বিবিধ প্রসঙ্গ
নভেম্বর ১৫, ২০১৫
এলোকেশী-মোহন্ত কথা– একটি ফিরে দেখা কাহিনী
ও একটি আন্দোলন
দীপক সেনগুপ্ত
ধর্মের আড়ালে অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজ করার প্রবণতা বহুদিনের।
সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির
অপচেষ্টার অসংখ্য ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তবে যা
জানা গিয়েছে বা কাগজে কলমে লেখা হয়েছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী ঘটনা
বাস্তবে সংঘটিত হয়েছে যার কোন তথ্য নেই। এ সব আগেও যেমন ঘটেছে
এখনও তেমনিই হয়ে চলেছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে কোন ধর্মস্থানের
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাধুরা অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের
সন্তুষ্টি বিধান ক’রেও সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে জীবনের অভাব ও
আর্তি অনেকটাই মেটানো সম্ভব। কিছু তথাকথিত ‘সাধু-সন্ন্যাসী’ সাধারণ
লোকের এই বিশ্বাসকে হাতিয়ার করেই নিজেদের বাসনা চরিতার্থ করে।
এ ধরনের অপরাধ এখনকার তুলনায় দু’এক শতাব্দী আগে অনেক কম হত কিনা
সে পরিসংখ্যান নেই। তবে সেকালে লোকসংখ্যা ছিল অনেক কম, যোগাযোগ
ব্যবস্থাও ছিল দুর্বল; এজন্য সামগ্রিক ভাবে সংখ্যার হিসাবে সেটা
হয়ত কম মনে হতে পারে। এ ছাড়াও তখন তথ্য ও সংবাদ আদান প্রদানের
আধুনিক প্রযুক্তিরও উদ্ভব হয় নি; এ কারণে শহর থেকে দূরে বা গ্রামাঞ্চলে
এ ধরণের ঘটনা ঘটলে স্থানীয় মানুষ ছাড়া কেউ জানতেই পারত না।
প্রায় দু’শ বছর আগে তারকেশ্বরের তৎকালীন মোহন্ত শ্রীমন্ত গিরি
খুনের দায়ে ধরা পড়েছিলেন। ঘটনাটি ১১ ই সেপ্টেম্বর ১৮২৪ ( ২৮ ই
ভাদ্র ১২৩১ ) অধুনা বিলুপ্ত ‘সমাচার দর্পণ’ নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত
হয়েছিল। সংবাদটি ছিল –
“তারকেশ্বরের মহন্তের পুণ্য প্রকাশ। - শুনা গেল যে তারকেশ্বর নিবাসি
শ্রীমন্তগিরি সন্ন্যাসী স্বীয় ধর্ম্মকর্ম্ম সংস্থাপনার্থ এক বেশ্যা
রাখিয়াছিল তাহাতে জগন্নাথপুরনিবাসি রামসুন্দরনামক এক ব্যক্তি গোপের
ব্রাহ্মণ ঐ বেশ্যার সহিত কি প্রকারে প্রসক্তি করিয়া ছদ্মভাবে গমনাগমন
করিত। পরে সন্ন্যাসী তাহা জানিতে পারিয়া ২ চৈত্র শনিবার রাত্রিযোগে
সন্ধানপূর্ব্বক হঠাৎ যাইয়া বেশ্যাকে কহিল যে একটু পানীয় জল আন
আমার বড় পিপাসা হইয়াছে তাহাতে বেশ্যা জল আনিতে গেলে সন্ন্যাসী
সময় পাইয়া ঐ ব্রাহ্মণের বক্ষঃস্থলের উপর উঠিয়া তাহার উদরে এমত
এক ছোরার আঘাত করিল যে তাহাতে তাহার মঙ্গলবারে প্রাণ বিয়োগ হইল
পরে তথাকার দারোগা এই সমাচার শুনিয়া ঐ সন্ন্যাসীকে গ্রেপ্তার করিয়াছে
এইমাত্র শুনা গিয়াছে।”
ঘটনার প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পরে অন্য একটি সংবাদে জানা যায় যে
অপরাধের জন্য মোহন্তের ফাঁসী হয়েছে। ২৭ শে মার্চ ১৮২৪ ( ১৬ ই চৈত্র
১২৩০ ) তারিখে ‘সমাচার দর্পণে’ই প্রকাশিত খবরটি ছিল –
“ফাঁসী। - পূর্ব্বে প্রকাশ করা গিয়াছিল যে তারকেশ্বরের শ্রীমন্তরাম
গিরি এক বেশ্যার উপপতিকে খুন করিয়া ধরা পড়িয়াছিলেন তাহাতে জিলা
