অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিশেষ গান সংখ্যা

বিশেষ গান সংখ্যা - ত্রিশে সেপ্টেম্বর, ২০১৮

 

"শুধু জেগে রবে আমার গানের পরিচয়":
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান- বাংলা কাব্যগীতির নতুন দিশা

তথাগত ভট্টাচার্য



রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, কাজী নজরুল। এই পাঁচ কবি-সুরকারের হাত ধরেই আধুনিক বাংলা গানের পথ চলা শুরু। একমাত্র নজরুল ইসলামের শিল্পী জীবনের শেষ পর্বের ব্যতিক্রমকে উপেক্ষা করলে (অর্থাৎ যখন তিনি গান তৈরী করে চলেছিলেন প্রধানত: নিউ থিয়েটার্সের চলচ্চিত্রের দাবি মেটাতে) বাঙালির পরম আদরের ও শ্রদ্ধার এই "পঞ্চকবি" র সকলেরই গীত -সৃষ্টি ছিল স্বকীয় প্রেরণায়। অস্বীকার করার উপায় নেই- একাধারে কাব্যময় গীত রচনা এবং তাতে সার্থক সুর সংযোজনা দাবি করে আক্ষরিক অর্থেই অ -সাধারণ প্রতিভার - যা স্বভাবতঃই সুদুর্লভ। তাই এই পঞ্চ প্রতিভার অস্তাচল পর্বে, ৩০-৪০ এর দশকে এসে দেখা গেল এঁদের হাতে অঙ্কুরিত বাংলা গানের নতুন ধারাটির উত্তরাধিকার বহনের দায়িত্ত্বে যাঁরা অগ্রগামী তাঁদের কেউই পঞ্চ কবির মতো একাধারে গীতিকার-সুরকার নন। বাংলা গানে গীতিকার এবং সুরকার - এই দুই স্বতন্ত্র স্রষ্টা-শ্রেণীর স্পষ্ট বিভাজন রেখার সূত্রপাত তখন থেকেই। নিজ নিজ ক্ষেত্রে সন্দেহাতীত ভাবেই প্রভূত প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যে একাকীত্বের সৃষ্টি একদা এই পাঁচ জনের গানে দিয়েছিল নিজস্ব ঘরানার স্বকীয়তা, বাংলা গান ধীরে ধীরে সেই ঘরানার নিজস্বতা হারালো। "রবীন্দ্রসঙ্গীত", "নজরুলগীতি", "দ্বিজেন্দ্রগীতি" ইত্যাদি পৃথক পৃথক ঘরানা-পরিচায়ক বিশেষণ হারিয়ে বাংলা গান পরবর্তী পাঁচ দশক ব্যাপী সময়সীমায় "আধুনিক গান" নামক এক সাধারণ অভিধায় পরিচিত হল - আবার একই সঙ্গে এই তরুণ গীতিকার ও সুরকারদের প্রতিভার নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার সংস্পর্শে এসে পেল এক নতুন প্রাণস্পন্দন। বাংলা গানের স্রোতস্বতী বাঁক নিল এক নতুন ধারায়।

তিন ও চারের দশক সাক্ষী থেকেছে একদিকে হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, রাইচাঁদ বড়াল, দুর্গা সেন প্রমুখদের মতো প্রতিভাবান সুরকার অন্যদিকে প্রণব রায়, অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থদের মতো প্রতিভাবান গীতিকারদের উত্থানের। তবে লক্ষণীয় বিষয় এই , যে বাংলা আধুনিক গানের সেই সূচনা পর্বে গীতিকবিদের একটি স্বতন্ত্র শ্রেণী গড়ে উঠলেও তদানীন্তন বাঙালী কবিরা কিন্তু সাধারণ ভাবে রেকর্ড ও ছায়াছবির বাণিজ্যিক গানের জগৎ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই পছন্দ করতেন। কেন, এ বিতর্কের অবতারণা বর্তমান আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক। তবুও, এটুকু উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, যে আধুনিক কবিকুলের সাধারণ ঔদাসীন্য সত্ত্বেও সেই সময়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র বা বিমল চন্দ্র ঘোষের মত মুষ্টিমেয় কয়েকজন কবি কিন্তু সাহিত্য জগতে তাঁদের কবি-পরিচয়ের পাশাপাশি ছায়াছবি এবং রেকর্ডের গান রচনার ব্যাপারেও উৎসাহী ছিলেন।

সময়ের হিসেবে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তৎকালীন এইসব প্রতিভাশালী কবি ও গীতিকবিদেরই উত্তরসূরি। বাংলা গানের বাণিজ্যিক জগতে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম পদার্পণ ‘৪০ দশকের শেষ দিকে সরোজ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত "অভিমান" ছায়াছবিতে গান রচনার মাধ্যমে - যখন তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী এক কিশোর।এরপর ধীরে ধীরে বাংলা ছায়াছবি এবং বেতারে গীতিকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেও বাংলা গানের যা তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ কৌলীন্য, অর্থাৎ রেকর্ডের গান, তাতে আত্মপ্রকাশ করবার জন্য পুলককে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও প্রায় গোটা এক দশক।

১৯৫৭ সাল। HMV থেকে প্রকাশিত হল তিন "বন্দ্যোপাধ্যায়" এর এক যৌথ প্রয়াস - অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার প্রথম রেকর্ড - "তোমার দুচোখে আমার স্বপ্ন আঁকা" । ঐ একই বছরে প্রকাশ পেল অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়েরই সুরে গায়ত্রী বসুর কন্ঠে "দূর বনপথে ছায়াতে আলোতে" । এর এক বছরের মধ্যে লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে ভূপেন হাজারিকার সুরে "রঙিলা বাঁশিতে কে ডাকে", এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ও কন্ঠে "ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা" আর "কত রাগিণীর ভুল ভাঙাতে"। বাংলা গানের ব্যাপারে যাঁদের সামান্যতমও ধারণা আছে , পুলকের সূচনাপর্বের এই গানগুলোর অদ্যাবধি জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে তাঁদের কারোর সংশয় থাকা উচিত নয়। বলাই বাহুল্য, বছর দুয়েকের ব্যবধানে পরপর এতগুলি জনপ্রিয় গানের রচয়িতা পুলককে এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলা আধুনিক গানও পেয়ে গেল রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী সময়ের সম্ভবতঃ সবচেয়ে রোমান্টিক গীতিকবিকে।

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পী জীবনের ব্যাপ্তি অর্ধ শতকের কিছু কম। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর রচিত রেকর্ড এবং ছায়াছবির গানের সম্মিলিত পরিমাপ ন্যূনাধিক সহস্র তো হবেই। এই বিপুল সংখ্যক গানের ভাণ্ডারের বিস্তারিত আলোচনা যে সময় ও পরিসর দাবি করে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত তার কোনটারই সহায়ক নয় এবং সম্ভবত: তার প্রয়োজনও নেই। যাঁরা বাংলা গান তথা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের একনিষ্ঠ শ্রোতা এবং একই সঙ্গে কাব্যরসিক, তাঁদের কাছে পুলকের গান বা তার কাব্যগুণ নিয়ে নতুন করে আলোচনা বাতুলতা। অন্যদিকে বাংলা আধুনিক গানে যাঁরা উৎসাহ-রহিত - এঁদের কারো কারো হয়ত রবীন্দ্র সঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্র-অতুল-কান্ত গীতি, লোকসঙ্গীত, শ্যামা সঙ্গীত ইত্যাদি বাংলা গানের অন্যান্য ধারায় উৎসাহ আছে - তাদের কাছেও এ আলোচনা অর্থহীন। এঁদের পাশাপাশি, "যে জন আছে মাঝখানে", এ আলোচনা শুধু তাঁদেরই জন্য। এঁরা বাংলা আধুনিক গানের নিয়মিত শ্রোতা, কিন্তু হয়তো তেমন গভীর ভাবে নন। পাশাপাশি এঁদের অনেকেরই বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে রবীন্দ্র ও রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতার যে ধারা তার সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিতি আছে। বর্তমান আলোচনার উদ্দেশ্য এই সুধী পাঠক ও শ্রোতাদের সামনে পুলকের শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতার কিছু নিদর্শন তুলে ধরা এবং পুলকের রচনার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ জাগিয়ে তোলা - এর বেশি আর কিছু নয়।

দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তিতে, বিভিন্ন শিল্পী ও সুরকারের প্রত্যাশা ও প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গান রচনা করলেও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে যদি চিহ্নিত করতে হয় তবে স্বীকার করতেই হবে, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মূলতঃ রোমান্টিক গীতি কবি। অবশ্য প্রথাগত ভাবে দেখতে গেলে অধিকাংশ বাংলা গীতিকবিতারই মূল সুর রোমান্টিকতা। রবীন্দ্রনাথের গীতিকবিতায় এর প্রথম এবং সার্থকতম প্রকাশ। জানার মধ্যে অজানা, চেনার মধ্যে অচেনা, রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানের যে দ্যোতনা রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতার মূল সুর পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গীতিকবিতার জগতে সেই রোমান্টিক ধারারই সার্থক উত্তরসূরী। প্রেম আর প্রকৃতি এখানে কবির ব্যক্তিগত সূক্ষ্ম হৃদয়ানুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে সার্থক রূপ পায় কবিতায়। ৪০-৫০ দশকের বাংলা গান যখন সামগ্রিক ভাবে প্রেমের বিভিন্ন প্রত্যক্ষ অনুভূতি প্রকাশে ব্যস্ত , যার সিংহভাগই আবার বিচ্ছেদ-বিরহ কিংবা প্রেমাষ্পদের প্রেম না পাওয়ার বেদনার হা-হুতাশ, তখন পুলক চেনালেন রোমান্টিকতার প্রকৃত সংজ্ঞা -

