অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিশেষ গান সংখ্যা

বিশেষ গান সংখ্যা - ত্রিশে সেপ্টেম্বর, ২০১৮

 

'উদাসী হাওয়া'য় ঝরা “মুকুল”

ভাস্কর বসু



১৯৬২ সাল। তখনো 'যাত্রিক' নামেই ছবি করেন তরুণ মজুমদার। মনোজ বসুর 'আঙটি চাটুজ্যের ভাই' গল্প অবলম্বনে তিনি শুরু করবেন পলাতক ছবির কাজ। কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছেন এক ভবঘুরে গায়ক যাকে ঘর আটকাতে পারে না। প্রাণের টানে সে ঘুরে চলে সারা বাংলার গ্রামে গ্রামে। এই ছবিতেও সুর করার জন্য তিনি ডাকলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। গল্প শুনে হেমন্ত বললেন, “এ তো সবই লোকসঙ্গীত, আমি এ বিষয়ে একটু মাটো আছি।” তরুণবাবু নাছোড়বান্দা, তিনি হেমন্তকেই চান সঙ্গীত পরিচালক রূপে। তখন হেমন্ত বললেন এক নতুন গীতিকারের কথা। তাঁর কাছে আসে গান লিখে নিয়ে। তাঁর লেখা গান খুব পছন্দ হেমন্তর। তরুণবাবুর আপত্তি নেই, বরং তিনি খুশী হলেন। আর গানে সুর করা শুরু হবে যখন, তখন ঘাড়ের ব্যথায় হেমন্তবাবু ভরতি হলেন বম্বের নর্থকোট হসপিটালে।

সেই অবস্থাতেই এক আজব কাণ্ড চলল হাসপাতালে। গীতিকার তাঁর লিরিক লিখে লিখে পাতা দিচ্ছেন হেমন্তকে আর সুরকার ওই শোওয়া অবস্থায় একটু ভেবে নিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সুর করে যাচ্ছেন কথায়। আর সেভাবেই ফলতে লাগল –

'জীবনপুরের পথিক রে ভাই / কোনও দেশে সাকিন নাই / কোথাও আমার মনের খবর পেলাম না'

- এবং অন্য সব চিরমধুর গীতাঞ্জলি।

পলাতক ছবি (১)

নাম ভূমিকাতে – অনুপকুমার (২)

সেই বছরেই (১৯৬২) প্রথম পুজোর গানেও মাতিয়ে দিলেন সেই গীতিকার আর হেমন্তর জুটি। দুটি গান ছিল – ১) তারপর? তার আর পর নেই ২) তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এল

'তারপর?' এই মহিলা কণ্ঠ চাঁদ ওসমানির যিনি ছিলেন ঐ গীতিকারের স্ত্রী। তারপরেই শুরু হল হেমন্তর গলাতে –

তার আর পর নেই নেই কোন ঠিকানা / যা কিছু গিয়েছে থেমে যাক থেমে যাক না।।

গানের পরের পংক্তিতে আছে এক অদ্ভুত ঔদাসীন্য – নিরাসক্তিও বলা চলে,

যা কিছু পেয়েছি কাছে তাই-ই সঞ্চয় / যা কিছু পেলাম নাকো সে আমার নয়।
পাহাড় নিষেধগুলো পেরিয়ে দেখি / কি আছে আমার পথে পড়ে।।

এক অনবদ্য প্রয়োগ! সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন বাধার পাহারা দেওয়ার কথা – 'নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে ঢেকে'! মুকুল সেই বাধার উচ্চতার কথা বললেন – 'পাহাড় নিষেধগুলো'! তাকে পেরোতে লাগে অদম্য শক্তি, কিন্তু এখানে যেন প্রায় রূপকথার ভঙ্গি – এত সহজেই পেরিয়ে এলাম –'দেখি কি আছে আমার পথে পড়ে!' এই গানে তো সেই রূপকথাই বলা হচ্ছে, থেমে গেলেই প্রশ্ন আসছে – 'তারপর?” বলা আছে আপন খুশির কথা, তৃপ্তির কথা-

“যা কিছু পেয়েছি কাছে তাই-ই সঞ্চয়,
যা কিছু পেলাম নাকো সে আমার নয়।”

অপর পিঠের গানটি একেবারে অন্যরকম। তাক লাগিয়ে দিল সকলকে – সেটি হল,

“তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো
তুমি এলে অনেক কথা এলোমেলো মনে হলো!”

কথায়, সুরে, গানে বৃষ্টির আলংকারিক রূপটি খুব সুন্দর প্রতিভাত।

"তোমার সময় থেকে কিছু সময় আমায় দিয়ো ঋণ!" বৃষ্টি মানেই আলসেমি, ক্ষণিক কর্মবিরতি! 'আমার অনেক কাজের মাঝে যেন হঠাৎ ছুটি হলো'! আমরা আজকের মানুষেরা বলেই থাকি না–'You came and made my day"!

তার কাব্যসুষমামণ্ডিত বাংলা অনুবাদ কি হতে পারে, তাই জানা যাচ্ছে-

দিন যে আমার আজকে হলো দিন
একটু বসো কাছে আমার
অনেক কথা আছে
তোমার সময় থেকে কিছু
সময় আমায় দিয়ো ঋণ!

