প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৬

 

নিউজিল্যান্ড থেকে ফিরে

সুবীর চৌধুরী


 

নিউজিল্যান্ড দেশটা আয়তন অনুসারে পৃথিবীর ৭৫ তম বড়দেশ আর প্রতি বর্গকিমি এ ১৭ জন লোক বাসকরে, সেই তুলনায় ভারতবর্ষ সপ্তম আর যেখানে বর্গকিমি এ ৪৩৬ জন লোকের বাস। নিউজিল্যান্ডের প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব সুন্দর, লোকজন এত কম হলে পরিবেশ তো ভাল হওয়ারই কথা। তাই পর্যটকদের কাছে নিউজিল্যান্ড এখন খুবই প্রিয় ঘোরার জায়গা। ভারত থেকে সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া হোয়ে নিউজিল্যান্ডে আসা যায়।

ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই তিনমাস নিউজিল্যান্ডে গরমকাল আর দেশটা ঘুরে দেখার জন্য সব থেকে ভালসময়, এসময় তাপমাত্রা ২০-৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থাকে। নর্থ আইল্যান্ড আর সাউথ আইল্যান্ড এই দুইমিলে নিউজিল্যান্ড, দুটো আইল্যান্ডই ভালকরে ঘুরে দেখতে হলে মোটামুটি ১৮-২০ দিন সময় লাগে। নর্থ আইল্যান্ডের আকর্ষণীয় শহর আর দর্শনীয়স্থান গুলোর নাম অকল্যান্ড, হ্যামিলটন, রোটারুয়া, ওয়েলিংটন আর সাউথ আইল্যান্ডের পিকটন, ক্রাইস্টচার্চ, ফ্রান্স জোসেফ গ্লেসিয়ার, কুইন্সটাউন, ডুনেডিন, সাউথ আইল্যান্ডের শেষ সীমানায় শহরের নাম ইনভার কারগিল।

পাঠকদের জানার জন্য ১৫ দিনে নিউজিল্যান্ডের দুটো আইল্যান্ডই ঘুরে দেখার একটা ট্যুরের বিবরণ এখানে দেওয়া হোল। আমরা ডিসেম্বরের এক দুপুরে সিডনি থেকে অকল্যান্ড পৌঁছলাম, এখানে এখন গরমকাল। অকল্যান্ডে দুটো রাত থাকলে শহরের আকর্ষণীয় স্থান গুলো ঘুরে দেখে নেওয়া যায়। নিউজিল্যান্ডের লোকজনেরা তাদের দেশের পরিবেশ নিয়ে খুবই সচেতন, অন্য দেশ থেকে কোনও রকম খাবার, কাঠের বা চামড়ার কোনও জিনিস আনা নিষেধ। অন্য দেশ থেকে আসা প্রত্যেক যাত্রীকে Bio Security র নিয়ম মানতে হয়। প্লেনেই ট্রাভেল হিস্ট্রি কার্ড দিয়ে দেয় , কার্ডটা ফিল-আপ করে অকল্যান্ড এয়ারপোর্ট থেকে বেরোবার আগে জমা কোরতে হয়। নিউজিল্যান্ডে ঘোরার জন্য নিজেরা গাড়ী চালাতে পারলে গাড়িভাড়া কোরে ঘুরতে পারা যায় অথবা টুরিস্ট বাসে গ্রুপ-ট্যুর করা। আগেই ঠিক করা ছিল অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে নেমে আমরা একটা গাড়ি ভাড়া করে নেবো , সেইমত গাড়ি নিয়ে আমরা ১৬ km দূরে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা, কিন্তু বেশ উঁচু নিচু। দেখে মনে হয় পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছে।

নিউজিল্যান্ড দেশটা ঘুরে বেড়ানোর জন্য বিখ্যাত, Tourism এদেশের প্রধান ব্যবসা। সারাবছরই টুরিস্টদের আনাগোনা , আর এখন তো Xmas ও NewYear এর জন্য Peak Season। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে টুরিস্টরা এইসময় নিউজিল্যান্ডে বেড়াতে আসেন। নিউজিল্যান্ডের মধ্যে অকল্যান্ড সবথেকে বড় শহর, যাকে City of Sails বলা হয়। সন্ধ্যাবেলা কাছেই Harbour এ বেড়িয়ে আসা যায়। এখানে অল্প বয়সী ছেলেরা সাইকেল রিকশা নিয়ে যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করে, টুরিস্টদের নিয়ে Harbour বরাবর ফুটপাথের উপর দিয়ে চলাচল করছে। পরেরদিন সকালে আমরা ৩০ km দুরে Waitakere রিজিওনাল পার্কে গেলাম, এটা অকল্যান্ড শহরের বৃহত্তম পার্ক। পাহাড়ি রাস্তা, দুধারে ঘন জঙ্গল আর মাঝে মাঝে বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থানের জন্য Lookout সাইন বোর্ড, যেখানে জায়গাটা দেখা আর ছবি তোলা যায়। এক জায়গায় দেখা গেল প্রায় ৩০ – ৪০ জন মহিলা পুরুষ বাচ্চাদের নিয়ে পিকনিক করছে একটা বড় নদীর ধারে, এটা সমুদ্রেরই অংশ , শামুকের খোল পড়ে আছে।

