ঘোড়াগুলো ও আমি
প্রসূন চক্রবর্তী
থাকতাম শ্যামবাজারে, পড়তাম পাড়ার লোকেদের মতে খোট্টাদের স্কুলে। ফলে ওই বর্ণসংকর জাতীয় কিছু একটা হয়েছি, বিশেষত গানবাজনার ব্যাপারে।
ছোটবেলা থেকে একটা জিনিষই বারণ ছিল বাড়ীতে – সেটার নাম বিবিধ ভারতী। হিন্দি যখন ইস্কুলে পড়তে হল ক্লাস সিক্সে উঠে, সেখানে কোনদিন কেউ আপত্তি করেছেন বাড়ীতে, মনে পড়ে না। হিন্দি বই পড়াতেও আপত্তি নেই, কিন্তু হিন্দি গান শুনলেই কেন বাড়ী আর বাড়ী থাকবে না, পানের দোকান হয়ে যাবে, সেটা এখনও বুঝিনি। তখন ভাবতাম আমি একা, কিন্তু পরে সমবয়স্ক বন্ধু বান্ধবদের সাথে কথা বলে দেখেছি সকলের অবস্থাই ছিল একরকম। সম্ভবত ষাটের দশকের শেষাশেষি আর সত্তরের দশকের প্রথম দিকে সব বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনচর্চাতে বেশ মিল ছিল।
যাই হোক, মোদ্দা কথাটা এই যে গান জিনিষটা আমার কাছে একটা অদ্ভুত জায়গাতে এসে পড়েছিল ১৯৭০ সালের পরের সময়। বাংলা হিন্দি দুটোতেই গানে অসাধারণ সুর শুনছি, কিন্তু তার কথার সাথে কিছুতেই নিজের জগতে যে ভাষাতে কথা বলছি, তা মেলাতে পারছি না। বরং সে জায়গাতে অনেক ইংরাজি গানের কথা সুর বেশ ভালোভাবেই মনের ওপর দাগ কেটে বসছে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, দেবব্রত, হেমন্ত গাইছেন – গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে, কিন্তু সে গানকে সব সময় মনে হচ্ছে একটু দূরের। বেশ কিছুটা না বোঝা। মান্না দে “ললিতা, ওকে আজ চলে যেতে বল না” গাইলে ভাল লাগছে, কিন্তু তাও সে গান ঠিক আমার গান মনে হচ্ছে না। কিন্তু তার জায়গাতে যেই শুনছি প্রায় সুরহীন – Come Mothers and Fathers throughout the land; Don’t criticise what you can’t understand - মনে হচ্ছে, এই তো, ঠিক এটাই তো বলতে চাই আমি। আর কদিন পর, মোটামুটি যখন ৯-১০ এ পড়ি, সাতের দশকের মাঝামাঝি, তখন Yeah, you got that something, I think you'll understand; When I say that something, I want to hold your hand- কথাগুলোর মানে বুঝতে পারছি ঠিকঠাক, বলতে চাইছি ঠিক এই ভাষাতেই গেয়ে কাউকে। কিছুতেই এর বাংলা কোথাও পাচ্ছিনা – সে যে কি যন্ত্রণা, লিখে বলে বোঝান মুশকিল।
এরকম সময় একদিন ক্লাস পালিয়ে স্কুলের দেওয়াল টপকে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। যাচ্ছি আমারই এক ক্লাসের সহপাপীর সাথে, তার বাসা নাকতলাতে। হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে শুনি একটা গান গাইছে যার কথা সুর সব আমার অচেনা, কিন্তু কথাগুলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা হলেও বুঝতে পারছি, চিনতে পারছি, নিজের অবস্থাকে তার সাথে মেলাতে পারছি। বলল ওদের পাড়াতে কয়েকজন আমাদের থেকে বেশ বড় , তারা এই গানগুলো লেখে, গায়। পাড়ার লোকজন মোটামুটি পাগল বলে ওদের, কিন্তু আমাদের বয়সী কয়েকজন খুব ভক্ত হয়ে গেছে ওদের। কদিন পরে পড়ব বলে ওদের বাড়ী চলে গেলাম – নিয়ে গেল সেই অদ্ভুত গান শোনাতে আমাকে এক অনুষ্ঠানে –
