প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সিনেমার খবর

জুন ৩০, ২০১৬

 

সত্যজিতের "আগন্তুক"

প্রবুদ্ধ মজুমদার



যাঁরা সিনেমাটিনেমা নিয়ে বেশ চর্চা করে থাকেন‚ তাঁরা "ফিল্ম বুঝি" এই অলীক সুখের ছায়ায় বসে বেশ আত্মতৃপ্তি পেয়ে থাকেন বলেই দেখেছি। হতে পারে বোঝেন। কিন্তু গোদার যেমন বলে গেছেন‚ "I don't think you should feel about a film. You should feel about a woman, not a movie. You can't kiss a movie." ফিল্মকে ফীল করা যেমন যায় না‚তেমনি "ফিল্ম বুঝি" বললেও কিছুই বোঝানো যাবে না। আসলে আমরা "ফিল্ম বুঝি"-র নামে যেটা করি তা হলো ফিল্ম দেখা‚ বারে বারে দেখা‚ আর খুঁজে খুঁজে ফিল্মের মধ্যেকার কারুকার্যগুলো দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে থাকা।

সত্যজিৎ কঠিন ছবি বানাতেন না‚ বা বলা ভালো ছবির ভাষাটা সহজ রাখতেন। মানে ঐ ত্রফো-গোদার-বুনুয়েলদের মতো নয়‚ যাদের ছবি দেখাটা সত্যি বলতে কি খুব চাপের‚ এতো বেশী ইমোশন্যাল অ্যাটেনশন চেয়ে বসে ছবিগুলো। তবে কারুকার্যের জন্য কঠিন ছবি বানাতে হবে তার কোনো মানে নেই। হলিউডে ফোর্ড‚ কাপ্রা বা আমাদের সত্যজিৎ বা তপন সিংহ তাঁদের কাজে একথা বারেবারে প্রমাণ করে গেছেন। এঁদের ছবি‚ আর যাই হোক‚ দুর্বোধ্য নয়।

আগন্তুক কি আদৌ বাংলা ছবি? নাকি ইওরোপীয়ান? এ আবার কি আঁতেলমার্কা প্রশ্ন? হ্যাঁ প্রযোজক হিসেবে দুপার্দ্যু-র নাম আছে ঠিকই। শুরুতে জানুস ফিল্মস-এর লোগো দেখে মনে হয়‚ আরে‚ নন্দন-টুতে ফিল্ম ফেস্টের ক্লাসিক ইওরোপ সেকশনের কোনো ছবি দেখছি নাকি। কিসব লোকের ছবির ডিস্ট্রিবিউটর এই জানুস ফিল্মস: ফেলিনি ত্রফো বার্গম্যান আন্তোনিওনি বাপরে বাপ। কিন্তু শুধু এইটুকুর জন্যই আগন্তুককে বিদেশী ছবি বলছি না। আসলে বাংলা ছবি বরাবর গল্পকেন্দ্রিক। ছবির চরিত্র‚ গান‚ ভিস্যুয়াল সবই গল্পের ওপর ভিত্তি করে বানানো। সত্যজিৎ-ও সেই ধারাতেই চলেছেন‚ যতক্ষণ না তিনি কাঞ্চনজঙ্ঘা বানিয়েছিলেন‚ বা আগন্তুক। বাঙ্গালীয়ানার বাইরে এসে এই দুটো ছবি তাঁর সবচেয়ে বেশী ইওরোপীয়ান।

