বিবিধ প্রসঙ্গ
জানুয়ারি ৩০, ২০১৬
চেনা সমুদ্র - অচেনা ইতিহাস
সোমেন দে
একটা নির্জন উপত্যকা কি করে একটু একটু করে একটা জনপদ হয়ে ওঠে
তার ইতিবৃত্ত কে আর গুছিয়ে লিখে রাখে। সেখানে প্রথমে একটা লোক
কি করে হঠাৎ এসে পড়ে, কি করে আর কেনই বা সেখানে বাসা বাঁধে! হয়তো
পেটের দায়ে, হয়তো শান্তির খোঁজে অথবা হয়তো বা অজানাকে জানতে। তারপর এক কি করে অনেক হয়, তার পাশে আর একটা তার পাশে আর একটা। এই
করে একটা বসতি গড়ে ওঠে। বসতি হয় একটা গ্রাম, গ্রাম হয়ে ওঠে একটা
শহর হয়। একটা সমুদ্র, একটা নদী, একটা পথ মানুষ কে টেনে আনে তার
কাছে। কারণ তারাও তো একলা থাকতে চায় না। চায় প্রাণের উষ্ণতা। আর
এভাবেই গোটা দুনিয়ায় হাজার হাজার শহর গড়ে উঠেছে।
দীঘা সমুদ্রতট
|
কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম দীঘা। উদ্দেশ্য নেহাতই মনের জং ছাড়ানো।
দীঘার সমুদ্র আর বেলাভূমি নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। সেই
এরোপ্লেন নামার যোগ্যতা-সম্পন্ন নির্জন সৈকত, বিস্তীর্ণ তটভূমি
আর পিন্টু ভট্টাচার্যের হিট গানে বর্ণিত ঝাউবনের ছায়ারা কবেই অপসৃত
হয়েছে। এখন সমুদ্রের ধারে শুধু নীরস গদ্যের মত পাথরের স্তূপ বসে
বসে অশান্ত ঢেউদের পাহারাদারি করে। ইতিহাস আমার প্রিয় বিষয় নয়।
দীঘায় আসা নেহাতই সমুদ্রের টান। আমার জনৈক বন্ধুর সুবাদে আমরা
যে বাড়িটিতে উঠেছিলাম সেই বাড়িটাই আমাকে হাতছানি দিল ইতিহাস
নিয়ে একটু নাড়াঘাঁটা করার। সেই হাতছানি ধরে এগোতে এগোতে বেরিয়ে
পড়লো একটি সৈকত শহরের আবিষ্কার এবং পুনরাবিষ্কারের একটি সুন্দর
গল্প।
রানসউইক হাউস
|
বাড়িটার নাম রানসউইক হাউস। বর্তমানে এটি স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের
গেস্ট হাউস। বাড়ির গঠনশৈলীতেই খানিকটা কলোনিয়াল রাজের ছাপ। বেশ
একটু উঁচু জমির ওপরে তৈরি দো তলা বাড়ি। সামনে একটা বিশাল ঘন সবুজ
গালিচার মত লন।
আর লন পেরিয়ে ই সুন্দর একফালি সমাধি ভূমি, তার
চারি দিকে কিছু ফুল গাছ খুব সসম্মানে ঘিরে আছে একটি শ্বেতশুভ্র
এপিটাফকে।
তাতে লেখা -
In affectionate
memory of JOHN FRANC SNAITH
The First Resident of Digha
Born At Middlesbourough, England
14th August 1882 and Died at Digha
on 18th December 1964
দীঘার প্রথম নাগরিকের বাড়ি। মনে মনে বললাম – স্নেইথ সাহেব,আপনাকে
তো মশায় কালচার করতে হচ্ছে।
দোতলা ওঠার সিঁড়ি
|
দোতলা ওঠার সিঁড়িটি ধব ধবে সাদা, কাঠের তৈরি,স্টেয়ার কেসে ভিক্টোরিয়ান
যুগের তৈলচিত্র, ঠিক ইয়োরিপিয়ানদের বাড়ি যেমন করে সাজানো থাকে।
নূতন ও পুরাতনের সুচারু মিশ্রণ। অবশ্য সিঁড়িটি ঘোরার মুখে একটি
রবীন্দ্রনাথের হাফ বাস্ট মূর্তি ও আছে।তিনি নূতন বা পুরাতন নয়।
সনাতন। সন্দেহ দেখা দিল – ঐ ভদ্রলোক যে রেটে এখানে ওখানে ঘুরে
বেড়াতেন এই বাড়িতেও এসে ছিলেন নাকি কখনো ?