বাঃ কি দারুণ কথা। সময়ের ঋণ – আজকের কর্মব্যস্ত, ঋণপূর্ণ যুগে যেন আরো বেশী করে প্রাসঙ্গিক। গীতিকার শৈলেন্দ্রও লিখেছিলেন, 'কিসিকা দর্দ মিল সকে তো লে উধার / জিনা ইসিকা নাম হ্যয়'! কি এক অদ্ভুত আনন্দ, এক শিহরণ- সে যেন হঠাৎ পাওয়ার আনন্দ –

মুকুল দত্ত ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (৩)

হঠাৎ কখন আমার আঁধার রাত্রি হয়ে গেছে /
আমি বুঝতে পারিনি যে /
আমি বলতে জানিনা যে/
আমার অনেক কাজের মাঝে যেন হঠাৎ ছুটি হলো।
তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো
তুমি এলে অনেক কথা এলোমেলো মনে হলো"!!

শুনেই ফেলা যাক –

'এলোমেলো' শব্দটিও দুর্দান্ত – 'প্রত্যহ বয় প্রাঙ্গণময় বনের বাতাস এলোমেলো / সে কি এলো। সে কি এলো!'

অসাধারণ, অনুপম এই গানের কথা। আর তার সঙ্গে হেমন্তর সেই গলা আর নচিকেতা ঘোষের সুর –শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে নিল। অর্থাৎ ১৯৬৩ তে 'পলাতক' মুক্তির ঠিক আগের পুজোতেই কিন্তু বাংলার শ্রোতাদের কাছের মানুষ হয়ে গেলেন মুকুল দত্ত।

আমাদের ভুললে চলবে না, এর আগের বছর (১৯৬১) অবধি পুজোতে মাত করতেন সলিল–হেমন্ত জুটি। সে বছরেই তাঁদের জুটির অনবদ্য গান দুটি ছিল একেবারে কালজয়ী – আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আর মনের জানালা ধরে। অর্থাৎ মুকুলকে মনে রাখতে হয়েছিল তিনি কোন শূন্য আসন পূর্ণ করতে চলেছেন, কিরকম প্রত্যাশা থাকে বাঙালী শ্রোতার হেমন্তর কাছ থেকে। একথা অনস্বীকার্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এবং 'পুরুষস্য ভাগ্যং'!! সাংঘাতিক সাফল্য লাভ করেছিলেন। ১৯৬৩ সালের --মাসে মুক্তি পেল 'পলাতক'। অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করল। আর বাঙালীর মনে গীতিকার – মুকুল দত্ত এক চিরকালীন আসনের দাবীদার হয়ে রইলেন।

তারপরই শুরু হল বাংলা গানে তাঁর নিয়মিত পথচলা। তবে তাঁর গান কিন্তু জনপ্রিয় হলেও মোটামুটি ভাবে সীমিত রইল দুই কন্ঠশিল্পী ও সুরকারের মধ্যে – তাঁর আবিষ্কর্তা হেমন্ত আর কিশোরকুমার। পরবর্তী কালে অন্য শিল্পীরাও গান করেছেন তাঁর লেখাতে, কিন্তু কিশোর বা হেমন্তর স্থান যে আলাদা, সেটা অনস্বীকার্য।

'পলাতক' এর গান এক নতুন আঙ্গিক নিয়ে এসেছিল বাংলা গানে। এই ছবিতে নায়ক ছিলেন অনুপকুমার। তখনকার দিনে নায়করূপে মধ্যগগনে উত্তমকুমার, পাশেই রয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়। অন্য ধরনের ছবিতে বসন্ত চৌধুরী, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখরা। অনুপকুমার তখন খ্যাত কমিক অভিনেতা বা বড়জোর চরিত্র অভিনেতা হিসেবেই। সেই ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন পরিচালক, দর্শকরাও তাঁকে বঞ্চিত করেননি।

'পলাতক' এর জীবনের মর্ম ধরা ছিল যে গানটিতে সেটি হলঃ

“জীবনপুরের পথিক রে ভাই
কোন দেশে সাকিন নাই
কোথাও আমার মনের খবর পেলাম না।”

'সাকিন' শব্দের প্রয়োগ এখানে মোক্ষম। শব্দটির অর্থ - নিবাস, বাসস্থান, ঠিকানা। এই গানের প্রথম দুটি লাইন মনোজ বসুর 'আংটি চাটুজ্যের ভাই' তে ছিল। অর্থাৎ লেখক তাঁর গল্পেই চরিত্রের আভাষ দিয়েছেন। এটি এমন একটি শব্দ যার উৎস হল আরবী ভাষা। যে ভাষায় কথা বলে বেদুইনরা আর তাদের পায়ের তলাতে সর্ষে। বিংশ শতকে না হলেও উনবিংশ শতকে এই শব্দের প্রচলন ছিল, সাহিত্যেও। এছাড়া দলিল, দস্তাবেজেও এটি বহুল ব্যবহৃত। মুকুল এই শব্দটিতে জেনে গেলেন গল্পকার কি বলতে চাইছেন। কোন অপরাধী যখন এজাহার (Statement) দিতেন পুলিশের কাছে বা আদালতে, সেখান সাকিন কথাটির খুব প্রয়োগ থাকতো। এখানে হয়তো গল্পকার সেভাবেই শব্দটিকে ভেবেছিলেন। আর তদনুযায়ী সাজালেন গানের বাকি অংশ। ছবির শুরুতেই যেন বসন্ত নিজের অপরাধের কথা দর্শকরূপী আদালতের কাছে কবুল করে নিচ্ছে।

তরুণ মজুমদার (৪)