এত যে শোনাই গান তবু মনে হয়
যে গান শোনাতে চাই হয় নি গাওয়া।
ফাগুনের কত চিঠি পেয়েছি জীবনে,
পরম লগন আজও হয়নি পাওয়া।

দুচোখে শুধুই নামে ঘুমের আবেশ
এখনও পাইনি তবু স্বপ্নের দেশ
প্রবাল দ্বীপের সেই তীর ছুঁয়ে মোর
মনের তরণী আজও হয়নি বাওয়া।

কবে এই ভাল লাগা ভালোবাসা হবে,
রূপের মাধুরী আরো অপরূপ হয়ে রবে

যেদিন চামেলি শুধু রবে না বনে
সুরভি ছড়ায়ে যাবে আমার মনে
সেদিন নয়ন মেলে মনে হবে মোর
কখনো এমন করে হয়নি চাওয়া।

তুমি-আমির চিরাচরিত গণ্ডীর বাইরে বাংলা গানের এই নতুন কাব্যভাষা শ্রোতাদের কাছে ছিল এক বিস্ময়ের উপহার।

চাঁদের মধ্যে প্রিয়ার মুখ, মেঘের মধ্যে তার চুল, হাওয়ায় তার নিঃশ্বাস - প্রকৃতির মধ্যে প্রিয়ার সৌন্দর্যের প্রতিফলনের বর্ণনার এই বৈচিত্রহীন পৌনঃপুনিকতায় কাব্যরসগ্রাহী শ্রোতারা যখন তিতিবিরক্ত, তখন পুলকের গান বহন করে নিয়ে এল টাটকা হাওয়ার মতো প্রেমের সম্পূর্ণ ভিন্ন অনুভূতি। হারিয়ে যাওয়া, হয়তো বা সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন, প্রিয়াকে কাছে পাবার কল্পনার এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতি ফুটে উঠল পুলকের রচনায়:

হেমন্ত, পুলক ও ভি বালসারা

ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না
ও বাতাস আঁখি মেলো না
আমার প্রিয়া লজ্জা পেতে পারে,
আহা কাছে এসেও ফিরে যেতে পারে।

তার সময় হল আমায় মালা দেবার
সে যে প্রাণের সুরে গান শোনাবে এবার।
সেই সুরেতে ঝর্না তুমি চরণ ফেলো না।
ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না।

প্রেমিক এখানে প্রকৃতির মধ্যে প্রেমিকার সৌন্দর্যের অন্বেষণে আগ্রহী নন। বরং ইন্দ্রিয়-ঘনিষ্ঠ বহিঃপ্রকৃতি যেন তার অনুভূতি-জগতে প্রিয়ার সান্নিধ্যের পথে অন্তরায় হয়ে উপস্থিত। রবীন্দ্রোত্তর যুগে বাংলা গানে প্রেমকে ঘিরে এই অতীন্দ্রিয় অনুভূতির প্রকাশ তুলনা রহিত। এ গান যেন শুধু রবীন্দ্রনাথের গান নয়, স্মৃতি বয়ে আনে তাঁর "ক্ষুধিত পাষাণ" ছোট গল্পেরও - যেখানে একাকীত্বের মুহূর্তে নায়কের নারী চেতনা সার্থক ভাবে রূপায়িত হয়েছে অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জগতে।

স্মৃতি-মেদুরতা রোমান্টিকতার এক অপরিহার্য উপাদান। এলিয়টের ভাষায়, নিষ্ঠুরতম এপ্রিল মাসে স্মৃতি আর বাসনার সংমিশ্রণেই শুকনো, মরা জমিতে ফুটে ওঠে সুন্দর লাইল্যাক ফুল। রোমান্টিক কবির সৃষ্টিতে তাই যুগে যুগে ফিরে এসেছে বিস্মৃতির অতল থেকে উঠে আসা, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির রোমন্থন। পুলকের কাব্যগীতিতেও আমরা বারবার পাই ফেলে আসা স্মৃতির বেদনা-বিধুর, মন-কেমন-করা স্পর্শ। স্মৃতিচারণার বিভিন্নমুখী এবং আশ্চর্য বৈচিত্র্যময় প্রকাশ ছড়িয়ে আছে পুলকের বেশ কিছু গীতিকবিতায়, যেগুলি নিঃসন্দেহে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম।

ফেলে আসা প্রেম যখন বাস্তব জীবন থেকে হারিয়ে গিয়ে পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কবির চেতনায় ফিরে আসে, তখনই তা উত্তীর্ণ হয় সার্থক রোমান্টিকতায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

হারিয়ে যাওয়া কার সে বাণী, কার সোহাগের স্মরণ খানি
আমের বোলের গন্ধে মিশে কানন কে আজ কান্না পাওয়ায়।

এরই সার্থক অনুরণন পুলকের রচনায় :

সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণকলির দিনগুলি যদি থাকত,
এই অলস বেলায় যদি একটি ডাহুক আনমনে আজও ডাকত !

এখনো পদ্মবনে কাঁপন তুলে
চলত উদাসী হাওয়া আপন ভুলে
আর আমার চোখের পাতা তেমনি খুশির রঙ পেয়ে ছবি আঁকত !

আমি সেদিনও বলিনি কিছু, যেমন করে-
আজও সব কথা বলতাম-তেমন করে।

এখনও মুগ্ধ তিথি বয়েই যেত
এ মনে মনের কথা রয়েই যেত
আর তেমনি দুহাত মোর কন্ঠমালাটি মান করে খুলে রাখত !

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সার্থক, মরমীয়া সুর সংযোজনায় এ গানের ভাবানুষঙ্গ শ্রোতারও স্মৃতিতে টান লাগায়। ধূলিধূসরিত, কর্মময় বাস্তব পৃথিবী ছেড়ে তার চেতনাকে নিয়ে চলে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা কোনো স্বপ্ন লোকে।

শুধুমাত্র হারানো প্রেম নিয়েই তো স্মৃতিমেদুরতা তৈরী হয় না। মানুষের স্মৃতি অজস্র ফেলে আসা কাহিনী, অনুভূতি, সুখ-দুঃখ-বেদনা, অজস্র চেনা অচেনা মুখের এক জটিল সমন্বয়। কোনো এক জ্যোৎস্না রাত্রির ঘুম-নিবিড় আলোছায়ার বাতাবরণে কবির চেতনায় এই বহুমাত্রিক স্মৃতির সঞ্চরণও ধরা পড়ে পুলকের রচনায়:

সুর ঝরা এই নিশিরাত,
জোছনার ছায়া ছায়া ঘুম।
মনে মনে এঁকে দিয়ে যায়
স্বপ্নের একি মরশুম।

স্মরণের ধূপ শুধু নীরবে জ্বলে
অতীতের কোন কথা চলেছে বলে।
কার তৃষিত প্রাণের শেষ গানে
বাতাস হয়েছে নিঝঝুম।

জীবনের ছবি কোনদিন
ধূলায় ধূসর যদি হয়
মুছে নিলে সে আনে আবার
হারানো দিনের পরিচয়।

সময়ের নদী যায় যাক না বয়ে
মিলন লগ্ন তবু যায় যে রয়ে
সেই পিয়াসী পথের বুকে কেন
কামনার রাঙ্গা কুমকুম।

স্মৃতিচারণা কখনো কখনো মানুষের আপন ব্যক্তিত্ব কেন্দ্রিক - যা চিরন্তন পরিবর্তনশীল। বিগত জীবনের পূর্ণতা-অপূর্ণতার পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে বিদায় নেওয়া পুরোনো রুচিবোধ বা পুরোনো চিন্তাধারাকে নিয়ে আমাদের যে ফেলে আসা ব্যক্তিত্ব, তাও কখনো কখনো স্মৃতিচারণার ছলে ফিরে আসে আমাদের কাছে - কোনো মেঘলা দিনের অলস অবসরে :

যখন আকাশটা কালো হয়
বাতাস নীরব থাকে
পৃথিবী সময় গোনে বৃষ্টি ঝরার
পুরনো সে দিন ভেবে
কি যে সান্ত্বনা পাই
পুরনো সে বেদনাকে মিষ্টি করার।

মিটবে না কোনোদিন যে চাওয়া,
এ জীবনে হারিয়েছি যে পাওয়া,
তারা সব ফিরে এসে জানায় যে অনুরোধ
সেই খেলাঘর খানি সৃষ্টি করার।
আমার আগের আমি বলে
আমারই দু হাত ধরে,
‘আমায় কি মনে পড়ে?
দেখ তো গো ভালো করে!’

বলবে না কিছু যে গো কখনো
তারই গান শুনি আমি তখনও
কথা তার লিখে রেখে উন্মুখ হয়ে থাকি

সে কথায় নতুনের দৃষ্টি পড়ার -
পুরনো সে বেদনাকে মিষ্টি করার।

যে অপূর্ব কাব্য ব্যঞ্জনায় ওপরের দুটি গানে স্মৃতি চারণার আনন্দ-বেদনা চিত্রিত হয়েছে, তাকে যদি সার্থক কবিতা না বলা যায়, তবে কাকে কবিতা বলে আমাদের জানা নেই!

