ফিসফাস কিচেন- পার্সি খানপান
সৌরাংশু
পার্সিদের নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই তাদের ইতিহাস ঘাঁটতে হয়, আর তখন ইতিহাসের সরণি বেয়ে চলে যেতে হয় সভ্যতার ঊষাকালে। কথিত আছে, এই যে আর্যরা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়, তাদের প্রথম ঘরবাড়ি ছিল কিন্তু আয়রিয়ানা ভায়জা বা আর্যদের শৈশবের দোলনা। যে জায়গাটাকে আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বর্তমানে আজারবাইজানের (আয়রিয়ানা ভায়জা শুনতে কাছাকাছি লাগছে না?) কোন একটা অঞ্চল হিসাবে ধরা যেতে পারে। আর সকলেই তো জানি যে আগুনের আবিষ্কারও হয়েছিল পার্সিদের হাতেই। তাদের রাজা হাওয়াশিয়াঙ্ঘার সময়।
রাজা জামশিদের সময় পার্সিদের জনসংখ্যা বেড়ে যাবার দরুণ তারা দক্ষিণের কোন অঞ্চলে চলে যায়। আইরিয়ানার নামানুসারে সেই অঞ্চলের নাম হয় ইরান।
জামশিদের আমলেই পার্সি নববর্ষের দিন স্থির হয় ২১শে মার্চ, অর্থাৎ মহাবিষুবের দিন। শুধুমাত্র পার্সিরাই নয়, ইরানের মুসলিমরা, এমন কি আফগানিস্তান এবং কাশ্মীরের বাসিন্দারাও নওরোজকে নববর্শ হিসাবে পালন করে। মদ বা সোমরস নাকি পার্সি নৃপতি জামশিদের সময়ই আবিষ্কৃত হয়েছিল। যার পার্সি নাম হোয়ামা।
এরও পরে ইরান থেকেও অধিগমন শুরু হয় এবং ব্যাক্ট্রিয়া হয়ে আর্যরা হিন্দুকুশ পেরিয়ে ভারতে এসে উপস্থিত হয়। হিন্দুকুশের ওপারে ছিল বলে নদীর নামও হয় সিন্ধু, আর দেশটার নাম হিন্দুস্তান বা ইন্ডিয়া।
খৃস্টজন্মের তিন চারশো বছর আগে থেকেই ইরান, ব্যাক্ট্রিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে পারস্য সভ্যতা ছড়িয়ে পড়ে এবং সারা পৃথিবীর সকালবেলার সভ্যতার মধ্যে পারস্যের নাম উঠে যায়। পারস্য বা পার্স বা পার্সিপোলিস (গ্রীকদের মতে) সাইরাস এবং দারিউসের সময় গ্রীসের এজিয়েন সাগর (ভূমধ্যসাগরের গ্রীস সংলগ্ন অঞ্চল) থেকে পাঞ্জাব অবধি পারস্য সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল।
ধর্মগুরু জোরাথুস্ট্রের আগমন অবশ্য তারও আগে। বলা যায় পশ্চিম এশিয়া থেকে উদ্ভূত তিনটি ধর্ম ইসলাম, খ্রিষ্টধর্ম এবং জুদাইজমের (ইহুদী ধর্ম) অণুপ্রেরণা এই জোরাস্ট্রিয়ানিজম।
খাদ্যাভ্যাসেও পারস্যের অবদান অনস্বীকার্য। গোলাপের আতর বা গোলাপ জল, সংরক্ষিত ফল, গ্রিল করা খাদ্য এবং বাকলাভা বা সেমাইয়ের বিভিন্ন মিষ্টি পারস্য থেকেই ছড়িয়ে পরে।
খ্রিস্ট জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই ম্যাসিডোনিয়ার আলেকজান্ডারের হাতে পারস্য সাম্রাজ্য পরাস্ত হয়। কিন্তু আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরে বেশিদিন গ্রীকদের হাতে পারস্য থাকে নি। এর কিছুদিনের মধ্যেই আর্তাকশন পাপাকানের হাতে সাসানীয় শাসনের সূত্রপাত এবং জোরাস্ট্রিয়ানিজমের পুনরুজ্জীবন। এই সময় পারস্যের খাদ্যাভ্যাসে প্রভূত পরিবর্তন হতে আরম্ভ করে। তবে মধ্য প্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার নব্য ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের চাপে ধীরে ধীরে পারস্য সাম্রাজ্যের বাড়বাড়ন্ত কম হতে থাকে এবং ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে নহবন্দের যুদ্ধে পারস্য সাম্রাজ্যের শেষ লিখন লিখিত হয়। এই সময় পার্সিদের অধিকাংশই এদিক ওদিক পালাতে থাকে। কিছুদিন খোরাসানে থাকার পর জলপথে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। প্রথমে দিউতে এসে উপস্থিত হয় পার্সিদের জাহাজ। তারপর পশ্চিম উপকূলের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যাবার জন্য তারা জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
লোকগাথা অনুযায়ী তারা পৌঁছয় গুজরাটের সঞ্জন বলে জায়গায়। কথিত আছে, পার্সিদের প্রতিনিধি হিসাবে তিনজন বয়স্ক ‘দস্তুর’ (পুরোহিত) সঞ্জনের সুলতান জাইদি রাণার দরবারে উপস্থিত হলে, ভারতীয় ভদ্রতার মোড়কে রাণা তাঁদের ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাই দস্তুরদের সামনে হাজির করেন দুধে টইটম্বুর এক পাত্র, এটা বোঝাবার জন্য যে ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী”। কিন্তু দস্তুররাও দস্তুরমতো প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিল। তারা ফটাক করে পকেট থেকে প্যাকেট বার করে গুঁড়ো চিনি ঢেলে দিলো দুধে, আর চিনি আর দুধ ‘এক দেহে হল লীন’। যেন ‘আমায় একটু জায়গা দাও গো মায়ের মন্দিরে বসি’ বলে মান্না দে গান গাইতে বসলেন।
মেনে নিলেন সুলতান। তবে শর্তাবলী রইল। যেমন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতে পারবে না, গুজরাটিতে কথা বলতে হবে আর বিয়ে ফিয়ে করতে হবে গুজরাটি শাস্ত্রমতে সন্ধ্যার পরে।
তা পার্সিদের তখন ‘দাঁড়াবার জায়গা’ নেই তো আরামকেদারা! এসব মেনে টেনে নিয়েই নওসারি, উদ্ভদা, ভারুচ, ভালসাদ, তারাপোর এবং বিল্লিমোরায় তারা থাকতে শুরু করল। এর পরে ব্যবসা বাণিজ্যের সূত্রে তারা সুরাত এবং মুম্বাইতেও ঘাঁটি গাড়ল।
যদি ভালো করে দেখি তাহলে আধুনিক ভারতবর্ষের গঠনে পার্সিদের অবদান প্রচুর। ব্যবসার ক্ষেত্রে যদি দেখি তাহলে প্রথমেই মনে আসে জামশিদজীর কথা। ভাবুন তো একবার! নভসারিতে জন্মানো এক ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে ব্যাঙ্গালোরে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাকচিতে একটা লৌহ ইস্পাত কারখানা, বোম্বেতে একটা হোটেল আর একটি জলবিদ্যুৎ সংস্থা খোলার স্বপ্ন দেখল। আর তারপর কি কাণ্ডটাই না হয়ে গেল। টাটা আজকের দিনে ভারতে কেন বিশ্বের দরবারে এক পরিচিত নাম।
তেমনই গোদরেজ, বোম্বে ডাইং, ব্রিটানিয়া আর আরও কতো কি!
কিন্তু আমাদের যে যাত্রা বা পাথেয় সে তো বাজার সরকারে শুরু আর পাচন প্রক্রিয়ায় শেষ। তবে এসব তথ্য নিয়ে করবেন কি? কিছুই না, কোন জাতি বা দেশের খাদ্যাভ্যাস জানতে চাইলে তার উৎস এবং চলন সম্পর্কেও একটু জ্ঞান থাকা ভালো। এই যেমন পার্সিদের কথাই ধরুন! পার্সিদের রান্নাবান্নার উৎস সন্ধানে দেখতে পাবেন ইরান বা মধ্য এশিয়া থেকেও যেমন প্রভাব এসেছে তেমনই ঘরের কাছের গুজরাত, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এমন কি গোয়ার খানপানও পার্সি রান্নায় প্রভাব ফেলেছে।