খেয়াল পোকা যখন আমার মাথায় নড়ে চড়ে
আমার তাসের ঘরের বসতি রে
অমনি ভেঙ্গে পড়ে।
তখন তালুক ছেড়ে মুলুক ফেলে হইরে ঘরের বার আমি,
কোথাও আমার মনের খবর পেলাম না।

অন্য একটি গানে আবার দেখালেন আশ্চর্য সাধু-চলিতের প্রয়োগ –

'চিনিতে পারিনি বঁধু, তোমার এই আঙিনা, তাই দেরী হল যে দেরী হল যে তোমার কাছে আসিতে'

এ যেন অনেকটা দ্বিজু বাবুর মত প্রয়োগ – 'মলয় আসিয়া কয়ে গেছে কানে, প্রিয়তম তুমি আসিবে'

আবার ধরা যাক, এজাহারের অন্য অংশ, যেখানে 'পলাতক' নির্দ্বিধায় নিজেকে 'নিরপরাধ', 'মুক্ত মানুষ' বলছে, - বলছে অদৃষ্টের কথা – 'নিয়তি কেন বাধ্যতে'?

“দোষ দিও না আমায় বন্ধু / আমার কোন যে দোষ নাই
কার কাছে রাখিলাম এ মন / কার কাছে যে চাই।

এখানে আবার 'রাখিলাম' 'নাই' কিন্তু 'চাই' বা 'ঘুরলাম'। সাধু-চলিতের এই অনবদ্য মিশ্রণ কিন্তু বুঝিয়ে দেয় তুলনামূলক ক্রিয়াপদের গুরুত্ব।

শহর গঞ্জ দোকান পাতি / খুঁজে খুঁজে মরি
হাটে বাটে ঘুরলাম কত / এখন ঘরে ফিরি (বন্ধু)
এই দোকানদারি বেচাকেনায় / কোন যে দাম নাই (আমার)!”

সে মানুষটি অবহেলা করেছে তার পরিবারকে, তার প্রতি আমাদের যেন উপচে পড়ে সহানুভূতি। অসামাজিক, অনিকেত, লাগামছাড়া এই শিল্পী মানুষ আমাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে যে অনেকগুলি কারণ তার একটি অবশ্যই মুকুলের গীতিকাব্য।

আবার আমরা ধরতে পারি 'অদ্বিতীয়া' (১৯৬৮) ও 'মন নিয়ে' (১৯৬৯) ছবির দুটি গান, দুটি গানে মিলে মিশে আছে বিদায়ের সুর আবার আশার আলো। প্রথমটিতে তিনি হাসিমুখে বিদায় দেওয়ার কথা বলছেন। রবিঠাকুর 'বিদায়ের এ পাত্রখানি' কে 'স্মৃতিসুধায়' ভরে রাখার কথা বলেন। নজরুল আবার বলেন, “মোছ আঁখি দুয়ার খোল দাও বিদায়”। আর মুকুলের একটাই অনুরোধ, আমরা 'যাই' বলি না, বলি 'আসি' কারণ আমাদের সংস্কারে পিছু ডাকলে যে যাত্রা শুভ হয়না – তাই,-

যাবার বেলায় পিছু থেকে ডাক দিয়ে
কেন বল কাঁদালে আমায়/
আমার এ মন বুঝি মন নয়।।
যাবার বেলায়...................

কি সুন্দর কাটল দিনগুলি, 'থাক' না 'স্মৃতিটুকু'। 'প্রহর' শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও 'মধুর তোমার শেষ' না হয় নাই হল।

হাসি আর গানে গানে এতদিন
ফুল ফোটানোর খেলা চলেছিলো
যে কাঁটা রয়েছে বিধে মরমের মাঝে
তার কথা মন ভুলেছিলো,
ব্যথায় ব্যথায় তাকে মনে পড়ে যায়
যাবার বেলায়.......

সিনেমার গান হলেও তার কিন্তু একটি সার্বজনীন আবেদন থাকে। আমরা জীবনের সঙ্গে মিলিয়েও দেখে নিয়ে পারি, যখন মিলনমেলাতে আমরা মাতি – 'হাসি আর গানে গানে এতোদিন' – কি অপূর্ব সেই জীবন! কর্তব্য, রোজকার ছন্দহীন বা গতানুগতিক জীবনের 'যে কাঁটা রয়েছে বিধে মরমের মাঝে / তার কথা মন ভুলেছিলো'– পিছুডাকের 'ব্যাথায় ব্যাথায় তাকে মনে পড়ে যায়'! আমরা ভাবি গান শুধু শোনার, কিন্তু তাকে অনুধাবন করলে তা যে আমাদের জীবনে সে এক অন্য মাত্রা আনতে পারে, সে কথা অনস্বীকার্য।

দ্বিতীয়টিতে – আশার মধ্যেও কি এক অজানা আশঙ্কার হাতছানি – গভীর দুঃখের রাত্রিরও শেষ হবে –

একদিন মাঝরাতে রাতটাও ফুরিয়ে যাবে
খুশীর বন্যা এসে ভাসাবে আমায়
আলোর জোনাকী জ্বেলে জ্বেলে
স্বর্গ আমার সাজাতে সাজাতে রাত পার হয়ে যাব।

রাত – প্রথমে আক্ষরিক, পরেই আলঙ্কারিক। এত বড় আশার কথা, কি অনমনীয় প্রত্যয় – কিন্তু আশঙ্কাও আছে,

