হাওর অধ্যুষিত ভাটি অঞ্চল এবং হুমায়ুন আহমদের
'ঘেটুপুত্র কমলা' -র ঘেটু গান
তপন কুমার রায়
বৈশাখে মাইলের পর মাইল সোনালি রঙের পাকা ধানের ক্ষেত, জ্যৈষ্ঠেই মাইলের পর মাইল বিস্তৃত জলরাশিতে বিচ্ছিন্ন জলবেষ্টিত ক্ষুদ্র দ্বীপাকৃতি গ্রাম, কার্ত্তিক পর্যন্ত, তবে ভাদ্রে সাগরসম বিস্তার। জ্যৈষ্ঠে বর্ষণ ছাড়াও মূলত উত্তরের মেঘালয়ের পাহাড় হতে নেমে আসা হুড়মুড়িয়ে পানি ঢুকে এই সাগরসম হাওরের সৃষ্টি। যোগাযোগ বলতে বর্ষায় নৌকা আর হেমন্তে হাঁটা, ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও’। জ্যৈষ্ঠ হতে আশ্বিন পানি আর পানি, বাকি সময় সবুজ অথবা সোনালী ধানের ক্ষেত এবং মাঝে মাঝে দু একটি বিল। এই হলো হাওর।
হাওরের অনন্য রূপ ফুটে ওঠে বর্ষাতেই। এতদ্দেশের মিঠাপানির মাছের বৈচিত্র্যের অনন্য আধার এই হাওর অঞ্চল। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ৭ টি জেলায় হাওর অঞ্চলের অবস্থান হলেও, প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পানিবেষ্টিত অঞ্চলের জীবনযাত্রার অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জিলার নিম্নাঞ্চল ভাটি অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। বৈশাখে গোলায় ধান তোলার পর অগ্রহায়ণ পর্যন্ত অখণ্ড অবসর। এই সময় গান বাজনা, জারি, সারি, কীর্তন, বাউল, কবি গান -ই ছিল মনোরঞ্জনের একমাত্র মাধ্যম। এ ছাড়া আরেকটি মাধ্যম ছিল ঘেটু গান।
বিস্তীর্ণ জলরাশির প্রতি জীবিত থাকাকালেই কিংবদন্তীতে রূপান্তরিত বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদের ছিল প্রবল অনুরাগ। তার থেকেই ভাটি অঞ্চলের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতির বিলুপ্ত একটি ধারা ঘেটু গানকে উপজীব্য করে সখের বশে তিনি নির্মাণ করেন 'ঘেটুপুত্র কমলা'। এই ঘেটু গানের গানের উৎপত্তি হবিগঞ্জ জিলার জলসুখা গ্রামে যেখানে হুমায়ুন আহমদ তাঁর ছবির শুটিং করেছেন। এ উপলক্ষে তিনি নিজেই শুধু এই গ্রামে গিয়ে থাকেননি, মাঝে মধ্যে তার স্ত্রী এবং শিশু পুত্রকে ও নিয়ে গিয়েছেন। বর্ষকালে শুধু এই জলসুখা নয়, বাংলাদেশের হাওর প্রধান অঞ্চল সমূহের প্রতিটি গ্রাম এক একটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ।
ঘেটু গানের উৎপত্তি, প্রসার ও বিলুপ্তি কৌতূহলোদ্দীপক। সুনামগঞ্জের কৃতি সন্তান শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের (মরমী কবি হাসন রাজা যার মাতামহ) আত্মজীবনী হতে জানা যায় শুরুতে কৃষ্ণ বিরহে অধীর হয়ে স্ত্রী সাজে সজ্জিত হয়ে পুরুষ ভক্তের হৃদয় বিদারক ভাব ভঙ্গিমা প্রকাশই ছিল ঘেটু গান। শুরুতে মন্দিরকেন্দ্রিক হলেও ক্রমে এই ঘেটু গানের জনপ্রিয়তা সাধারণ হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের তরুণদের