প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সিনেমা: ‘কিন্তসুকুরোই’

মে ৩০, ২০১৫

সিনেপর্দায় ভাঙা-গড়া জীবনের দর্শন

সরোজ দরবার

‘কিন্তসুকুরোই’
পরিচালক - কৌস্তভ ভট্টাচার্য

‘সিসা হো ইয়া দিল হো আখের টুট যাতা হ্যায়’- আনন্দ বক্সি সেই আটের দশকের গোড়াতেই এই ধ্রুবসত্যি তুলে দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে৷ সত্যি এই নিদারুণ সময়ের প্রহারে কীই বা না ভেঙে থাকতে পারে! তবু মজা হল, ভেঙে যাওয়া মানেই কিন্তু সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়! জীবন যদি ডিসপোজেবল হত, তবে তো ল্যাটা চুকেই যেত। কিন্তু ডানা ভাঙলেও সে আবার উড়তে চায়। ফিনিক্সের ধর্ম সে যেন বয়ে নিয়ে চলেছে তার চরিত্রেই। আমাদের, মানুষকে তাই ভাঙা মন জোড়া লাগিয়ে আবার জীবনের বৈঠা বাইতে হয়৷ ভাঙা জিনিসও যে কখনও সখনও জোড়া লাগানো যায় না তা নয়৷ জোড়া লাগানোর পর তা আগের মতোই থাকে কি না, সে আলাদা ব্যাপার, থেসিয়াসের জাহাজের প্যারাডক্স, কিন্তু জীবন সত্যিই সুন্দর যদি এই জোড়া দেওয়াকে একটা শিল্পিত রূপ দেওয়া যায়৷ অনুভূতির ফাটলগুলো যদি ততোটাই প্রকট না হয়, যদি সময়ের প্রলেপে তা জোড়া লেগে আবার নতুন এক রূপ নেয় তবে তো সোনায় সোহাগা৷বস্তুত এ নেহাতই কথার কথা নয়, এই জোড়া লাগানো আস্ত এক দর্শনই৷ যেমন তেমন করে জোড়াতালি দেওয়া নয়, শিল্পিত সুন্দর করে ভাঙাচোরা জীবনকে জোড়া লাগানোর দৃষ্টিভঙ্গী, যার নাম ‘কিন্তসুকুরোই’৷ এক বাঙালি পরিচালক এই দর্শনকেই ফ্রেমের বাঁধনে জুড়ে তৈরি করে ফেলেছেন তাঁর ছবি৷ সে ছবি পৌঁছে গিয়েছে কান চলচ্চিত্র উৎসবে৷ 