হুগলীর বিচারকর্ত্তারা তাহাকে বিচারস্থলে আনাইয়া বারম্বার জিজ্ঞাসা
করাতে প্রাণভয়ে ভীত হইয়া তিনবার অস্বীকার করিলেন কিন্তু ধর্ম্মস্য
সূক্ষ্ম গতিপ্রযুক্ত চতুর্থবারে স্বীকার করাতে শ্রীযুক্তেরা বহুতর
আক্ষেপপুর্ব্বক ফাঁসী হুকুম দিলেন তাহাতে ১৩ ভাদ্র তারিখে রীত্যনুসারে
তাহার ফাঁসী হইয়া কর্ম্মোপযুক্ত ফলপ্রাপ্তি হইয়াছে।”
সে যুগে বিচার ব্যবস্থা সম্বন্ধে বিশদ তথ্য ইতিহাস ঘেঁটে জানা
যেতে পারে; তবে লক্ষণীয় বিষয়টি হল, ২০১২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর রাজধানী
দিল্লিতে যে জঘন্যতম ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছিল এখনও কিন্তু তার চূড়ান্ত
ফয়সালা হয় নি।
যাই হোক, শ্রীমন্তগিরির ফাঁসীর প্রায় ৫০ বছর বাদে যে ঘটনাটি জনমানসে
তুমুল আলোড়ন তুলেছিল সেটির নায়কও ছিলেন তারকেশ্বরের মোহন্ত, নাম
মাধবচন্দ্র গিরি। ঘটনাটি হল এরকম : তারকেশ্বরের কাছে কুমরুল গ্রামে
এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাস করতেন, নাম ছিল নীলকমল মুখোপাধ্যায়। তার
স্ত্রী মন্দাকিনী আগের পক্ষের দুই কন্যা এলোকেশী ও মুক্তকেশীকে
নিয়ে থাকতেন। বড় মেয়ে এলোকেশীর বিয়ে হয়েছিল নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
নামে এক যুবকের সঙ্গে। নবীনচন্দ্র কর্মপোলক্ষে দূরে বাস করতেন
এবং মাঝে মাঝে বাড়ি আসতেন। বাড়িতে তার স্ত্রী এলোকেশী শ্বশুর শাশুড়ীর
সঙ্গেই থাকতেন। এলোকেশীর বিমাতা মন্দাকিনী মোহন্ত মাধবগিরির প্রণয়াসক্ত
হওয়ায় মাঝে মাঝে তারকেশ্বরে যেতেন, সঙ্গে থাকত সৎমেয়ে এলোকেশী।
রূপবতী এলোকেশীর প্রেমে পড়লেন মাধবগিরি। টাকার লোভে নীলকমল ও মন্দাকিনী
এলোকেশীকে মোহন্তর কাছে পাঠাতে রাজি হয়ে যান। নিঃসন্তান মেয়েকে
তার বাবা-মা-ই ( নবীনচন্দ্রের শ্বশুর শাশুড়ী ) সন্তান লাভের ‘অলৌকিক
ওষুধ’ আনতে তারকেশ্বরের মোহন্তর কাছে পাঠান। মাদক খাইয়ে মোহন্ত
এলোকেশীর সতীত্ব নষ্ট করেন। কন্যার সঙ্গে মোহন্তর এহেন সম্পর্ক
হওয়ায় গ্রামের মধ্যে নীলকমল একঘরে হয়ে যান। নবীনচন্দ্রও লোকমুখে
শুনতে পান যে তার স্ত্রী ভ্রষ্ট হয়েছেন এবং তিনি তারকেশ্বরের মোহান্তর
নিকট নিয়মিত যাতায়াত করেন। শ্বশুর শাশুড়ীর আদেশেই নাকি তার স্ত্রী
এই কাজ করছেন এবং এর দ্বারা তারা অর্থ উপার্জন করছেন। নবীনচন্দ্র
তার স্ত্রীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে যে তার কোন দোষ
নেই, বাবা মার কথাতেই সে একাজ করেছে। নবীন তার স্ত্রীকে খুবই ভালবাসতেন;
তিনি স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে মনস্থ করেন কিন্তু
মোহন্তর চক্রান্তে সেটা হয়ে ওঠে নি। তখন হতাশায় ও ক্ষোভে নবীন
তার স্ত্রীকে হত্যা ক’রে থানায় আত্মসমর্পণ করে ও নিজের শাস্তি
দাবী করে। এই ঘটনাটি ১২৮০ বঙ্গাব্দের ২৯ শে জ্যৈষ্ঠ ‘সুলভ সমাচার’
পত্রিকায় ‘একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। সমসাময়িক সংবাদপত্রে
প্রকাশিত খবরে প্রকৃত তথ্য পরিবেশিত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও তাই যথেষ্ট। সংবাদটি ছিল –
“একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা
নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক ব্যক্তি এই নগরে কম্পজিটারের
কাজ করিতেন, তাড়কেশ্বরের নিকট ঘোলা নামক এক গ্রামে তাঁহার বিবাহ
হয়। বয়স্থা স্ত্রীকে শ্বশুর বাড়ীতে রাখিয়া তিনি এখানে চাকরী করিতেন
এবং কখন কখন সেখানে যাইতেন। একবার তাঁহার স্ত্রীর চরিত্রের বিরুদ্ধে
কোন কথা শুনিতে পাইয়া হঠাৎ এক রাত্রিতে শ্বশুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত
হন। উপস্থিত হইয়া স্ত্রী এবং শাশুড়ীকে বাটীতে দেখিতে পাইলেন না।
শেষে শুনিলেন যে তাঁহার স্ত্রী তাড়কেশ্বরের মাহন্তের নিকট ব্যারামের
ঔষধ আনিতে গিয়াছে। তখন তিনি তাড়কেশ্বরের মন্দিরে অনুসন্ধান করিতে
গেলেন, কিন্তু সেখানে কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। পরে ফিরে আসিতে
আসিতে পথে একজন গরীব লোকের সহিত সাক্ষাৎ হওয়ায় সে বলিল যে তোমার
স্ত্রীকে মাহন্ত মন্দ করিয়াছে। প্রতি রাত্রিতে সে মাহন্তের নিকট
গমনাগমন করে এবং ইহা দ্বারা তোমার শ্বশুর শাশুড়ী অর্থ উপার্জ্জন
করিয়া থাকে। এই কথা শুনিয়া নবীন রাগিয়া তাহার শ্বশুরকে অনেক ভর্ৎসনা
করে। এমন সময় তাহার শাশুড়ী মেয়েকে সঙ্গে করিয়া বাটী ফিরিয়া আসিল।
স্ত্রীটি নিজে মন্দ হয় নাই মা বাপে তাহাকে মন্দ করিয়াছিল। সে স্বামীর
নিকট ভয় পাইয়া আপনার দোষ সমস্ত স্বীকার করে এবং বলে যে আমি মা
বাপের অনুরোধে বাধ্য হইয়া দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি। তুমি এখান হইতে
আমাকে শীঘ্র লইয়া চল, আমি পতিত হইয়াছি, তুমি না হয় আর একটি বিবাহ
করিয়া আমাকে দাসী করিয়া রেখ। তখন নবীন স্থির করিলেন পরিবারকে কলিকাতা
লইয়া আসিবেন। ইহাতে তাঁহার শ্বশুর শাশুড়ী দেখিল যে তাহাদের উপার্জ্জনের
পথ বন্ধ হয়, মাহন্তকে সংবাদ দিল। মাহন্তও তৎক্ষণাৎ বলিয়া পাঠাইল
যে আমি ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে লোক বসাইয়া রাখিব যেখান দিয়া যাইবে অমনি
ধরিয়া আমার নিকট আনিব। তাড়কেশ্বরের মাহন্ত খুব ধনী, লোকজন তাহার
অনেক আছে। সে দেশের মধ্যে তাহার অনেক আধিপত্য। নবীন যখন এই বন্দোবস্তের
কথা শুনিলেন তখন একেবারে নিরাশ হইয়া পড়িলেন। শ্বশুর শাশুড়ী মাহন্ত
এবং গ্রামস্থ লোক সকলেই বিরোধী সে কি করিবে? পর দিন সন্ধ্যাকালে
তাহার স্ত্রীকে পান তৈয়ার করিতে বলে; স্ত্রী যখন ঐ কাজে নিযুক্ত
আছে এমন সময় সে একখানি আঁইশ বটী লইয়া একটু ভাবিয়া তাহার গলায় এক
কোপ মারিল। স্ত্রীলোকটি তখন প্রাণ ভয়ে বলিল যে আমাকে মারিলে কি
হইবে আমার দোষ কি আছে। তাহার পর দুই তিন কোপ দিয়া খুন করিয়া নবীন
বাহির হইয়া তখনি হরিপালের থানায় আসিয়া সকল কথা স্বীকার করিয়া বলিল
যে শীঘ্র আমাকে ফাঁসি দাও, পৃথিবী আমার নিকট অরণ্যময় বোধ হইতেছে,
পরলোকগত আমার স্ত্রীর নিকট যাইবার জন্য আমি অধৈর্য্য হইয়াছি।
পরে হুগলীর জয়েণ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট তাহার নিকট রীতিমত এজাহার লইয়াছেন।
তৎকালে স্ত্রীলোকটির মৃতদেহ সেখানে ছিল। আমরা শুনিলাম স্ত্রীটি