অকল্যান্ডে Museum of Transport and Technology (MOTAT) এক দর্শনীয় স্থান, Defence এর বিভিন্ন প্লেন, যুদ্ধজাহাজ, সৈনিকদের ব্যবহার করা নানারকমের জিনিস রাখা আছে। Museum এর আরেকটা ইউনিট ২ km দূরে যেখানে পুরানো দিনের দমকল, প্রিন্টিং-মেশিন, অ্যাম্বুলেন্স সাজানো রয়েছে। এই দুই জায়গা ঘুরে দেখার জন্য এক কামরার বিশেষ ট্রামগাড়ি দশ মিনিট অন্তর যাতায়াত করছে। ট্রাম চালকের বয়স সত্তরের উপর, কালোপ্যান্ট সাদাজামা কালো কোট টাই আর তার সঙ্গে মানানসই কালো টুপি। ট্রাম চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ট্রাম চালকরা ভলেন্টিয়ার হিসাবে কাজ করেন। মিউজিয়ামের এন্ট্রি-টিকিট কাটলে ট্রামে চাপা Free, ট্রামের কনডাকটার সব যাত্রীদের ট্রামের সুভেনির টিকিট দেন যেটা অনেকেই অকল্যান্ডের স্মৃতি হিসাবে রেখে দেন।

অকল্যান্ডে মিউজিয়ামের ছবি

একই দিনে সন্ধ্যাবেলায় অকল্যান্ডের বিখ্যাত স্কাই-টাওয়ার ও দেখে নেওয়া যায়, মানুষের তৈরি নিউজিল্যান্ডের সবথেকে উঁচু ৩২৮ m টাওয়ার। টাওয়ারে তিন লেভেলে তিনটি প্লাটফর্ম আছে, ১৯২ মি লেভেলে প্লাটফর্মের বাইরে টাওয়ারের চারিদিকে রেলিং-ছাড়া বারান্দায় ঘোরা যায়, আবার সেখান থেকে স্কাইজাম্পও করা যায়। নিউজিল্যান্ড দেশটা এডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য বিশ্বসেরা, যেমন Bungy Jumping, পায়ের গোড়ালিতে বিশেষ ধরনের Elastic দড়ি পরে কোন উঁচু জায়গা থেকে লাফ দেওয়া, Elastic দড়ির জন্য শরীরটা একবার উপর আর একবার নীচে হতে থাকে। ১৯০মি লেভেলে ৩৬০ ডিগ্রী ঘূর্ণায়মান রেস্টুরেন্ট আছে যা প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঘোরে। আমরা ১৮৬ মি উঁচুতে Main Observation Level এ উঠলাম যেটা ৩৮ mm মোটা কাঁচ দিয়ে ঘেরা, এখান থেকে শহরের প্রায় ৮০ কিমি দূর অবধি দেখাযায়। রাত্রিবেলায় এখান থেকে নীচে আলোয় মোরা অকল্যান্ড শহর দেখা, সত্যই দুর্লভ অভিজ্ঞতা।

অকল্যান্ডের স্কাই টাওয়ার

দুদিন অকল্যান্ডে ঘুরে পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ রোটারুয়া যাওয়া, ২২০ km রাস্তা যেতে লাগবে প্রায় ৩ ঘণ্টা। রাস্তার ধারে বড়বড় ঝাউ গাছ ৩০-৪০ ফুট উঁচু। দুটো জমির মধ্যে ঝাউ গাছের বেড়া, সুন্দর করে ছাঁটা। শয়ে শয়ে বেশ নাদুসনুদুস গরু, তেমনই মোটাসোটা ভেড়া চরছে আর কিছু জায়গায় আলপাকা দে খা যায়। আলপাকা দেখতে অনেকটাই ভেড়ার মতো, আলপাকার গলাটা লম্বা আর ভেড়ার থেকে Height এ উঁচু। ভেড়া আর আলপাকার গায়ের লোম উল হিসাবে ব্যবহার হয়, তৈরি হয় কম্বল, সোয়েটার, টুপি, স্কার্ফ, গ্লাভস। নিউজিল্যান্ডে প্রায় ৩১% জমি ভেড়াদের দখলে আর ১৫% জমিতে গরু মোষ চরে। নিউজিল্যান্ডে খুব ভালো ওয়াইন তৈরি হয়, সারা দেশে প্রায় ৬০০ Wineries আছে। এখানকার Dairy Product ও খুবই উৎকৃষ্ট , দুধ, মাখন, চীজ নিউজিল্যান্ডের Biggest Export।tems। দুপুরে লাঞ্চের সময় হ্যামিল্টন পৌঁছলাম , জায়গাটা ছোট সাজানো শহর, এখানে একটা Museum দেখার আছে যেখানে পুরানো দিনের বিভিন্ন মডেলের ক্যামেরা, নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী ‘মাওরি’ দের ব্যবহার করা নৌকা সাজিয়ে রাখা আছে।

লাঞ্চের পর রোটারুয়ার উদ্দেশে রওনা হলাম, রাস্তার দুধারে বড়বড় ঝাউ আর পাইন গাছ। মাঝে মাঝে গরু ভেড়া চরছে, দু জায়গায় কয়েকটা ঘোড়াও দে খা গেল। রাস্তার ধারের সমস্ত জমি তার দিয়ে ঘেরা যাতে কোনভাবে জন্তু রাস্তায় চলে না আসে। বিকাল ৪.৩০ টা নাগাদ আমরা Rotorua পৌঁছলাম, এখানে দুদিন থাকতে হবে। রোটারুয়া জায়গাটা Geothermal Activity, Geysers আর Hot Mud Pool এর জন্য বিখ্যাত।

হোটেলে জিনিসপত্র রেখে বেড়িয়ে পরলাম, কাছেই একটা জায়গায় দেখা গেলো অনেক রকম খাবারের দোকান, সাইন বোর্ডে লেখা ‘Eat Street’। কাছেই একটা লেক, যেখানে Paddle করা নৌকা ভাড়া করে লেকে ঘোরা যায় আর আছে Sea Plane, Joy Ride এর জন্য। জল থেকেই উড়ে যাবে আবার লেকের জলে এসে নামবে। ৬-৭ ফুট Diameter এর প্লাস্টিকের স্বচ্ছ বল দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা আছে , বলের ভিতরে ঢুকে জলের মধ্যে ভেসে বেড়ানো যায়।