জন ফ্র্যাঙ্ক স্নেইথ-এর সমাধি
|
খবর নিয়ে জানলাম না ঐ মূর্তিটি নেহাতই গৃহসজ্জার কারণে। সাদা
সাহেবরা চলে যাবার দেশী সাহেবদের উদ্যোগে উনি এই স্থানে অধিষ্ঠিত
হইয়াছেন। এর কোনো ইতিহাস নেই। বাস করার ঘর গুলিতেও কিছু কিছু প্রাচীনের
ছোঁয়া সিলিংয়ে লোহার বিম,বিশাল জানালা, পেল্লায় বাথরুম। এখানে
আমাদের থাকার মেয়াদ চারদিন। মনে মনে ভাবলাম এই সময়ের মধ্যে যতটা
পারা যায় স্নেইথ সহেবকে একটু জেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।ধনুক
থেকে তীর সামনে যাওয়া আগে তাকে টেনে একটু পিছন দিকে নিয়ে যেতে
হয় তাকে লক্ষ্য অবধি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। সেই নিয়মে একটু পিছিয়ে
যাচ্ছি।
১৭৫০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস নামে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ইংরাজ যুবক
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে করণিক হিসাবে যোগদান করলো। তাকে পাঠানো
হল শহর কলকাতায়। কোম্পানির ব্যবসা তখন এ দেশে ধনে জনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।মুর্শিদাবাদের
নবাব আলিবর্দি খাঁর সঙ্গে কোম্পানির একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। এবার নবাব হবেন তার নাতি সিরাজ উদ উলহা। সিরাজ
আবার গোরাদের একেবারে দেখতে পারেনা। আলিবর্দির মৃত্যুর পর লেগে
গেল গণ্ডগোল। সিরাজ গোরাদের তাড়াতে চায় এ দেশ থেকে। শেষ পর্যন্ত
লেগে গেল সেই বিখ্যাত পলাশির যুদ্ধ। মাদ্রাজ থেকে থেকে রবার্ট
ক্লাইভ এসে যুদ্ধ পরিচালনা করলেন। ধূর্ত ক্লাইভ বুঝলেন শুধু বীরত্ব
দেখিয়ে যুদ্ধ জেতা যাবে না। বুঝলেন এ দেশে যেমন দেশের জন্যে লড়াই
করার জন্য অনেক বীর সৈনিকরা আছেন তেমনি আছেন ক্ষমতা লোভী মীরজাফররাও।
মীরজাফরদের খুঁজে বার করলেন এবং কাজে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেওয়ার
কাজে লাগালেন এবং এ দেশের ভাগ্য পালটে দেওয়ার যুদ্ধে জিতলেন। ভারতে
ব্রিটিশদের রাজত্ব কায়েম করার প্রথম দরজাটি উন্মুক্ত হল।
‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী
রাজদণ্ডরূপে।‘
এই যুদ্ধে ক্লাইভ কে উপযুক্ত সহযোগিতা করে তার আস্থা ভাজন হলেন
ওয়ারেন। পুরস্কার পেলেন হাতে হাতে। ১৭৫৮ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস
হলেন মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্ট।
এর পর আর পিছনে ফেরা নেই। ওয়ারেন হেস্টিংস ধাপে ধাপে উঠে ১৭৭৩
সালে বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়ে গেলেন। আগেই বলেছি ওয়ারেনের
চিন্তাধারা একটু অন্যরকম ছিল। সে বুঝল এ দেশে যদি জমিয়ে বসতে হয়
হয় তবে এই বিরাট দেশটাকে জানতে হবে। বুঝতে হবে এদেশের ধর্ম সংস্কৃতি
লোকাচার ভাষা আচার ব্যাবহার। জাতিভেদ কুসংস্কার অশিক্ষার অন্ধকার
থেকে যতটা দরকার এ জাতটাকে বের করে আনতে হবে নিজেদের স্বার্থেই।
এই মত নিয়ে তার জাত ভাইদের সঙ্গে বিরোধ বাদলেও ওয়ারেন নিজের বিশ্বাসে
অটুট রইলেন।
এ দিকে ব্রিটিশরা এ দেশে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যখন নিয়ে
আসতে লাগলেন রাশি রাশি নিজেদের লোক লস্কর সৈন্য সামন্ত, তখন একটা
সমস্যা দেখা দিল। শীতের দেশের গোরা সাহেবরা এ দেশের গরম আর মশার
কামড়ে কাহিল হয়ে পড়লেন। পলাশীর যুদ্ধে জেতার কায়দা কানুন তাদের
জানা ছিল ভালো রকম। কিন্তু মশা আর গরমের সঙ্গে যুদ্ধ করা কৌশল