অত্যন্ত সুন্দরী এবং তাঁহার প্রকৃতিও ভাল ছিল, কেবল বিমাতার কুমন্ত্রণায়
সে বিপাকে পড়ে। নবীনও তাহাকে অতিশয় ভালবাসিত। নবীন যখন সেই হৃদয়
বিদারক হত্যার কারণ সকল বলিতেছিল তখন কাছারি শুদ্ধ লোক কাঁদিতে
লাগিল। মাহন্তকে ধৃত করিয়া আনা হইয়াছে। এখন বিচারে কতদূর কি প্রমাণ
হয় দেখা যাউক। খুন করার অবস্থাটি ঠিক কি তাহা এখনও ভাল করিয়া আমরা
বুঝিতে পারিতেছি না। স্ত্রী যেখানে আপনার দোষ স্বীকার করিল সেখানে
কেমন করিয়া নবীন তাহাকে মারিল এটি বুঝা যাইতেছে না। শুনা যাইতেছে
নবীন খুব করিয়া গ্রামের মধ্যে চীৎকার করিয়া সকলকে বলে যে আমাকে
ধর আমি খুন করিয়াছি। এই সকল ব্যাপার শুনিলে যে তীর্থস্থানে যাইতে
কিরূপে লোকের ভক্তি থাকিবে তাহা আমরা বুঝিতে পারি না।”
সরকারী পুরানো কাগজপত্র ঘেঁটে দেখলে বহু তথ্য জানা সম্ভব। পরবর্তীকালে
অনেক গবেষক তখনকার ফাইল থেকে ঘটনাটি সম্বন্ধে আনুষঙ্গিক অনেক তথ্য
সংগ্রহ করেছেন। উল্লিখিত নবীনচন্দ্রের ঘটনাটি জনমানসে তীব্র আলোড়ন
সৃষ্টি করেছিল। এ ঘটনাটি ১৮২৪ সালে সংঘটিত শ্রীমন্তগিরি কৃত অপরাধের
থেকে অনেকটাই আলাদা ধরণের। দুটোই খুনের ঘটনা। কিন্তু প্রথমটিতে
শ্রীমন্তগিরি মোহন্ত একাই দায়ী, তিনি খুন করেছেন এবং বিচারে আইনানুযায়ী
ফাঁসী হয়েছে। একটি প্রসিদ্ধ ধর্মস্থানের মোহন্ত হিসাবে ঘটনাটির
গুরুত্ব থাকতে পারে কিন্তু অপরাধের প্রেক্ষিতে বিচা্র করলে খুন
করা এবং ফাঁসী হওয়ার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু মাধবগিরির
ঘটনায় মেয়েটির ( এলোকেশী ) নিজের মা-ই ( বিমাতা ) তাকে সন্তান
ধারণের ওষুধের জন্য তারকেশ্বরে পাঠায়। ক্রমশঃ মেয়েটির সেখানে নিয়মিত
যাতায়াত শুরু হয় এবং এজন্য ষোড়শবর্ষীয় মেয়েটির মাধ্যমে তার বাবা
মা অর্থ উপার্জন শুরু করেন। অনেকের মতে মেয়েটি একেবারে নির্দোষ
ছিল না; মোহন্তর মনোরঞ্জনের জন্য সে নাচ গানও করত। নবীন ব্যাপারটা
জানার পর নিজের স্ত্রীকে ক্ষমা করে এবং শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে যেতে
চায় কিন্তু নবীনের শ্বশুর শাশুড়ীর যোগসাজসে মোহন্ত সে পথ বন্ধ
করে দেয়। এর পর নবীনচন্দ্র ক্ষোভে দুঃখে তার স্ত্রীকে হত্যা ক’রে
এবং থানায় আত্মসমর্পণ করে। ফাঁসী দেবারও আবেদন জানায়। উদ্দেশ্য
- পরলোকে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়া। স্পষ্টতই নবীন তার স্ত্রীকে
যথেষ্ট ভালবাসত। অতএব এই ঘটনাটির সঙ্গে যথেষ্ট নাটকীয়তা ও আবেগ
জড়িত এবং নবীন, তার শ্বশুর-শাশুড়ী, নিজের স্ত্রী এবং মোহান্ত সকলেই
কম-বেশি দায়ী।
শ্রীরামপুরে হুগলী সেশন কোর্টে মামলাটির শুনানি শুরু হয়। নবীনচন্দ্রের
পক্ষে উকিল ছিলেন ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। জনসাধারণের
সহানুভূতি নবীনচন্দ্রের পক্ষেই ছিল। বাঙালী জুরিরা নবীনকে পাগল
বলে সাব্যস্ত করে এবং তাকে মুক্তি দিতে প্রার্থনা জানায়, কিন্তু
বিচারক ফিল্ড তাতে রাজী না হয়ে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টে পাঠিয়ে
দেন। তবে বিচারপতি স্বীকার করেন যে মেয়েটির বাবা-মা তাদের নিজের