রোটারুয়া জায়গাটা সক্রিয় অগ্নেয়াগিরির মধ্যে অবস্থিত, আজ আমরা ৩০কিমি দূরে Wai – O – Tapu জিওথার্মাল পার্ক দেখতে গেলাম। ৩ km Walking Track এ প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে ঘুরে যা দেখলাম সেটা ভাষায় বর্ণনা করা খুবই মুশকিল। মাটির উপর কিছুটা জায়গা কাদাকাদা হোয়ে ফুটছে, পুরো জায়গাটায় সালফারের গন্ধ। একটা জায়গায় জমির কিছুটা অংশ হলুদ হেয়ে গেছে,বোর্ডে লেখা ‘সালফার কেভ’ একটা ছোট জলাশয়, জলের তিন চার রকমের রং। খানিকটা হলুদ, কিছুটা লালচে, তারই পাশে হালকা সবুজ আর হালকা নীল রঙের জল। বোর্ডে লেখা Artist’s Pallette। পার্কের ভিতরে কিছুটা পথ বেশ চড়াই উতরাই, এইসব জায়গায় মাটির উপর কাঠের রাস্তা। প্রত্যেকেই মনোরম এই দৃশ্যগুলো নিজেদের ক্যামেরা বন্দি করে রাখছে। তিনঘণ্টা ধরে এই পরিবেশে ঘোরা বয়স্কদের পক্ষে কষ্টকর কিন্তু প্রকৃতির এই রূপ দেখার পর কষ্টটা আর মনে থাকে না। দুপুর ৩টা নাগাদ আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।

জিওথার্মাল পার্কের Artist’s Pallette

রোটারুয়াতে আছে নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী ‘মাওরি’ দের ভিলেজ, যেখানে সন্ধ্যা ৬-৯ টা অবধি মাউরিদের নাচ গানের অনুষ্ঠান হয়। আমরা সময়মত পৌঁছে গেলাম, ছোট খালের মধ্যে নৌকা করে দশজন মাওরিপুরুষ আদিবাসীদের পোশাক পরে তীর-ধনুক আর মশাল নিয়ে নিজেদের ভাষায় গান করতে করতে এসে হাজির হোল। একটা হলে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা আছে, সামনে স্টেজের উপর মাওরিদের ঘর উঠান। নাচ শুরু হবার পর আরও চারজন মাওরি মহিলা যোগ দিলেন, একঘন্টা পর অনুষ্ঠান শেষ হল। মাওরিদের দেশে এসে মাওরি আদিবাসীদের নাচগান না দেখলে নিউজিল্যান্ড দেশটা ঘোরা সম্পূর্ণ হয়না। এই অনুষ্ঠানের পর নৈশ ভোজের ব্যবস্থা থাকে। পারিবারিক কোন উৎসবে মাওরিরা এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় রান্না করে। মাটিতে গর্ত করে বড়বড় পাথর রেখে পাথরগুলো কাঠের আগুনে গরম করে। পাথরের উপর চারকোনা পাত্রে মাংস, আলু মশলা মাখিয়ে পাত্র ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়, চার ঘণ্টায় রান্না তৈরি হোয়ে যায়। মাওরিরা এই ধরনের রান্নাকে হাঙ্গি বলে। নৈশভোজে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে এইভাবে তৈরি মুরগির মাংস, আলু আমরা খেলাম, একদম অন্য রকমের রান্না কিন্তু অপূর্ব স্বাদ।

মাওরিদের হাকা নাচ

মাওরিদের হাঙ্গি খাবার

রোটারুয়ায় দুদিন থাকার পর ওয়েলিংটন যাওয়া, রাস্তা প্রায় ৪৫০km আর যেতে সময় লাগবে ৬ ঘণ্টা। রাস্তায় হুকাফলস পরবে , রাস্তা থেকে কিছুটা ঢুকে লুকআউট বোর্ড। রাস্তার উপর থেকে দেখাযায়, পাহাড়ের বেশ উপর থেকে জল পরার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছুটা রাস্তা যাবার পর এলো ৬১৬ Sqkm জায়গা জুড়ে বিশাল টাউপো লেক, নিউজিল্যান্ডের সব থেকে বড় লেক যা প্রায় ১৮০০ বছর আগে পৃথিবীর সব থেকে বড় অগ্নুৎপাতের ফলে তৈরি হয়েছিল। এই লেকের জল হাইডেল ও থারমাল পাওয়ার স্টেশনে ব্যবহার হয়। বিকাল সাড়ে পাঁচটায় আমরা ওয়েলিংটন পোঁছলাম। নর্থ আইল্যান্ডে আমাদের ঘোরা শেষ, কাল আমরা।nterislander Ferry চেপে ওয়েলিংটন থেকে সাউথ আইল্যান্ডের পিকটন FerryTerminal এ নামবো।

