'লোকসঙ্গীত' কথাটি সঠিক অর্থবহ নয়। বাউল, ভাটিয়ালি, জারি, সারি
প্রভৃতি বাংলার কতকগুলি বিশেষ গায়কী গানকেই আজকাল 'লোকসঙ্গীত'
বলা হয়ে থাকে। তবে শাস্ত্রীয় গায়নরীতির পরিপ্রেক্ষিতে এ সকল গানকে
'দেশীসঙ্গীত' বলা উচিত। গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে এসব বিকাশ
লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের কালে ইংরেজ শাসিত বঙ্গদেশে
যে নগর সভ্যতার রূপটি প্রাধান্য লাভ করেছিল, তার প্রভাবে গ্রাম
ও গ্রামীণ সংস্কৃতিকে হেয় মনে করা হত। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের
সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান এক নবযুগের সূচনা করেছিল। দেশীয় কৃষ্টির
উৎকর্ষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সকলেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিরাও ক্রমে গ্রামীণ সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা
- নানা শিল্পকাজের মাধুর্য অনুভব করতে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথ শৈশবে শাস্ত্রীয়, দেশীয় এবং ইউরোপীয় সঙ্গীত নিয়মিত
শুনেছেন এবং একটা বিরল সাঙ্গীতিক পরিবেশে থেকেছেন। ঐ সকল শ্রুত
গানের সুর ও ছন্দ তাঁর মনের নিভৃত কোঠায় সঞ্চিত হতে থাকে। ক্রমে
ঐ সকল সুর ও ছন্দ তাঁর অসামান্য বাণী রচনাকে আশ্রয় করে আত্মপ্রকাশ
করে। এক একটি গান স্বতন্ত্রতাপূর্ণ রবীন্দ্রসঙ্গীত রূপে এক নতুন
গায়নশৈলী রচনা করে।
প্রথম জীবনে কলকাতায় তিনি দেশীসঙ্গীতের মধ্যে প্রচলিত কীর্তন
ও রামপ্রসাদী গানই বেশী শুনেছেন। প্রথম যুগের সঙ্গীতরচনায় তাই
ঐ সুরে প্রভাবিত মাত্র কয়েকটি গানই স্থান পেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে
তাঁর গানের প্রধান উত্তরসাধক শ্রীযুক্ত শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন যে,
প্রথম থেকে সাতাশ বছর পর্যন্ত যে সব দেশী সুরের গান লিখেছেন তার
সবই কলকাতা অঞ্চলের প্রচলিত কীর্তন ও রামপ্রসাদী সুরে রচিত। যেমন,
(১) গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে, (২ ) আমিই শুধু রইনু বাকি, (৩) আমি
জেনে শুনে তবু ভুলে আছি, (৪) শ্যামা, এবার ছেড়ে চলেছি, (৫) আবার
মোরে পাগল করে, (৬) সুখে আছি, সুখে আছি।
শহর পরিবেশ ছেড়ে পল্লীর মুক্ত বাতাসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আসবার
সুযোগ হল কুষ্টিয়া, রাজশাহীর জমিদারী দেখতে গিয়ে। তখন নদীর বুকে,
গ্রামে গঞ্জে প্রায় দশ বছর থেকেছেন। এতদিন তিনি পল্লী সংস্কৃতির
নিদর্শনগুলি স্বস্থান থেকে উৎপাটিত হয়ে ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে আসা অবস্থায়
দেখেছেন। কিছু পরিমাণ কৃত্রিম পরিবেশের মধ্যেও তখন তাদের ভালো
লেগেছে। আর এখন সেই শিল্প-সংস্কৃতির উৎসমুখে এসে, পল্লীর প্রকৃতরূপ
দেখে অকৃত্রিম সুর শুনে মুগ্ধ হলেন। সেই পল্লী প্রকৃতি তখন রবীন্দ্রনাথের
অতুলনীয় সৃজনীপ্রতিভায় অতি মনোরমরূপে প্রকাশ পেল। এই প্রসঙ্গে
রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব উক্তিগুলো আমাদের স্মরণ করা উচিত। তিনি লিখেছেন
- "আমার লেখা যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন বাউল-পদাবলীর প্রতি
আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম,
বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা-সাক্ষাৎ আলাপ আলোচনা হত। আমার
অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিনীর
সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল-সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে
বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময় আমার মনের মধ্যে সহজ
হয়ে মিশে গেছে।"
"এমন বাউলের গান শুনেছি, ভাষার সরলতায়, ভাবের
গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না। তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ব,
তেমনি কাব্য রচনা, তেমনি ভক্তি রস মিশেছে। লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা
আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করিনে।"
উপরের উক্তিগুলিতে 'আমার জ্ঞাত বা জ্ঞাতসারে বাউল সুর মিশেছে'
এই অংশ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত রচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞাতসারে
যেসব গানে হুবহু কোন বাউল গানের রূপরেখায় গান লিখেছেন, সে গান
আমাদের সকলের মন মাতিয়েছে। যেমন,
(১) মূলগান: হরিনাম দিয়ে জগত; শুনতে চাইলে ক্লিক
করুন , থামাতে চাইলে আবার ক্লিক করুন। ভাঙাগান: যদি তোর ডাক শুনে
কেউ না আসে; শুনতে চাইলে ক্লিক
করুন , থামাতে চাইলে আবার ক্লিক করুন।
(২) মূলগান: আমি কোথায় পাব তারে; শুনতে চাইলে ক্লিক
করুন , থামাতে চাইলে আবার ক্লিক করুন।; ভাঙা গান: আমার সোনার বাঙলা; শুনতে চাইলে ক্লিক
করুন , থামাতে চাইলে আবার ক্লিক করুন।
কতগুলি গান বাউল, ভাটিয়ালি ও সারি গানের সুরের মাধুর্য মিশিয়ে
আপন অসাধারণ কবিত্বপূর্ণ বাণীযুক্ত করে যেভাবে রচনা করেছেন, তাতে
গানগুলি সর্বকালের স্থায়ী সম্পদ হয়ে আছে। এইরকম বিরাট সংখ্যক গানের
তালিকা এখানে লেখা সম্ভব নয়। যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করেন তাঁরা
সযত্নে সে গানগুলি পোষণ করেন এবং তাঁদের ঐ তালিকা চেনা আছে। কয়েকটি
মাত্র নমুনাস্বরূপ উল্লেখ করা যায় - 'আমার মন জাগলি নারে', 'এবার
দুঃখ আমার অসীম পাথার', 'আমি তারেই জানি', 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি',
'যা ছিল কালো ধলো', 'ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে'।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কালে যে গানগুলি তিনি পুব বাংলার বাউল সুরে
রচনা করেছেন, সেই গানগুলির মূল্যবোধ এখনও কমে নি। কয়েকটি গান উল্লেখ
করা যেতে পারে - 'ও আমার দেশের মাটি', 'ওরে তোরা নেই বা কথা বলছি',
'ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে', 'যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক', 'তোর আপন
জনে ছাড়বে তোরে' ইত্যাদি।
সারি গানের সুর নৌকা চালানোর সময় মাঝিদের মুখেই প্রথম উদ্ভব হয়।
এই সুরের একটি গান 'এবার তোর মরা গাঙে' গানটির কথা আগেই বলা হয়েছে।
এই সুরের দ্বিতীয় গানটির সুর পল্লীবাসীদের খুবই চেনা, কিন্তু তার
সাথে যে ভাব ও কথার রস মিশেছে তা অসাধারণ। গানটি - 'তোমার খোলা
হাওয়া, লাগিয়ে পালে'। আরেকটি গানও রচনাসৌকর্যে বিশ্বের অন্যতম
শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত রচনা - 'বজ্রে তোমার বাঁশি বাজে সে কি সহজ গান'।
অবারিত মাঠে রাখালের ভাটিয়ালি গান এক কালে পল্লীর একটি বিশেষ
সম্পদ ছিল। সেই ভাটিয়ালি সুরে অন্তত একটি গানের সুর ও অসাধারণ
রূপ-কল্পনার সমন্বয়ে চিরকালের গান হয়ে আছে। সে গানটি - 'গ্রাম
ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ'। এর প্রায় সমতুল্য বা তুলনাহীন পর্যায়ের
গান - 'ঐ আসন তলে মাটির পরে' এবং 'আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র-ছায়ায়
লুকোচুরির খেলা।'
'রামপ্রসাদী' বাংলার একটি নিজস্ব সুর। এমন সরল অথচ ভাবঘন গান
আর কোনও দেশে নেই। এই দেশী সুরে তিনি কয়েকটি গান রচনা করেছিলেন।
গানগুলি হল - 'আমিই শুধু রইনু বাকি', 'মিলেছি আজ মায়ের ডাকে',
'একবার তোরা মা বলিয়া ডাক', 'শ্যামা এবার ছেড়ে চলেছি মা ।'
রবীন্দ্রনাথের বাউল গানের অবদান খুবই মূল্যবান এবং বিশাল। এই
রকম রচনায় তা লিখে শেষ করা যায় না। প্রতিটি গান আপন মাধুর্য ও
স্বকীয়তায় অনন্যসাধারণ। আরও কয়েকটি গানের কথা এখানে উল্লেখ করতে
ইচ্ছা হয় -
(১) এই যে ভালো লেগেছিল
(২) যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
(৩) কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
(৪) বসন্তে কি শুধু কেবল, ফোটা ফুলের মালা
(৫) মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি
(৬) বাদল-বাউল বাজায় বাজায় বাজায় রে
(৭) পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে আয় আয় আয়
(৮) পাগলা হাওয়ার বদল দিনে
এই দেশী সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে আবার ছন্দ-বৈচিত্র্য প্রচলিত
রীতির ব্যতিক্রমগুলি আর এক রকমের মাধুর্য সৃষ্টি করেছে। যেমন,
ওরা অকারণে চঞ্চল - চার মাত্রার ছন্দ
আমার কী বেদনা সে কি জানে - তিন মাত্রার ছন্দ
যেতে যেতে চায় না যেতে
লহ লহ তুলে লহ - তেওড়া তালের ছন্দ
কিন্তু অজ্ঞাতসারে বাউল যেখানে রবীন্দ্রনাথের মনে প্রবেশ করে
সুরের মধ্য দিয়ে আবার বেরিয়ে এসেছে, সেই রকম রচনাগুলি আমাদের কাছে
অপূর্ব বিস্ময়। এই রকম দুটি গানের উল্লেখ করে প্রসঙ্গ শেষ করব।
'আমি তখন ছিলেম মগন গহন'গানটিতে 'আমার দেহের সীমা গেল পারায়ে'-
এই সঞ্চারী অংশটির সুরের সাথে অন্তরা এবং আভোগের সমন্বয় অত্যন্ত
বিস্ময়কর ও মাধুর্যপূর্ণ। আর একটি গান - 'বকুল গন্ধে বন্যা এল
দখিন হাওয়ার স্রোতে।' এই গানটিতে সঞ্চারী 'আকাশ পারে পেতে আছে
একলা আসনখানি' অংশের সুর হঠাৎ কীর্তনের আমেজ নিয়ে এসে একটা নতুন
সুরের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। প্রসঙ্গত বলা যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের
বহু কীর্তনাঙ্গ গানের সাথে বাউলের সুর একাত্ম হয়ে মিশে গেছে। আবার
বহু রাগভিত্তিক সুরের গানে হঠাৎ অজ্ঞাতসারেই যেন বাউলের আমেজ ফুটে
উঠেছে। 'তুমি কোন পথে যে এলে পথিক', 'ওগো সাঁওতালী ছেলে', 'আমি
তোমার সঙ্গে বেঁধেছি' ইত্যাদি গান চর্চা করলেই এই বিষয়টি যথার্থ
অনুভব করা যায়।
অবনীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে তাঁর এক ছবিতে বাউলের আলখাল্লা পরিয়ে
হাতে বাউলের একতারা দিয়ে রবি-বাউল সাজিয়ে এঁকেছিলেন। এই ছবিতে
রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাউল প্রকৃতি সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের
বাউল প্রকৃতি অনবদ্য।
গানের সূত্র – ইউ টিউব
লেখক পরিচিতি :প্রয়াত অনিল রঞ্জন গুহ ছিলেন
পোস্ট গ্র্যাজুয়েট টিচার্স ট্রিনিং কলেজ, বাণীপুরের সঙ্গীত বিভাগের
প্রথম অধ্যাপক। লখনৌর তৎকালীন Marris College of Music-থেকে (বর্তমান
নাম Bhatkhande Music Institute University) পাশ করে ১৯৪৮ সালে
উনি টিচার্স ট্রিনিং কলেযে যোগ দেন এবং সেখান থেকেই অবসর গ্রহণ
করেন।