আসলে ইওরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যেসব খ্যাপাটে মাথাওয়ালা লোকেরা সিনেমা বানানোয় মজেছেন‚ তাঁরা সিনেমাকে নিজের প্যাশনের বিস্ফোরণের একটা খোলা জায়গা বলে ধরে নিয়েছিলেন। সামান্য সেট‚ সামান্য বাজেটে বানানো সেই সব ছবিতে একটা-দুটো চরিত্রের মধ্যে দিয়ে সেই প্যাশনের স্রোত খুলে যাচ্ছে। জঁ পল বেলমন্দো বা মাস্ত্রইয়ানীকে পর্দায় দেখে মনে হয় এরা পরিচালকের প্যাশনের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে একেবারে দিশাহারা হয়ে গেছেন। তো এই পরিচালকেরা‚ ফ্রান্স থেকে রাশিয়া থেকে ইতালী‚ একের পর এক গল্পহীন চরিত্রকেন্দ্রিক ছবি বানাচ্ছেন‚ গল্পকে রীতিমত ঘৃণা করছেন‚ও তো ছোটো বাচ্চারা শোনে। গোদার বলে বসেন‚ আরে একটা বন্দুক আর একটা মেয়ে থাকলেই তো ছবি (পড়ুন হলিউডী) বানিয়ে ফেলা যায়। এমনকি হলিউড কাঁপানো পরিচালক মার্টিন স্কর্সেজী (যদিও আদতে ইতালীয়ান‚ অর্থাৎ ইওরোপীয়) বলেন‚ আমাকে টানে চরিত্র‚ প্লট নয়। আলাঁ রেনেঁ-র একটা ছবি আছে হিরোশিমা মন আমুর নামে। নন্দন চত্বরে এসব নাম মুখে মুখে ফেরে। দুজন নামহীন নরনারী‚ যাদের নাম শুধুই শী আর হী‚ বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু কথা বলে‚ না কোনো গল্প‚ না মিউজিক‚ না হিরোশিমার কোনো নাটকীয় দৃশ্য। তবু লোকে দেখছে‚ ভাবছে। এই হলো ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের সেই "auteur" থিওরী‚ যেখানে পরিচালকই ছবির "author"। গল্পের দরকার নেই‚ পরিচালকের হাতে থাকছে একটা কি দুটো মূল চরিত্র। তাদের পেঁয়াজের খোসার মতো খুলতে খুলতে ছবিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে (পেঁয়াজের কথাটা আগন্তুকের মধ্যেই আছে) এই ইওরোপীয় ছকেই বানানো আগন্তুক। তাই সত্যজিৎ তাঁর অন্য কোনো চরিত্র সম্বন্ধে যা বলেন নি‚ আগন্তুক প্রসঙ্গে সে কথাই বললেন‚ " I've told Utpal, you are playing me." বেথোফেন যেমন কুড়ি-পঁচিশ বছর বয়সে নাইন্থ সিম্ফনি লিখতে পারতেন না‚ তেমনি আগন্তুক সত্যজিতের শেষ কাজই শুধু হতে পারতো। আগন্তুকে সত্যজিৎ কোনো কাহিনীর ভরসায় বসে নেই। তাঁর একান্ত নিজের কনভিকশন‚ নিজের দর্শনের আকার নেওয়া মনমোহনের চরিত্র দিয়ে তৈরী এ তাঁর "personal" ছবি‚ যার "author" একমাত্র তিনিই। গল্প একটা আছে আগন্তুকে‚ শেষে একটা ওহেনরীসুলভ টুইস্টও আছে‚ কিন্তু সেটা গৌণ। মনমোহনের চরিত্রটা শেষ অবধি এতো আচ্ছন্ন করে রাখে যে এই শেষ টুইস্টটার কথা মনেও থাকে না।

আগন্তুকে মিউজিকের রোল কম‚ কিন্তু টাইটেল মিউজিকটার কথা না বললেই নয়। সত্যজিৎ যেভাবে রবিশঙ্কর‚ বিলায়েৎ খাঁ ও আলি আকবর খাঁকে দিয়ে কাজ করানোর পর একেবারে আর তাঁদের দিকে গেলেনই না‚ উল্টে নিজেই কম্পোজার হয়ে গেলেন‚ নিজের ওপর এরকম আস্থা রাখাটাও তো ইওরোপীয় বিশেষত্ব‚ মোটেই বাঙ্গালীসুলভ নয়। মিউজিক শুরু হচ্ছে ট্রাম্পেটের একটা ফ্লারিশ দিয়ে‚ সেই শেক্সপীয়ারের নাটকের প্রথ্ম দৃশ্যে যেমন বিউগল বাজিয়ে "রাজা আসছে রাজা আসছে" ধরণের আবহাওয়া তৈরী করা হতো। এরপর মিউজিকের মূল থীমটা আসে‚ ড্রামবীটে একটা রহস্যের ছোঁয়া। আর শেষে গীটারের তার আস্তে আস্তে বাজতে বাজতে হঠাৎ থেমে যায়। পাকীজা-র "চলতে চলতে"- গানে ট্রেনের আওয়াজ সারঙ্গীর সাথে যেমন চমৎকার মিশেছিলো‚ এই টাইটেল মিউজিকেও একটা তেমনি মুহূর্ত আছে। বাংলা সিনেমায় সত্যজিৎই বোধ হয় প্রথম দর্শককে টাইটেল মিউজিকও মুখস্থ করিয়ে ছেড়েছিলেন। সিনেমার গল্পটা তো সবাই জানেন‚ এই টাইটেল মিউজিকের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন। তবে এমনিতে আগন্তুকে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর বড়ো নি:শব্দ। বাজিলো কাহার বীণা গানটা রাখা হয়েছে এর ঠিক পরের টেনশনের মুহূর্তটাকে কাউন্টার করার জন্য। আর পৃথ্বীশ সেনগুপ্তের নিরুপায় মরণকামড়টার পরেই একটা চেলো আসে। এই তারযন্ত্রটির প্যাথোস কনটেন্ট বড়ো বেশী। গভীর রাতে একা বসে পাও কাসালের চেলো সোনাটা যদি শুনে থাকেন‚ তাহলে যন্ত্রটির মহিমা বুঝবেন।