আজ ট্যুরের ষষ্ঠদিন, সকাল ৯ টায় ফেরী ছাড়বে আর ৮ টার মধ্যে Ferry Terminal এ পোঁছতে হবে, যারা অকল্যান্ড থেকে ভাড়ার গাড়ী নেবেন তারা এখানে গাড়ী ফেরত দিয়ে পিকটনে অন্য একটা গাড়ী নেবেন। Ferry Terminal এ বোর্ডিং পাস নিয়ে, ভারি জিনিসপত্র জমা দিয়ে জাহাজে উঠতে হয়। ৯২km এই জলযাত্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লাগে আর এই ফেরীতে ভ্রমণ পৃথিবীর অন্যতম। ঠিক সকাল ৯ টায় Ferry ছাড়ল, ফেরীতে বসার জায়গার পাশেই কাঁচের জানালা। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল ১৮৫৯ সালে তৈরি নিউজিল্যান্ডের সবথেকে পুরানো লাইটহাউস, সমুদ্রের নীলাভ জল দূরে পাহাড় আর নীল আকাশ মনে হয় একসাথে মিশে গেছে। একজায়গায় দেখা গেল জলের তিন রকম রঙ, নীল ঘন নীল আর সবুজ। দূরে ঝরনা দেখা যাচ্ছে, ঝর্নার খুব কাছে জাহাজ চলে এলো যাতে ঝর্নার আরও ভালো করে দেখা যায়। জাহাজের খোলা ডেকের উপর যারা আছেন , তাদের গায়ে ঝর্ণার জল লাগতে কী হইচই, ঝর্ণা আর খুব উঁচু থেকে জল পরার অপূর্ব দৃশ্য সেই সঙ্গে জল পরার শব্দ, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি যেটা ভাষায় প্রকাশ করা খুবই মুশকিল। এবারে জাহাজ বাঁ দিকে ঘুরবে। দূরে পিকটন Ferry Terminal দেখা যাচ্ছে, জাহাজ থেকে নেমে আবার আর একটা গাড়ী ভাড়া করতে হবে সাউথ আইল্যান্ড ঘোরার জন্য।

‘পিকটন’ থেকে যেতে হবে ১৫০ km দূরে ‘কাইকউরা’ , গাড়ীতে ২ ঘণ্টা লাগবে। রাস্তার দুধারে প্রচুর আঙ্গুরের ক্ষেত, এই জায়গাটা ‘মারলবোরো’ এটা নিউজিল্যান্ডের সবথেকে বড় ওয়াইন তৈরির জায়গা রাস্তার উপরেই দুটো ওয়াইনারি দেখা যায়। ‘কাইকউরা’ ঢোকার আগে বেশ কিছুটা রাস্তা পাহাড়ের কোল দিয়ে, পাশে রেল পথ আর তার পাশে সমুদ্র, জলের তিন রকমের রঙ হালকা নীল ঘননীল আর সবুজ মিলেমিশে একাকার। এইখানে অনেক পর্যটক গাড়ী থামিয়ে এই মনোরম দৃশ্য দেখেন আর ছবি তুলে রাখেন। ‘কাইকউরা’তে এক রাতের জন্য বিশ্রাম নেওয়া, সেরকম দর্শনীয় কোন জায়গা নেই।

আজ ট্যুরের সপ্তম দিন, আমরা ‘কাইকউরা’ থেকে ‘ক্রাইস্টচার্চ’ যাবো, ১৭০km রাস্তা যেতে লাগবে ২ ঘণ্টা। ক্রাইস্টচার্চে দু রাত্রি থাকতে হবে নাহলে এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা হবে না। ২২.০২.২০১১ তারিখে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্রাইস্টচার্চের প্রচুর ক্ষতি হয়, ১৮৫ জন মানুষ মারা যান। আমরা দুপুর ১২.৩০ টায় ক্রাইস্টচার্চ পোঁছলাম, নিউজিল্যান্ডে হোটেলে চেক ইন করার সময় দুপুর ২ টা। তাই কাছেই বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে গেলাম ১৮৬৩ সালে তৈরি ২১ হেক্টর জায়গা জুড়ে , ওইসময়ে ডেনমার্কের প্রিন্স অ্যালবার্ট আর প্রিন্সেস অ্যালেক্সের বিবাহকে স্মরণে এখানে একটি ইংলিশ ওক গাছ রোপণ করা হয়েছিল। গোলাপ বাগানে প্রায় ২৫০ রকমের গোলাপ ফুল ফুটে আছে, গোলাপ ফুলের এই রকম সাইজ আর রঙ খুব কমই দেখা যায়। এশিয়া, নর্থ আমেরিকা, ইউরোপ, সাউথ আমেরিকা ও সাউথ আফ্রিকা থেকে বিভিন্ন রকমের গাছ এনে এখানে রোপণ করা হয়েছে। এখানকার রক গার্ডেনে এমন কিছু ফুলের গাছ আছে যা সারাবছর ফুটে থাকে।

বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশেই ক্রাইস্টচার্চের ক্যানটারবেরি মিউজিয়াম ১৮৬৭ সালে তৈরি হয় পরে ১৯৯০ সালে মিউজিয়ামের রেনভেশন হয়। প্রায় একঘণ্টা লাগে পুরো মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখতে।

এরপর দেখা গেলো ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু বাড়ি ও চার্চের মেরামতির কাজ এখনও চলছে, যাঁদের দোকান, শপিং মলের ক্ষতি হয়ে ছিল তারা বড় বড় রেডিমেড কনটেইনারে দোকান খুলে বসেছে। নাম দিয়েছে ‘ Re Start ’। অনেক পর্যটক এই নতুন দোকানে ঢুকে জিনিসপত্র দেখছেন বা কিনছেন।

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাথিড্রাল চার্চ

ক্রাইস্টচার্চের একটা বড় আকর্ষণ ছাদহীন দোতলা বাসে করে শহর ঘোরা , আমরা সকাল ১০ টায় বাসের দোতলায় উঠে বসলাম। আগের দিনে ঘোরা বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে দিয়ে নিয়ে গেলো, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ক্রাইস্টচার্চ ক্যাথিড্রাল দেখলাম। বড় বড় লোহার বিম আর কনটেইনার দিয়ে চার্চের ভাঙ্গা অংশটাকে সাপোর্ট দিয়ে রেখেছে। ভূমিকম্পে মৃত ১৮৫ জনের স্মরণে এক জায়গায় ১৮৫টা বিভিন্ন ধরনের সুন্দর সাদা চেয়ার সাজিয়ে রাখা আছে, যার মধ্যে বিকলাঙ্গদের, বাচ্চাদের চেয়ারও আছে। জায়গাটা দেখে অনেক পর্যটকের চোখেই জল গড়িয়ে আসে। ক্রাইস্টচার্চে এখন গরম কাল, রাত সাড়ে নটার সময়ও সূর্যের আলো দেখতে পাওয়া যায়।