কবির স্মৃতিচারণায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে কৈশোর প্রেমও - পুলকও ব্যতিক্রম নন :

তুমি এসো,    ফিরে এসো,    যদি আসে    ছেলেবেলা -
দুজনাতে    হবে জেনো    ঘর বাঁধা-   বাঁধা খেলা।

জল টলটল    ঢেউ চঞ্চল    সেই নদী,
সেই কৈশোর    ছুঁয়ে উচ্ছল    হয় যদি
তবে তখনি    দেব ভাসিয়ে    পাতাবাহারের    সেই ভেলা।।

পৌষ পরবের    চো’ত গাজনের    সেই দেশে    
চল একবার    এই আমরা    যাই ভেসে।
বনচম্পার    সেই মালাটি    হোক স্বপ্নেই    গেঁথে ফেলা।।

বাংলা গানে এর তুলনা খোঁজা বৃথা। বরং বাংলা গানের পাশাপাশি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পাঠক, যাঁরা অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যধর্মী উপন্যাস ও ছোট গল্পের সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা অতীনের "ঝিনুকের নৌকা" উপন্যাসটির সঙ্গে গীতিকবিতাটির ভাবগত সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন। স্বতঃপ্রণোদিত কবিতা, বা গীতিকবিতা, এবং বাণিজ্যিক গান রচনার মধ্যে প্রধানতম পার্থক্য সম্ভবতঃ এই , যে কবিতা কবির একক ও একাকী প্রয়াসের ফসল। কিন্তু যেখানে গীতিকার ও সুরকার দুজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, সেখানে গীতিকারের রচনার ওপর সুরকারের ব্যক্তিত্বের প্রভাব পড়তে বাধ্য। সুরকার অনেক সময়েই নিজের চাহিদা অনুসারে গীতিকারকে দিয়ে গান লিখিয়ে নিয়ে থাকেন। এই চাহিদা মূলত: দ্বিবিধ - এক, সুর-নির্ভর, অর্থাৎ যখন সুরকার আগে সুর তৈরী করে গীতিকারকে সেই সুর অনুযায়ী কথা বসাতে নির্দেশ দেন, আর দুই, বিষয়-নির্ভর - অর্থাৎ যেখানে সুরকারের দাবী থাকে গানে কোন বিশেষ ধরনের বিষয় বা ভাবের প্রকাশ। সন্দেহ নেই, গীতিকারের কাছে এ এক যথার্থ প্রতিস্পর্দ্ধা - নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতির উর্দ্ধে উঠে সুর বা বিষয়ের দাবী কে গানের মধ্যে সার্থক ভাবে প্রকাশ অবশ্যই গীতিকবির বিশেষ ক্ষমতার পরিচায়ক এবং সম্ভবত:সেই কারণেই সাহিত্যজগতের কবিরা বাণিজ্যিক গানের জগতে তেমন ভাবে আগ্রহী বা সফল কোনোটিই নন। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় যে এই প্রতিস্পর্ধার মোকাবিলায় সম্পূর্ণ সফল তা তাঁর আধুনিক ও চলচ্চিত্র সঙ্গীতের জগতের গগনচুম্বী সাফল্যই প্রমাণ করে।

সুরকার ও শিল্পী হিসেবে যাঁদের সঙ্গে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘকালীন সংশ্লেষ, তাঁদের মধ্যে প্রধানতম দুই ব্যক্তিত্ব মান্না দে ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়- পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের ভাষায়, যাঁরা ওঁর গীতিকার জীবনের দুই স্তম্ভ - দুজনেরই সাহিত্য ও কাব্য বোধ ছিল অসাধারণ। একই কথা প্রযোজ্য সুরকার নচিকেতা ঘোষ এবং সুধীন দাশগুপ্ত সম্বন্ধেও। তাই নির্দিষ্ট সুরের ওপর কথা লেখা ছাড়াও বহুক্ষেত্ৰেই এঁদের নিজস্ব ভাবনা ও অনুভূতি রূপায়িত হয়েছে পুলকের রচনায়। একেকজন সুরকারের সঙ্গে পুলকের যৌথ উদ্যোগ তাই পুলকের গানের আলোচনায় পৃথকভাবে উল্লেখ-সাপেক্ষ।

যাঁর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সংযোগ পুলকের সাফল্যের অন্যতম অনুঘটক, সেই মান্না দের জন্য পুলকের গান রচনার কথা প্রথমেই উল্লেখনীয়। মান্না দে ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবনের ঘনিষ্ঠতার কথা সর্বজন বিদিত। দুজনের একান্ত আলাপচারিতায় দুজনেরই ব্যক্তিগত জীবনের নানান ঘটনা, নানান অনুভূতির পারস্পরিক আদানপ্রদানের ফলস্বরূপ বাংলা গানের জগৎ সমৃদ্ধ হয়েছে একগুচ্ছ ভিন্ন স্বাদের প্রেমের গানে। পুলক-মান্নার যৌথ প্রয়াসে সৃষ্ট এই গানগুলি বাঙালি শ্রোতার কাছে নিয়ে আসে প্রেমের চিরাচরিত অভিব্যক্তির বাইরে সম্পূর্ণ নতুন অনুভূতির অভিজ্ঞতা, আর ফল স্বরূপ - ব্যাপক জনপ্রিয়তা :

বিখ্যাত ত্রয়ী – পুলক , মান্না, সুধীন

তুমি নিজের মুখেই বললে যেদিন
সবই তোমার অভিনয়
সত্যি কোন কিছু নয়
আমি দুঃখ পেলেও খুশি হলাম জেনে।

আমি মানুষ চেয়ে করেছিলাম ভুল
তুমি ছিলে শুধু রঙ করা পুতুল
আমার ভুল ভাঙ্গাতে ধুলো হয়ে
পড়লে যে তাই ভেঙ্গে।

কিংবা,

তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ - দিতে পারোনি।
কি তার জবাব দেবে ? যদি বলি,
আমিই কি হেরেছি ? তুমিও কি একটুও হারোনি ?

সবুজ পাতাকে ছিঁড়ে ফেলেছো,
ফুলেতে আগুন তুমি জ্বেলেছো।
ফাগুনের সব কেড়ে নিয়েছো -
স্মৃতিটুকু তার কেন কাড়োনি !

এমন আরো অজস্র গান, যা নিছক কাব্যগুণেই বাঙালি শ্রোতার হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে - "হৃদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই " , "জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই", "সেই তো আবার কাছে এলে" - ইত্যাদি জনপ্রিয়তার তুমুল শিখরে আরোহণ করা গান গুলি নিয়ে বাঙালি শ্রোতার কাছে নতুন কোন আলোচনা মাতৃসমীপে মাতৃস্বসা-প্রসঙ্গ অবতারণার মতোই অর্থহীন!

মান্না দের জন্য প্রেমের গানের বাইরে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের গান রচনার জন্যও পুলক চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দুটি এলবাম - "সারা বছরের গান" আর "সারা জীবনের গান" -ছিল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের গানের সংকলন। বাংলার ছটি ঋতুকে ঘিরে এমন রোমান্টিক অনুভূতির প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের পর বাঙালী শ্রোতার কাছে সম্ভবত: প্রথম অভিজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথের ঋতুপর্যায়ের বিভিন্ন গানের ভাব ও শব্দপ্রয়োগের দ্বারা কিছুটা প্রভাবান্বিত হলেও "প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন", "গহন মেঘের ছায়া ঘনায়ে", "স্বপনে বাজে গো বাঁশি", জ্বালাও আকাশ প্রদীপ", "না না যেওনা, ও শেষ পাতা", "কে তুমি তন্দ্রা হরণী " গান গুলি মান্না দের সার্থক সুর ও কন্ঠ দানে বিভিন্ন ঋতুর ভাবানুষঙ্গকে সার্থক ভাবে তুলে ধরে। তবে এদের মধ্যে কাব্যব্যঞ্জনায় অদ্বিতীয় রচনাটি হল -

 

না, না যেও না - ও শেষ পাতা গো শাখায় তুমি থাকো।
ছিলে তুমি, ছিলাম আমি, চিহ্নটি তার রাখো।
উত্তর বায় করুক শাসন, যাক ঘুচে যাক সবুজ আসন,
শেষ বেলাকার অশেষ নিয়ে স্মৃতির ছবি আঁকো।

ওই পাতাটায় অমর হবে তোমার আমার কথা,
পাশাপাশি থাকবে তোলা আনন্দ আর ব্যথা।
বসন্তদিন আসবে যখন ফুল হয়ে নয় ফুটব তখন ;
হিমের রাতের দুঃখ তোমার ভূষণ করে রাখো।

শীতের শুষ্কতার ছবি আঁকার পাশাপাশি শেষ পাতাকে ধরে রাখার আর্তিতে পুলক এখানে অসাধারণ দক্ষতায় মিলিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ এবং ও’ হেনরিকে। শীতের বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ প্রেরণা (উত্তর বায় জানায় শাসন / পাতলো তপের শুষ্ক আসন) সত্ত্বেও ভাবনার অসাধারণত্বে রচনাটি অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পের নায়িকার দৃষ্টিতে কবি বিদায়-উন্মুখ শেষ পাতা ও নিজের অস্তিত্বকে একাত্ম করে ফেলে স্বপ্ন দেখেন শীতের শুষ্কতার শেষে বসন্তের আগমনে নতুন জীবনে নতুন ফুলের আনন্দ নিয়ে ফিরে আসার, আর এই জন্মের রেখে যাওয়া হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা সেই অনাদৃত শিল্পীর আঁকা জীবনের অন্তিম এবং শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি ওই শেষ পাতাটির মতই অমর অক্ষয় হয়ে ইতিহাসের পাতায় রয়ে যাবার ।

"সারা জীবনের গান" এ পাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের চিরন্তন জীবন চক্রে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, মধ্যবয়স আর বার্ধক্যে মানুষের অনুভূতি আর চিন্তাধারার পরিবর্তনের এক সার্থক প্রতিচ্ছবি। মধ্যবয়সের পটভূমিকায় রচিত এই গানটি একবার ফিরে দেখা যেতে পারে:

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয় -
জীবনের কত কাজ সারা হয়ে গেল ,
আরো কত বাকি রয়ে গেল।

কালের তরঙ্গে আমি ভাসলাম,
আমি কাঁদলাম, কেঁদে হাসলাম।

যা পেয়েছি, সবটুকু দিয়ে গেছি এখানে-
কোন ফুল ফুল হবে, কোন ফুল কাঁটা হবে, কে জানে !

