বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা

বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা - জানুয়ারি, ১৫, ২০১৭
হেমেন্দ্রকুমার – বাংলা গোয়েন্দা-সাহিত্যের
অন্যতম পথিকৃৎ
ভাস্কর বসু
মুখবন্ধ:
তিনি বাংলা শিল্পজগতের এক বর্ণময় চরিত্র। কিশোর সাহিত্যে তাঁর
অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার কথা আমরা সবাই জানি। এই
লেখাতে
সেটিই আলোচ্য। কিন্তু তার আগে আমাদের দেখে নিতে হবে তাঁর আগের
শিল্পীজীবনটিকে। ব্যক্তিগতভাবে আমার দুঃখ, এমন একজন উঁচু মাপের
প্রতিভা সে ভাবে বাঙালীদের কাছে কল্কে পেলেন না, মোটামুটি জয়ন্ত-মানিক
বা বিমল-কুমারের স্রষ্টা হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকলেন।
সম্প্রতি লেখক বিনোদ ঘোষাল এর ‘হেমেন্দ্র সরণী’তে সুন্দর একটি
শ্রদ্ধার্ঘ্য আছে – যা থেকে জানা যাবে এক সম্পূর্ণ অন্য হেমেন্দ্রকুমারকে,
যিনি নিজের জীবনেই খুঁজছেন রোমাঞ্চ |
“মজার কথা হল, বোহেমিয়ান শরৎচন্দ্রের বেপরোয়া স্বভাবের সঙ্গে
ভালোমতো মিল ছিল হেমেন্দ্রকুমারেরও। সারা জীবনে কত যে ভয়ঙ্কর অভিযান
করেছেন, বলার নয়।ছোটদের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির লেখক হেমেন্দ্রকুমার
রায়ের সেই সব অভিযান কিন্তু মোটেই কিশোরসুলভ ছিল না। বরং রীতিমতো
প্রাপ্তবয়স্ক।
রাতের পর রাত খুঁটিয়ে দেখেছেন কলকাতার বিখ্যাত সব গণিকাপল্লি।
সোনাগাছি, রুপোগাছি, জয়া মিত্রর গলি, আপার চিৎপুর রোড, বউবাজার,
কড়েয়া, হাড়কাটা, হরি-পদ্মিনীর গলি, শেঠবাগান, নতুন বাজার, মহেন্দ্র
গোস্বামী লেন, জোড়াবাগান, মালি পাড়া…!
রাত জেগে জেগে টহল দিতেন, আর দেখে বেড়াতেন গণিকাদের হাবভাব, বাবুদের
রকমসকম। শরীর ব্যাবসার ধরনধারণ। বিচিত্র সে সব
অভিজ্ঞতা। ভয়ানকও। ওঁর সঙ্গীসাথি, এমনকী সাহিত্যিক-বন্ধুরা ছিলেন
ঠিক এমনটিই”। ১
এই অভিজ্ঞতা তাঁকে নিশ্চয়ই অনেক পরিণত করেছিল। তাঁর কাহিনিতে
যে অনেক জায়গার বিস্তারিত বিবরণ পাই তাও খুবই যথাযথ। ওপরের লেখা
থেকে বোঝা যাচ্ছে যে তিনি এই রকম জায়গাতে অনেক রাত কাটিয়েছেন।
চরিত্রগুলিও খুব বাস্তবসম্মত। তাঁর সামগ্রিক শিল্প ও সাহিত্যজীবনে
এর একটা সুদৃঢ়, সুস্পষ্ট প্রভাব রয়ে গেছে।
অন্য ক্ষেত্র :
প্রখ্যাত বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভি বলতেন, তাঁর জীবনের উজ্জ্বলতম
আবিষ্কার আর এক বিশ্বসেরা বৈজ্ঞানিক, ‘মাইকেল ফ্যারাডে’। বাংলার
ও পরবর্তী কালে ভারতের শিল্পজগতের এই রকম কোহিনুর হীরে আবিষ্কার
করলেন হেমেন্দ্রকুমার। তিনি খুঁজে বার করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন
ভারতীয় সঙ্গীতজগতের এক জ্যোতিষ্ককে … শচীন দেব বর্মণ। এর আগে শচীন
দেব তাঁর ‘সানুনাসিক’ কণ্ঠ আর ‘বাঙাল’ উচ্চারণের জন্য গাইবার সুযোগ
থেকে বঞ্চিত হন।
এই তথ্য ক’জনের জানা ? তাঁর আত্মজীবনী ‘সরগমের নিখাদ’ এ শচীন
জানিয়েছেন তাঁর সুরারোপিত প্রথম গানের গীতিকার ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার।
সেই গানটি হল -“ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে মাঠের বাটে যাই!! আর এক
স্মৃতিচারণে প্রেমেন্দ্র মিত্র জানিয়েছেন প্রথম আলাপের কথা। কবি
যতীন বাগচি মশাইয়ের বাড়ীতে তাঁরা আড্ডা মারতেন, আসতেন হেমেন্দ্রও।
একদিন রাত নটার সময় হুড়মুড় করে এসে গেলেন হেমেনবাবু। সঙ্গে মঙ্গোলীয়
ছাঁচের মুখের এক তরুণ। হেমেন্দ্র জানালেন, গানগুলি তাঁর রচনা আর
গেয়ে শোনাবেন সেই তরুণ। সেই প্রথমবার তাঁর গান শুনেই সাহিত্যিকবৃন্দ
মুগ্ধ। বলা বাহুল্য, সেই প্রশস্তি পেয়ে এই তরুণের পথ চলা অনেক
সুগম হয়েছিল। আর সানুনাসিক’ কণ্ঠ আর ‘বাঙাল’ উচ্চারণ – – পরবর্তীকালে
তাঁর ট্রেডমার্ক হয়ে ওঠে । ২
গীতিকার রূপে তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় গান সম্ভবতঃ শিশির ভাদুড়ির
সীতা নাটকের “অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে”। মনে পড়ে মান্না
দে র কন্ঠে এই গানটি পুনর্বার যখন গীত হয়, ততদিনে আমরা বিমল-কুমার,