তবু কেন মন উদাস হল

এই যে খুব সহজ ভাষাতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বর বা আশা-নিরাশার আলোছায়া সৃষ্টি – এটা মুকুলের গীতিকাব্যের এক বড় বৈশিষ্ট্য।

বাংলা গীতিকারদের কাছে এক দারুণ সমস্যা রবিঠাকুর। তাঁর গানগুলি এমনই উচ্চ পর্যায়ের যে বাঙালী গীতিকারদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু তাঁকে অনুপ্রেরণা হিসেবে ধরে নিয়ে বাঙালী গীতিকাররা চমৎকার কাজ করেছেন। মুকুল এঁদের অন্যতম।

কিশোরকুমার এর গলায় একটি পুজোর গান (১৯৭৫) খুব জনপ্রিয়। গানটির আবার ঐতিহাসিক মূল্যও আছে, কারণ এর সুরকার স্বর্ণকন্ঠী গানের জগতের সম্রাজ্ঞী, লতা মঙ্গেশকর। কতিপয় গানেই তিনি সুর করেছেন। গানটি হল- “তারে আমি চোখে দেখিনি / তার অনেক গল্প শুনেছি / গল্প শুনে তারে আমি / অল্প অল্প ভালো বেসেছি”

এর মূল ভাবটি যে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ছিল, তা হল,– “এখনো তারে চোখে দেখি নি, শুধু বাঁশি শুনেছি / মন প্রাণ যাহা ছিল দিয়ে ফেলেছি"।

কিশোরকুমার (৫)

কিন্তু অনুপ্রাণিত হলেও আঙ্গিকটি একেবারেই রাবীন্দ্রিক নয়, বরং অনেকটা লোকগীতির আদল। সেখানেও এই সাধু – চলিতের অপূর্ব মিশ্রণ আছে –

আসতে যেতে ছলকিয়া যায় রে যৌবন।
বলতে পারে না তার ও বিবশ মন
ভালবাসার ভাল কথা শুনে নাকি
শিহরিয়া যায় শুনেছি।।

আবার সেই ক্রিয়াপদের তারতম্য। উপরের পংক্তিটিতে গীতিকার বোঝাতে চাইছেন, অন্যান্য শব্দগুলির তুলনাতে 'ছলকিয়া' আর 'শিহরিয়া' বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

আবার 'অনিন্দিতা' (১৯৭২) ছবিতে হেমন্তর সুরে কিশোরকন্ঠে আরো একটি অতি বিখ্যাত গান হল –

“ওগো নিরুপমা, করিও ক্ষমা, / তোমাকে আমার ঘরণী করিতে
আমার মনের দোসর করিতে / পারিলাম না/ পারিলাম না কিছুতেই

এখানেও গীতিকারের অনুপ্রেরণা ছিল রবীন্দ্রনাথের “অবিনয়” কবিতাটি – যেখানে বলা হয়েছে-

হে নিরুপমা, গানে যদি লাগে বিহ্বল তান
করিয়ো ক্ষমা ॥ --
হে নিরুপমা, চপলতা আজি যদি ঘটে তবে
করিয়ো ক্ষমা।

নিঃসন্দেহে ক্ষমা চাইবার কারণ দুটি একেবারেই ভিন্ন, তবুও এই আধুনিক গানটির পিছনে রবিবাবুর একটু 'হাত' আছে মানতে হয়। নিদেনপক্ষে অন্ত্যমিল আর 'করিও' শব্দের প্রয়োগের জন্য হলেও। পরে আবার দেখবো আঙ্গিকটি পালটে একেবারে আটপৌরে হয়ে গেছে –

লতার মত জড়িয়ে রয়েছ গাছে
বুঝি ফুল ফুটবার সময় এসেছে কাছে
এমন মধুর ভঙ্গিমা আমি কোনোদিন
ভুলবোনা যেন কিছুতেই, ওগো নিরুপমা।।

শেষের কবিতার নায়িকা শেষ চিঠিতে লিখেছিল – 'ফিরিবার পথ নাহি, দূর হতে যদি দেখ চাহি, পারিবে না চিনিতে আমায়, হে বন্ধু বিদায়”, সেভাবেই মুকুলের গানের নায়িকা আঁধারেতে হারিয়ে গিয়ে থাকবেন, তাঁর না আসার কারণ অজানা, কিন্তু 'সে তো এলো না”!

"চোখের দুয়ার থেকে মনের আঙিনা বল কত দূর,
যে যায় সে যায়, ফিরিবার পথ নাই - একি দূর, বহুদূর"

বাংলা গানের এক প্রবাদপ্রতিম স্থপতি কবীর সুমন তাঁর একটি প্রবন্ধে বলেছেন – 'মোহিনী চৌধুরী, মুকুল দত্ত, অমিয় দাশগুপ্ত, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মতো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রবীন্দ্রনাথের আমল থেকে দীর্ঘকাল আধুনিক বাংলা গানে ক্রিয়াপদের সাধু ও চলিত রূপের যে নিরঙ্কুশ ও নিরুদ্বিগ্ন সহাবস্থান দেখা গিয়েছে তা আমাকে অন্তত মানসিক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিল আমার যৌবন থেকেই'। মুকুল দত্তের গানে দেখলাম তাঁর কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। 'আমি পাগল হইয়া বনে বনে হইলাম পরবাসী / আমি দেখতে ভালবাসি' – এই গানও মুকুলেরই রচনা। এমনকি পরবর্তী কালে সুমন হয়তো এই 'মানসিক ঝামেলায়' র হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁর গীত বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতটি যখন শুনি –

“দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে॥ শুভক্ষণে কাছে ডাকিলে,. লজ্জা আমার ঢাকিলে গো,. তোমারে সহজে পেরেছি বুঝিতে!” তখন আমরাও কোনরকম ঝামেলার স্পর্শ পাই না, সৌভাগ্যক্রমে সম্ভবত তিনি উত্তরও পেয়ে গেছেন 'খুঁজিতে খুঁজিতে'!