মেয়েকে মোহন্তের কাছে পাঠালেও ক্রমশঃ মোহন্ত এবং মেয়েটির মধ্যে
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে নাকি ঠাট্টা তামাশাও চলত।
হাইকোর্টের বিচারপতি মার্কবি-ও এটি মেনে নেন এবং সব দিক বিবেচনা
করে নবীন ও মোহান্তকে দোষী সাব্যাস্ত করেন। খুনের দায়ে নবীনের
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং মোহান্তর তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড সহ দু’হাজার
টাকা জরিমানা হয়।
অধুনালুপ্ত ‘বেঙ্গলী’ সংবাদপত্র মন্তব্য করে –‘মানুষ যেমন মঞ্চে
অভিনয় দেখতে ভীড় করে ঠিক তেমনিই বহু লোক নিয়মিত সেশন আদালতে হাজির
হত মামলাটির গতি-প্রকৃতি জানতে।’ ক্রমশঃ ভীড় এত বাড়তে থাকে যে
আদালতে প্রবেশমূল্য ধার্য করতে হয় এবং পরে নিয়ম করা হয় যে, যারা
ইংরাজি বুঝতে পারে তারাই সেশন আদালতে প্রবেশাধিকার পাবে, কারণ
মামলার শুনানি ও অন্যান্য কথাবার্তা সব ইংরাজিতেই হত। জনসাধারণের
চাহিদা বুঝতে পেরে তখন প্রতিটি সংবাদপত্রই বিচারের খবর বিশদভাবে
ছাপত। নবীন খুন করলেও সে তার স্ত্রীকে ভালই বাসত এবং তাকে নিয়ে
চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু সে পথও ছিল বন্ধ। তার অসহায়তা ও ক্ষোভই
যে তাকে অপরাধের দিকে ঠেলে দিয়েছে এটা বুঝতে পেরে মানুষ তার উপর
সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে। এ কারণেই সেশন আদালতে বাঙালী জুরীদের মতামতকে
বিচারপতি গ্রাহ্য না করায় তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। বিচারপতির
রায়কে তারা মনে করেছিল, স্থানীয় ব্যাপারে ইংরেজ শাসকরা অহেতুক
নাক গলাচ্ছে। তারা চাইছিল নবীনকে মুক্তি দিয়ে মোহন্তর শাস্তি আরও
বাড়ানো হোক। নেতৃস্থানীয় ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য ব্যক্তিসহ
দশ হাজার স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে জমা পরে,
বক্তব্য, নবীনকে ক্ষমা প্রদর্শন করতে হবে। জনরোষ এত তীব্র আকার
ধারণ করে যে নবীনকে দু’বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
এলোকেশী ও মোহন্তের কাহিনী এত প্রচার লাভ করে এবং আলোচিত হয় যে
অসংখ্য পটে আঁকা ছবি, নাটক, প্রহসন, গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়।
চিত্র ১ - তিন জন মহিলার মাঝখানে
ঘোমটার আড়ালে এলোকেশী। ডান হাতে নৈবেদ্য সাজানো থালি।
এলোকেশীর পিছনে তার ছোট বোন মুক্তকেশী। এলোকেশীর সামনে
ডানদিকে পারিবারিক পরিচারিকা ও সংযোগ রক্ষক তেলী বৌ।
|
এ ধরণের অন্তত ৩৪ টী বইয়ের কথা জানা গেছে, কয়েকটি চিত্রশোভিত।
এর মধ্যে কয়েকটি আবার বেশ কয়েকবার নিঃশেষিত হয়ে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
এই লাভজনক ব্যবসায় বটতলাও পিছিয়ে থাকে নি। অতি সম্প্রতি শ্রীপান্থ
তার ‘মোহন্ত-এলোকেশী সম্বাদ’ বইতে লিখেছেন – “সচিত্র বই নজরে পড়েছে
আমাদের খানচারেক, ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘মোহন্তের চক্রভ্রমণ’
( ৪ খানা ছবি); মহেশচন্দ্র দাস দে-র ‘মাধবগিরি মহন্ত এলোকেশী পাঁচালী’
( ৩ খানা ছবি ); হরিমোহন চট্টোপাধ্যায়ের ‘উঃ মোহন্তের এই কাজ!!’