‘কিন্ত্সুকুরোই’- এ শব্দের অর্থ কি? অনেকের মতো পরিচালক কৌস্তভ ভট্টাচার্যর। বলা যায় এ দর্শন যেন দৈবক্রমেই একদিন ধরা দিয়েছিল তাঁর কাছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে ঘুরতে একদিন চোখে পড়ে গিয়েছিল শব্দটি। সেই শব্দের অর্থ খুঁজতে খুঁজতে কৌস্তভ পৌঁছে গিয়েছিলেন জীবনের এক আলোর সরণীতে। প্রাথমিকভাবে বলা যায় ‘কিন্তসুকুরোই’ জাপানের ভাঙা বস্তু বা পাত্র জোড়া লাগানোর এক রকমের আর্ট৷ সোন-রূপা-প্লাটিনামের গুঁড়ো দিয়ে ভাঙা পাত্র এমনভাবে জোড়া দেওয়া হয়, যাতে তা আগের অবস্থার থেকে আরও ভালো হয়ে ওঠে-এই হল কিন্তসুকুরোই৷ কিন্তু এ তো বাইরের কথা৷ এর ভিতরে আছে জাপানের জীবনযাপনের এক গভীর দর্শন৷ ‘ওয়াবি-সাবি’ দর্শন এবং ‘নো মাইন্ড’ দর্শনের যে মূলসূত্র, মোটামুটি যাকে বলা যায়, যে কোনও পরিবর্তনকেই স্বীকার ও গ্রহণ করার  মানসিকতা, তারই এক বাস্তবগ্রাহ্য রূপ মেলে ‘কিন্তসুকুরোই’ আর্টের মধ্যেও৷ যেখানে ভাঙা কোনও জিনিস জোড়া লেগে আগের থেকেও ভালো হিসেবে প্রতিভাত হয়। একই কথা খাটে সম্পর্ক কিংবা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও৷ এই শব্দের সূত্রেই  নিজের ছবির চিত্রনাট্য লেখেন কৌস্তভ৷
কিন্তু সিনেমা শিল্প তো অর্থের বাগদত্তা। সুতরাং পয়সার দরকার সবার আগে। ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে তাও জোগাড় হয়৷ টিনা, চক্রবর্তী, অভীক দত্ত, চিত্র সেন, তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভশ্রী বসু, রুমা পাত্র, দেবযানী ভট্টাচার্য এতজনে এগিয়ে আসেন ছবি তৈরির জন্য৷ কেন্দ্রীয় দুই চরিত্রে অভিনয় করেন সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও পৃথা ভদ্র৷ ক্যামেরা হাতে কৌস্তভের ভাবনাকে তুলে রাখলেন শুভজিত দত্ত৷ ‘কান’-এ শর্ট ফিল্ম কর্ণারের কথা মাথায় ছিল৷ সেটাকে টার্গেট করেই ছবি শেষ করেন কৌস্তভ ও তাঁর দুই সহযোগী অরুণাভ গঙ্গোপাধ্যায়, মৃত্যুঞ্জয় রায়৷ ছবি সম্পাদনা করেন শ্রেয়া চট্টোপাধ্যায়৷

কিন্তু শুধুই কি বায়বীয় দর্শন? বাস্তব কি এরকম কাউকে দেখাতে পারে, যিনি ভাঙাচোরা পেরিয়ে এগিয়ে গেছেন নতুন জীবনের দিকে? পরিচালক মনে করিয়ে দেন সুজেট জর্ডনের কথা।   বলেন, ‘‘এই শহরে এভাবে আত্মপ্রকাশের সাহস ক’জন রেখেছেন? ইনফ্যাক্ট আমার এক বন্ধুই সুজেটের কথা আমাকে বলেছিল৷ আমি তখন ‘কিন্তসুকুরোই’ এর বাস্তব উদাহারণ খুঁজছিলাম৷ ওই বন্ধুর কথাতেই হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো মনে হয়েছিল, সুজেটের থেকে বড় কিন্তসুকুরোই আর কে আছেন? ক’জন বলতে পারেন, ‘আমি পার্ক স্ট্রীট কাণ্ডের নির্যাতিতা নই, সুজেট জর্ডন’ এই যে জীবনের ভাঙাকে তিনি আত্মপ্রত্যয়ে জোড়া লাগিয়ে আরও ভিন্ন হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারলেন, সেটা যেন সেই দর্শনেরই প্রকাশ৷ তাই তিনিই ছিলেন আমার কাছে কিন্তসুকুরোই৷’’

কৌস্তভের ছবি ‘কান’ এর শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হল। তবে দূর প্রবাসেও পরিচালকের সঙ্গে যেন থেকে গিয়েছিলেন  সুজেট জর্ডন৷  নাহ, তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত কোনও নায়িকা চরিত্র নেই কৌস্তভের ছবিতে, তাঁর জীবনের ঘটনার কোনও ছায়াও নেই, তবু পরিচালকের মনে তিনি থাকবেন সত্যিকারের একজন ‘কিন্তসুকুরোই’ হয়েই৷ আমরাও কৌস্তভের ছবি দেখতে দেখতে হয়তো খোঁজ করব কিন্তসুকুরোইয়ের। হয়তো বাইরে। পাব কিংবা পাব না। আর যদি তা পেয়ে যাই আমাদের নিজেদের ভিতরেই, সব ভাঙাগুলোকে জোড়া লাগিয়ে যদি এগিয়ে যেতে পারি নতুন করে, নতুন হয়ে, নতুন দিকে, তবে তো কৌস্তভের ছবি জীবন ও শিল্পের মধ্যিখানে কখনও সখনও থেকে যাওয়া ভাঙাচোরাগুলিকেও জোড়া দিয়ে আমাদের রওনা করিয়ে দিতে পারবে সম্পৃক্তির পথে।  