বাংলা গানের আরেক গবেষক সলিল চৌধুরীর গানে এই সাধু-চলিতের প্রয়োগ নিয়ে কি বলছেন দেখা যাক। উদ্দিষ্ট গানটি – 'দূর নয় বেশী দূর ঐ সাজানো সাজানো বকুল বনের ধারে' !! সদ্য প্রয়াত অরুণ কুমার বসু ('ভাস্কর বসু' ছদ্মনামের গীতিকার) লিখেছেন -

সলিল চৌধুরী (৬)

'সাধু ক্রিয়াপদের ব্যবহার, সজনী জাতীয় শব্দ ব্যবহার সলিল চৌধুরীর গানের বহু ব্যবহৃত মুদ্রাদোষ। এই সাধু ক্রিয়াপদ কিন্তু গানের ভাষাকে ভঙ্গিতে একটি কৃত্রিম প্রাচীনত্বের মাধুর্য সৃষ্টি করেছে। যেন সোনাই-মাধব, মাধব মালঞ্চী কন্যার মত কোনও ব্যালাডের নায়ক জলের ঘাটে তার হারানো প্রিয়ার জন্য হাহুতাশ জানিয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে 'যাক যা গেছে তা যাক' – কঠিন বর্তমানে হাজির করে এই রোমান্টিক স্বপ্নালুতাকে। এই বৈপরীত্যের আধুনিকতা গানটিকে একটি ভাবীকালের আধুনিক গানে পরিণত করে। এ গান সলিলের গীতিকার প্রতিভার উচ্চাঙ্গের সৃষ্টি।”

'বৈপরীত্যের আধুনিকতা' – এই শব্দবন্ধটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সাধু-চলিত নয়, তৎসম – তদ্ভব – দেশি শব্দের মিশ্র প্রয়োগও এই বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। তাঁর জনপ্রিয় গানে রবীন্দ্রনাথ 'দিবসরজনী' বা 'তেয়াগে কায়'র মত শব্দর সাথে সহাবস্থান ঘটালেন 'ভালবাসা কারে কয়' এর মত একেবারে গ্রাম্য উক্তির। সম্ভবত এ এক অমোঘ প্রয়োগ – ভালবাসার সর্বগামিতাকে ফুটিয়ে তুলতে।

তাঁর জীবনের দুই প্রাণপুরুষ কিশোরকুমার ও হেমন্ত। 'একটুকু ছোঁয়া লাগে' (১৯৬৪) বলে একটি সিনেমাতে দুই বন্ধুর ভূমিকাতে ছিলেন কিশোরকুমার ও বিশ্বজিৎ। কিশোরের গলায় গান গেয়েছিলেন তিনি নিজেই – বিশ্বজিৎ এর গলাতে হেমন্ত। বেশীরভাগ গানগুলিই ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত – 'একটুকু ছোঁয়া লাগে', 'প্রাঙ্গণে মোর শিরিষ শাখায়', 'মনে কি দ্বিধা' – ইত্যাদি। দুই বন্ধুর সমবেত কণ্ঠে ছিল একটিই গান, বন্ধুত্বের অঙ্গীকারকে স্বীকার করে নিয়ে, তার সুরকার হেমন্ত, গীতিকার মুকুল দত্ত -

দুস্তর পারাবার পেরিয়ে (৭)

- “দুস্তর পারাবার পেরিয়ে চঞ্চল মন চলে যায় / বন্ধুর পথে আছে বন্ধু, মিশে গেছে জানা অজানায় —”

গানের শুরুতেই নজরুল রয়ে গেলেন, ছোট্ট একটি অনুপ্রাস (বন্ধুর পথে আছে বন্ধু) দিয়ে চমৎকার সাজালেন গানটিকে মুকুল। একটা কথা স্বীকার করতে হবে, যখন কোন গীতিকার খুব জনপ্রিয় শব্দবন্ধ দিয়ে গান শুরু করেন, তিনি ঝুঁকি নেন। তাঁর গানটি মৌলিক নয়, শ্রোতার এ আশঙ্কা থাকতেই পারে। কিন্তু গীতিকার খুব আত্মপ্রত্যয়ী। তিনি ভাবেন অচিরেই শ্রোতার সে ভাবনা ঘুচিয়ে দেবেন।

ঠিক এই আত্মবিশ্বাসেই তাঁর 'আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন' গানে সলিল ব্যবহার করেছেন 'পৃথিবী আমারে চায়' এর মত এক জনপ্রিয় শব্দবন্ধ।

১৯৭৩ সালে পুজোর কিশোরের দুটি গান নিজের সুরে মুকুলের কথাতে জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়েছিল, একটি প্রায় ভাটিয়ালি পল্লীগীতির আদলে – 'এই যে নদী / যায় সাগরে'। সেখানে তিনি লেখেন,