সেই সময়কার কথা ধরুন, যখন পথের ধারে ধারে যখন সরাই থাকত না তখন তখন পার্সি ব্যবসায়ীরা এক বিশেষ ধরণের খিচুড়ি নিয়ে যেত পথের পেটপুজোর জন্য। এই রেসিপিটা মেহেরবাই জামশিদজী নুসারওয়ানজী ওয়াদিয়ার সৌজন্যে। যিনি, সেই উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে গুজরাটি ভাষায় ‘বিবিধবাণী’ বলে একটা পার্সি রান্নার বই লিখে রেখে গেছেন। যাই হোক সেই খিচুড়ি করতে গেলে চাল আর ডাল হলুদ আর নুন মাখিয়ে হাল্কা থেঁতো করে ভিজে কাপড়ে বেঁধে গরম বালিতে চাপা দিয়ে রেখে তার উপর কাঠকুঠ জড়ো করে আগুন দিয়ে রাখতে হবে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তারপর পোড়া কাঠকুঠ সরিয়ে পার্সেলটাকে আরেকবার উলটে দিয়ে বসিয়ে রাখতে হবে একইভাবে। দেড় ঘন্টায় রাতের খাবার তৈরী। খেতে খাজা হলেও কাজ চলে যাবে বোধহয়।
ইয়ে মানে, বুঝতে পেরেছি যে প্রথম চোটেই যা নমুনা পেলেন তাতে পালিয়ে যেতে পারেন এই লেখাটা থেকেই। না বাবা! সে সবের মধ্যে না গিয়ে চিকেন বা মাটন নুন হলুদ লঙ্কা আদা রসুন দিয়ে মেখে রাখুন তারপর সিদ্ধ করে নিন। এবং সিদ্ধ চিকেন বা মাটন সরিয়ে নিয়ে এসে বাকি জলটাকে বেস হিসাবে ব্যবহার করে, গরম মশলা, জায়ফল জয়িত্রী, তেজপাতা ইত্যাদি আখনি করে নিন। আখনি জানেন তো? একটা পুঁটলিতে সব গোটা মশলা ভরে ফুটন্ত জলের থেকে দু ইঞ্চি উপরে রাখবেন। যাতে ভাপ তৈরী হয় আর মশলার ভাপ জলের মধ্যে টুপ টুপ করে পড়ে। এখন এই জল ফুটলে পেঁয়াজ ভেজে চাল ভেজে ডাল ভেজে দিয়ে দিন। সঙ্গে সেদ্ধ মাংসও দিন। পরে পুঁটলির মশলা বেটেও দিয়ে দিন। আর খিচুড়ি রেঁধে নিন। প্রয়োজনে শেষে একটু গুঁড়ো গরম মশলা আর ঘি দিয়ে নামিয়ে দিন। ব্যাস পার্সি খিচুড়ি তৈরী।
এই খিচুড়ি ফিচুড়ি ছেড়ে আসুন আমার আসলি পার্সি খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে মুকালাত এবং মুলাকাত সম্পর্কে জানি।
পার্সি রান্না বললেই বিশ্বশুদ্ধু লোক ‘ধনশক’ ‘ধনশক’ বলে চ্যাঁচাতে থাকবে। যেন শয়নে স্বপনে জাগরণে জেরক্সিসের বংশধরেরা ধনশক খেয়েই বর্তে যায়। আসলে কিন্তু ধনশক নিয়মভঙ্গের খাবার। যে কোন মাসে এমনিতে চারটে দিন ‘বাহমান, মোহর, ঘোস এবং রামরোজ’ যেদিন পার্সিরা মাংস খায় না। এছাড়াও পার্সি ক্যালেন্ডারের একাদশ মাসেও তারা চারপেয়ের মাংস থেকে দূরে থাকে। একইভাবে প্রিয়জনের মৃত্যুর পর তিন দিন অশৌচ পালিত হয় এবং চতুর্থ দিনে ধনশক দিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন সূচিত হয়। তাই ধনশক উৎসবের নয় দুঃখের দিনের শেষের খাবার। সে যাই হোক ধনশক নিয়ে যখন কথা হচ্ছে তখন বিস্তারিত ভাবে একটু আলোচনাও হোক রেসিপি নিয়ে!
এর অন্য অনেক রকম রেসিপি থাকতে পারে কিন্তু আমার পছন্দ এটিই। ১ ইঞ্চি গোল হলুদ, ৫০ গ্রাম কারি পাতা, আড়াইশো গ্রাম জিরে, ৬০ গ্রাম শাহজিরা, ১ কেজি ধনে, ৫০ গ্রাম মেথি, ৫০ গ্রাম দারুচিনি, ৫০ গ্রাম লবঙ্গ, ৫০ গ্রাম ছোট এলাচ, ২০০ গ্রাম গোল মরিচ, ৫০ গ্রাম পোস্ত, ৫০ গ্রাম তেজপাতা, ৫০ গ্রাম শুকনো কমলালেবুর খোসা, ৫০ গ্রাম শুকনো পাতিলেবুর খোসা। ১-২ চা চামচ তেলে সবকটা মশলা নেড়ে গুঁড়ো করে এয়ারটাইট জারে রেখে দিন। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মশলা থাকবে।
