গান শোনার অভ্যেস - বাংলা লিরিক গান
শিবাংশু দে
একটা গল্প মনে আসছে। তখন আমরা নিতান্ত বালক। মাঝেমধ্যে দোকানে রেকর্ড কিনতে যাওয়া হতো। সেরকম একবার রেকর্ড শোনা হচ্ছে, মানে বাবার ছিল দোকানে গিয়েই বলা হেমন্তের নতুন কোন রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড এসেছে কি না? তার পর অন্য কোনও গান শোনার কথা, কেনার কথা ভাবা যাবে না হয়। সেমত কেনাকাটা করে একটু দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চলছে, এই সময় এক সজ্জন এসে একটা রেকর্ডের খোঁজ করলেন। দোকানী তখন রেকর্ডটি চালিয়ে সন্তর্পণে স্টাইলাসটি তার উপর রাখা মাত্র (তখন কেনার আগে লোকজন রেকর্ডটি বাজিয়ে শুনে নিতো) সদম্ভে, সজোরে মান্না দে গেয়ে উঠলেন, "দে রে লে লে য়ম",বাবা বেশ চমকে গেলেন। তার একটু পরেই শুরু হয়ে গেলো, "এক চতুর নার"। আমরা বেশ শুনছিলুম, কিন্তু বাবা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে দোকানীকে প্রশ্ন করলেন, "এটা কী গান?"। দোকানী তখন বিশদ জানালেন গানটি বিষয়ে। তখন বাবার সব রাগ গিয়ে পড়লো প্রয়াত কৃষ্ণচন্দ্র দে ও শচীনকত্তার উপর। তিনি রীতিমতো অপ্রসন্ন হয়ে দোষারোপ করছিলেন এই দুজনকে। অভিযোগ ছিলো, তাঁরা তাঁদের শিষ্য ও বংশধরদের মধ্যে সঠিক সঙ্গীতের শিক্ষাটি দিতে পারেননি। বাড়ি ফেরার পথেও বাবা ক্রমাগত গজগজ করতে করতে ফিরলেন, এই হয়েছে গানের হাল আজকে, সেই আজ আর এই আজ! এখন আমরা জানি এই গানটি শুধু প্লেব্যাক সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একটা জলবিভাজকই নয়, এই মুহূর্তেও সর্বকালের লোকপ্রিয় একটা সৃষ্টি। বাবারা সেটা তখন বুঝতেন না। তাঁদের সঙ্গীত উপভোগের মানদণ্ড আলাদা ছিলো। এক কথায় গান শোনার অভ্যেস। এই অভ্যেসের সঙ্গে গানের সুর ও কথাবিন্যাস দুইই ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কৃষ্ণচন্দ্র দে
শচীন দেব বর্মণ
গান কেউ শোনেন কান দিয়ে, কেউ অভ্যেসবশে, কেউ বা মস্তিষ্ক দিয়ে, ক্রিটিক্যালভাবে। কবিতাও তাই। কেউ তাকে আবেগ দিয়ে স্পর্শ করতে চান, কেউ অবলম্বন হিসেবে, কেউ বা তাকে নিছক মেধাপ্রকল্প ভেবে নেন। প্রত্যেকের যাত্রার অভিমুখ কিন্তু একইদিকে। একটু ছায়া, একটু স্বস্তি, একটু শান্তি, আর কিছু নয়। এরকম মানুষ চিরকাল আছেন যাঁরা মনে করেন আমি কবিতা বুঝিনা তাই ওটা ট্র্যাশ। সময়ের অপচয়। কেউ বা কবিতার কাছে কিছু পেয়ে থাকেন, তাই তাঁরা আরো কিছু পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যান। কেউ বা মেধাচর্চা করে শেষ পর্যন্ত কবিতার রহস্যময় জগতে ঢোকার পাসপোর্টও পেয়ে যান। সবারই স্বাধীনতা আছে নিজের মতো করে ভাবার। তবে শ্রমের শর্তটি অস্বীকার করলে কিছু প্রাপ্তি হবেনা। কবিতার কাছে কিছু পেতে গেলে ভাষাটি অন্তত ভালোভাবে শিখতে হবে। কারণ কবিতা ভাষাভিত্তিক শিল্প। তেমনি গানের কাছে তাৎক্ষণিক ভালো লাগার ঊর্ধে কিছু পেতে গেলে সুরের কারিগরির দিকগুলি নিয়ে একটু প্রস্তুতি থাকা দরকার। এমন নয় যে সে প্রস্তুতি না থাকলে গানের কাছে কিছু পাওয়া যাবেনা। কিন্তু এ দিল মাঙে মোর। সঙ্গীতসমুদ্রের কোনও সীমা নেই।
