হিন্দু ও বৌদ্ধ, উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই বিশেষরূপে সমাদৃত ছিলেন। বৌদ্ধ সরস্বতীর দুটি রূপ রয়েছে, এক মুখ-দুই বাহু বা ত্রিমুখ-ছয় বাহু। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করতেন দেবতা মঞ্জুশ্রী ও প্রজ্ঞাপারমিতার মতো দেবী সরস্বতীও সাধককে জ্ঞান, বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি প্রদান করে থাকেন। বৌদ্ধ সাধনমালায় তাঁকে উৎসর্গ করে বহু ধরনের সাধনা লিপিবদ্ধ আছে।
বজ্রযানে দেবী সরস্বতীর পাঁচটি রূপ দেখা যায়। মহাসরস্বতী, বজ্রবীণা সরস্বতী, বজ্রসারদা, আর্যসরস্বতী এবং বজ্রসরস্বতী । এঁদের সবার রূপ, ধ্যান ও সাধনা পৃথক ।
১৪. সেরিব্রালিটির দেবী হিসেবে সরস্বতী বাঙালি মানসে পৌত্তলিকতা ও পৌত্তলিক বিরোধিতার মাঝখানে কোনও নো ম্যান'স ল্যান্ডে অবস্থান করেন । বিদ্যাস্থানে বসন্তপঞ্চমীতে সরস্বতীর লৌকিক পূজাকে কেন্দ্র করে নানা ধরণের মধ্যবিত্ত বিরোধাভাস নিয়মিত চোখে পড়ে। হেরম্ব-রবীন্দ্র বনাম সুভাষ ও অন্যদের মতান্তর ইতিহাস খ্যাত । সে ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। ভাবমূর্তির দিক দিয়ে নিতান্ত নির্বিবাদ এই দেবী কল্পনা সম্ভবত সব চেয়ে বেশি অন্তর্বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে সাম্প্রতিককালে। মকবুল ফিদা হুসেনের মতো জাতীয় সম্পদকে শেষ জীবনে নির্বাসন গ্রহণ করতে হলো নিজের মতো করে সরস্বতীকে চিনতে গিয়ে। আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সরস্বতীর প্রতি আর্ষ চুম্বনেচ্ছা নানা মহলে তুমুল বিপাক সৃষ্টি করেছিলো। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব বা নান্দনিকতার নিরিখে আমরা নানা সরস্বতীকে পেয়েছি । প্রত্যেকেই হয়তো বহিরঙ্গে কিছু পরিমাণে ভিন্ন, কিন্তু অন্তর্মহলে সরস্বতী নামক প্রতীকটির স্থান জ্ঞান, বিবেক ও শুভবুদ্ধির সিংহাসনে। বোধবিবেচনার এই নকটার্নে দাঁড়িয়ে বিগ্রহবিযুক্ত এই ইতর আমি স্মরণ করি এক প্রিয় কবির ভালোবাসায় ঋদ্ধ বসন্তপঞ্চমীর সেই আকাড়া কিশোরীকে। যার হাত ধরে সঙ্গে রয়েছে আর এক প্রিয় কবির মননশব্দে আঁকা মহাশ্বেতার রূপকল্প,
'' মহাসমুদ্র থেকে গভীর রাত্রে উঠে এলেন দেবী সরস্বতী,
....... উত্তরের ঠান্ডা বাতাস এবং বালির স্রোতের মধ্যে ডুবে থাকে
হাজার হাজার নিরক্ষর গ্রাম,
সমস্ত জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে ছেঁড়া কাঁথার ফুটো দিয়ে হু-হু করে
বাতাস ঢুকে যায়-হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়-
এই অচেতন রাত্রেই গঞ্জে ও শহরে বীণাবাদিনীর আরাধনার আয়োজন চলে,
...... হাতের পুঁথি নিক্ষিপ্ত হোলো সমুদ্রগর্ভে, দেবী
ডানহাত বাড়িয়ে দিলেন ঊর্দ্ধ আকাশে-কেড়ে নিলেন
কালপুরুষের খড়্গ ,
মহাসমুদ্রের সমস্ত নৈশ বর্ণমালা শুষে তাঁর শরীরে উঠে এলো
অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার-
উত্তরে এবং দক্ষিণে উলঙ্গ ঘৃণাভরে ছুঁড়ে দিলেন সমস্ত আবরণ-
দু'টি বিশাল জলস্তম্ভের মতো ঊরু বিস্তৃত করে তিনি দাঁড়ালেন
নক্ষত্রের আগুন-ছড়ানো বাঘছাল-পরা রাত্রির বুকের উপর
গলার হার ছুঁড়ে দিলেন হিমালয়ের চূড়ায়-
চিক চিক করে উঠলো ভোর-.......”
( শ্রীপঞ্চমী: গান্ধীনগরে একরাত্রি: মণিভূষণ ভট্টাচার্য)
লেখক পরিচিতিঃ শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে
ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের
ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা
ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে
শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত
জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না
তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ
করা হয়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।