তবু সুখ, ভরে বুক- আমি দেখলাম ভোর হল, সন্ধ্যাও এল।

সফলতা-অসফলতায় মেশা সাধারণ মানুষের জীবন। মধ্য বয়সে পৌঁছে তার সান্ত্বনা এইটুকুই, যে ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সামাজিক জীবনের সব আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য হয়তো সে পায়নি, কিন্তু তার নিজের কর্তব্যটুকু,দায়িত্বটুকু পালনে সে কোন ত্রুটি রাখেনি। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় মেশা জীবনের এই সুদীর্ঘ পথ কালের তরঙ্গে ভেসে ভেসে সে সার্থক ভাবেই পাড়ি দিয়ে আসতে পেরেছে। এরই কাছাকাছি ভাব ব্যক্ত হয়েছে আধুনিক বাংলা গানের আরেক সার্থক গীতিকবি মুকুল দত্তের একটি জনপ্রিয় রচনাতেও- "বুঝিনি চলার পথে কি ছিল দেবার / এ পথে নিজের করে কি ছিল নেবার/ জানি চরণ আমার তবু থামেনি কোথাও/ ভেবে কি দিয়েছি আর কি নিয়েছি"।

মান্না দের জন্য ভিন্ন স্বাদের আর একটি অনন্য গীতিকবিতার উল্লেখ না করলে এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সেটি হল সুদীর্ঘ "নীলাম হল শুরু" । এক কল্পিত নীলামঘরের বর্ণনার মাধ্যমে পুলক শ্রোতাকে সম্মুখীন করেন কঠোর বাস্তবের। জীবনের অমোঘ সত্য - তার অনিত্যতা। বিলাস, বৈভব, সুখ, সাচ্ছল্য - এদের কোনো কিছুই জীবনে চিরস্থায়ী নয়। মহাকালের অলঙ্ঘ্য নির্দেশে তা যেমন অযাচিত ভাবে মানুষের জীবনে দেখা দিতে পারে, তেমনি কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই একদিন শূন্যে বিলীন হয়েও যেতে পারে। একদিন ঘর আলো করা বৈভব সামগ্রীর ভাগ্যবিপর্যয়ে ঠাঁই হয় নীলাম ঘরে ;

এই বাটাতেই মেজবাবুর থাকতো মিঠে পান
আর এই যে রূপোর গড়গড়াটায় দিতেন সুখের টান।
আজ দেউলে হয়ে পড়ে গেছে মেজবাবুর দর -
এ খেলা চলছে নিরন্তর।

এমনিভাবেই, কবির কল্পনার নীলাম ঘরে স্থান পেয়েছে আরো বহু ভাগ্যবিপর্যয়ের নিদর্শন :

এই যে দেখুন শখের জিনিস, খুকুর হারমোনিয়াম,
বাবার কোলে বসে খুকু গাইতো কৃষ্ণ নাম।
আজ খুকুর বাবার চাকরি গেছে, নীরব ওদের ঘর ,
এ খেলা চলছে নিরন্তর।

কিংবা

এই টাইপ করার কলটা দেখুন, মালিকানি যার-
ফুটপাথে এই কল চালিয়েই চালাতো সংসার।
আজ দিদিমনির আঙ্গুল ভাঙা - সেই তোলে না ঝড়।
এ খেলা চলছে নিরন্তর।

কিংবা,

পেটের দায়ে বিকোয় কেতাব, মেডেল, উপহার,
পরীক্ষায় যে প্রথম হত, এই ঘড়িটাই তার।
আজ পাশ করা সেই বেকার ছেলে রইল সবার পর -
এ খেলা চলছে নিরন্তর।

শ্রোতার মানসচক্ষে ভেসে চলে ভাগ্যের কশাঘাতে দীর্ণ  কিছু মানুষের মুখের এক মিছিল। এই মিছিলের শেষে কবি তুলে ধরেন জীবনের আরেক অমোঘ, নিষ্ঠুর সত্য - অর্থের বিনিময়ে জীবনের সব কিছুর - এমন কি মানুষের হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি, ভাবাবেগেরও - বিক্রয় যোগ্যতা :

আসুন, নীলাম ডাকুন, কিনে ফেলুন, স্নেহ মায়া সব।
চোখের নেশা, বুকের ভাষা, সুখের অনুভব
হেথা ভাগ্য নিজেই টাকার মালায় হয় যে স্বয়ম্বর -
এ খেলা চলছে নিরন্তর।

জীবনের এই নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি, এক বোবা অনুভূতির সামনে শ্রোতাকে দাঁড় করিয়ে গান শেষ করেন পুলক।

নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে একত্র প্রয়াসেও পুলক রচনা করেছেন বহু অসামান্য গীতিকবিতা। এদের মধ্যে দুটি অনবদ্য গানের কন্ঠ শিল্পী সেই মান্না দে,ই :

ক’ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছো, যে তুমি ভালবাসবে ?
পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কি করে এখানে তুমি আসবে !

হাজার কাজের ভিড়ে সময় তো হয়নি তোমার,
শোনোনি তো কান পেতে অস্ফুট কোন কথা তার।
আজ কেন হাহাকার করো?
সে কথায় ইতিহাস গড়ো?
কি সুখ জলাঞ্জলি দিয়েছ, যে তুমি সুখের সাগরে ভাসবে!

এবং :

আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে নিশুতি রাত গুমরে কাঁদে,
মনের ময়ূর মরেছে ওই ময়ূর মহলেই।
দেখি - মুকুটটা তো পড়ে আছে,
রাজাই শুধু নেই।

এই দরবারেতে ছিল আমার সোনার সিংহাসন,
আমি হাজার হাতের সেলাম পেলাম, পেলাম না তো মন।
আজ মখমলের ওই পর্দাগুলো
ওড়ায় শুধু স্মৃতির ধুলো,
ফুল বাগানের বাতাস এসে আছড়ে পড়ে যেই।

দুটি গানেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমের জন্য চাপা হাহাকার আর আর্তি রূপ পেয়েছে সার্থক কাব্য ব্যঞ্জনায়। পুলকের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, এই দুটি রচনারই প্রেরণা ছিল নচিকেতা ঘোষের জীবনের কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতি- যার অংশীদার তিনি পুলককে করেছিলেন একান্ত আলাপচারিতায়। এর সঙ্গে ছিল প্রেমের গানের জন্য মান্না দের চিরন্তন প্রত্যাশা। সব মিলিয়ে তৈরী হয়েছিল দুটি অমর সৃষ্টি।

নচিকেতা ঘোষের সুরে প্রাণ পাওয়া পুলকের আরো কিছু উজ্জ্বল কাব্যগীতি - "নেবোনা সোনার চাঁপা কনকচাঁপা ফেলে (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়)", "তোমায় আমায় প্রথম দেখা গানের প্রথম কলিতে (মাধুরী চট্টোপাধ্যায়)", "এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না (নির্মলা মিশ্র)"। সেই সঙ্গে আরো অজস্র ছায়াছবির গান - যার কিছু কিছু ছায়াছবির গান পর্যায়ে আলোচিত হবে।

সুধীনবাবুর চাহিদা ছিল মূলত: সুর-নির্ভর - তাঁর দেওয়া সুনির্দিষ্ট সুর ও ছন্দের ওপরেই পুলককে রচনা করতে হয়েছে অধিকাংশ গান। তার মধ্যেই বেশ কিছু গান কাব্যগুণেও সমুজ্জ্বল। তুলনায় কম পরিচিত, অথচ অসামান্য রোমান্টিক (যে রোমান্টিকতার কথা আলোচনার শুরুতে উল্লেখিত হয়েছে) এই গীতিকবিতাটির এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে :

যে কদিন আকাশ জুড়ে
দল বেঁধে যায় হাঁস,
যে কদিন শিমূল তলায় দাঁড়ায় ফাগুন মাস,
সে কদিন দূরকে কাছে চেও -
যা খুশি তাই নিয়ে গান গেও।

পলাশের পাতায় ঢাকা পড়ে,
যে কদিন সূর্য ওঠে ভোরে
সোনা রোদ ঝরলে গায়ে চমকে ওঠে ঘাস।