ভূমিকম্পে মৃত ১৮৫ জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৮৫ টি সাদা চেয়ার

আজ ট্যুরের নবম দিন, এখান থেকে ‘মাউন্টকুক’ যেতে হবে,৩৬০km রাস্তা সময় লাগবে ৫ ঘণ্টা, জায়গাটা সাউথ আইল্যান্ডের প্রাণকেন্দ্র। রাস্তার দুধারে আঙ্গুরের ক্ষেত, একটা ওয়াইনারি ও দেখা গেল। রাস্তার ওপরেই দেখা গেলো ৮৭ sqkm জায়গা জুড়ে প্রায় ২৭ km লম্বা ‘টেকাপো লেক’। লেকের পারেই গড়ে উঠেছে মানুষের বসবাসের জন্য ঘরবাড়ী আর টেকাপো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। টেকাপো লেকের পারে ‘লূপিন’ গাছ ও তার সুন্দর নীল বেগুনী কমলা হলুদ গোলাপি আর সাদা রঙের ফুল, একসঙ্গে এত রকম ফুলের কালার কম্বিনেশন খুব কমই দেখা যায়। লেকের ধারেই ১৯৯৫ সালে তৈরি ‘Church of the Good Sheperd’, কাছেই Mt Cook পাহাড় দেখা যাচ্ছে সামনে বিশাল নীল জলের লেক, তার মাঝে চার্চটিকে খুবই সুন্দর লাগছে। সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি চার্চে এসেছেন ,তাঁদের ফটোগ্রাফার দম্পতির বিভিন্ন পোজে ছবি তুলছে। আমরা বিকাল ৪.৩০ টায় Mt Cook এ হোটেলে পোঁছলাম। হোটেল থেকেই পাহাড়ের চূড়ায় বরফ জমে আছে দেখতে পাওয়া যায়। মাউন্টকুক নিউজিল্যান্ডের মধ্যে সবথেকে উঁচু পাহাড়, ১২,১২৮ ফুট, পর্বতারোহীদের খুব প্রিয় জায়গা কারণ বিভিন্ন উচ্চতায় Low Peak, Middle Peak ও High Peak আছে। মাউন্টকুকে একরাত থেকে পরের দিন কুইন্সটাউন যেতে হবে।

আজ ট্যুরের দশম দিন। মাউন্টকুক থেকে কুইন্সটাউন যাওয়া,২৬০km রাস্তা, সময় লাগে ৩ ঘণ্টা। সকাল দশটার সময় বেরলাম, মাউন্টকুক থেকে কিছুটা যাবার পর একটা জায়গা এলো ‘টুইজেল’ এখানে ‘Wrinkly Rams’ নামে এক ক্যাফে আছে যেখানে ভেড়ার লোম ছাঁটার Live Demonstration দেখানো হয়। হাতে সময় থাকলে আর আগে থেকে এখানে বলা থাকলে অনেকেই ভেড়ার গায়ের লোম ছাঁটা দেখে।

বিকেল ৩ টার সময় আমরা ‘কুইন্সটাউন’ এ পোঁছলাম, এই শহরটাকে ঘিরে রয়েছে ‘ওয়াকাটিপু’ লেক। লেকটার গঠন Z এর মতন, আমাদের হোটেলটা লেকের ধারেই। এই শহরে আছে ৪৫০ m উপরে স্কাই লাইন রেস্টুরেন্ট, Cable Car এ চেপে যেতে হয় যেটা Steepest Lift।n Southern Hemisphere। ডিনার ৮ টার সময় করতে হোলে , ৭ টায় Cable Car এ চড়ে বসতে হবে। Cable Car এর জানালা দিয়ে নীচে পাহাড় আর গাছপালা দেখতে দেখতে উপরে ওঠা, Cable এর।nclination এতটাই steep যে অনেক পর্যটক ভয়ে চেঁচামিচি শুরু করে দেন। রেস্টুরেন্ট থেকে নীচে শহরটাকে খুবই সুন্দর লাগে , পাহাড়ের উপরে এমন সুন্দর রেস্টুরেন্ট না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, প্রায় ১০০ জনের Buffet Lunch বা Dinner করার এলাহি ব্যবস্থা। কাঁচের বড়বড় জানালা, তার পাশে বসে নীচে লেক আর ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে খাওয়ার মজাটাই আলাদা। এই রেস্টুরেন্ট এতই জনপ্রিয় যে কুইন্সটাউনে যারা আসেন তারা এখানে এসে লাঞ্চ বা ডিনার করেন, আগে থেকে Seat Book না করলে জায়গা পাওয়া মুশকিল হয়। কুইন্সটাউনেও দুদিন থাকতে হয়, নাহলে এখানকার আকর্ষণীয় স্থানগুলো দেখা হবেনা।

স্কাইলাইন রেস্টুরেন্ট থেকে নিচে কুইন্সল্যান্ড শহর

কুইন্সটাউনে আর এক বিখ্যাত খাবারের জায়গা ‘Fergburger’, এটা Hamburger Restaurant, সকাল ৮.৩০ টায় খোলে আর ভোর ৫ টায় বন্ধ হয়। Ferburger এর Burger খাবার জন্য সব সময় লোকজন দোকানে আসে আর বেশির ভাগ সময়েই মানুষের লাইন থাকে। ভাবতে অবাক লাগে যে এই দোকানের Burger এতটাই জনপ্রিয় যে দোকানটা ২৪ ঘণ্টায় মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা বন্ধ থাকে। কুইন্সটাউনে যারা বেড়াতে আসেন , তারা ‘Fegrburger’ থেকে Burger বা তাদের পছন্দমত কোন খাবার খাবেনই। এত জনপ্রিয় হওয়া সত্যেও Fergburger এর কোন Branch নেই, একমাত্র এই দোকান কুইন্সটাউনের শটওভার স্ট্রীটে। কাল সকালে ‘Milford Sound’ যাওয়া হবে।