“ভালোবাসি পিকাসো বুনুয়েল দান্তে,
বীটলস ডিলান আর বেথোফেন শুনতে;
রবিশঙ্কর আর আলি আকবর শুনে,
ভালোলাগে ভোরে কুয়াশায় ঘরে ফিরতে”
চিৎকার করে বলেছিলাম মনে আছে – ইয়েস ইয়েস, দিস ইস ইট। রেকর্ড পেয়েছিলাম তারপর একটা, কিন্তু কোথায় যে চলে গেল সেটা, কে জানে।
শুনতে হলে এক ক্লিক -
গৌতম চট্টোপাধ্যায়
বাংলার প্রথম ব্যান্ডের লাইভ শো
অনেকগুলো বছর কেটে গেছে তারপর, বাংলা গান দূর থেকে আরো দূরে চলে গেছে ততদিনে – গোটা দশ কি বারো গান শুনেছি এর মধ্যে মনে রাখার মত, এরকম এক সময় বউ ছেলে নিয়ে বইমেলা গেছি। মোটামুটি ১৯৯৫ কি ১৯৯৬ হবে সেটা। আমরা বই বেচি না, বিষয় বেচির স্টলের বাইরে বোধহয়, একটা ক্যাসেট প্লেয়ারে কিছু লোক গান চালিয়েছিল –
“তার নীল দেওয়াল যেন স্বপ্ন বেলোয়ারী,
তার কাঁচ দেওয়াল যেন স্বপ্ন বেলোয়ারী”।
চমকে উঠেছিলাম শুনে, এ গান, এ কথা কে লিখল? হলুদ রঙের ক্যাসেট, কিনে এনে বাড়ী ফিরে বোধহয় ১০-১২ বার শুনেছিলাম গানগুলো। বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই দিয়ে শুরু, টেলিভিশনের গুণগানে শেষ। কিন্তু ঘরানাটা মোটেই তখন অবধি শোনা বাংলা গান নয়। ততদিনে সুমন শোনা হয়ে গেছে কিছু, কিন্তু ওই “সাপ-লুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে” বা “ছেলেটা যে করে হোক, রিকশা চালিয়ে যায়” বা “নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই, এক ফোঁটা শান্তিতে তোমাকে চাই”, এরকম কিছু গান ছাড়া টানছে না কিছুই । দমকা বাতাসের মত তখন এল
“আমি কেমনে মানুষ হই?
আমার মহান হবার সাধই জাগে;
মহান হতে পারিনে,
আমি যে সাধ আহ্লাদ ছাড়িনে”।
আবার বছর কুড়ি পরে – ওই হলুদ মোড়কের ক্যাসেটটা অনেক অর্থেই একদম নতুন একটা সময় নিয়ে এসেছিল বাংলা গানে। সত্যি বলতে, ওই মহীন আর সত্তরের মহীন একদম আলাদা। মহীনের গান বলতে এই প্রজন্ম যেটা চিনল, তা আসলে একটা যাকে ইংরাজি ভাষাতে বলে কোলাজ। বিভিন্ন লেখক, সুরকার, গায়কের সমন্বয়ের একটা জায়গা।
প্রথমে আসি নামকরণে । হ্যাঁ, প্রথম রেকর্ডের প্রায় কুড়ি বছর পর এসেছিল এই ক্যাসেট – কিন্তু তাই কি নামের কারণ? না কি এই কবিতাটা মনে করিয়ে দেওয়া -
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাই আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড় থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল !
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !
এবার একটা গান শুনুন, আবার বছর কুড়ি পরে থেকে
বাঁকানো সিঁড়ির পথে সেখানে নেমে আসে
চাঁদের আলো
কাউকে চেনো না তুমি তোমাকে চেনে না কেউ
সেই তো ভালো
সেথা একলা তুমি গান গেয়ে ঘুরে ফিরে
তোমার এলোচুল ঐ বাতাসে শুধু ওড়ে
সেই বাড়ির নেই ঠিকানা
শুধু অজানা লাল সুরকির পথ শূন্যে দেয় পাড়ি
আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি
দেখা যায় তোমাদের বাড়ি
মনে হয়না যে আবার কুড়ি বছর পর কবিতার কবি বেঁচে থাকলে এরকম কিছু একটাই লিখতেন ১৯৯৫ সালে ?