ধনশক রান্নার জন্য পাঁঠার মাংসের ‘রাণ’ বেছে নিন বা মুর্গির মাংসের থাই বা বুকের অংশ। এক ইঞ্চি ছোট ছোট করে কেটে নিন। এক কাপ অড়হর ডাল, পৌনে কাপ মুগ, পৌনে কাপ মুসুর, পৌনে কাপ ছোলার ডাল, পৌনে কাপ বিনসের বীজ, ২ টেবিল চামচ বিউলির ডাল। এছাড়া এক চা চামচ করে হলুদ, লঙ্কা এবং জিরে গুঁড়ো, ২ টেবিল চামচ করে ধনে গুঁড়ো এবং ধনশক মশলা।
ডালে ব্যবহারের জন্য ২টি আলু, ২টি টমাটো, ৪-৬টি কাঁচা লঙ্কা বীজ বার করে নিয়ে, ২ টেবিল চামচ ধনে পাতা ১ টেবিল চামচ পুদিনা পাতা ২০০ গ্রাম পাকা কুমড়ো, ২০০ গ্রাম লাউ, ১টা মাঝারি আকারের বেগুন ৮টি আঁটি মেথি পাতা ৪-৬টি রসুন পাতা, ২-৩টে সবুজ পেঁয়াজ ২ ইঞ্চি আদা এবং ১টি রসুনের কোয়া।
আলাদা করে ৩টে বড় পেঁয়াজ, ১ ইঞ্চি দারুচিনি, ৪-৬টে লবঙ্গ, ৪-৬টি খোসা ছাড়ানো বড় এলাচ, ২টো ফুল চক্রি এবং ৫০ গ্রাম ঘি বা প্রকারান্তরে মেটের চর্বি।
রান্নার জন্য বাড়তি মশলা হিসাবে ১ চামচ হলুদ গুঁড়ো, একটু লঙ্কা গুঁড়ো, ১ চামচ জিরে গুঁড়ো, দু চামচ ধনে গুঁড়ো, ২ চামচ ধনশক মশলা, ১ চামচ আদা বাটা, ১ চামচ রসুন বাটা।
এ ছাড়া ২-৩টে টমাটো ১ আঁটি ধনে পাতা ২-৩টে কারি পাতা ৪ আঁটি মেথি পাতা। আর এছাড়া তেঁতুলের কাথ, ১-২টিও লেবুর রস আর ১ টেবিল চামচ গুড়।
ব্যাস আপনার প্রস্তুতি সারা হয়ে গেছে। এরপর মেথিপাতা আধ চামচ নুনজলে কুড়ি মিনিট ভিজিয়ে তারপর জল বার করে নিন যাতে তেতো ভাব দূর হয়। ডাল ধুয়ে নিয়ে মাংস মিশিয়ে সিদ্ধ করুন। সিদ্ধ হয়ে গেলে মাংস সরিয়ে নিয়ে বাকি ডাল গ্রাইণ্ডারে বেটে নিন। এর পর মাংস আবার দিয়ে দিন। একটা কড়াইতে ঘি গরম করে তাতে প্রথম সেটের মশলা নেড়ে নিন বাদামী হওয়া পর্যন্ত। পরবর্তী সেটের মশলা দিন এবং দেড় দু মিনিট নেড়ে নিয়ে জল দিন। সব্জি টুকরো করে দিয়ে নেড়ে নিন। ডাল মিশ্রণটি দিয়ে ভালো করে মিলিয়ে নিন এবং ১৫ মিনিট ঢিমে আঁচে রান্না করুন। শেষে তেঁতুলের কাথ, লেবুর রস আর গুড় দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নামিয়ে নিন। এরপর ব্রাউন রাইস, কাবাব এবং ‘আমলি নু কাচুম্বর’ বা আমলকীর আচারের সঙ্গে পরিবেশন করুন।
কিন্তু ধনশকের বাইরে তো এক রান্নাঘর ভর্তি পার্সি রান্নার ইতিহাস। সেগুলো? তাদের পুলাউ, তাদের গোস্ত, তাদের ইডা, তাদের কুটু, তাদের পাটিও, তাদের মচ্ছি, তাদের মুর্ঘি, তাদের ফালুদা, তাদের কাঞ্জি। একদম স্পেশাল ব্যাণ্ডওয়াগণনের মতো রেসিপি কার্ট ঢুকে পড়বে যেন। মুম্বইতে গিয়ে অথেনটিক পার্সিদের বাড়িতে খাওয়া এক আর দিল্লির ‘সোডাবটলওপেনারওয়ালা’ অথবা মিসেস বাগলিস কিচেনে খাবার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রথমে সোডাবটলওপেনারওয়ালা। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে ২০০৫-৬এ বার দুয়েক একই ফ্লাইটে চোখাচুখি হয়েছিল বটে। তা তিনি তখন পেজ থ্রির মহান খিলাড়ি, অলিভ রেস্ত্রোবারের মালিক আর একটা পার্সি বা ইরানী রেস্তোরাঁর চেন খুলেছেন। এটুকুই জানতাম। অলিভে যাবার মতো ইচ্ছা বা উপায় কোনটাই হয় নি। কিন্তু ২০১৬তে দিল্লির সোডাবটলওপেনারওয়ালায় গিয়ে তাক লেগে গেলো। দিল্লি না বলে নয়ডা বলাই ভালো। এখন এই চেনটি দিল্লি, মুম্বই, ব্যাঙ্গালোর সহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। তাক লাগার কারণ এর ডেকর- সজ্জা। একদম উনবিংশ শতাব্দীর পার্সি বা ইরানী বাড়িগুলোর ছোঁয়া দিয়ে তৈরী হয়েছে এই রেস্তোরাঁগুলো। গিয়ে খেয়েছিলাম সালি চিকেন, ধনশক, ব্রাউন পুলাউ আর রোটলি। সালি চিকেনের রেসিপিটা এদের থেকেই নেওয়াঃ
একটা প্যানে তেল গরম করে কাঁচা লংকা, দারুচিনি, লবঙ্গ এবং বড় এলাচ ফোড়ন দিয়ে চারটে মাঝারি মাপের পেঁয়াজ কেটে ভেজে নিন। এরপর আধ কাপ জল দিয়ে সেটা সিদ্ধ হতে দিন। আদা রসুন হলুদ জিরে গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো নুন দিয়ে দু তিন মিনিট কষুন। এতে টম্যাটো কেটে দিন। এরপর চিকেনের থাই সহ ঠ্যাঙ দিন এবং ঢিমে আঁচে হালকা হালকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাঁধতে থাকুন যতক্ষণ না পর্যন্ত চিকেন রঙ ধরে। এবারে এক কাপ জল দিয়ে ঢাকা দিন। যতক্ষণ না পর্যন্ত গ্রেভি গাঢ় হচ্ছে এবং চিকেন সিদ্ধ হচ্ছে। এরপর প্লেটে সাজিয়ে তার উপর কাঠি কাঠি করে ভাজা আলু দিয়ে ঢেকে দিন। ব্যাস সালি চিকেন তৈরী। সালি মানে আলুভাজা। আর চিকেন তো চিকেন। যদিও শুধুমাত্র চিকেনের ডিশটাকে খারি মুরঘি বলে। এটা গোস্ত দিয়েও করা যায়। আর সালির জায়গায় কুড়মুড়ে করে ভাজা ভিন্ডি দিয়ে ভিডা মা খারি চিকেন বা গোস্ত, বা শুকনো এপ্রিকট দিয়ে জর্দালু দা খারি গোস্ত বা চিকেন বা বেগুন দিয়ে ভেংনা মা গোস্ত এসবও বানানো যায়।
এরপরের গল্পটা হল মিসেস বাগলি’স কিচেন নিয়ে। দিল্লির আইটিও থেকে সফদরজং/ আম্বেদকার স্টেডিয়ামের দিকে যেতে গেলে বাঁদিকে পড়ে দিল্লির পার্সিদের আঞ্জুমান ধর্মশালা। ভিড়ভাড়ের মধ্যে নিটোল শান্ত একটি জায়গা যেখানে ২০ মিটার দূরের গাড়ির প্যাঁপোঁ পৌঁছয় না। আমরা সমগ্র পরিবার পৌঁছলাম তারপর সেই উনবিংশ শতাব্দীর উঠোন ছুঁয়ে একবিংশ শতাব্দীর রোদ্দুর প্রবেশ করল রান্নাঘরে। অপেক্ষায় থাকলাম কিছুক্ষণ। দাম নিচ্ছে তো কাঁড়ি কাঁড়ি। এক প্লেট নশো টাকা। এদিকে জোমাটোতে দিচ্ছে দুজনের খাওয়া নাকি ৫০০ টাকায় হয়ে যায়। কে জানে কোন সমান্তরাল পৃথিবীতে এসে পড়েছি কি না। নিলাম সেই একই, ধনশক, সালি চিকেন, মাটন কাবাব, ক্যারামেল পুলাউ আর পাটরা নি মচ্ছি। সেখানে বসে খেতে দেবে না, তা ডাব্বা ডুব্বা নিয়ে ইন্ডিয়া গেটে হাজির হয়ে যা বুঝলাম তা হল, ঝোলের একটা আইটেম তৈরী করা থাকে আর মাংস ফাংসগুলো সেদ্ধ করা থাকে। তারপর একটু নাড়াঘাঁটা করে দিয়ে দিয়েছে। এমন কি সালি চিকেনের আলুভাজাগুলোও আগরওয়াল সুইটস থেকে আনানো। লে হালুয়া। তবে পাটরা নি মচ্ছিটা ছিল দারুণ। (পাটরাণী মচ্ছি নয় কিন্তু!)
