অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিশেষ গান সংখ্যা

বিশেষ গান সংখ্যা - ত্রিশে সেপ্টেম্বর, ২০১৮

 

সলিল চৌধুরী ও সুধীন দাশগুপ্ত - সুরের দুই দিশারী

কৃত্তিবাস দাশগুপ্ত



"গত শতাব্দী থেকে ভারতবর্ষ যেমনভাবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে ভাষা, শিল্পকলা, পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রহণ করেছে, ঠিক অনুরূপভাবেই ভারতীয় সঙ্গীতও পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে আত্মস্থ করেছে। প্রগতিশীল কৃষ্টি কখনোই বিদেশী প্রভাবের ভয়ে ভীত নয়। … আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি বিশ্বের সঙ্গীত জগতে ভারতীয় সঙ্গীতের দেবার অনেক কিছুই আছে - কারণ ভারতীয় সঙ্গীতে আছে দুর্লভ গভীরতা, গাম্ভীর্য আর সর্বোপরি এর ভাবমাধুর্য। আজকের বিশ্বসঙ্গীতে সমস্ত প্রয়োগ কৌশলের চমৎকারিত্বের আড়ালে রয়েছে ব্যাক্তিমানসের প্রতিফলন, ভারতীয় সঙ্গীত তাতে প্রাণ সঞ্চার করবে - আত্মিক প্রতিফলন ঘটাবে। " -- সলিল চৌধুরী, সাং-গীতিকা শারদীয়া সংখ্যা, ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ

হঠাৎ ভাস্করদা লিখে পাঠালেন সলিল চৌধুরী আর সুধীন দাশগুপ্ত র গানের কাঠামো আর যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে কিছু লিখতে। আমি একটু দিশাহারা বোধ করলাম। প্রথমতঃ নিজেকে কোনোদিনই গান বোদ্ধা বলে মনে করিনি - তার ওপর এই দুই দিকপালকে নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতাও আমি অর্জন করেছি বলে মনে করিনা। তবে ভাস্করদার কথা ঠেলাও সম্ভব নয়। তাই যৎসামান্য জ্ঞানের ভিত্তিতে কিছু বলার চেষ্টা করছি।

ছবি – ১ - সুর রচনাতে মগ্ন সলিল

ছবি- ২ – সুধীন ও মান্না

কাঠামো, প্রশ্নোত্তর আর সোজা পথের ধাঁধা

যদিও দুজনেই গানের structure নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, আমার মতে সলিল অনেক বেশি দুঃসাহসিকতার নিদর্শন দিয়েছেন। দুজনেরই বেশির ভাগ গান স্থায়ী- অন্তরা - সঞ্চারী - আভোগ, এই ধাঁচে বাঁধা। সলিল প্রচুর ধাঁচ-বহির্ভূত কাজ করেছেন, মূলতঃ কবিতায় সুর বসিয়ে যে সব গান সৃষ্টি করেছেন তাতে এই কাঠামোর বালাই নেই। কাব্যের গতিতে, লেখনীর ছন্দে গান গাঁথা হয়েছে। সুধীনের খুব একটা এই জাতীয় কাজ খুঁজে পাইনা - প্রেমেন মিত্তিরের "সাগর থেকে ফেরা" আর সুকান্ত ভট্টাচার্যের "ঠিকানা" র একটি অত্যন্ত অল্পশ্রুত সুর-স্থাপনা ছাড়া। "বাঁশ বাগানের মাথার ওপর" গানটির উল্লেখ করা যায় কবিতার সুরারোপ হিসেবে, তবে কাঠামোগত ভাবে কিন্তু এটা খুবই সনাতনী, ওই স্থায়ী-অন্তরা-সঞ্চারী-আভোগ নিয়ে বানানো। তাই কবিতার ওই পুরোপুরি ওপেন structure টা নেই।

কিন্তু এদের বেশির ভাগ গানের মধ্যে পাশ্চাত্য সংগীতের একটা লুকোনো কিন্তু সর্বব্যাপী প্রভাব অনস্বীকার্য। এটা একটু খতিয়ে দেখতে গেলে কিছুটা সংগীতের পরিভাষার আশ্রয় নিতেই হয়। প্রচেষ্টা থাকবে খুব সহজ ভাষায় লেখার, পরিভাষার ব্যবহার শুধুমাত্র অনিবার্য কারণেই হবে।