নিয়মের মন কটা দিন সর্বনাশের ঝোঁকে
ধুলো দিক সব নিষেধের পলকহারা চোখে।

খেয়ালের পক্ষীরাজে চড়ে,
বাঁধা ছক দাও না বদল করে -
এ’ কদিন ভুলেই থেকো সকল অবিশ্বাস।।

সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে একাত্মতার ফসল আরো অজস্র গান - যাদের মধ্যে কাব্যগুণে স্বাতন্ত্র্যের দাবি করা কিছু গান "আমি তার ঠিকানা রাখিনি (মান্না দে)", "চাঁদের আলোয় রাতের পাখি কি সুর শিখেছে (শৈলেন মুখোপাধ্যায়)", "যদি আকাশ হত আঁখি", "না বলে এসেছি, তা বলে ভেবোনা" (আরতি মুখোপাধ্যায়) "এত বড় আকাশটাকে ভরলে জোছনায়" (অরুন্ধতী হোম চৌধুরী), সেই সঙ্গে আরো অজস্র ছায়াছবির গান - যার কিছু কিছু ছায়াছবির গান পর্যায়ে আলোচিত হবে।

সুধীন দাশগুপ্তের সুরে পুলকের রচনা আর একটি গানের উল্লেখ না করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকবে - সেটি হল "আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না"। তুমুল জনপ্রিয় এই গানটি বাংলায় স্বল্পসংখ্যক অনাবিল হাসির গানের অন্যতম। পরবর্তী কালে ছায়াছবিতে ব্যবহৃত হলেও পুলকের নিজের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় গানটি তিনি প্রথমে রচনা করেছিলেন একান্তভাবে মান্না দের জন্যই। মান্না দের বাড়িতে ওনার অপেক্ষায় বসে, থেকে - উনি রান্নাঘরে রান্না করছেন - এই খবর পেয়ে ! পুলকের নিজের স্বীকারোক্তিতে এই গানে ননসেন্সের স্পর্শ এবং ছন্দের ব্যবহার - এই দুই দিক থেকেই উনি সুকুমার রায়ের কাছে ঋণী। স্বাদের ভিন্নতার জন্য গানটির উল্লেখ করা হল। কিন্তু গানটি এতই জনপ্রিয়, যে এ গান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অর্থহীন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য পুলকের গান রচনার ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীয়। মনে রাখতে হবে, যে মান্না দের প্রতিতুলনায়, পুলক কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নিয়মিত গীতিকার বলতে যা বোঝায়, তা ছিলেন না - সেই মর্যাদা পেয়েছিলেন অন্য কোনো গীতিকার। সেই কারণেই বোধহয়, যখনই পুলক সুযোগ পেয়েছেন হেমন্তর জন্য কলম ধরার, নিজেকে প্রমাণের তাগিদে রচনা করে গেছেন কাব্যগুণে সমৃদ্ধ অসাধারণ একেকটি কাব্যগীতি। অবশ্য পুলকের নিজের স্মৃতিচারণা অনুসারে, হেমন্তর কন্ঠের রোমান্টিক মাদকতাও পুলককে প্রণোদিত করেছিল তাঁর জন্য বিশেষ ধরণের রোমান্টিক গান রচনা করতে :

সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায় -
তুমি ভোরের বেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিলে
কৃষ্ণচূড়ার ওই ফুল ভরা গাছটার নীচে ;
আমি কৃষ্ণচূড়ার সেই স্বপ্নকে, আহা দুচোখ ভরে দেখে গেলাম।।

তুমি চলতে চলতে
থমকে গেলে কেন কে জানে -
আমার মনটা ছড়ানো ছিল যেখানে।
আমি দেখলাম, শুধু দেখলাম
আর সুখের কান্না কেঁদে গেলাম।।

কিংবা,

কতদিন পরে এলে একটু বোসো
তোমায় অনেক কথা বলার ছিল
যদি শোনো।

জীবনের যে পথ আমার ছিল
গো তোমার ছায়ায় আঁকা,
সেই পথ তেমনি আছে সবুজ ঘাসে ঢাকা।
চেনা গান বাজল যদি
বেজেই আবার থামবে কেন !

হেমন্তর মরমী সুর ও কন্ঠে এ গানের রোমান্টিক আবেদন বাঙালি শ্রোতার কাছে চিরন্তন। আবার প্রেমেরই গান, কিন্তু একটু ভিন্ন বক্তব্যের :

না যেও না, তুমি যেও না -
থামবে, এ ঝড় থামবে, এখনি বৃষ্টি নামবে,
রুক্ষ এ দিন শেষ হবে।

চেনা আকাশের রঙ যত এখন বদলে গেছে যাক না -
ওখানে পাখিরা পাড়ি দিতে ভাঙ্গবে না হয় কিছু পাখনা।
তবুও নতুন এক নীলাকাশ
ভরবেই কলরবে।

স্বপ্নের পথে যত যাই, স্বপ্ন যাক না তত দূরে
ক্ষতি কি তবুও যদি চলি সব কিছু বাধা ভেঙ্গে চুরে !
আমরা নতুন যেন হয়ে যাই
আমাদের অনুভবে।

বাস্তবের রূঢ়তার পটভূমিকায় প্রেমের অসফলতার পরিপ্রেক্ষিতে এই দৃঢ় আশাবাদ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত কবিতা "দুঃসময়" কে মনে পড়ায় - " মোদের সাক্ষাৎ হল অশ্লেষার রাক্ষসী বেলায়..."।

হেমন্তর সুর ও কন্ঠে রূপ পাওয়া এই গীতিকবিতাটিও নিঃসন্দেহে আলোচনার যোগ্য:

ওগো মেঘ, তুমি উড়ে যাও কোন ঠিকানায়?
কে তোমায় নিয়ে যায় দূর অজানায় –
বলো না আমায়!

আমি নই সেই বিরহী, আমার কাউকে বলার কিছু নেই।
তবু যেন কি বেদনা জমে ওঠে হৃদয়ে -
মনে হয় আমার কেউ কেন নেই সেই অলকায়।

তবু আজ এই লগনে তোমায় একটি বারতা জানালাম-
ব্যথা যদি নাই পাই, এ জীবনে কি পেলাম!

সেই প্রেম কোথায়?
যে সে আমার মনকে কাঁদায় !

উজ্জয়িনীর এক কবি সার্ধ সহস্রাব্দ আগে মেঘকে দূত করে পাঠিয়েছিলেন স্বর্গপুরী অলকায় প্রিয়ার কাছে বিরহী যক্ষের হৃদয় বেদনা বহন করে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আধুনিক মননের মনোবেদনার গঠন অনেক জটিল ও গভীর-মূল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর "উত্তরাধিকার" কবিতায় নতুন প্রজন্মকে দিয়ে যাবার জন্য তাঁর যৌবনের সম্পত্তির তালিকা তৈরী করতে গিয়ে অন্যতম সম্পদ হিসেবে গণনা করেছিলেন "দুঃখবিহীন দুঃখ"-কে, আর পুলক তাঁর রচনায় তুলে ধরলেন, প্রেমহীনতার নয়, প্রেমের বেদনাবিহীনতার বেদনাকে। নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, সমসাময়িক বাংলা গানের প্রচলিত ভাব ধারার চেয়ে এই ভাবনা বহুদূর এগিয়ে।

আর একটি গানে দৈনন্দিন বৈচিত্ৰহীনতার মধ্যে নিজেকে সঞ্জীবিত রাখার আশ্চর্য জীবন দর্শনের প্রকাশ:

 

দিন চলে যায়, সবই বদলায় -
শুধু এই আমার এ মন
যা ছিল থাকে তেমন -
পুরনো হয় না।

কত কি শোনা কথা কত সুখ কত ব্যথা
হারানোর দলেই লেখে নাম
শুধু তুমি যে নাম লিখেছ মুছে যায় না।

দেখি রোজ নতুন চোখে জীবনের নতুন জাগা
বাতাসের ভালবাসায় ফুলেদের কাঁপন লাগা।
এভাবেই বাঁচিয়ে রাখে আমার এই মন আমাকে;
হাসি গান খেলার হয় না শেষ –
আহা, আমিও ভালবাসি - ভোলা যায় না।

এদের পাশাপাশি আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গান - "কোনোদিন বলাকারা অতদূরে যেত কি", "জানিনা কখন তুমি", "চলিতে চলিতে পথে তোমায় দেখে", "তুমি চলে গেলে" - আপন কাব্যগুণে এবং হেমন্তর দরদী কন্ঠে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে চিরকাল।