মধ্যে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। সৌখিন ও পেশাদার ঘেটু দল গঠন হয়। হিন্দুদের কৃষ্ণ পূজার পদ্ধতি হিসাবে এর প্রচলন হলেও কালক্রমে সৌখিন মুসলিমরাও ঘেটু দল গঠন করতে শুরু করে। সুশ্রী চেহারার ছেলেদেরকে তাদের পিতামাতার কাছ হতে রীতিমতো দলিল দস্তাবেজ করে খরিদ করে ঘেটু গানে নাচানো হতো। অবিবাহিত কিশোররা সারাদিন ঘেটু নিয়ে মাতামাতি করতো। ছেলে ছোকরারা বাপের গোলার ধান, গোয়ালার গরু, মায়ের অলঙ্কার গোপনে চুরি করে বিক্রি করে এর আয়োজন করত। বয়স্ক অভিবাদকদের সামাজিক বাধার কারণে গোপনে গভীর রাতে এর আয়োজন হতো। পঞ্চায়েতে ঘেটু গানের সৌখীনদেরকে নাকে খত দিয়ে শাস্তি প্রদান করা হতো।
দুই সম্প্রদায়ের ঘেটু দল প্রতিযোগিতার সময় খাওয়া দাওয়ার বাছ বিচার, বিধি নিষেধ থাকত না। পিতার কড়া শাসনের কারণে দেওয়ান সাহেব কেবল এই গানের কথাই শুনতেন স্বকর্ণে এবং স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাননি। শুধু একদিন তাঁর পিতা মকদ্দমা উপলক্ষে সিলিটে গেলে অনেক দিন লুকিয়ে রাখা দুই ঘেটুকে তাদের পুকুরে স্নান করাতে আনলে মেয়েদের মতো লম্বা চুল, হাতে অলঙ্কার পরিহিত মায়েদের মতো চলা ফেরা, কথা বলা অদ্ভুত দুই কিশোরকে দেখে জানতে পারেন এরাই ঘেটু।
তাঁর উদ্ধৃত একটি ঘেটু গানের কলি এরকম:
কয়ে থাকো যদি ব্যথার কথা
খুলে যাক যদি প্রাণ
নয়নের জলে ভিজায়ে হৃদয়
করে থাকোই যদি দান
এমনি মধুর চাঁদের আলোকে
কম্পিত হৃদি পলকে পলকে
অধরে অধরে পরশ মাখা
সুধা করে থাকো প্রাণ
তবে বধূ এসো হে
ধীরে এসে কাছে বসো হে –
এমন মধুর চাঁদিমা যামিনী
না হতে অবসান।
জনপ্রিয় ঘেঁটুরা ঐ সময়কালীন তারকা মর্যাদা পেত তার প্রমাণ এই যে জনপ্রিয় ঘেটুদের বাঁশি নিলাম হওয়ার নজীরও ছিল।
সুত্রঃ 'যমুনা নিউজ, ময়মন সিংহ', ইউটিউব
আমার নিজের কখনো ঘেটু গান দেখার সুযোগ হয়নি। ক্রমে যাত্রা গান জনপ্রিয়তা পেল। প্রথম দিকে যাত্রা গানেও নারী চরিত্রে পুরুষরাই অংশ নিত। স্বাধীনতার পর আমার এলাকায় দেখি যাত্রা গানে নারীরা সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন, তবে স্থানীয় নয়, মূলত ময়মন সিংহ / ব্রাহ্মণ বাড়িয়া থেকে আসা পেশাদার যাত্রা অভিনেত্রীরা। যাত্রার প্রসারে ক্রমে ঘেঁটু গানের বিলুপ্তি ঘটে। ঘেটু গান প্রায় অবলুপ্ত হলেও এখনো নমুনা হিসাবে বিশেষ বিশেষ পালা পার্বণের অনুষ্ঠানাদিতে তা পেশ করা হয়। হুমায়ুন আহমদের ছায়াছবিতে চিত্রায়িত ‘আমার যমুনার জল দেখতে কাল, সান করিতে লাগে ভালো, যৌবন বসিয়া গেল জলে’ একটি জনপ্রিয় ঘেটু গান। নীচে সেটি দেওয়া হল -
পরিচিতি - জন্ম এবং বেড়ে ওঠা হবিগঞ্জ জিলার এক প্রত্যন্ত হাওর বেষ্টিত গ্রামে। প্রকৌশল বিষয়ে লেখা পড়া, পেশায় ব্যাংকার এবং নেশায় স্মৃতিচারণ ও তা নিয়ে অতি সম্প্রতি ফেস বুকে লেখা লিখি শুরু করা।