সে যাই হোক যা গুষ্টির তুষ্টিপুজো সব করে দিয়েছি জোমাটোতে আমরা আসুন পাটরা নি মচ্ছিটাকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখি। এ অনেকটা আমাদের ভেটকি পাতুরির মতো কেস। তবে কাঁচা আমের উপস্থিতি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
পমফ্রেট বা অন্য কাঁটা ছাড়া মাছের আধ ইঞ্চি পুরু আর তিন চার ইঞ্চি লম্বা চওড়া মাছের ফিলেকে নুন আর লেবুর রসে ম্যারিনেট করে রাখুন। একটা নারকেল গ্রেট করে তাতে কাঁচা লঙ্কা, ধনে পাতা পুদিনা পাতা, ধনে জিরে গুঁড়ো, লেবুর রস অথবা কাঁচা আম কোরা, একটু চিনি এবং নুন হলুদ দিয়ে একসঙ্গে গ্রাইন্ড করে ফেলুন। তারপর কলাপাতার মধ্যে তেল মাখিয়ে মাছের দু পিঠে তেল মাখিয়ে গ্রেট করা নারকেলের চাটনি মাখিয়ে কলাপাতা মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে ১৭৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে মিনিট পনেরো বেক করুন বা ডবল বয়লারে মিনিট কুড়ি স্টিম করে নিন। ব্যাস আপনার পাটরা নি মচ্ছি তৈরী। খুলে মাখনের মতো খুবলে খেয়ে ফেলুন।
আর অথেনটিকের গল্প যেটা সেটা ঠিক আমার নয়। আমার পিতৃদেবের। আশির দশকের তিন আম্পায়ার খুব বিখ্যাত ছিলেন। মনে করে দেখুন। মোটা মতো স্বরূপ কিষণ, আর দুজন চশমা পড়া রিপোর্টার এবং ধোতিওয়ালা (আসলে দোতিওয়ালা)। শেষোক্ত জনের থেকে নববর্ষের নিয়মিত কার্ড বাবা বহুদিন পেয়েছেন। সেই তাঁর বাড়ির রান্না বান্না অথেনটিক পার্সি রান্না।
একটা বেছে নিই। নাম তার বাটেরো। খেজুরের রসে মাংস রান্না। মাটনের রাণের মাংসের টুকরোয় একটা কাঁটা চামচ দিয়ে ভালো করে ফুটো ফুটো করে তাতে একটু ফার্মেন্টেড খেজুরের রস বা তাড়ি বা বিয়ার আর আদা রসুন বাটা জিরে লঙ্কা হলুদ আর গোল মরিচ গুঁড়ো দিয়ে দু তিন ঘন্টা ম্যারিনেট করে রাখুন। বা ফ্রিজে সারা রাত রেখে দিতে পারেন। এর পর একটা প্যানে ঘি গরম করে মাংস ভেজে নিন বাদামি হওয়া পর্যন্ত আগুন কমিয়ে একটু একটু করে তাড়ি বা বিয়ার দিয়ে ঢাকা দিয়ে ঢিমে আঁচে মাংস রেঁধে নিন। এরপর রোটলি বা পরোটা দিয়ে খেয়ে নিন।
এবারে আসুন আরেকটা বিশেষ রান্না দেখে নিই। পাটিও। পাটিও হল পার্সিদের যে কোন সি ফুড দিয়ে একটু টক একটু মিষ্টি একটু ঝাল রান্না। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এই রান্না হয়। আসুন একটা বিশেষ রেসিপি দেখে নিই। লগন নু পাটিও। প্রথমে চিংড়ি মাছকে নুন হলুদ লঙ্কা মাখিয়ে রাখুন। অপর দিকে তেঁতুল আর গুড় জলে ভিজিয়ে রাখুন। অন্য দিকে কাশ্মীরি লঙ্কা, টমাটো, আদা, রসুন, তিরিশ গ্রাম মতো কাজু, ধনে, জিরে এবং নারকেল কোরা একসঙ্গে গ্রাইণ্ড করে মিশ্রণ তৈরী করুন। এরপর একটি প্যানে তেল গরম করে তাতে মিশ্রণটি ঢেলে নাড়তে থাকুন যতক্ষণ না তেল ছাড়ে। আন্দাজমতো নুন হলুদ দিন। তেল ছাড়ার পর এতে তেঁতুল ও গুড়ের ক্বাথ দিন। দিয়ে ফুটতে শুরু করলে হাল্কা জল দিয়ে চিংড়ি মাছগুলি দিয়ে ঢিমে আঁচে ঢাকা দিয়ে রান্না করে ফেলুন। লগন নু পাটিও বা কলমি (চিংড়ি) নু পাটিও প্রস্তুত।