জয়ন্ত-মানিকের ভক্ত হয়ে গেছি। শুনে ভাবলাম, সত্যি নাকি ? তারপরে
বড়দের কাছে একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, ঠিক কথা।
শিশির ভাদুড়ি ছিলেন তাঁর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ সুহৃদ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের
‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ নামে রচিত শিশির ভাদুড়ির জীবনকাহিনিতে তার বিস্তারিত
বিবরণ আছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সীতা’ নাটক না করতে পেরে শিশিরকুমার
যখন প্রায় হতোদ্যম, তখন হেমেন্দ্রকুমার তাঁকে পরামর্শ ও সাহস দেন
। ‘নাচঘর’ পত্রিকার কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে নিজে নাটক রচনা করতে
পারলেও তিনি সর্বদাই ছিলেন শিশির ভাদুড়ির পাশে। রচনা করেছিলেন
গান, যা নাটকটির অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিল। জাতীয়
নাট্যশালা গড়ার কর্মযজ্ঞেও শিশিরকুমার আর হেমেন্দ্র একসঙ্গে কাজ
করেছিলেন | দেশবন্ধুর অকাল প্রয়াণে সেই কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়।
হেমেন্দ্রর মুখ থেকে এই খবর শুনে খুব ভেঙে পড়েন শিশিরকুমার। ‘নিঃসঙ্গ
সম্রাট’ বইটি সুনীলের অন্যান্য বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত
কাহিনির তুলনায় বেশ নিরেস। কিন্তু হেমেন্দ্র – শিশির সখ্যের যে
মর্মস্পর্শী চিত্র তিনি এখানে তুলে ধরেছেন তা আমাদের, হেমেন্দ্র
প্রেমিকদের, মনে থেকে যাবে।
একবার হেমেন্দ্র যখন খুব অসুস্থ, শিশির খবর পেয়ে বলেছিলেন যে
তিনিও আর বেশি দিন নেই। কথার খেলাপ না করে চলেও গেলেন আর কিছুদিনের
মধ্যেই।
‘নাচঘর’ পত্রিকাটি হেমেন্দ্র সম্পাদনা করতে শুরু করেন ১৯২৫ সাল
থেকে। ‘নাচঘর’ ছিল একটি অতি উঁচু মানের শিল্প-সাহিত্য-বিনোদন সংক্রান্ত
পত্রিকা। বেশ কিছু লেখকের হাতেখড়ি ঐ পত্রিকার মাধ্যমে। বেশ কঠোর
সমালোচনাও করতেন চলচ্চিত্রের।
আর হেমেন্দ্রকুমারের আরাধ্য জীবনদেবতা ছিলেন খোদ রবি ঠাকুর। হেমেন্দ্র
রচনাবলীর ভূমিকা লিখতে গিয়ে তা জানিয়েছেন অন্যান্য লেখক ও তাঁর
গুণগ্রাহীরা। হেমেন্দ্র নাকি মাত্র দু-জনের চরণ স্পর্শ করে আশীর্বাদ
নিয়েছিলেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথ আর অবনীন্দ্রনাথ।
এ ছাড়া সিনেমা জগতের সঙ্গেও তাঁর যোগসূত্র ছিল বেশ ভাল। ১৯৩৫ সালে
জ্যোতিষ মুখার্জী পরিচালিত “পায়ের ধুলো” ছবির কাহিনিকার হেমেন্দ্রকুমার।
তাঁর “যখের ধন” চলচ্চিত্রায়িত হয় ১৯৩৯ সালে। ছবির সঙ্গীত পরিচালক
? তাঁর সেই আবিষ্কার – ‘শচীন দেব বর্মন’। প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্য
সেনগুপ্ত, শিবরাম, বুদ্ধদেব, প্রমুখ কল্লোল যুগের সাহিত্যিকদের
কাছে তিনি ছিলেন অগ্রজপ্রতিম।
সমকালীন বাংলা কিশোর সাহিত্য
হেমেন্দ্রকুমার যখন বাংলা কিশোর সাহিত্যে আসেন, তখন তার আসন
রীতিমতো পাকা। কলম ধরেছেন স্বয়ং রবি ঠাকুর, - তা ছাড়া উপেন্দ্রকিশোর,
অবনীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, যোগীন্দ্রনাথ
সরকার প্রমুখের কলমে কিশোর সাহিত্য নবদিগন্ত স্পর্শ করছে। তাঁরা
লিখেছেন ছড়া, কবিতা, রূপকথা, ঐতিহাসিক, সামাজিক গল্প, হাসি-মজার
গল্প। কিন্তু অভাব ছিল রহস্য- রোমাঞ্চসিক্ত কিশোর সাহিত্যের, যাকে
বলা যেতে পারে অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির। এই অভাব বোধ করেছিলেন অনেকেই।
এবার সেই স্থান পূর্ণ করলেন হেমেন রায়। আর এমন ভাবে করলেন, তা
হয়ে রইল বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদ। ‘মৌচাক’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে
তাঁর প্রথম কাহিনি প্রকাশিত হল… ‘যকের ধন’। ১৯২৩ সালে। সব বাঙালি
ছেলে-মেয়েরা বিমল, কুমার, রামহরির সঙ্গে চলল আসামের জঙ্গলে। পরে
পরেই এল ‘মেঘদূতের মর্ত্যে আগমন’ আর ‘ময়নামতীর মায়াকানন’। আর যায়
কোথায়? জনপ্রিয়তাতে তিনি তুঙ্গে উঠে গেলেন। বাকি সব কিছু ছেড়ে
মন দিলেন কিশোরসাহিত্য রচনাতে। কাজেই বাংলার অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যে