“কেউ যায়রে বন্ধুর বাড়ি / নাও বাইয়া উজানে
কেউ শাঁখা ভাইঙা সিঁদুর / ধুইয়া ফিরে ভাটির টানে
কারো আশার তরী বন্ধু / পায় নারে কিনারা
ভালোবাসা মরণ হইয়া / কারে করে ইশারা”

এই গানে খুব দার্শনিক ভাবে নদীর নীরব সাক্ষী থাকার কথা (নদী কথা বলে না) লিখলেন। 'উজান' ও 'ভাটি' – কি সুন্দর প্রয়োগ! একজন চলে গেল (বন্ধুর বাড়ি / নাও বাইয়া উজানে) আর অন্যজন - (কেউ শাঁখা ভাইঙা সিঁদুর / ধুইয়া ফিরে ভাটির টানে) ফিরে এল। 'মৃত্যু'কে এরকম দার্শনিক রূপ দেওয়া হল অথচ একেবারে মাটির ভাষায়। বেশ ইঙ্গিতময়, 'বন্ধু' কি তিনি যিনি 'জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে' দাঁড়িয়ে আছেন? হতেই পারে, নদী হয়তো এখানে জীবননদী। তাই আরো তাৎপর্যপূর্ণ – 'ভালোবাসা মরণ হইয়া / কারে করে ইশারা'!

পরবর্তী কালেও আমরা দেখলাম, গীতিকারের আপশোষ নদীর নিঃশব্দ, নীরবতা নিয়ে –

বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের- হাহাকার শুনেও,
নিঃশব্দে নীরবে- ও গঙ্গা তুমি- গঙ্গা বইছ কেন?

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণাতে (কথায় কথায় রাত হয়ে যায়) তে একটি সুন্দর ঘটনার কথা লিখেছেন। তরুণ মজুমদার তাঁর ফুলেশ্বরী ছবিটিতে পুলক এবং মুকুল দুজনকে দিয়েই গান লিখিয়েছেন। তরুণ নিজেও গান লিখেছিলেন – 'শুন শুন মহাশয়'! একটি গান মুকুল দত্ত লিখলেও তরুণবাবু চাইছিলেন পুলক সেটিকে অন্যভাবে লিখুন। কারণ গানটি সুন্দর হলেও তাঁর ছবির সঙ্গে মানানসই হচ্ছে না। পুলক প্রথমে খুব আপত্তি করলেন। তরুণবাবু বললেন দৃঢ়ভাবে, -'না, না আপনি দ্বিধা করবেন না। উনি খুবই উদারচেতা মানুষ। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলে নেব।” লিখলেন পুলক, কিন্তু আটকে গেলেন একটি লাইনে – 'অনেক সুখে এখন আমার চোখে এল জল'! এই পঙক্তিটি তাঁর বুকে আলোড়ন তুলল। অনেক চেষ্টা করেও অন্য কিছু লিখতে পারলেন না, রেখে দিলেন।

অনেক সুখে এখন আমার চোখে এল জল (৮)

তরুণবাবুকে বলে এই গানের গীতিকার রূপে পুলক ও মুকুল – দুজনেরই নাম রেখে দিলেন। বাংলা গীতিকাব্যের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম – দুই জনপ্রিয় গীতিকার মিলে একটি গান লিখলেন। আর মুকুলের উদারতার কথা নিজে দৃঢ়ভাবে জানতেন বলেই তরুণবাবু নির্দ্বিধায় এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন।

“ফুলেশ্বরী” ছবিতে নায়ক বৃন্দাবন কাজ করে রেলে, আর অবসরে গান বাঁধে। সে যেন একেবারে সেই কবি যে বলে –'কে লইবে আনন্দ আমার?” তুচ্ছ জাগতিক চাহিদার কাছে হার মানতে চায় না। তার বিধবা মা যখন এসে জানায় সে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে, সে সেই বঞ্চনার কথা অবলীলাক্রমে উড়িয়ে দেয়। তারপরে মুকুলের লেখা তার যে গানে সে তার জীবন দর্শন জানায় –

আমি নয়ন ভরে দেখতে ভালোবাসি
নয়ন যদি ভরে তবু
ভরে নাকো মন কভু
আমি পাগল হইলাম শুনে শুনে তোমার মোহনবাঁশী।

যে মানুষ এই পৃথিবীর এত আলো, আনন্দ, আকাশ দেখে মুগ্ধ – তার কাছে 'মাত্র তিনি কাটা জমি'!– সে উড়িয়ে দেয় মার কথা। জানায় বৈমাত্রেয় হয়েও মার যে নিজের সন্তানের চেয়ে তার প্রতি বেশী ভালোবাসা, সেখানেই তার জয়।

তোমার পথের ধারে আমি পাতিলাম ঘর
আসতে যেতে মন যে আমার হয়ে গেল পর
ভাবের লতায় ধরল কলি, রসের খোঁজে আসে অলি,
আমি নিজের ঘরে নিজে এখন হইলাম পরবাসী
আমি দেখতে ভালবাসি।

এই গানের ভাবটি যেন একেবারে সেই সাধক প্রেমিকের। তার আগেই অবশ্য বৃন্দাবনের আমরা পরিচয় পেয়েছি। সে সরস্বতীর সাধনায় ব্যপৃত। ছোট গুমটিম্যান হয়েও সে পৃথিবীর গান বাঁধতে চায়।

তোমায় প্রাণে ধরিতে গো করি হে বাসনা
অভিলাস আর কুসুম দিয়া করি আরাধনা
তুমি আমার ভাবনা কামনা সবই
তবু তোমায় পাইতে পারলাম না।
তুমি সুখ দিয়া দিলে দরশন,
আমি সুখ সইতে পারলাম না।