তাদের জানা ছিল না। তারা খুঁজতে লাগলো এমন কিছু জায়গা যেখানে গরম
অনেকটা কম। কারণ সে রকম জায়গায় তারা স্বাস্থ্যাবাস গড়ে তুলবেন।
এই খোঁজাখুঁজি চলতে লাগলো চারিদিকে।
আঠারোশো শতাব্দীর শেষের দিকে দার্জিলিং আর সিমলা দুই পাহাড়ি জায়গায়
স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে উঠলো। সে সময় ওয়ারেন হেস্টিংস কোলকাতার কাছেই
একটি সমুদ্রতটের সন্ধান পেলেন যেখানে হাঙ্গর আর কুমিরের উৎপাত
ততটা নেই। চারিদিকের জঙ্গলে শিকার করাও যায়, সমুদ্রে মাছ ধরাও
যায়।তবে কোলকাতার খুব কাছে হলেও জায়গায় কিন্তু যাতায়াত করার পথ
খুব দুর্গম। চারি দিকে নদী নালা। ভালো রাস্তা নেই।
তবু ওয়ারেন চেষ্টা চালিয়ে গেলেন তার এই পছন্দের সমুদ্রতটটিকে
জনপ্রিয় করে তোলার জন্যে। পুরনো সমৃদ্ধ শহর কন্টাইয়ের কাছে জায়গাটির
তখন নাম ছিল বীরকুল। বীরকুলকে জনপ্রিয় করার চেষ্টায় যে ওয়ারেন
কিছুটা সফল হয়েছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সতেরোশো আশি সালের
১৯ মের হিকিজ গেজেটে প্রকাশিত একটি চিঠিতে –
‘We
are informed that the following persons of figure and consequence
are arrived at Beercool for the benifit of their health from
Calcutta. Henry Great Esq,Major Camac, Doctor Allen, Captain
Kilpatrick of 31st legion ….And we have the pleasure to assure
the freinds of above honourable party and the public in general
that they have received the most essential benefit from the
salubrious air of that admirable spot, which we have no doubt
will make the place a fashinable resort’
তবে ঠিক কি ভাবে হেস্টিংস সাহেব বীরকুল জায়গাটির সন্ধান পেলেন
সেটা নির্দিষ্ট ভাবে জানা যায় না। ব্রিটিশদের ভারতে আসার আগে বীরকুল
জায়গাটি ময়ূরভঞ্জের রাজা দের অধীনে ছিল। ১৫০০ সালে এই অঞ্চলে একটি
কৃষক বিদ্রোহ হয়। কৃষকরা বিদ্রোহের পর তারা তাদের নিজেদের লোক
সাগর রাইয়ের হাতে জমিদারিত্ব তুলে দেয়। মীরজাফর কে সরিয়ে ১৭৬০
সালে মীর কাশিম নবাব হবার খুশিতে ইংরেজদের মেদিনীপুর জেলাটি উপঢৌকন
হিসাবে দান করে। ওয়ারেন হেস্টিং ১৭৬৩ সালে বাংলার গভর্নর জেনারেলের
পদাধিকারে মেদিনীপুর জেলা সংলগ্ন উড়িষ্যার উপকূলবর্তী অঞ্চল দখলে
নেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হয়তো সেই সময়ে এই অঞ্চলে পরিদর্শন
করতে এসে বীরকুলের সমুদ্রতটের খবর পান।
১৫০০ শতাব্দীতে লেখা ফা হিয়েনের ভ্রমণ কাহিনী তে বিরকুল বা কাঁথী
নামের কোনো জনবসতির নাম পাওয়া যায় না। পরবর্তী কালে লিখিত ভ্যালেন্টাইনের
ভ্রমণ কাহিনীতে কেন্দুয়া নামে একটি নদী বন্দরের উল্লেখ আছে। এই
কেন্দুয়া আসলে সাহেবদের উচ্চারণের দোষে কন্টাই হয়ে থাকবে হয়তো।
স্ত্রীকে লেখা হেস্টিংস এর চিঠির একটি সংকলন বার করেন সিডনি গ্রেয়ার।
সেখানে প্রাপ্ত একটি বিবরণে বীরকুলের যে সুখ্যাতি পাওয়া যায় তা
এ রকম –
‘Beercool
was the sanatorium, the Brighton of Calcutta,. and the newspaper
and councils records mention constantly that so-and-so gone
to Beercool for his health …. It has already advantage of a
beach which is free from sharks and all noxious animals except
crabs and there is proposal to erect convenient apartments for
the reception of the nobility and the gentry and organise entertainment.’