পাশ্চাত্য সংগীতের structure এর ভিত্তিপ্রস্তর হচ্ছে phrase এবং period। সাধারণত দুটো phrase দিয়ে একটা period তৈরী হয়। এই দুটো phrase কিন্তু এক নয়। কিছুটা প্রশ্নোত্তরের মতো। প্রথম, বা antecedent phrase যদি প্রশ্ন হয়, তার উত্তর বা resolution হয় consequent phrase-এ। অর্থাৎ period-এ সুরস্রষ্টা একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেন, সেটা পুরোপুরি সাঙ্গীতিক প্রশ্ন, যাতে শ্রোতার মনে একটা tension তৈরী হয়,তারপর খুব দক্ষতার সঙ্গে তিনি সেই tension টাকে মিটিয়ে দেন।

একটা উদাহরণ দিলে কি বলতে চাইছি হয়তো একটু পরিষ্কার হবে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই মন কেমন করা গান, "এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন" এই গানের প্রথম লাইনটা গেয়ে থেমে যান। কি, একটু অদ্ভুত লাগছে না? মনে হচ্ছে একটা কিছুর কিনারায় দাঁড়িয়ে আছেন, আর একটু এগোলেই গন্তব্যস্থল - সম্মুখে শান্তি পারাবার। যখন "তোমার নিমন্ত্রণ" গাইলেন, কলজে ঠাণ্ডা হলো। কেন এরকম হয় ? এটাই period এর মজা। "থাকেনা কো মন" লাইনটাতে মন শব্দটির সুরের পিছনে খুব সূক্ষ্ম ভাবে শুদ্ধ নি আছে, যদিও গায়ক গাইছেন রে স্বর টি। শুদ্ধ নি-কে পরিভাষায় "leading tone " বলা হয়, অর্থাৎ সা স্বরের পৌঁছনোর ঠিক আগের ধাপ। তা "leading tone" আর tonic note (অর্থাৎ সা) এর মধ্যে এক অমোঘ আকর্ষণ আছে। কোনো লাইন যদি "leading tone" এ শেষ হয়, অনিবার্য ভাবে সুরে tension সৃষ্টি হয়। ঘুরে ফিরে "নিমন্ত্রণ" এ যখন আবার সা-এ ফিরে আসেন গায়ক, কিছুটা নিশ্চিন্ত লাগে নিজেকে।

সুধীন আর সলিল ও মোটামুটি এই রসেই জারিত ছিলেন, আর তার প্রমাণ বেশির ভাগ গানেই আমরা পাই। সুধীন যদিও প্রচুর খাঁটি দেশজ সুরে গান রচনা করেছেন। তবে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে, সুধীন এর গানে একটা সুস্পষ্ট পাশ্চাত্য রঙের ছোঁয়া লাগে। হয়তো এটার পিছনে কিছুটা ছোট ভাই পরিমলের হাত আছে - দক্ষ গিটার বাদক হওয়ার দরুন গানে harmonic depth এর গুরুত্বটা সহজেই হয়তো বুঝেছিলেন পরিমল।

"আরো দূরে চলো যাই" গানটার কথাই ধরুন। আশার মধুমাখা কণ্ঠ যখন গেয়ে ওঠে "ঘুরে আসি", প্রথম phrase এর সেখানেই দাঁড়ি, আর আমরা শ্রোতারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে জানতে কোথায় ঘুরে আসার কথা বলছেন মাধবী। ওই "পাশাপাশি, ঘুরে আসি", শুনে অবচেতন মন বুঝতে পারে, যে সুর আবার ঘরে ফিরে এসেছে, আপাতত শান্তি। পাঠক বন্ধুদের কাছে আবেদন করি, বাংলা গান শোনার সময় একটু সচেতন থাকবেন এই ধরণের সুরের টানাপোড়েনের ব্যাপারে। অনেকে মনে করেন ওই ভাবে গান শুনলে রসগ্রহণে ব্যাঘাত ঘটে, বিশ্লেষণের মারপ্যাঁচ গানকে ঠিক ভাবে উপভোগ করতে দেয় না। আমি কিন্তু তা আদপেই মনে করি না। খুব সুস্বাদু খাবার চাখার সময় যেমন আমরা বোঝার চেষ্টা করি রান্নায় কি উপাদান দেওয়া হয়েছে, গান শোনার ব্যাপারটাও অনেকাংশেই সেরকম।