একটা ব্যক্তিগত ভালো-না-লাগা। গুগাবাবায় সত্যজিতের কন্ঠস্বর ছিলো ভূতের রাজা হিসেবে। সেটা একটা মজার এক্সপেরিমেন্ট‚ এবং চমৎকার ভাবনা। কিন্তু আগন্তুকে ওঁর নিজের কন্ঠ ব্যবহারটা আমার কাছে ঠিক জমেনি। উৎপল দত্তের ঐ দাপুটে সংলাপের মাঝে সম্পূর্ণ অন্য আওয়াজে দু-এক কলি গানের লাইন ছন্দ কেটেছে। যে সত্যজিত সৌমিত্রের লিপে কিশোর কুমারকে ব্যবহার করে একেবারে আউট-অফ-দ্য-বক্স কামাল করেছিলেন‚ তিনি কন্ঠ মেলানোর ক্ষেত্রে এরকম ছন্দপতন কেন করলেন জানি না।

আগন্তুককে স্ট্রাকচারের দিক দিয়ে ইওরোপীয়ান বলেছিলাম মনে পড়ছে। আর ছবির মূল থীম? সেটা অবশ্য জাপান‚ ফ্রান্স‚ আমেরিকার (হলিউডের) দুর্ধর্ষ এক ককটেল। আবার একটা নন্দন-ছাপ আঁতেল ডায়লগ দিলাম‚ ভাবছেন? বলছি। ফ্রান্সের ব্যাপারটা তো মনমোহন নিজেই ইশারায় বলেছেন। ঐ যে‚ উনি নিমো ছদ্মনামে লিখতেন? ক্যাপ্টেন নিমো‚ ফরাসী ঔপন্যাসিক জুল ভের্নের সেই কাল্ট চরিত্র‚ নামহীন‚ পরিচয়হীন জলে জলে ঘুরে বেড়ানো এক বিষণ্ণ বুন্দেলখন্ডী রাজপুত্র। জেমস ম্যাসনের অভিনয়টা মনে পড়ে‚ অর্গানে বাখের ডি মাইনরে তোকাত্তা আর ফুগতে ঝড় তুলছেন। ল্যাটিনে নিমো মানে নামহীন। আগন্তুকের এটাই থীম‚ ম্যান ইউথ নো নেম।