তাঁকে একেবারে ‘পথিকৃৎ’ বলা খুব ভুল হবে না।
লেখক শিবরাম চক্রবর্তী একেবারে নির্দ্বিধায় জানাচ্ছেন,
“বাংলা শিশু-কিশোরদের সাহিত্যকে সেই আদ্যিকালের বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর
জগত থেকে আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন হেমেন্দ্রকুমারই। তারপরে
আমরা সবাই তাঁরই অনুবর্তী।” ---
বিশ্বসাহিত্যে সমকালীন ডিটেকটিভ
/ কিশোর অ্যাডভেঞ্চার গল্প :
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে বিশ্ব-সাহিত্যের এই অঙ্গনটিও
একবার ঘুরে দেখা যেতে পারে। এর আগেই এসে গেছে ফরাসি সাহিত্যিকদের
কলমে অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্য, এসে গেছে আলেকজান্ডার দুমা বা জুলে
ভার্নের হাত ধরে, উনবিংশ শতাব্দীতে। এর পরে এসেছেন এইচ জি ওয়েলস,
মার্ক টোয়েন, রবার্ট লুই স্টিভেনসন প্রমুখ।
রহস্য সাহিত্যের সূচনা হয়ে গেছে এডগার এলেন পোর হাত ধরে। বিংশ
শতাব্দীর শুরুতেই এসে গেছেন সবার প্রিয় ‘শার্লক হোমস’। এসে গেছেন
এলিস, টম সইয়ার, টারজানের মত চরিত্ররাও। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে
সেভাবে কিছু নেই।
এইখানেই সেই আজব কাণ্ড ঘটালেন হেমেন্দ্রকুমার। এ কথা অনস্বীকার্য
যে তাঁর লেখাতে বহু বিদেশি গল্পের প্রভাব আছে। কিন্তু তা পরিবেশিত
হল একেবারে দেশজ ভঙ্গিতে ও ভাষায়। বিমল-কুমার বা জয়ন্ত-মানিক -
এদের কে দেখে কখনোই মনে হবে না যে আমাদের অপরিচিত। আর বুড়ো চাকর
রামহরি? এই চরিত্র কিন্তু বিদেশি অ্যাডভেঞ্চারে নেই। এর জন্য হেমেন্দ্র
অনুপ্রেরণা পেলেন বাংলা সাহিত্যের কাছেই। রবিঠাকুর, শরৎচন্দ্র
বা অন্যান্য অনেক লেখকের লেখাতে এই রকম চরিত্র আছে। ‘রাইচরণ’ (খোকাবাবুর
প্রত্যাবর্তন) বা ‘বেহারী’ (চরিত্রহীন)র মতো অনেক ‘পুরাতন ভৃত্য’রা
বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত। সম্পর্কটা অনেকটা অভিভাবকের
মতোই। এইভাবেই দেশজ উপাদান আমদানি করে অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিকে একেবারে
বাঙালি ‘মরমে পশিয়ে’ দিয়ে তাদের মনপ্রাণ আকুল করলেন।
হেমেন্দ্রকুমার – কিশোর সাহিত্য
– থ্রিলার ও গোয়েন্দা গল্প :
এবার আমরা একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই তাঁর গোয়েন্দা সাহিত্য
নিয়ে। কারণ আমাদের এই গোয়েন্দা সংখ্যার এটিই মূল বিষয়।
আগেই বলেছি মাসিক “মৌচাক” পত্রিকাতে যখন প্রকাশিত হতে শুরু করল
‘যকের ধন,’ তখন থেকেই কুকুর বাঘা ও
অভিভাবক
কাম ভৃত্য রামহরিকেও ভালোবেসে ফেলল বাংলার পাঠক পাঠিকারা । আসলে
সেই সময় বাংলাতে কিশোর কাহিনি কিছু লেখা হলেও ঠিক অ্যাডভেঞ্চার
বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না। সেই স্থান পূর্ণ করলেন হেমেন রায়। যকের
ধন ছিল আসামের জঙ্গলে। কুমার তার বাড়ীতে ঠাকুরদাদার মৃত্যুর পর
সেই সাংকেতিক ভাষায় লেখা গুপ্তধনের সন্ধান পায়। ঠাকুরদা গুপ্তধনের
সন্ধান দিয়ে গেছেন খাসিয়া পাহাড়ে। কুমার সন্ধান পেয়েই গেল তার
প্রাণের বন্ধু বিমলের কাছে। বয়সে সে কুমারের চেয়ে একটু বড়। তার
ওপর দৈহিক শক্তি ও বুদ্ধিমত্তাতেও সে কুমারের শ্রদ্ধার পাত্র।
কাজেই কুমারের মনে হয়েছিল তার বন্ধু নিশ্চয় এই সংকেতের অর্থোদ্ধার
করতে পারবে। এই দুই চরিত্রের মাধ্যমেই শুরু হল হেমেন্দ্রকুমারের
জয়যাত্রা।
এ কথা ঠিক যে এই অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন বিদেশি সাহিত্যের
কাছ থেকেই। শার্লক হোমস আর ওয়াটসনও দুই বন্ধুই ছিলেন। আসলে কাহিনিতে
দুটি চরিত্রের বাক্যালাপের মাধ্যমে গতি বাড়ানো সম্ভব। আবার লেখক
চরিত্র অনেকটা যেন পাঠকের মনের ভাব বুঝে অন্য গোয়েন্দা বা নায়ককে
প্রশ্ন করে সমাধান বুঝে নেয়। বিদেশি সাহিত্যে থাকলেও বাংলা সাহিত্যে
এই রকম জনপ্রিয় জুটি তিনিই প্রথম তৈরী করে ফেললেন। বিমল এখানে
শুধু বুদ্ধিমান আর সুদেহীই নয়, সে অনেক বেশি অনুসন্ধিৎসু এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ।