ওয়ারেন হেস্টিংস শুধু বীরকুলকে জনপ্রিয় করার চেষ্টাই করেন নি
নিজেও বাসযোগ্য একটি বাংলো বাড়ি তৈরি করেন।
তবে হাঙ্গর কুমিরের উৎপাত না থাকলেও এই অঞ্চলে খুব ঘন ঘন সাইক্লোন
হত। ওখানকার সমুদ্রেরও খুব বিধ্বংসী চেহারা ছিল। এই সব কাড়নে হেস্টিংস
সাহেবের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও বীরকুল ঠিক তেমন ভাবে সৈকত শহর
হয়ে ওঠেনি। জর্জ চ্যাম্পম্যান নামের আরেক সাহেব যখন ১৭৯৬ সালে
বীরকুলে যান তখন সেখানে ভাঙ্গা পরিত্যক্ত কিছু বাংলো দেখতে পান।
আরও কিছুদিন পরে ১৮২৩ সালে একটি দল সেখানে গিয়ে দেখেন সেখানে
হেস্টিংস এর বাংলো বাড়ি ছাড়া সবই সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
বীরকুল আবার একটি জনহীন সমুদ্রতটে পরিণত হয়। আশে পাশের জঙ্গল বুনো
কুকুর, সাপ খোপের অভয়ারণ্য হয়ে যায় । কেয়া গাছে ঘন ঝোপে আবার ছেয়ে
ফেলে সমস্ত বালিয়াড়ি।
প্রায় একশো বছর এ ভাবেই পরিত্যক্ত পড়ে ছিল ওয়ারেন হেস্টিংস এর
সাধের Brighton of Calcutta।
হ্যামিল্টন এন্ড কোম্পানি ছিল উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের
প্রথম ভাগে কলকাতার একটি অভিজাত অলঙ্কার বিপণি। এই হ্যামিল্টন
কোম্পানির খদ্দের এই শহর তথা দেশের অনেক রইস ব্যক্তিরা। এই দোকানের
মালিকের নাম ছিল জন স্নেইথ। বিয়ে থা করেন নি ভদ্রলোক। কিন্তু স্বভাবে
আছে ব্রিটিশ আভিজাত্যে, সৌখিনতা এবং রোমান্টিকতা। তার দোকানের
খদ্দেরের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন অনেক রাজা-রাজড়া, জমিদার, ব্যবসায়ীরা।
তাদের আমন্ত্রণে ঘুরে বেড়াতেন নানা জায়গা। তেমনি এক খদ্দের ছিলেন
বালিশাইয়ের এক ভূস্বামী। তিনি খুব সম্ভবত বারো ভুঁইয়ার এক ভুঁইয়া।
তিনি জানতেন সায়েবের প্রকৃতি প্রেমের কথা। সেই ভুঁইয়া সাহেবকে
জানালেন কন্টাইয়ের কাছে বীরকুলের সমুদ্রতটের কথা। পুরনো পত্র পত্রিকা
ঘেঁটে জন স্নেইথ আগেই জানতে পেরেছিলেন বীরকুলের কথা। তাই সঙ্গে
সঙ্গেই যেতে চাইলেন বীরকুলে।
রানসউইক হাউসের ফলক
|
সেটা ছিল ১৯২১ সাল। বেলদা থেকে পৌঁছালেন কন্টাইয়ের ডাকবাংলো
তে। সেখান থেকে হাতিতে চেপে পৌঁছালেন দীঘা গ্রামে। ওয়ারেন হেস্টিংস
আবিষ্কৃত বীরকুলের তটভূমি তখন নিরন্তর সমুদ্রের আগ্রাসনে বিলীন
হয়েছে সমুদ্রগর্ভে। এখনকার দীঘা তখন সমুদ্র থেকে প্রায় চার কিলোমিটার
দুরে ছিল। কিন্তু তবু সেই দীঘা থেকে নীল সমুদ্রের উথালি পাথালি
ঢেউ, সেই সঙ্গে সূর্যের আলোয় সোনা ঝরা বিস্তীর্ণ বালুকারাশি দেখে
সাহেবতো একেবারে দিওয়ানা হয়ে গেলেন। কলকাতায় ফিরেই সরকারের কাছে
দরবার করলেন দীঘাতে তার জমি চাই। প্রায় সাড়ে এগারো একরের একটুকরো