মাটন, চিকেন, মাছ এমনকি চিংড়িও হয়ে গেল। কিন্তু পার্সিদের প্রিয় ডিম কই? ডিম পার্সিদের স্টেপল ডায়েট। গল্প শুনেছিলাম মুম্বইয়ের এক পার্সির। সে সকাল সন্ধ্যা নরিমান পয়েন্ট থেকে গভর্মেন্ট হাউস পর্যন্ত প্রতিদিন সাঁতার কাটতো আর বারোটা ডিম খেত। একবার মহাবালশ্বর যাবার পথে কোন গাড়ি থেকে টিটকিরি দিচ্ছিল বলে নিজের গাড়িটাকে তাদের গাড়ির সামনে রেখে হেঁটে এসে স্রেফ কাঁধের জোরে একটা বড় স্টেশন ওয়াগনকে উলটে দিয়েছিল। এসব অবশ্য গল্পকথা হতে পারে। তবু পার্সিদের ইডা প্রীতি সন্দেহাতীত। তবে ডিমের সাধারণ রেসিপি ছেড়ে আমরা বরং কয়েকটি পানীয়ের দিকে চলে যাই। দুধ না পাফ বা ফেনা ওঠা দুধ। এটা রাতে তৈরী করে পরের দিন সকালে খেতে হয়। দু লিটার ফুলক্রিম দুধের সঙ্গে আড়াইশো গ্রাম চিনি মিশিয়ে ঘন করে তাকে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ভাল করে সেরামিকের পাত্রে ঢেলে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখুন। পরের দিন সকালে দেখবেন দুধের উপর ক্রিম তৈরী হয়ে গেছে। একই দিকে ক্রমাগত নাড়তে নাড়তে তাতে গোলাপ জল এবং জায়ফল গুঁড়ো দিন। এবারে অর্ধেক দুধ একটি ঠাণ্ডা পাত্রে নিয়ে খুব করে ফেটান। দেখবেন ফেনা তৈরী হবে। এবারে বাকি দুধ গ্লাসে ঢেলে তার উপরে ধীরে ধীরে এই ফেনা ঢালুন। ব্যাস দুধ না পাফ তৈরী। এর সঙ্গে ব্রেকফাস্টের জন্য আকুরি আর ব্রেড নিয়ে নিন। আকুরি আর কিছুই না, স্ক্র্যাম্বল্ড এগ। তা স্ক্র্যাম্বল্ড এগ তো সবই জানেন আমরা না হয় মেওয়া নি আকুরি তৈরী করি। অর্থাৎ ড্রাইফ্রুটস দিয়ে আকুরি। গিরি বাদাম ভেজে নিয়ে তেলে ডিম আর নুন দিয়ে নাড়তে থাকুন। প্রায় হয়ে এলে তাতে কিসমিস দিন এবং নামাবার আগে তাতে গিরি বাদাম দিন। সঙ্গে কাজু এবং চিরঞ্জিও দিতে পারেন। মনে রাখবেন ডিম আগুন থেকে সরিয়ে নেবার পরেও রান্না হয়। তাই ঝুরো ঝুরো হয়ে যাতে না যায় তাই পুরোটা শুকিয়ে যাবার আগেই নামিয়ে নিন। এর সঙ্গে পরিবেশন করুন পাও বা বিশেষ ধরণের হাতে গড়া পাঁউরুটি।
ডিম নিয়েই যখন কথা হচ্ছে তখন এগ ফ্লিপটাও দেখে নিই। এটা কিন্তু পানীয়। প্রথমে ডিমের কুসুম এবং ক্যাস্টর সুগার একসঙ্গে ফেটাতে থাকুন এবং ধীরে ধীরে তাতে দুধ দিন ভ্যানিলা এসেন্স দিন। এর পর আলাদা করে ডিমের সাদা অংশ খুব জোরে ফেটাতে থাকুন যতক্ষণ না পর্যন্ত শক্ত হয়ে যায়। এবারে পূর্বের মিশ্রণটির সঙ্গে ধীরে ধীরে ঢেলে দিন। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পরিবেশন করুন এগ ফ্লিপ। এছাড়া প্ররসিদের প্রিয় ড্রিঙ্ক হল কাঞ্জি। তরমুজের বীজ এবং গিরি বাদাম গুঁড়ো করে তার সঙ্গে সুজি বা পানিফলের আটা মিশিয়ে দুধ ও চিনির সঙ্গে মিশিয়ে তারা খায় সুজি নু কাঞ্জি বা শিঙ্গারা নু কাঞ্জি। আর সিদ্ধ কাঁচা আমের সরবত হল বাফলু।
পার্সি রেসিপি সফরের শেষপ্রান্তে প্রায় এসে পৌঁছেছি। এবারে আমরা পার্সিদের আদিতম রান্না পুলাউ বা পিলাফে যাব। মুম্বইয়ের বিখ্যাত ব্রিটানিয়া রেস্তোরাঁর বেরি পুলাও যারা একবার না চেখেছে তাদের বলে বোঝানো সম্ভব হয় না এর স্বাদ। তবে এর জন্য যে বেরি জাতীয় ফলটির দরকার হয় সেই জেরেস্ক কিন্তু একেবারেই ইরানী সম্পত্তি। তার বদলে শুকনো ক্র্যানবেরি দিয়ে করা যেতে পারে বটে তবে টক টক ভাবটার বদলে মিষ্টি কিছু এসে হাজির হবে আপনার প্লেটে। তবু আমরা জেরেস্ক ধরেই করছি। পার্সি বা ইরানি পুলাউ বা পিলাফের জন্য আপনাকে কাবাব বানাতে হবে। মাটনের কিমা, আদা রসুন পেঁয়াজ, হলুদ লঙ্কা ধনে জিরে গুঁড়ো, গরম মশলা গুঁড়ো, ধনেপাতা পুদিনাপাতা কুচি এবং আটা ব্রেডের স্লাইস। সবগুলিকে একসঙ্গে মিশিয়ে ডিমে ফেটিয়ে তাতে মাখিয়ে ঘন্টা খানেক রেখে দিন ম্যারিনেট হতে। এরপর ডুবো তেলে ছোট ছোট গুলি বানিয়ে ভেজে তুলে নিন বাদামি করে।