পুলকের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সংশ্লেষণার ভিত্তিতে দেখতে গেলে অন্য যে সুরকার-শিল্পীর নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি হলেন অখিলবন্ধু ঘোষ - যাঁর অধিকাংশ জনপ্রিয় গানেরই রচয়িতা পুলক। ৫০-৬০ এর দশকে, অর্থাৎ বাংলা গানের তথাকথিত স্বর্ণযুগের সময়ে আপন গায়ন শৈলীর স্বাতন্ত্র্যে অন্যান্য রথী-মহারথী কণ্ঠশিল্পীদের পাশাপাশি নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতি তৈরী করে নেওয়া এই শিল্পী গায়ন ভঙ্গীর দিক থেকে ছিলেন সুধীরলাল চক্রবর্তী বা জগন্ময় মিত্রের মত বিগত দশকের জনপ্রিয় কন্ঠ শিল্পীদের অনুগামী। তাঁর এই বিশেষ গায়ন শৈলীর কথা মাথায় রেখেই পুলক তাঁর জন্য রচিত গানের ভাব ও ভাষায় এনেছিলেন বিগত দশকের স্পর্শ। পুলকের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, অখিলবন্ধুর গাওয়া সম্ভবত: সবচেয়ে জনপ্রিয় গানটি পুলক প্রথমে রচনা করেছিলেন শচীন দেব বর্মণের জন্য, যা নাকি শচীন কর্তার প্রথমে পছন্দ হলেও পরে বিশেষ কোনো কারণে তিনি গাইতে অস্বীকৃত হন। সেই সময় গানটি ‘অন্য কাকে দেওয়া যায়‘ ভাবতে ভাবতে পুলকের মনে আসে অখিলবন্ধুর কথা। অখিলের কন্ঠে গানটি শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের স্বাক্ষর হয়ে রয়ে যায় - গানটি হল "ও দয়াল বিচার কর।"

 

এরপর অখিল বাবু পুলকের বহু গান রেকর্ড করেন যাদের জনপ্রিয়তা আজও অম্লান - যেমন "তোমার ভুবনে ফুলের মেলা", "আমি বলতে ভুলে গেছি", "কেন তুমি বদলে গেছ", "এমনি দিনে মা যে আমার", "কবে আছি কবে নেই"। "এমনি দিনে মা যে আমার" গানটিতে সুধীরলালের জনপ্রিয় গান "মধুর আমার মায়ের হাসি"র প্রতিচ্ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়।

অখিল বাবুর জন্য পুলক তার গানের ভাব ও ভাষায় কিভাবে পরিবর্তন আনতেন, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যে সময় মান্না দে র জন্য পুলক লিখছেন "জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই/ পাছে ভালোবেসে ফেল, তাই দূরে দূরে রই", তারই কাছাকাছি সময় অখিলের জন্য লিখছেন "আমার আকাশ কাঙাল করিয়া পাঠায়েছি মেঘ যত / তোমার কুঞ্জ বীথিকার ফুল ফোটাতে মনের মত"। দুটি রচনার তুলনা করলে প্রথমটির ভাষার আধুনিকতা আর দ্বিতীয়টিতে প্রাচীনতার স্বেচ্ছাকৃত অনুসরণ দৃষ্টি এড়াবার নয়। অখিলবন্ধুর জন্য এই ধরনের ভাব ও ভাষার অবলম্বনে পুলকের একাধারে দূরদর্শিতা ও দুঃসাহসিকতার যুগপৎ পরিচয় মেলে।

আর একজনের সঙ্গে পুলকের দীর্ঘকালীন সম্পর্কের উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি হলেন ভি. বালসারা। এই ভিন্ন ধারার সুরকারের সঙ্গে পুলকের যৌথ সৃষ্টির সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু যে কারণে এই স্বল্পসংখ্যক গান গুলি উল্লেখযোগ্য তা হল গান গুলি সব দিক থেকেই অ -প্রথাগত - যেমন বিষয়বস্তুর , তেমনি কন্ঠশিল্পী নির্বাচনে। তথাকথিত প্রথিতযশা শিল্পীদের বাইরে, তৎকালীন দুই তরুণী প্রতিভা - শ্রাবন্তী মজুমদার আর রানু মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে রূপ পাওয়া এইসব গানগুলির অধিকাংশই বিষয়বস্তুর নিরিখে ছিল অভিনব - কোনো গানে পোষা কুকুরের সঙ্গে একটি বাচ্চা মেয়ের সম্পর্ক ও সেই পোষ্যটির বিয়োগ বেদনা (কুচকুচে কালো সে....বুশি বল,বুশি বল - রানু), কোন গানে বয়ঃসন্ধি তে পৌঁছনো মেয়ের প্রতি মায়ের ব্যবহার (একটি বছর কাটলো, সমুদ্র ফের ডাকলো - রানু) কোনোটাতে দিদির প্রতি তার প্রেমিকের ভালোবাসায় ঈর্ষান্বিত বালিকার মানসিকতা ( আমার চার বছরের বড় দিদির আঁচলে- শ্রাবন্তী) - এই ধরনের অভিনব বিষয় গান গুলিতে যেন এনে দিয়েছিল এক ধরণের টাটকা হাওয়া।

তবে সব রচনাকে অতিক্রম করে যায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তীর দ্বৈত কন্ঠে গাওয়া বাবা মেয়ের গান - "আয় খুকু আয়"। বাবা-মেয়ের সম্পর্কের আবেগ ও উষ্ণতাকে বাংলা গানে এভাবে আগে কোনোদিন নিয়ে আসা হয়নি। এই গানের দুটি পংক্তি - "আরশিতে যখনই চোখ পড়ে যায়/ মনে হয় বাবা যেন বলছে আমায়, "আয়, খুকু আয়"- কাব্যব্যঞ্জনায় শুধু বাংলা গানের জগতে নয়, বাংলা কবিতার জগতেও চিরস্থায়িত্বের দাবি রাখে।

গান রচনার ক্ষেত্রে সুরকার বা গায়কের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের অনুঘটন সংক্রান্ত আলোচনায় ইতি টানবার আগে পুলকের সঙ্গে আর একজন সুরকারের ব্যক্তিগত সম্পর্কের উল্লেখ করা প্রয়োজন - তিনি সলিল চৌধুরী। সবাই জানেন, সলিল একাধারে গীতিকার ও সুরকার - সম্ভবত: রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী যুগের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও সফল। যে সলিল তাঁর পেশাগত জীবনের একেবারে প্রথম যুগে , হাতে গোনা দু-একটি ছায়াছবিতে ছাড়া সারা জীবনে অন্য কোন গীতিকারের রচনায় সুরসংযোগ করেন নি ( অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতাগুলিকে বাদ দিয়ে ), সেই সলিল চৌধুরী রেকর্ডের জন্য একমাত্র পুলকের রচনার জন্যই সুর তৈরী করতে সম্মত হয়েছিলেন। নির্মলা মিশ্রের কন্ঠে গীত সেই ঐতিহাসিক গান দুটি - "এ মন মোর জানিনা" আর "আমার এ বেদন মাঝে তুমি"। পুলকের শিল্পী জীবনে নিঃসন্দেহেই এ একটা উল্লেখযোগ্য অর্জন।

রেকর্ডের আধুনিক গানের প্রসঙ্গ ছেড়ে এবার পুলকের সৃষ্টি জগতের অন্য একটি সাম্রাজ্যে প্রবেশ করা যেতে পারে - ছায়াছবির গানের জগৎ। ছায়াছবির গানে পুলকের বিশিষ্টতার আলোচনায় প্রবেশ করবার আগে ছায়াছবির গান সৃষ্টির প্রাথমিক শর্তগুলি একবার ফিরে দেখা যেতে পারে। সবাই জানেন, ছায়াছবিতে গান প্রযুক্ত হয় বিশেষ কোনো পরিস্থিতির দাবী মাথায় রেখে। সমগ্র কাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বিশেষ পরিস্থিতির মূল্যায়ন এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চরিত্র বা চরিত্র গুলির মানসিকতা বা জীবন দর্শন এই সব কিছুই গানের মাধ্যমে দর্শকের সামনে উপস্থাপনার দায়িত্ব থাকে ব্যবহৃত গানের ওপর। আবার সেই সঙ্গে এই প্রত্যাশাও থাকে যে চলচ্চিত্রের বাইরে, স্বাধীন ভাবেও সে গানের থাকবে এক সার্বজনীন আবেদন - যাতে ঐ বিশেষ ছায়াছবির দর্শন-নিরপেক্ষ ভাবে সাধারণ শ্রোতার কাছেও গানটির আবেদন থাকে অম্লান। বলাই বাহুল্য, এত রকম প্রত্যাশার দাবীকে সন্তুষ্ট করে, সার্থক, কাব্যগুণ সম্পন্ন গীতিকবিতা রচনা করবার জন্য প্রয়োজন বিশেষ ধরনের ক্ষমতা। যে কোন প্রতিভাসম্পন্ন কবি বা গীতিকারের পক্ষে তাই সার্থক ছায়াছবির গান রচনা সহজ করায়ত্ত নয়। বহুক্ষেত্রেই তাই দেখা যায়, গান হিসেবে জনপ্রিয় হলেও চলচ্চিত্রে তার প্রয়োগ বালখিল্য ধরণের হয়ে থাকে, কিংবা বিপরীত ভাবে, চলচ্চিত্রে প্রয়োগ যথাযথ হলেও, চলচ্চিত্রের বাইরে অনেক গানেরই তেমন আবেদন থাকে না।

এই অগ্নিপরীক্ষায় পুলক যে সসম্মানে উত্তীর্ণ , তা ছায়াছবির গানে তাঁর ব্যাপক সাফল্যই প্রমাণ করে। ওপরে উল্লেখিত প্রতিটি শর্তই কিভাবে পুলকের গানে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে তা বোঝানোর জন্য ছায়াছবি থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে আনা যেতে পারে। . . .