কুইন্সল্যান্ডে Fergburger এর বিখ্যাত দোকান

সকাল ৭ টার ট্যুরিস্ট বাসে যাওয়াই ভালো কারণ শুধু যেতে আসতেই ৯ ঘণ্টা লাগবে। বাস থেকে নেমে আবার ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট Cruise করে ঘোরা। বাসের ড্রাইভার যেতে যেতে।nformative Commentary করতে লাগলেন, কুইন্সটাউন থেকে ২ ঘণ্টা বাসে যাবার পর আসবে ‘Te Anau’ নামে এক জায়গা। তখন Tea আর Toilet Break, এই ‘ Te Anau ’ আর ‘Milford Sound ’ এর মধ্যে কোন পেট্রোল পাম্প নেই আর মোবাইল ফোনের সিগনালও পাওয়া যাবে না। এই জায়গাটার প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যই অপূর্ব, মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ আর উঁচু উঁচু পাহাড়।বাস ড্রাইভার বললেন মেইন রাস্তা থেকে কিছুটা ভিতরে বড় লেক আছে, রাস্তার উপর এক জায়গায় সাইন বোর্ডে লেখা ‘ Site for Bush Walk, Fishing, Water Sports ’। Te Anau পৌঁছে ড্রাইভার বললেন ২০ মিনিটের Break, একটা ক্যাফেতে বাস থামল। অনেকেই বাস থেকে নেমে কফি নিলো , ক্যাফের মধ্যে গিফট আইটেম, সুভেনির, নিউজিল্যান্ড লেখা টুপি, টি শার্ট বিক্রি হচ্ছে।ক্যাফের বাইরে একটা ঘেরা জায়গায় কয়েকটা আলপাকা চরছে, অনেকেই ছবি তুলল। এরপর বাস ছাড়ল। রাস্তায় অনেক গুলো ছোট ব্রিজ পড়ল, নীচে ঝর্নার জল বয়ে যাচ্ছে, কাঁচের মতো স্বচ্ছ জল আর জলের নীচে নুড়ি পাথরও দেখা যাচ্ছে। এবার ড্রাইভার বললেন, সামনে একটা পার্ক আসছে দশ মিনিট হেঁটে পার্কটা দেখে নিন। বাসের সকলকে নামিয়ে দিয়ে বাস এগিয়ে যাবে, পার্ক থেকে বেরিয়ে আবার বাসে উঠতে হবে। পার্কের মধ্যে খুব বেশি উঁচু নিচু জায়গাতে কাঠের রাস্তা বানানো, এক জায়গায় পাহাড়ের সামনেই লেক। লেকে পাহাড়ের প্রতিবিম্ব জলে দেখা যাচ্ছে, বোর্ডে লেখা ‘মিরর লেক’। পার্কটা ঘুরে দেখে সকলে বাসে উঠে পড়লো।

এবার প্রকৃতির যে দৃশ্য দেখা গেলো সেটা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না, পাহাড়ের চূড়ায় বরফ জমে আছে আর কয়েক জায়গায় ঝর্ণার জল পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে নীচে নেমে আসছে। ড্রাইভার বাস থামিয়ে বললেন, জায়গাটা দেখে ছবি তুলে আসুন। আরও বললেন কিছু দিন আগে এই ঝরনার জলের Test করা হয়েছিল, বাজারের মিনারেল ওয়াটারের Test Result ১০ আর এই ঝর্ণার জলের ৩। অনেকে ঝরনার জল চেখে দেখছে আর বোতলে ভরে নিচ্ছে। ***