এতটাই জনপ্রিয় হল সে গানগুলো, যে টাইটান ঘড়ির বিজ্ঞাপনেও তার আস্বাদ পাওয়া গেল। হিন্দি সিনেমাতেও অনুমতি নিয়ে সে গানের হিন্দি হল, বাজার মাত করল। পাগল হয়ে যাবার মত অবস্থা হল এর পর একদিন। মুন্নার দোকানে সিগারেট কিনছি আর আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ কানে এল,
“শ্রোতাদের মুখোমুখি, কেঁপে উঠি অজানা ভয়ে;
মাথাগুলি সারি সারি, যেন সর্ষের ফুল শয়ে শয়ে;
বিনীতা কেমন আছো? বিপদ আমার;
পরশু বিএ পার্ট টু, কি জানি কি লিখবো খাতায়” –
সেই প্রায় কুড়ি বছর আগে শোনা গান, নতুন গলায়, একটু নতুন সুরে। বাড়ী এনে ফিরে পেলাম আবার নতুন করে সাজান-
“রানওয়ে জুড়ে পড়ে আছে শুধু কেউ নেই শূন্যতা;
আকাশে তখন থমকিয়ে আছে মেঘ ;
বেদনাবিধুর রাডারের অলসতা;
কিঞ্চিৎ সুখী পাখীদের সংবেগ”-
বেশ খটোমটো শব্দ, কিন্তু সুর ও পরিবেশনা আজকের মানানসই।
গানটা শোনা যেতে পারে:
জীবনানন্দকে ধরে নেওয়া হয়, রবীন্দ্রনাথের পর প্রথম আধুনিক কবি হিসাবে। তাঁর লেখা সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা থেকে এই গানের দলের নামকরণ। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে (১৩৫৫ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এই কাব্যগ্রন্থের বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ওঠে।
আমরা যাই নি ম'রে আজো—তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে ;
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন—এখনো ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে।
আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে একভিড় রাত্রির হাওয়ায়;
বিষণ্ণ খড়ের শব্দ ঝ’রে পড়ে ইস্পাতের কলে;
চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো—ঘুমে—ঘেয়ো
কুকুরের অস্পষ্ট কবলে।
যেখান থেকে দলের নামটি নেওয়া, তারও একটা ছোঁয়া পাওয়া যায় ওদের প্রথম গানে – যে গানটা ওদের প্রথম রেকর্ড এ ছিল আর পরে ক্যাসেটেও ফিরে এসেছিল
ভালোবাসি জ্যোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে
ছায়া ঘেরা মেঠোপথে ভালোবাসি হাঁটতে
দূর পাহাড়ের গায়ে গোধূলির আলো মেখে
কাছে ডাকে ধান খেত সবুজ দিগন্তে
তবুও কিছুই যেন ভালো যে লাগেনা কেন
উদাসী পথের মাঝে মন পড়ে থাকে যেন
কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও
জীবনানন্দের নতুনভাবে লেখা কবিতার মত, মহীনের গানও ছিল একেবারে নতুন – খুব কম ছেলেমেয়েই সে সময় এই গান শুনেছিল। জীবনানন্দে যেমন বাঙালী কবিরা নতুন কাব্যভাষার সন্ধান পেয়েছিল, ‘মহীনের’ গানেও তাই।
যাদবপুরে টেবিল বাজিয়ে এই গান গাইলেও খুব বেশী শোনার লোক ছিলনা ১৯৮০-৮১ সালে।
সুমনের কিছু গান যদি বাঙ্গালী ১৯৯২ সালে পছন্দ না করত, তাহলে কি হত, বলা মুশকিল। কিন্তু ওপেন ডোর পলিসিতে আমাদের দেশে যদি এমটিভি না আসত, এফ এম না আসত, তাহলে বাংলা গান নতুনভাবে কিছুদিনের জন্য হলেও বেঁচে উঠত কিনা, সে নিয়ে আমার বেশ ভালোরকম সন্দেহ আছে। সুমন যে গান করেছেন, তা ইংরাজি গানে নতুন কিছু নয়। কিন্তু তার কথা আজকের বাংলাভাষাতে আজকের সময়ের। ডিলান অনুবাদ করে গেয়েছেন, সেটাও নিজের মত করে। টুকে কপি করে কিছুমাত্র নিজস্বতা না রাখলে কি হয়, তার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ বোধহয় “মৌনমুখরতা”। অন্যদিকে, সাইমন গারফাঙ্কেলের গানের সুরের ইন্টারল্যুড এনে গান বেঁধেছেন নিজের মত করে মহীনরা – নতুন গান হয়ে গেছে তা।
১৯৮০-১৯৯২ অবধি- আমার কাছে – কয়েকটা গান বাদ দিলে বাংলা গান প্রায় নেই বললেই হয়। ১৯৯২ তে সুমন, ১৯৯৩ তে নচিকেতা। কিছু পরে অঞ্জন। তারও পরে অন্যান্যরা। মহীন / চন্দ্রবিন্দু / ভূমি / ক্যাকটাস / ফসিলস/ লক্ষ্মীছাড়া ও আরো কয়েকটি বাংলা ব্যান্ডের গান এসেছে কিন্তু এদের অনেক পরে। ব্যান্ডের গান বলতে বাঙ্গালী যাদের বোঝে, দাপটে দাঁড়িয়ে এখন মহীনই ওই সময় থেকে – অন্তত প্রথম তিনটে ক্যাসেট তো বটেই।
ঝরা সময়ের গান (আবার জীবনানন্দ – ঝরা পালক) এ্যালবামে দুটো অসাধারণ গান নিয়ে কিছু না বলাটা পাপ বলে কিছু থাকলে তাই হবে।
“তোমায় দিলাম” নামটা শুনে হয়ত কিছু মনে হবে না আপনার, কিন্তু এরকম গান খুব বেশী হয়নি বাংলাতে
শহরের উষ্ণতম দিনে
পিচগলা রোদ্দুরে
বৃষ্টির বিশ্বাস
তোমায় দিলাম আজ।
আর কি বা দিতে পারি
পুরনো মিছিলে পুরনো ট্রামেদের সারি
ফুটপাথ ঘেঁষা বেলুন গাড়ি
সুতো বাঁধা যত লাল আর সাদা
ওরাই আমার থতমত
এই শহরে রডোডেনড্রন
তোমায় দিলাম আজ।
আমার প্রথমবার শুনে মনে হয়েছিল – সাহস আছে আর ক্ষমতাও, একটু ঔদ্ধত্যও।
একটা রডোডেনড্রন শব্দে যে কত কিছু বলে দেওয়া যায় – আবার নতুন করে জানলাম সেদিন।
কাঁপে কাঁপে
আমার হিয়া কাঁপে
এ কি যে কাণ্ড
এ কি যে কাণ্ড
এ কি কাণ্ড সব পণ্ড এ ব্রহ্মাণ্ড
শূন্য লাগে
তুমি ছাড়া শূন্য লাগে ॥
............
শিরে সংক্রান্তি
শিরে সংক্রান্তি
হে অশান্তি দাও ক্ষান্তি সব ভ্রান্তি
দূর হোক আগে
কফি ছাড়া শূন্য লাগে ॥
আপনার হয়নি এরকম?
হয় না এখনও?