আরো বহু বিষয়ের মতো সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে ঠাকুরবাড়ি, বাঙালির গান শোনার, বোঝার, সৃষ্টি করার ক্ষমতাটিকে সুনির্দিষ্ট প্রত্যয়ে একটা বাঁক দিয়েছিলেন। বাণীর গভীরতা সাহিত্য উৎকর্ষের শিখর ছুঁয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সুরের বৈচিত্র্য ও প্রয়োগে অনন্য সব পরীক্ষা নিরীক্ষা। আমাদের আবহমান সংস্কৃতিতে এর কোনও অতীত উদাহরণ নেই। নেই কোনও সমান্তরাল সাফল্যের নজির। সমঝদারেরা বলেন সারা পৃথিবীতে এর সমতুল কিছু দেখা যায়নি। আমরা ইতরজনেও তার কিছুটা বুঝি। মাতৃভাষাসূত্রে এই কৃতিত্বের অংশীদার হয়ে হয়তো কিঞ্চিত শ্লাঘাও বোধ করি। কিন্তু সমস্যাটি আসে অন্যদিক থেকে। বাংলায় যাকে বলে স্ট্যান্ডার্ড, সেটা এইফাঁকে এতোটাই উপরে উঠে গেছে যে পরবর্তী সুরশিল্পী বা গীতিকারদের জন্য তা এক অনন্ত চ্যালেঞ্জ। পরিবর্তিত হওয়াটা কালের ধর্ম। কিন্তু কীভাবে পরিবর্তিত হলে তা কম্পোজার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ছায়ার বাইরে আসতে পারার এলেম দেখাবে, সেটা নিয়ে অনিঃশেষ পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে গত ষাট-সত্তর বছর ধরে। সত্যি কথা বলতে কি ছায়ার বাইরে আসার জন্য অনেক সংলাপ বিনিময় হয়েছে, কিন্তু দিনের শেষে কেউই বাইরে আসতে পারেননি। বাণীশিল্পের দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জ করার কোনও অবকাশ নেই। কারণ রবীন্দ্রনাথ চেতনে-অবচেতনে শুদ্ধ কবিতা ও লিরিকের মাঝখানের সীমারেখাটি প্রায়শই অদৃশ্য করে দেন। তাই কোনও পাথুরে মাপদণ্ড এখানে অপ্রাসঙ্গিক। উত্তর-রবীন্দ্র বাংলাগানের বিবর্তনটি অন্যান্য যেকোনও ভাষাভিত্তিক অর্বাচীন সাঙ্গীতিক বিকাশের সঙ্গে মিলবে না। তাই আমাদের গান শোনার অভ্যেসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের হস্তাবলেপ পরিপ্রেক্ষিতগুলি পাল্টে দেয়।
একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। বাংলাগানের শ্রোতা এবং স্রষ্টারা নানারকম শৈলী নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। এই সব পরীক্ষা থেকে অন্তত একটা সূত্র সাধারণভাবে উঠে আসে। শৈলী যাই হোক না কেন যদি মেলোডির অভাব থাকে তবে কোনও গানই সামগ্রিকভাবে বাঙালি শ্রোতার আনুকূল্য পায়না। বিভিন্ন বিদেশি জঁর নির্ভর অনেক কাজ হয়েছে আমাদের গানে। কিন্তু সেই সব গানই সাধারণ শ্রোতার কাছে গ্রাহ্য হয়েছে যেখানে তাল, লয়, চলন, গতি ও গানের অন্যান্য অঙ্গ কখনও মেলোডির সহজ উৎসার ও অগ্রগতিকে ব্যাহত করেনি। তাই যদি সুরসৃষ্টির সফলতার প্রেক্ষিত থেকে বাংলাগানের গড়ে ওঠা বিচার করি, তবে দেখবো মেলোডিক প্রোগ্রেশনের নানা বৈচিত্র্যই তার মূল লক্ষণ। এই দৃষ্টিকোণটি থেকে বিচার করলে দেখা যাবে বাংলাগানে এতো বিরাটমাপের সুরকারেরা রাজত্ব করে গেছেন, তার জুড়ি অন্য ভাষায় মেলা ভার। কিন্তু গানের বাণী সৃষ্টির প্রশ্নে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি যাওয়ার মতো গীতিকারদের সন্ধান আমরা পাইনি। অবশ্য এটা একটা খণ্ডিত সন্ধান। আমরা পৃথকভাবে গীতিকার বা সুরকারদের চিহ্নিত করার প্রয়াস থেকে নাহয় একটু নিবৃত্ত হই। এখানে আমাদের বিচার্য হোক বাংলাগানে সম্পূর্ণ কম্পোজারদের ঐতিহ্যটি। রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী বাংলাগানের প্রধান দিকপাল, যেমন রামপ্রসাদ সেন বা রামনিধি গুপ্ত (কমলাকান্ত, দাশরথি রায়, শ্রীধর কথক, রাম বসু প্রমুখ কম্পোজারদের আমি প্রধান উৎসমুখ হিসেবে বিবেচনা করছি না), নিজস্ব গীতধারা প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। এটা ছিল আদ্যন্ত নাগরিক স্রোত। আবহমান কীর্তন ও লোকজ সঙ্গীতধারার প্রভাবী স্রোতে লালন বা সিরাজ সাঁই সৃষ্ট সমান্তরাল গীতধারা প্রবলভাবে বর্তমান ছিল। এই সমস্ত স্রোত এসে মিলে যায় রবীন্দ্রসঙ্গমে। এই সব ঐতিহ্যের উপাদান এবং নিজস্ব সীমাহীন সৃজনসম্পদ, সুর বা বাণী, উভয় ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ কম্পোজার হিসেবে অনর্গল গ্রহণ করেন। উপরন্তু সেই পথে বাংলাগানকে এমন একটা উচ্চতায় নিয়ে যান, যা হয়তো তার আগে অসম্ভব বোধ হতো। এই সৃষ্টিধারার সময়কালের পরিধিও বিস্ময়কর। এতো দীর্ঘদিন ধরে (প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের সৃষ্টিশীল জীবৎকাল) শ্রোতামণ্ডলীর অভিনিবেশকে আকর্ষণ করে রাখার ক্ষমতা সম্ভবত সারা বিশ্বেই তুলনাহীন।
অন্য লেখার প্রসঙ্গ আনছি না। রবীন্দ্রনাথের গানে টেক্সট (Text) আর কনটেক্সটের (Context) ক্রমাগত স্থানপরিবর্তন, সুষম বৃত্তাকার কেন্দ্রিক টানে গীতিধর্মিতার ধরন বজায় রেখেছিল। কবিতার রহস্যগূঢ় মোহমায়াকে এভাবে প্রশ্রয় দিয়ে যাওয়া, এখনও পর্যন্ত আর কারো দ্বারা সম্ভব হয়নি। ভিতর থেকে অ্যাকাডেমিক দর্শনচর্চার তুমুল প্ররোচনা থাকলেও লিখতে বসে কবিতার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সেই তাড়নাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতাও কবি হিসেবে তাঁর অন্যতম সিদ্ধি। এই পর্যায়ের শৈল্পিক পরিণতমনস্কতা এখনও পর্যন্ত অদ্বিতীয় একটি সাফল্য। তাঁর সমসাময়িক কম্পোজারসমূহ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত বা এই ঘরানার শেষ দিলীপকুমার এবং পরবর্তীকালে নজরুল, সে রকম কিছু ভাবতেই পারেননি। অন্যদিকে প্রতিটি ব্যবহৃত শব্দ, কয়েনেজ, ধ্বনি ও সমাপতন, সুরের ভাষায় নির্ভুল অনূদিত হয়ে যায়। শতাধিক বছর পেরিয়ে এসেও শ্রোতার ভিতরে এখনও অনুরণন সৃষ্টি করে। প্রবণতা দেখলে মনে হয় আরো বেশ কিছুদিন এরকম যাবে। এহেন একটি হিমালয়ের ছায়ায় পরবর্তীকালে আর কোনও সম্পূর্ণ কম্পোজারের স্বাধীনভাবে স্ফূর্ত হওয়া দুষ্কর। এমনকি সলিল চৌধুরীও পারেননি। তাঁর সুরের জাদু যতো-ই বহুমুখী, মুগ্ধমোহন হোক না কেন, বাণীর ঔৎকর্ষের বিচারে সেটি তাঁর পূর্বসূরির উত্তরাধিকারটি পায়নি। কনটেক্সটের কাছে টেক্সট পিছিয়ে পড়েছে সব সময়।
সলিল চৌধুরী |
১৯৫২ সালে সলিল চৌধুরীর মনে হয়েছিল, ".... আমি মনে প্রাণে আমার বিষয়বস্তুর প্রতি আন্তরিক হতে চাই। কোনো কথাকে প্রকাশ করবার সময় কোনো সুরের আমি যখন আশ্রয় নিই আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে আমার দ্বারা ঐ কথাটি ঐভাবে বলা ছাড়া অন্য কোনোভাবে বলা সম্ভব নয়।" সলিল চৌধুরী কিন্তু কবি ছিলেন না। তাঁর কথা কিন্তু আসলে সুরের কথা, ভাষার ভূমিকা সেখানে দ্বিতীয় সারিতে। এ নিয়ে তাঁর মনে কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলনা। যদিও একগুচ্ছ চাবি বা শপথের মত উঁচুমানের কবিতাও বেরিয়েছে তাঁর হাত থেকে, কিন্তু আদ্যন্ত তিনি গীতিকবি। খুব উর্বর সুরের জমি ছিলো তাঁর মননে। গান ভাবলেই আগে সুরটি, তার স্বরলিপি, তার অর্কেস্ট্রেশন, তার পরিবেশন, সব মিলিয়ে তাঁর কথা হয়ে উঠতো।