পক্ষান্তরে কুমার যেন এক্কেবারে বাঙালি কিশোর, তার মনে দুর্গম
জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও মনে ভয় আর আশঙ্কাও আছে। সে বিমলকে
স্মরণ করিয়ে দিতে ছাড়ে না, “ডানপিটের মরণ যে গাছের আগায়।” যকের
ধনের সন্ধানে গিয়ে বিপদে পড়ে যখন বিমলের প্রাণ সংশয়, কুমার ফিরে
আসতে চাইছিল। কিন্তু বিমলের ‘কাপুরুষ’ গালাগালি শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও
তাকে নিরস্ত হতে হয়। এদের সঙ্গে রামহরি আর বাঘা থাকার ফলে কাহিনি
বেশ বহুমাত্রিক হয়ে গেল। চারজনের কথাবার্তা, ভয়-ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা,
উদ্দীপনা - সব কিছুই আলাদা।
কুমার যেহেতু ভাবুক প্রকৃতির, তাই তার বর্ণনাতে যাত্রাপথের সৌন্দর্যও
সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গার ভৌগোলিক বর্ণনা
ও চরিত্র, সেখানকার নদ-নদী, গাছপালা চমৎকারভাবে মিলেমিশে গেছে।
মনে হয় হেমেন্দ্রকুমার তাঁর চরিত্রদের তাঁর প্রাণের মানুষ রবি
ঠাকুরের মত ‘পথের প্রান্তে’ শুধু গুপ্তধনের সন্ধান না করে, ‘পথের
দুধারে’ ছড়িয়ে থাকা ‘দেবালয়ে’রও সন্ধান দিতে চান। ছোট্ট একটি বিবরণ
দেওয়া যেতে পারে -
“জানলার বাইরে আমার চোখ গেল। নিঝুম রাতের চাঁদের আলো মেখে স্বর্গের
মতো খাসিয়া পাহাড়ের স্থির ছবি আঁকা রয়েছে। চমৎকার, চমৎকার! শিখরের
পর শিখরের উপর দিয়ে জ্যোৎস্নার ঝরনা রুপোলি লহর তুলে বয়ে যাচ্ছে,
কোথাও আলো কোথাও ছায়া – ঠিক যেন পাশাপাশি হাসি আর অশ্রু। বিভোর
হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলুম – এমন দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি।”
বিভোর হয়ে তা পড়ে মুগ্ধ হলেন বাঙালি পাঠক, ভাবলেন –কই, এমন লেখা
তো আমরা আগে আর কখনো পড়িনি।
গোয়েন্দা কাহিনিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র নিঃসন্দেহে জয়ন্ত আর
মানিক। এই দুই বন্ধুর কাছে ক্রাইম পেশা নয়, নেশা। এতেই তাদের মজা।
এদের কাহিনিতে আছেন পুলিশ ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু। তাঁর সেই বিখ্যাত
“হুম” আমাদের মন কেড়ে নিত।
জয়ন্তের বিভিন্ন কীর্তি কাহিনির মধ্যে আমার সবথেকে প্রিয়, ‘জয়ন্তর
কীর্তি’। কেন, তা বিস্তারিত বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। এই কাহিনিতে
যেভাবে হেমেন্দ্রকুমার বিজ্ঞানের অবতারণা করেছেন তা একেবারে বিস্ময়কর।
এই কাহিনির প্রকাশ বিংশ শতকের তিনের দশকে। ক্রাইমের যে মূল পাণ্ডা,
সেই ভবতোষ মজুমদার এক রীতিমত পণ্ডিত ব্যক্তি। একই সঙ্গে আবার তিনি
বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। যে পদ্ধতি অবলম্বন করে তিনি ক্রাইমগুলি
ঘটিয়েছেন, তা একেবারে অভূতপূর্ব। এমনকী জানা গেলেও ভবতোষকে হাতেনাতে
ধরতে গিয়ে চূড়ান্ত ভাবে নাকাল হতে হয়েছে জয়ন্তকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও
সে যে সফল হতে পেরেছে, তার কারণ আবার তার নিজস্ব পাণ্ডিত্য। ছোট
করে কাহিনিটি বলে নিলে আলোচনার সুবিধে হবে, তাই একটু বলে দিচ্ছি।
কলকাতা শহরে একবার এক দুর্দান্ত ডাকাতের দলের উদয় হল। পরপর কয়েকজন
ধনী লোকের বাড়িতে ডাকাতি হল। এদের কাজ করবার পদ্ধতি ভারী অভিনব।
জানলার মোটা গরাদ বাঁকানোর জন্য এরা ব্যবহার করেছে oxy-Acetylene
Torch. একজন মানুষকে অজ্ঞান করার জন্য ব্যবহার করেছে হাইড্রোজেন
– আর্সেনাইড নামে একটি বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস। চোরেরা আবার সেই
গ্যাসে নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, কারণ তারা গ্যাস- মুখোশ পরে
থাকে। কলকাতা পুলিশের ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু জয়ন্তর শরণাপন্ন হলেন,
প্রথমে অনিচ্ছায়, পরে একরকম প্রায় নিজের মান বাঁচাতে। যখন জয়ন্ত
কিছুটা এগোচ্ছে, তার জীবন বিপন্ন হল। জয়ন্তর প্রাণনাশের চেষ্টা
হল, তাও আবার হাইড্রোজেন আর্সেনাইড ভর্তি বাল্ব দিয়ে। আবার তার
ঘরে এক বড় অজগর সাপ ঢুকিয়ে। আচ্ছা, অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছে নাকি?