জমি পেয়েও গেলেন। আরেক সাহেব ইঞ্জিনিয়ার এইচ এ ক্লয় কে ভার দিলেন
এই জমিতে একটি বাংলো তৈরি করার। সমুদ্র পথে বাড়ি তৈরির মাল মশলা
এলো। ওখানেই ইঁট ভাটি করে ইঁট তৈরি হল। ১৯৩০ সালে তৈরি হয়ে গেল
রানসউইক হাউস। স্নেইথের একটি নিজস্ব টু সিটার এরোপ্লেন ছিল। সেই
এরোপ্লেনে মাঝে মাঝেই চলে আসেন দীঘা। দীঘার সমুদ্রতট এতটাই শক্তপোক্ত
যে অনায়াসেই সেখানে নেমে পড়তো স্নেইথ সাহেবের উড়োজাহাজ।
এদিকে সাহেবের বয়স বাড়ছে। ব্যবসা যদিও ভালোই চলছে। কিন্তু আটচল্লিশ
বছরের চিরকুমার স্নেইথের মনে কিঞ্চিৎ বৈরাগ্য জন্মেছে। অনেক তো
হল। কার জন্যে আর অর্থ উপার্জনের বন্ধনে আটকা পড়ে থাকবেন। আমেরিকায়
তার এক প্রিয় ভাগনে থাকে। তার নাম ফ্লেনিগান। স্থির করলেন তাকেই
দিয়ে যাবেন সব সম্পত্তি।
মনে যেমন বাসনার উদয় তেমনি কাজ। কোলকাতায় রইল পড়ে খানদানী হীরে
মানিকের জমাট ব্যবসা। ভাগনে ফ্লেনিগন যেমন পারে সামলাক। স্নেইথ
জমিয়ে বসলেন দীঘাতে। পছন্দ মত কিছু অনুগতজন পরিচারকদের নিয়ে এলেন
সেখানে। খালি জমিতে কিছু শাক সব্জীর চাষবাস করালেন। নিজের জেনারেটার
বসিয়ে নিলেন। বাড়ি সাজালেন নিজের মত করে। সপ্তাহান্তে ফ্লানিগেন
মামার উড়োজাহাজ বেহালা ফ্লাইং ক্লাব থেকে উড়িয়ে নিয়ে নামত দীঘার
সমুদ্রতটে। নিয়ে আসতো খাবার দাবার, দরকারি জিনিস পত্র। কখনো কখনো
বন্ধু বান্ধবদেরও দল বেঁধে নিয়ে আসতেন। দীঘায় বসে যেত পান ভোজনের
আসর। ক্রিসমাসে জমিয়ে পার্টি হত। কখনো আবার বড়িষার অক্সফোর্ড মিশন
অরফানেজের বাচ্চাদের নিয়ে আসতো ফ্লানিগেল। তাদের নিয়ে হত স্পোর্টস,
ফান্সিড্রেস, ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা।
এর মধ্যে স্নেইথ সাহেব নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দীঘা
কে জনপ্রিয় করে তোলার। তার বিশেষ বন্ধু নাড়াজলের রাজাকে অনুরোধ
করলেন দীঘাতে একটি বাড়ি বানাতে। রাজা বাড়িতো বানালেনই, সঙ্গে বানালেন
একটি স্কুলও। স্নেইথ সাহেব তৎকালীন সরকার কে মাঝে মাঝেই বোঝাবার
চেষ্টা করতেন দীঘা একটি চমৎকার টুরিস্ট স্পট হতে পারে। ইংরেজ সরকার
হয়তো তখন ব্যতিব্যস্ত স্বাধীনতার আন্দোলন নিয়ে। এ দিকে তাই কান
দেয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল। ইংরেজদের জমানা শেষ। কিন্তু
স্নেইথ সাহেব হাল ছাড়েন নি।
বিধান রায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবার পর স্নেইথ তাঁকে দীঘায় পর্যটনের
উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জানান। বিধান রায়ের মনোমত হয় প্রস্তাবটি।
ধীরে ধীরে এখানে কাজ শুরু হয়। গড়ে ওঠে চীপ ক্যান্টিন, বে কাফেটেরিয়া,
সারদা বোর্ডিং। সরকার তৈরি করে একটি টুরিস্ট লজ। ষাটের দশকে শুরু