"নতুন জীবন" ছবিতে নায়কের (অনিল চট্টোপাধ্যায় অভিনীত) চরিত্রটি ছিল এরকম - ধনী পরিবারের সন্তান যে অভাব কাকে বলে কোনোদিন জানেনি - পরিশ্রম বা অর্থোপার্জনের প্রয়োজনীয়তাও তার কোনোদিন হয় নি। বন্ধু বান্ধব নিয়ে ফুর্তি করে, দুহাতে টাকা উড়িয়ে দিন কাটে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য হল, যতই ফুর্তিবাজ হোক, মানুষটা কিন্তু চরিত্রের দিক দিয়ে খাঁটি। কোনো তথাকথিত লাম্পট্য বা পঙ্কিলতার মধ্যে কখনো থাকে না। নারী সংসর্গ শুধুমাত্র পয়সার বিনিময়ে নাচ গান উপভোগ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ - তার অতিরিক্ত কিছু নয়। এমন একটি চরিত্রের জন্য পুলক রচনা করেন :

লাজবতী নূপুরের রিনি ঝিনি ঝিনি -
ভালো যদি লাগে, তবে দাম দিয়ে কিনি।
ভেবো না ভেবো না, বেশি তো নেব না,
বেহিসেবি ভালোবেসে হব না ঋণী।
জীবনটা আমি বলি উৎসব,
শুধু এক মুঠো জলসার কলরব।
ভেবো না ভেবো না, বেশি তো নেব না -
মায়াপুরী মনে মোর এসো মায়াবিনী।
উড়ন্ত সময়ের সঙ্গে আমার
নেইকো চুক্তি তাই একটু থামার-
কোথাও থামার।

ভাবনার ভীরু ঘর ফেলে তাই,
আমি খেয়ালের রাজপথে ছুটে যাই।
ভেবো না ভেবো না, বেশি তো নেব না -
সোহাগিনী হয়ে এসো লীলাবিহারিণী।

যাঁরা ছবিটি দেখেন নি সেই সাধারণ শ্রোতাদের কাছেও গানটি চূড়ান্ত জনপ্রিয়। আর যাঁরা ছবিটি দেখেছেন তাঁরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করবেন নায়কের সম্পূর্ণ চরিত্রটি সার্থক ভাবে রূপায়িত হয়েছে গানটিতে।

"বালুচরী" ছবিটিতে নায়ক নায়িকার মিলনের পথে অন্তরায় নায়িকার সাংসারিক দায়বদ্ধতা। পিতৃবিয়োগের পর তাদের চার ভাই বোনের সংসারচক্রকে টেনে নিয়ে যাবার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পড়ে নায়িকার (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) ওপর। সেই দায়িত্ব পরিত্যাগ করে নিজের সুখের নীড় বাঁধবার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। নায়ক কিন্তু পরম মমতায় ও ধৈর্যে নায়িকার প্রতীক্ষায় থাকে। নায়কের (এক্ষেত্রেও অনিল চট্টোপাধ্যায়) মানসিকতা অসাধারণ দক্ষতায় তুলে ধরেন পুলক তার রচনায়:

আসবে কখন বন্ধু আমার সেই শুধু ভাবি মনে

আজও হৃদয় আমার পথ চেয়ে দিন গোনে -
আসবে কখন বন্ধু আমার সেই শুধু ভাবি মনে।
জীবন পথের ক্লান্ত দিনের শেষে
কখন তুমি ডাক পাঠালে সে কোন অচিন দেশে -
আহা কান পেতে মন সেই কথাটি শোনে-
আসবে কখন বন্ধু আমার সেই শুধু ভাবি মনে।
স্বপ্ন দেখি তাই, যে গান আমি গাই
রেখে দিলে তুমি তারে মরমের মণিহারে।
অনেক বাধার অথৈ সাগর কূলে
থেমেও যদি বন্ধ খেয়া আবার গেল খুলে ।

তবু তীরের মায়ার জাল কেন সেই বোনে -
আসবে কখন বন্ধু আমার সেই শুধু ভাবি মনে।

এখানেও একই কথা প্রযোজ্য - যারা ছবিটি দেখেন নি - তাঁরা মুগ্ধ হন গানটির রোমান্টিক আবেদনে। আর যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন "অনেক বাধার অথৈ সাগর কূলে" নায়কের ক্লান্ত, একাকী পথ চলা আর হৃদয়ের গভীরে নায়িকার স্বপ্ন নিয়ে চিরন্তন প্রতীক্ষার বেদনা বিধুর অনুভূতি।

"শজারুর কাঁটা" ছায়াছবিটি সকলে না দেখলেও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসটি অন্তত: সবারই পড়া। কাহিনীটি সবারই জানা, তবু ছবির গানের পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য পটভূমিকাটি ফিরে দেখা প্রয়োজন - দেবাশিস দীপাকে বিয়ে করেছিল তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। প্রথম রাত্রেই দীপা দেবাশিসকে জানিয়ে দেয় ,সে অন্যের বাগদত্তা - কেবল পরিবারের গুরুজনদের চাপে দেবাশিস কে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে এবং দেবাশিসের সঙ্গে বিবাহিত জীবন যাপনে সে অক্ষম। দেবাশিসকে সে অনুরোধ করে এতদ্সত্ত্বেও সে যেন দীপাকে পরিত্যাগ না করে, কেননা এতে তাদের পরিবারের সম্মান জড়িত। পরম ভদ্র মানুষ দেবাশিস সব মেনে নেয় । কিন্তু তার অন্তরে ঝড় ওঠে। একদিকে তার শিক্ষা, রুচিবোধ ও ভদ্রতা আর অন্যদিকে তার কামনা-বাসনা - নিজের বিবাহিত পত্নীকে নিজের করে না পাবার হতাশা ও যন্ত্রণা। এই অন্তর্দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত মানুষটির মনস্তত্ত্ব সার্থক রূপায়িত হয় পুলকের কলমে:

সময় কখন যে থমকে দাঁড়াল
কালবোশেখির মাসে
কি যে করে মন জানিনা এখন
ঝড়ের পূর্বাভাসে।

একি দিশাহারা বিভ্রমে
কত মেঘ একে একে জমে,

আলো মুছে যায় ক্রমে ক্রমে-
অন্ধ আবেগ আসে।।
যদি বন্দী আশা দুঃসাহসী হতে চায়,
যদি সব প্রতিরোধ উচ্ছ্বাসে ভেসে যায়,

তবে বৃষ্টির পথ ধরে
মন পড়ুক না ঝরে ঝরে
কোনো সাগরের অন্তরে
সাধের সর্বনাশে।।

রাজেন তরফদারের "জীবন কাহিনী’ ছবিতে অনুপকুমার অভিনীত চরিত্রটির কথা স্মরণ করা যাক। বেকার জীবনের হতাশা, অপমান, আত্মগ্লানি যুবকটিকে প্ররোচিত করে আত্মহননের পথ বেছে নিতে। গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে তার জীবনের অন্তিম পরিকল্পনা চরিতার্থ করবার মুহূর্তে সে প্রতিরুদ্ধ হয় তারই মতো জীবনে অসফল আর এক ব্যক্তির দ্বারা (বিকাশ রায় অভিনীত) - কন্যাকে নিয়ে ছোট্ট সংসারে যার উপার্জন বলতে জীবন বীমার দালালি। মরণোন্মুখ যুবকটিকে সে বাঁচায় মানবিকতার তাগিদে নয়, নিজের স্বার্থে। যুবকটিকে সে অনুরোধ করে সে যখন এই ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, তখন আত্মহননের পূর্বে সে যেন একটি বীমা পলিসি করে যায় এবং বৃদ্ধকে তার "নমিনি" নির্বাচিত করে যায়। সেক্ষেত্রে দালালি এবং বীমার অর্থ - এই দু দিক থেকেই বৃদ্ধ লাভবান হবে। যুবকটি রাজী হয়ে যায় এবং যেহেতু পলিসি করা থেকে মৃত্যুর মাঝখানে কমপক্ষে এক বছরের ব্যবধান না থাকলে বীমার অর্থ পাওয়া যাবে না তাই এই এক বছর বৃদ্ধ যুবকটিকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে রাখে। কিন্তু সেখানে বৃদ্ধের কন্যার সঙ্গে পরিচয় হবার পর দুজনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে যুবকটি জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পায়। যুবকটির মানসিকতার পরিবর্তন সার্থক রূপ পায় পুলকের রচনায়:

তোমার আলোয় চোখ রেখেছি

আমি তোমার মাঝে পেলাম খুঁজে বাঁচার এ নিশানা
তোমার আলোয় চোখ রেখেছি প্রাণের অভিধানে,
নতুন চোখে পড়ে নিলাম এই জীবনের মানে।
আমি ঝড়ের মুখে শপথ পেয়ে সর্বনাশের
নতুন পাতা উলটে গেলাম ইতিহাসের
আমি নতুন আকাশ খুঁজে পেলাম সূর্যের সন্ধানে।
ভালবাসার স্রোতে কখন মিটল পরম তৃষা
পথ হারানো মনকে দিলাম পথে চলার দিশা।
আমি অবিশ্বাসী এই পৃথিবীর বুকের মাঝে
শুনতে পেলাম অঙ্গীকারের কি সুর বাজে
আমি পৌঁছে দিলাম বাঁচার খবর বিস্মিত মোর প্রাণে।