হলিউডের ওয়েস্টার্নে সেই ধুলো ঘোড়া রিভলবার টেবল মাউন্টেন আমাদের মতো যেসব মাঝবয়সী দর্শকের শিরাধমনীতেও রক্তের গতিবেগ বাড়িয়ে দেয়‚ তারা জানবেন‚ ম্যান উইথ নো নেম-এর কি অভিঘাত। কুরোসাওয়ার সানজুরো-তে তোশিরো মিফুন-অভিনীত সামুরাইয়ের কোনো নাম নেই‚ জিগ্যেস করলে বলে সানজুরো (মানে তিরিশ বছর বয়সী)। এই এলো জাপান কানেকশন। সের্জিও লিওনের ডলার ট্রিলজি‚ যেটা কুরোসাওয়ার দ্বারা প্রভাবিত‚ তাতে ক্লিন্ট ইস্টউডের নাম প্রথম পর্বে নেই (লোকে জো বলে ডাকে)‚ দ্বিতীয় পর্বে নেই (লোকে ডাকে মানকো‚ মানে যার শুধু একটা হাতই চলে‚ যেমন শরাবী-তে অমিতাভ)‚ তৃতীয় পর্বে কোনো নাম নেই‚ শুধু টুকো ডাকে ব্লন্ডি বলে। শুধু নাম কেন‚ কোনো পরিচয় নেই‚ মুখে আওয়াজ নেই‚ চোখে কোনো আবেগের বহি:প্রকাশ নেই। এতোটা নির্মম পাথর অবশ্য মনমোহন নন। সত্যজিৎ তো আর ওয়েস্টার্ন বানাতে বসেন নি। কিন্তু ছবির এসেন্স? সেই ম্যান উইথ নো নেমই তো?

নামহীন নায়ক-এর শুরুটা অবশ্য আমেরিকার হার্ড-বয়েলড পাল্প ফিকশনে‚ সেই ত্রিশের দশকে জেন গ্রে‚ ভ্যান টিলবার্গ‚ আর ড্যাশিয়েল হ্যামেটদের হাতে। হ্যামেটের রেড হারভেস্ট পড়ে ফেলেছিলেন কুরোসওয়া‚ সেই আইডিয়া নিয়ে সেভেন সামুরাই-তে সাতজন নামহীন পরিচয়হীন যোদ্ধাকে এনে ফেললেন আন্তর্জাতিক সিনেমার মঞ্চে। এরই হলিউডী ভার্সান ম্যাগনিফিশিয়েন্ট সেভেন‚ যেখানে গ্রামের বৃদ্ধ লোকটি ক্রিসকে বলে‚ তোমরা হলে হাওয়ার মতো‚ হঠাৎ করে আসো‚ সব ওলটপালোট করে আবার চলে যাও। আর ক্রিস‚ শেষে বলে‚ “We lost. We always lose”। নামহীন নায়ক ধুলোর মেঘে ঢেকে আবার অজানার পথে যাত্রা করে। মনমোহন আগন্তুকে একেবারে এই হাওয়ার মতো হঠাৎ‚ আর ক্রিস-এর মতো লুজার‚ খালি হাত । আশ্চর্য কনসেপ্ট‚ আশ্চর্য প্রয়োগ। আশ্চর্য মানুষ সব‚ সানজুরো ব্লন্ডি ক্রিস মনমোহন‚ চ্যাপলীনের দ্য ট্র্যাম্প.....

মনমোহন চরিত্রটিতে সত্যজিতের নৃতাত্বিক পড়াশোনার গভীর ছাপ দেখা যায়। বিশেষ করে বিখ্যাত ফরাসী নৃতাত্বিক ক্লঁদ লেভি-স্ট্রসের তত্বের প্রয়োগ। এখানে আমার আঁতলেমো-ও ফেল মেরে যায়‚ এতো কঠিন বিষয় নিয়ে দুম করে মন্তব্য করার ক্ষমতা নেই। তাই আমার বাবার একটা বইয়ের (বাংলা লোককথার টাইপ ও মোটিফ ইনডেক্স: দিব্যজ্যোতি মজুমদার) সাহায্য নিয়ে অল্প কথায় লেভি-স্ট্রসের বক্তব্যটা বলছি। আগে অনেকের ধারণা ছিলো‚ সাধারণ নিরক্ষর মানুষ ছিলেন বর্বর‚ অসভ্য ও বুদ্ধিহীন। লেভি-স্ট্রস বললেন‚ যেসব মানুষের হাতে সভ্যতার সৃষ্টি‚ তারা কোনোভাবেই নির্বুদ্ধিতায় আচ্ছ্বন্ন ছিলেন না। মানুষের ভাবনাচিন্তার যে প্রক্রিয়া‚ সেটা সব সময় সব সমাজে একই রকম ছিলো‚ তথাকথিত বন্যদের সঙ্গে আজকের শহুরে মানুষের সেদিক থেকে কোনো তফাত নেই‚ দুজনেই সমান "ইন্টেলেকচুয়াল"। শুধু তাই-ই না‚ দুজনেই খুব বেসিক কতগুলো প্যারামিটার দিয়েই তার পরিপার্শ্বকে মাপে‚ যেমন গরম-ঠাণ্ডা‚ সোজা-উল্টো‚ ভালো-খারাপ‚ বন্য-সভ্য ইত্যাদি। এই বাইনারী ফর্মুলা আমাদের সিস্টেমে ঢুকে গেছে বলেই আমরা কারুর ব্যাপারে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি‚ এ ভালো ও খারাপ এ ধান্দাবাজ ও চোর ইত্যাদি। লেভি-স্ট্রসের আর একটা কনসেপ্ট যেটা সত্যজিতের মনে ধরেছিলো‚ একটা পরিবার‚ সেটা শুধু স্বামী-স্ত্রী-সন্তানকে নিয়েই গঠিত হয় না। তাতে পেরিফেরাল চরিত্ররা‚ দাদুঠাকুরমাদিদামাসীপিসীমামাকাকা ইত্যাদি সম্পর্কগুলো-ও নিজের নিজের ভূমিকা পালন করে।