হয় টুরিস্টদের আনাগোনা।
সাড়ে এগারো একর জমির ওপর রানসউইক হাউস
|
দীঘা স্নেইথের এতটাই প্রিয় হয়ে উঠে ছিল যে তিনি প্রায় ভুলেই গেলেন
তার জন্ম ভিটে মিডলসবোরোর কথা। তার ঐ সাড়ে এগারো একর জমির যে কোনাটিতে
প্রথম সূর্যের আলো পড়ে সেই যায়গাটি বেছে রাখলেন নিজের শেষ ঘুমের
বিছানা পাতার জন্য। স্নেইথ সাহেবের দীঘাকে সৈকত শহর করার নিরলস
চেষ্টা যখন প্রায় সফল হয়ে উঠেছে, তখন ১৯৬৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বরের
মিষ্টি শীতের দিনে, তিনি তার প্রিয় রানসউইক হাউসেই বসে বঙ্গোপসাগর
থেকে ভেসে আসা হিমেল হাওয়ায় শেষ বারের মত নিশ্বাস নিলেন।
এর পর জন ফ্রাঁ স্নেইথের উত্তরাধিকারী ফ্লানিগেন কলকাতায় বসে
হ্যামিল্টন কোম্পানির ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মামার
প্রিয় রানসউইক হাউসটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকলেন। আগের মতনই টু
সিটার চালিয়ে শনিবারে এসে হাজির হতেন দীঘায়। বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে
আসতেন। তবে তখন সে রাজও নাই সে রাজত্বও নাই। নতুন ভারতীয় সরকারের
কাজ করার ধরন ধারণ আলাদা। সাদা চামড়ার বন্ধু বান্ধবরা এ দেশ ছেড়ে
চলে যাচ্ছেন একে একে। ফ্লানিগেনও ঠিক করলেন মানে মানে এ দেশ থেকে
পাততাড়ি গোটানোই ভালো।মামার কাছে থেকে পাওয়া ব্যবসা বিক্রি করে
দিলেন। শেষ অবধি ১৯৭৪ সালে তার মামার প্রিয় হাউসটি এক লাখ টাকায়
বিক্রি করে দিলেন স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের চেয়ারম্যান জে সি
তালুকদারের কাছে।
জন ফ্র্যাঙ্ক স্নেইথ
|
এই বাড়িতে অতিথি হয়ে থাকার সময় ভাবছিলাম এই সৈকত শহরটি যার মানসপুত্র,
এ শহরে কোনো রাস্তার মোড়ে তার মূর্তি নেই, কোথাও তার নামে কোনো
রাস্তাও নেই। হাজার হাজার পর্যটক, যারা এখানে প্রায়ই আসেন, জানিনা
কজন এই স্নেইথ সাহেবের নাম অবধি শুনেছে।
মানুষ যেখানে শেষ নিশ্বাস ফেলতে চায় সেটাই তার সব চেয়ে প্রিয়
জায়গা। সবার অলক্ষ্যে রানসউইক হাউসের এক কোনায় পরম শান্তিতে শুয়ে
আছেন এই শহরের অঘোষিত রূপকার। এখন পর্যন্ত সে শান্তি বিঘ্নিত হয়
নি। জানি না এ শান্তি কত দিন থাকতে দেবে আমাদের ইতিহাস-উদাসীন
বিস্মরণ-পটু দেশবাসীরা। যে ভাবে ভিড় বাড়ছে এ শহরে, কবে কোন সরকার
বা প্রোমোটার বা দুজনে মিলে স্নেইথ সাহেবের ঐ দু গজ জমিন অকারণে
জুড়ে থাকাটাকে অর্থ মূল্যে মাপবার চেষ্টা করবেন এবং বুঝতে পারবেন
এখানে চমৎকার একটা হোটেল বাড়ি হতে পারে।
লেখক পরিচিতি - চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী।
বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।