আর আধ ঘণ্টার মধ্যে গন্তব্য স্থলে পোঁছে যাওয়া যাবে , এবারে রাস্তাটা খুবই সরু আর বেশ চড়াই উতরাই। রাস্তার দুধরেই বেশ ঘন জঙ্গল, এক জায়গায় তো সূর্যের আলোও আসছে না। এবারে গাড়ি পারকিং করার জায়গা দেখা যাচ্ছে আর ‘মিলফোর্ড সাউণ্ড এসে গেলো। ড্রাইভার আমাদের ‘Scenic Cruise’ এর বোর্ডিং পাস দিয়ে দিলেন যেটা ১২ টা ৪৫ মিনিটে ছাড়বে। Cruise এ জানালার ধারে বসতে পাওয়া গেলে বাইরের দৃশ্যাবলী ভালকরে দেখা যায়, ঠিক সময়েই Cruise ছাড়ল। Cruise এ Crew Member, Commentary করছিলেন, বললেন দুটো খাড়া পাহাড়ের মধ্যে সরু জায়গা দিয়ে Cruise টা যাবে, নিউজিল্যান্ডে এই জায়গাটা Tourist দের কাছে খুবই প্রিয়। তিনটি পাহাড়ের চূড়া আছে, একটা হাতির মাথার মত দেখতে বোলে ‘হাতি ’ আরেকটি ঝুঁকে পরা সিংহের মত বোলে ‘সিংহ’। এখানে দুটো স্থায়ী ঝর্ণা আছে, ‘লেডি বোয়েন ’ আর ‘স্টারলিং’ ১৫৫ m উঁচু যেখান থেকে সারা বছরই জল পরে। এছাড়া বর্ষাকালে শতাধিক অস্থায়ী ঝর্ণা দেখা যায়। হাতি আর সিংহ দুটো পাহাড়ের চূড়াই আমরা দেখলাম, এবার দেখা যাচ্ছে এক ঝর্ণার খুব উঁচু থেকে জল পড়ছে। আমরা উপরের ডেকে উঠলাম, Cruise টা পাহাড়ের কাছে চলে এলো, ঝর্ণার জলের ছাঁট পর্যাটকদের গায়েও লাগছে। তারমধ্যে ফটো তোলার জন্য হুড়োহুড়ি, একজনকে দেখলাম প্লাস্টিকের বর্ষাতি পরে জলের ছাঁট থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। কিছু ছোট আকারের ঝর্ণার জল মাটিতে পরার আগেই হাওয়ায় মিশে যায়। এখানে জন্তুদের মধ্যে সাদা সিল মাছ, পেঙ্গুইন, ডলফিন আর মাঝে মাঝে তিমি মাছ দেখা যায়, আমরা কয়েকটা বাচ্চা সিল মাছ দেখলাম, রোদ পোয়াচ্ছে। এবার Cruise এর মুখ ঘুরল, ফেরার পালা। সন্ধ্যে ৬.৩০ টায় আমরা Fergberger এর দোকানের কাছে নেমে, বিখ্যাত Berger খেয়ে হোটেলে ফিরলাম, সত্যই এই Berger এর অপূর্ব স্বাদ।
আজ ট্যুরের দ্বাদশ দিন, কুইন্সটাউন থেকে ‘Franz Josef Glacier’ যাবার পালা , ২২০ km রাস্তা পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ৫ ঘণ্টা। তাই সকাল ৯-১০ টার মধ্যে বেড়িয়ে পড়াই ভালো , ১০৫km দূরে ‘ওয়ানাকা’ হয়ে যেতে হবে। রাস্তার উপর দুধারেই ঝাউ আর পাইন গাছের সারি, মাঝে মাঝে আঙ্গুরের ক্ষেত। কয়েক জায়গায় রাস্তার ওপর সাইনবোর্ডে লেখা ‘B and B’ আগেও দেখা গেছে , মানে ‘Bed and BreakFast’। ‘ওয়ানাকা ’ জায়গাটায় প্রচুর Tourist আসে, তাদের মধ্যে কেউ বুশ ওয়াকিং, কেউ ঘুরে ঘুরে সাইক্লিং করে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাবার জন্য। তারা এই রকম ‘B and B’ Sign Board এর Direction দেখে সেইমত বাড়িতে পোঁছে যায়, রাত্রিটা থাকে আর পরের দিন Break Fast করে আবার বেড়িয়ে পড়ে। ওয়ানাকাতে বাঙ্গি জাম্পিং, জেটবোটিং, ঘোড়ায় চড়ে ট্রেকিং, নদিতে সারফিং ও রাফটিং করার ও ব্যবস্থা আছে। রাস্তার ওপরে একটা গলফ কোর্স ও দেখা গেলো , এই জায়গাতে ‘কিয়া ’ নামে Mountain Parrot দেখতে পাওয়া যায়, আমরা তো দেখতে পেলাম না।

এই রাস্তার উপর অনেক গুলো নদীর ওপর ছোট ছোট ব্রিজ আছে, বেশির ভাগই সিঙ্গল লেন-ব্রিজ আর লাইট ভেহিকল যাবার জন্যে। একটা ব্রিজের আছে যেটা রেল কাম রোড ব্রিজ, একই রাস্তার উপর দিয়ে রেল যাবে আবার গাড়িও যাবে, এইজন্য কনক্রিটের রাস্তা আর রেল লাইনটা কনক্রিটের ভিতরে। এইবার ‘ Franz Josef Glacier ’ লেখা বোর্ড দেখা গেল, আর মাত্র ৫০ km। এরপরেই পাহাড় দেখতে পাওয়া গেলো, যার চূড়াতে জমাট বরফ। এবারে রাস্তা সরু হয়ে আসছে, আর ঘনঘন বাঁক, গাড়ি সাবধানে চালাতে হচ্ছে। বিকাল সাড়ে চারটায় হোটেলে পোঁছে গেলাম, হোটেলে ঘর থেকেই পাহাড় আর তার চূড়ায় বরফ এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। ভোরবেলায় সূর্যের আলো পরলে পাহাড়ের চূড়া সোনা দিয়ে মোড়া মনে হয়। নিউজিল্যান্ডের জল হাওয়া দূষণ-মুক্ত কিন্তু Franz Josef Glacier এর জলহাওয়ার গুণমান যেন আরও এক কাঠি উপরে। পরিবেশের এই তফাতটা বেশ উপলব্ধি করা যায়।

Franz Josef Glacier

Franz Josef এর Main Attaraction হোল Glacier দেখা , তাই সকালবেলা বেড়িয়ে পড়াই ভালো। এখানে দুটো Glacier আছে, Franz Josef Glacier আর Fox Glacier। রাস্তায় প্রথমে Franz Josef Glacier পড়ে যেটা প্রায় ১২ km লম্বা, যে জায়গাটা জুড়ে এই দুটো Glacier সেটা World Heritage Site আর ‘Te Wahipounamu’ পার্কের অংশ। বছরে প্রায় ২৫০০০০ ভিজিটার এই Glacier দেখতে আসেন, ২০১২ সাল থেকে হেলিকপ্টার ছাড়া এই জায়গায় আসা না। তাছাড়া এই Glacier এর উপর হাঁটতে গেলে।ce Axe আর বিশেষ ধরনের বুট জুতা লাগে, যা ট্যুর অপারেটারেরা দেয়। Franz Josef Glacier দেখতে যাওয়ার রাস্তায় কিছুটা যাওয়ার পর, সাইনবোর্ডে লেখা ‘Do Not Go Beyond This Point’। এই Glacier এর বরফগলা জল থেকেই ২৫km লম্বা ‘Waiho’ নদীর উৎপত্তি যেটা ‘টাসমান সাগরে’ পড়েছে।