মনমোহন প্রথম থেকেই তাঁর সামনের মানুষগুলির (সাত্যকিকে ছেড়ে) এই দ্রুত বাইনারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার রোগটা বুঝেছেন‚ সহ্য করেছেন‚ লড়েছেন‚ ও শেষে এই গোলোকধাঁধা থেকে মুক্তি চেয়েছেন। পরবর্তী pixprab5.jpgপ্রজন্মকে বলে গেছেন‚ এবার তুমি আমার কাছে আসবে সাত্যকিবাবু‚ নইলে লেভি-স্ট্রাউসের ঐ বেসিক ফর্মুলায় পড়ে গেলে কূপমন্ডুকই থেকে যাবে। মনমোহনের মূল ভাবনাটা হলো‚ যাদের আমরা আদিবাসী/জংলী/বন্য/অসভ্য বলে নিজেকে গজদন্তমীনারে বসিয়ে দুলে দুলে হাসছি‚ তাদেরও একটা সংস্কৃতি আছে‚ শিল্প আছে‚ সায়েন্স-টেকনলজি সবই আছে‚ সেগুলো আমাদের "সভ্য" সমাজের থেকে কিছুই কম নয়। বরং ড্রাগের নেশা‚ সন্ত্রাসবাদ‚ যুদ্ধ-অশান্তি-দুর্নীতি‚ আর হিপোক্রিসী মিলিয়ে আমাদের শহুরে "সভ্যতা"‚ ঐ বন্য-অসভ্যদের হাতে তৈরী মানুষের প্রকৃত "সভ্যতা"-র থেকে অনেক পেছনে।

এ তো গেলো ছবির দার্শনিক দিক। তত্ত্বকথায় না গিয়ে শুধু যদি ছবির ফেস ভ্যালুটাই দেখি? দেখি বাঙ্গালীর চরিত্রচিত্রণ? বাঙ্গালী বলে একরকম নিরীহ অথচ নখদন্তশীল হিংস্র প্রাণীকে নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। কিন্তু শুধু দু-তিন কথায় এমন স্টাডি সত্যজিত আগে নিজেও করেছেন কি? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বাপরে বাপ বলি যখন শুনি

---"পরনিন্দা নয়‚ পরচর্চা নয়‚ মুখেন মারিতং জগৎ নয়.."
----"স্ট্রাগল‚ বাঙ্গালীর বড় প্রিয় শব্দ"

আর শেষে‚

"মাতব্বরী জিনিসটা আমার একেবারে সহ্য হয় না।"

এই চারটে লাইন‚ যতদিন বাঙ্গালী হিসেবে বেঁচে থাকবো‚ "হৃৎপিন্ডে দন্তশূল"-এর মতো তীক্ষ্ণ হুল ফুটিয়ে যাবে।