পরিচালকের কথা
ম্যাজিক
কৌস্তভ ভট্টাচার্য

পৃথিবীতে প্রাণ জিনিসটা ঠিক কিভাবে ঘটলো সেটা একটা ব্যোমকেশোপম রহস্যের বাবা। তার মধ্যে মানুষের মত একটা মাথাওয়ালা জীবের তৈরী হওয়াটাও নেহাৎ কম কিছু নয়...

তো সেই কিমাশ্চর্যম কিম্ভূতেপনার মাঝে দাঁড়িয়ে মানুষের বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা আবিষ্কার সিনেমা - চব্বিশটা ফ্রেম এক সেকেন্ডে চালিয়ে দিলে মনে হয় ছবি নড়ছে - অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটাই একটা বিভ্রম তৈরী আর সেখান থেকেই কেল্লাফতে - এর চেয়ে বড় ম্যাজিক আর কি আছে!

ফরাসী ভ্রাতৃদ্বয় অগাস্তে আর লুই সেই ১৮৯৬ - তে THE ARRIVAL OF A TRAIN দেখিয়ে সেই যে ম্যাজিকের শুরুয়াদ করেন - তদ্যবধি শক-হুন-পাঠান-মোঘল-চীনা-আমরিকি-বাঙালি এবং তাবৎ নন বেঙ্গলি এই নেশায় বুঁদ।

কিন্ত্সুকুরোই ছবিটা আমি সহ গোটা টিমের কাছে সেই ম্যাজিক শিক্ষার হাতেখড়ি।

জাপান দেশটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতিহাসে প্রফেসনালিজম দেখিয়ে সিক্স সিগমা, গ্রাফিক নভেল ইত্যাদি পায়োনিয়ার করে - জগতের অশেষ উপকার করেছে - কিন্তু এর আগে একটা অন্য জাপান ছিলো। যেখানে দেখনদারির উপর দিয়ে চলতো দর্শন, স্যামুরাই প্রথার কাঁধে মাথা রাখত মহাজন বৌদ্ধ ধর্ম - কিন্ত্সুকুরোই সেই হারানো জাপানের একটা শিল্প যার মোদ্দা কথা - ভাঙা জিনিস এমন ভাবে সারাও - যাতে সারাবার পর জিনিসটার আর্থিক আর বৌদ্ধিক মূল্য বাড়ে।

এই এক লাইনের কাঁধে ভর দিয়েই আমাদের সিনেমা পাহাড় দেখার অপচেষ্টা - এভাবেই আমাদের ছোটছবি চলে আঁকে বাঁকে।

তো কি দাঁড়ালো? আমাদের ছবি, যার ভাষা বাংলা আর সারমর্ম জাপানি, তা দেখানো হল প্রথম লুমিয়েরদের খাস দেশে - ম্যাজিক ছাড়া কম কী

আলোচক পরিচিতি - সরোজ দরবার যাদবপুরের মাস কম্যুনিকেশনের ছাত্র। পেশায় খবর লিখিয়ে। বর্তমানে কলকাতা ২৪ x ৭-এ কী -বোর্ড চালান নিয়মিত। পাশাপাশি কবিতা ও গল্প লেখেন। প্রকাশিত বই- ‘চলতি হাওয়ার পংক্তি'।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।