‘মায়া” – তিন নম্বর ক্যাসেট কিছু একদিক দিয়ে দেখতে গেলে বোধহয় সবথেকে বেশী আসল মহীনের গানে ভরা।
প্রথম গানেতেই চমক – ফিরে এল সেই স্কুল জীবনের “ভালবাসি” “যখন ধোঁয়া মেঘে” আর “আমার দক্ষিণ খোলা জানলা” – এ দুটো গান বাদ দিলে সবকটা গানই কিন্তু পুরানো মহীনের লেখা সুর দেওয়া। সেদিক দিয়ে দেখলে দেখি কি পেলাম নতুন করে অরুণেন্দু দাসের লেখা গান “দিশেহারা আমার মন” একটা মন ভরিয়ে দেবার গান – যাকে আজ বলে পজিটিভ গান।
দিশেহারা যে মোর মন
কিসের সাধ্য কি জীবন
খুঁজে ফিরি কোথায় নেব ঠাই
চারিদিকে সবাই মোর
কেউ ভালো কেউ মন্দ ঘোর
আপন মান যেচে সে থাকা দায়
মনে ভাবনা তবু ঘিরে রয়েছে সদাই
এতো চাওয়া নিয়ে কোথা যাই
শোনো যদি কোনোদিন
আমি হঠাৎ ভাবনাহীন
রাখিনি কোথাও মন ঠিকানায়
যেন খোঁজা আমার শেষ
তাই হলেম যে নিরুদ্দেশ
সাথে করে শুধু হৃদয়টাই
মনে ভাবনা তবু ঘিরে রয়েছে সদাই
এতো চাওয়া নিয়ে কোথা যাই
সাইমন গারফাঙ্কেলের গানের ইন্টারল্যুড পেলেন ? কিন্তু ওইটুকুই, বাকিটা অরুণেন্দু দাসের লেখা।
“এই মুহূর্তে” ভীষণভাবে আজকের কথা আজকের গান। এ গানের কিছুই বাদ দিতে পারি না ২০ বছর পরেও। এখন জীবন্ত, এখনও আজকের কথা বলে এই গান-
এই মুহূর্তে,
ভীতু মানুষের ভীড়ে বাসভূমি অস্থির
এই মুহূর্তে,
কাঁটা তার পেরিয়ে প্রহরা এড়িয়ে
এই মুহূর্তে,
দলে দলে হেঁটে যায় বিদেশের সীমানায়
এই মুহূর্তে,
নতুন ঠিকানা চাই যেখানে সবার ঠাঁই
এই মুহূর্তে।
কোনো অলিখিত শর্তে
গোপনে গোপনে চলে লেনদেন বিকিকিনি-
যতো মারণাস্ত্র...
এই মুহূর্তে,
কোনো ভাঙা দেশ জুড়তে
দুঃখী মানুষের শোকে কনসার্টে গান গায়-
কত মায়েস্ত্রো...
পারিনা পারিনা কেনও বুঝতে
এ কি প্রপঞ্চ মায়া?
এ বিশ্বরূপ দেখে
চুপ ক'রে থাকি যদি
আমি নেহাতই বেহায়া।
এই মুহূর্তে,
তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে মন্বন্তর বাড়ে
এই মুহূর্তে,
খরা আর বন্যা শিশুদের কান্না
এই মুহূর্তে,
জীবনধারণে গ্লানি
শুধু মিছে হয়রানি
এই মুহূর্তে,
বুকের গভীর ক্ষত ছড়িয়ে ইতস্তত:
এই মুহূর্তে।
এই মুহূর্তে,
কার কোনো স্বার্থে?
চিরহরিতের বন ফিকে হয় মহীরুহ-
পতনের শব্দ...
এই মুহূর্তে,
অধিকার কাড়তে
অনেক আশার কথা বলেছিল যারা আজ-
সকলেই স্তব্ধ...
পারিনা পারিনা কেনও বুঝতে
এ কি প্রপঞ্চ মায়া?
এ বিশ্বরূপ দেখে চুপ ক'রে থাকি যদি
আমি নেহাতই বেহায়া।
এই মুহূর্তে,
নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে ঘুণ ধরে বিশ্বাসে
এই মুহূর্তে,
খোলা বাজারের হাওয়া চুপিসারে করে ধাওয়া
এই মুহূর্তে,
হাওয়ায় অসুখ হয় ভিতরে ভিতরে ক্ষয়
এই মুহূর্তে,
তবুও মানুষ হাসে গান গায় ভালোবাসে
এই মুহূর্তে।
এই মুহূর্তে,
এই সময়কে ধরতে
বুদ্ধিমানেরা যত বাণী দেয় শত শত
সমাজটা গড়বার...
এই মুহূর্তে,
তবু প্রতিরোধ গড়তে
বোকারা স্বপ্ন দ্যাখে আবার নতুন করে
পৃথিবীটা সাজাবার...
পারিনা পারিনা কেন বুঝতে
এ কি প্রপঞ্চ মায়া?