তাই গানের বাণীগুলি বহুসময়েই সমকালের চলিত প্রবণতার থেকে ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত একটা বিশেষ সময়ের দাবিই থাকতো প্রত্যক্ষভাবে। পরিচিত ছাঁচের থেকে আলাদা তাঁর লেখা বহু লিরিক শ্রোতাবর্গকে চমকে দিয়েছে বহুবার। আমরা এখনও সেই সব লিরিক ভালোবেসে শুনি, অনেকটা অভ্যেসবশে। একটু মনঃসংযোগ করে যদি বিশ্লেষণ করতে যাই, তবে চোখে পড়ে যাবে পুনরাবৃত্তি, মামুলি শব্দবন্ধ, অপ্রভাবী রূপক ইত্যাদি। যদি ধরে নিই গণসঙ্গীতের ক্ষেত্রে সূক্ষ্মতার সঙ্গে আপোষ করতে হয় তবে আমাদের তাঁর চল্লিশের দশকের গান গুলি মনে রাখতে হবে। "হেই সামালো" বা "ও আলোর পথযাত্রী" রয়েছে তার মধ্যে। কিন্তু পঁয়তিরিশ বছর পেরিয়ে এসে পাচ্ছি-
"... কোটি কোটি মোরা দেশের সন্ততি
এসো মিলেমিশে ঘোচাই দুর্গতি
গড়ি নতুন করে এ দেশ আবার
নতুন জীবনের তুফান আনি
হিন্দু মুসলমান।" (১৯৭৮)
অথবা,
".... স্বার্থের চিন্তায় দিন গেল
জীবনের ধ্রুবতারা অস্ত গেল।
চারিদিকে শুধু মরু ধু-ধু ধু-ধু
সাথিহীন, রাতদিন শুধু বেদনা,
এবারে নতুন করে বাঁচতে হবে।।" (১৯৮২)
যে কবি লিখেছেন নির্ভার, তীক্ষ্ম শব্দের স্কেচ," একদিন ফিরে যাব চলে" (১৯৬৩), তিনিই আট বছর পরে নিঃসঙ্কোচে লিখছেন "সুদূরে মিলায়ে" বা "তোমার তরে"। ["সীমানা ছাড়িয়ে সুদূরে মিলায়ে যাবে" (১৯৭১); যাওয়ার পরে গো তোমার তরে" (১৯৭১) ]
অসম্ভব জনপ্রিয় এই গানটির বাণী বাঁধার সময় সলিল কী আরও একটু নিজেকে প্রয়োগ করতে পারতেন না?
"নিজেরে হারায়ে খুঁজি তোমারি নয়ন মাঝে" (১৯৬১)
অথবা, তাল ও লয়ের সুষম সন্তুলন রাখতে গিয়ে চলিত ভাষায় লেখা গানটির সঙ্গে আপোষ করছেন তিনি,
"শুকশারিরা সেখানে কূজনে কূজনে দুজনে গাহিয়া যেত
ঐ নদীটি বহিয়া যেত" (১৯৬৩)
সত্তর দশকের পক্ষে রীতিমতো প্রাক্তন কাব্যশৈলীর অমনোযোগী ব্যবহার পাচ্ছি ,
"...জীবন বালুর বেলায় শুধু ঘর বাঁধা বাঁধা খেলায়
কেটেছে আমার গো প্রিয়া মিছে কতনা বেলা..." (১৯৭১)
এইসব চ্যুতি হয়তো সুরকে জায়গা ছেড়ে দিতে তিনি ব্যবহার করেছেন। হয়তো শব্দের অভিঘাত নিয়ে একটু ধৈর্যহীন, অসহিষ্ণু। অবশ্য এই বিচারটি আমরা এই মুহূর্তের মানদণ্ডে করার প্রয়াস পাচ্ছি। তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে গেলে খুব একটা বেমানান লাগেনা। আমার পিতৃদেবের বিচারে (তিনি একজন নিবেদিত কাব্যপ্রাণ মানুষ ছিলেন) সলিলের লিরিক সেই যুগে মানুষকে বিশেষভাবে প্রেরিত করতো। যদি সংখ্যাগুরু মানুষের কাছে পৌঁছোতে পারাটা কাব্যের প্রসাদগুণের লক্ষণ হয়, তবে সলিলের বাংলা লিরিকে নতুন কোনও স্বাদ এনে দেওয়ার প্রয়াসকে সাফল্যের একটা নিরিখ বলে মানতে হবে। যে কবির থেকে আমরা "মনের জানালা ধরে", "পথে এবার নামো সাথি", "আমায় প্রশ্ন করে" বা "কী যে করি, দূরে যেতে হয়", এই পর্যায়ের অসংখ্য লিরিক পেয়েছি, তাঁর শক্তির প্রতি নতমস্তক হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এমন কী "সাতভাই চম্পা" বা "হলুদ গাঁদার ফুল" এর মতো সুরের সঙ্গে, ভাবের সঙ্গে মিলে যাওয়া শব্দের আলপনা খুব বেশি পাইনা আমরা। তবু তাঁর সুরস্রষ্টা সত্ত্বা প্রায়ই ঢেকে দিয়েছে তাঁর গীতিকারের পরিচয়।