লক্ষণীয় যে এই গানগুলিতে তিনি প্রথাগত ভাবেই প্রচলিত ভক্তিগীতির আদলটি রেখেছেন – অনেকটা “সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু / অনলে পুড়িয়া গেল / অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে / সকলি গরল ভেল "। তা সুন্দরভাবে মানানসই হয়েছে।

পুলককে রাহুল দেব বর্মণ বলেছিলেন, 'হেমন্তকুমার শুড লার্ন ফ্রম কিশোরকুমার হাউ টু সিং”! যৌবনের মত্ততায় অনেকে এরকম কথা বলে ফেলতেই পারেন। পরে অবশ্য কথাটা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু যে কিশোরকুমারকে নিয়ে তুলনা, তিনি অসম্ভব হেমন্ত ভক্ত, তাঁর গলার এবং সুরের। তাঁর প্রযোজিত 'লুকোচুরি' ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক স্বয়ং হেমন্ত, এমনকি তাঁর নিজের গলাতে একক গানও ছিল –

“মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে
স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙ্গে রঙ্গে ছবি আঁকে” –

এ গানের গীতিকার অবশ্য মুকুল নন, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।

১৯৮০ সালে মেগাফোনের তরফ থেকে যখন পুজোর গান করার জন্য খুব চাপ দেওয়া হয় কিশোরকে, কিশোর তখন শর্ত দেন গানে সুর করবেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর হেমন্ত–কিশোর সমন্বয়, তখন গীতিকার রূপে তো মুকুল দত্ত থাকবেনই। এই রেকর্ডটিতে চার-চারটি গান ছিল, খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সম্ভবতঃ – “আমার পূজার ফুল, ভালোবাসা হয়ে গেছে, তুমি যেন ভুল বুঝোনা” আর “চোখের জলের হয়না কোন রং”!

দ্বিতীয় গানটির পুরো বিশ্লেষণের দিকে না গিয়েও প্রথম দুটি লাইনে কি অসম্ভব সুন্দর এক ছবি আঁকা হয়ে যায়, বর্ণনার অতীত।

একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথা জানাতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক আলাপচারিতাতে বলেছিলেন, “কি অদ্ভুত সুন্দর এক ছবি আঁকা হয়ে গেল একটি লাইনেই – 'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে”! সত্যি কথাই। গান শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে শান্তিনিকেতনের সেই অদ্ভুত মায়াময় জ্যোৎস্না রাত, সেখানে ছেলে মেয়েরা ঘুরে ঘুরে গান গাইছে, 'চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো' – আর 'দ্বার জানালার ফাঁক ফুকর দিয়া' ঘরে জোছনার আলো ঢুকে পড়েছে। ফাঁকা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, খুঁজে চলেছে মানুষজন। প্রশ্ন উঠতে পারে, ঘর ফাঁকা কেন? উত্তর অবশ্য গানেই আছে, 'সবাই গেছে বনে'!

মুকুলের এই গানটির দুই লাইনেও যেন এক অদ্ভুত মর্মবেদনা –

“চোখের জলের হয় না কোন রঙ / তবু কত রঙের ছবি আছে আঁকা। দেখতে গিয়ে হারিয়ে গেলাম / গহীন আঁধার পথে আঁকা বাঁকা।”

এরকম এক একটি পঙক্তি কিন্তু হঠাৎ এসে যায়, যত আমরা ভাবি তত আমাদের মুগ্ধ করে। চোখের জলের রং নেই কিন্তু সেই কান্নার ইতিহাস যে জানে সে কিন্তু বিভিন্ন রঙের ছবি খুঁজে নিতে পারে। সে ছবি হতে পারে দারিদ্র্যের, বঞ্চনার, হতাশার, পরাজয়ের – ব্যতিক্রমী ভাবে আনন্দের বা সাফল্যেরও। সেই যে অন্য পংক্তিটি - – 'অনেক সুখে এখন আমার চোখে এল জল'। তা আবিষ্কার কি অত সহজ – 'গহীন আঁধার পথে' হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।

মুকুলের সঙ্গে অন্য শিল্পীদের সম্পর্কের উল্লেখ করতে গেলে দুটি অন্য ধরনের গানের কথা উল্লেখ করা দরকার। ১৯৬৩ সালে আশা ভোঁশলের গলায় দুটি সম্পূর্ণ অন্য ধারার গান শোনা যায় – থুইলাম রে মন পদ্মপাতায় আর মনের নাম মধুমতী। 'থুইলাম' শব্দটির প্রয়োগ বেশ ব্যতিক্রমী। 'দিয়ে-থুয়ে' – অর্থাৎ 'রেখে'!

আশা ভোঁসলে (৯)

'থুইলাম রে মন পদ্মপাতায়
ধুইলাম রে মন জলে,
আর অঞ্চলে ঢাকিলাম এ মন
তবু কেন জ্বলে।

এই গানটি শুনে মনে পড়তে পারে – 'ফুলেশ্বরী'র সেই বিখ্যাত লাইনগুলি – যখন বৃন্দাবন তাকে নিয়েই গান বেঁধেছিল –

তোমার গোপন কথা যত আছে বন্ধু বুকে
অঞ্চলে ঢাকিলে তবু ঢাকা নাহি থাকে।
স্বপ্নের দেউল যেন তোমারি ও আঁখি
স্বপ্নের দেউল যেন তব দুটি আঁখি
কিছু স্বপ্ন দাও বন্ধু আমিও তো দেখি।
কেন অধরের বাঁশরী যে সুর ভুলে যায়।।

এই দুটি গানেই যেন শরীর ও মনের একাত্মতার কথা বলা আছে, ভাষাটিও সেই বৈষ্ণব পদাবলী ধাঁচের। সেই যে-

“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গে লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর!”