( ৪ খানা ছবি ); দুর্গাদাস ধরের ‘আজকের বাজার ভাও’ ( ৮ খানা ছবি
) উপভোগ্য সব কাঠখোদাই ।” সে সময় অন্তত ১৯ খানি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল
এবং প্রতিটিতেই ভাল রকম অর্থ উপার্জন হয়েছিল; তবে সবচেয়ে জনপ্রিয়
হয়েছিল ‘মোহন্তের এই কি কাজ’ নাটকটি। সে সময়ে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল
থিয়েটারে’ মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ চলছিল কিন্তু লোক সমাগম কম হওয়ায়
নাটকটি বন্ধ করে দেবার কথা ভাবছিলেন কর্তৃপক্ষ। ঠিক তখনই হাতে
পেয়ে যান ‘মোহন্তর এই কি কাজ!’ প্রহসনটি, আর ফিরে তাকাতে হয় নি।
কালীঘাটের পটে বিষয়বস্তু হিসাবে সাধারণতঃ পৌরাণিক কাহিনীই স্থান
পেত। কিন্তু এলোকেশী-মোহন্ত ঢেউ-এ সব ভেসে গেল। এই কাহিনী্র নানা
দৃশ্য নিয়ে আঁকা পটে বাজার ছেয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার
হল, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসে এ ঘটনার ছাপ পড়েছিল; এলোকেশী শাড়ি,
এলোকেশীর নাম লেখা বঁটি, পানের ডিব্বা ইত্যাদি বাজারে বিক্রি হতে
লাগল। সবচেয়ে মজার বিজ্ঞাপনটিতে দাবী করা হয়েছে, জেলের মধ্যে মোহন্তর
টানা ঘানি থেকে নিষ্কৃত তেল দিয়ে তৈরি ব্যথার ওষুধে অব্যর্থ ফল
লাভ হবে। ঘটনার দীর্ঘ ৫০ বছর পরেও সমাজ জীবনে এলোকেশী-মোহান্ত
ঘটনাটির প্রভাব লক্ষ করা গেছে।
চিত্র ২ – এলোকেশীর ছিন্ন শির।
|
তারকেশ্বরের মোহন্তর কীর্তির বোধ হয় পরম্পরা রক্ষিত হয়েছিল। কারণ,
এলোকেশীর ঘটনাটি ঘটে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯২৩-এ প্রকাশিত হয় ইন্দুনিভা
দাস সম্পাদিত ‘সেবা ও সাধনা’ পত্রিকা। এটির দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয়
সংখ্যায় ‘মোহন্তের অন্তলীলা’ নামক প্রকাশিত সংবাদটি ছিল এইরকম
– “তারকেশ্বরের মোহন্ত মহারাজ আদ্যলীলা মধ্যলীলা সাঙ্গ করে এবার
অন্তঃ-লীলার অভিনয় কচ্চেন। যবনিকা পতন শীঘ্রই হবে। এর ভিতর আবার
একটা কথা উঠেছে তারকেশ্বরের গদিতে আর একজন মোহন্তকে বসাতে হবে
কারণ নাকি মোহন্ত না হলে তীর্থস্থান মানায় না। ... এই সব ভাব প্রবণতাকে
দূর করে দাও দেখি। তারকেশ্বরের সমস্ত সম্পত্তি কমিটির হাতে আন।
তারকেশ্বর এখন একটি প্রয়োজনীয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এটিকে একটি বড়
গন্ডগ্রামে পরিণত কর। দেখবে শত শত গ্রাম উপকৃত হবে ”।
তারকেশ্বরের মোহন্তদের অনাচার ও অত্যাচারের কাহিনী বছরের পর বছর
ধরে একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেকে ধরেই নিয়েছিল যে
এটাই নিয়তি এবং প্রতিবাদ করে কোন লাভ নেই বরং তাতে মোহন্তর রোষের
শিকার হতে হবে। ইংরেজ শাসকেরা সুবিধা ও অর্থের লোভে ক্ষমতাবান
মোহন্তর পক্ষ সমর্থন করায় মোহন্তর বিরুদ্ধাচারণ আরও কঠিন হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু এহেন দুর্নীতিগ্রস্ত মোহন্তকেও ক্ষমতাচ্যুত করতে একটি আন্দোলন
গড়ে উঠেছিল এবং প্রাথমিকভাবে মোহন্তর বিরুদ্ধে সংগঠিত হলেও ক্রমশঃ
এটা স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
চিত্র ৩ – মোহন্তর বিচার চলছে।
|
সেটা ছিল ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ। তখন মোহন্ত ছিলেন সতীশচন্দ্র গিরি।
তিনি নিয়ম করেছিলেন – বিয়ের আগে এলাকার কুমারীদের তার কাছে পাঠাতে
হবে; তার এলাকায় নতুন বধূ হয়ে আসা সব মহিলাদের তার আশীর্বাদ নিতে
হবে; মন্দিরে প্রবেশ করার আগে সব দর্শনার্থীদের ভিজে কাপড়ে তার
সামনে গিয়ে অনুমতি নিতে হবে ইত্যাদি। বিগ্রহের কাছে পৌঁছতে অনেকগুলি
দরজা পেরোতে হত এবং প্রত্যেক বারই পৃথকভাবে প্রবেশ মূল্য দিতে
হত। মোহন্তকে মনে করা হত ‘ধর্মে’র ধারক এবং বাহক। প্রবর্তিত নিয়মগুলিকে
ধর্মীয় আচার ও অনুশাসনের অঙ্গ বলে চালান হত এবং ধর্মভীরু মানুষ
বিনা প্রতিবাদে এগুলি মেনে নিত। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যে মোহন্তর
বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন না এমন নয়, কিন্তু এ
নিয়ে কোন আন্দোলন গড়ে ওঠে নি। এবার সেই আন্দোলনই সংগঠিত হল দুই
সন্ন্যাসী স্বামী বিশ্বানন্দ ও স্বামী সত্যানন্দের নেতৃত্বে মহাবীর
দলের সহায়তায়।
মহাবীর দল ও সত্যাগ্রহ সম্বন্ধে দেবাশিস শেঠের লেখা একটি মূল্যবান
প্রবন্ধ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অনেক