আমাদের গান শোনার অভ্যেস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একটা প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন কালপর্বের গীতিকারদের রচনার অংশ ঊদ্ধৃত করে তুলনামূলক অবস্থানে পৌঁছোবার তাগিদ বেশ স্পষ্ট থাকে। অলস মায়ায় সহজেই গীতিকারদের মধ্যে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট ভেদ করে ফেলা যায় হয়তো। কিন্তু তা সুবিচার হয়না। বাংলাভাষার ক্রমবিবর্তনে পাল্টে যায় মূলত ক্রিয়া ও সর্বনামের বিভিন্ন রূপগুলি। তাছাড়া বিবর্তিত হয় প্রচলিত, হয়তো লোকপ্রিয়, বিভিন্ন প্রতীক, রূপক ও মোটিফের নান্দনিক আপোষসমূহ। অতুলপ্রসাদের প্যাথোস হয়তো শৈলেন রায়ের লেখার মধ্যেও এলো। কিন্তু তব, মম, পেয়েছিনু ইত্যাদি আপাত মিলের আড়ালে ফেলে অসাম্যময় বহু গরমিল করে দিয়েছে।
অজয় ভট্টাচার্য, অথবা ধরা যাক সুধীন দাশগুপ্তের লিরিকে প্রচলিত সরল শব্দগুলি শুধু বিন্যাসের জোরে শ্রোতার মনে বহুসময় স্পর্শ রেখে যেতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাগানে রথীমহারথী কম্পোজারদের কোনও অভাব নেই। নাম শুনলেই রোমাঞ্চ জাগে, এমন লিস্টিও ফুরোয় না।
সুধীন দাশগুপ্ত |
কিন্তু সবার মাঝে একটা নাম, সুধীন দাশগুপ্ত বোধ হয় একটা সুরও করেননি যাকে also ran বলা যায়। তাঁর প্রয়োগ কৌশল ছিল অনন্য। শিল্পবিলাসীর মেঘপ্রাসাদ থেকে বহুদূরে তিনি এক শিল্পকর্মী। সশ্রম প্রতিভার ছাপ তাঁর সব শিল্পকর্মে। শুধু তাঁর টেকনিক নিয়ে আলাদা আলাদা করে আলোচনা করতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। অন্তর্বস্তু নিয়ে চর্চা চলতেই থাকবে। সত্তরের দশক থেকে চাঁদ-ফুল-পাখি বহুনিন্দিত একটা মোটিফ। এটা সত্যি যে সলিল বা সুধীন এই সহজ সমাধানের অংশ নন।
ভুলে যাওয়া সঙ্গত হবেনা, শব্দের এই চেনা ছকটি কিন্তু একসময়ের শ্রোতাদের (পড়ুন, বাজারের) প্রত্যক্ষ তাগিদ থেকেই এসেছিলো। সময়ের পলি এসে শ্রোতাদের শ্রবণ অভ্যাস বদলে দিয়ে যায়। গীতিস্রষ্টা তাঁর সময়ের ফসল। পারম্পর্যহীন বিচ্ছিন্ন ঊদ্ধৃতি শুনে বা পড়ে একজন স্রষ্টাকে সামগ্রিকভাবে বিচার করা যায়না। কবিরা পাঠ অভ্যাসে স্বচ্ছন্দ। গীতিকারেরা শ্রবণ অভ্যাসে। তাই উভয়ের গুণগ্রাহিতার মাপকাঠি পূর্ণতঃ পৃথক। শ্রোতাদের কাছে নগদবিদায়ের ক্ষেত্রে গীতিকারেরা কবিদের থেকে এগিয়ে থাকেন। কারণ কবিতা একটা একেবারেই বিমূর্ত মাধ্যম, লিরিকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আকর্ষণীয় সুরের আবেদন খুবই প্রত্যক্ষ। ধরাছোঁয়ার সুযোগ অনেক বেশি।
যদি সুরের প্রশ্ন আসে, তবে বলবো বাংলাগানের মূল নির্মাণটির মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। কীর্তন, ঠুমরি, টপ্পা, কাওয়ালি, কাজরি, চৈতি ইত্যাদি শৈলীগুলি থেকে আহরিত একালের যেসব সুরসৃষ্টি আমরা শুনতে পাই, সেখানে পরিবর্তনগুলি যতোটা প্রসাধিত, ততোটা অভিনব নয়। আমার মনে পড়ছে বহুকাল আগে একজন প্রবীণ শ্রোতা, যিনি সমকালীন গানের হালহকিকৎ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন না, তাঁকে এ আর রহমানের একটি কম্পোজিশন বম্বে ছবির কব্বালিভিত্তিক গান "কহনা হি ক্যা" শোনালুম। তিনি