তিন-চারের দশকে একজন কিশোর সাহিত্যিক গোয়েন্দা কাহিনি শোনাচ্ছেন
এরকম বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে? লেখার গুণ এমনই, যে তা ক্ষুদে পাঠকরা
গোগ্রাসে গিলছে। অর্থাৎ হেমেন্দ্রকুমারের দুটি জিনিষের ওপর আত্মবিশ্বাস
ছিল প্রবল, নিজের লিখনশৈলী আর পাঠকদের গ্রহণক্ষমতা।
এই ডাকাতের দলকে ফাঁদে ফেলার জন্য জয়ন্ত অদ্ভুত এক ফাঁদ পাতল।
নকল নবাব সাহেব সাজিয়ে এক পুলিশ কর্মচারীর বাড়িতে প্রচুর সোনা-দানা,
হীরা-জহরৎ রাখার ব্যবস্থা হল। ফলাও করে সেই খবর কাগজে ছাপা হল।
চোরের দল হানাও দিল, কিন্তু শিকার ফস্কে গেল সুন্দরবাবু এক হাঁচিতে।
কিন্তু ডাকাত দলের একজন অকুস্থলে মারা গেল। সেই ব্যক্তিকে দেখে
তো পুলিশের চক্ষু চড়কগাছ – প্রায় কুড়ি বছর আগে এক মৃত ব্যক্তির
সঙ্গে তার অদ্ভুত মিল। পরে খোঁজ করে জানা গেল, মৃত অপরাধী মারা
যায়নি, নিহত ব্যক্তিই সেই কুখ্যাত অপরাধী মহাদেও কাহার। কিন্তু
সে যখন জেল ভেঙে নিরুদ্দেশ হয়, তখন তার যা বয়স, সাতাশ-আঠাশ বছর
পর যখন সুন্দরবাবু তাঁকে দেখলেন তার চেহারাতে কোন রকম পরিবর্তন
নেই। এর আগে আর এক অপরাধী বলরাম চৌধুরী সম্পর্কেও এরকম তথ্য পাওয়া
গিয়েছিল। কীভাবে সম্ভব এই অবাস্তব ঘটনা?
ঘটনাচক্রে জয়ন্ত ভবতোষের কীর্তি জেনে ফেলল। ভবতোষ শৌখিন মানুষ,
তার একটি বজরা ছিল তার কাজের জায়গা। সেখানে জয়ন্ত বন্দী হল আর
দেখে ফেলল কাঁচের কফিনে শোয়ানো দুই মৃত শরীর। তারপরে বেশ পড়াশুনো
করে সে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছল, তা একেবারে অভাবনীয়।
এই সময় মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপন (Organ Transplantation) এবং
উন্নত প্রজনন বিদ্যা (Eugenics) নিয়ে কাজ করছিলেন এলেক্সিস ক্যারল।
রকফেলার ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক ১৯১২ সালে নোবেল পান। নোবেল
কমিটি জানিয়েছেন, তাঁর নোবেল পাওয়ার কারণ ছিলঃ
“The Nobel Prize in Physiology or Medicine 1912 was awarded
to Alexis Carrel "in recognition of his work on vascular
suture and the transplantation of blood vessels and organs".
৪
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও শল্য চিকিৎসার মান খুব অনুন্নত ছিল।
এলেক্সিস ক্যারল- এর নেতৃত্বে তার দারুণ মানোন্নয়ন হয়। নোবেল প্রাইজ
তারই স্বীকৃতি। এর পরে রকফেলার-এ আরও গবেষণা শুরু হয়। ভাবা হয়,
যে উদ্ভিদের মত মানুষের জীবনকেও কি নীরোগ, সুস্থভাবে দীর্ঘ করা
সম্ভব? এলেক্সিস ক্যারল-এর ছাত্র Serge Voronoff বা Eugen Steinach
এর মতো বিজ্ঞানীরা কাজ করে চলেছিলেন পুনর্যৌবন (Rejuvenation)
নিয়ে।
রকফেলার ইউনিভার্সিটির ক্যারল আর তাঁর ছাত্রবৃন্দের কাজকর্মের
খতিয়ান পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে। --- ৫
ভবতোষ এই চিকিৎসার খোঁজ পায়। এই পদ্ধতি সে প্রয়োগ করে পুরোনো
অপরাধীদের কাজে লাগিয়ে মস্ত ক্রাইম ঘটাতে। সুবিধে হল যে দাগী আসামীর
খোঁজ পাওয়া যায়, আবার সে ডুব দেয়। ব্যস, পুলিশ আবার বিভ্রান্ত।
সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর হল :
o ১৯১২ সালে এলেক্সিস ক্যারল নোবেল প্রাইজ
পেলেন
o গবেষণা সংক্রান্ত খবর আসতে শুরু করে তিনের দশকে
o হেমেন্দ্রকুমার বিজ্ঞানের শিক্ষক বা কর্মী নন, মূলত তিনি শিল্পজগতের
লোক
o তিনের দশকে (১৯৩৭) কিশোর গোয়েন্দা কাহিনিতে সমসাময়িক বিজ্ঞানের
ছোঁয়া থাকা বিস্ময়কর
o এই সময় কিশোর কিশোরীদের মধ্যে সেভাবে বিজ্ঞান পত্রপত্রিকা পাঠের
প্রচলন নেই
o এ সব সত্ত্বেও তিনি নির্দ্বিধায় ‘জয়ন্তর কীর্তি’ তে এই আধুনিক
বিষয়ের অবতারণা করলেন, আর জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গেলেন
নিজের লেখনীশক্তির ওপর এবং পাঠকমণ্ডলীর ওপর কতটা আত্মবিশ্বাস
থাকলে এত বড় কাজ করা যেতে পারে ? আর কোন রকম আজগুবি কল্পনা নয়,
বাস্তবিক ভিত্তির ওপরে রচিত একটি কল্পকাহিনি। কী পরিমাণ নিষ্ঠা, চর্চা থাকলে সেই সময় (সেই চল্লিশের
দশকে, যখন ইন্টারনেট, কেবল টিভি, অন্যান্য মাধ্যম একেবারেই সুলভ
নয়) শুধু গ্রন্থ ও পত্রিকা পাঠ করে, তার তাৎপর্য অনুধাবন করে তার
মোক্ষম প্রয়োগ করে দেখানো যায়? একটু অবশ্য দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন
| জয়ন্ত যখন সুন্দরবাবু আর মানিককে এক দীর্ঘ বক্তৃতার মাধ্যমে