তথ্যও পরিবেশিত হয়েছে। ১৮৫৭ আলে সিপাহী বিদ্রোহের আগেই ব্রাহ্মণ
সেপাইরা ব্যারাকপুরে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু সাহেবদের
ঘোড়দৌড়ের মাঠের জন্য জমি প্রয়োজন হওয়ায় মন্দিরটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত
হয়। এটি প্রতিরোধ করতে সেপাই ও স্থানীয় জনসাধারণ একত্রিত হয়ে মহাবীর
দল গড়ে তোলেন। সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে সাহেবরা পিছু হটে এবং
মন্দিরটি রক্ষা পায়। এ সময় থেকেই মহাবীর দল একটি জনপ্রিয় সংগঠন
হয়ে ওঠে।
চিত্র ৪ - মোহন্ত জেলখানায় তেলের ঘানি টানছে।
|
মোহন্তর ধর্মবিরুদ্ধ বিগর্হিত কাজ বন্ধ করার জন্য স্বামী বিশ্বানন্দ
বেনারসের হিন্দু মহাসভার দ্বারস্থ হন। প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির
কাছেও সাহায্য প্রার্থনা করে আবেদন জানানো হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের
৮ই এপ্রিল নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ,
ড: জে. এম. দাশগুপ্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ড: প্রতাপচন্দ্র
গুহরায়, সতীশচন্দ্র সরকার প্রমুখ নেতারা তারকেশ্বরে উপস্থিত হন
সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলার জন্য। বহু সংখ্যক মহিলারাও এগিয়ে
এসে মোহন্তর অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরে। ক্রমে একটি মোহন্ত বিরোধী
আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে এতে
যোগ দেয়। মহাবীর দল তো ছিলই। ঘোষণা করা হয় যে, যেহেতু তারকেশ্বরে
ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা বিগ্রহ দর্শন করতে
আসেন, তাই উদ্ভূত সমস্যাটি শুধু বাংলার নয়, সমস্ত দেশেরই সমস্যা।
প্রস্তাব গৃহীত হয় যে মোহন্তকে গদীচ্যুত করতে হবে। আন্দোলন ক্রমশঃ
তীব্র আকার ধারণ করে এবং গণ আন্দোলন ভেঙে দিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট,
এস. পি. প্রভৃতি উচ্চপদস্থ প্রশাসকরা পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির
হন। বহু লোক গ্রেফতার বরণ করে। পুলিশ দিয়ে আন্দোলন প্রতিহত করার
চেষ্টায় আন্দোলনকারীদের জেদ আরও বেড়ে যায়। ইতিমধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে
মোহন্ত তার নিজের গদিতে সাদরে আমন্ত্রণ জানান। বলা বাহুল্য দেশবন্ধু
ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। রতনে রতন চেনে। শোনা যায়, ভারতের
বিভিন্ন স্থানের মোহন্তরা একজোট হয়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকা সতীশ
গিরিকে পাঠিয়েছিলেন আন্দোলনকে প্রতিহত করবার জন্য। এরই মাঝখানে
তৎকালীন গভর্ণর লর্ড লিটন ঘোষণা করেন যে, কিছু স্বার্থান্বেষী
ব্যক্তি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে ধর্মভীরু লোকদের একত্রিত
করে আন্দোলন সংগঠিত করেছে। এত করেও কিন্তু আন্দোলনের তীব্রতা কিছুমাত্র
হ্রাস পায় নি, বরং তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলে।
কাজী নজরুল ইসলামও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মোহন্তর বিরুদ্ধে
গান রচনা করে তিনি তারকেশ্বরের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগলেন।
এতে জনসাধারণ আরও উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল। এই সময়ে একটি চমকপ্রদ ঘটনা
ঘটে। মন্দিরের কাছে রাজবাড়ির মাঠে একটি জনসভা আহ্বান করা হয়েছে,
মঞ্চে উপস্থিত রয়েছেন দেশবন্ধু চিত্তরন্নজন দাশ, নেতাজী সুভাষ
চন্দ্র বোস, স্বামী বিশ্বানন্দ প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা। কাজি নজরুলও
উপস্থিত। মোহন্তর ছিল নিজস্ব লেঠেল বাহিনী, সহস্রাধিক বাছাই করা
লোক নিয়ে তৈরি এই বাহিনীর নাম ছিল বীরভদ্র দল এবং এর সর্দার ছিলেন
সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও ছিলেন একজন নামকরা লেঠেল। সভা চলা
কালীন এই বীরভদ্র দলের সদস্যরা সভা ঘিরে দাঁড়িয়েছিল, সামনেই লাঠি
হাতে সর্দার। এমন সময় চিত্তরঞ্জন নজরুলকে গান গাইতে অনুরোধ করেন।
কাজী উদাত্ত কন্ঠে শুরু করলেন তার সেই গান –
“জাগো আজ দন্ড হাতে চন্ড বঙ্গবাসী।
ওই ডুবালো পাপ চন্ডাল তোদের বাংলাদেশের কাশী।
জাগো বঙ্গবাসী।
মোহের আর নাইকো অন্ত পূজারী সেই মোহান্ত
মা বোনের সর্বস্বান্ত করছে বেদীমূলে। ......”