এরপর Fox Glacier দেখতে যাওয়া , এটি ১৩km লম্বা। ১৮৭২ সালে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইলিয়াম ফক্স এই Glacier দেখতে এসেছিলেন, তাঁর নাম অনুসারে এই Glacier এর নামকরণ হয়। এই Glacier এর বরফগলা জল থেকে উৎপত্তি হয়েছে ফক্স নদীর। এই Glacier দেখতে রোজ প্রায় ১০০০ পর্যটক এখানে আসেন। কিছুটা রাস্তা গাড়ী করে যাবার পর , গাড়ী পারকিং করে বাকি রাস্তা হেঁটে যেতে হয়। রাস্তার দুধারে পাহাড়, বহু দূরে পাহাড়ের উপর Glacier দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের ওপর থেকে মাঝে মধ্যে পাথর ভেঙ্গে পড়ে, তাই রাস্তার ধারে তারের বেড়া আর সতর্কবাণী। রাস্তার উপর বড়বড় পাথর পড়ে আছে কিছু জায়গায় সাদা বালি, মনে হয় বর্ষাকালে বা যখন বরফ গলে তখন এই জায়গায় আসা যায় না। Glacier খুব কাছ থেকে দেখতে হোলে প্রায় ৪ ঘণ্টা হাঁটতে হবে , আমরা সমতল রাস্তার উপর ২ ঘণ্টা হাঁটলাম। এবারে পাহাড়ি রাস্তা, হাঁটাও বেশ কষ্টকর হচ্ছে আরও ১ ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা আর এগোতে পারলাম না। নয়নাভিরাম এই দৃশ্যকে সবাই ক্যামেরা বন্দি করে রাখছে। এক ক্যানাডিয়ান দম্পতি তাদের বাচ্চাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে চলেছেন, অনুমতি নিয়ে তাদের ছবি তুললাম। যে জায়গা অবধি উঠতে পেরেছি সেখান থেকে Glacier এর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম আর ভগবানকে স্মরণ করলাম এই দুর্গম স্থানে পৌঁছানোর জন্যে।

নিউজিল্যান্ড ভ্রমণ-সূচী অনুযায়ী আজ চতুর্দশ দিন, Franz Josef থেকে ক্রাইসচার্চ ফিরে যাওয়া। সকাল দশটায় বেড়িয়ে প্রথমে Greymouth Railway Station যেতে হবে , প্রায় ১৮০km পথ সময় নেবে সোয়া দুঘণ্টার মতো সেখানে গাড়ীটা ফেরৎ দিতে হবে, আর Greymouth Station থেকে ক্রাইসচার্চ অবধি TranzAlpine Scenic Train এ যাওয়া। এই ট্রেন সাড়ে চার ঘণ্টায় ২২৩km পথ পার হবে, আর ট্রেন লাইনের দুধারেই অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। ট্রেনে সীটের ধারে বড় বড় কাঁচের জানালা আর ট্রেনটার ঠিক মাঝখানে একটা বগি যেখানে জানালা নেই, শুধু রেলিং দেওয়া খোলা বারান্দা , প্রকৃতির শোভা ভালভাবে দেখার জন্য। ট্রেন দুপুর ১ টা ৪৫ মিনিটে ছাড়ল, ট্রেনে ক্যাফেটেরিয়াও আছে। ট্রেনটা এখন একটা ব্রিজের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, নীচে গভীর খাদ। ট্রেনে রানিং কমেনট্রিও হচ্ছে যা থেকে জানা গেল এবারে ওয়াইমাকাইরি নদী আসছে যেটার উৎপত্তিও বরফ গলাজল থেকে। সামনে বড়বড় ঝাউ আর পাইনগাছের জঙ্গল।এখন ট্রেনটা আর একটা ব্রিজের ওপর, নীচে পাহাড়ি নদী। ব্রিজের পর টানেলের মধ্যে দিয়ে ট্রেনটা যাচ্ছে। দূরে কিছু বাড়ি, বড় বড় শেড দেখা যাচ্ছে, এবার ক্রাইসচার্চ আসছে। সন্ধ্যা ৬ টায় ক্রাইসচার্চ রেলষ্টেশনে পোঁছে গেলো।

নিউজিল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পরেও ওখানকার লেকের নীল জল , পাহাড়ের চূড়ায় জমা সাদা বরফ, রাস্তার ধারে সবুজ ঝাউবন, নাদুসনুদুস ভেড়া আর গরু এখনও চোখে ভাসে। পাঠকগণ যারা বেড়াতে ভালোবাসেন আর যাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব তারা নিশ্চয়ই নিউজিল্যান্ড ঘুরে আসবেন, খুব ভাল লাগবে।

 


লেখক পরিচিতি -  বি.ই.কলেজ , শিবপুর ( এখন ইন্ডিয়ান   ইন্সিটিউট  অফ   ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড  টেকনোলজি , IIEST , Shibpur )  থেকে  বাস্তু বিদ্যায় স্নাতক।  সরকারি , আধা সরকারি আর  বেসরকারি  সংস্থায়  বিভিন্ন  পদে  ভারতের  নানা জায়গায়  নির্মাণ কাজে  নিযুক্ত  ছিলেন।   ভ্রমণ কাহিনি   আর  জীবনের  বিশেষ কিছু  ঘটনা   সহজ  সরল   ভাষায়  লিখতে   পছন্দ  করেন।    অপ্রচলিত বিন্যাস   ও  সূত্রে   শব্দছক   তৈরি   করেন   যা   বিভিন্ন  দৈনিক  আর  ম্যাগাজিনে  প্রকাশিত  হয়েছে।  

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।