তিন-চারবার গানটি শুনে নিজের মনে একটি বৈষ্ণব কীর্তন গেয়ে উঠলেন। দুটি গানের কংকাল প্রায় এক। তফাৎ ছিলো শুধু সঙ্গীত আয়োজনে। পরবর্তীকালে তালবাদ্যের প্রয়োগে প্রচুর বদল হয়েছে। বেড়েছে ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্রের বহুল প্রয়োগ। স্প্যানিশ গিটার বা স্যাক্সোফোন, ট্রাম্পেটের রমরমা। কিন্তু মৌলিক সুর প্রয়োগের সময় সুরকারেরা লোকপ্রিয় ফ্রেম বা ফ্রেজগুলিকে সতত প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। মনে হয় নবতর যন্ত্রানুষঙ্গে যদি এই সব কম্পোজারের রচনাগুলিকে আমরা নতুন করে সাজাতে পারি, তবে সমস্যাটি আসবে অন্যদিক থেকে। লোকপ্রিয়তার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে কালসাপেক্ষ বাজারের চাপ। মুহ্যমান লিরিকের দুর্বলতা। বিষয়সমূহ তো পালটায়নি। প্রেম, বিরহ, শৃঙ্গার,একাকীত্ব, অসহায়তা, টুকরো সুখ, গভীর দুঃখ, মানুষের অনুভূতির জগতের ভিত্তি তো একই আছে। কিন্তু সে সব বোধপ্রকাশের ভাষাটির আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে।
বিশ শতকের তিরিশ দশক থেকে বাংলাগানের প্রযোজনা আর একক স্রষ্টানির্ভর থাকেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুরকার ও গীতিকারের দায়িত্ব ভাগ হয়ে যায়। এর ফলে দেখা গেলো সুরকারই চালকের আসন পেয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তবেই গীতিকারের কিছু সুযোগ প্রাপ্তির সম্ভাবনা। যদি সংখ্যাতত্ত্বে যাই, তবে গত পঞ্চাশ বছরের বাংলাগানের সফলতম গীতিকার ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, ".... আমি কবি ছিলাম কি না জানিনা, তবে কৈশোর থেকে বুঝে নিয়েছিলাম, গান লেখা কবিতা লেখারই একটা অঙ্গ। এখনকার কবিরা আমাদের গীতিকার আখ্যা দিয়েছেন। যার ফলে আমরা গীতিকার হয়ে গেছি, কবি হতে পারিনি।.... আমি জানিনা, কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র আর গীতিকার প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পর্কে এঁদের কী ধারণা?" কবি স্বীকৃতি পেলে তাঁর কোন সিদ্ধিলাভ হতো জানা নেই। কিন্তু গীতিকার হিসেবে তাঁর সাফল্য ও লোকপ্রিয়তা অধিকাংশ স্বীকৃত বাংলাকবির ঈর্ষার কারণ হতে পারে। তবু তাঁর স্বরে স্পষ্ট আক্ষেপ। কেন তাঁকে মানুষ কবি হিসেবে নেয়নি।
গত শতকে চল্লিশের দশক থেকে যাঁরা শুধু গীতিকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যেমন অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, সুবোধ পুরকায়স্থ, প্রণব রায়, হীরেন বসু, শ্যামল গুপ্ত প্রমুখ, প্রায় সর্বক্ষেত্রেই সুরকারের শর্ত মেনে গানে কথা বসাতেন। বাঘা বাঘা সুরকারের দল, যেমন, হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটক, অনিল বাগচি, শচীন কত্তা, দুর্গা সেন, কালীপদ সেন, গোপেন মল্লিক, নচিকেতা ঘোষ, রবিন চট্টোপাধ্যায়, এঁদের স্তরের স্রষ্টাদের দেখা যেতো হারমোনিয়াম নিয়ে বসে আছেন। সহকারীরা ঘিরে বসে। গীতিকারকে বলে উঠলেন, "ও মশাই, মুখড়াটা এমন হবে, রিদম আর ফ্রেজগুলো এভাবে দেবো ভেবেছি। একটা জবরদস্ত কথা বসান তো।" গীতিকার, তিনি যতোই বরিষ্ঠ, প্রবীণ বা এলেমদার হোননা কেন, তাঁর মাথায় শুধু তিন অক্ষর, চার অক্ষরের লাগসই শব্দের সন্ধান চলেছে। রিদমে পড়বে, সুরের ছাঁদে বেমানান হবে না। প্রয়োজনে কল্পনা বদলে আলপনা করে দেবার আদেশ আসতে পারে। পাঁচ অক্ষরে ফাঁক পড়লে দামালপনাও করে দেওয়া যায়। চ্যালেঞ্জটা খুব সহজ নয়। অন্য ধরনটায় ছিল পুরোনো হিসেব। গীতিকারেরা বেশ কয়েকটি গান বেঁধে সুরকারদের কাছে গচ্ছিত রাখতেন। তাঁরা সময়-সুযোগ মতো তাতে সুর বসাতেন। কিন্তু সেখানেও গীতিকারদের সুরের প্রয়োজনে কথায় অদলবদল করতে হতো।