"তিন ভুবনের পারে" ছবিতে শিক্ষিতা এবং পেশায় শিক্ষিকা নায়িকা জীবনে ব্রত নেয় বিপথগামী এক যুবককে নিজের জীবনে গ্রহণ করে তাকে শিক্ষিত শুধু নয়, উচ্চশিক্ষিত করে তুলে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার। কিন্তু যুবকটি তার পুরোনো সংসর্গ. পুরোনো জীবন থেকে নিজেকে অত সহজে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। তার উদ্দাম, নেশাগ্রস্ত জীবন মাঝে মাঝেই অনুপ্রবেশ করে তাদের সাংসারিক জীবনে। নায়িকা তার স্কুলে শিশুদের সামনে গান গায়:

কোনো এক চেনা পথে যেতে যেতে একদিন
পথ বলে অরণ্যে যাব ।
বনের উদ্দাম চঞ্চলতা
চলনা তোমাকে দেখাব।

তখনি ঝড়ের মত চমকে উঠে
বেশ কিছু দূর আমি গেলাম ছুটে
হঠাৎ সামনে এক নদী
বলল সাঁতার দিই যদি
তাহলে ওপারে যেতে পাব।
বনের উদ্দাম চঞ্চলতা
তখনি তোমাকে দেখাব।

ওখানে বাতাস যেন কিসের ভয়ে
পায়ে পায়ে আসে যায় সব সময়ে

হঠাৎ আমাকে একা পেয়ে
সে এল ঘূর্ণিপাক হয়ে
বলল তোমাকে ঘোরাব
বনের উদ্দাম চঞ্চলতা এখনি তোমাকে দেখাব।

তখনি আকাশ ছোঁয়া গাছের ফাঁকে
পুরোপুরি হারালাম আকাশটাকে।
অমনি অরণ্য কাঁপিয়ে
আঁধার পড়ল ঝাঁপিয়ে
কি করে ফেরার পথ পাব?
বনের উদ্দাম চঞ্চলতায়
বুঝিনি সে পথও হারাব।

আপাতদৃষ্টিতে শিশুদের শোনানো অরণ্য ভ্রমণের বর্ণনার পংক্তিগুলির পরতে পরতে অপূর্ব কাব্যব্যঞ্জনায় জড়িয়ে রয়েছে নায়িকার নিজের জীবনের হতাশা। সুখী সচ্ছল স্বাভাবিক বিবাহিত জীবনের "চেনাপথ" ছেড়ে তার পথও তো ঘুরে গিয়েছিল "বনের উদ্দাম চঞ্চলতা"র দিকে। অবশেষে সেই উদ্দাম অরণ্যে শেষ পর্যন্ত যখন আঁধার ঝাঁপ দিয়ে পড়ল, সে উপলব্ধি করল তার আর ফেরার পথ নেই - "বনের উদ্দাম চঞ্চলতায় বুঝিনি সে পথও হারাবো"। কবির নিজস্ব উপলব্ধির গভীরতা কি অসামান্য ভাবেই না এখানে ছবির গোটা গল্পটি তুলে এনেছে!

"ফরিয়াদ" ছবির নায়িকা (সুচিত্রা সেন) এক দুষ্ট লোকের চক্রান্তে বাধ্য হয় স্বামীপুত্র নিয়ে তার সুখী জীবন বিসর্জন দিয়ে হোটেল গায়িকার পঙ্কিল জীবন বেছে নিতে এবং সেই খলনায়কের শোষণের শিকার হতে। এই পঙ্কিলতার যন্ত্রণার মধ্যেও তার মনে একদিন লাগে গোপন আনন্দের ছোঁয়া যখন সে নিজের একমাত্র সন্তানকে দূরে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে এসে মনে করে, তার নিজের জীবনে যাই হোক, সন্তানকে অন্ততঃ সে এই সমস্ত পঙ্কিলতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। যন্ত্রণা-জর্জর বাহ্যিক জীবনে নায়িকার এই গোপন আনন্দ ব্যঞ্জনাময় হয়ে ব্যক্ত হয় হোটেলে গেয়ে চলা তার গানে:

সে আমার বুক ভরানো
ছোট্ট একটা চিঠি
অনেক স্বপ্ন দিয়ে গড়া
সবার মাঝে যায় না তাকে পড়া।

সে যে আমার মুখের হাসি,
আমার চোখের জল,
ব্যথার আলোয় ফোটা
সুখের শতদল।
সে আমার সাধের জীবন, সাধের মরণ,
স্বর্গ বসুন্ধরা।

সে যে হাজার চাঁদের আলো,
হাজার অন্ধ রাত,
বিষের কাঁটা ওগো,
আশার পারিজাত।
সে আমার গোপন প্রাণের আনন্দ আর
হাহাকারে গড়া।

পুলক রচিত ছায়াছবির গানের আলোচনার উপান্তে উল্লেখ করব একটি দারুণ জনপ্রিয়, কিন্তু ভিন্ন স্বাদের গানের- "শঙ্খবেলা" ছবির "আমি আগন্তুক" গানটি। পার্টিতে নায়কের (উত্তমকুমার) মদমত্ত অবস্থায় গাওয়া এই গানটি রচনার সময় ছবির পরিচালক পুলককে নির্দেশ দিয়েছিলেন , যে প্রচলিত ধারা অনুসারে পানোন্মত্ত নায়কের মুখে হয় স্যাটায়ার-ধর্মী , নতুবা হালকা দার্শনিকতায় ভরা - এই দুই ধরনের গানই তাঁর কাঙ্ক্ষিত নয়। তিনি চান নতুন ধরনের কিছু। এই "নতুন কিছু" সৃষ্টির তাগিদ থেকেই পুলক রচনা করেন এই গানটি। এখানেও পুলকের সুকুমার-অনুপ্রাণিত ননসেন্স রচনার ক্ষমতার পরিচয় মেলে। তুমুল জনপ্রিয় এই গানটির কথাগুলি অনুধাবন করলেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। সবার কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত এই কথাগুলি নিয়ে নতুন করে আলোচনা অর্থহীন। . . .

পুলকের গানের জগতে পরিভ্রমণ যেন ছুটিতে সীমিত অবসরে কোথাও বেড়াতে যাবার মতোই। হয়তো সমস্ত দ্রষ্টব্যস্থান গুলি ঘুরে দেখা হয় না- কিংবা দেখলেও যথাযোগ্য সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। তবু ছুটি শেষ হয়, আর কাজের জগতে প্রত্যাবর্তনও অবশ্যম্ভাবী হয়। এক্ষেত্রেও স্থান কালের পরিসীমা আমাদের অনিবার্য যতিচিহ্নের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করে। শেষ করবার আগে শুধু মনে হয় , রবীন্দ্রনাথের একটি লাইন, "অনেক দিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরে আসে" , পুলকের জীবনেও কি সত্য হয়ে উঠেছিল? বহুকাল আগে লঞ্চে গঙ্গা পার হতে গিয়ে বর্ষার ভরা নদীর দিকে তাকিয়ে যিনি লিখেছিলেন,"জলে নেবোনা, আর থৈ পাবে না..জল খেলা খেলো না আর তুমি সহসা" সেই গানই কি প্রৌঢ়ত্বে তাঁর কাছে আবার ফিরে এসে ডাক দিল সেই জলের সাথেই মরণখেলা খেলবার জন্য ? কে বলবে? আমরা, তার মুগ্ধ শ্রোতারা, শুধু "চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে!" যেন নদীর গহীন জলে নয়, কোনো বিষণ্ণ বিকেলে তিনি হারিয়ে গেলেন কোনো অলৌকিক, অবিরল বৃষ্টিধারায় । চলে গেলেন, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে চিরকালের মতো গেঁথে রেখে গেলেন তাঁর গানের সুদৃঢ় প্রত্যয় :

বৃষ্টি ধারায় রং মুছে যায়, ছবি তো মোছে না -
দূরের আকাশ ভোলে যে সুর, পাখি তা ভোলে না।

তথ্যসূত্র:

  • ১) কথায় কথায় রাত হয়ে যায় - পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় (আনন্দ পাবলিশার্স)
  • ২) জীবনের জলসাঘরে - মান্না দে (আনন্দ পাবলিশার্স)
  • ৩) বাংলা গানের পথ চলা - অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (আজকাল প্রকাশনী)
  • ৪) গানের গল্প, গল্পের গান - অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (আজকাল প্রকাশনী)

এছাড়া পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু গানের পরামর্শ দিয়ে এবং গানের কথা লিখে দিয়ে সক্রিয় সহায়তা করেছেন বন্ধুবর শ্রী অভি দত্তশর্মা


লেখক পরিচিত - জন্ম, চেতনার উন্মীলন, শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অতিবাহন - সব কিছু কলকাতায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ তে বৈদ্যুতিক প্রকৌশলে (Electrical Engineering ) স্নাতক। বর্তমানে কর্মসূত্রে গুরগাঁও, হরিয়ানা নিবাসী। পেশাগত জীবনের বাইরে ব্যক্তিগত জীবন বলতে - স্ত্রী ও এক কন্যা সহ পারিবারিক দিনযাপন আর গান-কবিতা-সাহিত্য সমৃদ্ধ বাংলা সংস্কৃতি কেন্দ্রীক নিজস্ব সময় যাপন । অবসর সময়ে সামান্য লেখালেখি - কিছু কবিতা এবং কিছু প্রবন্ধ। প্রবন্ধের প্রিয় বিষয় - বাংলা গান এবং গীতিকবিতা। কবিতা ও প্রবন্ধের প্রকাশ - মূলতঃ বিভাব, প্রমা, মিলেমিশে, একুশ শতকের মতো ছোট-পত্রিকা আর সানন্দার মতো বাণিজ্যিক পত্রিকা।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.