বোঝানোর চেষ্টা করছিল, সেখানে তিনি ‘ফুট’ কাটলেন। মানে যাকে বলে
একটি ছোট্ট ফুটনোট রেখে পাঠকদের অনুরোধ করলেন এই বক্তৃতা অংশটি
যেন তাঁরা বাদ দিয়ে না যান। ব্যস, এটুকুই। এর সাফল্য নিশ্চয় তাঁকে
অনুপ্রাণিত করে থাকবে | পরবর্তী কালেও অব্যাহত রেখেছেন বাংলা কিশোর
সাহিত্যের গোয়েন্দা কাহিনিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের ধারা।
হেমেন্দ্র বিরচিত আরো একটি গোয়েন্দা কাহিনির নাম ‘অন্ধকারের বন্ধু’।
এই কাহিনিতে এল আর এক নতুন গোয়েন্দা,
হেমন্ত
আর তার সঙ্গী রবিন। হেমন্ত জয়ন্তের থেকে আরো পরিণত। সে বিজ্ঞানে
এম এসসি পাশ করেছে সসম্মানে। ইউরোপের চারটি দেশের পুলিশ, ইংরেজ,
ফরাসী, জার্মান ও অস্ট্রিয়ান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের ব্যাপারে
সবচেয়ে পটু। গোয়েন্দাগিরিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সর্বাধুনিক প্রয়োগ
সম্পর্কে হাতে কলমে কাজ করবার জন্য হেমন্ত এই চারটি দেশ এবং আমেরিকা
ঘুরে এসেছে। সে প্রত্যক্ষভাবে অপরাধীদের সঙ্গে মেলা মেশা করার
জন্য ছদ্মবেশে বিভিন্ন অস্থানে কুস্থানে ঘোরাফেরা করে। নিজের বাড়িতে
সে বানিয়েছে ছোট একটি ল্যাবরেটরি, তার পাশেই একটি বড় গ্রন্থাগার।
পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, আবার বিভিন্ন রকম বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকাও
সে নিয়মিত পড়ে।
‘অন্ধকারের বন্ধু’ র শুরুতেই দেখি হেমন্ত রবিনকে বোঝাচ্ছে হাতের
ছাপের গুরুত্বের কথা। সাজাহানের সময় পাঞ্জার ছাপ দিয়ে মোহর দেওয়া
হত, কারণ প্রত্যেকের পাঞ্জার ছাপ আলাদা আর তাই এই ছাপ তার নিজস্ব
চিহ্ন। হাতের লেখা বা সই জাল করা গেলেও পাঞ্জার ছাপ নকল করা যাবে
না। উইলিয়াম জেমস হার্শেল ১৮৭৭ সালে বাংলা পুলিশে প্রথম আসামীদের
হাতের ছাপ নেওয়া শুরু করলেন। এখানে একটি ভীষণ জনপ্রিয় ছবির সংলাপ
উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না :
- উইলিয়াম জেমস হার্শেল কে ছিল? উইলিয়াম জেমস হার্শেল?
- ইংলিশম্যান, আই সি এস। একসময় বাংলাদেশে পোস্টেড ছিলেন। ১৮৮০
সালে ইংল্যান্ডের ‘নেচার’ পত্রিকায় তাঁর একটা চিঠি বের হয়। আঙুলের
ছাপ থেকে যে অপরাধী ধরার একটা উপায় হতে পারে এই চিঠিতেই তা প্রথম
জানা গেল।
ছবির নাম ‘সোনার কেল্লা’ আর পরিচালক সত্যজিৎ রায়। আসলে যে চিঠিটির
কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তা হার্শেল লিখেছিলেন তা আর এক প্রবন্ধকার
হেনরী ফল্ডস -এর একটি প্রবন্ধের প্রত্যুত্তরে। ফল্ডস ছিলেন এক
স্কটিশ পদার্থবিদ। জাপানে বসে তিনি কাজ করছিলেন। ১৮৮০ সালে তিনি
নেচার পত্রিকার এক প্রবন্ধে জানান যে তিনি হাতের ছাপ নিয়ে কিছু
কাজ করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে অপরাধী ধরার ক্ষেত্রে এটি সহায়ক হতে
পারে। এর উত্তরে চিঠি এবং প্রবন্ধ লিখে হার্শেল জানান, যে তিনি
১৮৬০ সাল থেকেই এই নিয়ে কাজ করে আসছেন, অনেক ছাপ নিয়েও ফেলেছেন,
কাজেই তাঁকেই এই বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। পরে তিনি একটি বইও
প্রকাশ করেন।৬
হেমন্তর চরিত্রচিত্রণ সম্পর্কে একটি কথা মনে না এসে পারে না।
গোয়েন্দা কাহিনির রচয়িতা নিজের সৃষ্ট গোয়েন্দার মধ্যে নিজেকেই
খুঁজে পেতে চান। শরদিন্দু ব্যোমকেশ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘অনেকটা
Self-Projection’ বলতে পারেন’। সন্দীপ রায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
বিভিন্ন আলোচনাতে জানিয়েছেন যে স্বয়ং সত্যজিৎই হলেন আসল ফেলুদা।
এখানে হেমন্তর মধ্যেই যেন আমরা ‘হেমেন্দ্র’কে খুঁজে পাই। শুধু
নামের মিল নয়,- অপরাধীদের সম্পর্কে মেলামেশা করার প্রবণতা, অভিজ্ঞতার
লোভে নির্দ্বিধায় তথাকথিত কুস্থানে যাওয়া, পড়াশুনোর স্পৃহা, বিজ্ঞানের
অদম্য কৌতূহল বা অপরাধী ধরার জন্য বিজ্ঞানের প্রয়োগ, - সব কিছুতেই
যেন মনে হয় হেমেন্দ্র নিজেই হেমন্তর ছদ্মবেশে কাজগুলি করে চলেছেন।
এখানে একটি সংযোজন আবশ্যক মনে হয়। সেই সময়, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর
দুই বা তিনের দশকে কলকাতা পুলিশের বেশ নাম ছিল। তাদের প্রায়শই
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হত। সম্ভবতঃ সেই সমস্ত কাজের