এ বিশ্ব রূপ দেখে
চুপ ক'রে থাকি যদি
আমি নেহাতই বেহায়া।
এই মুহূর্তে,
বোকারা স্বপ্ন দ্যাখে পৃথিবীটা সাজাবার
এই মুহূর্তে।।
বাকি সব গান নিয়ে বলার মত জায়গা দেননি সম্পাদক মশাই, কিন্তু একটা গান নিয়ে তো না বললেই নয়. কালকের সুরে আজকের কথা বসিয়ে কালকের গানকে কিভাবে নতুন আঙ্গিকে আনতে হয় নতুন শ্রোতাদের সামনে, এ গান তারই এক অসাধারণ উদাহরণ।
রাধা বসে আছেন তার কালা কখন আসবে – এ গান অনেক শুনেছি. কিন্তু আজকের রাধা কেন শুধু আসবার অপেক্ষাতে থাকবে?
আশায় আশায় বসে আছি
ওরে আমার মন
এই অবধি একদম শোনা বাউলগান। কিন্তু তারপরই এল-
কখন তোমার আসবে টেলিফোন।
বদলে গেল সবকিছু এক মুহূর্তে
কালা যখন তখন করো ডায়াল
বুঝিনা ছাই তোমার খেয়াল
তোমার আমার এই যে দেওয়াল
ভাঙবে রে তখন
কখন ভাবি আসবে টেলিফোন
কখন ভাবি আসবে টেলিফোন।
তোমার সঙ্গে দেখতে পেলে
পাড়াপড়শি মন্দ বলে
পাড়াপড়শি মন্দ বলে গো
তার চেয়ে রাত্রিবেলা সবাই যখন
রাত্রিবেলা
রাত্রিবেলা
রাত্রিবেলা সবাই যখন
ঘুমে অচেতন
তখন ভাবি আসবে টেলিফোন
তার চেয়ে ভাল তোমার টেলিফোন ।
তোমার সঙ্গে থাকলে আমি
কি হয় জানেন অন্তর্যামী
কি হয় জানেন অন্তর্যামী গো
দুরুদুরু বক্ষ জাগে
চিত্তে উচাটন
তার চেয়ে ভাল তোমার টেলিফোন
তার চেয়ে ভাল তোমার টেলিফোন ।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং মধুর ধ্বনি
শুনি তোমার আগমনী
আগমনী আগমনী
শুনি তোমার আগমনী গো
তাতে ধন্য হয় যে রাধারানী
তাতে ধন্য হয় যে রাধারানী
ধন্য এ জীবন
সবচেয়ে ভাল তোমার টেলিফোন
এ রকম কিছু বাংলা গানে এর আগে হয়নি।
এরপরও একটা ক্যাসেট বের হয় – “ক্ষ্যাপার গান” নামে। কিছু অসাধারণ, কিছু ভাল আর কিছু চলনসই গান নিয়ে। এখানেই আসে প্রথম “তাই জানাই গানে ভালোবাসি তোমায়” - Jim Croce র গান "I'll Have To Say I Love You In A Song" অবলম্বনে। এটা ছাড়াও পরে যখন সিডি বের হল, তখন আরো একটি এরকম গান ইংরাজি গানের কপি করে গাওয়া হয়েছিল। ওই সময়ও বাঙ্গালী খুব একটা বিদেশী গান শুনে অভ্যস্ত হয় নি, সে দিক দিয়ে দেখলে ঠিকই আছে হয়ত, কিন্তু আমার কানে লেগেছিল। আজও লাগে। শোনো সুধীজন, সাততলা বাড়ী, ঘরে ফেরার গানের মত কয়েকটা গান বাদ দিলে আজ এই ক্যাসেটের গান খুব একটা আর শুনিও না।
মহীনদের চিনি, জানি, প্রায়ই মনে করি। শুনি ভালবাসি। আজও। পুরোনো হল না আজও।
বাংলা গানে ১৯৭৫ এর পরে আসা সুমন বাদ দিলে আর কেউ আছেন কি এরকম আপনার তালিকাতে?
লেখক পরিচিতি –জন্ম ও পড়াশোনা কলকাতায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ানো এখানে ওখানে। শখ রাত জেগে গান শোনা, সিনেমা দেখা আর গল্প করা। উপরোধে লেখক।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.