সবাই স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করছে, গান শেষ হলেই লেঠেল বাহিনী ঝাপিয়ে
পড়বে। কিন্তু একি! লেঠেল সর্দার সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখ যে
অশ্রুসিক্ত। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলল – “কাজীদা, গানটা আর একবার
গাইবে?” গান শেষ হলে সর্দার লাঠিখানা নজরুল ও চিত্তরঞ্জনের পায়ের
কাছে নামিয়ে রেখে শপথ নেয় – এখন থেকে আমি আর মোহন্তর দাসত্ব করব
না, আমি আন্দোলনকারীদের পক্ষেই লাঠি ধরব।
শেষে সত্যাগ্রহীদেরই জয় হয়। মোহন্ত সতীশচন্দ্র গিরি জনসাধারণের
কাছে ক্ষমা চেয়ে তারকেশ্বর ছেড়ে চলে যান। মন্দির চালানোর জন্য
একটি পরিচালন সমিতি গঠন করা হয় এবং হুগলীর জেলা জজের রায় অনুযায়ী
ঠিক হয়, যিনিই মোহন্ত হউন না কেন তাকে পরিচালন সমিতির সিদ্ধান্ত
মেনে কাজ করতে হবে। মোহন্তর বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন শেষ হলেও
মহাবীর দলের বিপ্লবী কার্যকলাপ কিন্তু ফুরিয়ে গেল না। গতিপথ পরিবর্তন
করে পূর্বোক্ত সংগঠনটি ক্রমশঃ বৃটিশ বিরোধী কর্মসূচীতে অংশ গ্রহণ
করে এবং পরিশেষে বৃহত্তর স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
এখানে ঘটনার বিভিন্ন দৃশ্যপট অবলম্বনে অঙ্কিত কয়েকটি পটের ছবি
ও মহেশচন্দ্র দাস দে রচিত ( ১৮৭৪-৭৫ খ্রিঃ ) বই থেকে একটা কাঠ
খোদাই ছবি দেওয়া হয়েছে।
‘এলোকেশী-মোহন্ত কথা – একটি ফিরে দেখা কাহিনী’র এখানেই সমাপ্তি,
কিন্তু একটা প্রশ্ন রয়েই গেল। আজ থেকে ১০০/১৫০ বছর আগে এ ধরণের
অপরাধমূলক ঘটনার প্রাদুর্ভাব – বিশেষ করে অসহায় নারীদের উপর অত্যাচার
ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কারণ হিসাবে অশিক্ষা, কুসংস্কার, মানুষের অসংস্কৃত
ধর্মবিশ্বাস, পুরোহিতদের অপপ্রচার, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী ও সচেতনতার
অভাব ইত্যাদি বহু বিষয়কে তুলে ধরা যায়। কিন্তু এ যুগে এ ধরণের
ঘটনা ও সামাজিক অস্থিরতা কি হ্রাস পেয়েছে ? এখন বহু সংখ্যক স্কুল,
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতি, শিক্ষার প্রসার, উচ্চ শিক্ষা
ও গবেষণার ব্যাপক আয়োজন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চমকপ্রদ অগ্রগতি
কি মানুষের মন থেকে হিংসা, দ্বেষ, স্বার্থপরতা, প্রভুত্ব লাভের
ইচ্ছা দূরে সরিয়ে, শুভ বুদ্ধি জাগ্রত ক’রে কোন উচ্চতর স্তরে মনকে
উন্নীত করতে সহায়ক হয়েছে ?
চিত্র পরিচিতি - কালীঘাটের পট এবং
ওমহেশচন্দ্র দাস দে রচিত ( ১৮৭৪-৭৫ খ্রিঃ ) বই থেকে একটা কাঠ
খোদাই ছবি ।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান
ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (
IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে
অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা
করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার
সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।