কয়েকটা পর্যবেক্ষণে আসি। প্রথম‚ সত্যজিতের ছবিতে শিশু চরিত্রের একটা রেকারিং মোটিফ আছে। "ঐ হাসির চেয়ে বড়ো থ্যাঙ্ক ইউ আর হয় না" এই উক্তি সেই শিশু চরিত্রের প্রতি পরিচালকের গভীর শ্রদ্ধাকেই পুন:স্থাপিত করে। সত্যজিতের ছবিতে ছোটো ছেলে যত রয়েছে‚ ছোটো মেয়ে সেরকম সংখ্যায় নেই‚ দুর্গা ছোটো হলেও সে উনবিংশ শতাব্দীর গ্রামের মেয়ে‚ জন্ম থেকেই তাকে বড় হয়ে যেতে হয়েছে। সত্যজিৎ নিজের ছেলেবেলাটাকে যত্ন করে তাঁর ছবিতে সংরক্ষণ করে রেখেছেন‚ তাই তাঁর একাধিক ছবিতে যে একলা মুখচোরা কল্পনাপ্রবণ ছোটো ছেলেগুলি দেখি সেগুলি তাঁর নিজেরই প্রতিফলন। আর শিশুমুখগুলিকে পর পর ফ্রেমে ধরা‚ এ তিনি আগেও করেছেন‚ হীরক রাজার দেশে-তে। একই বয়সী ছেলে সব‚ কিন্তু মুখগুলিতে কতোরকম আলাদা অভিব্যক্তি। এখানেও সাত্যকি ও তার বাবা-মা-কাকু-জেঠুদের মধ্যে ভাবনার কতো তফাৎ। পৃথ্বীশ দাঁতনখ বার করে বলছে‚ আপনি সামবডি না নোবডি সেটা জানাচ্ছেন না কেন। আর সত্যকি বলে‚ তুমি আমার দাদু‚ হতেও পারো‚ আবার নাও হতে পারো। দুজনের মনেই একই সন্দেহ‚ একই প্রশ্ন‚ কিন্তু একটার প্রকাশের ভঙ্গী চুড়ান্ত অসহিষ্ণু‚ অন্যটা নির্মল‚সরল। সরলতা‚ বিশ্বাস‚ ভদ্রতা নম্রতা সহিষ্ণুতা এসব তো " সভ্যতা"-রই একটা চিহ্ন বলে আমরা মনে করি‚ তাই না?

তবে পৃথ্বীশ নয়‚ এ ছবিতে সত্যজিতের প্রকৃত "বাঙ্গালী" চরিত হলো রক্ষিত-দম্পতি। পৃথ্বীশ ওয়ান-ডাইমেনশ্যানাল চরিত্র‚ শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক। কিন্তু রক্ষিত-দম্পতি ঐ পাঁচ মিনিটেই এতো শেড দেখালেন নিজেদের চরিত্রের! রবি ঘোষকে দেখি আর বিস্মিত হই। একটা ছবি দেখেছিলাম‚ বোধ হয় আগুন। রবি এক উকিলের ভূমিকায়। স্মার্ট‚ কনফিডেন্ট‚ ঐ মুখেন মারিতং টাইপ। এক দৃশ্যে কেউ ভদ্রতা করে ওঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধেই কালো কোটটা খুলে দেয়‚ নীচে ময়লা ছেঁড়া শার্ট বেরিয়ে পড়ে। এক মিলিসেকেন্ডে তাঁর মুখের ভাব হাসি থেকে অসহায়তায় পরিবর্তিত হয়। এতো নিঁখুত অভিনয় তিনি পারতেন। যদিও করতে পারেন নি‚ বাংলা ছবির দুর্ভাগ্য। আর রবি যেভাবে "ইয়ে" শব্দটিকে ব্যবহার করতে পারতেন‚ যেমন থ্রো‚ তেমনি টাইমিং।

রক্ষিত-দম্পতির মতো অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি মারার তীব্র অশ্লীল কৌতুহল‚ এ জিনিস বাংলার বাইরে উত্তর মধ্য পশ্চিম ভারতে অনেক দিন থেকেও দেখিনি। রবিনসন স্ট্রীটে বাবা-মেয়ে-ছেলে ঘরের ভেতর কতগুলো অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে জীবন যাপন করছিলো‚ কোনো ফৌজদারী অন্যায় তো করে নি। সেই বাড়ীর ছবি তুলতে শিক্ষিতা মা তাঁর কিশোরী মেয়েকে নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন‚ ঐ দেখ সেই বাড়ী! কতো জল্পনা‚ কতো নিষ্ঠুর সব সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন সবাই‚ রাস্তা থেকে মিডিয়ায়। রসালো সব মনোহর কহানীয়াঁ। ভিড় জমে আসে‚ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি‚ খাড়া কান‚ হায়নার মতো মড়ার দিকে নজর।