মাটনের টুকরোকে আদা রসুন ধনে জিরে নুন হলুদ লঙ্কা মাখিয়ে ম্যারিনেট করুন। পেঁয়াজ ভেজে তুলে নিন। এরপর তেলে গোটা গরম মশলা দিন। এরপর ম্যারিনেট করা মাংসের টুকরো এবং টম্যাটোর টুকরো দিন। ভাল করে কষতে থাকুন। প্রয়োজনে পরিমানমত জল দিন। সিদ্ধ প্রায় হয়ে এলে ধীরে ধীরে পেঁয়াজ ভাজা দিতে থাকুন। ঢাকা দিয়ে দিয়ে রান্না করে ফেলুন যাতে গ্রেভি প্রায় শুকিয়ে যায়। প্রেশারে সিদ্ধ করলে সময় বাঁচে কিন্তু স্বাদের সঙ্গে কোথাও যেন একটু বেইমানি হয়ে যায়।
পুলাউএর জন্য নোনতা জল ফুটিয়ে তাতে ভিজিয়ে রাখা চাল দিন। প্রায় রান্না হয়ে এলে নামিয়ে নিন। পেঁয়াজ ভেজে নিন। বেরিগুলি ভিজিয়ে নিন। এরপর ঠিক বিরিয়ানির মত করে প্রথমে তেল তার উপর চাল তার পর মাংস, গ্রেভি, বেরি এবং পেঁয়াজ দিয়ে স্তর তৈরী করতে থাকুন। এইভাবে বিরিয়ানির মতো দম দিয়ে তারপর ভাল করে ঝাঁকিয়ে মিশিয়ে নিন এবং গরম গরম পরিবেশন করুন।
বেরি পুলাও তৈরী। এবারে যদি বেরি না পান কি করবেন? ক্র্যানবেরি দিয়ে চেষ্টা করতে পারেন। অথবা বেরি ছাড়াই পার্সি পুলাউ তৈরী করুন। সঙ্গ দানের জন্য পার্সি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন মাছ বা মাংসের পদ তো রইলই।
আর শেষ পাতে মিষ্টি? আসুন ফালুদা দিয়ে আজকের রান্না শেষ করি। এক কাপ জল গরম করে কর্ণফ্লাওয়ার দিয়ে গাঢ় করুন। এরপর ফুটো ফুটো ঝাঁঝরি বা কলন্দরের মধ্যে দিয়ে একটা ঠাণ্ডা জল এবং বরফ সম্বলিত পাত্রে ধীরে ধীরে মিশ্রণটি চালাতে থাকুন। সেমাই তৈরী। এরপর দুধ গাড় করে ঠাণ্ডা করে তাতে তাতে ক্রিম, কন্ডেন্সড মিল, ড্রাই ফ্রুটের টুকরো, গোলাপ জল এবং চিনি মেশান। ঠাণ্ডা দুধের মিশ্রনটি গ্লাসের মধ্যে সেমাই দিয়ে ঢালুন এর উপর একটা কুলফি বা আইসক্রিম দিয়ে পরিবেশন করুন।
আর সঙ্গে একটা মুরাম্বা বা মোরব্বা হবে না? বেলের মুরাম্বার জন্য পাকা বেল নিন। হাতে তেল মাখিয়ে বেল ফাটিয়ে ভিতর থেকে বীজ এবং ফলের তন্তু সরিয়ে বাকি অংশকে ছোট ছোট টুকরো করুন। আধ লিটার জলে লেবুর রস এবং আড়াই কিলো চিনি দিয়ে এক তারের চিনির রস বানিয়ে তাতে বেলের টুকরোগুলো দিয়ে ফোটাতে থাকুন রস ঘন হওয়া পর্যন্ত। এরপর এক চিমটে নুন দিয়ে ফলগুলিকে সিরাপ থেকে সরিয়ে সিরাপে এলাচগুঁড়ো দিন। ধীরে ধীরে রস ঘন হয়ে এলে ফলগুলি আবার দিন এবং ঠাণ্ডা করে বোতলে ভরে রাখুন।
এতক্ষণ রসনার তৃপ্তি হল খুব। এবারে কিছু সিরিয়াস কথাবার্তা। গত ২০১৫র হিসাবে ভারতে পার্সিদের সংখ্যা মাত্র ৬৯০০০। এবং প্রতি দশ বছরে প্রায় ১২% করে জনসংখ্যা কমছে। পার্সিরা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন জনজাতি তাদের সংস্কৃতি, তাদের আচার ব্যবহার, উৎসব ইত্যাদি প্রাচীন পৃথিবীর একটা অংশকে বহন করে চলে আসছে। জানি না কি ভাবে এই জনজাতির মিলিয়ে যাওয়া আটকানো সম্ভব। ইতিহাসের একটা অংশ যদি আমার জীবদ্দশাতেই ডোডো পাখিতে রূপান্তরিত হয় তাহলে বসে বসে দেখা ছাড়া সত্যিই কি কিছু করার আছে? উত্তরটা বোধহয় কারুরই জানা নেই।
লেখক পরিচিতি: লেখক ভারত সরকারের আধিকারিক। অধুনা দিল্লিবাসী এবং নিয়মিত বাংলা ব্লগার। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে ফিসফাস কিচেন-১ ইতিমধ্যেই সৃষ্টিসুখ থেকে গত বইমেলায় প্রকাশিত। এটি দ্বিতীয় মরশুম। এছাড়াও লেখকের আরও তিনটি গদ্য-গল্পের বই রয়েছে।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.