সলিলের গানেও আমরা এই রচনাশৈলী দেখতে পাই, তবে একটু বক্র ভাবে, কারণ উনি কোনোদিনই সোজা পথের ধাঁধায় পড়তে চাননি। এই দেখুন, কথা প্রসঙ্গে পেয়ে গেলাম উদাহরণ। "পথ হারাবো" "বলেই এবার", এই দুটি বাক্যাংশ কে দুটো phrase হিসেবে দেখা যেতে পারে। এবার দেখুন, এই দুটি phrase-এরই শুরুটা একরকম, কিন্তু ওই "এবার" শব্দটা শেষ হচ্ছে শুদ্ধ নি স্বরে। সলিল শ্রোতার মনে জাগিয়ে তুললেন সা তে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আর "পথে নেমেছি" র পাকদণ্ডী দিয়ে ফিরে এলেন সেই সা-এ। এই গানের প্রথম লাইনটাকে সঠিক ভাবে প্যারালাল period বলা উচিত , কারণ দুটি phrase-এরই প্রারম্ভিক সুর এক। পারিভাষিক শব্দে এই tension resolution কে "ক্যাডেন্স" বলা হয়।

রানারের ইতিবৃত্ত

সুরের জাদু যেটা সলিল করতেন, তার গহনে লুকিয়ে আছে তাঁর পাশ্চাত্য harmonic তত্ত্বের অগাধ জ্ঞান। ওনার অনেক গানেই আমরা দেখতে পাই, মূল সা স্বর কে ভিত্তি করে সা-গা-পা সুর দিলেন কোন লাইনে , তার পরের লাইনেই গা কে সা ধরে আবার সা-গা-পা গড়লেন, যাতে শ্রোতার একটু বিভ্রান্তি ঘটে, আবার একই সঙ্গে সুরের এক অদ্ভুত নতুনত্বের স্বাদও বেরিয়ে আসে। "আজ তবে এইটুকু থাক" গানটির কথাই ভাবুন। "ধূসর ধূলির পথ" বেঁধেছেন এক সা এ, আবার "ভেঙে পড়ে আছে রথ" বেঁধেছেন আগের লাইনের গা কে সা ধরে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে।

অনেকগুলো গানে সলিল ক্রমাগত সা পাল্টেছেন,অর্থাৎ স্কেল পরিবর্তন করেছেন। এটাকে যদিও আমরা "tonic shifting" বলে থাকি, এর সঠিক নাম হলো modulation, এবং শ্রোতাকে সম্পূর্ণ দিশেহারা করার জন্য এটা যথেষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ দুটো গানের নাম বলি : "শোনো কোনো একদিন" এবং "এই রোকো পৃথিবীর গাড়িটা থামাও"। রানার গানেও এই জাতীয় স্কেল নিয়ে খেলাধুলো আছে। রানারের এই বৃত্তাকার scale বদল আমি একটা ছবির মাধ্যমে ধরার চেষ্টা করেছিলাম:

ছবি- ২ – রানার গানের বৃত্তাকার scale বদল

Arrangement, ছন্দ এবং আরো দু কথা

এবারে আসি "orchestration" বা যন্ত্রানুষঙ্গের বিষয়ে। একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, সলিল চৌধুরীর শৈশবের নেশা, বাঁশি, কিন্তু ওনার সমস্ত গানে ছড়িয়ে আছে। আর যেহেতু ছোটবেলা থেকেই গ্রামোফোনে western classical শুনে কান ঋদ্ধ , তারযন্ত্র আর choral-এর ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বাঁশি আর string section এর harmonic মেলবন্ধনের এক অবিস্মরণীয় উদাহরণ রয়েছে হিন্দি ছবি "সঙ্গত" এর সেই গান "কানহা বোলে না" এর শুরুতে। Strings এবং জলতরঙ্গ chordal প্রোগ্রেশন বাজাচ্ছে, আর তার ওপরে বাঁশি সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করছে। Choral অনুষঙ্গের জাদুকরী মাধুর্য গানকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সলিল তার প্রচুর দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য রেখে গেছেন। "পরখ" ছবির "মেরে মন কে দিয়ে" গানে শুধু লতা মঙ্গেশকরের "a capella" (বাদ্যযন্ত্রহীন) গায়ন, মাঝে মাঝে হালকা হাওয়ার ছোয়াঁর মতো choral অংশ ঢুকিয়েছেন সলিল, একটু হারমনিক depth আনার জন্য। গানটা শুনলে যদি গায়ে কাঁটা না দেয় তাহলে খুব আশ্চর্য হবো। আবার "এই রোকো" গানে রয়েছে পুরোপুরি jazz-ভিত্তিক গিটার ও ড্রাম সঙ্গত। এরকম অসংখ্য মনিমুক্তো ছড়িয়ে আছে সলিলের সাঙ্গীতিক ভাণ্ডারে।

সুধীনের গানে যদিও স্পষ্ট ভাবে chordal প্রোগ্রেশন দেখা যায় খুব প্রথমদিকের সৃষ্টি থেকেই, যেমন "এক ঝাঁক পাখিদের মতো কিছু রোদ্দুর", তাহলেও সুধীন প্রবল ভাবে ভারতীয় ধাঁচে সুর দিতেন ষাটের দশকের মাঝামাঝি অবধি। "ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়" গানের অসহায়তা একতারার বিষণ্ণ আওয়াজে ধরা পড়ে, ঠিক যেমন একই ছবিতে "কাঁচের চুড়ির ছটা" গানটি তবলা আর বাঁশি নিয়ে বৈঠকি মেজাজে আমাদের মন ভরিয়ে দেয়। পিকনিক ছবি থেকে আমরা দেখি এক পুরোপুরি নতুন সুধীনকে। গানের চেহারাই পাল্টে ফেললেন। গিটার, ড্রাম আর বংগোর জমজমাট সঙ্গতে প্রতিটি গান ভরে দিলেন যৌবনের উচ্ছলতায়। আবার কিছু গানে fusion করে দেখালেন, রাগসংগীত আর rock and roll অনবদ্য দক্ষতায় একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠলো, যেমন অনুপ ঘোষালের গাওয়া "চিন্তা নাই রে", ছদ্মবেশী ছবির "বাঁচাও কে আছো মরেছি" অথবা বসন্তবিলাপ ছবির "আগুন"। যে গানের হাত ধরে বাঙালির রকবাজি কৌলীন্য লাভ করলো, সেই "জীবনে কি পাবোনা" অবশ্য সুধীন আগাগোড়া rock’n’roll এর আদলে সৃষ্টি করলেন। সৌমিত্রর বেপরোয়া টুইস্ট নাচের পরিমণ্ডলে কোনো দেশী সুরের জায়গা ছিলোনা। আশা ভোঁসলের গলায় গাওয়া সুধীনের গান, সুধীবৃন্দ নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, বাংলা গানের জগতে নজিরবিহীন।

একটু অন্য স্বাদের গান "আমি তার ঠিকানা রাখিনি"। সুধীন এই গানটি লিখে বদ্ধপরিকর ছিলেন যে কিশোর কুমার দিয়ে গাওয়াবেনই। কিন্তু সে সাধ তাঁর মেটেনি , মান্না দে এই গানটি তাঁর অসামান্য স্বরমাধুর্য ঢেলে গেয়েছিলেন। শ্রোতারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, গানটার প্রথম স্তবকে একটা কি দুটো সুর কে বেশ খানিকক্ষণ টেনে রাখা হয়েছে - "রাখিনিইইইই", "আঁকিনিইইই.", - এটা কিছুটা পাশ্চাত্য সংগীতে বেহালার টানকে অনুকরণ করে বানানো। এই ধরণের স্বরপ্রয়োগের সময়ে দেখা যায়, western classical composerরা সুরটাকে অনেকক্ষণ ধরে রাখলেও, পিছনে chord পাল্টে দেন, যাতে শুনলে মনে হয় সুরের পশ্চাৎপট পাল্টে যাচ্ছে। গানটা শুনলে বেশী অনুধাবন করা যাবে। ঠিক এই অঙ্গের আরো একটি গান আছে অজয় দাসের সুর করা, "তোমাকেই ভেবে প্রহর ফুরায়"।

এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পিছনে আমি দুজনের পরোক্ষ প্রভাব অনুমান করি। প্রথমজন সুধীনের সহোদর পরিমল, যাঁর কথা আমি আগেও উল্লেখ করেছি। দ্বিতীয় জন আরেক বঙ্গসন্তান, যিনি বোম্বেতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটাচ্ছেন হিন্দি গানের ব্যাকরণ নিয়ে নয়ছয় করে। এবং এই পঞ্চমী প্রভাব যে সলিলকেও হেলিয়ে দেয়নি, সে কথা বলি কোন সাহসে ? ল্যাটিন rhythm নিয়ে গানের মাদকতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া তো প্রায় পঞ্চমের হস্তাক্ষর বলা যেতে পারে। আমি যতদূর জানি, Bossanova ছন্দের বাংলা গানে প্রথম আবির্ভাব হয় মান্না দের গাওয়া সুধীন সুরারোপিত "বন্ধু যদি তুমি নাই এলে" গানে, ১৯৭৫ সালের "অপরাজিতা" ছবিতে। তার দু বছর পরে সলিলও ঊষা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়ালেন তাঁর bossanova-য় উদ্বেলিত গান "বলো কি করে বোঝাই"। একটা অপ্রীতিকর কথা একটু স্পর্ধাসহকারেই বলা যায় , যে সলিল ও সুধীন সুর এবং harmony নিয়ে যত যুগান্তকারী কাজই করে থাকুন, গানের ছন্দ নিয়ে কিন্তু সেরকম নাড়াচাড়া করেন নি। আর শুধু এই কারণেই রাহুল দেব বঙ্গহৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকতে পারবেন।

নটে গাছটি মুড়োল

অনেক বকবকানি হল। পাঠক বন্ধুরা যদি লেখাটা পড়ে এই দুই দিকপাল সুরস্রষ্টার গানের আঙ্গিক ও রসায়ন নিয়ে আর একটু নাড়াচাড়া করার ব্যাপারে উৎসাহিত বোধ করেন, তাহলে আমার কাজ সম্পন্ন মনে করবো। সলিলের একটা সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অসাধারণ ইন্টারভিউ আছে Youtube-এ, বেশ লম্বা, কিন্তু প্রচুর ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনার খোঁজ পাওয়া যায় তার মধ্যে।

সলিল খুব চাইতেন অর্কেস্ট্রাল woodwind section ব্যবহার করতে, নিদেনপক্ষে একটা oboe আর ক্লারিনেট থাকলে কি ভালো হতো ,প্রায়ই বলতেন। কিন্তু কলকাতায় চলে আসার পর এগুলোর কিছুই সহজলভ্য ছিল না, খুব আক্ষেপের সঙ্গে সে কথা বলেছেন। যাই হোক, এতো দৈন্যের মধ্যেও যে সম্পদ উনি আমাদের মধ্যে রেখে গেছেন, তার সঠিক মূল্যায়ন করতে আরো অনেক সময় লেগে যাবে আমাদের। সুধীনও কিছুটা অবহেলিতই থেকে গেলেন "উঁচুদরের" সংগীত বোদ্ধাদের কাছে। প্রার্থনা করি এমন দিন আসবে, যেদিন আমরা এই ছুৎমার্গ ছাড়িয়ে উঠে গানকে শুধু গানের মাপকাঠিতে বিচার করতে শিখবো।


লেখক পরিচিত - লেখক কৃত্তিবাস দাশগুপ্ত নিউ জিল্যান্ডে বহুকাল প্রবাসী। আই.আই.টি. খড়্গপুরে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠ করার সময় থেকেই সংগীত ও বিশ্বসাহিত্যে অনুরাগ ঘনীভূত হয়। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে সংগীত ও পাঠে মনোনিবেশ করে লেখক নিজের মানসিক সন্তুলন বজায় রাখেন।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.