সঙ্গেও হেমেন্দ্র বিশেষ পরিচিত ছিলেন। ‘উইলিয়াম জেমস হার্শেল’
এর উল্লেখ তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু তুলনাতে বাঙালী পুলিশরা
সেই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতিতে নিজেদের ঠিকভাবে সড়গড় করে তুলতে
পারেননি। এ ছাড়া তাঁরা নিজেদের দৈহিক কর্মক্ষমতার নিয়মিত অনুশীলন
নিয়েও খুব বেশি অভ্যস্ত নন। সুন্দরবাবু কিছুটা তারই প্রতীক, তবে
শিল্পের খাতিরে কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জন তো থাকবেই। এছাড়া মানিক আর সুন্দরবাবুর
ঝগড়াও কাহিনিকে তীব্র অনুসন্ধানের মাঝে বেশ অন্যরকম স্বস্তি দেয়।
‘অন্ধকারের বন্ধু’ কাহিনিতে যাঁকে অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করে,
তিনিও পণ্ডিত ব্যক্তি, ডাক্তার, রসায়ন নিয়ে গবেষণা করেন, কাগজে
প্রবন্ধ লেখেন কিন্তু নৃশংস মানুষ। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তিনি খুন
করেন টাকার লোভে। এই খুনের তদন্তে নেমে হেমন্ত ধুলোর উপযোগিতাও
বোঝায়। ধুলো নগণ্য হলেও তার অগম্য স্থান কিছু নেই। কাজেই নখের
ফাঁকে বা চুলের ভিতর পাওয়া ধুলো পরীক্ষা করে অপরাধী, তার সঙ্গী
বা অপরাধের শিকার (Victim) সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
বিশেষ করে তার কোথায় যাতায়াত বা কাদের সঙ্গে মেলামেশা – এই সমস্ত
খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যা হয়তো তার ঘনিষ্ঠ জনেরও অজ্ঞাত, তা সংগ্রহ
করা সম্ভব হয়।
এই পদ্ধতিতে চোর পাকড়াও করার গল্প শুনিয়েছেনও তিনি। সে গল্পের
নাম ‘একপাটি জুতো’। সেখানে গোয়েন্দা অবশ্য জয়ন্ত। চোর জুতো ফেলে
গেছিল আর জুতোর ধুলোর মধ্যে খুব সূক্ষ্মভাবে মিশে ছিল শাঁখের গুঁড়ো।
তার থেকেই জয়ন্ত ‘শাঁখারি’ অপরাধীর সন্ধান পায়।
‘অন্ধকারের বন্ধু’ কাহিনিতে খুনী মানুষটি তাঁর রসায়নের শখ মেটাতে
বাড়িতে বিরাট বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার খুলে বসেছেন। তিনি পুরোনো পাপী,
জালিয়াত। সেই ল্যাবরেটরি বানাতে গিয়ে তিনি প্রায় ফকির। কাজেই টাকার
লোভে তিনি মানুষ খুন করেন। করেনও আবার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। তিনি
দু-দুটি মানুষকে খুন করেন দ্রবীভূত বাতাস (Liquefied Air) দিয়ে।
এই দ্রবীভূত বাতাস মানুষের সংস্পর্শে এলে অত্যধিক ঠাণ্ডাতে (-১৯৬°
সেন্টিগ্রেড) সে মারা যাবে, কিন্তু পোস্ট- মর্টেম করে কিছু বোঝা
যাবে না। বিস্ময়কর পদ্ধতি, তাই না? ভাবলে অবাক হতে হয় যে তিনি
প্রথাগত ভাবে বিজ্ঞান পড়েননি, অথচ কী আশ্চর্য রকমের কৌতূহল ছিল
তাঁর অপরাধ বিজ্ঞানে।
অনুপ্রাণিত উত্তরসূরি :
যে কোন অগ্রপথিকই তাঁর পরবর্তী পথযাত্রীদের যাত্রা সুগম করে
দিয়ে যান। হেমেন্দ্রকুমারও ব্যতিক্রম নন। তাঁর রচনাবলীর প্রকাশক
এশিয়া পাবলিশিং এর কর্ণধার শ্রী সুখময় মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় “পথের
পাঁচালীর লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির
রচনায় হেমেন্দ্রকুমারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন”। ৭
১৯৩৭ সালে বিভূতিভূষণ যখন ‘চাঁদের পাহাড়’ দিয়ে কিশোর অ্যাডভেঞ্চার
কাহিনির যাত্রা শুরু করছেন, তার আগেই ‘আবার যখের ধন’ সন্ধানে বিমল
ও কুমার আফ্রিকা পাড়ি দিয়ে দিয়েছে, সঙ্গে বাঘা আর রামহরি।
তাঁর যাত্রা শুরুর কিছুদিন পরেই এসে গেলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে
উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, শ্রী ব্যোমকেশ বক্সী। তিনের দশকে ব্যোমকেশ
বক্সী যখন অজিতকে নিয়ে পথ চলা শুরু করেন, তিনি নিশ্চয়ই বিমল-কুমার
বা জয়ন্ত-মানিকের থেকে কিছুটা সাহস পেয়ে থাকবেন। যদিও এডগার এলেন
পো-র আমল থেকেই গোয়েন্দার একটি নির্বোধ বন্ধু থাকে, যে কাহিনি
লিপিবদ্ধ করে…. তা হলেও তার বঙ্গজ সংস্করণ হাতের কাছে থাকায় তাঁর
কাজ কিছুটা সুবিধেজনক হয়। শরদিন্দু ক্ষুধার্ত পাঠক ছিলেন, কাজেই
১৯২২ এ ধারাবাহিক ভাবে ‘মৌচাক’ পত্রিকাতে প্রকাশিত ‘যকের ধন’ নিশ্চয়ই
তাঁর চোখ এড়ায়নি। ব্যোমকেশেরও একটি রামহরি স্বরূপ পুরাতন ভৃত্য
ছিল, নাম পুঁটিরাম। বিমল-কুমার জয়ন্ত-মানিক চিরজীবন অবিবাহিত ছিল,
শরদিন্দু অবশ্য বিয়ে দিয়ে ব্যোমকেশকে ‘ফাঁসাতে’ চেয়েছিলেন।
তবে কিশোর কাহিনিতে তাঁর সত্যকার প্রভাব যদি কারো ওপর পড়ে থাকে,