উপরের দুটি গানেই এই প্রভাব লক্ষনীয়। আগেই আমরা পলাতকের গানেও এই নিয়ে আলোচনা করেছি। আশার জন্য লিখিত অপর গানটিতেও ছিল ছন্দে গাঁথা, চমৎকার প্রতীকের ব্যবহারে উজ্জ্বল।

"মনের নাম মধুমতি, আর চোখের নাম আয়না
আমি দু হাতে চোখ ঢেকে রাখি, মন যেন জানা যায়না।
সুখের নাম প্রজাপতি আর দিনের নাম আলো
কপালে সুখ নাই বা আমার, এই পোড়া কপাল কালো!
তাই ইচ্ছের নাম আগুন রাখি, এই জ্বালা যে আর সয়না
আমি দু হাতে চোখ ঢেকে রাখি, মন যেন জানা যায়না।"

বম্বেতে প্রবাস জীবন কাটানোর ফলে মুকুলও কিছুটা যেন 'দুহাতে চোখ ঢেকে' রেখে গেলেন – আমরাও তাঁর 'মন যেন' জানতে পারলাম না। সেরকম ভাবে তাঁর উল্লেখ চোখে পড়ে না। গীতিকাররা এমনিতেই পরিচিতি পাননা, সুতরাং প্রবাসী গীতিকারের পক্ষে সেরকম গুরুত্ব পাওয়ার প্রত্যাশা খুব উজ্জ্বল নয়। তিনি কি হারিয়েই যাবেন, অনেক বুকভরা অভিমান নিয়ে, তাঁর বিখ্যাত গানটির মতই –

অমিতাভ ও শ্ত্রুঘ্ন সিনহার সাথে – মুকুল দত্ত (১০)

যাবার পথে পথিক যখন পিছন ফিরে চায়
ফেলে আসা দিনকে দেখে মন যে ভেঙ্গে যায়।
চোখের আলো নিভলো যখন মনের আলো জ্বেলে
একলা এসেছি আমি একলা যাব চলে।
আমিও সুখের মত ফুরিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবো না ফিরে কোনদিন।।
আমিও নদীর মত আসবো না ফিরে আর
আসবো না ফিরে কোনদিন।

কি জানি! মুকুল দত্তর জীবনও তো তেমনভাবে চর্চিত নয়। এমনকি তাঁর সামগ্রিক জীবনী খুঁজে পাওয়াও খুব দুষ্কর। তাঁর একমাত্র লেখা বই, কিশোরকুমারের জীবনী “একদিন পাখি উড়ে যাবে” দুষ্প্রাপ্য। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বই এর এ হেন অবস্থা দেখে তার রচনাকারের প্রতি অবহেলা সুস্পষ্ট। স্রষ্টা মুকুল হয়তো একেবারেই চিন্তিত বা ব্যথিত নন। তাঁর গানের বাণীর মতোই তিনি মনে করে থাকতে পারেন,

“যা কিছু পেয়েছি কাছে তাই-ই সঞ্চয়,
যা কিছু পেলাম নাকো সে আমার নয়।”

আমরা, তাঁর অনুরাগীরা একটু ক্ষুব্ধ। তবে আশা রাখছি, কেউ নিশ্চয় ভবিষ্যতে আগ্রহী হবেন। সেই ভরসাতেই থাকি। তাঁর গানে সেই আশার বাণীই শুনিয়েছিলেন যে,- আমাদের কোন 'বন্ধু'ই হয়তো তাঁকে 'পথের সাথী' করে নিতে চাইবেন, বাংলা গীতিকাব্যে তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে তাঁর 'ঋণ' শোধের প্রয়াসে ব্রতী হবেন, -

“খুশির খেয়ালে পাল তুলে যেও চিরদিন
হাসি আর গানে শোধ করে যেও যত ঋণ
স্মৃতির পটেতে যত ব্যথা আছে ভুলে যেও
ভুলো না তারে ডেকে নিতে তুমি।”

তথ্যঋণ –

  • ১ – আনন্দধারা – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
  • ২ – কথায় কথায় রাত হয়ে যায় – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
  • ৩ – বিভিন্ন বাংলা গান সংক্রান্ত ওয়েবসাইট
  • ৪ – আধুনিক বাংলা গানে 'কথা' – সম্পাদনা – অলক চট্টোপাধ্যায় – আজকাল
  • ৫ – বাংলা গানের পথচলা – অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছবিঋণ –

  • ১ – হেমন্ত ও মুকুল দত্তর ছবি (৩ ও ১০) – সঞ্জয় সেনগুপ্ত
  • ২ – অন্যান্য ছবি – অন্তর্জাল
  •  


    লেখক পরিচিতিঃ জন্ম কলকাতায়বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজারউনিশ-কুড়িনির্ণয়দেশইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টিঅবসরঅন্যদেশ,পরবাস ইত্যাদিতে) প্রকাশিত। সম্প্রতি  নিজের একটি ব্লগ চালু করেছেন – www.bhaskarbose.com

    Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.