আসলে কী হয় ব্যাপারটা, গান নিয়ে লিখতে গেলে যেটা সতত মনে পড়ে, পৃথিবীর সর্বত্র তো কোটি কোটি রকম গান তৈরি হয়, কিন্তু যা টিকে থাকে তা শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সঙ্গীত হয়ে উঠেছিলো। যন্ত্রসঙ্গীতের কথা বাদ দিচ্ছি, কারণ এই আলোচনায় তার প্রসঙ্গটি গৌণ। তার উল্লেখ থাকছে শুধু সহায়ক সুরস্রোত হিসেবে। কন্ঠসঙ্গীতের ব্যাপারে সব চেয়ে প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে গলার সঠিক সুরসংস্থান। যে পর্দাটি ধরতে চাইছি সেটিকে ঠিকঠাক গলা থেকে বার করা। বাংলায় যাকে বলে ভয়েস ট্রেনিং। পাতিয়ালা ঘরের অজয়বাবুর কথা ভাবা যায়। ওঁদের ঘরানার সব থেকে জরুরি তালিম হচ্ছে এইটা। কিন্তু এই বিষয়ে বেশি মনঃসংযোগ করতে গিয়ে অনেক সময় ওঁরা গানের স্পিরিটটাকে দ্বিতীয় সারিতে রাখেন, এর ফলে গোললাইনের কাছে এসে কিরানা পার্টি মেরে বেরিয়ে যান। সবাই তো আর বড়ে গুলাম নন। আর বাংলা ব্যান্ড কোম্পানি প্রায় পুরোটাই স্পিরিট, সুরের তোয়াক্কা কেউ বিশেষ করেন না। কয়েকজন জনপ্রিয় ব্যান্ডগায়ককে যখন খালি গলায় সামনে বসে গান গাইতে শুনেছি, তখন এই সীমাবদ্ধতাটিকে অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠতে দেখেছি। ইক্যুয়ালাইজার, মিক্সার, বাসকন্ট্রোল, সর্বোপরি ধমাধম ধমাধম কৃষ্টির ঢাক ছাপিয়ে অধম শ্রোতাদের কান পর্যন্ত যা পৌঁছোয় তা নিয়ে বিশেষ আশাবাদী হওয়া যায়না।
শচীন কত্তা বলতেন যে সুরটা রিক্সাওয়ালাও গাইতে পারবে তাই জনপ্রিয় হবে। কিন্তু নিজে গানটা গাওয়াতেন রফি, কিশোর, মান্না, লতা, আশাকে দিয়ে, যাঁরা সুরসংস্থানের ঈশ্বর কোটীর মধ্যে পড়েন। এ ব্যাপারে কোনও আপোষ নয়। তাই জনপ্রিয় গান গাইতে গিয়ে যদি আমি জনতার গায়নক্ষমতার অনুকরণ করি তবে প্রিয়তা হয়তো আসে, গান আসেনা। বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গায়নপদ্ধতির স্কিলসেট দিয়ে বাংলা গান বিচার একটা অর্বাচীন লক্ষণ। যেমন অনেকে এখন রবীন্দ্রনাথের গানকেও মূল রাগের সুরসংস্থান অনুযায়ী ভাগ করে গাইতে চান বা পৃথকভাবে তার বর্গীকরণ করেন। স্বয়ং কবির বক্তব্যও প্রাসঙ্গিক – “রাগরাগিণীর উদ্দেশ্য কী ছিল? ভাব প্রকাশ করা ব্যতীত আর তো কিছু নয় ----- এখন রাগরাগিণীই উদ্দেশ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যে রাগরাগিণীর হস্তে ভাবটিকে সমর্পণ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, সে রাগরাগিণী আজ বিশ্বাসঘাতকতাপূর্বক ভাবটিকে হত্যা করিয়া স্বয়ং সিংহাসন দখল করিয়া বসিয়া আছেন।” ["সংগীত ও ভাব"]