আমার মতে তিনি সত্যজিৎ রায়। সত্যজিতের শঙ্কু কাহিনিতে দেখা যায়
খলনায়ক রূপে চিহ্নিত আছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও উচ্চমার্গের মানুষজন।
বিজ্ঞানী হলেই যে তাঁরা ধোয়া তুলসীপাতা হবেন, এ ধারণার অবসান আমরা
হেমেন্দ্রকুমারের হাতে দেখেছি এবং এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে।
সত্যজিৎও তাই বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না। সাধারণ ধারণার
বাইরে গিয়ে পণ্ডিত অথচ পথভ্রান্ত কুটিল অপরাধীদের পিছু ধাওয়া করতে
দেখা গেছে জয়ন্ত বা হেমন্তকে, এবং ফেলুদাকে বা প্রফেসর শঙ্কুকে।
এ ছাড়া বাচ্চাদের কাছে গল্প বলতে গিয়ে সত্যজিৎ ল্যাটিন, গ্রীক
ভাষার বহুল ব্যবহার করেছেন। কাকের ল্যাটিন নাম করভাস দিয়ে একটি
গল্পের নামকরণ হয়েছে। ফেলুদা সাংকেতিক ভাষায় ডায়রি লেখে গ্রীক
লিপির মাধ্যমে। তোপসেকে বুঝিয়ে দেয়, জলের মত করে, গ্রীক এলফাবেটে
যা কাপ্পা, ইংরেজিতে তা K. C না থাকার জন্য লিখতে হবে K দিয়ে।
Calcutta = καλκυττα। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যখন আমরা
‘বাদশাহি আংটি’ পড়ছি, তার আগেই পড়া হয়ে গেছে ‘যকের ধন’, ‘আবার
যকের ধন’, জয়ন্তর কীর্তি’ বা ‘অন্ধকারের বন্ধু’। কাজেই রসাস্বাদনে
কোন কষ্টই হয়নি | ছোট ‘রায়’ এর আগে বড় ‘রায়’ আমাদের তৈরী করে দিয়েছেন।
এমনকি প্রফেসর শঙ্কুর একটি কাহিনীতে গিয়ে মৃতদেহ দেখে জার্মান
চরিত্র জার্মান ভাষায় আর্তনাদ করে এবং সেটি সত্যজিৎ সেই ভাষাতেই
হুবহু লিখে দেন। ফেলুদার ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং একই সঙ্গে সে দৈহিক
বলেও বলীয়ান। বিভিন্ন বিষয়ে কৌতূহল তার, প্যারাসাইকোলজি, নিউমারোলজি,
সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল, বাংলা সাহিত্য! তার রসবোধও
সাংঘাতিক। সেই বর্ণাঢ্য যাত্রা দেখলে একজন পাঠক হিসেবে তাঁর রচয়িতাকে
হেমেন্দ্রকুমারের যোগ্য উত্তরসূরি বলতে দ্বিধা হয়না।
লেখাটি লিখতে গিয়ে আবার খুঁটিয়ে পড়লাম হেমেন্দ্রকুমারের কিছু
রচনা। সেই কৈশোরের মুগ্ধতা নিয়ে নয়, বেশ কিছুটা নির্মোহ দৃষ্টি
দিয়ে। এবং তুলনাও করে ফেললাম আগে পরে পড়ে ফেলা বেশ কিছু দেশজ ও
বাইরের গোয়েন্দা সাহিত্য বা অ্যাডভেঞ্চারের গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে।
আর নতুন করে আবার আবিষ্কার করে ফেললাম আর এক অজানা, শক্তিশালী
লেখককে। অজানা হয়তো পুরোপুরি নয়, কিন্তু তাঁর প্রাণের ঠাকুরের
গানের ভাষায়, “জানার মাঝে অজানারে, করেছি সন্ধান”। তাঁর বইয়ের
পাতায় পাতায় পড়ে আছে সুলিখিত কাহিনি আর সুপ্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার।
সেই ‘আনন্দেরই দান’ দেখে আমার ‘উঠেছে মন মেতে’। আমাদের কাজ খুব
সহজ, ইনটারনেটে ক্লিক করেই মিলিয়ে নিতে পারছিলাম তাঁর দেওয়া তথ্যাবলী।
ভাবছিলাম, প্রায় ১০০ বছর আগে, কী ভাবে দুর্জয় সাহসে ভর করে তিনি
এরকম সৃষ্টিশীলতা দেখিয়েছেন?
“বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার প্রাণ!”
তথ্যসূচী :
১ - http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/special-write-up-by-binod-ghoshal-on-hemendra-kumar-roy-in-patrika-1.278992
২–হেমেন্দ্রকুমার রচনা সংগ্রহ– ৩ – এশিয়া পাবলিশিং হাউস, তৃতীয়
প্রকাশ, মার্চ, ১৯৮৩ – পৃঃ – ৫-৬
৩–হেমেন্দ্রকুমার রচনা সংগ্রহ– ৪ – এশিয়া পাবলিশিং হাউস, তৃতীয়
প্রকাশ, মার্চ, ১৯৮৩ – পৃঃ – ৬
৪- https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/medicine/laureates/1912/
৫- http://www.rockefeller.edu/about/awards/nobel/acarrel#sidebar
৬ - http://www.encyclopedia.com/science/encyclopedias-almanacs-transcripts-and-maps/herschel-william-james
৭–হেমেন্দ্রকুমার রচনা সংগ্রহ– ৭ – এশিয়া পাবলিশিং হাউস, ১৯৮৫
– পৃঃ – ২
লেখক পরিচিতি -জন্ম
কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে।
১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন
ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর
বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি,
নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন
(সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।