দ্য বোন কালেক্টর-এ ডেনজেল ওয়াশিংটন এক জায়গায় বসে বসে কি অভিনয়টাই করেছিলেন। প্রমোদ গাঙ্গুলী অন্তর্জলি যাত্রায় দেখিয়ে দিলেন ওরকম তিনিও পারেন‚ হয়তো একটু বেশীই পারেন। এখানেও কানে খাটো "ফিলদী রিচ" ব্যারিস্টারের চরিত্রে মাত্র দু-তিন মিনিট‚ বসে বসেই। জাত অভিনেতা এঁরাই। "হিন্দুস্তানীও হতে পারে‚ আবার বাঙ্গালীও হতে পারে"‚ "হিন্দুস্তান" নিয়ে বাঙ্গালীর এই চিরন্তন মিসকনসেপশনকে এইভাবে আউট-অফ-দ্য-ব্লু তুলে ধরা‚ সত্যজিতের পক্ষেই সম্ভব। (ও তুমি খ্রীস্টান নও‚ তুমি বাঙ্গালী? এ প্রশ্ন শুধু বাঙ্গালীই করতে পারে)। সত্যজিতের ডিটেইলস তো লোককথার উপাদান‚ এখানেও যে কুকুরটিকে প্রমোদবাবুর কোলে বসিয়েছেন তার কান বড় বড় লোমে ঢাকা। কোনো খাড়া কানের কুকুরকে প্রমোদবাবুর কোলে বসালে ওঁর কানে-খাটোত্বের সাথে কনট্রাস্ট হয়ে যেতো। একই রকম ডিটেইলস আর কন্টিন্যুইটি দেখি আর এক জায়গায়। অনিলা তার মামার গৃহত্যাগের কারণ হিসেবে বলেছিলো "বাইসন। কিছু বুঝলে?" সুধীন্দ্র বুঝতে পারেনি‚ অনিলাও আর ভেঙ্গে বলেনি। এর অনেক পরে পৃথ্বীশের সাথে মনমোহনের কথোপকথনের সময় সুধীন্দ্র কপাল টিপে বসে ছিলো‚ মনমোহন হঠাৎ "আমি জংলী নই‚ আমি আলতামিরার মতো বাইসন আঁকতে পারিনা" বলতেই সুধীন্দ্র চোখ তুলে তাকায়‚ এতক্ষনে বাইসনের মিসিং লিঙ্কটা ধরতে পারে। তুখোড় ডিটেইলিং‚ নিখুঁত কন্টিন্যুইটি।

একজন "বাইরের লোক" এসে একটা শান্ত নিস্তরঙ্গ পরিবারে উলোটপালোট করে দিয়ে যাচ্ছে‚ এই থীমকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সিনেমায়: সত্যজিতের আগন্তুকের মতো সিরিয়াস চরিত্রনির্ভর স্টাইলেই হোক‚ তপন সিংহের গল্পনির্ভর ও সেন্টিমেন্টাল ছবি অতিথি-ই হোক‚ বা হলিউডের হাসির ছবি বিল মারে অভিনীত "হোয়াট অ্যাবাউট বব?"-ই হোক। সব টেকনিকগুলো-ই সমান সার্থক‚ কারণ ঐ একটাই‚ ছবিগুলো দর্শককে ভাবায়।

 


লেখক পরিচিতি - প্রবুদ্ধ (জন্ম ১৯৭৩): যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্স্ট্রুমেন্টেশন ইঞ্জিনীয়ারিংএর স্নাতক। গেইল ইন্ডিয়া লিমিটেডে কর্মরত‚ চাকরীসূত্রে বরোদানিবাসী। দেশ ও স্টেটসম্যানে চিঠি লেখা দিয়ে সিরিয়াস লেখালেখির শুরু ছাত্রাবস্থাতেই। সিনেমা সঙ্গীত আর্ট খেলা রাজনীতি খাওয়াদাওয়া অনেক বিষয়েই "জ্যাক" হিসেবে লিখে থাকেন‚ তবে সময় নেই এই বাজে অজুহাতে মাঝে মাঝে লেখায় ছেদ পড়ে। পড়া শোনা দেখা ও খাওয়াটা মন দিয়ে করে থাকেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।