প্রশ্ন হচ্ছে, গানটি হয়ে উঠছে কি না তা নিয়ে চিন্তা করা না তার সুরের কাঠামো কোন রাগের আরোহ-অবরোহের সঙ্গে মিলছে, তা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কাব্যগীতিতে লিরিকের সম্মান সুরের উপরে চলে গেছে। কিন্তু গান যেহেতু গাওয়া হয়, আবৃত্তি করা হয়না, তাই সুরের প্রতি তন্নিষ্ঠ না থাকলে শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি দাঁড়াবে না। এ একটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ ও সংযমের খেলা। তাই বাংলা গানটির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি আমরা অপ্রয়োজনীয় ভাবে নিকটতম একটি রাগের আরোহ-অবরোহের বিস্তার করতে থাকি তবে তা বিড়ম্বনার সূচনা করে।
গানের ব্যাপারে শুধু কানে শোনায় বিশ্বাস রাখলে, অর্থাৎ শোনার অভ্যেসটুকুই যদি একমাত্র বিবেচ্য হয়, তবে আলোচনাটা হবেনা। সেটা নিজস্ব ভালো লাগা বা না লাগার পর্যায়েই থেকে যাবে। আমার যা শুনতে ভালো লাগছে, অন্যের তা না লাগতেও পারে। অতএব এই চর্চায় বেশি এগোলে শেষ পর্যন্ত অহমবোধে আঘাত লাগার সম্ভাবনা থেকে যায়। সেটা বড়ো বিপজ্জনক। আমাদের কর্ণেন্দ্রিয়টি গানের ব্যাপারে বাহির দেউড়ি মাত্র। যা কানে শুনি, তা কতোটা মস্তিষ্কে জারিত হয়ে হৃদয়ে পৌঁছোচ্ছে, সেই পরিমাপ করতে গেলে সুর-অসুরের স্বভাবধর্মটা জানতে হবে। সেটা একটা উচ্চস্তরের গণিত পদ্ধতির মতো। সেই বিচারে অবিমিশ্র ভালো বা মন্দ কিছু হয়না। গোটা প্রক্রিয়াটিই তুলনামূলক বিচার।
এর উপর লোকপ্রিয়তার বালাই একধরনের স্টিমরোলার (কবির উপমা ধার করলুম)। যা সচরাচর মেধাহীন ও নির্মনন। ভিন্নমত সহ্য করতে অপারগ। এমনিতেই আজকাল একটা প্রবণতা বেশ দেখতে পাই, যেকোনও ক্লাসিসিজমকে এলিটিজম নাম দিয়ে গালাগাল দেওয়ার। আরো বিপজ্জনক হলো ব্যক্তিগত বুদ্ধিহীনতার দায় সাব-অল্টার্ন সেরিব্র্যালিটির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। প্রবণতাগুলি অত্যন্ত ভুলভাল সময়ের বিষ। গানই বা বাকি থাকে কেন?
এই মুহূর্তে আমাদের বাংলা লিরিকগান শোনার অভ্যেসটি বিশেষ দোলাচলের মধ্যে আছে। উত্তম, দীক্ষিত শ্রোতারাও প্রায়শ খেই হারিয়ে ফেলেন। প্রায় চার দশক হয়ে গেলো গৌতম চট্টোপাধ্যায় বাঙালির গান শোনার অভ্যেসটি পাল্টানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন। মহীনের ঘোড়া কিছু মানুষের বাংলাগান শোনার ধরনটা প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু যথেষ্টমাত্রায় অভ্যেসটি পাল্টাতে পারেনি। আড়াইদশক হয়ে গেলো সুমনের একক প্রচেষ্টা পাল্টে দেবার ইচ্ছেটাকে অনেকদূর নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাও থেমে গিয়েছে।ভূমি, চন্দ্রবিন্দুর সাফল্যে ভাঁটার টান। প্রতুল মুখোপাধ্যায়, মৌসুমী ভৌমিক টেনে চলেছেন। নকল-নবিশদের কোলাহলে বাজার বধির। একশো বছর ধরে তৈরি করা বাংলালিরিকগানের গ্র্যান্ড ডিজাইনটি বামিয়ানের বুদ্ধ হয়ে গেছে। বাঙালির গান শোনার অভ্যেস একটা নকটার্নে (nocturne) দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে। ততঃকিম? ব্যতিক্রম একেবারে নেই তা নয়, তবে তা সংখ্যালঘু। তবে সম্ভবত সেটাই “দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক”!
তাই হয়তো একটাই জাদু, "হাল ছেড়োনা বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে...."!
লেখক পরিচিতিঃ শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.